মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩৭
মুশফিকা রহমান মৈথি
“গবেষণায় বলে চুমু খেলে নাকি ছয় ক্যালোরি বার্ন হয়। “ফিল গুড” হরমোন নিঃসরণ হয় বলে মেদ গলে। যত আন্তরিকতার সাথে চুমু খাওয়া হয় তত ভালো ফলাফল। দাঁতের জন্যও চুমু বেশ উপকারী। আমার যদিও দাঁতের সমস্যা নেই, তবে বিয়েতে খাওয়াটা বোধ হয় বেশি হয়ে গেছে। হুট করে বিবাহে আমার স্ট্রেসও বেড়ে গেছে। তাই আমি কি তোমাকে চুমু খেতে পারি?”
পিউ শব্দ করে হাসলো। তার হাসি খুব রহস্যময়ী। নীলাদ্রির মনে হলো সে এতোদিন যে পিউকে দেখেছে সেই পিউয়ের সাথে এই পিউয়ের মিল নেই। লাল বেনারসীর এই নারী ভিন্ন, কোনো জটিল গণিতের সমীকরণ, কোনো দুর্লভ ফসিল যার ডিএনএ বোঝার সাধ্য নীলাদ্রির নেই অথবা হতে পারে কোনো দুর্বোধ্য কবিতার শেষ চরণ। প্রকৃতির সেই বিচিত্র রহস্য যা নীলাদ্রি কখনোই স্পর্শ করে নি। নীলাদ্রিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পিউ সকৌতুক স্বরে শুধালো,
“নীলাদ্রি ভাই কি চুমু নিয়ে থিসিস করে এসেছেন?”
পিউয়ের প্রশ্নে কিঞ্চিত লজ্জা পেলো নীলাদ্রি। সে চুমু নিয়ে থিসিস করে নি। এই বিষয়গুলো সেই বয়ঃসন্ধিকালের কৌতুহলের সমাধান মাত্র। বন্ধুদের ঝোপের ভেতর মেয়ে বান্ধবীর সাথে ঘনিষ্ট হবার কারণ বের করতেই এই তথ্যের অনুসন্ধান। কিন্তু সেটা পিউকে বলতে ইচ্ছে হলো না। আসলে বিবাহ করাটা যতটা সহজ বলে ভেবেছিলো নীলাদ্রি, ততটা সহজ নয়। যতই বিবাহের কাছে সময় ঘনিয়ে যাচ্ছে ততটাই মনের মধ্যে আশংকা ডানা মেলছে। ডানা মেলছে বিবাহ পরবর্তী আচারণের। বিবাহ পরবর্তী ধাপ। প্রেমিক হলে এই ধাপ অতিক্রম করাটা হয় সহজ। প্রেমিকার অধরে হুমড়ি খাওয়া প্রেমিকার পক্ষে খুব কঠিন নয়। কোনো ভনিতা লাগে না। কিন্তু তার মতো ব্যক্তি কি করে সূচনা করবে? অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো। সে সারারাত গল্প করেই কাটাবে। কিন্তু কি গল্প করবে? তাই গুগলে টাইপ করলো, “বাসর রাতের গল্প”। ফলাফল যা আসলো তাতে গলা শুকিয়ে গেলো। এসব কি অসভ্য সমাধান! এমন আচারণ করলে পিউ কি ভাববে? না অসম্ভব। পুরুষের কামুকতাকে কখনো তেমন গুরুত্ব দেয় নি সে। সে শুদ্ধ পুরুষ। সুতরাং সে শুদ্ধই থাকবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু সব শুদ্ধতা গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো পিউকে দেখে। প্রতিরোধ, কঠোর প্রতীজ্ঞা মাথা নুয়ে পড়লো। নির্লজ্জের মতো কিছু উপকারিতা সাজিয়ে চেয়ে বসলো উষ্ণ অধর স্পর্শ। এখন নিজের এমন আবদারে নিজেই লজ্জিত হতে হচ্ছে। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সে। পিউ বুঝলো মানুষটি বিব্রতবোধ করছে। তার এমন লজ্জামিশ্রিত মুখখানা দেখে ভীষণ মায়া হলো পিউয়ের। তাই তার কোমল হাতখানা নীলাদ্রির হাতের উপর রাখলো। গাঢ় স্বরে বললো,
