মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ শেষ পর্ব (শেষ অংশ)
মুশফিকা রহমান মৈথি
“ঐন্দ্রি”
আকুতিময় চিরচেনা স্বরখানা শুনতেই টলমলিয়ে উঠলো অন্তর। পেছনে ফিরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। সামনের মানুষটিকে ভোলার জন্য এতোটা দূরে পাড়ি দেওয়া সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আকুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখজোড়ায় তীব্র তৃষ্ণা, আকুলতা, যন্ত্রণা। এমন মূর্ছানো লাগছে সুঠামদেহী ছেলেটাকে। কাছে আসতে নিলেই ঐন্দ্রিলা শীতল স্বরে বললো,
“তুই চলে যা অভ্র”
বলেই চোখজোড়া সরিয়ে নিলো ঐন্দ্রিলা। অভিমানিনীর কাছ থেকে যেনো এমন প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলো অভ্র; অভিমান, অভিসম্পাত। তবুও মান ভাঙ্গাবেই। ম্লান মুখখানা পরখ করলো নীরব চোখে। সাতটা দিন পর মেয়েটাকে দেখছে সে। ক্লান্ত, বিষন্ন ভঙ্গিতে বসে রয়েছে সে। সৌন্দর্য্য মলিন হয়ে গেছে, চোখে বিষাদের মেঘ মেদুর। বেদনার সুরটা চাবুকের মতো প্রহার করলো যখন ঐন্দ্রিলা ছোট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ম্লান স্বরে বিদ্রুপ টেনে বললো,
“আমি তোর মত অভিনয় করতে পারি না, আমার সময় লাগবে নিজেকে গুছিয়ে নিতে”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়লো শূন্যতা। ভেতরের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা তীব্র রুপ নিলো। মুখে ফুটে উঠলো তীব্র বেদনার ছাপ। অভ্র পরাস্ত, হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো হাটু গেড়ে বসে পড়লো তার পায়ের কাছে। ব্যাকুল স্বরে বলল,
“প্লিজ ঐন্দ্রি, এমন নিষ্ঠুর হইস না। তুই ছাড়া আমি আমাকে কল্পনা করতে পারি না”
বলেই তার হাতখানা ছুঁতে চাইলো। এবার ঐন্দ্রিলা তার দিকে তাকালো। ব্যাথাতুর দৃষ্টি। হাতখানা সরিয়ে নিলো। নির্লজ্জ, বেহায়া হৃদয়টা আবারোও দূর্বল হবার ছুতো খুঁজছে। মূর্ছানো প্রণয়ফুলটা বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। চোখগুলো টলমলে হয়ে উঠলো ঐন্দ্রিলার। মুখে ফ্যাকাশে হাসি এঁকে বললো,
“আমি নিষ্ঠুর? সত্যি কি তাই?”
অভ্র উত্তর দিতে পারলো না। ঐন্দ্রিলার চোখ ভিজে এলো। এতোটাদিন খুব কষ্টে নিজেকে সামলেছিলো। বুঝিয়েছিলো। সান্ত্বনা দিয়েছিলো। আজ সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। অভিমান বিষাদসিন্ধুর স্রোতের রুপ নিলো। বুকের মানে আগলে রাখা ঝড়, তান্ডবদের মুক্তি দিলো সে। অশ্রুমিশ্রিত স্বরে বলল,
“বলেছিলাম তোকে অভ্র, আমার দ্বারা দ্বিতীয়বার বিশ্বাস ভাঙ্গার যন্ত্রণা সহ্য করা সম্ভব না। আমি ঠকতে চাই না। অথচ আমি আবার ঠকে গেলাম অভ্র, আমি আবার বিশ্বাস করে ঠকে গেলাম। আবার ভালোবেসে ঠকে গেলাম। ঠকতেই যখন হবে তবে কেনো আমাকে স্বপ্ন দেখালি? কেনো মিথ্যে ভালোবাসার চোরবালিতে আটকালি? কেনো?”
“আমি মানছি আমি সেই সময় বিয়েটা টাকার জন্য করেছিলাম। দাদা যদি শর্ত না ছুড়তেন আমি কখনো বিয়ের জন্য উতলা হতাম না। মানছি সংসারজীবনে আমি টাকার লোভে পা দিয়েছি। অন্যায় করেছি। পাপ করেছি। আমি সব মেনে নিচ্ছি। কিন্তু তোর প্রতি আমার ভালোবাসায় খুঁত নেই, কখনো ছিলোও না। কারণ আমার জীবনে নারী, প্রেয়সী, স্ত্রী— সবকিছুই তুই। আমার ভালোবাসায় কোনো প্রতারণা নেই। আমি তোকে সত্যি তোকে ভালোবাসি”
অভ্রর মুখে “ভালোবাসি”—কথাটা শোনার জন্য তীব্র পিপাসু ঐন্দ্রিলা। অথচ আজ সেই কথাটায় ভরসা পাচ্ছে না। ভৎসনা করে বললো,
“তাহলে আমি কেনো দেখতে পাচ্ছি না? আমি কেনো শুধু লোভ আর স্বার্থপরতা দেখছি। কেনো আমার কাছে সব মিথ্যে লাগছে? কেনো?”
