মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩৬+৩৭

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩৬+৩৭
ফাবিয়াহ্ মমো

চাপা আর্তনাদে চিল্লিয়ে উঠলো মেহনূর। রুমের প্রতিটি দেয়াল যেনো সাক্ষী হিসেবে মৌন রইলো। অসহ্য ব্যথায় চোখ খিঁচে আছড়ে পরলো কান্নায়, সাথে-সাথেই মাথা নামিয়ে ফেললো বিছানার দিকে। পৈশাচিক আনন্দে হাসি ফুটলো কারোর, তবুও রক্তাক্ত হাতটা সে ছাড়লো না। রক্তে মাখামাখি হওয়া সাদা ব্যান্ডেজের হাতটা আরো তীব্রযোগে মুচড়ে ধরলো, মুচড়ে দিতেই ঠোঁট কুঁচকে দাঁত শক্ত করলো রজনী ইবনাত। ব্যথায় কুন্ঠিত হওয়া মেহনূর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে পারলো না, গলনালীর কাছে সব শব্দগুলো তার জট পাকিয়ে গেলো।

অবনত অবস্থায় চোখ কুঁচকেই ডানহাতটা দিয়ে চাঁদর খামচে ধরলো। মুচড়ে ধরার প্রবণতা যতো তিলতিল করে বাড়ছে, ততোই পাঁচ আঙ্গুলের মুষ্ঠিতে বিছানার চাদরটা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আড়চোখে তার হাতের দিকে তাকালো রজনী, ফিক করে আবারও প্রাপ্তিসূচকের হাসি দিলো। দৃষ্টিটা হাতের উপর স্থির রেখে মুচড়ে ধরা হাতটা অকস্মাৎ ছেড়ে দিলো। ছেড়ে দিতেই বিছানার উপর ধপ করে ব্যান্ডেজযুক্ত হাতটা পরে গেলো। সাদা ব্যান্ডেজটার রঙ পালটে লালবর্ণের রূপ নিয়েছে, শুকনো হাতটা যেনো কয়েক মিনিটের তাণ্ডবলীলায় তরতাজা রক্তে মেখে গেছে। রজনী নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো, মেহনূরের জন্য তার নিজের হাতটাও পরিষ্কার নেই। রক্তের অংশাবশেষ তার হাতকেও রাঙিয়ে দিয়েছে, সেটা দেখে মনে-মনে কিছুটা ঘৃণার উদ্রেক হলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দ্রুত হাতটা পরিষ্কার করার জন্য আশেপাশে তাকালো, কিন্তু মুছার জন্য কিছু না পেয়ে শেষমেশ মেহনূরের আচঁলটার দিকে চোখ আঁটকালো। মেহনূর তখনও বিছানায় মাথা নুইয়ে কাঁদছে, ব্যথায় জর্জরিত হাতটা যেভাবে ধপ করে ফেলেছিলো সেভাবেই পরে আছে। রজনী চুপচাপ মেহনূরের আচঁলটা টেনে হাত মুছতে নিলো, এই সুযোগে আবারও মেহনূরের দিকে আড়চোখে তাকালো রজনী। কোনোরূপ বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে হাত মুছতে-মুছতেই ব্যঙ্গতার কন্ঠে বললো ,

– তোমার গালটায় ঠাটিয়ে চড় দিলে ভালো হয়। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাদের চেহারাই হয় চড়-থাপ্পর খাওয়ার জন্য। তুমিও তাদের থেকে ব্যতিক্রম নও। তোমার সাথে শত্রুতা করার ইচ্ছা নেই। শত্রুতা করতেও যোগ্যতা থাকা লাগে, একটা সমান-সমান ব্যাপারও আছে, এই দুটোর একটাও তোমার মধ্যে নেই। আমি ভেবেছিলাম ইউ আর এ্যা স্ট্রং ওপোনেন্ট। এখন তোমার অবস্থা দেখে আশ্চর্য হবো নাকি হাসবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। মাহতিম তোমার মতো গণ্ডমূর্খ ধরে আনবে, সেটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।

মেহনূর মাথা নত করে রাখলো তখন, উঠানোর সাহস হলেও জোর পেলো না। মাহতিমের একটা কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো, ‘ তোমার শান্ত, চুপচাপ স্বভাবটা আমার ভালো লাগে। ‘ সহসা ব্যথা ভুলে চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, ঘেঁটে-ঘেঁটে সেই দিনটার কথা স্মরণ করতেই আবার চোখ আবার খুলে তাকালো। মাহতিম যদি গণ্ডমূর্খকে বিয়ে করে তাহলে এই মহিলার সমস্যা কি? সে কেনো মেহনূরের সাথে অমানুষের মতো আচরণ করছে? যেখানে বিয়ের পুরো ব্যাপারটাই মাহতিম নিজে দেখেছে, সেখানে এই মহিলার অবৈধ হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক ঠেকলো না। মেহনূর ঢোক গিলে একটু স্থির হওয়ার চেষ্টা করলো, ব্যথায় হাতটা অসাড় হয়ে আছে তার। নাড়াচাড়া করতে গেলেই মারাত্মক পীড়া দিচ্ছে। রজনী সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকলো না, যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো তখন। দরজার বাইরে পা দিতেই হঠাৎ কি যেনো ভেবে পা থামিয়ে ফেললো। মাথাটা পিছু ফিরিয়ে মেহনূরের বিপন্ন অবস্থা দেখে আরেকবার হাসার চেষ্টা করলো, সেই হাসিটা ভূতুড়ে কান্ডের মতো কিছুক্ষণ স্থায়ী থেকে এরপর গম্ভীরতায় আচ্ছন্ন হলো। তীব্র ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে মনে-মনে বলতে লাগলো,

– তোমার স্বামীকে তো শায়েস্তা করতে পারবো না। সে অধিকারও আমার নেই। কিন্তু সে হয়তো জানে না তার কলিজার উপর হাত লাগিয়ে কি কি কারুকাজ দেখাতে পারি। তোমার স্বামীকে কাদা-জল খাইয়ে ছাড়বো মেহনূর লক্ষ্মী। তোমার স্বামীকে কঠিনভাবে জব্দ করবো।
দাঁতে-দাঁত পিষে কটমট ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো রজনী। এরপর পা চালিয়ে হরদম গতিতে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। নিরুপায় মেহনূর ব্যথিত চোখ তুলে রজনীর যাওয়া দেখলো, মহিলার দাপট-চলন-অঙ্গীভঙ্গি সবই যেনো অন্য মাত্রায় প্রকাশ পাচ্ছে। শহরে এভাবে চলাফেরা করা মহিলাগুলো এতো সহজে দাপট দেখায় না, নেহায়েত এর পেছনে বিশাল ‘ কারণ ‘ লুকিয়ে আছে।

ফোনের দিকে প্রায় আটজোড়া চোখ উন্মুখ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের অবস্থা এমন, যেনো ফোনের মধ্যেই জান ঢুকে যাচ্ছে। চিন্তায় সবার মুখের অবস্থা বারোটা বেজে গেছে, কেউ স্বস্তিতে নিশ্বাস পযর্ন্ত নিতে পারছে না। নীতি উদ্বেগের যাতনায় রীতিমতো নখ কামড়াচ্ছে, দাঁত দিয়ে নখ কাটছে বারবার। তৌফ ডান হাতের তালুর সাথে বাঁহাতের তালুটা ক্রমাগত ঘষাঘষি করছে, সৌভিক হাতে ফোন নিয়ে স্ক্রিনের দিকে ব্যকুলদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাকিদের অবস্থাও একই। হঠাৎ নিরবতা পণ্ড করে ফোনের নোটিফিকেশন বেজে উঠল, ওমনেই হুড়মুড় করে উঠলো আটজনের দৃষ্টি। ধুকধুক-ধুকধুক করে হৃদপিন্ড লাফাতেই সৌভিক সবার মুখের দিকে একবার-একবার করে তাকিয়ে নিলো, জোরে দম নিয়ে সেটা শব্দ-সহকারে ছাড়তে-ছাড়তে নোটিফিকেশন অপশনে বৃদ্ধাঙ্গুল রাখলো।

সাথে-সাথে স্ক্রিনের রঙ পালটে হোয়াটসঅ্যাপের ব্যাকগ্রাউন্ডে ঢেকে গেলো, চোখের সামনে স্পষ্ট হলো ছোট্ট একটা ভয়েস টেক্সট। সৌভিক আবারও বুকভর্তি নিশ্বাস টেনে সেখানেও বৃদ্ধাঙ্গুল স্পর্শ করলো, আঙ্গুল উঠাতেই বাজতে লাগলো বাচ্চা কন্ঠের আতঙ্কিত সুর। প্রতিটি কথা শুনতে-শুনতেই বুকের পৃষ্ঠে ‘ ধ্বক-ধ্বক ‘ করে তীড়ের মতো কঠিন কিছু বিদ্ধ হলো, সৌভিক হাতের ফোন ফেলেই দৌড়! সৌভিকের পিছু-পিছু ধুপধাপ শব্দ করে দৌড় লাগালো সবাই। সৌভিক ছুটে গেলো মাহদির রুমের দিকে, বাকিদের মধ্য থেকে মেয়েদের দলটা ছাদের দিকে পা চালালো। অবশিষ্ট দুজন হতভম্বের মতো দু’দলের গতিপথ দেখে চিন্তিত হয়ে উঠলো, কোনদিকে পা চালাবে সেটা নিয়ে চিন্তা করতেই শেষমেশ মাহদির রুমের দিকে ছুট লাগালো। সৌভিক বন্ধ দরজায় ধাক্কায় মেরে একইগতিতে রুমের ভেতরে ঢুকলো, বিছানার কাছে আসতেই হতবাক দৃষ্টিতে থমকে গেলো।

বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ ঠেসে বিলাপ করছে মাহদি। দুহাতে বালিশটাকে শক্ত করে খামচে ধরেছে সে, বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজেই অস্ফুট সুরে আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে। সৌভিক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো, মাহদিকে টেনেটুনে বালিশ থেকে উঠিয়ে সোজা করে বসালো। ইতিমধ্যে মাহদির শিশুসুলভ বাচ্চা মুখটা কান্নায় লাল হয়ে গিয়েছে, চোখদুটো টলমল করছে, হিঁচকে কান্নায় ঠোঁট উলটে হাতের উলটোপিঠে অনবরত চোখ ডলছে সে।

সৌভিককে সামনে দেখেও কান্না থামাতে পারছিলো না মাহদি, ঠোঁট উলটে কেদেঁই যাচ্ছিলো তখন। সৌভিক প্যান্টের বাম পকেট থেকে রুমাল বের করে মাহদির মুখ মুছে দিতে লাগলো, চোখে ডলতে থাকা হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজের দিকে মুখটা ঘুরালো। পেছন থেকে হুরহুর করে সিয়াম ও তৌফ ঢুকলো, বিছানার দিকে নজর পরতেই চটপট করে বিছানায় এসে বসলো। সৌভিক চোখ মুছে দিতেই ঘটনাটা আবার শোনার জন্য শান্তভাবে তাগাদা দিলো। মাহদি চোখ-মুখ লাল করে তিনজনের দিকেই তাকাতে লাগলো, অথচ মুখ ভেদ করে অত্যাচারের দৃশ্যটা বর্ণনা করলো না। তৌফ, সিয়াম সৌভিকের মতোই তাড়া দিলো মাহদিকে, একে-একে তিনজনের মুখে অনুরোধ শুনে বিগলিত কন্ঠে বলতে লাগলো মাহদি,

– তোমাদের কথামতো সেখানে নজর রাখতে গিয়েছিলাম। সবকিছু ঠিকই ছিলো। মা যখন রুমে ছিলো তখনও সবকিছু ঠিক ছিলো। যেই মা কাজের উছিলায় রুম থেকে বেরিয়ে গেলো তখনই মামী বউয়ের হাতটা নিয়ে মনের সুখে মোচড়াতে লাগলো। সকালেই নীতি আপু বউয়ের হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে, সেই হাতে ইচ্ছে করে ব্যথা দিয়েছে মামী। তৌফ ভাইয়া, এখন তুমিই বলো মামী বউয়ের হাতে ওভাবে ব্যথা দিলো কেনো? খুব রক্ত পরছিলো তৌফ ভাইয়া। আমি ভয়ে কোনোমতে ভয়েস রের্কড করেছি, সেটাই হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে রুমে চলে এসেছি। আমি ওই রজনী মামীর সামনে যাবো না ভাইয়া। আমাকে ওই ডাইনী মহিলার কাছে পাঠিও না। আমি ভাইয়াকে সব বলে দিবো, আমি বিচার দিবো, ওই মহিলাকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। ভাইয়া ওই ডাইনীকে ছাড়বে না!
মাহদি তিরিক্ষি মেজাজে গজগজ করতে লাগলো, চোখ দিয়ে আর পানি পরলো না। চোখদুটো যেনো প্রতিশোধের শিখানলে দাউদাউ করে জ্বলছে, ওরা তিনজন কিচ্ছু বললো না। ভারী নিশ্বাসে দম ছাড়লো সবাই, মাহদির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তিনজন একে-অপরের মুখপানে উদ্বিগ্ন চেহারায় তাকালো। তৌফ কিছুক্ষণ নিরব থেকে গুমর কন্ঠে বললো,