“আমি আপনার স্ত্রী নীলাদ্রি ভাই, আমার কাছে চুমু খেতে চাবার জন্য এতো অজুহাতের প্রয়োজন নেই”
“জানি। কিন্তু দ্বিধা হয়। এমন অনৈতিক চাহিদা করলে তুমি যদি রাগ করো। যতই হোক, আমি তো তোমার প্রেমিক নই। প্রেমিক হলে হিসেব ভিন্ন হত”
পিউ হাসলো। আবার সেই রহস্যময়ী হাসি। হাটুতে দু হাত জড়ো করে থুতনি ঠেকালো। মিষ্টি হাসিটা ঠোঁটে এটে বললো,
“কি অদ্ভুত দেখুন, আমার জীবনের প্রেম শব্দটার সূচনা আপনি। অথচ আপনি আমার প্রেমিক নন। আপনাকে নিয়ে আমার শত নির্ঘুম রাতের কবিতা, আমার মনবিণার ভৈরবী রাগের নাম আপনি। আমার মন আপনার জন্য তৃষিত নীলাদ্রি ভাই, কত বসন্ত এই তৃষ্ণা আমি আগলে রেখেছি হিসেব নেই। যে মিষ্টি অনুভূতির জন্য আমি প্রতীক্ষিত, সেই অনুভূতির স্বাদ পেলে আমি রাগ দেখাবো কি করে নীলাদ্রি ভাই?”
পিউয়ের চোখখানা ঝাপসা। হৃদয়টা ভার লাগছে। কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। মানুষ খুব আনন্দের ছোঁয়া পেলে বুঝি আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। এক অচেনা ভয় হয়, ঝুলিভর্তি সুখ হারানোর ভয়। আজ পিউয়েরও সেই ভয়টা হচ্ছে। চোখের অশ্রুগুলো বোকার মত গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। হঠাৎ রুক্ষ্ণ অধরের উষ্ণ স্পর্শ পেলো চোখে। পড়ন্ত অশ্রুটি শুষে নিলো সে। তাতেই ক্ষান্ত হলো না সে। অগণিত চুমুতে ভরিয়ে দিলো সামনের বোকাপুরুষটি। চোখে, গালে, কপালে তার ঠোঁটের ছোঁয়া। পিউয়ের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো উষ্ণ রক্তের ঢেউ। উত্তাল জোয়ারের সর্বগ্রাসী আঘাত হানলো মনতটে। কালবৈশাখী ঝড় থেকেও প্রলয়ংকারী ঝড় উঠলো হৃদয়ে। পুরুষের স্পর্শে শিহরণ বয়ে গেলো সমস্ত শরীরে। নীলাদ্রি তার অশ্রুগুলো সযত্নে মুছে গাঢ় স্বরে বললো,
“তুমি আর কখনো কাঁদবে না পিউ। তোমার কান্না আমার কাছে অভিশাপ লাগে”
পিউয়ের অশ্রুরা সেই আদেশ মানলো না। বোকাপুরুষটিকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। আকুল নিবেদন করে বসলো,
“আমি আপনাকে অসহ্যরকম ভালোবাসি নীলাদ্রি ভাই, আপনার মনশহরে আমাকে একটু ঠাঁই দিবেন?”