অভ্র নিঃস্ব মানুষের মতো তার পাজোড়া আঁকড়ে ধরলো। কোলে মাথা রেখে কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি বলবো না আমাকে বিশ্বাস কর, আমি বলবো না আমাকে ক্ষমা কর। তুই ঘৃণা কর আমাকে, মার, কাট—যা খুশি কর। শুধু আমাকে ছেড়ে যাস না ঐন্দ্রিলা। আমি বাঁচবো না। এতোদিন আমি ভাবতাম, তুই আমার পুতুল আর আমি তোর অধিপতি। ভুল, আমি ভুল ছিলাম। তুই আমার রানী, আমি তোর সামান্য দাস। তোর শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো শুধু আমাকে তোর জীবন থেকে মুছে ফেলিস না। আমি তোকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি”
পায়ে গরম তরলের অনুভূতি হলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র কাঁদছে। একটা মানুষ কি এতটা অভিনয় করতে পারে? কিসের জন্য টাকার জন্য?
নিচের কেবিনে পঙ্গপাল বসে আছে। দুই পরিবারের কোনো প্রাণ বাকি নেই। এতটা পথ এই বয়সে আউওয়াল সাহেবও পাড়ি দিয়েছে। কারণ নাতবউকে অনেক কিছু বলার আছে তার। ছোট মেয়েটার কাছে সারাজীবনের জন্য নয়তো অপরাধী হয়ে যাবেন। নিজেকে সর্বদা বুদ্ধিমান এবং বিবেকসম্পন্ন মানুষ ভেবে যে দম্ভ করতেন তা গুড়িয়ে যাবে। ধুলো থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে যাবেন নিজের কাছে। এদিকে সালাম সাহেব নীলাদ্রিকে অকথ্য ভাষায় গা’লা’গা’ল করছেন,
“আহাম্মক কোথাকার, এই মুল্লুকে কে থাকে? আসতে আসতে কতবার গাড়ি বদলাতে হয়েছে জানিস? গাধা কোথাকার”
“আমি তো আপনার জন্য বাড়ি বানাই নি বাবা”
নিরুদ্বেগ কন্ঠ নীলাদ্রির। ফলে সালাম সাহেব আরোও চেতে গেলেন,
“তা বানাবি কেনো? গাধার বাচ্চা”
“হ্যা, আমি আপনার ই বাচ্চা”
বলেই পিউয়ের কাছে গেলো সে। পিউ যে এমন মীরজাফরের মত কাজ করে আশা করে নি। মেয়েটা অভ্রকে জানিয়ে দিলো। ফলে রাগী স্বরে জানতে চাইলো,
“তুমি এই কাজটা কেনো করলে?”
“কোন কাজ?”
“এই যে অভ্র আর এই গুষ্টিকে খবর দিলে”
“এছাড়া কি করতাম? তোমার বোন তো ঘরে বেবাগী হয়ে পড়েছিলো”
“তাই বলে খবর দিয়ে দিবে। ও মানা করেছিলো। এই সুযোগে বদের হাড়িকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানো যেতো”
“ওরে বুদ্ধি। একেবারে বুদ্ধির ঢেকি! আচ্ছা, বোনটা যে আড়ালে এতো কষ্ট পাচ্ছিলো সেটা নজরে পড়লো না? অভ্রকে শায়েস্তা করাটা জরুরি নয়, ঐন্দ্রিলার কষ্ট কমানো জরুরি। তোমার বউ হবার আগে ওর বান্ধবী আমি। তাই বান্ধবী হিসেবে সেটাই করেছি যেটা ওর জন্য ভালো”
নীলাদ্রি আর তর্ক করার উপায় পেলো না। পিউ সালাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, শরবত করে দিই”
“দাও তো পিউ মা, শরীর ব্যাথা হয়ে গেছে এতো জার্নিতে। একটু রিফ্রেশ লাগবে। দাও দাও”
সাবেরা ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
“তুমি কি এখানে শীতের ছুটি কাটাতে এসেছো? মেয়ের রুমে তো অভ্র গেলো এখনো আসলো না”
কতটা সময় কেটে গেছে জানা নেই। বৃষ্টি থেমে গেছে। সাদা পেজো মেঘ বেড়িয়ে এলো কৃষ্ণ মেঘের আড়াল থেকে। এক ভঙ্গিতে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। অভ্র এখনো তার পা ধরে রেখেছে। ক্লান্ত স্বরে বললো,
