মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ২৩

মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ২৩
মুশফিকা রহমান মৈথি

এটুকুতেই সীমাবদ্ধ রইলো না অভ্র। মধ্যকার দূরত্ব অচিরেই ঘুচিয়ে ঐন্দ্রিলার পাতলা অধরজোড়ায় উষ্ণ ঠোঁট মিশিয়ে দিলো সে। উষ্ণ ঠোঁটের কোমল স্পর্শে কেঁপে উঠলো সারা দেহ ঐন্দ্রিলা। স্তব্ধ হয়ে গেলো যেনো মস্তিষ্ক। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো তার। বিমূঢ় চেয়ে রইলো সে। বিহ্বলতা কাটতেই নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ফলে আগ্রাসী হয়ে উঠলো সেই চুম্বর। নমনীয়তা হারিয়ে গেলো। একটা সময় ঠোঁটে হালকা কামড় বসিয়ে দিলো সে। ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো ঐন্দ্রিলা। ছাড়ানোর চেষ্টা বেড়ে গেলো। একটা সময় অভ্রও তাকে এবার মুক্ত করলো নিজের থেকে। তার ঠোঁটে উন্মোচিত হলো চিত্তশীতলকারী হাসি। তার গাঢ় নয়নে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে ঐন্দ্রিলার হতবিহ্বল মুখবিবর। ঐন্দ্রিলার নিন্মোষ্ঠে কামড়ের চোঁটে ক্ষত হয়েছে। কিঞ্চিত রক্তও বেড়িয়েছে। অভ্র তার ক্ষত ঠোঁটজোড়ায় রুক্ষ্ণ আঙ্গুল ছুয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“আমাকে রাগানোর ছোট্ট শাস্তি।”
বলেই নির্লজ্জের মতো হাসছে সে। ঐন্দ্রিলার চোখজোড়া ছলছল করছে। মিশ্র এক অনুভূতি তার গলায় দলা পাকাচ্ছে। সে কেনো অভ্রের উপর রাগ করতে পারছে না। সে কেনো তার হাস্যজ্জ্বল মুখখানায় চড় বসাতে পারছে না৷ ঐন্দ্রিলা উঠে যেতে নিলেই অভ্র তার হাত ধরে টান দিলো। ফলে টাল সামলাতে না পারায় তার উপর পড়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র বিনা ভনীতায় তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। ঐন্দ্রিলা কোপিত স্বরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমাকে ছাড়”
ঐন্দ্রিলা গলার স্বর কাঁপছে। টলমল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। অভ্র খুব যত্নে তা মুছলো। তাকে ঠিক বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঘোরলাগা স্বরে ফিসফিসিয়ে বললো,
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় তোমার কান্নামিশ্রিত মুখ। তোমাকে কাদাতে আমার ভালো লাগে।
ওগো প্রিয়,
তোমার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা হোক সবার,
শুধু ঐ মুক্তোদানা অশ্রু হোক আমার”

স্তব্ধ হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে তার। গলার কাছটা কেমন শুকিয়ে এলো যেন। হাত পা অবশ লাগছে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না।সে মুখ তুললে অভ্র তার কপালে গাঢ় চুম্বন আকলো। এলোমেলো, অবিন্যস্ত চুলগুলোকে কানের পেছনে গুজলো। তারপর বিড়বিড়িয়ে বললো,
“তুমি আমার জন্য কেনো কাঁদো না। তুমি কি জানো না….”
বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গেলো অভ্র। তার কথাগুলো আর স্পষ্ট হলো না। ঐন্দ্রিলা শুধালো,
“কি জানি না? এই বল, কি জানি না”