নীলাদ্রি তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখলো। অদ্ভুত শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে জটিল অংকখানার সমাধানটা অবশেষে মিলে গেলো। অমীমাংসিত উত্তরটা সে পেয়ে গেছে। সে পিউকে পেয়ে গেছে। যদি এই অনুভূতি ভালোবাসা হয়, তবে সে ভালোবাসে পিউকে। হাজারবার ভালোবাসে। পিউয়ের মুখখানা তুললো আলতো হাতে। তার তিরতির করে কম্পিত ঠোঁটে মিশিয়ে দিলো অধরজোঁড়া। পৃথিবীর সকল অমৃতসুধা বৃথা এই স্বাদের কাছে বৃথা। বারোলো মদ মুখ থুবড়ে পড়বে। একটা সময় বেসামাল হয়ে উঠলো সে। ঠোঁটজোড়াকে মুক্তি দিয়ে গাঢ় স্বরে বললো,
“আমি অনৈতিক দাবি করে বসলে তুমি রাগ করবে পিউ?”
পিউ হাসলো। সেই হাসিতে নীরব সম্মতি ছিলো। শুদ্ধ পুরুষ তার শুদ্ধতাকে অবিলম্বে পরিত্যাগ করে বেসামাল নষ্ট পুরুষে রুপান্তর হলো। তার উষ্ণ স্পর্শে দগ্ধ হলো পিউ। বাহিরে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে। আশ্বিনা বৃষ্টি।
বিয়ে বাড়ি থেকে আসতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অভ্র। শরীর আর চলছে না। আজ কম শ্রম যায় নি। শ্বশুরবাড়ির হাজার ফরমাইশের পর পিউয়ের বাবার সাথে লুকোচুরি। সব মিলেই শরীরের শেষ বিন্দু শক্তিটুকুও নিঃশেষ। ঐন্দ্রিলা এসে গয়নাগুলো খুললো। মেঘ ডাকছে। তীব্র বৃষ্টি হবে। আজকাল রাত হলেই আকাশ বিরহে আচ্ছাদিত প্রেমিকার মতো কান্না শুরু করে। আজ মনে হচ্ছে একটু বেশি বৃষ্টি হবে। তবে আজকের রাতের একটাআ বিশেষত্ব আছে। তা হলো আজ পূর্ণজ্যোৎস্না। নির্মল রুপোর থালার মতো চাঁদখানা নিজের ঐশ্বরিক সৌন্দর্য নিয়ে কালো আকাশে উন্মোচিত হয়েছে। কালো মেঘেরাও তাকে আড়াল করতে পারছে না। আঁধারিয়া আকাশে রুপালী জ্যোৎস্না, সেই সাথে শারদীয়া বৃষ্টি এক অলীক প্রকৃতি। কাঠগোলাপটাও ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সেই বর্ষণে। ঐন্দ্রিলা জানালার দিকে চেয়ে বললো,
“এই অভ্র, বৃষ্টিতে ভিজবি?”
“ক্ষেপেছে?”
অভ্র কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠলো। ঐন্দ্রিলা তার উত্তরে অপ্রসন্ন স্বরে বললো,
“চল না ছাদে। কি সুন্দর বৃষ্টি। একটু ভিজি। এতো আনরোমান্টিক কেনো তুই?”