“তুই চেয়েছিলি আমার অশ্রুরা যেনো তোর হয়; অথচ দেখ আমার চিরকালের অশ্রুর কারণ হয়ে গেলি তুই”
ঐন্দ্রিলার শ্রান্ত বিলাপে চূর্ণ বিচূর্ণ হলো অভ্রর হৃদয়। মেয়েটির সম্পূর্ণ অধিকার আছে অভিসম্পাতের। কিন্তু এই প্রথম মেয়েটির অশ্রু তাকে আঘাত করছে। চিরটাকাল মেয়েটির অশ্রুর আধিপত্য চেয়েছিলো, কাঁদাতে চেয়েছিলো কারণে অকারণে। আজ সবকিছুই অভিশপ্ত লাগছে। ঐন্দ্রিলার অশ্রুর কারণ হওয়া কতটা যন্ত্রণার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যেনো। অভ্র জোর করে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। আকুতিময় স্বরে বললো,
“আমার গর্দান তোকে সপেছি, তুই যে শাস্তি দিবি মাথা পেতে নিবো। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাস না, প্লিজ”
উত্তর দিতে পারলো না ঐন্দ্রিলা। মাথাটা দুলে উঠলো। চোখের সম্মুখে নেমে এলো নিগূঢ় অন্ধকার। ঢলে পড়লো অভ্রর বুকে। পেলব শরীরটা দ্বিতীয়বার নিথর হয়ে লুটিয়ে পড়লো তার কোলে। অভ্রর মনে হলো পৃথিবীটা মুহূর্তেই থমকে গেছে। আর্তনাদ করে উঠলো সাথে সাথে,
“ঐন্দ্রিলা”
নিচের কেবিনে থমথমে মুখে বসে রয়েছে অভ্র। তার মুখে কোনো কথা নেই। গুমোট হয়ে আছে পরিবেশ। সালাম সাহেব তো রেগেমেগে আগুন হয়ে গেছেন। অভ্রর উপরে তীব্র ক্ষোভ ঝাড়লেন,
“এই ছেলে তুমি কি করেছো? ও বেহুশ কেনো হবে? নিশ্চয়ই তুমি এমন কিছু করেছো যে ঐন্দ্রিলার মাথায় চাপ পড়েছে। কোন দুঃখে যে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছি আমি? একটা রাবিশ, আস্তো রাবিশ”
অভ্রর হাত কাঁপছে। ঐন্দ্রিলার সব রিপোর্ট নরমাল আসার পরও কেনো এমন বেহুশ হয়ে গেলো। না চাইতেই আবার মানসিকভাবে আঘাত করে বসলো কি সে? অভ্রর পর সালাম সাহেবের টার্গেট হলো নীলাদ্রি,
“এই গাধার বাচ্চা গাধা, তোর এসিসট্যান্টটা কই? এক গাধা আরেক গাধাকে এসিসট্যান্ট বানিয়েছে। ওকে আমি থাপড়ে সোজা করে দিবো। বললাম, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবো না বদ্যি ধরে এনেছে। আমার মেয়ের যদি কিছু হয় আমি তোকে, অভ্রকে আর তোর এসিস্ট্যান্ট গাধাকে দেখে নিবো”
পায়চারি করছে নীলাদ্রি। মেজাজ অত্যধিক খারাপ হচ্ছে। কটেজ থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটু দূরে। বদের হাড্ডি অজয়টা একটা মারমা বৈদ্য ধরে নিয়ে এসেছে। বৃদ্ধ, ছোটখাটো মহিলা, মুখে বৈধ্যক্যের ছাপে চোখ দেখা যাচ্ছে না। মহিলার বয়স নাকি ছিয়াশি বছর। তার চিকিৎসা জ্ঞান এতোটাই প্রসিদ্ধ গ্রামে যে সবার মুখে মুখে এক কথা “মাংখাই সব রোগ ঝাটাপেটা করে ভাগায়”। তাই অজয় ছুটে যেয়ে মাংখাইকে ধরে এনেছে। মহিলা পড়াশোনার “প” জানে না অথচ সে রোগ ঝাটাপেটা করবে। আহাম্মকের শিরমনি অজয়ের মাথা থেকেই এমন বুদ্ধি আসবে। সালাম সাহেব এদিকে চটে তান্ডব করছেন। নীলাদ্রিও মনে মনে গুনে গুনে দশটা গালি দিলো অজয়কে। এর মাঝেই পিউয়ের সাথে মাংখাই নেমে এলো নিচে। মহিলার মুখখানা থমথমে। সবার মাঝে আতংক। সাথে সাথে অভ্র আগে ছুটলো তার কাছে। উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালো,
“ঐন্দ্রি, কেমন আছে?”
