মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ শেষ পর্ব (১)
মুশফিকা রহমান মৈথি
“আমি ভেবেছি, অভ্রকে এবার ওর টাকা বুঝিয়ে দিবো বউমা। অনেক তো হলো লুকোচুরি। সে তার কথা রেখেছে। বিয়েটা করেছে। নাতবউয়ের ভালোবাসা আদায় করেছে। সে আমার দেওয়া সব শর্তই পূরণ করেছে। এবার এই টাকাটা তার প্রাপ্য। কি বলো?”
আউওয়াল সাহেবের কথাগুলো কানে আসতেই পা আটকে গেলো ঐন্দ্রিলার। মস্তিষ্কে তীব্র ঝাকুনি খেলো যেনো। স্তব্ধ হয়ে গেলো চিন্তাশক্তি। বোঝার চেষ্টা করলো শ্বাশুড়ী এবং দাদা শ্বশুরের কথোপকথন। কানন শ্বশুরের প্রস্তাবে প্রসন্ন স্বরে বললো,
“যা ভালো মনে করেন বাবা। তবে আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ভাগ্যিস টাকার মুলো ঝুলালেন। নয়তো আমার ছেলেটা কখনো বিয়ে করবে এমন কল্পনা স্বপ্নেও আনতে পারি নি। ছেলেটার অবশেষে একটা হিল্লে হলো। যখন হুট করে জেদ ধরলো ঐন্দ্রিলাকে বিয়ে করবে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বিয়ের নাম শুনতেই ছ্যাৎ করে উঠা ছেলে আমার বিয়ের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। পরে জানতে পারলাম, আপনি তাকে নতুন দোকানের জন্য টাকা দিবেন। সব ভালো হচ্ছিলো কিন্তু বিয়ের সময় যা ঘটনা ঘটলো, আমি তো ভয়েই ছিলাম। একেই আমার ছেলের কোনো জিনিসের প্রতি মন টিকে না, উপর থেকে ঐন্দ্রিলার সম্মতি নেই। এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি? জেদের জন্য বিয়ে কি টিকে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এজন্যই আমি শর্তটাকে আরোও বাড়ালাম। বললাম, যদি একবছরের মাঝে নাতীর মুখ না দেখায় তবে আমিও টাকা দিবো না। আমার নাতীও শর্ত মেনে নিলো। বাকুয়ী বংশের ছেলে তো শর্তে হারার পাত্র না। তবে মানতেই হবে নাতীর মুরোদ আছে। ঠিক ঐন্দ্রিলাকে নিজের বশে নিয়ে এসেছে। যে মেয়ে তাকে দেখলেই খ্যাক করে উঠতো সেই মেয়ে তাকে চোখে হারায়। জন্মদিনে তার জন্য রান্না করছে, ভাবা যায়? এখন আমার চিন্তা নেই বৌমা। আমার প্রপৌত্রের মুখ দেখে এখন মরতে পারবো। তাই চিন্তা করেছি, শুধু টাকা নয়, ঘাটের জমিটাও ওর নামে লিখে দিবো। কি বলো বৌমা?”