অভ্র তার হাত সরিয়ে চোখ মেললো। নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“রোমান্স করতে চাইলে আমার কাছে আয়, প্রেমের বৃষ্টিতে ভেজাচ্ছি। এই রাতদুপুরে শেওড়াগাছের পেত্নীর মতো ছাদে বৃষ্টিবিলাশ করতে হবে না”
অভ্রের কন্ঠে মৃদু ঠান্ডার আমেজ। ঐন্দ্রিলা কপাল কুঁচকে ক্ষুদ্ধ স্বরে বললো,
“মর তুই”
“ঐন্দ্রি, ঠান্ডা লাগবে”
ঐন্দ্রিলা পাত্তা দিলো না। তরতর করে সিড়ি বেয়ে উঠে গেলো। এই অলীক রাতের মোহ কাটাতে পারলো না যেন।
ঝুমঝুম শারদীয়া বর্ষণ। শীতল বর্ষণের মাদকতায় দু হাত মেলে ভিজছে ঐন্দ্রিলার তুলতুলে দেহ। শাড়িটা লেপ্টে আছে পেলব শরীরে। অভ্র হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের লোহার গেটের ধারে। রাত বিরাতে নিজের স্ত্রীকে একা ছাড়তে পারে নি সে। বলা তো যায় না, কারোর নজর যদি পরে। যেমনটা তার হয়েছে। তার গাঢ় নয়ন আটকে আছে লাস্যময়ীর দিকে। আলোআঁধারিয়ায় তার প্রলেপ স্পষ্ট। পুরুষ কি এমন ভাঁজেই সুখে খুঁজে? পূর্ণচন্দ্রিমার রুপালী আলো, শীতল বারির জলকেলি আর তার পুতুল। স্বর্গীয় স্বাদ বুঝি এটাই। এমন সৌন্দর্য্যে মহাকাব্য লিখে ফেলতে পারবে যেনো অভ্র। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বুকে হাটতে হাটতে খুঁজে পাওয়া এই তো সেই শান্তি, সেই বনলতা সেন। নিজেকে জীবনানন্দ দাশ মনে হলো যেনো অভ্রর। হাসলো। বৃষ্টির শীতলতাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলো সে ঐন্দ্রিলার কাছে। হাতের বেষ্টনীতে বাঁধলো পুতুলকে। শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে অনাবৃত শীতল উদরে হাতের স্পর্শ পেতে কেঁপে উঠলো ঐন্দ্রিলা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অভ্রর দিকে। নেশাতুর চাহনী ঐন্দ্রিলা। তার ঠোঁটে চুমু খেলো অভ্র। মিষ্টি স্বরে বলল,
“ঘরে যাবি না”
ঐন্দ্রিলা দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরল। চোখে চোখ রেখে বললো,
“দেখ চাঁদটা কি সুন্দর”
“আমার চাঁদ আরোও সুন্দর”
অভ্রর ভেজা গলদগম্ভীর নয়নে বুকের ভেতরে ঝড় উঠলো ঐন্দ্রিলায়। তুমুল আবেগের ঝড়। ছাঁদের কর্নিশের কাঠগোলাপ গাছ, এই নিটল পূর্ণিমা আর শারদীয়া বর্ষণকে সাক্ষী রেখে দেখালো মস্ত বড় নির্লজ্জতা। পায়ের পাতার উপর ভর করে ভেজা ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিলো অভ্রর নিকোটিনে পোঁড়া ঠোঁটে। চুম্বন কতটা দীর্ঘ হলো সেই হিসেব রাখলো না। নিঃশ্বাসে টান পড়লে সরে এলো। মাতাল কন্ঠে বললো,
“আমি খুব ভাবে ফেঁসে গেছি অভ্র, না চাইতেও তোর মায়ায় আটকে গেছি। আমি বোধ হয় তোকে অশৈল্যভাবে ভালোবেসে ফেলছি, যা আমার স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই ভালো কিছু নয়”
“ভালোবেসে ফেলেছি” কথাটা শুনতেই মস্তিষ্কের নিউরনে আলোড়ন জাগলো। স্তম্ভিত হলো অভ্র। কিন্তু তার পুতুল আজ সব দায়রা ভেঙ্গে তাকে কাছে চাইছে। শারদীয়া বৃষ্টিবিলাশের পর সে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে প্রেমের বৃষ্টিতে ভেজার লোভে। একটু একটু করে সেই উন্মাদনায় টগবগ করে উঠলো পুরুষের নিষিদ্ধ চেতনা। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে সব প্রতিরোধ। মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে দুটো প্রাণ। একে অপরের মাঝে ডুবে যাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।
