মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৭
ইয়াসমিন খন্দকার
সারজিস এসে উপস্থিত হয়েছে অভীক্ষার বাড়ির সামনে৷ দরজা খুলেই তাকে দেখে অভীক্ষা নির্জীব ভাবে বলে, “আপনি কেন এসেছেন এখানে? কি চাই আপনার? আমাকে এত অপমান করেও কি আপনার মন ভরে নি?”
সারজিস বুঝতে পারে অভীক্ষা তার উপর কতোটা রেগে আছে৷ এখানে দোষ সম্পূর্ণ রূপেই অভিকের সেটা সে মেনে নিয়েছে৷ আর সেজন্য সে মাথা নিচু করে বলে, “আমি তোমার সাথে যা যা অন্যায় করেছি তার জন্য আমি মন থেকে ক্ষমা চাইছি৷ সমস্ত সত্যটা এখন আমি জানতে পেরেছি যে আদতে তোমার কোন দোষ ছিল না৷ আসল দোষী ছিল আমার মা..যে চক্রান্ত করছে তোমার বিরুদ্ধে। আমি ভাবতেও পারিনি মা এত নিচে নামতে পারে।”
অভীক্ষা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তো এখন যখন সব জানতেই পেরেছেন তো ভালো। এতে আমার কিছু যায় আসে না৷ আমি তো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যেও আপনার কাছে যাইনি। তাহলে আপনি কেন এসেছেন এখানে?”
সারজিস বলে, “আমি তোমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি অভীক্ষা৷ দয়া করে আমার সাথে ফিরে চলো!”
সারজিসের কথা শুনে ভীষণ রেগে যায় অভীক্ষা৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে এমন কথা বলার? আপনি ভুলে গেছেন আমার সাথে কতটা খারাপ ব্যবহার করেছিলেন সেদিন? আপনি ভুলে গেলেও আমি সেটা ভুলব না। চলে যান এখান থেকে। আপনার সাথে কোনরকম সম্পর্ক আমি পুনঃস্থাপন করতে চাই না।”
সারজিস অনুনয়ের সুরে বলে,”এরকম করো না অভীক্ষা। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয়৷ আমার যায়গায় একবার তুমি নিজেকে বসিয়ে দেখ..তুমি আমার স্থলে থাকলে কি এই একই ভুল করতে না?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আপনি কি ভেবেছেন আমায়? এসব কথা বললেই সব কিছু থেকে ছাড় পেয়ে যাবেন? তাহলে ভুল ভাবছেন। আমি এত সহজে গলার মেয়ে নই। নিজের প্রতি হওয়া কোন অন্যায় অবিচার আমি ভুলিনি আর ভুলবো না। সেদিন আপনি কোন কিছু বাচ-বিচার না করে নিজের মায়ের কথায় নেচে আমায় জঘন্য ভাবে অপমান করেছেন। এই অপমান আমি এত সহজে ভুলবো না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, যেই সম্পর্কে বিশ্বাস নেই..সেই সম্পর্ক আর টিকিয়ে রাখবো না। আমি ডিভোর্স চাই আপনার থেকে।”
“অভীক্ষা…”
এমন সময় সুনীতি এসে বলে,”কে এসেছে অভীক্ষা?”
সে সামনে এসে সারজিসকে থেমে থমকে যায়। শক্ত মুখ করে থাকে৷ সারজিস এবার সুনীতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আন্টি,আপনি প্লিজ অভীক্ষাকে একটু বোঝান না। আমি নিজের সব ভুল স্বীকার করছি এবং কথা দিচ্ছি অভীক্ষাকে দ্বিতীয় বার আর কখনো কষ্ট দেব না। দয়া করে ওকে আমার কাছে ফিরতে বলুন।”
সুনীতি বলে,”এ ব্যাপারে আমার কোন মতামত নেই সারজিস। আমি সেই টাইপের মা নই যে নিজের মেয়ের উপর কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া পছন্দ করি। আমার মেয়ে এখন বড় হয়েছে তাই ওর জীবনের সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ওর আছে। তবে আমি তোমাদের দুজনকেই একটা পরামর্শ দেব ধৈর্য ধরে একটু তোমাদের সম্পর্কটা নিয়ে ভাবতে। বিচ্ছেদ কিন্তু কোন কিছুর সমাধান নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক অনেক সময় জীবনসঙ্গীর প্রতি আমাদের মন উঠে যায় তবে তার মানে এই নয় সেই ভাঙা মন আর জোড়া লাগানো যাবে না৷ একে অপরের মধ্যে ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে তোলা যাবে না। এজন্যই আমি তোমাদের সময় নিতে বলছি..সময় নিয়ে দেখো জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে। যা তোমাদের দুজনের জন্যই ভালো হবে।”
অভীক্ষা এবার একটু নরম হয়ে বলে,”তুমি যদি বলো তবে আমি সময় নেব। তবে সেটা হবে আমাদের আসাম থেকে ঘুরে আসার পর।”
সারজিস অবাক হয়ে জানতে চায়,’মানে?’
সুনীতি একটু ইতস্তত করে বলে
“আসলে আমার শরীর কিছুদিন থেকে ভালো যাচ্ছিল না এজন্য ডাক্তারের কাছে গেছিলাম৷ তখন ডাক্তার হাওয়া বদল করতে বলেছে। এজন্য অভীক্ষা ঠিক করেছে ও আমাকে নিয়ে আসামে যাবে।”
সারজিস অল্প করে বলে, “ও..”