– দেখছোস না এবার? আমি কি তোদের মিথ্যা বলছিলাম? এই মহিলা যে নিজের ভাতিজির প্রতিশোধটা ঠিকই তুলবো এই কথাটা কি ভুল বলছিলাম? আসতে-না-আসতেই দামড়ি বেডির পিনিক শুরু। একমাত্র মাহতিমের দোষে আজ মেহনূর ভুগতাছে! আর এইদিকে শা’লায় বাঘের কাছে হরিণ দিয়া ফিল্ড মা’রাইতে গেছে। মুখটা খারাপ করতে চাইছিলাম না, তাও খারাপ হইলো।
তৌফের রাগান্বিত মুখ দেখে মাহদি পিটপিট করে তাকালো। কপালটা সামান্য কুঁচকে ওদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– তোমরা কার কথা বলছো? ভাতিজিটা কে?
তৌফ প্রশ্নটা শুনতে দেরি, সঙ্গে-সঙ্গে ত্রস্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিতে গেলো, কিন্তু মাঝপথে তাড়াতাড়ি কথা ছিনিয়ে নিলো সিয়াম। আমতা-আমতা করে ‘ মানে, ওইযে মানে ‘ করতেই চটপট মিথ্যা সাজিয়ে বললো,

– রজনী মামী তো আগে থেকে খারাপ এটা তো তুই জানোস। মানে, মাহতিম যে উনার চুজ করা মেয়ে বিয়ে না করে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করেছে, এটা নিয়ে ক্ষোভ আরকি।
মাহদি এ কথা শুনে আরো ক্ষেপে গেলো। কপালটা কঠিনভাবে কুঁচকে বিছানায় তৎক্ষণাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
– আমার ভাই যাকে মন চায় তাকে বিয়ে করবে, এতে ওই মহিলার কি? আমরা কি ওর টাকায় চলি না ঘুরি? উলটো আমাদের বাবা ওই মহিলাকে হেল্প করেছিলো। উনাকে থাকার জন্য আমাদের বাড়িতে জায়গা দিয়েছিলো। সাহস কতো বড়, আমার ভাইয়ের পার্সনাল লাইফে ইন্ট্যরফ্যার করে! ভাই কাকে বিয়ে করবে, না-করবে এটা অবশ্যই তার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে না।

উত্তেজিত মাহদিকে দেখে শঙ্কায় দরজার দিকে তাকাতে লাগলো ওরা। না-জানি গলার স্বর রজনীর কান পযর্ন্ত চলে গেছে। যদি না যায় তবেই ভালো। ওরা দ্রুত মাহদির হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে ফেললো, সিয়াম চটাশ করে ওর মাথায় জোরেশোরে চাট্টি মারলো। ব্যাথায় ‘ উফ ‘ করতেই ঠোঁট গোল করে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো মাহদি, সিয়ামের দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– অসহ্য তো! আমাকে মারছো কেনো? আমি কি করেছি? তোমরা ওই মহিলাকে ভয় পাও? ওই ব’দ মহিলাকে ভয় পাও? সত্যি তোমাদের দিয়ে কিচ্ছু আশা করা যায় না। আমি ভাইয়াকে সব বলে দিবো! সব বলে দিবো। মামীকে যদি গুল না খাইয়েছি, আমিও মাহদি আনসারী না। আমার বউয়ের প্রতিটা চোখের পানির হিসাব নিবো, ভাইয়া আসুক। ভাইয়া ওই মহিলাকে ছাড়বে না।
তাড়াতাড়ি মাহদির মুখে হাত চাপা দিলো তৌফ। মাহদিকে আর বলতে না দিয়ে চিন্তিত সুরে বললো,

– চিল্লাস না কেচুটে কোথাকার! তোর ভাই এখন আমাদের সাথে নেই। ওই ব্যাটা যেখানে গেছে সেখান থেকে ভুলেও ওর হেড চিফ আসতে দিবে না। পাগলামো করিস না মাহদি। অফ থাক এখন।
মাহদি ছোটাছুটি করতে নিয়েছিলো কেবল, তৌফের দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে শুনে শান্ত হয়ে গেলো। মাহতিম যেখানে আছে সেখান থেকে আসলেই চট করে ফেরা যায় না। একবার সাইকেল থেকে পরে পা ভেঙ্গেছিলো মাহদির, পায়ের একটা জায়গায় তিনটে সেলাই লেগেছিলো রীতিমতো। মাহতিমকে পুরো ঘটনা জানানোর পরও সে আসতে পারেনি, কল করে নিজের ব্যর্থতার কথা জানিয়ে কল কেটেছিলো। প্রায় তিনটা মাস বিছানায় কাটিয়েছে তবুও বড় ভাইকে কাছে পায়নি। এরপর থেকেই মাহদি এটা ভালো করে জানে, বাড়িতে কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে তার ভাই সবার মতো ঝটপট আসতে পারবে না। কড়া নিয়মের মধ্যে যার জীবন বেধেঁ থাকে, নিয়ম ভেঙ্গে নিজের আত্মসর্বস্ব ক্ষুণ্ণ করে সে কখনো আসবেনা।

নীতি খুব সাবধানে ব্যান্ডেজের কাপড় পেঁচাতে লাগলো, কোনোক্রমেই যেনো ব্যথার উৎপাত সৃষ্টি না হয় সেদিকে সর্তক দৃষ্টি রাখলো। মেহনূরকে পেইন কিলার খাইয়ে নানা কথার জালে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখছে ফারিন। রজনীর বিষয়ে যেনো আগে থেকেই প্রশ্ন না করুক তার জন্য বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। মেহনূর ব্যাপারটা ঠিকই পরিষ্কার করে বুঝতে পারছে, ওরা কেউই চাচ্ছে না রজনীর বিষয়টা আলোকপাত করতে। কেমন যেনো মিইয়ে-মিইয়ে থাকছে ওরা। মেহনূরকে সবসময়ের মতো চুপচাপ দেখে নীতি চিকিৎসার বাক্সটা বক্স করে আলামারিতে রাখতে গেলো। দ্বার খুলে রাখতে-রাখতেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– ভাবী, তোমার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। মেয়েলি যতো স্বভাব থাকা উচিত সবটাই তোমার মধ্যে পরিপূর্ণভাবে আছে। কিন্তু একটা জিনিসের ভারি অভাব।
নীতি বাক্সটা জায়গা মতো রাখতেই কথার মাঝে থেমে গেলো। আলামারিটা ভালোভাবে বন্ধ করে এবার মেহনূরের দিকে তাকালো, সেখান থেকে সরে বিছানায় আসতে-আসতেই প্রীতি ও ফারিনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা ইশারা করলো। ইশারাটুকু দুজন কিভাবে বুঝলো সেটা অনুমান করতে পারলো না মেহনূর, চটপট ভঙ্গিতে বিছানা থেকে নেমে রুমের বাইরে চলে গেলো তারা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ঘটনাটা গভীরভাবে চিন্তা করবে, তখনই মেহনূরের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে একদম মুখোমুখি হয়ে বসলো নীতি। মেহনূরের কৌতুহল দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে বাকি কথাটুকু বলতে লাগলো,

– এই অভাবটা তুমি এখনও টের পাচ্ছো না। তুমি বয়সে ছোট হলেও আশাকরি তোমার বুদ্ধি যথেষ্ট অমায়িক ভাবে আছে। যতটুকুই আছে ততটুকু খাটিয়ে আমাকে শুধু একটা কথার জবাব দাও, তুমি যে অতিরিক্ত মাত্রায় চুপচাপ থাকো সেটা কি কোনো পুরুষের সহ্য হবে? তোমাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস করা হলে বেশিরভাগ সময়ই চুপ করে থাকো। কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেলে কিন্তু আমারও চরম রাগ লাগে। সেদিক দিয়ে ভাইয়া এখনো তোমার সাথে বিদ্রুপ আচরণ করেনি। ভাইয়া তোমার প্রতি যথেষ্ট কনসার্ন ভাবী। ফিউচারে কখনো যদি ভাইয়ার ক্যারেক্টার নিয়ে গুজব উঠে আশা করবো তুমি তাতে কান দিবে না। আমি ভাইয়ার সহোদর বোন না, কিন্তু ছোট থেকে এমনভাবেই মানুষ হয়েছি কোনোদিন বড় ভাইয়ের অভাব ফিল করিনি। ভাইয়ার যদি আপন কোনো বোন থাকতো, হয়তো এতোটাও আদর করতো না যতটা আমরা পেয়েছি। খারাপ লাগছে এখন, তোমার সাথে বেশিদিন স্পেন্ড করতে পারছি না। দু’ঘন্টা পরেই আমার আর প্রীতির ফ্লাইট। টিকিটটাও ভাইয়া এ্যাজেন্সীতে বলে বুক করে দিয়েছে, আমার যেতে হবে ভাবী।

নীতির দিকে তাকিয়ে চুপ থাকতে পারলো না মেহনূর। নীতিকে অপ্রত্যাশিত ভাবে চমকে গিয়ে জাপটে ধরলো দুহাতে। নীতি হা করে পরিস্থিতির দোলাচলে আশ্চর্য হয়ে গেছে, মেহনূর কখনো জাপটে ধরতে পারে এটা কল্পনার দৃশ্যপটে ভাবাও যেনো মুশকিল। মেহনূর জাপটে ধযে চোখ বন্ধ করে নিচু সুরে বলতে লাগলো,

– আপনি আরো কিছুদিন থাকলে খুশী হতাম। আপনাদের আড্ডায় যুক্ত থাকতে পারাটাও আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। আমি কখনো মানুষের মাঝে থাকতে পারিনি, আড্ডায় কখনো কেউ হাত ধরে টানেনি, কেউ বলেনি ‘ তুমি আমাদের সাথে থাকো।’ আপনি থেকে গেলে খুব ভালো হতো। কেনো জানিনা, আমার খুব খারাপ লাগছে। সবাই এক-এক করে চলে যাচ্ছে। এই বাড়িটা আপনাদের ছাড়া শূণ্য লাগবে আপু।
মেহনূরের কথায় আলতো করে হেসে দিলো নীতি। সেও মেহনূরকে দুহাতে স্নেহের ডোরে আগলে ধরলো। মাথায় একটা হাত বুলিয়ে দিতেই স্বহাস্য সুরে বললো,

– হুট করে যদি ফ্যাস্টিভ্যালের ইভেন্টটা না হতো, তাহলে আমি সত্যিই থেকে যেতাম। আমিতো আগেও বলেছি তোমার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। তুমি মন খারাপ কোরো না ভাবী। আমি জক্কি সামাল দিয়ে আবার বিডিতে আসবো।

ঠিক দুপুরের মধ্যেই লাগেজ রেডি করে নিচে নামলো নীতি-প্রীতি। জনে-জনে সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে যেয়ে উঠলো। একই গাড়িতে চড়ে বসলো সিয়াম। নীতি-প্রীতিকে এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে যাবে একটু। পরশুদিন একইভাবে সৌভিক ও তৌফ নিজের কর্মক্ষেত্রে চলে যাবে। বাড়িতে থাকবে শুধু সামিক ও সাবির, এর মধ্যে ফারিন চলে যাবে হোস্টেলের জায়গায়, মাহদি আপাতত বাসা থেকে এক পা-ও নড়বে না। যদি তাকে স্কুলে পাঠানোর কথা তুলে তাহলে বরফ খেয়ে ঠাণ্ডা বাধিয়ে বাসায় থেকে যাবে। রজনী নামক ডাইনীর কাছে তার বউকে ফেলে যাবে না। রজনী সেদিনের ঘটনার পর হুট করেই ভালো সাজতে শুরু করলো, মেহনূরের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো ঠিকই, কিন্তু কোনো ধরনের ক্ষতি করতো তার।