মহিলা একটু সময় নিয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে মারমা ভাষায় কিছু বললো। তার মুখোভাব দেখে আতংকিত হলো সবাই। শুধু অজয়ের মুখেই আনন্দের বলিরেখা দেখা গেলো। উৎফুল্ল স্বরে ভাঙ্গা বাংলায় বললো,
“স্যার, আপনে মা হবে”
নীলাদ্রি চেতে উঠে বললো,
“এই গাধা, আমি মা কি করে হবো? আমি কি মহিলা নাকি? ছাগল কোথাকার! তোমাকে সাংগু নদীতে দিনে দশবার চুবাবো, যদি বুদ্ধি খুলে”
সালাম সাহেব ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
“যেমন গাধা, তেমন তার এসিসট্যান্ট”
অজয় মাথা নাড়িয়ে তাকে বুঝাতে চাইলো কিন্তু নীলাদ্রি সেই সুযোগ দিলো না। মনভরে তাকে ঝাড়লো দুজন। এর মাঝেই পিউ তাকে থামিয়ে বললো,
“তুমি মামা হতে চলেছো বুদ্ধির ঢেকি। ও বুঝাতে চাইছে ঐন্দ্রিলা মা হতে চলেছে”
“ঐন্দ্রিলা মা হতে চলেছে”—কথাটার মাঝে কি যেনো ছিলো। নিমিষেই নিচের কেবিনে খুশির লহর বয়ে গেলো। অভ্রর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর উত্তাল অনুভূতিগুলো বেসামাল হয়ে গেলো। এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে যেতে নিলো উপরে। কিন্তু বাধা দিলেন আউওয়াল সাহেব, গম্ভীর স্বরে বললেন,
“আমি নাতবউয়ের সাথে কথা বলবো”
ঐন্দ্রিলা একাকী ঘরে বসে আছে। তার হাতখানা পেটের উপর। তার ভেতর একটি ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে, অনুভূতিটা এতোটা স্নিগ্ধ, মোলায়েম যে বোঝানো সম্ভব নয়। আনমনেই যত্নশীল হয়ে যাচ্ছে সে। চিন্তা হচ্ছে, এতোটা জার্নি করা কি ঠিক ছিলো? ভাবাচ্ছে তাকে। এই ছোট জান তার অংশ।
“আসবো”
প্রৌঢ় স্বরে শুনতেই উঠে বসলো সে। দাদাজান প্রবেশ করলেন ঘরে। চেয়ার টেনে বসলেন একটু দূরে। গম্ভীর স্বরে শুধালেন,
“কেমন আছো নাতবউ?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো”
“এই বুড়োকে তুমি ঘৃণা কর তাই না?”
হঠাৎ এমন বাচ্চামো প্রশ্নে অবাক হলো ঐন্দ্রিলা, উত্তর দিলো না। আউওয়াল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি তোমার অপরাধী। বিয়ের শর্তটা আমি ই অভ্রকে দিয়েছিলাম। বিয়ের দিন তুমি যখন পালিয়ে গেলে আমি ভয় পেলাম, ভয় পেলাম যে আদৌ তোমাদের সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যত আছে কি না। কিন্তু দেখো আজ আমি চোখের সামনে ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি। ভবিষ্যতের টলমলে ভবিষ্যত। এতো সুন্দর দিনে তোমাদের মধ্যে বিবাদ। এখন তোমার সাথে আমার বংশধরের কাছেও আমি অপরাধী। তাই তোমাকে কিছু বলা প্রয়োজন। জানো নাতবউ, আমার শর্তটা পুরো বৃথা হয়ে গেছে।
অভ্রকে আমি টাকাটা সেধেছিলাম তোমার অসুস্থতার সময়। তখন অভ্রর টাকার প্রয়োজন ছিলো খুব। ও লোনের টাকাটা সব খরচ করে ফেলেছিলো। কিন্তু ছেলেটাকে টাকা নেয় নি। কি বলেছে জানো? বলেছে, “আমি টাকাটা নিলে আমাদের সম্পর্কটা দরকষাকষির সম্পর্ক হয়ে যাবে। আমার ভালোবাসা বিবর্ণ হয়ে যাবে”। আমার নাতী বলে বলছি না, ছেলেটা সত্যি তোমাকে ভালোবাসে। ও আমাকে বলেছিলো, ও তোমাকে টাকার জন্য বিয়ে করে নি। শুধু টাকার লোভে তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছে। কিন্তু বিয়ে যখন ই করতো তোমাকেই করতো। আমি বিশ্বাস করি নি। তবে এখন সেটা উপলব্ধি করি। ছেলেটি তোমাকে কত ভালোবাসলে নিজেকে ভাঙতে পারে আমি দেখেছি। আমি বলবো না ওকে ক্ষমা করে দাও। তবে একটা সুযোগ দাও। নিজের জন্য, যে আসছে তার জন্য”
খুব শান্ত, স্থিরভাবে কথাগুলো বললেন দাদাজান। ঐন্দ্রিলা কিছুই বললো না। শুধু শুনলো। দ্বিধান্বেষী হৃদয় সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। অভ্র যা করেছে, এতো জলদি সব ভুলে যাওয়া সম্ভব?
