মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩২

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩২
ইয়াসমিন খন্দকার

সুনীতি মন খারাপ করে ছাদে বসে আছে। তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে নানানো চিন্তাভাবনা। এর মাঝেই হঠাৎ পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরে তাকায় সুনীতি। পিছনে ফিরতেই রাহেলা খাতুনকে দেখতে পায় সুনীতি। রাহেলা খাতুন সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি সুনীতি। আমি সবটাই জানি। তোমার অভিককে ভুল বোঝার জন্য হয়তো যথেষ্ট কারণ আছে কিন্তু তুমি আবেগ দিয়ে না ভেবে একটু বিবেক দিয়েও ভাব। অভিকের যায়গায় তুমি থাকলে কি একই কাজ করতে না? অভিক তোমার ভালোর কথা ভেবেই,,”

সুনীতি মলিন হেসে বলে,”ও আমার একটু বেশিই ভালো ভেবে নিয়েছে। এতটাও ভাবা উচিৎ হয়নি।”
রাহেলা খাতুন একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। কারণ তিনি বুঝতে পারেন সুনীতিকে এখন আর কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই। এজন্য তিনি বলেন,”তুমি একটু সময় নিয়ে ভাবো। হয়তো তখন অভিকের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।”
বলেই রাহেলা খাতুন চলে যান। সুনীতি সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত ছাদেই থাকে। অতঃপর গেস্টরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। অভিক সবটাই লক্ষ্য করে কিন্তু সুনীতিকে তার মতো থাকার সুযোগ দিতে চায় অভিক। এজন্যই এই ব্যাপারটা নিয়ে আর তেমন কিছু বলে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে সুনীতি। নামাজ আদায় করে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়। অতঃপর বাড়িতে ফিরে এসেই রান্নাঘরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রকম রান্না করে। আহসান চৌধুরী এবং রাহেলা খাতুন নিচে নামলে তাদেরকে চা খেতে দেয় সুনীতি। অতঃপর ব্রেকফাস্টে জ্যাম-পাউরুটি খেতে দেয়। কিন্তু একটা বারেও জন্যেও অভিকের কোন খোঁজ নেয় না। রাহেলা খাতুন এই ব্যাপারটা নিয়ে সুনীতির উপর রেগে যান। কিন্তু তার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে কিছু বলেন না। আহসান চৌধুরী খাওয়া শেষ করে সুনীতিকে বলেন,”অভিক বোধহয় কিছু খায়নি এখনো অব্দি। তুমি যাও ওর রুমে গিয়ে ওর খাবার দিয়ে আসো।”

সুনীতি আপত্তি জানায় না। খাবার সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়ে যায় অভিকের রুমের দিকে। অভিক সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। গতকাল থেকে সুনীতির অবজ্ঞা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। এজন্য সেও নিচে খেতে যাওয়ার আগ্রহ দেখায় নি। এরইমধ্যে সুনীতি খাবার নিয়ে তার রুমে চলে আসে। সুনীতিকে আসতে দেখে অভিকের মনে শীতল বাতাস বয়ে যায়। সে একটু শান্তি বোধ করে। অভিক ভাবে সুনীতি হয়তো সব মনোমালিন্য দূরে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু অভিককে ভুল প্রমাণ করে খাবারটা বিছানার পাশে ডেস্কে রেখে দিয়ে সুনীতি কঠোর স্বরে বলে,”খাবারটা দিয়ে যাচ্ছি জলদি খেয়ে নাও। এটা জাস্ট ফর্মালিটির জন্যই করেছি। এটা ভেবে নিও না যে তোমায় আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।”

অভিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আবারো তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। তবুও মনে একটা আশা রাখে। যেহেতু সুনীতি তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে তার মানে সুনীতি তার জন্য কেয়ার করে। যতই ভুল বোঝাবুঝি হোক সুনীতির অভিকের প্রতি চিন্তার কমতি হয়নি। সুনীতি খাবার রেখে দিয়েই চলে যায়। অতঃপর অভিক খেতে শুরু করে দেয়।
সুনীতি বাইরে আসতেই হঠাৎ করে তার মাথা ঘুরিয়ে ওঠে। সুনীতি বুঝতে পারে না এর কারণ কি। সুনীতি অনেক কষ্টে সামনে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
এদিকে অভিক খাওয়া শেষ করে বাইরে এসে দেখে সুনীতি দরজার থেকে কিছুটা দূরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। এটা দেখে অভিক অনেক ভয় পেয়ে যায়। সুনীতির কাছে গিয়ে তাকে ডাকতে থাকে,”নীতি,,,এই নীতি চোখ খোলো। কি হয়েছে তোমার?”