মাহদির সর্তক দৃষ্টি শুধু রজনীর ক্রিয়াকলাপের উপর আঁটকে থাকে। চুম্বকের মতো রজনীর পিছু-পিছু সারা বাড়ি ঘুরতে থাকে, তার বিশ্বাস রজনী একা পেলেই মেহনূরকে আবার ঘায়েল করার চেষ্টা করবে। তাছাড়া মাহদি যে গোয়েন্দার মতো মস্তিষ্ক নিয়ে এই বয়সেই পিছু লেগেছে সেটাও রজনীর কাছে ধরা খাবে না। দিনের-পর-দিন এমন করেই যেতে থাকলো, জমজমাট বাড়িটার মানুষ হিসেবে থেকো গেলো কেবল পাঁচ জন। সবাই নিজেদের দীর্ঘকালীন ছুটি কাটিয়ে ব্যস্ত জীবনের দিকে ছুটে গিয়েছে। অপরদিকে বাড়ির মানুষজন স্বাভাবিক মেজাজে তাদের দিন গুজরানে ব্যস্ত হয়েছে।

দিনপন্ঞ্জিকার দিন হিসেবে প্রায় আটটি দিন পেরিয়ে গেলো। চোখের পলকে চলে দিলো একটি নিরব সপ্তাহ। ঋতু পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রকৃতি এখন শ্রাবণের মায়ারূপকে আলিঙ্গন করেছে। গ্রীষ্মের তপ্ততাকে রুখে দেওয়ার জন্য বর্ষণের ঢল নেমেছে সর্বত্র। নীলচে আকাশটা আকস্মিকভাবে পালটে যায় এখন। সূর্যকে ঢেকে দিতে আসে তাণ্ডবকারী কালোমেঘ। মেঘে-মেঘে ব্যাপক ঘর্ষণে সৃষ্টি হয় বজ্রপাতের হাহাকার। দালানকোঠা যেনো কেঁপে যেনো প্রতিটি বাজের হুঙ্কারে। এমনই রোদনধারার দিনে প্রকৃতির বিষণ্ণতায় উপন্যাসের শক্ত মোলটে ডুবে ছিলো মেহনূর। শাড়িটাও আজ কায়দা করে পরা। বাঙালি সাজে শাড়ি পরেছে সে, শাড়িটার রঙও ভারি সুন্দর। গাঢ় নীলের জামদানী শাড়ি, সঙ্গে নীলরঙের ব্লাউজ।

চুলগুলো কিশোরীর মতো বেণী করা, বেণীর কিছু-কিছু জায়গায় মাহদির কারসাজিতে গুঁজে আছে বকুল ফুল। মুঠোভর্তি বকুল ফুল কুড়িয়ে মেহনূরের চুলে হাসি-হাসি মনে গুঁজে দিয়েছে মাহদি। ব্লাউজটা যেনো লম্বায় খাটো হয়েছে একটু, শাড়িটাও যেনো ভুলবশত নিচে নামিয়ে পরেছে। খুঁতখুঁতে মনটা বারবার কেমন যেনো অনুভব করছে, আবার অলসতার কাছে হেরে বসে শাড়ি ঠিক করতে ইচ্ছে করছে না। বিছানায় বসে জানালার সাথে ঘেঁষাটে দিয়ে বই পড়ছে মেহনূর, হাতে সুন্দর একখানা রোমান্টিক উপন্যাস। বইটা অজ্ঞাতনামায় কুরিয়ার করেছে কেউ, কিন্তু মেহনূরের সুপ্ত মন জানে কাজটার ইতিহাস। নিছক কেউ বই পাঠাতে যাবে না, দাদাভাই বই পাঠালেও সেটা মেহনূর জানতে পারতো।

এক কার্টুন রাজ্য পাঠানোর ক্ষমতা যেনো একটা মানুষের আছে, সেই মানুষটা কতো দূরে আছে সে হিসেবে জানা নেই। আকাশটা কঠিনভাবে অন্ধকার করেছে আজ, গুড়ুম-গুড়ুম করে মেঘও ডাকছে। বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গটা অকস্মাৎ করে মেঘ ফাটিয়ে জোরে একটা শব্দ করে, এরপর তলিয়ে যায় অজানায়। উপন্যাসের শব্দমালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের লীলা দেখায় মগ্ন ছিলো মেহনূর, কেনো জানি খুব করে ইচ্ছে করছে তার একটু কন্ঠ শোনার জন্য। মানুষটা বুকভরা আক্ষেপ, প্রচণ্ড হতাশা, ব্যর্থ একটা চাওয়া নিয়ে চলে গিয়েছে, একদিনও খোঁজ নেয়নি সে। ওই অসভ্য খ্যাত মানুষটা কিন্তু সত্যি-সত্যিই তার কথা পালন করেছে, ভুলেও মেহনূরের প্রতি তীব্র আসক্তিটা প্রকাশ করেনি।

আটটা দিন পেরিয়ে যাচ্ছে তন্মধ্যে একদিনও খোঁজ নেয়নি। আনমনে আকাশে তাকিয়ে হেসে দিলো মেহনূর। কোলের বইটা বন্ধ করে বুকমার্ক গুঁজে দিলো, সেটা রেখে দিতেই হাত বাড়ালো বালিশের দিকে। বালিশের তলা থেকে টেনে বের করলো বাদামী রঙের নান্দনিক ডায়েরী। ডায়েরীর মোলাটের সাথেই যুক্ত থাকে সুন্দর একটা বলপয়েন্ট। মেহনূর ডায়েরীটা খুলে কলমটা ঠিক করে নিলো, ফকফকা একটা পৃষ্ঠা খুলতেই কোলে একটা বালিশ টেনে তার উপর ডায়েরী রাখলো। কলমের নীলচে কালিতে বাংলাক্ষর সাজিয়ে মনের অব্যক্ত কথা লিখতে লাগলো। বৃষ্টি নামার পূর্বমূহুর্তে জোরে বাতাস ছাড়লো, মেহনূরের কানের কাছে গুঁজা চুলগুলো উড়তে লাগলো তখন। নিবিষ্ট মনে লিখে যাচ্ছিলো মেহনূর, ধ্যান নেই কোথাও।
১২ মে ২০১৯,
শ্রাবণ মাস।

আকাশে প্রচুর মেঘ জমেছে। কোথাও কোনো আলো নেই। বিদঘুটে অন্ধকারে প্রকৃতি ঢেকে আছে, গুড়-গুড় শব্দ হচ্ছে খুব। রুমের আলোটা এখনো জ্বালাইনি, ভেবেছি জ্বালাবো না। এই রুমটা অন্ধকারই ভালো, এতে আলো থাকার প্রয়োজন দেখি না। আপনার শয়নকক্ষে চলে এসেছি, আপনার বিছানায় থাকছি এখন। ছাদের রুমটায় সারাদিন কাটাই, শুধু রাতটুকুর জন্য আপনার রুমটাই সম্বল। আট দিন যাবৎ আপনাকে দেখি না। কতদূরে পাড়ি জমিয়েছেন তাও জানি না। এখন কেউ আমায় জ্বালাতন করেনা, আপনি যেভাবে কথার জালে লজ্জায় মারতেন সেরকম কেউ নেই। আপনাকে অসভ্য বলতে গেলেও এখন হাসি। দিনশেষে আপনি তো আমার সাথেই অসভ্যতামি করেন। আপনি যে এতোবড় উচ্চপদের মানুষ তা আমি অনুমানও করতে পারিনি।

আপনার হাসিসুলভ আচরণটা সবসময় আপনাকে প্রাণোচ্ছল বানিয়ে রেখেছে, কখনো বুঝতেই দেয়নি আপনার মধ্যে সামরিক কর্মকাণ্ডের নীতিনিষ্ঠতা আছে। আপনি কোন্ বাহিনীর মানুষ সেটা জানতে পারিনি। তবে, আপনার পড়ার টেবিলে এমন কিছু ছবি দেখেছি সেটা হয়তো আপনি নিজেই পেন্সিল দিয়ে এঁকেছেন। ছবিটার অর্থ কিছুই বুঝিনি, কিন্তু নর্থ-সাউথ-ইষ্ট-ওয়েষ্ট এগুলোর প্রথম অক্ষরগুলো লেখা ছিলো। আপনাকে খুব কষ্ট দিয়েছি আনসারী সাহেব। আমাকে ক্ষমা করার জন্য আপনি ফিরে আসুন। আপনার অনুপস্থিতি আমাকে বিষিয়ে তুলছে, এইযে দেখুন ডায়েরীর পাতায় কতো সুন্দর করে মনের কথাগুলো বলতে পারছি, অথচ আপনি সামনে থাকলে কিছুই বলতে পারি না। তখন আপনি আমাকে আবেগহীন ভাবেন, আরো হয়তো ভাবেন আমি বোধহয় বেশিই চাপা। হ্যাঁ, আমি চাপা। একটা সত্যি কি জানেন? নিরবে যখন একাকী থাকি, তখন দুনিয়ার সবচেয়ে চন্ঞ্চল মেয়েটা কেবল আমি। একাকীত্বের দুনিয়ায় আগন্তুকের মতো আপনি আমার মনের আঙিনায় ঠাঁই নিয়েছেন। আপনার হাসিমাখা অধরদুটো….

আচমকা জোর গলায় ডেকে উঠলো মারজা। একাধারে ‘ মেহনূর মা ‘ বলে ডেকেই যাচ্ছে। শ্বাশুড়ির ডাকে প্রচণ্ড কৌতুহল হলো মেহনূর, দ্রুত ডায়েরী-কলম ওভাবে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো পৃথিবার বুকে। বৈরি আবহাওয়ায় বাতাসের তেজে খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির বড়-বড় ফোঁটা ঢুকতে লাগলো। মূহুর্ত্তের ভেতর ডায়েরীর পৃষ্ঠা ভিজে গিয়ে নীলচে কালি সর্বত্র সরিয়ে পরলো। বাতাসের আরেকদফা হিংস্রতায় ডায়েরীর উপর বৃষ্টির ছাঁট লাগলো আবার। এবার বিগড়ে গেলো অক্ষরগুলোর লেখা। প্রকৃতি যেনো পৈশাচিক হাসিতে মেতে উঠেছে, ডায়েরীর উপর ক্রিয়া ফলিয়ে প্রচণ্ড খুশীতে হিংস্র হয়ে উঠেছে। ঠাস-ঠাস ভূমি কাঁপিয়ে চর্তুদিক বজ্রাহত হলো, প্রকৃতির এমন ভয়াবহ রূপ যেনো অশনীসংকেতের বার্তা দিচ্ছে। ইশারা দিচ্ছে অশুভ কিছুর আগমন। আবার দালান কেঁপে উঠলো, সাথে-সাথে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেলো আনসারীর বাড়ি।

আবহাত্তয়ার পৈশাচিক চিৎকারে বারবার দালান শুদ্ধো কেঁপে উঠছে। কানে হাত চাপা দেওয়ার মতো বিকট শব্দ হচ্ছে। একটু পরপর হুঙ্কার দিচ্ছে জোরালেভাবে, তীব্র সুরে, ভয়ঙ্কর কাঁপুনিতে। প্রকৃতির এমন বিধ্বংসী রূপ দেখে মারজার মনটা কেনো যেনো কু ডেকে উঠলো। তিনি কোনোভাবেই শান্ত থাকতে পারলেন না, এরই মধ্যে ছুটে এসেছে মেহনূর। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতির জন্য শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে, দৌঁড়ে আসাতে সামান্য হাঁপাচ্ছে সে। বিছানায় জবুথবু হয়ে বসেছিলো মারজা, দরজায় হাঁপাতে থাকা মেহনূরের ক্লান্ত মুখ দেখে মায়াসূচকে হাসি দিলেন। মাথাটা একটুখানি ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে দুলিয়ে ভেতরে আসার ইশারা দিলেন, মেহনূর ঠোঁট প্রসার করে হাসি দিতেই ধীরপায়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো। মারজা মুগ্ধ হয়ে তার বউমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আপাদমস্তক পুলকিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখলেন। মেহনূরের একটা হাত টেনে নিয়ে তার পাশে বসালেন মারজা।

শ্বাশুড়ির সৌহে কিছুক্ষণ কাটানোর জন্য মেহনূর পা তুলে মারজার মতোই বিছানায় আসন করে বসলো। মারজার চোখের দিকে তাকাতেই তাঁকে প্রচণ্ড বিমর্ষ এবং বিষণ্ণ দেখালো, কেনো এই বিষণ্ণতা সেটা বুঝার জন্য গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। অবচেতন মন কেনো জানি বলছে, কিছু তো অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। সেটার ফল যে কোনোভাবে সুমিষ্ট, শুভ হবে না সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত। মারজা শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন,