অভীক্ষা বলে,”আমি আপনার সাথে আপাতত আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে চাইনা। আমার আর মায়ের পাসপোর্ট, ভিসার সব কাজ প্রায় শেষ..এই সপ্তাহের মধ্যেই আমরা আসামের করিমগঞ্জে যাচ্ছি। সেখান থেকে ফিরে আসার পর জানাচ্ছি, আমার এবং আপনার সম্পর্ক নিয়ে আমার অভিমতের বিষয়ে। তার আগে আমি চাইনা এই নিয়ে আর কোন কথা হোক..আশা করি আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন।”
সারজিস মাথা নাড়িয়ে বলে, “আমাকেও খুব শীঘ্রই সেনা ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে..আশা করি তোমরা যখন ফিরে আসবে তখন আমিও আবার ঢাকায় ফিরতে পারব। তারপর নাহয় ভেবেচিন্তে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। তুমি সাবধানে থেকো, নিজের আর তোমার মায়ের যত্ন নিও। আমি তাহলে আজ আসি।”
বলেই সারজিস চলে যেতে নিলে সুনীতি বাঁধা দিয়ে বলে,”আরে আরে তুমি কোথায় যাচ্ছ বাবা? যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে তো যাও..”
সারজিস হালকা হেসে বলে,”আজ আর কিছু খাবো না আন্টি..আরেকদিন নাহয়..”
“এসব বললে তো শুনছি না৷ তুমি এসে খেয়ে যাও।”
এমন সময় রাহেলা খাতুনও চলে আসেন এবং বলেন,”বৌমা, তুমি ভালো মন্দ কিছু রান্নার ব্যবস্থা করো..বিয়ের পর এই প্রথম দিন জামাই বাড়িতে এলো তার তো ভালো করে খাতির যত্ন করতে হয়।”
সারজিস বলে,”আরে না..আপনাদের এতটা ব্যতিব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।”
কিন্তু কেউ তার কোন কথা শুনল না। তাকে জোর করে খেতে বসালো। হরেক রকম পদের খাবার খাওয়ানো হলো। অভীক্ষা দূর থেকে দেখল সবকিছু। তার মনে জমে থাকা রাগ এখনো কমে নি। তবে লোকটাকে এত তৃপ্তি করে খেতে দেখে অনেক ভালো লাগল। অভীক্ষা মনে মনে বলল,”আমাদের মধ্যে এত তিক্ত একটা বিষয় না এলে হয়তো আজ আমরা এক থাকতে পারতাম। কিন্তু এখন যে আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে আমায় অনেক ভাবতে হবে..”
খাওয়া শেষ করে সারজিস অভীক্ষার কাছে এসে বলে,”আমার সব ভুলগুলো ফুল হয়ে যাক…তবুও তুমি আমার হও…”
অভীক্ষা কোন অভিব্যক্তি দেখায় না।
ময়লা খড়ের আস্তরণে আবৃত একটি ঘর। সেই ঘরে আছে অনেক গুলো ভেড়ার পাল। সেই ঘরের এককোণেই দাঁড়িয়ে আছেন এক মধ্যবয়সী পুরুষ। দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছেন আকাশের পানে। মধ্যবয়সী পুরুষ হলেও তার দেহ এখনো যথেষ্ট সুঠাম। বয়সটা ছাড়িয়েছে পঞ্চারের গণ্ডি তবে বয়সের ছাপ চেহারায় খুব একটা পড়ে নি৷ দাঁড়িগুলো না পাকলে হয়তো তার বয়স আন্দাজ করা কারো জন্য এতটা সহজ হতো না। হঠাৎ করেই সেই পুরুষের সামনে এসে দাঁড়ায় ৩৫ বছর বয়সী শক্তপোক্ত মোটা, কুচকুচে কালো দেখতে এক ব্যক্তি। তিনি এসেই বলেন, “কি খবর ওস্তাদ? এভাবে জানালা দিয়ে কি দেখছেন?”
“আকাশের দিকে দেখছি রে কালিয়া..”
“কি দেখতে পাচ্ছেন আকাশে?”
“জানিনা..কিন্তু এই আকাশ যেন আজ আমাকে কোন কিছুর ইশারা দিচ্ছে..”
“কি বলেন ওস্তাদ?”
“হুম, কেন জানি মনে হচ্ছে..আমার খুব আপন কেউ আসছে আমার কাছে।”
“আপনার আপনজন?”
“হুম।”
“কি বলেন ওস্তাদ..আমি ১০ বছর থেকে এই সরাইখানায় কাজ করি কিন্তু কখনো তো আপনার কোন আপনজনকে এখানে আসতে দেখিনি। আপনি বা অন্য কেউ এই ব্যাপারে কিছু বলেনও নি। তাহলে এখন হঠাৎ করে আপনার আপনজন কোথা থেকে আসবে?”
মন রাঙানোর পালা সিজন ২ পর্ব ২৬
পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ আলতো হেসে বলে,”ভাগ্যে থাকলে অনেক কিছুই হয় রে কালিয়া..যেমন তোর বাবা তো একসময় এই এলাকার আদিবাসী দলের নেতা ছিল কিন্তু আজ দেখ ভাগ্যের ফেরে তোর বাবা সহ তোদের পুরো পরিবারকে এই সরাইখানায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। ঠিক তেমনি..ভাগ্য এক নিমেষেই অনেক কিছু পরিবর্তন করে ফেলে। হয়তো আপনজনদের কাছ থেকে বিচ্ছেদ ঘটায় আবার কখনো মিলন..”