মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৯
ইয়াসমিন খন্দকার
অভিক সুনীতির সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল৷ তাই স্বাভাবিক ভাবেই সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। শিহাব এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরাফাতের কাছ থেকে কৌশলে তার বন্দুকটা কেড়ে নেয়৷ আরাফাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই বন্দুকটা অভিকের দিকে তাক করে বলে,”আমাকে এত সহজে ধরতে পারবি না তুই। আমি যদি ভালো থাকতে না পারি তাহলে তোকেও ভালো থাকতে দেব না। তোকে আমি শেষ করে দেব।”
আরাফাত সহ অন্যান্য আর্মি সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে চলে আসে৷ আরাফাত অন্য একটা বন্দুক শিহাবের দিকে তাক করে বলে,”বন্দুকটা হাত থেকে ফেলে দে। নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”
শিহাব বাঁকা হেসে বলে,”ভালো তো আমার সাথে এমনিতেও হবে না। নিজের খারাপ টা দেখার আগে নাহয় আমি তোদের এই মেজরের খারাপ থাকার ব্যবস্থাটা করে দেই।”
একথা বলেই অভিকের একদম বুক বরাবর বন্দুক টা তাক করে ফেলে শিহাব। আরাফাত চিল্লিয়ে ওঠে,”একদম গুলি করবি না৷ ওখানেই থেমে যা।”
অভিক শান্ত চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। শিহাব বলে ওঠে,”প্রস্তুত হয়ে যা মেজর। তোর সময় ঘনিয়ে আসছে৷ এবার তোর খেলা শেষ। আমার এত কষ্ট করে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য ধ্বংস করার শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই কথাটা বলেই শিহাব একটা গা জ্বালানি হাসি দেয়। বন্দুকের ট্রিগার চেপে ধরে গুলি চালিয়ে দেয়৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলিটা বুক ভেদ করে বেরিয়ে যায়। অভিক দূরে ছিটকে পড়ে।
অভিক নিজের বুকে হাত রেখে দেখে সে একদম অক্ষত আছে। গুলিটা তার বুকে লাগার ঠিক আগ মুহুর্তে কেউ যেন তাকে দূরে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। অভিক চকিতে সামনে তাকাতেই হতবাক হয়ে যায়। চিৎকার করে বলে ওঠে,”আনিসা,,,!”
আনিসার বুক থেকে তরল স্রোতের মতো রক্ত বেয়ে পড়েছে। তবুও তার মুখে শোভা পাচ্ছে তৃপ্তির হাসি৷ শিহাব ব্যর্থতার সাথে চিৎকার করে ওঠে। কারণ তার উদ্দ্যেশ্য পূরণ হয়নি। গুলিটা অভিকের বুক ভেদ করার আগেই আনিসা এসে অভিকের ধাক্কা দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। যার ফলে গুলিটা এসে অভিকের পরিবর্তে আনিসার বুক ভেদ করে যায়।
অভিক দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে যায় আনিসার কাছে। অন্যান্য কয়েকজন আর্মি অফিসার এবং আরাফাতও ছুটে আসে। আর কয়েকজন এগিয়ে গিয়ে শিহাবের হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে তাকে বন্দি করে নেয়।
অভিক আনিসার কাছে গিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে বলে,”কেন করলি এমনটা তুই? আমাকে বাঁচানোর জন্য কেন নিজের জীবনের এত বড় ঝুঁকি নিলি? তোর যদি এখন কোন ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে যে আমি কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
আনিসার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবুও সে বহু কষ্টে বলে,”আমি তোকে বলেছিলাম না,,,তোর বিপদে সবার আগে আমিই এগিয়ে আসব। আমি আমার কথা রেখেছি৷ তোর বিপদে ঢাল হয়ে এগিয়ে এসেছি।”
অভিক আরাফাতকে বলে,”ওর তো ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছে। দ্রুত ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। নাহলে যে ওকে বাঁচানো যাবে না।”
আরাফাত মাথা নাড়ায়। আনিসা অভিকের হাত শক্ত করে ধরে বলে,”আমার হাতে আর বেশি সময় নেই অভি। পারলে যা কিছু হয়েছে তার আমায় ক্ষমা করে দিস। আর তুই আমার একটা শেষ অনুরোধ রাখিস,,,এই কু**ত্তা শিহাব আমার বাবাকে মে*রে পাশেই কবর দিয়েছে। তুই আমাকেও আমার বাবার পাশেই কবর দেয়ার ব্যবস্থা করে দিস। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।”
বলেই আনিসা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। অভিক বলে ওঠে,”এমন বলিস না আনিসা। আমি তোর কিছু হতে দেব না। তোকে বাঁচতে হবে। চোখ খুলে রাখার চেষ্টা কর,,,আনিসা,,”