– তোকে অসময়ে বিরক্ত করছি মা। একা থাকি তো, কথা বলার মানুষ না পেলে খারাপ লাগে। তুই কিছু মনে করিসনি তো? রাগ করেছিস?
দ্রুত শ্বাশুড়িকে বিচিত্র চিন্তা থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য তাঁর হাতদুটো ধরলো মেহনূর। রেশমী চুড়ির রিনরিন শব্দটা মৃদ্যুতালে হতেই মারজার হাতদুটো মেহনূরের মুঠোয় ভরসা পেলো। মেহনূর সদাসর্বদার মতোই নিচু গলায় শান্তভঙ্গিতে বললো,
– আমাকে এসব বলে কষ্ট দিবেন না মা। আপনার উপর কেনো রাগ করবো? আমারই ভুল হয়েছে। আপনি যে একা আছেন সেটা ভুলে গিয়ে উনার রুমে বসে ছিলাম। আমাকে মাফ করুন।
মারজা সঙ্গে-সঙ্গে জিভ কেটে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন। একটা হাত মুক্ত করে মেহনূরের দিকে মারের ভঙ্গিতে শূন্যে উঠালেন। খানিকটা রাগ দেখিয়ে বললেন,

– খালি ‘ মাফ করুন, মাফ করুন ‘ বলতে থাকিস। ভুল হলেও বলিস ‘ মাফ করুন ‘, নাহলেও বলিস ‘ মাফ করুন ‘। বাবামশাইকে এ ব্যাপারে বিচার লাগাবো? কানটা মুচড়ে দেবো?
এমন প্রসঙ্গ শোনার পর মেহনূরের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে হো-হো করে রুম কাঁপিয়ে হেসে দিতো, হাসতে-হাসতে লুটোপুটি খেতেও কার্পণ্য করতো না। কিন্তু এসবের কিছুই না করে মেহনূর কিয়দংশ পরিমাণে হেসে দিয়ে আবারও নিচু গলায় বললো,

– দাদাভাইকে বলতে না হবে মা। আমি খেয়াল রাখবো।
মারজা তবুও আদুরে ভঙ্গির রাগটা কায়েম রাখলেন, চোখের উপরে থাকা ভ্রুঁদুটো কুঁচকে রেখেই গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু রীতিমতো তিনি ব্যর্থ। মেহনূর ফের হেসে দেওয়ার চিন্তা করতেই আকস্মিকভাবে এমন অবস্থা হলো সে আর হাসতে পারলো না। ওইসময় দারুণ শব্দ করে রূহ কাঁপিয়ে প্রচণ্ড হুঙ্কারে বাজ পরলো। মেহনূর অকস্মাৎ এমন শব্দ শুনে এতোটাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে যায়, সে দিশেহারা পথিকের মতো ভয় পেয়ে মারজার দেহটায় তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পরলো। মারজার কাধে থুতনি রেখে চোখদুটো খিঁচুনি দিয়ে বন্ধ করলো। আর কোনো হুঁশজ্ঞান নেই মেহনূরের, ভয়ের চোটে শুধু মারজাকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। পিঠে হাতের স্পর্শ লাগিয়ে শান্ত হতে বললেন মারজা। ‘ কিচ্ছু হয়নি, এটুকু শব্দে কেউ ভয় পায়? ‘ বলেই তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। ভয়ের মাত্রাটা একটু কেটে গেলে বুক ধড়ফড় করা অবস্থায় চোখ খুললো মেহনূর, মারজাকে ছেড়ে দিতে-দিতেই জানালার বাইরে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– এমন ঝড়ো অবস্থা দেখলে ভয় পাই মা। এমন অবস্থা দেখলে শুধু সমুদ্রের উত্থাল-পাত্থাল অবস্থার কথা মনে হয়। দাদাভাই সমুদ্র দেখতে গিয়ে যেই ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন এখনো সেই গল্প তিনি শুনান। গা ছমছম করে উঠে ওই গল্প শুনলে। আমি এমন দিনে একা থাকতে পারিনা। সবসময় বুবু বা মা আমার কাছে থাকতো।
মেহনূরের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি লক্ষ্য করে মারজাও জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলেন। আকাশের ফেঁটে যাওয়া দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বললেন,
– সমুদ্রের কথা যদি জানতে চাস, সেটা তোর স্বামী এলেই শুনে নিস। এসব ব্যাপারে ও-ই ভালো খবর দিতে পারবে।
ইঙ্গিতটা মাহতিমের দিকে নির্দেশ করলে মারজার দিকে চকিত ভঙ্গিতে তাকালো মেহনূর। মারজা তখনও আকাশের দিকে মন ভোলানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মেহনূর বিষয়টা পরিষ্কার ভাবে বোঝার জন্য কৌতুহল গলায় প্রশ্ন করলো,

– আমি আপনার কথা বুঝিনি মা। ঝড়ের সাথে উনার কি সম্পর্ক?
মারজা একই অবস্থাতে স্থির রইলেন, জানালা থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে হাসিসূচকে বললেন,
– ঝড়ের কাছে হার মানলে সাক্ষাৎ মৃতুর দর্শন। একটু যদি এদিক-সেদিক করে তাহলে মনে কর্ মাহতিম আর ফিরবে না। তবে এখনো এই কাজে আছে কিনা জানিনা। মাহতিম সবসময় বলে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ যতোটা সহজে মোকাবিলা করা যায়, মানুষের ধূর্ত চাল মোকাবিলা ততটাই কঠিন। প্রকৃতির হালচাল দ্রুত ধরা যায়, মানুষেরটা ধরা যায় না।

মারজা হুট করে চাপা ব্যথার মতো শ্বাস ছাড়লেন। জানালার বাইরে দৃষ্টিলব্ধ চোখদুটো চট করে বন্ধ করলেন। মেহনূর আনমনে আকাশের দিকে তাকালো। বড় বড় চোখদুটো অজানা ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। পুরো মুখটাই স্বহাস্য রূপ পালটে মলিন অবস্থা ধারণ করেছে। বুকের ভেতরটা টাইফুনের মতো হুলস্থুল করছে, অসহ্য অপরাধে মুষড়ে আসছে সরল-কোমল মনটা। মাহতিম তো ওর জন্যই গাড়ি ঘুরিয়ে এসেছিলো। হাতে সময় নেই জেনেও সে বিদায় জানাতে দেরি করেনি। মাহদির ছোট্ট একটা কল শুনেই মেহনূরকে বিদায় জানাতে ছুটে আসে মাহতিম। সেই মানুষটা মেহনূরের কঠিন-কঠিন কথা শুনে নিশ্চয়ই অভিমান করেছে, রেগে গেছে। ক্ষোভে হয়তো মনের মধ্যেই বিক্ষোভ করে বেড়াচ্ছে, সে প্রকাশ করছে না কিছুই। হঠাৎ ভাবনার রাজ্যে ছেদন করে হাসি দিয়ে বললেন মারজা,

– আগে এই বাড়িটা এমন খাঁ খাঁ করতো না। বাপ-বেটা দুজন মিলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। দুটো মানুষ দুশো মানুষের সমান হৈ-হুল্লোড় করতো। ওর বাবা ছুটি কাটাতে এলেই মাহতিম আর স্থির থাকতে পারতো না, সোজা বাবার কাধে চড়ে ফূর্তি করতো। আমাকে কতোভাবে যে জ্বালিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই রে মা। একবার কলেজে থাকাকালীন কি করেছে শোন। মাহতিম তখন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফে পড়তো। বাসা থেকে ওর কলেজ দূর বলে ওর বাবা কর্তৃপক্ষকে বলে-টলে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। ঈদের ছুটি পেয়ে ও বাড়িতে আসে, এসেই বাপের সাথে এক সপ্তাহ বন্দুকের টিপ শিখলো। ওইযে শিখলো, মনে কর্ আমাকে ছাড়েনা।

আপেল,পেয়ারা, তরমুজ যেটাই পায় সেটাই আমার মাথায় রেখে টার্গেট করে। আমিতো ভয়ে শেষ! এদিকে ওর বাপও কম ইতর ছিলো না। আগেরদিন রাতে কি নিয়ে যেনো মন খারাপ করেছিলাম সেটার শোধ তুলতে গিয়ে মাহতিমকে আরো লেলিয়ে দেয়। এইযে আমি বুঝাচ্ছি, ‘ থাম বাবা, আমি মরে যাবো, তোর নিশানা ভুল হলেই আমাকে আর পাবি না। ‘ এদিকে কে শোনে কার কথা? বদমাইশটা সত্যি-সত্যিই আমার দিকে ওর বাবার বন্দুক তাক করলো, ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে নিশান ঠিক করলো। আমিও আজীবনের জন্য তওবা করে একনিশ্বাসে ‘ লা ইলাহা ইলাল্লাহু, আল্লাহ মাফ করো। ‘ বলে ফেললাম।

এরপর বিশ্বাস কর্, আমার কলিজাটা স্বাভাবিক হতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগেছে, এমন ভয়ঙ্কর শব্দ! বাড়ির সবক’টা চাকর কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খিঁচে আছে। আরেকটু যদি অস্থির হতাম তাহলে হার্ট এ্যাটাক করে সেদিনই ম’রতাম। এরপর থেকে ওর বাবার মুখে একটা কথা খুব গর্ব করে বলতে শুনতাম। তার ছেলে নাকি তার সাথে ভালোই পাল্লা দিতে পারে। পুরো ট্রেনিং সেন্টারে নাকি ওর মতো চতুর বন্দুকবাজ কেউ ছিলো না। মাথার খুলি নাকি এমনভাবেই উড়াতে পারতো, বাস্তবে নাকি সেটাও এক বীভৎস দৃশ্য। সেটা হাতে গুণে দশের মধ্যে একজন করতে পারে। এখনো ওর টিপ নিয়ে ওর বাবার কলিগরা প্রশংসা করে। আজ যদি ওর বাবা বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো জানতে পারতো আজ সেই হাসিখুশি ছেলেটা খুব উচ্চপদে চলে গেছে। সে দেখেও যেতে পারেনি মেহনূর, আমার জীবনে এটা সবচেয়ে বড় আফসোস। যেই ছেলেকে উনি কাছেপিঠে মানুষ করলেন, ছেলে আজ বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে, অথচ বাপ তার একবিন্দু দেখতে পারলোনা। জানিস….

মারজার কথা আর শুনতে পেলো না মেহনূর। জানালার দিকে মুখ করে ক্রমাগত বলেই যাচ্ছিলেন মারজা, তিনি আর বউয়ের দিকে খেয়াল দিতে পারলেন না। ঠোঁটদুটো ফাঁক করে নিশ্বাস ছাড়ছিলো মেহনূর, ওই অবস্থাতেই চোখদুটো বন্ধ করে মাথা নিচু করলো। মাহতিমের কথা শুনলে এখন প্রচণ্ড অস্থির লাগে, মন আনচান হয়, মানসিক অবস্থা প্রকটরূপে বেচইন হয়ে উঠে। কোলে রাখা হাতটা আচঁলের কাপড়টুকু কঠিনভাবে খামচে ধরলো, ওমনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে একটার-পর-একটা স্মৃতির পৃষ্ঠা উলটাতে লাগলো মেহনূর। কালো শার্টপ্যান্ট পরা সাহেবী বেশভূষার লোক, যার মেজাজটা অস্বাভাবিক খারাপ ছিলো, বাড়িতে অতিথি হিসেবে পরিবার নিয়ে ঢুকলো, সবাই তাদের নিয়ে ব্যস্ত হলো, সুরাইয়া তাকে নিয়ে কুমতলব ঠাওরাতে লাগলো, গোসল শেষে পেটের কাছে কুচিগুলো ঠিক করছিলো মেহনূর, আয়নায় তাকাতেই কোনো পুরুষের সামনে ওমন অপ্রত্যাশিত দর্শন, ভয়ে-আতঙ্কে জ্বরে ভুগে সে, পরদিন সকালে দাদাভাইয়ের লাইব্রেরীতে আবারও লোমহর্ষক ভঙ্গিতে সাক্ষাৎ হয়, শেল্ফের সাথে ধাক্কা খেয়ে কোমরে সূচালো তারকাটা বিদ্ধ হয়।

গাঢ় করে ক্ষত হয় জায়গাটা, গলগল করে রক্ত পরতে থাকে। সেই কাটা জায়গায় ওই মানুষটার প্রথম স্পর্শ টের পায় মেহনূর। সুদেহী মানুষটা নিজের বাহুদ্বয়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো কোলে তুলে, একদিন রাতে কিসের শোধবোধ করার জন্য তার হাতটা টেনে গাঢ় করে চুমু খায়। জঙ্গলে ছ্যাঙ্গাজাতীয় কীট থেকে রক্ষা, শেফালী মেজোমার অত্যাচার থেকে বাঁচানো, সুরাইয়াকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে মোকাবিলা করা, সবই যেনো তার অনন্য ঘটনার অংশ। মেহনূর চোখ বন্ধ করেই রাখলো, পাঁচ আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে কোলে থাকা আচঁলটা আরো দলা পাকাতে থাকলো, স্মৃতির পৃষ্ঠা যতো সামনের দিকে উলটাচ্ছে বুকের ভেতরটা অশান্ত ঝড়ের মতো ধড়াস-ধড়াস করে উঠছে। ভাগ্য যেনো টেনে-হিঁচড়ে বারবার তার সামনে দাঁড় করাতে ব্যস্ত।