ঐন্দ্রিলার মনে হল তার পুরো শরীরটা অসাড় হয়ে গেছে। সত্যের তীব্র আঘাতে তার তিলে তিলে গড়া বিশ্বাস টলমলে হয়ে গেলো। সংসার সংসার বলে অকৃত্রিম মায়ায় জড়িয়েছিলো তা কি কেবল ছলনা ছিলো? সব মিথ্যে ছিলো? শুধু টাকার জন্য অভ্র তার সাথে নাটক করেছে? এত যত্ন, আহ্লাদ, স্নেহ সবই কি মিথ্যে ছিলো? সব কিছু কেবল ঠুংকো শর্তের জন্য? আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরে গেলো। বিছানায় বসলো সে। ঘরময় সুখময় স্মৃতি। দেওয়ালও সাক্ষী দিচ্ছে তাদের মুহূর্তগুলো।
মাথার পেছনটা তীব্র ব্যাথায় ঝাঝিয়ে উঠছে। ঘরের প্রণয়মুহূর্তগুলো খুব তিতকুটে লাগছে। বিছানার উপর শাড়িটা পড়ে আছে। অভ্রর জন্য একটা কালো ঘড়ি কিনেছিলো। বাহিরে যেতে পারছে না বলে অনলাইনে অর্ডার করেছিলো সে। ঘড়িটা বিছানার উপর ই রাখা। ঘরটাকে সাজানোর জন্য কত কিছুর ব্যবস্থা করেছিলো সে। এখন সব বৃথা লাগছে। বিছানা থেকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা দেখা যাচ্ছে। সেই আয়নায় ক্লান্ত দৃষ্টিতে লাগলো সে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখতেই তিক্তটা বাড়লো বাজে ভাবে। এতোটা অথর্ব সে? একটা মানুষ কি করে বারবার মানুষ চিনতে ভুল করে? নিজের নির্বুদ্ধিতার উপর প্রচন্ড রাগ হলো। সেই সাথে নিজের উপর জমলো ঘৃণা; এতো ভালোবাসার লোভ কেনো তার? ক্রোধ, বিতৃষ্ণা, বিষাদে ঝাঁঝরা হয়ে উঠলো সে। বিছানার পাশে রাখা তাদের দুজনের ফটোফ্রেমটা ছুড়ে মারলো সে আয়নার দিকে। হলুদের ছবি, যেখানে অভ্র একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুহূর্তেই তীব্র ঝংকার তুলে গুড়িয়ে পড়লো আয়নাটি। ফটোফ্রেম ভেঙ্গে কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো মেঝেতে। অবহেলায় পড়ে রইলো ছবিটি। ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে। মানুষের চোখও নাটক করতে পারে বুঝি?
ঘরময় হুলস্থূল কান্ড। ঘরের নিষ্পাপ জিনিসগুলো নিজের আহুতি দিলো বিনা কারণে। ভাঙ্গা কাঁচ, এলোমেলো বিছানা চাঁদর, ভাঙ্গা শোপিচ, ফুলদানি, মাটিতে অবহেলায় পড়ে থাকা শাড়ি সাক্ষী দিচ্ছে ঐন্দ্রিলার আহত হৃদয়ের। ঐন্দ্রিলার চাহনী শান্ত। অশ্রু শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে চোখের নিচে। ভাঙ্গা কাঁচে পা টা কেটে গেছে, রক্ত পড়ে জমাট বেঁধে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে কিন্তু অনুভূতি শুন্য। ফোন বাজছে অক্লান্তভাবে। অপরপাশের মানুষটির বেশ ধৈর্য্য। সে অক্লান্তভাবে ফোন দিচ্ছে শুধু। ঐন্দ্রিলা নির্লিপ্ত চাইলো ফোনের দিকে।
অভ্র নামটা জ্বলজ্বল করছে। এখন ঐন্দ্রিলার ঔষধ খাবার সময়। নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেবার জন্য ফোন করেছে। প্রতিদিন সে বাঁধাধরা সময়গুলোতে ফোন দিবেই। এটা একেবারে নিয়মমাফিক। ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। ফোনটা ধরা হলো না। কেটে গেলো বাজতে বাজতে। মনটা আবার দূর্বল হয়ে গেল। ভালোবাসার ক্ষুধার্থ হৃদয় মস্তিষ্ককে বুঝালো, “ভুল হচ্ছে, কোথাও ভুল হচ্ছে। কেউ সারাক্ষণ নাটক করতে পারে না। একটা মানুষ সারাক্ষন মিথ্যের মুখোশ পড়ে থাকতে পারে না”।