কিন্তু লাভ হলো না। মাতালাল মানুষটি ঘুমের অতল গহ্বরে ডুবে গেলো। আর হাজারো চিন্তার মাঝে ফেলে গেলো ঐন্দ্রিলাকে। সে অভ্রের ঘুমন্ত মুখের দিকের চেয়ে আছে। এই ছেলেটাকে বোঝার সাধ্য তার নেই! সে কি আদৌ তাকে ভালোবাসে! যদি ভালোবেসেই থাকে তবে এমন নিমপাতার ভালোবাসা কার কাম্য! ঐন্দ্রিলার রাগ হলো। প্রচন্ড রাগ। রাগে অভ্রের চুল মুঠো করে কিছুসময় ঝাকালো। কিন্তু কাজ হলো না। কারণ যাকে আঘাত করার প্রয়াস সে চালাচ্ছে সে তো আপাতত ধরনীতেই নেই। আছে স্বপ্নের জগতে।

ঐন্দ্রিলাদের বাড়িতে সকাল হলো খুব আয়োজন করে। একটু পর হ্যাপি এবং তার পরিবার চলে যাবে । বিকালের শেষে ঐন্দ্রিলাও তার শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। উৎসবের আমেজ এখন ফুরয়ে এসেছে। ঘরময় ছোটাছুটি করছে নীলাদ্রির কুকুর শকুন্তলা ছোটাছুটি করছে। নীলাদ্রি বদৌলতে এই ছোট কুকুরটি এখন ঘরময় উথাল পাথাল করে। তাকে বাহিরে আটকায় না নীলাদ্রি। কারণ সে নাকি ভয় পাবে। তার থাকার জায়গা ছাঁদে করা হয়েছে। কিন্তু এই কুকুর ঘরময় ছোটাছুটি করে। নীলাদ্রির ঘরটা পিউ কিভাবে যেনো সালাম সাহেবের থেকে উদ্ধার করেছে। সাবেরা সেটা জানে না। জানতে গেলেও স্বামী বলবে না। এর মাঝেই হ্যাপি ছুটে এলো। হাপাতে হাপাতে বললো,
“ভাবী, ভাইজান পাগল হয়ে গেছে”

সকাল সকাল কোথা থেকে জোড়া ছাগলের আমদানী হলো ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি। বাদশাহ ছাগলের দড়ি ধরে আছে এক হাতে। আর অপর হাতে কাঠাল পাতার ডাল। ছাগলগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে পাতা খাবার জন্য। ম্যা ম্যা করে সকালের শান্ত পরিবেশ ছিড়ে ফেললো। গৃহকর্ত্রী ছাগলের ডাকে বেরিয়ে এলেন। নীলাদ্রি তার শকুনতলাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সালাম সাহেব তার ভুড়িখানা আদর করছে। আর গদগদ স্বরে বললো,

“বাদশাহ তোমার কাছে আমি অত্যন্ত খুশি। এই জন্য তোমাকে আমি একশত টাকা বকশিস দিবো”
বাদশাহ স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“স্যার এখন একশত টাকায় ট্রাফিক পুলিশেরো মন গলে না”
“তাহলে একশত টাকা বাদ। দাঁড়িয়ে থাকো তুমি”
এর মাঝে সাবেরা শুধালো,
“ছাগল কেনো এনেছো তুমি?”
“আমি ছাগল পালবো”
“পাগল হয়েছো নাকি?”
“কেনো? কেনো? তোমার ছেলে কুত্তা পালতে পারলে আমি ছাগল পালতে পারবো না কেনো। আমি তো নামও ঠিক করে রেখেছি। ওই কালোটার নাম নীলাদ্রি আর বাদামীটার নাম হ্যাপি। আহা শান্তি”
সালাম সাহেবের মুখে নিজের নামে ছাগলে নামকরণ শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো হ্যাপি। রাগে গজগজ করে বললো,