তরুণের কাছ থেকে ধাওয়া খেয়ে আবারও সেই মানুষটার মুখোমুখি! ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত-ভঙ্গুর দেহটা আবারও তার বলপূর্ণ হাতদুটোর মাঝে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। কেনো এই স্বস্তি, কেনো এমন শঙ্কাহীন, মন যেনো এসবের উত্তর বানাতে ত্রস্ত। এবার রেসোর্টের নিরব পরিবেশে শুধু মুখোমুখি নয়, অদৃশ্য কোনো বন্ধন যেনো সংষর্ষ লাগাতে ব্যস্ত। সেই পড়ন্ত বিকেলটা সন্ধ্যার সাজে পসরা সাজিয়েছিলো, আবারও কালো পোশাকে তার আর্কষণীয় ব্যক্তিত্বটা চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। রোমন্থন করা মূহুর্তগুলো তার ঠোঁটের হাসি দিয়ে সিক্ত করছিলো তখন, গিটারের তারে আঙ্গুলের অগ্রভাগ সুরের মূর্ছনায় ডুবে ছিলো সন্ধ্যাটা। বাতাসে তালে-তালে কোমল ধ্বনি উঠেছিলো, ‘ তাকে অল্প কাছে ডাকছি, আর আগলে-আগলে রাখছি, অল্পেই হারাচ্ছি আবার। ‘ তার চোখের হাসি-হাসি দৃষ্টি জুড়ে শুধু মেহনূর ছিলো, ঠোঁটের প্রাণখোলা হাসিটা তার সান্নিধ্য পেয়ে আশেপাশের কোনো বাধ মানেনি। গিটারের তারে আঙ্গুল কাটলেও মেহনূরের উপর থেকে দৃষ্টি সরায়নি। সেই রাতে যখন জঘন্য ঘটনা…. আর ভাবতে পারলো না মেহনূর। বন্ধ চোখের দু’কোল থেকে তরল ফোঁটা গড়াতে লাগলো, খামচে ধরা হাতের উপর টপটপ করে পরতে থাকলো, মারজার দিকে দৃষ্টি তুলে ভেজা কন্ঠে বলতে ইচ্ছে করলো,
– মা আমার খারাপ লাগছে। আমার খুব খারাপ লাগছে।

ইচ্ছাটা কাগজের মোয়ার মতো গুটিয়ে গেলো। মারজাকে একটুও মুখ ফুটে বলতে পারলো না। মারজা তখনও অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে অতীতে দিনগুলো বলেই যাচ্ছেন, মেহনূরের দিকে অজান্তেই বেখেয়ালী হয়ে গেছেন। মেহনূর তাড়াতাড়ি চোখের সিক্ততা ঢাকার জন্য মাথা আরো নিচু করলো, দলা পাকানো আচঁলটা চোখে তুলে দ্রুতগতিতে চোখজোড়ার অবস্থা শুষ্ক করলো। আকাশের কারসাজি যেনো থামার ইচ্ছাতে ছিলো না, হুঙ্কারে দ্বিগ্বিদিক ফেটে পরছিলো তখন। এমনই সময় খবর এলো বাড়িতে অতিথি এসেছে। কে এসেছে সেটা জানার জন্য মারজা প্রশ্ন ছুড়লে, তড়িৎগতিতে উত্তর পায় রজনী ভাবীর ভাতিজি। চাপা আক্রোশে মারজার স্বাচ্ছন্দ্য মুখটা আকাশের মতোই কালো হয়ে যায়, হাসিটা কোথায় মিলিয়ে যায় সেটা খোঁজা মুশকিল।

মারজার দেহটা বিছানা থেকে নামাতে ইচ্ছে করছিলো না, তবুও মনের উপর বেহিসেব ভর জুগিয়ে স্বাগত জানাতে নামলেন । মেহনূরকে কি উত্তর দিবেন এটা নিয়ে আপাতত মাথাব্যথা নেই। মেহনূর অন্যান্য মেয়েদের মতো পরিস্থিতির মারপ্যাঁচ ধরতে পারবেনা। একদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি মেহনূরকে পরিচয় করানোর জন্য সেদিকে নিয়ে গেলেন। মেহনূরও আগত মেহমানের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে শ্বাশুড়ির সাথেই পা বাড়ালো। প্রশস্ত ড্রয়িংরুমের আভিজাত্য সোফার দিকে দৃষ্টি আঁটকালো মেহনূরের, শ্বাশুড়ির পিছু-পিছু পা বাড়িয়ে এগুতে থাকলে ‘ ভাতিজি ‘ বলা মেয়েটার উপর আশ্চর্য হয়ে তাকালো। মেয়েটার পড়নে এ কি ধরনের পোশাক? শার্ট রঙের টপ পরেছে মেয়েটা। টপসের কাধদুটো নেই, হাতদুটোও খালি। বুক থেকে পেট পযর্ন্ত ঢাকা ওইটুকু পোশাক কি করে শালীন পোশাক হতে পারে? টপের উপর পাতলা ফিনফিন ধরনের কটি পরেছে।

ওই কটি পোশাকটা পরা যা, না পরাও তা। কালো রঙের জিন্স পরা, দামী ব্রান্ডের হিল বুট দেখা যাচ্ছে। পায়ের উপর পা তুলে বাঁ পা-টা ক্রমাগত নাচাচ্ছে। মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে ফোন টেপা বাদ দিয়ে মুখ তুলে তাকালো। মারজার দিকে চোখ পরতেই দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, অনেকটা আমোদিত ভাবসাব দেখিয়ে মারজার সাথে কুশল বিনিময় করলো। মারজা এবার পরিচয় করাতে মেয়েটার হাত ধরে মেহনূরের মুখোমুখি করালো। মেহনূর সহজ চাহনিতে মেয়েটার দিকে তাকালেও মেয়েটার চাহনিতে বিষভরা ক্রোধ ছিলো। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে মারজা প্রস্তুত গলায় বললেন,

– মেহনূর এই দ্যাখ, ও হচ্ছে রজনী ভাবীর একমাত্র ভাতিজি। আগে তো আমাদের বাসাতেই থাকতো, এখন অবশ্য বিদেশ থাকে। ওর বাবা খুব ভালো মানুষ, একদিন উনার সাথেও দেখা করাবো।
মারজার পরিচয় পর্ব শেষ হতেই মেয়েটা নিজ উদ্যোগে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত এগিয়ে দিলো, কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো,
– কেমন আছো মেহনূর? আমি অনামিকা। ছোট করে অনা ডাকলেই হবে। তুমিতো দেখছি আমায় জুনিয়র। নেভার মাইন্ড, কিসে পড়াশোনা করছো এবার?
মেহনূর ছোট্ট একটা ঢোক গিলে ডানহাতটা বাড়িয়ে বললো,
– মাধ্যমিক।

অবাকে হা করে তাকালো অনামিকা। মেহনূরের হাতটা আর হ্যান্ডেশেকের জন্য ধরলো না। আশ্চর্য মুখভঙ্গি নিয়ে চট করে মারজার দিকে তাকালো, বিষ্ময়াভূত দৃষ্টি দিয়ে তাকাতেই মেহনূরের দিকে তর্জনী তাক করে বললো,
– ওকে বিয়ে করেছে? সত্যি? আমি কি কানে ঠিক শুনছি মারু আন্টি?
মারজা এমন প্রশ্ন শুনে বিপাকে পরলেন। অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে একবার অনামিকার দিকে তাকালেন, আরেকবার থতমত দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকালেন। মেহনূর ইতিমধ্যে তার দিকে প্রশ্নসূচকে তাকিয়ে আছে। মারজা চটজলদি পরিস্থিতিটা অনুকূল করার জন্য প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললেন,
– মাহতিমের ব্যক্তিগত পছন্দের উপর আমি কখনো বাধা দেইনি। তাছাড়া ও আমার দূর সম্পর্কীয় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের নাতনী। এবার যখন ওদের বাড়িতে দীর্ঘদিনের ছুটিতে গেলাম, তখন ওকে ভালো লাগে। তাই ওদের দুছনকে সেখানেই বিয়ে করিয়ে দেই।

অনামিকা উত্তর শুনে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে আঙ্গুল নামিয়ে নিলো। মারজা সামনে না থাকলে আসলেই মেহনূরকে কঠিন কিছু বলে ফেলতো! মিথ্যা অভিনয় চলমান রেখে দুজনের সাথেই ভালো ব্যবহার করলো অনামিকা। এর মধ্যে মারজার গুরুত্বপূর্ণ কল আসলে মারজা সেদিকে ছুটে যায়, সুযোগ বুঝে মেহনূরের কাছে ফলের জুস খাওয়ার বায়না করে সে। মেহনূর অতিথি আপ্যয়নের জন্য রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকলে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে অনামিকা। চোখদুটো দুষ্কর্ম করার জন্য যেনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। জিন্সের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে, কিছু একটা টাইপ করতেই কানে ঠেকালো আধা-খাওয়া আপেলের ছোট্ট ছাপবিশিষ্ট দামী ফোন। কলের বিপরীতে কথা শুরু করতেই ঠোঁটের হাসিটুকু পালটে গিয়ে ক্রুদ্ধ আভা ফুটলো। গলায় তেজ মিশিয়ে চাপাসুরে বললো,

– গেঁয়ো মেয়ে এটা। এটাকে টাইট দেওয়া আহামরি কিছু না। আমি জানিনা রজনী ফুপি কেনো এটাকে আরামে থাকতে দিচ্ছে। সে কি আমার প্রতিটা ম্যাটার ভুলে গেছে? উহু, আমিতো চুপ করে থাকার জন্য এখানে আসিনি। কক্ষনোই না। এই মেয়ের চামড়ায় যদি এসিড ঘঁষে দিতে হয়, তাও আমি করবো। আমার চামড়ার কথা কিন্তু ভুলিনি। যেই দাগ আমার শরীরে বসিয়েছিলো আমি এর চেয়ে তিনগুণ ডাবল চিহ্ন করে ছাড়বো। মাহতিমের দেওয়া প্রত্যেকটা পেইন আমি হিসেব করে রেখেছি, এখন শুধু দাবার গুটির মতো চাল দিতে থাকবো। আমি মেহনূরকে ছাড়বো না।

বিলাসবহুল কোয়ার্টারের সামনে বিশেষ গাড়িটা থামলো। গাড়িটার পেছনে আরো তিনটি সিকিউরিটি গাড়ি থেমেছে। সিকিউরিটি গাড়ি থেকে আর্মিদের বেশভূষার দু’দল বেরিয়ে এলো, বিশেষ গাড়িটার কাছে দাঁড়াতেই গাড়ির ড্রাইভার সিটের দরজাটা ভেতর থেকে খুললো। ড্রাইভার লোকটা বেরিয়ে পেছনের সিটের দরজা খুলতেই সিকিউরিটি দল থেকে ক’জন সদস্য কোয়ার্টারের প্রবেশপথে এগিয়ে গেলো। সেখানেও একইভাবে কিছু নিরাপত্তাকর্মী পাহারা দিচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের হাতে লম্বা-লম্বা বন্দুক। সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
– উনি ভেতরে আছেন? আপনারা খবর পাঠান ল্যাফটেন্যান্ট জাফর হাবিব এসেছেন।
সিকিউরিটি টিমের একজন উত্তর দিলো,
– জ্বী আছেন। আপনারা ভেতরে যেতে পারেন। আপনাদের আসার ব্যাপারে আগেই আমাদের কাছে ইনর্ফম করা হয়েছে।

প্রত্যুত্তরে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ালো, অপেক্ষা না করে জাফর হাবিব তার দলবল নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করলেন। উনার পিছু গোটা সিকিউরিটি টিম আসতে থাকলে উনি হাতের ইশারায় একজনকে সামনে আসতে বললেন। পিছন থেকে একজন সেই ইশারা পেয়ে চট করে জাফর হাবিবের ডানপাশে এসে হাঁটতে লাগলো। জাফর হাবিব যথেষ্ট রসিকপ্রিয় মানুষ, মাঝে-মাঝে কথা বলার সঙ্গী হিসেবে মাইনুদ্দীনকে পছন্দ করে। লিফটে ঢুকে থার্ড নাম্বারে ক্লিক করতেই মাইনুদ্দীনের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
– বুঝলে মাইনু, লাইফে আজীবন লেগে থাকতে হয়। লাইফ যে কোন্ পথে টান মারবে কেউ আন্দাজও করতে পারবেনা। এই ডিপার্টমেন্টে কখনো পা দিয়েছো?
মাইনুদ্দীন একটু ইতস্তত করতে লাগলো। হাতে যদি বন্দুক না থাকতো তাহলে মাথাটা একটু চুলকে নিতো। তবুও ইতস্তত গলায় সে বললো,