দাদাজানের সাথে কথা বলার পর পর ই প্রবেশ করল অভ্র। ঐন্দ্রিলা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। শুন্যদৃষ্টি বাহিরের দিকে। অভ্র বিছানার কাছে এসেই দাঁড়িয়ে গেলো। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে। ইচ্ছে হলো পৃথিবীর সব আনন্দের খোড়াক তার পদতলে বিছিয়ে দিতে। তার দাস হয়ে তার সব অভিমান, কষ্টের ভার বয়ে নিয়ে। কিন্তু সেই সুযোগ দিলো না ঐন্দ্রি। ম্লান স্বরে বললো,
“আমি বাড়ি যাবো”
কথাটা শুনতেই অভ্রর মনে হলো প্রাণে পানি ফিরলো। হাটু গেড়ে বসলো ঠিক তার সামনে। আকুতিভরা টলমলে স্বরে বললো,
“সত্যি?”
“হ্যা, তবে এটা যদি ভেবে থাকিস যে আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি তাহলে ভুল ভাবছিস। আমি শুধু আমাদের দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে চাই। কারণ যে আসছে তার তো দোষ নেই। তোর শাস্তি সে কেনো পাবে?”
অভ্র চুপ করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। একটা সান্ত্বনা। তার পুতুল তার কাছেই থাকবে। শুধু ভালোবাসাটা মলিন হয়ে গেছে। অভ্র মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে তার অভিমানিনীর মান ভাঙ্গাবে। ভাঙ্গাতেই হবে।
আজকের সকালটি অন্যরকম। সোনালী রোদের কিরণে কেমন খুশি খুশি মেজাজ। আজ ডাক্তারের কাছে যাবে অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা। আল্ট্রাসোনোগ্রাম করা হবে ঐন্দ্রিলার। বান্দরবান থেকে আসার পর টেস্ট করে কনফার্ম হয়েছে তারা। সাবেরার পরিচিত একটা ভালো ডাক্তারের সাথে আজ যাবে তারা। বান্দরবান থেকে আসার পর থেকে ঐন্দ্রিলা তীব্র শীতল হয়ে গিয়েছে। না পারতে কথা বলে না সে। রাতে ঘুমানোর সময় বুকে শোবার বাহানা করে না। কিন্তু অভ্র সব মেনে নিয়েছে। সে প্রচেষ্টা ছাড়ছে না। পারলে হৃদয় অর্পন করতো তার চরনে। বাইক বেঁচে দিয়েছে। একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনেছে সে। যেনো কোনো সমস্যা না হয় ঐন্দ্রিলার। গাড়ির দরজাটাও খুলতে দেয় না ঐন্দ্রিলাকে। ঐন্দ্রিলা তবুও নীরব।
তিনজনের পর ঐন্দ্রিলার সিরিয়াল এলো। ডাক্তার একজন বৃদ্ধ মহিলা। চশমার ফাঁক থেকে ঐন্দ্রিলাকে দেখে বললো,
“এই প্রথম আল্ট্রাসাউন্ড?”
“জ্বী”
“আচ্ছা শোও, আর তুমি বাহিরে যাও”
অভ্রকে বাহিরে যেতে বলায় সে কপাল কুঁচকে ফেললো,
“কেনো?”
“তুমি এখানে থাকবে নাকি?”
“হ্যা, আমার বাচ্চার হার্টবিট শুনবো আমি”
“কি অদ্ভুত, পুরুষরা তো থাকে না বাবা”
“আমি থাকবো। আমার বউয়ের আল্ট্রাসাউন্ড হচ্ছে, অন্য মহিলারটা দেখছি নাকি?”
এসিস্ট্যান্ট হেসে ফেললো। ডাক্তার বিপাকে পড়লো। ঐন্দ্রিলা বিরক্ত হয়ে বললো,
“থাক বাদ দেন তো। থাকুক”
ডাক্তার হাল ছেড়ে দিলো। তিনি তার কাজ শুরু করলেন। স্ক্রিনে ঐন্দ্রিলার পেটের ভেতরে ছোট কিছু দেখা যাচ্ছে। অভ্র ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলো। সে ঐন্দ্রিলার হাত আঁকড়ে ধরলো। তার হাত কাঁপছে। ধীরে ধীরে ডাক্তারের চোখ মুখ কুঁচকে এলো। চিন্তিত স্বরে বললো,
“আপনারা প্রস্তুত তো?”
“কিসের জন্য?”