“ভাইজান আপনি ছাগলের নাম আমার নামে রাখলেন! আপনি এমন কাজ করতে পারলেন?”
“ছিঃ ছিঃ। তোর নামে ছাগলের নাম রেখে ওকে আমি অপমান করবো না। আমি হ্যাপি রেখেছি কারণ দেখ ছাগলটা কেমন হাসি হাসি। তাই ওর নাম হ্যাপি”
হ্যাপি সাবেরা দিকে চাইলো। ভাইয়ের সাথে কথায় সে পারবে না। তাই হাতিয়ার ফেলে ভাবির সরনাপন্ন হওয়াই ভালো। সাবেরা কঠিন স্বরে বাদশাহকে হুকুম দিলো,
“বাদশাহ এই জোড়া ছাগল এখন এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাবে। যেখান থেকে এসেছে সেখানে রেখে আসো”

“তা সম্ভব না ম্যাডাম। এরা আশ্চর্যময়ী ছাগল। কথা বলতে পারে। কথা বলা ছাগলজোড়া আমি ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেছি। এখন তা ফেরত দিলেও টাকা ফেরত আসবে না”
“কথা বলা ছাগল মানে?”
বাদশাহ একটা ছাগলকে শুধালো,
“বলো নীলাদ্রি এপ্রিলের আগে কোন মাস?”

নীলাদ্রি নামকরণ করা ছাগলটি “ম্যা” করলো। বাদশাহ মুখে দুশো ভোল্টের হাসি ফুটিয়ে বললো,
“দেখুন ম্যাডাম। সে মে বলেছে। নীলাদ্রি ছাগল নীলাদ্রি স্যারের মতোই বুদ্ধিমান”
সালামি সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। নীলাদ্রি চোখ কুচকে বললো,
“এটা সব ছাগল ই বলে। ছাগল ম্যা বলবে না কি ভ্যা বলবে। আপনাকে বোকা বানিয়ে টাকা লুটেছে। যেমন মুনিব তেমন তার ভৃত্ত। বোকার প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করবেন দুজন”
নীলাদ্রির কথায় ক্ষেপে গেলেন সালাম সাহেব। ক্ষিপ্র স্বরে বললেন,

“হ্যা, হ্যা তুমি তো বিদ্যাধর হয়েছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চালাক ভাবো তো! এজন্যই তোমার ঘরে বাজ পড়ে। আমি তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছি। এক মাসের মধ্যে আমার ছাগল তোমার ওই কুত্তার থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে দেখাবে”
“ওর নাম শকুনতলা। ওকে শকুনতলা বলে ডাকবে বাবা। আর গাধা পিটিয়ে যেমন ঘোড়া হয় না। তেমন নীলাদ্রি নাম রাখলেই ছাগল বুদ্ধিমান করা যায় না”
বলেই ঘরের ভেতর চলে গেলো নীলাদ্রি। সাবেরা স্বামীর উপর ক্ষিপ্ত হলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। এই ছাগলকান্ড পড়েও সামলানো যাবে।

ঐন্দ্রিলা চেয়ার টেনে বসলো নাস্তার টেবিলে। সারাটা রাত কেটেছে নির্ঘুম। চোখজোড়া তার রক্তিম হয়ে আছে। অভ্রের শক্ত বাধন থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। মানুষটি এখনো ঘুম। নাস্তার টেবিলে ছাগলকান্ড নিয়ে হট্টগোল হলেও পাত্তা দিলো না ঐন্দ্রিলা। তার জীবনে তো অভ্রকান্ডের অভাব নেই। এর মাঝে সালাম সাহেব শুধালেন,
“অভ্র কোথায়?”