– না, স্যার।
লিফট উপরে উঠতে-উঠতেই জাফর হাবিব প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললেন,
– না জানার তো কথা না। নৌবাহিনীর বিশেষ সদস্যরা এখানে থাকছে। এই ডিপার্টমেন্টে অবশ্য তোমাকে নিয়ে আসিনি।

ছোট্ট একটা শব্দ করে সিলভারের দু’দ্বার দুদিকে সরে গেলো, ওমনেই চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোর দেখতে পেলেন জাফর হাবিব। লিফট থেকে বেরিয়ে স্মৃতির পাতা নাড়াতে-নাড়াতে আসল ফ্ল্যাটের কাছে চলে এলেন তিনি। সিকিউরিটি টিমকে বাইরে থাকতে বলে দিলেন তখন। হালকা অফ হোয়াইট দরজাটা নতুনের মতো চকচক করছে, বন্ধ দরজার এক জায়গায় কালো ক্যাপিটাল লেটারে লিখা, ‘ M. ANSARI ‘ . জাফর হাবিব হাত উঠিয়ে ডানদিকে থাকা কলিংবেলটার বোতামে তর্জনী চাপ দিলেন, সাথে-সাথেই বেলের শব্দ হয়ে থেমে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোলগাল নব্ এবং কিছু সিকিউরিটি সিস্টেম সম্পণ্ণ হয়ে দরজা খুললো, পাশে থাকা মাইনুউদ্দীন আশ্চর্যভাবে এসব কীর্তিকাণ্ড দেখছে। তখনই ভেতর থেকে কাটকাট গলার আওয়াজ এলো,
– কাম ইন। আনসারী হেয়ার।

আজ মস্ত আকাশের উপর বৃষ্টির গুরুভার পরেছে। সেই গুরুভারটা গুরুত্বের সাথেই থেমে-থেমে পালন করছে কালোমেঘের আকাশ। বৃষ্টির প্রবল ধারায় শহরের আনাচে-কানাচে করুণ-বেহাল দশা এখন, পা ফেলতেও মানুষ দ্বিধাবোধ করছে আজ। বৃষ্টি তখনও থেমে যায়নি, কালো মেঘে পুন্ঞ্জীভূত হয়ে বারবার আকাশ ফেটে স্ফূলিঙ্গ দেখা দিচ্ছিলো। মেহনূর ফ্রিজ থেকে দুটো কমলা বের করে সমানতালে ছিলে যাচ্ছে, তার অন্যমনষ্ক দৃষ্টি এখন জানালার বাইরে আকাশের দিকে স্থির। মান-অভিমানের গোলকধাঁধায় আজ মেহনূর যথেষ্ট ক্লান্ত অনুভব করছে, এই ক্লান্তি সমস্ত দেহে বিষাদের মতো আঘাত করছে।

আঘাতে নিরবে-নিরবে ক্ষত হচ্ছে ভেতরের ছোট্ট মনটা। মেহনূর কমলার গা থেকে শেষ খোসাটা ছিলে নিতেই গায়ের সাথে ঘেঁষে দাঁড়ালো কেউ। অন্য কারোর উপস্থিতি টের পেতেই খানিকটা চমকে উঠে সৎবিৎ ফিরে পাশে তাকালো মেহনূর, ডানে তাকিয়ে দেখলো মাহদি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বৃত্তের মতো গোল কমলাটা তার দু’হাতের মুঠোয় দু’ভাগ হয়ে আছে, সেখান থেকে কমলার প্রতিটি অংশ আলাদা করে কাঁচের পিরিচ সাজাচ্ছে মাহদি। এটুকুনি দেবরের কার্যকলাপ দেখে আশ্চর্য হতে গিয়ে অকস্মাৎ হেসে দিলো মেহনূর। মাহদির পিঠে হালকা মতোন চাপড় মারতে গিয়ে সেটা আর করলো না, হাতটা মাহদির মাথায় রেখে পরমস্নেহে চুলের ফাঁকে-ফাঁকে বুলিয়ে দিতে থাকলো। মাহদি এমন ভঙ্গিতে কাজ করতে লাগলো, যেনো সে এসবে পুরোনো দিনের দক্ষ কারিগর। মাহদির চুলের চামড়ায় আঙ্গুলের ডগা দিয়ে বুলিয়ে দিতেই প্রসন্ন হাসিতে বললো মেহনূর,

– তুমি এখানে কেনো পুচকে দেবর? তোমার কি মোবাইলে খেলা নেই? আমাকে সাহায্য করতে হবে না। তোমার কিছু লাগলে বলো আমি করে দেই।
মাহদি বড়দের মতো গলাটা একটু খুকখুক করে কেশে নিলো, কথা বলার জন্য গলাটা পরিষ্কার করতেই মেহনূরের হাত থেকে অন্য কমলাটা নিতে-নিতে বললো,
– আমি আমার বউকে সাহায্য করছি। বউকে টুকটাক কাজে হেল্প করাই যায়। তাছাড়া অনা-মনার কাছ থেকে দূরে থাকো, পারলে তোমার প্রিসিয়াস আইটেমগুলো লুকিয়ে রাখো। ঘর থেকে কিছু উধাও হলে সেই জিনিস আর ফিরে পাবেনা।

মাহদির কথায় ভ্রুঁদুটো কুঁচকে কপালে অসংখ্য ভাঁজ পরলো। বাড়ির নতুন অতিথি নিয়ে কেমন ইশারা দিলো? অনামিকা কি চোর নাকি চোরাই স্বভাবের অন্য কেউ? মেহনূরের মুখটা আড়চোখে দেখতে পেলো মাহদি। সাথে-সাথে চোখ বুজে নিজেকে অনেকগুলো গা’লি দিলো, পরিস্থিতিটা তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করার জন্য তাড়াহুড়ো করে অন্য প্রসঙ্গ টেনে বললো,
– কমলা সব সাজিয়ে দিয়েছি। তুমি কি এগুলোর জুস করবে? করলে তুমি সাবু খালাকে বলে দাও। খালা চমৎকার করে জুস বানিয়ে দিবে।

মেহনূর মৃদ্যু করে হেসে দিয়ে মাথাটা একটু নিচে ঝুঁকালো। মাহদির মাথায় ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে তাকে চলে যেতে বললো। মাহদি আরো কিছুক্ষণ থাকতে চাইলো কিন্তু মেহনূরের কথা শুনে আর সেখানে থাকলো না। মেহনূর আধুনিক যুগের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে জানেনা, গ্রামের সহজাত জিনিস দিয়েই শরবত বানানো শিখেছে। বড় মার কাছ থেকে শরবত বানানোর যেসব কৌশল রপ্ত করেছিলো, সেগুলো একে-একে ফলাতে থাকলে রান্নাঘরের দরজার আড়াল থেকে সবকিছু দেখতে লাগলো মাহদি। চোখদুটো সর্বক্ষণ মেহনূরের উপরেই আঁটকে আছে, বাড়িতে যেদুটো ডা’ইনীর আগমন হয়েছে, তাদের আসাটা এই মূহুর্তে ঘোর অমঙ্গল। দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ হাতে হেঁচকা টান খায় মাহদি, ভয়ের চোটে গলা ফাটিয়ে ‘ আম্মু ‘ বলে চিৎকার দিবে সেটারও সুযোগ আর রইলো না।

মুখের উপর কঠিনভাবে হাত চেপে ধরলো কেউ, তারহাতদুটো পিছমোড়া করে শক্তভাবে ধরে আছে, চোখ খুলে ঠিকঠাক মতো অজ্ঞাত ব্যক্তিকে দেখবে সেটারও কোনো ব্যবস্থা নেই। বুকটা ঢিপঢিপ করে কাঁপতেই সেকেন্ডের ভেতর ঘেমে উঠলো মাহদি। হাত-মুখ-চোখ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিলেও নাকের ইন্দ্রিয়শক্তি তখনও সচলভাবে কাজ করছে। নাকে যে মিষ্টি পারফিউমের সুভাস পাচ্ছে সেটা ঠিকমতো আন্দাজ করতেই পুরো দেহ যেনো শিরশির করে কেঁপে উঠলো। তীব্র আতঙ্কে কিচ্ছু বললো না মাহদি, শুধু চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলো। মাহদিকে স্বল্প সময়ের ভেতর টেনে এনে রুমের দরজার সাথে ঠেসে ধরলো, ছোট্ট মুখটার দু’গালে বাঘের থাবার মতো শক্ত করে চেপে ধরলে ঠোঁট ধীরে-ধীরে উঁচুতে উঠে গেলো। মাহদির দিকে কড়া দৃষ্টি ছুঁড়ে হুঙ্কার দিয়ে বললো,

– চোখ খোল্।
কন্ঠের তীব্রতায় আরেকবার শিউরে উঠলো মাহদি। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই চোখভর্তি পানিগুলো টলমল করে উঠলো ওর। মনে-মনে যে ব্যক্তিকে নিয়ে ছক কষেছিলো, সেটা পুরোপুরি খাপে-খাপ মিলে গেছে। গালটা যেভাবে চেপে ধরেছে মাহদি গোঙানো সুরেও আওয়াজ করতে পারছিলো না, সেই কড়া চাহনিটা ওর মুখের কাছে এসে আবারও নিচু সুরে বললো,

– তুই ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলি? কোনো মিথ্যা বলতে যাবিনা। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে নজরদারি করবি সেটা ভুলে যা মাহদির বাচ্চা। তোর ভাই যে নেই, এইবার তোকে, আর তোর বউকে কে রক্ষা করবে? নীতিরাও নেই, সৌভিকরাও বাড়ি ফিরেছে, তোর বোকামার্কা মা থাকার চেয়ে না-থাকাও ভালো। সে আমার কোনোকিছুই করতে পারবে না। তুই সাবধানে থাকিস। তোর ভাই আমার সাথে যা করেছিলো, সেটা যদি একটুখানি জায়গামতো পৌঁছে দেই তাহলে ওই গেঁয়োর অবস্থা কেমন হবে সেটা ভালোমতো চিন্তা করে নিস। আমাকে রাগাতে যাস না। তোর ভাইকে বলিস অনামিকা এখানে শান্তিমতো থাকতে এসেছে। আমার সাথে যদি তামাশা করার চেষ্টা করে, ক্ষতিটা ওর কলিজার উপর টেনে-খুবলে করবো।

টলমলানি অশ্রুগুলো এক-এক করে গাল বেয়ে নামতে লাগলো। মাহদি কাঠ-কাঠ ভঙ্গিতে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখ থেকে যে অশ্রুগুলো পরছিলো তাও অবিরামভাবে পরছে, তাতে কোনোপ্রকার হেলদোল নেই। অনামিকা গালটা ছেড়ে দিতেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ছেড়ে রাখা সিল্কি চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি করলো। মাহদি শুষ্ক-রুক্ষ গলায় ঢোক গিলে কাঁপা-কাঁপা সুরে বললো,

– যা-যাই?
অনামিকা হাসিহীন মুখে দাম্ভিকতার ভঙ্গিতে মাথাটা ‘ হ্যাঁ ‘ করে নাড়ালো। ডানহাতের তর্জনী তুলে বেরিয়ে যাওয়ার ইশারা করলো। মাহদি ভয়ে-ভয়ে চোখ নত করে নব্ ঘুরিয়ে দরজা খুললো, বাইরে পা দিতেই অনামিকার কন্ঠটা ফের বেজে উঠলো,
– তোর মা’কে কিছু বলতে যাস না মাহদি। এবার কিন্তু টর্চার তোর উপর করবো না, তোর ‘ বউ, বউ ‘ করা মেহনূরের উপর চালাতে থাকবো। মুখটা একদম স্কচট্যাপের মতো বন্ধ করে রাখবি, নাহলে এটার পরিণাম মোটেও ভালো হবেনা।
দরজার নব্ ধরে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে মাহদি। রাগে শরীরের প্রতিটি কোষ যেনো বিক্ষোভ করে উঠছে, আজ যদি তার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে মাহতিমকে ডেকে এনে একেবারে ওর শিরায়-শিরায় শিক্ষা ঢুকিয়ে ছাড়তো। মাহদি মাথাটা পিছু না ঘুরিয়ে ছোট্ট করে বললো,