ঠিক ই তো, অভ্র কখনো তার উপর সম্পর্ক চাপিয়ে দেয় নি, ধৈর্য্য ধরেছে তার মনের দরজা খোলার। দূর্ঘটনার পর থেকে মানুষটি তাকে পুতুলের মত আগলে রেখেছে। যেনো একটু রুঢ়তা তাকে ভেঙ্গে ফেলবে, গুড়িয়ে দিবে। একটা মানুষ তো সারাক্ষণ নাটক করতে পারে না। কোথাও একটা ভুল নিশ্চয়ই হচ্ছে। অভ্রর সাথে কথা বললে বোধ হয় সব সমাধান হয়ে যাবে। ঐন্দ্রিলা ফোনটা হাতে নিলো। অভ্রর নাম্বারে ফোন দিলো কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ। ফলে সে উঠে দাঁড়ালো। পা থেকে এখনো চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়ছে। তীক্ষ্ণ ব্যাথা মস্তিষ্ককে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তবুও ঐন্দ্রিলা হাটতে লাগলো। গন্তব্য অভ্র। অনেক প্রশ্ন বাকি। উত্তর চাই।
বিল্লালের মাথার চুল ছেড়ার যোগাড়। কখন থেকে কিছু হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মিলছে না। একশত আটষ্টটি টাকার একটা গ্যাপ থেকেই যাচ্ছে। হিসেব এমন একটি জিনিস যা যতক্ষণ না পর্যন্ত মিলবে ততসময় পর্যন্ত বিরক্তি কাটে না। মিললে শান্তি, আর না মিললে মাথার প্রতিটি নিউরণে এতো উন্মাদ হয়ে উঠে যে চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। ঘড়ির দিকে একদফা তাকালো। তৃষা অপেক্ষা করছে। তার যাওয়া উচিত। গতরাতে মাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা বলেছে সে। বিল্লালের বাবা গত হয়েছে আজ পনেরো বছর। মা-ই তার সব। বিল্লালের মাও ছেলেঅন্তপ্রাণ। তাই তো ছেলের পছন্দে তার দ্বিমত নেই। শুধু একটাই চিন্তা সেটা হলো, তৃষার পরিবার।
স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে সে। তাদের মতো পরিবারে মানিয়ে নিতে পারবে? বিল্লালের মা একটা ছোট এনজিওতে চাকরি করতেন। সেই টাকা দিয়ে টেনেটুনে সংসার, ছেলের পড়াশোনা চালাতেন। ছেলে অনার্সটা শেষ করেই অভ্রর সাথে ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। যেহেতু তার নিজের কোনো অর্থ নেই, তাই সে ম্যানেজার হিসেবেই ছিলো। অভ্র বন্ধুর জায়গাতেই তাকে রেখেছে। কখনো কর্মচারীর মতো আচারণ করে নি। বিল্লালের যা বেতন, তাতে মোটামুটি মা-ছেলের বেশ ভালোভাবেই চলে যায়।
সম্পত্তি বলতে দাদাবাড়ি থেকে পাওয়া তিনটি ঘর আর বিল্লালের একটি মোটরসাইকেল। সেখানেই তাদের অবস্থান। তৃষা এই সবকিছু জানে। তবুও সে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবগত। নীলাদ্রির মত ছেলেকে যদি সরকারি চাকরির মুলো ঝুলায় শ্বশুর তাকে না জানি কোন অস্ত্রে বধ করে। অভ্রকে জানিয়েছে ব্যাপারখানা। বিল্লাল চেয়েছিলো একটা ভালো বেতনের চাকরি খুজতে কিন্তু তাতে অভ্রর চাকরি ছাড়তে হতো। এতো বিশ্বাসী মানুষ এবং বন্ধুকে হারাতে চায় না অভ্র। তাই অভ্র তাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছে। অভ্র তাকে তার ব্যবসার পচিশ শতাংশের মালিকানা দিতে চায়। যার মুল্য বিল্লাল কখনো তাকে ছেড়ে যাবে না। বিল্লাল এই ব্যবসার পেছনে কম শ্রম দেয় নি। এই ব্যবসার সাফল্যে বিল্লালের ভূমিকা অনেক। তাই তাকে পচিশ শতাংশের অংশীদারিত্ব দেওয়া ভুল নয়। তাই বিল্লালের কাজের চাপ বেড়ে গেছে। আগামীকাল তৃষার বাবার সাথে দেখা করবে সে। তাই এই হিসেবের ঝঞ্জাট আজ শেষ করবে। কিন্তু তৃষার সাথে দেখাও করতে হবে। মেয়েটির ছুটি হয়ে যাবে। বিল্লাল আবার হিসেবে মুখ গুজলো।
“বিল্লাল সাহেব কি ব্যস্ত?”
চিকন মেয়েলী কন্ঠে চোখ তুলে তাকালো বিল্লাল, হতবাক স্বরে শুধালো,
“একি, তুমি এখানে?”
“কেনো আসা বারণ? পাপ করে ফেললাম?”