ঐন্দ্রিলার অবাক প্রশ্নে মহিলা ডাক্তার কিঞ্চিত চিন্তিত মুখে বললেন,
“ট্রিপলেটের জন্য! আমি তো তিনটে আলাদা হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি। এক, দুই, তিন”
“তিনটে? আপনার ভুল হচ্ছে না তো”
“কি বলছো মেয়ে, আমি কি আজকের ডাক্তার। পঁচিশ বছর এই লাইনে”
ডাক্তারের কথাটা শুনতেই তড়াক করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো সে অভ্রর দিকে। অভ্রর চোখ মুখ উজ্জ্বল। আনন্দ যেনো ঠিকরে পড়ছে। ঐন্দ্রিলার চাহনীর মর্মার্থ বুঝতেই অসহায় স্বরে বললো,
“আমার দোষ নেই”
ডাক্তার বিরবির করে বললেন,
“স্ট্রেঞ্জ”
এবার সাউন্ড বাড়িয়ে দিলেন। ছোট, কিন্তু স্থির হার্টবিট শুনতে ফেলো অভ্র। তার চোখ ভিজে এলো। ঐন্দ্রিলার হাত ধরা হাতের বাধন আরোও শক্ত হলো। ডাক্তার বললো,
“বংশে, জমজ বা ট্রিপ্লেটের হিস্ট্রি আছে?”
“চৌদ্দ গুষ্টিতে নেই”
“এটা খুব ইউনিক কেস জানেন তো? আপনারা কি প্রস্তুত? কারণ ট্রিপলেট জন্ম দেওয়া, পালা খুব কঠিন”
ঐন্দ্রিলা এবার কিঞ্চিত ভয় পেলো। চিন্তার মেঘ নেমে এলো মুখে। কিন্তু অভ্র আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললো,
“আমি সামলে নিবো, ইনশাআল্লাহ”
তিনটে বাচ্চার কথা শুনে পরিবারের সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বেশি উৎফুল্ল হলেন সালাম সাহেব। তার ধারণা তার পাল্লাভারী হচ্ছে। আউওয়াল সাহেব খুশিতে গদগদ। বারবার কেঁদে উঠছেন বৃদ্ধ মানুষটি। কানন এবং সাবেরার নজরদারি বেড়ে গেলো। এরা পারে না ঐন্দ্রিলাকে মাথায় তুলে রাখতে। রুম বদলে নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু অভ্র সবার উদ্দেশ্যে বললো আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললো,
“আমার বউয়ের খেয়াল আমি রাখতে পারবো। এতো উত্তেজনার প্রয়োজন নেই”
কথাটা ফলেও গেলো। প্রথম তিন মাসে ঐন্দ্রিলার খাবারের প্রতি তীব্র অনীহা এবং অরুচি দেখা গেলো। সে কিছুই খেতে পারে না। যা খায় উগড়ে দেয়। এমনও হয়েছে সে পানিও বমি করেছে। এই পুরো মুহূর্তগুলোতে অভ্র তার পাশে ছিলো। সে উদ্বিগ্ন হতো, ব্যাকুল হত। কিন্তু প্রকাশ করতো না। যা খেতে ভালোবাসে ঐন্দ্রিলা সেটাই তার সামনে এনে দেবার চেষ্টা করলো। একদিন রাত সাড়ে তিনটের সময় চটপটি খাবার বায়না করলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র সাথে সাথেই ফোন করলো বিল্লালকে। রাত সাড়ে তিনটায় এক দোকান খুলিয়ে চটপটির জিনিসপত্র কিনে আনলো। ইউটিউব দেখে দেখে সেটা বানানোর চেষ্টা করলো। সারা রাত কাটলো এভাবেই। অবশেষে সকাল দশটায় চটপটি পরিবেশন করা হলো। ঐন্দ্রিলা এক চামচও খেতে পারলো না। বমি করে ভাসিয়ে দিলো। কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই অভ্রর। ঐন্দ্রিলা অবাক হয় ছেলেটার ধৈর্য্য দেখে। এই ছেলেটি কি সে যে কলেজের সামনে মারপিট করে বলতো,
“পাছা দিয়ে ভালোবাসা বের করে দিবো”
হাসি পায় ঐন্দ্রিলার। অভিমানের দেওয়ালটা কমতে লাগলো ধীরে ধীরে। কিন্তু এতো বড় অন্যায়ের শাস্তি তো এতো কম হলে হয় না। তাই নিজেকে কঠিন বানিয়ে রাখলো সে।
ধীরে ধীরে পেটখানা বড় হতে লাগলো ঐন্দ্রিলা। ভারী হয়ে যাচ্ছে পা। হাটতে কষ্ট হয়। যত দিন যাচ্ছে ভেতরে লালিত তিনটে প্রাণ বলিষ্ট রুপে নিজেকে জানান দিচ্ছে। এই তো সেদিন রাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো ঐন্দ্রিলার। পেটে তীব্র ব্যাথা অনুভূতি হলো। ছোট ছোট পায়ের জোর অনুভূতি হলো। সেই লাথিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো অভ্ররও। অভ্রর এই কদিনে একটা স্বভাব, ঘুমাবার সময় ঐন্দ্রিলার পেটে হাত রেখে ঘুমায়। পর পর তিনটে লাথিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে বসে নিষ্পলক তাকালো ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলার চোখমুখ চকচক করছে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি তার পেটের দিকে। অভ্র পেটের কাছটায় মুখ নিয়ে শুধালো,
“আম্মা, তুমি কি বাবার কন্ঠ শুনতে পাচ্ছো?”