অভ্রের কথা শুনতে হতচকিত হলো ঐন্দ্রিলা। আমতা আমতা করে বললো,
“ঘুমাচ্ছে”
“কাল রাতে কখন ফিরলো ও?”
“বারোটার পরে”
সালাম সাহেব আর প্রশ্ন শুধালো না। এর মাঝেই হ্যাপি বেফাঁস বললো,
“তোর ঠোঁট লাল হয়ে আছে কেন ঐন্দ্রিলা?”
কথাটা শুনতেই জমে গেলো ঐন্দ্রিলা। তার মুখ লাজে রক্তিম হয়ে উঠলো। সেই সাথে স্পষ্ট হলো রাতের স্মৃতি। ঐন্দ্রিলা কোনোমতে বললো,
“ব্যাথা পেয়েছি”
“কিভাবে?”
সকলের নজর ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলা মাথা চুলকে বললো,
“বাথরুমে আছাড় খেয়েছি রাতে”
হ্যাপি মিটিমিটি হাসলো। বাকিরা সেটাকে গুরুত্ব দিলো না। সাবেরা তখন ঐন্দ্রিলার উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার ঘরে এসো। কথা। কথা আছে তোমার সাথে”

বাবা মায়ের ঘরে যেতেই মাকে দেখলো আলমারি খুলছে সে। ঐন্দ্রিলাকে দেখে আলমারি থেকে কিছু জিনিস বের করে খাটে রাখলেন সাবেরা। তার মধ্যে কিছু পুরানো শাড়ি এবং গহনার বাক্স। গহনার বাক্সটি ঐন্দ্রিলার দাদীর। এই রুপোর কারুকাজ করা বাক্সের প্রতি প্রচন্ডলোভ ছিলো ঐন্দ্রিলা। সাবেরা তার দিকে জিনিসগুলো এগিয়ে বললো,
“বিয়েরদিন এগুলো নাও নি তুমি। গুছিয়ে নাও”

ঐন্দ্রিলা কথা বললো না। জিনিসগুলো নিলো না সে। চুপ করে বসে রইলো। সাবেরা কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো,
“আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো। আমার কথা শুনতেও তুমি অপছন্দ কর। তবে শুধু এটুকু বলবো, এই বাড়ি তোমার ছিলো, তোমার আছে, থাকবে। যদি রাগ হয়, জেদ হয় তাহলে এখানে চলে এসো। তোমার ভাঙ্গন তহবিল এখনো অক্ষত। আমি হয়তো তোমার কাছে খুব খারাপ মা। তবে তুমি আমার কাছে আমার প্রিয় আমড়া কাঠের ঢেকি। সারাজীবন তাই থাকবে”
ঐন্দ্রিলা মায়ের দিকে তাকালো। তার মুখে ম্লান হাসি। সে জিনিসগুলো নিলো হাতে। ছোট করে বললো,
“আমি আসছি”

অভ্রের ঘুম ভাঙ্গলো খুব দেরিতে। তখন ঘড়ির বড় কাটাটা ভিড়েছে বারোটার ঘরে। এতোটা সময় শেষ কবে ঘুমিয়েছে মনে নেই। চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে, মাথাটা ভার হয়ে আছে। সেই সাথে তীব্র ব্যাথা। যেনো কেউ তার চুল টেনে ছিড়ে ফেলেছে। অভ্র সময় নিলো স্বাভাবিক হতে। খুব ক্ষুদা লেগেছে। আশপাশটা দেখে ধাতস্থ হলো সে ঐন্দ্রিলার রুমে। গতকালের স্মৃতিগুলো খুব স্পষ্ট নয়। খুব অস্পষ্ট। ঐন্দ্রিলার খুব রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলো সে। বৃষ্টিতে ভিজেও যখন মেজাজ ঠান্ডা হয় নি তখন দোকানে চলে যায় সে। ফোন করে ডাকলো বিল্লাল এবং তরুনকে। তরুন বেচারা বাধ্য হয় আসতে। তুলতুলে আবহাওয়ায় ঘুমের বেশ আয়োজন করেছিলো সে। কিন্তু অভ্রের জন্য সেটাকে বাতিল করতে হয়েছে। আর বিল্লাল তো আধ ঘুম থেকে উঠে আসে। টাকা দিয়ে বলে,