তৃষার প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো বিল্লাল। ব্যস্ত হয়ে বললো,
“না, না সেটা কখন বললাম? তুমি ভুল বুঝছো”
“বুঝেছি, বুঝেছি। আর কথা ঘুরিও না। তোমার কাছে আসি নি। এসেছি, ব্যাংকের বার্তা নিয়ে। অভ্র কোথায়? ওকে ফোনে পাচ্ছি না”
“ও একটা ক্লাইন্টের কাছে গেছে। আমাকে বলো”
“আচ্ছা, কাল একবার ব্যাংকে এসো তো। ঢাকা থেকে ভিজিটে আসছে। অভ্রর লোন বাড়ানো নিয়ে কথা হবে। এই নাও লেটার। আমি চললাম”
বলে যেতে নিলেই হাত টেনে ধরলো বিল্লাল। তৃষাকে নিজের কাছে টেনে শুধালো,
“তাহলে আমার কাছে আসো নি?”
“আজ্ঞে না”
“কষ্ট পাইলাম কিন্তু”
“পাও, আমার কি?”
“এভাবে প্রেমিককে শাস্তি দিলে কিন্তু ভোগান্তি আছে”
“কি ভোগান্তি?”
বিল্লাল কথাটা শেষ করার সুযোগ পেলো না। তার পূর্বেই এলোমেলো ভঙ্গিতে প্রবেশ করলো ঐন্দ্রিলা। তাকে খুব অন্যরকম লাগলো যেনো। চোখ মুখ শুষ্ক, মলিন। এসেই শুধালো,
“অভ্র আছে?”
বিল্লাল সেপ্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালটা শুধালো,
“তোমাকে এমন লাগছে কেনো? শরীর খারাপ নাকি?”
“আমি ঠিক আছি, অভ্র কোথায় সেটা বলো। ওর ফোনটা বন্ধ আসছে”
“ক্লাইন্টের সাথে গেছে। তুমি বসো না?”
ঐন্দ্রিলার কিছু ভালো লাগছে না। অভ্রর সাথে কথা বলাটা জরুরি। খুব জরুরি। তাকে অন্যমনস্ক দেখে তৃষা চেয়ারটা এগিয়ে বললো,
“তুমি বসো ঐন্দ্রিলা। তোমাকে অসুস্থ লাগছে”
এতোসময় বাদে তৃষাকে খেয়াল করলো ঐন্দ্রিলা। তৃষাকে দেখতেই হৃদয়ের তিক্তটা আরোও গাঢ় হলো। নিজের বৈশিষ্ঠ্যর বিরুদ্ধে সে জঘন্য একটি কাজ করে বসলো। অহেতুক তৃষাকে কথা শুনিয়ে দিলো, তাও কটু কথা। রুঢ় স্বরে বললো,
“তুমি এখানে কি করছো?”
তৃষা বেশ অপ্রস্তুত হলো ঐন্দ্রিলার কন্ঠে। বিল্লালের দিকে তাকালো একবার। নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে সহজ গলায় বললো,
“অভ্রর কাছে এসেছিলাম, ব্যাংকের বিষয়ে। একটা নিউজ দেবার ছিলো”
“তুমি কি ডাকবাহক? না মানে তোমার ই আসতে হয়েছে? আর কেউ ছিলো না?”
খুব তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালো ঐন্দ্রিলা। এটা ভুল নয় যে এই সামান্য বিষয়ে তৃষার আসার প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু সে এসেছে বিল্লালের সাথে দেখা করতে। তৃষা কথাটা চেপে গেলো। নিচু স্বরে বললো,
“ছিলো, কিন্তু নিউজটা দেওয়া খুব জরুরি ছিলো। অভ্র আমার ফোন ধরছে না আমার, তাই আসা……”
“আচ্ছা তৃষা, তোমার সমস্যাটা কি বলো তো!”