অভ্রর বুকে লেপ্টে আছে ঐন্দ্রিলা। ঘনঘন নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে। কিন্তু অভ্রর চোখে ঘুম নেই। ঐন্দ্রিলা তাকে ভালোবাস্তে শুরু করেছে। যে চোখে ঘৃণা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত সেই চোখে এখন কেবলই আবেগ, প্রেম। নারীর প্রেম ভয়ংকর। তারা ভালোবাসে না, আরাধনা করে। সেই আরাধনার তাপ লাভার মতো গিলে ফেলে সব কিছু। অভ্র তার আধিপত্য চেয়েছিলো, আরাধ্য হবার ইচ্ছে ছিলো না। আসক্তি হতে চেয়েছিলো, প্রেম নয়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপরাধবোধ জানান দিচ্ছে। ঐন্দ্রিলার শান্ত মুখখানার দিকে তাকালেই ব্যথা হচ্ছে। এই ভালোবাসা শব্দটির ভার সহ্য হচ্ছে না। মাথা ব্যথা করছে। অসময়ে বৃষ্টিতে ভেজার ফল? নাকি ঐন্দ্রিলার ভালোবাসার বর্ষণে ভেজার ফল? ভালোবাসার বিপরীতে ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে হয়। নয়তো পাপীর খাতায় নাম লিখাতে হয়। পুতুলের প্রতি নিষ্ঠুর আকর্ষণ থাকে, মোহ থাকে। ভালোবাসা কি থাকে? ঐন্দ্রিলা কি তার মোহ নাকি ভালোবাসা? মাহাবুল হক কি কাউকে হৃদয় বিকিয়ে দিতে পারে? আর চিন্তা করতে পারছে না। চোখের পাতা ভারী হচ্ছে। মাথাব্যথা করছে। জ্বর আসবে? প্রেমজ্বর?
অভ্র তিনদিন পর আজ ঘর থেকে বের হচ্ছে। মাঝে তীব্র জ্বর হলো। ঐন্দ্রিলার অপরাধবোধ হলো। সে জানে মানুষটির ঠান্ডার বাতিক তবুও অন্যায় আবদার করেছে। সাধ্য অনুযায়ী সেবাও করেছে। অভ্রর কাছে এই অনুভূতিটা নতুন। ঐন্দ্রিলার এমন কোমলতা তার জন্য বরাদ্দ ছিলো না কখনো। কিন্তু মেয়েটির সবকিছুতে এখন সে। আধিপত্যের সাথে সাথে আরাধ্য হবার ভার অনুভূত হচ্ছে। সেও স্বামীর সকল দায়িত্ব পালন করছে। আজ ঐন্দ্রিলাকে কলেজ থেকে আনতে গিয়েছে। খরখরে রোদে বাইশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেছে। চমকে দেবার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু মেয়েটি এখনো বের হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই ভেতরে গেল সে। ক্যাফেটেরিয়া পার হতেই দেখা মিললো দু বান্ধবীর। ঐন্দ্রিলা অভ্রকে দেখে সত্যি চমকে গেলো। কিন্তু তার মুখে একটা লুকোচুরি ভাব প্রকাশ পেলো। হঠাৎ নজরে পড়লো ঐন্দ্রিলা কনুই চেপে রেখেছে। সেখান থেকে গলগল করে পড়ছে তাজা রক্ত। রক্ত দেখতেই মাথা ঘুরে উঠলো অভ্র। মুখখানা কঠিন হয়ে গেলো। মাথায় রক্ত উঠে গেলো। স্নায়ু কাজ করছে না। মেঘস্বরে জেরা করে উঠলো,
“হাতে লাগলো কি করে?”
ঐন্দ্রিলা উত্তর দিতে চাইলো না। কিন্তু পিউ চুপ থাকলো না। গরগর করে বললো,
“ওই যে ছাত্রদের নেতা আছে না আশরাফ, ও বাইক দিয়ে ধাক্কা দিয়েছে ঐন্দ্রিলাকে। ইটের উপর পড়ে কি বাজে ভাবে কেটে গেছে দেখ। ও ইচ্ছে করে কাজতা করেছে। ক্ষমতার জোর দেখায় সবসময়। আস্তো বেয়াদব”
“কোথায় পাবো আমি তাকে?”