– ঠিক আছে, বলবো না।
নব্ ছেড়ে দরজার বাইরে পা বাড়ালো মাহদি, হাতের উলটোপিঠে চোখদুটো ভালো করে মুছলো। নিজের রুমের দিকে যেতে-যেতেই অনেক কিছু ভাবতে লাগলো। তার একটু আগের ভয়ার্ত মুখটা এখন যেনো আকাশের মতো কঠোর হয়ে আছে। যে চোখে ভয় গ্রাস করেছিলো সেটা আকস্মিকভাবে বদলে গেছে, বুকের ভেতর তরতাজা রক্তগুলো রাগে-ক্ষোভে উত্থাল করছে এখন, কিছুতেই শান্ত হতে চাচ্ছেনা ক্ষুদ্ধ-বিক্ষুদ্ধ মন।

সাদা পরিষ্কার ডিভানে বসে আছেন জাফর হাবিব। পায়ের উপর পা তুলে রেখেছে সে। ঠিক সামনের টেবিলে পেটমোটা ধরনের দামী একটা বোতল সাজানো আছে। তিনি বোতলটার দিকে তীক্ষ্মদৃষ্টি ছুঁড়ে দেখতে লাগলেন, ইংরেজি এ্যালফাবেটে গভীর মনোযোগ ঢেলে দিয়ে হঠাৎ মনে-মনে উচ্চারণ করে উঠলেন, ‘ বিদেশী মাল, উফ! ‘। ভদ্রলোকের মুখোমুখি সোফায় সাধারণ কায়দায় বসে আছে মাহতিম। জাফর হাবিবের তৃষ্ণার্ত মুখটা দেখতে পেয়ে ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি দেখা দিলো। টেবিলটার দিকে হাত বাড়িয়ে পেটমোটা বোতলটা হাতে নিলো, প্রোফেশনাল স্টাইলে ছিপি খুলতেই জাফর হাবিব চোখ ছোট করে বললেন,

– ইজ দিজ ট্রু ইয়াং বয়? তুমি কি ওগুলো চেখে দেখো? সবই তো দেখছি এ্যাব্রড কান্ট্রির হাইপ মাল।
ঠোঁটের হাসিটা আর বাঁকাভাবে রইলো না, এবার যেনো চওড়া করে হেসে দিলো। ছ্যাৎ করে শব্দ হতেই বোতল থেকে ফেনা মতো কিছু পানীয় মাহতৈমের হাত গড়িয়ে পরতে থাকলো, এরপর কাঁচের গ্লাসের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ঢকঢক করে সামান্য পানীয় ঢেলে নিলো। আধাভর্তি গ্লাসটার নিচে থাকা চিকন দন্ডটা দু’আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে ধরলো, এরপর তরল পানীয় দ্বারা পরিপূর্ণ গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রসন্ন হাসিতে বললো,
– আপনাদের জন্য কালেকশন রেখেছি স্যার, এসব আমার জন্য না।

মাহতিমের হাত থেকে সেও একই ভাবে দু’আঙ্গুলের ফাঁকে নিলো গ্লাসটা। ঠোঁটের কাছে গ্লাস ঠেকিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিলো, তৃপ্তিতে চোখমুখ বুজে এলো তার। মাহতিম এটা ভালো করেই জানে, তার থেকে উর্ধ্বতন পদের মানুষদের কিভাবে হ্যান্ডেল করা লাগে। মাহতিম একপেশে হাসি দিয়ে নিজেও পায়ের উপর পা তুলে নিলো, সোফায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসতেই বাঁ কনুইটা সোফার হ্যান্ডেলে ঠেকিয়ে দিলো। জাফর হাবিব তৃপ্তিজনক সুখ থেকে বিচ্যূত হয়ে আবার চোখ খুলে তাকালেন, মাহতিমকে চতুর চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি দিয়ে বললেন,

– শুনলাম নতুন বিয়ে করেছো, কথাটা কি সত্যি না গুজব? তোমার বিয়ে নিয়ে যেই গুজব রটে মাই গড! বিশ্বাস করতে গিয়েও ভড়কে যাই।
মাহতিম ওইভঙ্গিতেই জবাব দিলো,
– না, এবার সত্যি শুনেছেন। বিয়ে করেছি।
জাফর হাবিব কেবল আরেক চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে এমন কথা শুনে বিষ্ময় দৃষ্টিতে বললেন,
– কে সেই ভাগ্যবতী মেয়ে? আমি কি তাহলে ফাইনালি এম. আনসারীর বিয়ের সংবাদ শুনলাম? আমিতো ভেবেছি চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞা করে বসে আছো।

মাহতিম ‘ চিরকুমার ‘ শব্দটা শুনেই ফিক করে হেসে দিলো। জাফর হাবিবের দিকে সদ্য খোলা বোতলটা আবার এগিয়ে দিতেই গ্লাস ভর্তি করে দিলো। পুনরায় আগের মতো বসলে পরিষ্কার হাসিতে বললো মাহতিম,
– বিয়ে করেছি এটা সত্য। ভাগ্যবতী না বলে ভাগ্যবান বলুন মেজর। ভাগ্যটা বলতে গেলে আমার। এমন সময়ে আমার লাইফে কেউ চলে আসবে এটা ধারণা করতে পারিনি। তবে এখন যেহেতু এসে গেছে, সেক্ষেত্রে আমার ভাগ্য বলা চলে।
মেজর জাফর হাবিব হাসতে-হাসতে হঠাৎ মলিন হয়ে গেলেন। হাতের গ্লাসটা ঠোঁটে না ঠেকিয়ে টেবিলে রেখে দিলেন। চোখদুটো কিছুক্ষণ বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলেন, জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় বলতে লাগলেন,

– তোমার বাবার হাসি-হাসি মুখটা দেখতে পাচ্ছি মাহতিম। আমার দিকে সে হাসছে। আমি যদি এখন ওর দিকে এগিয়ে যাই তাহলে ও আমাকে জাপটে ধরে নাচবে। কি অমায়িক হাসি, এতো সুন্দর হাসিটা ওই শেষ সাক্ষাতে দেখেছিলাম। চোখের সামনে মৃত্যু দেখেও আমার দিকে হাসছিলো, হাত নাড়িয়ে টাটা দিতেই চোখের পলকে মিলিয়ে গেলো।
বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। নিশ্বাসটা আচানক আঁটকে গিয়ে কোথাও ছুড়ির মতো ঢুকে গেলো। বন্ধ চোখজোড়া কুঁচকে নিতেই ঠোঁট খুলে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো, চোখের কুঁচকে রাখা ভাবটা ধীরেসুস্থে স্বাভাবিক হয়ে পরিষ্কার দৃষ্টিতে তাকালো। জাফর হাবিব চোখের উপর রুমাল চেপে ধরে আছেন। ভদ্রলোক যে সহকারী বন্ধুর মৃ’ত্যুযন্ত্র’নায় ব্যথা অনুভব করছেন, সেটা পরিদৃষ্ট। মাহতিম গলা খাকাড়ি দিয়ে একটু কেশে নিলো, ইঙ্গিতে জাফর হাবিব শান্ত হয়ে আবার প্রাণোচ্ছল হাসিতে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। হাসিটুকু ধরে রেখে গ্লাস তুলে বললেন,

– নাম কি? কোথাকার মেয়ে? শহরের তো?
মাহতিম সহজ ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– ম্যাডামের নাম মেহনূর। আমার মায়ের দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয়, গ্রামে ওদের বসতবাড়ি আছে।
জাফর হাবিব উত্তর শুনে পানসে মুখে তাকালেন, কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বললেন,
– মারজা ভাবীর ওই রিলেটিভ নাতো? তুমি কাকে বিয়ে করেছো?
মাহতিম সকল কৌতুহল ধূলিসাৎ করে গোড়া করে বলতে লাগলো,

– এবার যে অনেক দিনের ছুটি নিয়েছি তাতো আপনি জানেন। ছুটিটা মূলত ওদের বাড়িতে গিয়েই নেওয়া হয়েছে। মায়ের ফোর্স দেখে ডিপার্টমেন্ট থেকে প্ল্যান মোতাবেক চার দিনের ছুটি নিয়েছিলাম, মা বায়না ধরলো তার আত্মীয়ের বাড়ি যাবে। না করতে পারিনি। তার সঙ্গেই আমার ভাইবোনদের নিয়ে গেলাম। সেখানে সবকিছু নরমাল দেখা গেলেও কোনোকিছু এ্যাবনরমালের চেয়ে কম লাগেনি। আমি ছাড়া বিষয়টা কেউ ধরতে পারেনি, ইভেন মা’ও না। আমি যখন গেলাম সেদিন থেকেই ওই বাড়িতে অনেক কিছু টের পেয়েছি, সবচেয়ে বড় রহস্য হলো ওই প্রবীণ বয়সী হান্নান শেখ। যিনি কিনা মেহনূরের আপন দাদা। আপনি কি আমার পয়েন্ট ধরতে পেরেছেন মেজর?
মেজর হাবিব চোখ-কান সজাগ করে তাকালেন। এতোক্ষণ পর তার সবল মনটা মাহতিমের কথায় অন্যকিছুর আভাস টের পাচ্ছে। বিশাল বড় প্রশ্নটা ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি প্রশ্নটা না করে পারলেন না,

– তুমি কি মেহনূরকে অন্য উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছো মাহতিম? তোমার ভেতরে কি চলছে খুলে বলোতো।
মাহতিম তৎক্ষণাৎ নিজের মতামতটা পরিষ্কার করে বললো,
– ওকে বিয়ে করার পেছনে কোনো মোটিভ রাখিনি মেজর। ও আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। ওকে সম্পূর্ণরূপে মন থেকে চেয়েছি। ওই একমাত্র ব্যক্তি যার সামনে আমার মস্তিষ্ক কখনো কাজ করেনা।
মেজর আশ্চর্য হয়ে চোখদুটো বড় বড় করলেন, আশ্চর্যের সীমাটা এমনভাবে গলা উঁচিয়ে ফলালেন সেটা মাইনুদ্দীনের কান অবধি পৌঁছে গেলো। মাইনুদ্দীন বিষ্ময়ে চমকে গেলেও মাহতিম তখন মেজরের অবস্থা দেখে হাসি দিয়ে ফেললো। মেজর হাবিব তখন আহাম্মক হয়েই বলতে লাগলেন,

– কি তাজ্জব কারবার দেখি! এতো বছরেও যা শুনতে পারলাম না সেটা নাকি এখন শুনি। মাহতিম তোমার ওয়াইফ আসলেই সাইলেন্ট কি’লার। মেবি সে নিজেও জানেনা কাকে সে গুরুতর ভাবে ঘায়ে’ল করেছে।
মাহতিম হাসিটুকু কমাতে-কমাতে একপর্যায়ে গম্ভীর হয়ে গেলো। পিঠটা সোফায় ঠেকিয়ে কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

– ওর বয়সটা কম ছিলো বলে ফার্স্ট স্টেপে ভেবেছিলাম আংটি পরিয়ে রেখে যাই। কিন্তু মন সায় দেয়নি মেজর। মনে হচ্ছিলো ওকে রেখে গেলেই কিছু-না-কিছু একটা ঘটবে। হান্নান শেখকে দেখে প্রথম যেই খটকাটা লেগেছিলো, সেটার হিসাব কিছুদিন আগে মিলিয়েছি। আপনার কি অপারেশন ঝিলতলার কথা মনে আছে?
মেজর হাবিব কপাল কুঁচকে তাকালেন, ডানে তাকিয়ে খোলা জানালার বাইরে সর্তক দৃষ্টি দিয়ে আবার মাহতিমের দিকে ফিরলেন। দেয়ালের যদি কান না থাকে তবেই এখন ভালো। মেজর হাবিব একটু এগিয়ে এসে প্রশ্নাত্মক গলায় বললেন,

– যেই অভিযানটা তোমার আন্ডারে লিড হয়েছিলো সেটার কথা বলছো না?
মাহতিম ‘ হ্যাঁ ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে দিলো। মেজর হাবিব কপাল কুঁচকে কিছু একটা ঘোরতর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। মাহতিম উনার চিন্তার জটটা আরেকটু খুলে দিতেই স্বর নামিয়ে সাবধানী কন্ঠে বললো,
– আপনাকে আমি এজন্যই ডেকেছি কারণ আপনাকে আমার দরকার। কালাম সরদার নামটা তো শুনেছেন নিশ্চয়ই? অপারেশন ঝিলতলা নামে যেই অভিযানটা করেছিলাম সেখানে সবগুলো আসামী ধরা পরলেও মূল আসামী পলাতক ছিলো।
জাফর হাবিব কপালে জমা বিন্দু-বিন্দু ঘামগুলো অশ্রু মুছা রুমালে মুছে নিলেন। তিনিও স্বর নামিয়ে সজাগ হয়ে বললেন,