সাথে সাথেই আরেকটা লাথি অনুভূত হলো। অভ্রর গলা ধরে গেলো। অজস্র চুমু খেলো পেটে। ধীর স্বরে বললো,
“বাবা তোমাদের অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছে আম্মু। তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু”
ঋতু বদলের ছোঁয়ায় প্রকৃতি নতুন সাজে সাজতে ব্যস্ত। মানুষের জীবন তীব্র গতিতে চলমান। ঝরাপাতার গাছে এখন ফুল ধরেছে। শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম শেষে বর্ষা নেমে এসেছে ধরনীতে। ঘাসফড়িংয়ের দাপাদাপি ঘাসের উপর বিদ্যমান। দেখতে দেখতে সাইত্রিশ সপ্তাহ কেটে গেছে। ডিলেভারীর ডেটের আগেই ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বলেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যাচ্ছে, যেমন পানি শুকিয়ে আসছে, অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তাই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত দিয়েছে ডাক্তার। সকাল সকাল ভর্তি হল তারা। নীলাদ্রি-পিউ চলে এসেছে।
নীলাদ্রির বিসিএসের রিটেন পরীক্ষা সামনের সপ্তাহে। তবুও সব ছেড়ে চলে এসেছে। পরিবারের প্রতিটি প্রাণ উপস্থিত। বিল্লাল এবং তৃষাও এসেছে। কিছুদিন আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। প্রথমে তৃষার বাবা আপত্তি জানালেও অবশেষে বিল্লালের সততা তাকে অভিভূত করতে পেরেছে। একটু পর অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করানো হবে ঐন্দ্রিলাকে। নরমাল ডিলেভারী করা সম্ভব নয়। সিজারিয়ান হবে। যখন নার্সরা এলেন তাকে নিয়ে যেতে ঐন্দ্রিলার হৃদয় নড়েচড়ে উঠলো। ভয় হলো ভীষন। অভ্রর দিকে চাইলো কাতর নয়নে। নয় মাসে ছেলেটাকে শাস্তি দেবার নামে নিজেদের মাঝে একটা দেওয়াল তুলে রেখেছিলো। এখন ভয় হচ্ছে যদি আর ফেরা না হয়? তাহলে কি তাদের গল্পটা অসম্পূর্ণই থাকবে? অভ্রর হাতখানা শক্ত করে ধরে ধীর স্বরে বললো,
“আমাদের হিসেবটা এখনো শেষ হয় নি কিন্তু, অপেক্ষা করিস। আর যদি না ফিরি”
“খবরদার এমন কথা বলবি না, আমি তোর অপেক্ষায় থাকবো”
অভ্রর দৃঢ় স্বর। ফ্যাকাশে হাসলো ঐন্দ্রিলা। অবশেষে তাকে নিয়ে গেলো নার্সরা।
অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে অপেক্ষা করছে সবাই। আড়াই ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। অভ্র থমথমে মুখে বসে আছে। দু ব্যাগ রক্ত লেগেছে। নীলাদ্রির মুখখানা ভীত। পিউয়ের হাত ধরে বললো,
“পিউ তুমি ভেতরে গেলে আমি তো বেহুশ হয়ে যাবো”
“ভালো হবে তো, আমরা দুজন ই বেডে শুয়ে থাকবো অজ্ঞান হয়ে”
“মজা করো না”
“আচ্ছা, হাদারাম করবো না। তুমি একটু সাবধান হইয়ো। বলা যায় না, আমারও তিনজন হলে! তোমার যে স্ট্যামিনা”
“তুমি দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছো”
হেসে উঠলো পিউ। অবাক হবার ভান করে বললো,
“বেশি নষ্ট না কম নষ্ট?”
এর মাঝেই নার্সরা বেরিয়ে এলো। তিনটে নবজাতক হাতে। একটি মেয়ে এবং দুটো ছেলে। মেয়েটির আদল একেবারে ঐন্দ্রিলার অনুরুপ। ছেলেরা অভ্রর প্রতিচ্ছবি। ছোট ছোট তিনটে শরীর। অপারেশন শেষ হয়েছে। অভ্র প্রথমেই শুধালো,
“আমার স্ত্রী?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, নিন বাবুদের কোলে নিন”
অভ্র মেয়েকে কোলে নিলো। তুলতুলে শরীরটা কোলে নিয়ে পৃথিবীর সর্বসুখী মানুষের তালিকায় উত্তীর্ণ হলো যেনো সে। সালাম সাহেব নাতীকে কোলে নিয়ে বলল,
“অবশেষে নানা হয়েই গেলাম ইদ্রিশ ভাই? আসলের থেকে সুদের মায়া তো অনেক”
“ঠিক সালাম ভাই”
আউওয়াল সাহেবের জীবনচক্র আজ পূর্ণ। একটুপর আজান দেওয়া হলো বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে। বাচ্চাদের নাম রাখা হলো জিহান, দিহান এবং অথৈ। অভ্র অনুমতি চাইলো ঐন্দ্রিলাকে দেখার। অনুমতি পেতেই ছুটে গেলো সে।
ক্লান্ত, ব্যাথাতুর মুখখানায় চুমু খেলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা চোখ মেলে চাইলো। চাহনী খুব ক্লান্ত, অমলিন স্বরে বললো,
“বাবুরা কেমন হয়েছে?”