হিম কন্ঠে বুক কাঁপলো ঐন্দ্রিলার। অভ্রর হাত ধরে বললো,
“ঝামেলা করিস না। ছেলেতা ভালো না”
কিন্তু অভ্র শুনলো না। ফাঁকতালে পিউ বলে দিলো,
“অশ্বথ গাছের নিচে দল নিয়ে সিগারেট খাচ্ছে
অভ্রর শিরা উপশিরার রক্ত টগবগ করে ফুটছে। রাগে তার গা কাঁপছে। তার পুতুলকে ব্যথা দেবার কথা কেউ কল্পনাও কিকরে করে? এদিকে তার রুদ্রমুর্তিতে ভয় প্রগাঢ় হলো ঐন্দ্রিলার। একবার এক জুনিয়র ঐন্দ্রিলার প্রতি নিষিদ্ধ চিন্তা করেছিলো বলে তাকে বেদম পিটিয়েছিলো অভ্র। আজ হয়ত খু’ন করে ফেলবে। ঐন্দ্রিলা বাঁধা দিতে চাইলো কিন্তু শুনলো না অভ্র। হনহন করে অশ্বথ গাছের কাছে গেলো। আশরাফ সেখানে দু পাঁচটা ছেলের সাথে সুখটান দিচ্ছে গাঁজার স্টিকে। গাঁজার গন্ধে নাড়িভুড়ি উগড়ে যাবার যোগাড়। এই ছেলেটিকে সবাই এড়িয়ে চলে। একেই রাজনীতি করে, উপরন্তু অভদ্র এবং অসভ্য। বাজে স্বভাব তো আছেই, সেই সাথে অর্থের গরম আছে। কাউকে পরোয়া করে না। কিন্তু অভ্র জেদি স্বভাবে তার স্বভাব খাটল না। একপ্রকার নির্ভীক চিত্তে তার সামনে দাঁড়ালো। আশরাফ গাঁজায় রক্তিম চোখ তুলে হুংকার ছাড়লো,
“কি চাই?”
অভ্র উত্তর দিলো না। একহাতে তার কলার ধরে টেনে তুললো। তারপর ছিটকে ফেললো মাটিতে। আশরাফের সাঙ্গপাঙ্গ্রা তটস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অভ্র ক্ষান্ত রইলো না। বেধরক মা’রতে লাগলো। ঘায়েল বাঘের মত গর্জালো,
“আমার পুতুলের গায়ে হাত দেবার সাহস হলো কি করে তোর? জানোয়ার কোথাকার”
মা’রের ফলে আশরাফের গাল ফুলে গেলো। গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো। কিন্তু অভ্র থামলো না। উন্মাদের মতো তাকে ঘু’ষির পর ঘু’ষি মা’রতে লাগলো। আশরাফ প্রতিরক্ষাও করতে পারলো না। তার ঠোঁট কেটে ঝুলে গেলো। সে আধমরার মত মা’র খাচ্ছে। তার দলবল ঠেকাতে এলো, কিন্তু অভ্রর মাথায় খু’ন ভর করেছে। আজ প্রা’ণ নিতেও তার কোনো দ্বিধা নেই। কলেজে সকলে জড়ো হয়ে গেলো। আতঙ্ক গুঞ্জন শোনা যেতে লাগলো। ঐন্দ্রিলা ছুটে গেলো অভ্রকে থামাতে। পাছে অঘটন না হয়। অভ্র হাত ধরে অনুরোধ করলো,
মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৩৬
“অভ্র ছেড়ে দে”
কিন্তু অভ্র তার সজ্ঞানে নেই। সজোরে ধাক্কা দিকে হাত ছাড়িয়ে আবার পেটাতে লাগলো আশরাফ ছেলেটিকে। হঠাৎ চিৎকার কানে এলো পিউয়ের,
“অভ্র, ঐন্দ্রিলা”
অভ্র থেমে গেলো। আধমরা আশরাফের কলার ছেড়ে পেছনে ঘুরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অভ্র। ভাঙ্গা ইটের স্তুপে নিথর পড়ে আছে ঐন্দ্রিলা। তার মাথার পেছন থেকে বইছে টকটক রক্তিম লোহুস্রোত………