“বুঝলাম না ঠিক”
“মানে টা খুব সহজ তৃষা। তুমি ছেলেমানুষ নও। অভ্র বিবাহিত। ক্লাস টেনের অপূর্ণ প্রণয় এখন পূর্ণ করার স্বপ্ন থাকলে আমি বলবো তুমি স্বপ্নটা ছেড়ে দাও তৃষা। নানা উছিলায় অভ্রর আগে পেছনে ঘোরা, তার সাথে গলে গলে পড়া ব্যপারগুলো দৃষ্টিকটু। সেদিনের ঘটনা কিন্তু আমি ভুলি নি তৃষা। তুমি যদি ভেবে থাকো আমার বরের গায়ে তুমি ঢলে পড়বে আর আমি চুপ থাকবো তবে ভুল। আমি আমার জিনিস কারোর সাথে ভাগ করায় অভ্যস্ত নই। যদি আমার জিনিস নিতে হয় তবে তোমাকেও তার কঠিন দাম দিতে হবে”
ঐন্দ্রিলার কথাগুলো চাবুকের মতো আঘাত করলো তৃষার আত্নসম্মানের দেওয়ালে। কান ঝাঁঝিয়ে উঠলো। ইহজীবনে তার চরিত্রে এমন কালিমা কেউ লেপ্টে পারে নি। সে কি না বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইছে? এতো বড় মিথ্যে অপবাদ? তীব্র অপমানে মুখ লাল হয়ে উঠলো মেয়েটির। বিল্লাল ঐন্দ্রিলার উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাবিআপু, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে”
“না, আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না বিল্লাল। আমি তো না জেনে বলছি না”
তৃষা তখন প্রতিবাদ করে উঠল তীব্রভাবে,
“তুমি আসলে কিছুই জানো না ঐন্দ্রিলা। তুমি আসলে কুয়োর ব্যাঙ, যার কাছে আকাশটা খুব ছোট আর গোল। তাই তো আজ আমাকে অপবাদ দিতে তোমার বাধছে। শোনো ঐন্দ্রিলা, আমার ঠ্যাকা পড়ে নি তোমার বরকে নিয়ে টানাটানি করবো বা তার উপর গলে পড়বো। এই সবকিছু তোমার বরের পরিকল্পনা ছিলো। আমার টার্গেট ফিলাপে ক্লাইন্ট দরকার ছিলো, আর তোমার বরের তোমাকে প্রেমে ফেলতে একটা মেয়েসঙ্গ। তাই আমরা একে অপরকে সাহায্য করেছি এতোটুকুই। অভ্র জানতো তুমি মুখে যাই বলো না কেনো তুমি একটা বোকা মেয়ে। প্রেমে পড়তে তোমার সময় লাগবে না। অন্য বউদের মতো তুমিও অভ্রকে কারোর সাথে সহ্য করবে না। নিজে হেটে ওর কাছে ধরা দিবে। আর ওর পরিকল্পনা সফল হবে। তুমি ওর প্রেমে ধরা দিলে, ওর সাথে সুষ্ঠুভাবে সংসার করলে তো দাদার কাছ থেকে সে টাকা পেয়ে যাচ্ছে। আফটার অল সে তো টাকার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছে।“
বিল্লাল তৃষাকে বাঁধা দিতে চাইলো, কিন্তু সে থামলো না। ঐন্দ্রিলা স্তব্ধ তাকিয়ে রইলো। ছলছল করছে তার চোখে ভাঙ্গা স্বপ্নের হাহাকার। তৃষা তোয়াক্কা করলো না তার ভঙ্গুর মনোস্থিতি। বিদ্রুপ টেনে বললো,
“তুমি তো মনে হয় জানোও না তাই না? অভ্র তোমাকে টাকার জন্য বিয়ে করেছে। দোকান করতে এডভান্স লাগতো। তুমি সেই টাকা পাওয়ার মাধ্যম। আর আমি তোমাকে প্রেমে ফেলার মাধ্যম। আমার এতো খারাপ দিন আসে নি যে অভ্রকে নিয়ে চিন্তা করবো”
ঐন্দ্রিলার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে কেউ ভোতা ছুরি দিয়ে আঘাতের মত আঘাত দিতে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে হৃদয়টা। এতোদিন খুব যত্নে লালিত প্রণয়ফুলটাকে কেউ রুক্ষভাবে উগড়ে ফেললো যেনো। বারবার স্বার্থান্বেষী মানুষদের স্বার্থ উদ্ধারের মাধ্যমই কেনো হয় সে? প্রথমে সৌরভ, এখন অভ্র। সবাই শুধু স্বার্থের দায়েই তার সাথে ভালোবাসার নাটক করে। কি নির্মম পরিহাস ভাগ্যের। ঐন্দ্রিলা আর দাঁড়াতে পারলো না। চলে যেতে নিলে বিল্লাল বললো,
“ভাবিআপু কোথায় যাচ্ছ? আমার মনে হয় তোমার অভ্রর সাথে কথা বলা জরুরি”
ঐন্দ্রিলার কঠিন স্বরে উত্তর দিলো,
“কোনো প্রয়োজন নেই, আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি”
বলেই সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা বাড়ালো। বিষন্ন মনটাকে জোর করে টেনে নেওয়া শুধু।
বিল্লাল বারবার অভ্রকে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু ফোনটা বন্ধ। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে রাগী স্বরে তৃষার উদ্দেশ্যে বললো,
“কি প্রয়োজন ছিলো তৃষা এতো কথা বলার?”