“সুন্দর”
“আমি কিন্তু ফিরেছি”
“ধন্যবাদ”
“শুধু ধন্যবাদ?”
“তোর জন্য আমার প্রাণ হাজির। শুধু বল একবার”
“হৃদয় নিঙরানো প্রেম নিবেদন”
“যথাআজ্ঞা মহারানী”
চারদিন পর বাসায় আনা হলো ঐন্দ্রিলাকে। তিনটে বাচ্চা সামলানো কি মুখের কথা। কিন্তু শ্বাশুড়ি এবং মা থাকায় একটু সহজ হচ্ছে। এদিকে অভ্র তো আছে। মেয়েভক্ত বাবা। ছেলেদের দিকে খেয়াল না থাকলেও মেয়েকে চোখে হারায় সে। তার সবকিছু নিজ হাতে করে। মেয়েটার স্বভাবে একেবারে ঐন্দ্রিলার মত। নাক উঁচু, জেদি। বাবা কোলে না নিলে সে ঘুমাবে না। আর ছেলেগুলো একেবারে শান্ত। শুধু খিদে লাগলে একসাথে চিৎকার করে। সালাম সাহেব সারাক্ষণ নাতীদের মুখে তাকিয়ে থাকেন। তা দেখে অভ্র শ্বশুরের উদ্দেশ্যে বললো,
“কি শ্বশুর আব্বা, আমার প্রোডাক্ট কেমন দেখছেন? টপ নচ না?”
অভ্রর কথা শুনে সালাম সাহেব মুখ বাকিয়ে বললেন,
“ছাগলের ঘরে ছাগল বলে কি! এ যেন তার কৃতিত্ব! আমার নাতি-নাতনী তো আমার মতো সুন্দর হবে এটাই সাইন্স”
“গুষ্টির দূর দূর থেকে এমন ইউনিক প্রোডাকশন দেখেছেন কখনো? একসাথে ৩টে? এটা আমার ভালোবাসা বুঝলেন। আমি যে আপনার মেয়েকে কতটা ভালোবাসি এই তার প্রমাণ, বুঝলেন শ্বশুর আব্বা”
নির্লজ্জ ছেলেটার কথা শুনে ঐন্দ্রিলা পারে মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়ে। বাবা হয়েছে অথচ মুখে লাগাম নেই।
বিকালের রোদ নরম হয়ে এসেছে। অবশেষে বাচ্চারা ঘুমে। অভ্র তিনজনকে শুইয়ে দিয়েছে। বারান্দায় এসেছে ঐন্দ্রিলা। ক্লান্তি মুখমন্ডলে লেপ্টে আছে। অভ্র ধীর পায়ে এসে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ঐন্দ্রিলা তার উষ্ণ স্পর্শে নিজেকে এলিয়ে দিলো। হেসে শুধালো,
“কেমন লাগছে জনাব?”
“খুব শান্তি। আমি তোকে বোঝাতে পারবো না বাবু। থ্যাংকিউ সো মাচ এতো চমৎকার গিফটের জন্য”
“আর আমার গিফট?”
অভ্র হাসলো। তাকে ছেড়ে হাটু গেড়ে হাত বাড়িয়ে গাঢ় স্বরে বললো,
“আমার মনশহরের প্রতিটি ইটে তোর নাম খোদাই করা। বাতাসে শুধু তোর গন্ধ। অলিতে গলিতে তোর হাসির গুঞ্জন। অম্বরজুড়ে ভাসমান মেঘেরা ধরণীতে গলে পড়ে তোর প্রতীক্ষার বিরহে। প্রতিটি প্রহর তুইতে সাজতে চায়। পথহারা পথিকের মতো বসে আছে শুধু তোর অপেক্ষায়। এই ছেড়া নোটের উদাসীন মনশহরে নিমন্ত্রণ জানালাম। আসবি কি?”
হেসে উঠলো ঐন্দ্রিলা। এই ছেলেটার উপর কি আর অভিমান করে থাকা যায়! যে হৃদয় নিঙড়ে নিমন্ত্রণ জানায় সেই মনশহরের নিমন্ত্রণ কি ফেরানো সম্ভব! ঐন্দ্রিলা পারলো না। অবশেষে ছেড়া নোটের মনশহরে নিমন্ত্রণ অকলুষিতভাবেই গ্রহণ করলো আমড়া কাঠের ঢেকি। চলতে থাকতো তাদের টক, ঝাল, মিষ্টি গল্পটি………………