– তুমি কাকে সন্দেহ করছো মাহতিম? মেহনূরের দাদাকে নাকি? তুমি কথা না প্যাঁচিয়ে সোজাসাপ্টা বলো।
মাহতিম স্থির হয়ে জাফর হাবিবের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে উত্তর শোনার জন্য জাফর হাবিব প্রচণ্ড খচখচ অনুভব করছেন। তিনি সহ্য করতে না পেরে আরেকবার তাগাদা দিলেন, এবার মাহতিম নতমুখে নিশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে বললো,

– সাসপেক্ট পার্সন দুজন মেজর। এক. আমার শ্বশুড়মশাই, দুই. আমার দাদাশ্বশুড়।
বাকশূণ্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন জাফর হাবিব। মুখের ভাষাও যেনো হারিয়ে গেছে উনার। এতো বড় আসামীর সন্ধান কিনা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পাওয়া গেছে আজ। এতোদিন পরও মাহতিম সেই কেসটা সগোপনে চালিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখে তিনি অবাক! ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া দিবেন বুঝতে পারছেন না, শুধু ভেতরে-ভেতরে বুঝে নিয়েছেন মাহতিম খুব ভয়াবহ ধরনের চিন্তা কষে রেখেছে। সেটা যে কতোটা ভয়াবহ হবে, তিনি আবারও চোখ বন্ধ করে দেখতে লাগলেন।

স্টাডি টেবিলের সামনে বসে পিসি অন করলো মাহদি। ছুটি কাটানোর পর অনেকদিন যাবৎ পিসিতে হাত দেওয়ার সুযোগ পায়নি। আজ অনেকটা বাধ্য হয়েই জে’দের ব্যতিরেকে পিসির সামনে চেয়ার টেনে বসলো, মাউসে ক্লিক করে কাঙ্ক্ষিত পাসওয়ার্ড দিয়ে পিসির সিকিউরিটি শেষ করলো। মাউস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কায়দামতো জিমেইলে এন্ট্রি করলো, টেবিলের নিচে হাত রেখে ড্রয়ারের মতো টান দিয়ে কির্বোড বের করলো। একনাগাড়ে ফুলস্পিডে বাংলা শব্দ টাইপ করতে থাকলো মাহদি। দক্ষ হাতে সম্পূর্ণ একটা জিমেইল সম্পন্ন করে অন্য জিমেইল এ্যাড্রেসে সাথে-সাথে সেন্ড করে দিলো। জিমেইলটা সেন্ড করতেই জোরে-জোরে দুটো নিশ্বাস ছেড়ে টেবিলেই মাথাটা নত করে রাখলো। চোখ বুজে অষ্ফুট সুরে বারবার বলতে লাগলো,

– তুমি চলে এসো ভাইয়া, চলে এসো, তুমি এবার চলে এসো প্লিজ।
গুণে-গুণে দশ মিনিট যেতেই মাহদির ডান থাইটা সুড়সুড় করে উঠলো। মাহদি তৎক্ষণাৎ বেজায় স্পিডে ট্রাউজারের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো, একটানে এন্ড্রয়েড ফোনটা বের করতেই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ‘ ইয়াহু ‘ বলে মৃদ্যু শব্দে চিল্লিয়ে উঠলো। তড়িঘড়ি করে চেয়ার থেকে উঠে রুমের দরজাটা লক করে বিছানায় উঠে বসলো। কলটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই চটপট গলায় বললো,

– ভাইয়া তুমি কেমন আছো? তুমি মায়ের সাথে কথা বলো আর আমাকে কল দাওনা? আমাকে কি মনে পরেনা?
ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় কিছু বলতে গিয়েও চুপ রইলো মাহতিম। দু’কানে ইয়ারপড ঢুকিয়ে সেও টেবিলে বসে পিসিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। মাহদি কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে বললো,
– আমার বউকে তুমি কি বলেছো হ্যাঁ? বিয়ে করেছো কি কাঁদানোর জন্য?
এবার কির্বোডের উপর হাত থেমে গেলো মাহতিমের। কিছুটা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আমিতো মা’কে ছাড়া আর কাউকে কল দেইনি। ও কাঁদবে কেনো?
মাহদি ঠোঁট ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,

– কল দেওয়া কি উচিত না? আমার বউ কি টেনশন করেনা? তুমি এতো খারাপ জানলে জীবনেও আমার বউকে বিয়ে করতে দিতাম না। দশ বছর পর আমিই ওকে বিয়ে করে আনতাম।
মাহতিম বিরক্ত হয়ে বললো,
– চড় খাবি? আমি আসলে কিন্তু কঠিন চড় লাগাবো। আমার বউকে তোর বউ বলা বন্ধ করিস। চড় কিন্তু একটাও মাটিতে পরবেনা ।
মাহদি নিজের চিকন-চিকন ভ্রুঁদুটো কুঁচকে ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললো,

– যেটা তোমার ওটা আমার। যেটা আমার ওটা আমারই।
বেখাপ্পা উত্তর শুনে বোকা বনে গেলো মাহতিম। এটুকুনি ব’দমাশের মাথায় কি জটিল-জটিল কথা ঢুকে গেছে। মাহতিমকে চুপ থাকতে মাহদি নিজেই বলে উঠলো,
– ভাইয়া শুনো আমাদের বউ ঠিকমতো নিজের খেয়াল রাখছেনা। কি করা উচিত বলো?
‘ আমাদের বউ ‘ শুনে আর নিজেকে থামাতে পারলোনা মাহতিম, ফিসফিস করে হেসে উঠলো পিসির সামনে। ফাজিলটাকে ধরে কঠিনভাবে কান মোচড়াতে ইচ্ছে করছে। শেষমেশ কিনা আমাদের বউ বলে আখ্যা? মাহতিম অনেক কষ্টে নিজের হাসি আটঁকে মাহদির উদ্দেশ্যে বললো,

– শোন্ ব্যাটা, ও আমার বউ। ওকে ভাবী ডাকতে শিখ। পারলে ভাবী আম্মা ডাকবি, ভাবী আম্মা। বুঝছিস?
মাহদি নাছোড়বান্দার মতো জবাব দিলো,
– না, ও আমার ভাবী টাবী না। ও আমার বউ। তোমার বউ মানে আমারও বউ। তুমি যখন বুড়ো হয়ে যাবে, তখন আমি ওকে বিয়ে করে ফেলবো।
মাহতিম হাঁফ ছেড়ে সশব্দে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো, এসব পাকনা পোলাপানদের সাথে যুক্তি লাগিয়ে পারা যাবেনা। মোদ্দাকথায় আসার জন্য জোর দিলে মাহদির কন্ঠটা বিমর্ষ আকার ধারণ করলো। যেই প্রফুল্ল স্বরটা এতোক্ষণ ছিলো সেটার পরিবর্তে একরাশ বিষণ্ণ সুর ভর করে বললো,

– তোমার রুমের ফ্লোরে বসে ও খুব কাঁদছিলো ভাইয়া। ও তোমার জন্য প্রতিদিন যেই ডায়েরীটা লিখতো ওটা বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যেই হাতটায় নীতি আপু ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলো সেটা পরশুদিন মা খুলে দিয়েছে। ঘা শুকায়নি ভাইয়া। এখনতো ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেনা। সকালে জোর-জবরদস্তি করে কয়েক লোকমা মা খাওয়ায়, এরপর যে তোমার রুমে ঢুকে সেখান থেকে সহজে বেরোয় না। আজ ওই অনামিকা এসেছে, এখনো ওর কানে কিছু ঢুকায়নি। আমি আশেপাশে ঘুরি দেখে আমাকে অনেক শাসিয়েছে ভাইয়া। তুমি প্লিজ প্লিজ চলে এসো।
কলের বিপরীতে স্তব্ধ হয়ে আছে মাহতিম। চোখের সামনে থাকা পিসিটা বিমূঢ় দৃষ্টিতে বন্ধ করে দিলো। সহসা কিছুক্ষণ নিরব থেকে কোমল গলায় বললো,

– তোকে কিছু করেছে?
মাহদি বিষণ্ন গলায় বললো,
– না ভাইয়া। শুধু গালটা —
কথা শেষ করার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে বিকট শব্দ শুনলো মাহদি। আচমকা ভয় পেয়ে কান থেকে ফোন পরে গেলো ওর। দ্রুত ফোনটা তুলে আবার কানে ঠেকাতেই ‘ টুট টুট টুট ‘ শুনতে পেলো ।

রাতের খাবার শেষে কেবল বিছানায় এলেন মারজা। সঙ্গে করে তিনি মেহনূরকেও নিয়ে এসেছেন। আজ তিনি মেয়ে-সম বউমার সঙ্গে গল্প করতে-করতে ঘুমাবেন বলে চিন্তা করেছেন। পুরোনো দিনের আবদ্ধ স্মৃতির কারখানাটা খুলে দিবেন আজ, সেখান থেকে অসংখ্য মধুর স্মৃতি বের করে মেহনূরকে শোনাবেন। মেহনূর একটু একা থাকার সুযোগ খুজেঁ যাচ্ছিলো কিন্তু সুযোগটা সে পায়নি। মারজার উৎসুক মুখটা দেখে বলতেও পারেনি আজ তার মন খারাপ। ভীষণভাবে খারাপ। একাকিত্বের মাঝে অন্ধকার রুমে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। কিভাবে মনের চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থা সম্পর্কে মারজা বলবে?

এমন কোনো সিস্টেম যদি থাকতো, যেখানে মনের সব কথা অটোমেটিক আশেপাশের মানুষগুলো বুঝে ফেলতো, তাহলে এমন অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতো মেহনূর। মারজা বিছানায় শুয়ে-শুয়ে অনায়াসে সকল কথা বলতে লাগলেন, একে-একে সব ঘটনা খুলে বলতেই কখন যে নিদ্রার রাজ্যে তলিয়ে গেলেন সেটা নিজেও ধরতে পারলেন না। পাশে থাকা মেহনূর টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে মারজা গায়ে পাতলা কম্বলটা টেনে দিলো। বিছানা থেকে নেমে চুপিচুপি সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। আবছা অন্ধকারে পা চালাতে-চালাতে আচঁলটা চোখে ডলছিলো বারবার। বন্ধ রুমটার কাছে এসে ডানহাত বাড়িয়ে ধাক্কা দিলো, দরজাটা খুলে গেলে ভেতরে ঢুকলো মেহনূর। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে রুমের সুইচবোর্ড থেকে ড্রিম লাইটটা জ্বালিয়ে নিলো। শূন্য রুমের শূন্য বিছানায় পা উঠিয়ে বসলো। মাহতিমের একান্ত নিজস্ব বালিশটা টেনে এনে কোলের উপর রাখলো মেহনূর। বালিশটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকাতেই টপটপ করে গোল-গোল বিন্দু কণা বালিশের উপর পরতে লাগলো। কাঁপা-কাঁপা গলায় হালকা সুরে বলে উঠলো,

– আমাকে মাফ করতে চলে আসুন।
ঝরঝর করে চোখ থেকে ফোঁটায়-ফোঁটায় অশ্রু ঝরছে। রাত্রিকালীন নিরিবিলি সময়টা লুকিয়ে থাকা ব্যথাকে জাগিয়ে দিচ্ছে যেনো। ঘুমন্ত শহরটা নিদ্রামগ্নে ডুবে গেছে ভীষণভাবে, কোথাও কেউ জেগে নেই আজ। চারপাশটা এতো নিরব হয়ে উঠলো, শেষমেশ কেবল টিকটিক করে ঘড়ি চলার আওয়াজটা স্পষ্ট হতে লাগলো। মেহনূর ঢোক গিলে চোখ খুলে তাকাতেই বালিশটা জায়গামতো রেখে দিলো। মাহতিমের পাঠানো বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখার জন্য উঠতে উদ্যত হলো মেহনূর, হঠাৎ নিরবতার সন্ধিক্ষণে ছেদন ঘটিয়ে বহুদিন পর টানা একসপ্তাহ একদিন শেষের রাত্রিরে ফোন বেজে উঠলো।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩৪+৩৫

নিরব রুমটায় বিকট আওয়াজের জন্য কেমন ভূতুড়ে-ভূতুড়ে ঠেকছে। মেহনূর প্রথমে অবিশ্বাস করলেও শেষে দেখলো ঠিকই ফোন বাজছে, সেটা বালিশের পাশ থেকে বেজেই চলছে। বুকভরা সাহস নিয়ে জোরে-জোরে দম নিতেই ফোনটার কাছে এগিয়ে গেলো মেহনূর, ঠান্ডা হয়ে আসা হাতটা আস্তে করে ফোনের নিচে ঢুকিয়ে সেটা মুঠোয় তুলে নিলো। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আনন্দ-অশ্রু মিলিত চাহনিতে হু হু করে কেদেঁ উঠলো মেহনূর।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩৮+৩৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here