তৃষা শক্ত মুখে বসে ছিলো। বিল্লালের এমন কথায় তার ছাইচাপা রাগ স্ফুলিঙ্গের রুপ নিলো। ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,
“প্রয়োজন ছিলো, ঐন্দ্রিলার একটু রিয়েলিটি চেক হওয়া প্রয়োজন। আর তুমি এখন ঐন্দ্রিলার পক্ষ নিয়ে মোটেই কথা বলবে না বিল্লাল”
“তৃষা শান্ত হও”
“না আমি শান্ত হব না। কেউ আমার চরিত্রে আঙুল তুলবে আর আমি চুপ করে বসে থাকবো? আমি কি ফেলনা মেয়ে? কোনো চিপ, ক্যারেক্টরলেস মেয়ে নাকি যে বিবাহিত পুরুষকে চাইবো? আর তুমি আমাকে বলছো শান্ত হতে! নাকি তুমিও আমাকে এমন মেয়ে ভাবো বিল্লাল? এজন্য কি আমাকে এড়িয়ে যেতে তুমি?”
তৃষার প্রশ্নের বানে ক্ষতবিক্ষত হলো বিল্লাল। মেয়েটির মুখমন্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। মুখভাব কঠিন। বিল্লালকে চুপ করে থাকতে দেখে তৃষা আরোও অধৈর্য্য হলো৷ চাপা আর্তনাদ প্রকাশ পেলো,
“তুমি চুপ করে আছো কেনো?”
“কারণ আমি এখন যাই বলি না কেনো তুমি বুঝবে না। তাই বলছি ঠান্ডা হও। তুমি ঠান্ডা হলে আমি উত্তর দিবো”
“আমি ঠান্ডাই আছি। বেশি কথা বলবে না। আমার প্রশ্নের উত্তর আগে দাও। আমাকে কেনো এড়িয়ে চলতে? আমাকে এতো অপছন্দ করতে কেনো তুমি?”
“কারণ আমি তোমার প্রেমে পড়তে চাই নি”
তৃষা স্তম্ভিত হলো। এমন উত্তরের জন্য যেনো প্রস্তুত ছিলো না সে। বিল্লাল মৃদু স্বরে বললো,
“আমি কখনো তোমার প্রেমে পড়তে চাই নি তৃষা, তুমি বাধ্য করেছো। নয়তো আমি স্বপ্নেও ভাবি নি ক্লাসের নেকুপিসির প্রেমে আমি আপাদমস্তক ডুববো। তাই এড়িয়ে যেতাম”
তৃষা আর কথা বাড়ানোর সুযোগ পেলো না। রাগটা গলে যাচ্ছে যা খুবই অনুচিত কাজ।
অভ্রর ফোনে চার্জ নেই। ক্লাইন্টের সাথে মিটিং শেষ। ব্যাটা খুব পাকিয়েছে। মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। এখন আর দোকান যাবে না সে। সরাসরি বাসা। ঐন্দ্রিলার সাথে কথা হয় নি সারাদিনে। মেয়েটা তখন ফোন ধরে নি। ব্যস্ত ছিলো কি? আচ্ছা তাকে চমকে দিলে কেমন হয়? এখন অভ্রর বাসায় যাবার সময় নয়। আজ তার জন্মদিন। নিশ্চয়ই ঐন্দ্রিলা কোনো সারপ্রাইজের ছক কষেছে। হুট করে পৌছে তার পরিকল্পনা ভেস্তে দিলে কেমন হয়? রেগে লাল হয়ে যাবে। আর সেই রাগী মুখখানা চোখ মুদে দেখবে অভ্র। যে ভাবা সেই কাজ। অভ্র রওনা হলো বাসার পানে। বাসায় আসতেই দেখা গেলো বসার ঘরে সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। অভ্র সহজ গলায় শুধালো,
মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব ৪১
“কি হয়েছে?”
“ঐন্দ্রিলা বাসায় নেই। কোথাও পাচ্ছি না। ও বাড়িতেও যায় নি। কোথায় গেছে কেউ জানে না”…………………