“দু বোতল ভালো দেখে জিনিস যোগাড় কর। আমি মদ খাবো আজ”
“পাগল তুই! তুই এখন শ্বশুরবাড়ি আছিস। জানলে কেলেঙ্কারি হবে। ভাবিআপু তোকে গিলে খাবে”
বিল্লাল চেঁচিয়ে বললো। অভ্র গম্ভীর স্বরে বললো,
“হোক কেলেঙ্কারী। কুচ পরোয়া নেহি। আমি কি কাউকে ভয় পাই? সবাই কি পেয়েছে আমাকে। যার যেমন ইচ্ছে তেমন আমার উপর চাপিয়ে দিবে। জীবন আমার সার্কাস হয়ে গেছে। আর তুই তো ঐন্দ্রিলার চামচা হয়ে গেছিস দেখছি। আর একবার ভাবিআপু, ভাবিআপু করলে তোর মুখে জুতা খুলে মারবো। তোর ভাবিআপুকে আমি ভয় পাই নাকি! ”
অভ্রের উত্তরে তরুন বললো,

“ভাই, আমার কেন মনে হচ্ছে আপনি একটা বিশ্বরেকর্ডের ধান্দায় আছেন। বাংলাদেশের প্রথম পুরুষ যার বিবাহকাল তিনদিন! প্রেস্টিজ আর থাকবে না ভাই।”
কিন্তু সাগরেদদের কথা আমলে আনে নি। বিনা কোনো বাধায় সে মদ সেবন করেছে। কথাগুলো মনে পড়তেই কিছুক্ষণ কপাল চাপড়ালো সে। এর মাঝেই শাড়ি আর গয়নার বাক্স হাতে প্রবেশ করলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র মুখ তুলে তাকালো তার দিকে। চোখাচোখি হলো। ঐন্দ্রিলা গম্ভীর স্বরে বললো,
“মহারাজের ঘুম ভাঙ্গলে ফ্রেশ হয়ে যেতে হবে। মানুষ তো তার মহারাজের জন্য অপেক্ষা করবে না”
ঐন্দ্রিলার ঠোঁটের ক্ষত নজরে আসতেই আবছা স্মৃতি স্পষ্ট হলো। সাথে সাথেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো অভ্রের। এর মাঝে ঐন্দ্রিলা ব্যাগ গুছাতে গুছাতে ব্যাঙ্গ করে বললো,

“আগে তো জানতাম শুধু মারামারি করা হয়। এখন তো দেখছে মদ খেয়ে মাতলামি করা হয়। দিনে দিনে আর কি কি জানবো কে জানে। ভাগ্যিস বাবা মা টের পায় নি। নয়তো কেলেঙ্কারি হত। কেউ কি একবার ভেবেছে আমার বাবা-মার মান সম্মান কোথায় থাকতো! ঘর ভর্তি মেহমান আর ঘরের জামাই এসেছে মদ খেয়ে। ছিঃ”
হঠাৎ পেছনে ঘুরতেই দেখলো অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র খানিকটা এগিয়ে এসে তার দিকে ঝুকলো,
“যে পুরুষের শুধু দেহে লোভ সে তো খারাও পুরুষ। খারাপ পুরুষ মদ খাবে, মারামারি করবে এটাই স্বাভাবিক না!”
ঐন্দ্রিলা বুঝতে পারলো অভ্র কিসের জের ধরে আছে। কিছু বলতে গেলেও সে থেমে গেলো। অভ্রও অপেক্ষা করলো না। সে হনহন করে বাথরুমে চলে গেলো। মাথাটা ঠান্ডা করা প্রয়োজন। সেই সাথে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো অভ্র। সিদ্ধান্তটা অতিদ্রুত বাস্তাবায়িত করতে হবে।