সুনীতি কোন সাড়া দেয় না। অভিক ভীষণ ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সুনীতিকে কোলে তুলে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। আহসান চৌধুরী ও রাহেলা খাতুন নিচেই ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। অভিককে এভাবে সুনীতিকে কোলে নিতে আসতে দেখে তারাও হতবাক হয়ে যান। আহসান চৌধুরী বলে ওঠেন,”সুনীতির কি হয়েছে অভিক?”
“জানি না, বাবা। হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।”
“আমিও যাচ্ছি চলো। তুমি একা সবকিছু সামলাতে পারবে না।”

রাহেলা খাতুন উদ্বিগ্নতার সহিত বলেন,”আমিও যাব তোমাদের সাথে। এখানে থাকলে তো চিন্তায় মরে যাব।”
অভিক বলে,”ঠিক আছে, চলো তোমরা সবাই। ফাস্ট।”
সবাই দ্রুত পৌঁছে যায় নিকটবর্তী হাসপাতালে। সুনীতিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার তার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। অভিক কেবিনের বাইরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল৷ ডাক্তার বাইরে আসতেই তাকে সবাই মিলে ঘিরে ধরে। অভিক প্রশ্ন করে,”ওর অবস্থা এখন কেমন ডাক্তার?”
“চিন্তার কোন কারণ নেই। আপাতত উনি ঝুঁকিমুক্ত। হঠাৎ করে পেশার ভীষণ লো হয়ে গেছিল তাই অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে উনি অনেকক্ষণ থেকে কিছু খান নি৷ আপনারা তো ওনার ফ্যামিলির লোক। উনি খাচ্ছেন কি খাচ্ছেন না সেদিকে একটু খেয়াল রাখবেন না?”

অভিক সহ উপস্থিত সবাই লজ্জায় মাথা নামিয়ে দেয়। ডাক্তার চলে যান। অভিক দেয়ালে ঘুষি মা”রতে মারতে নিজের হাত রক্তাক্ত করে ফেলে। চিৎকার করে বলে,”সবটা আমার ভুল৷ আমি নীতির খেয়াল রাখতে পারি না। বারবার ওকে কষ্ট দেই।”
আহসান চৌধুরী অভিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”তুমি নিজেকে এভাবে দোষ দিও না, অভিক। তোমাকে এখন সবার আগে নিজেকে সামলাতে হবে। নাহলে তুমি সুনীতিকে কিভাবে সামলাবে?”
“কি করব আমি বাবা? আমার যে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।”

রাহেলা খাতুন এসব দেখে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে থাকেন। সুনীতিকে আপাতত আজকের দিনটা হাসপাতালেই রাখা হবে। আহসান চৌধুরী ও রাহেলা খাতুন কিছুক্ষণ থেকে চলে যান। অভিক হাসপাতালেই বসে রয়।
কিছু সময় পরই সুনীতির জ্ঞান ফেরে৷ জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে ভীষণ শান্ত হয়ে আছে। অভিক একবার সুনীতির সাথে দেখা করতে গেছিল কিন্তু সুনীতি অভিকের সাথে কোন কথা বলে নি। অভিকও সুনীতিকে বেশিক্ষণ বিরক্ত না করে বাইরে বেরিয়ে আসে। এভাবে সেদিন কয়েকবার অভিক সুনীতিকে চেক করল গোপনেই। নিজেও সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না।

পরদিন সকালে ডাক্তার সুনীতিকে চেক করে বুঝলেন সুনীতি এখন একদম ঠিক আছে। তাই সুনীতিকে চলে যাবার অনুমতি দিয়ে দিলেন। অভিক হাসপাতালের যাবতীয় সব কাজ শেষ করে সুনীতিকে নিয়ে রওনা নেয়। উল্লেখ্য সুনীতি এখনো অব্দি অভিকের সাথে কোন কথা বলে নি। হাসপাতাল থেকে বের হবার সময় হঠাৎ করে এক অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের মুখোমুখি হয় সুনীতি ও অভিক। তাদের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় সাজিদ ও ইভার। সুনীতি দেখতে পায় ইভার কোলে একটি ছোট্ট বাচ্চা। এটাই বুঝি তাহলে সাজিদ ও ইভার ছেলে। সাজিদ ও ইভার মাঝে ভুলবোঝাবুঝি অনেক আগেই মিটে গেছিল। নিজেদের সন্তানের খাতিরে ইভা সাজিদকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। সালমা খন্দকারও সবকিছুর জন্য ক্ষমা চেয়েছেন বিধায় ইভা ও সাজিদ তাকেও ক্ষমা করে দিয়েছে। ইভা মূলত গর্ভাবস্থায় বাংলাদেশেই ছিল। কারণ আমেরিকায় তার যত্ন নেয়ার মতো কেউ নেই। বাংলাদেশে সালমা খন্দকার তার যত্ন নিয়েছে প্রেগ্ন্যাসির সময়টায়। এখন তার একটি ছেলেও হয়েছে এই হাসপাতালেই। আজ সেই সন্তানকে নিয়ে তারা বাসায় ফিরছে।

সাজিদ সুনীতিকে দেখে লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়৷ অতীতে সুনীতির সাথে সে অনেক খারাপ করেছিল। মামা-মামির মৃত্যুর পর তার অনুশোচনা বেড়েছে। তাই আজ সব কিছু ভুলে সুনীতির সামনে হাতজোড় করে বলে,”আজ ক্ষমা না চাইলে জানিনা জীবনে আর কখনো এই সুযোগটা পাবো কি না। আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি সুনীতি। পারলে আমায় বড় ভাই মনে করে মাফ করে দিও।”

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩১

সুনীতি সামান্য হেসে বলে,”আমার এখন এসব কিছু সয়ে গেছে। সবটাই আমার ভাগ্যের দোষ। যারাই আমার আপনজন তারাই হয় আমাকে ছেড়ে যায় নাহলে বিশ্বাসভঙ্গ করে। কত জনের উপর আর রাগ পুষে রাখব? সবাইকেই আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। এবার সবাই আমাকে অন্তত মুক্তিটা দিক!”
বলেই সুনীতি চলে যায় সামনের দিকে।

মন রাঙানোর পালা পর্ব ৩৩