ধীরে ধীরে আনিসা হাল ছেড়ে দেয়। তার নিঃশ্বাসের গতি কমে আসে। শারীরিক নড়াচড়াও একদম বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই একটু পর তার হৃদস্পন্দন থেমে যায়। অভিক আনিসাকে ডেকে ওঠে,”এই আনিসা,,চোখ খোল,,কথা বল,,”
কিন্তু আনিসার থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়না। চিরস্তব্ধতা এসে ভড় করে আনিসার উপর। আরাফাত অভিকের কাঁধে হাত রাখে। তার চোখেও জল৷ অভিক ব্যর্থতার কন্ঠে বলে,”আমরা ওকে বাঁচাতে পারলাম না আরাফাত। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আনিসা নিজের জীবন দিয়ে দিল। ও আমায় বলেছিল ওর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে। কিন্তু এরকম প্রায়শ্চিত্ত তো আমি চাই নি। আমি তো চেয়েছিলাম আনিসা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক। দীর্ঘ ৯ টা বছর মেয়েটা যে অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করেছে তারপর কি ও একটু সুখ ডিজার্ভ করত না? একটা স্বাভাবিক জীবনে কি ওর প্রাপ্য ছিল না? শুধু একটা ভুল মানুষকে ভালোবাসার ফল আজ ওকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হলো।”
আরাফাত বলে,”তুই শান্ত হ অভিক। নিয়তি হয়তো এটাই ছিল৷ তাই তো আনিসার জীবনটা এমন হয়ে গেল। বাবার আদরের এক প্রাণোচ্ছল, উচ্ছ্বসিত মেয়ের শেষ পরিণতিটা এমন হবে তা তো আমিও ভাবিনি। আমার এখন খুব মনে পড়ছে আমাদের কলেজ জীবনের সেই চঞ্চল আনিসার কথা। যে সিএনজিতে ৫ টাকা ভাড়া কমানোর জন্য সিএনজি চালকের সাথে সেই তর্ক করত, একটা ফ্রি ফুচকার জন্য ফুচকাওয়ালা মামার কাছে কিভাবেই না রিকোয়েস্ট করত, গোটা ক্লাসটাকে মাতিয়ে রাখত কিন্তু আজ,,”
আরো এক ফোঁটা অশ্রু পড়ে আরাফাতের চোখ দিয়ে। অভিক উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”ঐ শিহাব কুত্তা*টাকে ওর অপরাধের জন্য চরম থেকে চরমতর শাস্তি পেতেই হবে।”
আনিসার জানাজা পড়ানোর পর তার ইচ্ছামতো আনিসার বাবার কবরের পাশেই তাকে কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে।অভিক কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে৷ হঠাৎ পিঠে কারো স্পর্শ অনুভব করতেই পিছন ফিরে তাকায়। সুনীতি অশ্রুসিক্ত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে। সুনীতিকে দেখেই অভিক আবেগপ্রবণ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। সুনীতি কান্না করতে করতে বলে,”এসব কি হয়ে গেল অভিক? আনিসা আপু,,,”
অভিক বলে,”তুমি খেয়েছ তো?”
“হুম। তোমার সাথে কথা বলার পরই আমি খাবার খেয়ে নিয়েছি। তারপরই আনিসা আপুর খবরটা পেলাম। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে চলে এলাম। এ’কটা দিন তো উনি আমাদের সাথেই কাটিয়েছেন। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওনার জন্য।”
অভিক বলে,”ও আমাদের বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখেছে সুনীতি। আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। যদিও ও প্রথমে নিজে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাকে বিপদে ঠেলে দিয়েছিল কিন্তু শেষ অব্দি তার জন্য চরম মূল্য চুকিয়েছে। জানো, ও মৃত্যুর আগে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আমি না ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি। মেয়েটা যে বড্ড অসহায় ছিল। ৯ টা বছর এত নারকীয় অত্যাচার সহ্যের পর একটু মুক্তির স্বপ্নই দেখেছিল,,,বেশি কিছু তো চায় নি। এর জন্য কি ওকে একটু ক্ষমা করে দেয়া যায়না? আচ্ছা, তুমি তো আমার স্ত্রী। তোমার স্বামীকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য তুমি ওকে ক্ষমা করতে পারবে না?”
সুনীতি কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আনিসা আপুর জন্যই আমি আপনাকে জীবিত ফেরত হয়েছি। ওনার উপর আমার কোন রাগ বা ক্ষোভ নেই। আল্লাহর কাছে আমার একটাই চাওয়া, ওনার সব ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে যেন ওনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। জীবনে উনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন, মৃত্যুর পর অন্তত একটু সুখ ডিজার্ভ করেন।”
মন রাঙানোর পালা পর্ব ২৮
“একদম ঠিক বলেছ তুমি।”
“আল্লাহর কাছে আমরা দুজনে ওনার জন্য প্রার্থনা করব।”
অভিক সায় জানায়।