সালাম সাহেব বাড়ির বাগানে হাটছেন। পাশে অভ্র। খাওয়ার পর শ্বশুরমশাইয়ের হঠাৎ তলবে খানিকটা অপ্রস্তুত হল অভ্র। কিঞ্চিত ভয় হচ্ছে। লজ্জাও লাগছে। গতকালের ঘটনা তিনি জেনে গেলে ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন জানা নেই অভ্রের। সালাম সাহেব হাটতে হাটতে বাড়ির পেছনে আসলেন। গতকালকের বৃষ্টিতে কাঁদা পানিতে চপচপ করছে জায়গা। সেখানে একটি কাঠের বসার স্থান। সেখানে পেপার বিছিয়ে বসলেন। তার ছাগলের ম্যা ম্যা ডাক কানে আসছে। তিনি ধীর স্বরে বললেন,

“আমি দুটো ছাগল খরিদ করেছি। দেখেছো”
“জি না”
নিচু স্বরে উত্তর দিলো অভ্র। সালাম সাহেব হাসলেন। বেশ স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“এই ছাগল জোড়া আমাদের মাঝে অমিল কি জানো”
অভ্র উত্তর দিলো না। মৌন রইলো। সালাম সাহেব বললেন,
“আমরা হলাম মানুষ। আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ আমাদের মাঝেই বিবেক দিয়েছেন, বুদ্ধি দিয়েছেন। তাই আমাদের দ্বারা ভালো কাজ হয় মন্দ কাজ হয়। আমাদেরকে ভালো কিংবা খারাপের দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায়। ঠিক কি না?”

“জি ঠিক”
“আমরা বাদে অন্য কোনো পশুর মাঝে বিবেক নেই, বুদ্ধি নেই। আমাদেরকে সমাজে যেমন ভালো মানুষ এবং খারাপ মানুষের ভাগে ফেলা যায় ওদের কিন্তু যায় না। কোনো বাঘ মানুষ খেয়ে ফেললে তাকে কিন্তু বলে না তুমি খারাপ বাঘ। বা আমার এই ছাগলগুলো কাল কোনোভাবে আমার প্রাণ বাঁচালেও তাদের বলা হবে না ভালো ছাগল। এটা হয় শুধু মানুষের জন্য। ঠিক না?”

“জি ঠিক”
অভ্র বুঝতে পারছে না তার শ্বশুর আধ্যাত্মিক
কথা কেন বলছে। এই গোলগাল ছোট ভুড়ি ওয়ালা মানুষটির মস্তিষ্কে কি চলছে! সালাম সাহেব আবার বললেন,
“আমাদের মানুষের ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব। আমাদের বিয়ে করতে হয়, সংসার করতে হয়। একটা ভিন্ন মানুষের সাথে আমাদের এই সম্পর্কটা সৃষ্টি শুরু থেকেই আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন। এর মাঝে অদ্ভুত সৃষ্টি মেয়ে। অন্য বাড়ির মেয়ে সব ফেলে একটা পুরুষের সাথে চলে যাবে। সেখানে তার পরিবারের সাথে মিলে থাকতে হয়। আমার মা বলতেন জানো, “শোন বগা, মাইয়্যা মাইনসেরে আল্লাহ বানাইছে অনেক ধৈর্য্য আর মায়া দিয়া। নয়তো অন্য ঘরে সে নিজেকে মানাইতে পারতো না। মাইয়্যা মানুষই পারে এক্কান দালানরে ঘর বানাইতে। তাই তার দুইডা গালিও মাথা নুয়াইয়্যা হুনবি”– এটা কেন বলেছি জানো?”

“জি না”
সালাম সাহেব হাসলেন। তার কন্ঠ এবার আরোও ধীর হলো,
“আমার ধারণা গতকাল তোমার এবং আমার মেয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া হয়েছে। সেই রাগে তুমি বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেছো। পুরুষ মানুষের রাগ দেখানোর জন্য পুরো পৃথিবী আছে। তোমার রাগ হলো তুমি বাহিরে কাউকে একটা ঘুষি মেরে দিলে, কিন্তু মেয়েদের তা নেই। তারা তাদের আপনজনের সামনেই চিৎকার করে, চেঁচেমেচি করে। তাদের সাথে ঝগড়া করে। সেই ঝগড়া লেশ তারা আজীবন টানে। পুরুষও যদি একইভাবে তার সাথে রাগ দেখায়। ঝগড়া করে, রাগ করে বাড়ি না আসে। তাহলে কি সেই সম্পর্ক টিকবে।

সম্পর্কগুলো তুলোর মতো। তাদের আগলে রাখতে হয়, নয়তো উড়ে যায়। পশুদের সম্পর্ক ঠিক রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু মানুষের আছে। তাই বলছি তোমাদের জীবনটা মাত্র শুরু হয়েছে। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি। তুমি গতকাল আরেকটি পঁচা কাজ করেছো। তুমি কাল ঐন্দ্রিলার উপর রাগ দেখিয়ে মদ্যপান করেছো। আমার মেয়েটা সবার আড়ালে তোমাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেছে যেনো কেউ টের না পায়।

আমি জানি কারণ আমি দেখেছি। আমি তোমাকে খারাপ ভালোর ভাগে ফেলবো না। কারণ একটা কাজেই কাউকে খারাপ বা ভালো বলা যায় না। তবে আশা রাখছি তুমি এমনটা হরহামেশ করবে না। স্ত্রীর সাথে রাগ করে মদ্যপান মোটেই ভালো কাজের মধ্যে পড়ে না। আশাকরি তুমি বুঝেছো। তুমি বুদ্ধিমান। তোমার বিবেক আছে, এখন বাকিটা তোমার বিবেক যা বলবে তাই করো। তবে আমার মেয়ে কিন্তু আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। ওর চোখে অশ্রু আমি সহ্য করবো না।”
অভ্র মাথানত করে রইলো। তার মুখ থেকে একটা শব্দ বের হলো না। সালাম সাহেব হাসলেন। গুনগুন করে গাইলেন,

“হায়রে প্রেম আমার,কেন যে বারবার,
তারই কথাই শুধু বলেরে,
যে গেছে হারায়ে,দু’বাহু বাড়ায়ে,
আঁধারে খুজে শুধু মরেরে,
হায়রে প্রেম আমার”

পিউয়ের ধুম জ্বর। বৃষ্টিতে ভেজার কারণে তার রাতে জ্বর আসলো বিনা নোটিশে। সেই জ্বর এখনো কমার নাম নেই। সারা গায়ে ব্যাথা। মনে হচ্ছে একশ হাতি তার উপর দাঁপিয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠার শক্তিটুকু নেই। এরমাঝে শুধু একটু পর পর সকাল থেকে ফোন বাজছে। ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এতো কার ঠেকা পড়েছে! পিউকে এতো কিসের জরুরি তলব। পৃথিবী কি সে ছাড়া অচল। বিরক্তির ঠেলায় সে ফোনটাই বন্ধ করে রেখেছে সে। ঘুম আসছে খুব। একটু ঘুমালে কি ভালো লাগবে। এর মাঝে মায়ের স্বর কানে এলো,
“পিউ কি ঘুমাচ্ছিস মা? দেখ কারা এসেছে।”

পিউ চোখ মেলে তাকালো। ঝাপসা চোখে দেখলো কোথা থেকে একটা ডাক্তারকে রীতিমতো বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে আহাশ এবং নীলাদ্রি। তাদের দেখতেই চোখ কচলে তাকালো পিউ। আহাশ অভিমানী স্বরে বললো,
“তোমার জ্বর এসেছে বলো নি কেনো পিউ আপু?”
পিউ উত্তর দেবার আগেই নীলাদ্রি তার সামনে ডাক্তারকে বসিয়ে বললো,

মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ২২

“এই যে রোগী, নেন চিকিৎসা করেন”
“আরে ভাই আমি তো মানুষের ডাক্তার নই। আমি পশুপাখির ডাক্তার”……..

মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ২৪