মনে রেখ এ আমারে গল্পের লিংক || রায়েনা হায়াত

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ১
রায়েনা হায়াত

–‘তুই অফিসে চলে গেলে তোর বউ সারাদিন কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলে। বাড়ির একটা কাজও করে না। বিয়ে হয়েছে মাত্র ১৫ দিন এর মধ্যেই এসব কী?’
ঘরের বাইরে থেকে শাশুড়ির কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায় অবনী। হৃদানের সাথে বিয়ে হয়েছে ১৫ দিন হলো। একটু আগেই হৃদান অফিস থেকে এসেছে। তাই তার জন্য শরবত আনতে গিয়েছিলো সে। দরজার কাছ অব্দি এসে এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অজানা আশঙ্কায় বুকটা ভার হতে শুরু করে। দু বার বড় বড় শ্বাস নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হৃদান কি জবাব দেয় তা শোনার জন্য। মিনিট খানেক বাদে ঠান্ডা গলায় হৃদান বলে,
–‘আমি ওর সাথে কথা বলতেছি, আম্মা। আপনি চিন্তা করবেন না।’

ছেলের জবাবে তেমন একটা সন্তুষ্ট হলেন না হানিফা বেগম। তবুও আর কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ততক্ষণে অবনীও সরে গেছে। সংসারটা তার কত ভালো হবে সে ঢের বুঝতে পারছে। ডাইনিং এ শরবতের গ্লাসটা রেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়। তার শাশুড়ি তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক বাদেই ডাক পরে হৃদানের। অবনী নিজেকে সামলে ঘরের দিকে যায়। হাতের শরবতটা সেখানেই থেকে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোটবেলায় বাবার দেয়া মা’কে থা’প্পড়টা। তার শ্বাস ভারী হতে থাকে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে হৃদানের সামনে যায়। তাদের বিয়েটা ছিলো পারিবারিক ভাবে তাই এখনো দুজনের মাঝে কিছুটা জড়তা রয়েই গেছে বোধহয়। তার ভাবনার মাঝেই হৃদান নিজ থেকে শুধায়,
–‘আপনি তো আমার জন্য শরবত আনতে গেছিলেন। শরবত কোথায়?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঠান্ডা গলার হৃদানের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। চোখে মুখে সামান্যও ক্রো’ধ নেই। বরং বরাবরের মতোই তার চোখ মুখ শান্ত। অবনীকে নিজের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে হৃদান আবার শুধায়,
–‘কি হলো অবনী? তাকিয়ে আছেন কেনো? শরবত কোথায়? ভুলে গেছেন আজ?’
–‘ডাইনিং-এ রেখে এসেছি। আসলে আম্মা!’
হৃদান হয়তো বুঝলো। তবুও এড়িয়ে গিয়ে অবনীর শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মুখ মুছে দেয়। তারপর এক হাতে অবনীকে কাছে টেনে নিয়ে কানের পৃষ্ঠে গুঁজে দেয় ছোট ছোট চুলগুলো। এরপর ঠোঁট ছোঁয়ায় অবনীর কপালে। অবনী অবাক হয়। তার শাশুড়ি যা বলে গেছে তাতে সে হৃদানের থেকে এ ধরণের প্রতিক্রিয়া মোটেও আশা করেনি। তাকে আরও অবাক করে দিয়ে হৃদান বলে

–‘আম্মার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছেন?’
অবনী মাথা নিচু করে নেয়। নিচু স্বরেই বলে,
–‘আমি আপনাদের কথা শুনতে চাইনি। আসলে শরবত..’
–‘জানি আমি। বলতে হবে না। বিশ্বাস করি আপনাকে।’
অবনী অনুভূতিশূণ্যের মতো তাকায়। অতীত জ্বলজ্বল করে ওঠে চোখের সামনে। হৃদানের চোখে সত্যিই একটুও সন্দেহ কিংবা রাগ কিছুই নেই। হৃদান তাকে এতো বিশ্বাস করে? সত্যিই? নাকি সে হ্যালুসিনেট করছে? অবনী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ঘোরের মাঝে বলে বসে,

–‘আপনি সত্যিই আমাকে এতোটা বিশ্বাস করেন হৃদান? আপনি সত্যি তো নাকি আমি হ্যালুসিনেট করছি? হৃদান!’
অবনী দু হাতে হৃদানের চোখে মুখে হাত ছোঁয়ায়। তার চোখের কোণ ভিজে আছে। হৃদান মুচকি হেঁসে অবনীর চোখেই ঠোঁট ছুঁইয়ে জড়িয়ে ধরে। অবনী একটা ভরসার বুক পেয়ে নিজেকে আটকাতে পারে না। চোখ বেয়ে পরতে থাকে অজস্র জল। হৃদান জানে এই মেয়ের অতীত, শুধু মেয়েটাই জানে না হৃদান সবটুকু জানে। অতীত নিয়ে হৃদান একটুও ভাবে না। প্রত্যেক মানুষের জীবনে অতীত থাকে। কালো অতীত! তাতে কি জীবন থেমে গেলে চলবে?

বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়িতে ঢোকে অন্তি। ভার্সিটি শেষে সেখান থেকে টিউশনিতে গিয়েছিলো সে। মাসের শুরু বলে বেতনটাও পেয়েছে। তাই একেবারে বাজার করে ফিরেছে। ১ মাস আগে তার বাবার হার্ট অ্যাটাক এসেছিলো। ডক্টর বলেছেন একদম বেড রেস্টে রাখতে হবে। তাছাড়াও বাবা-মা’র তো বয়স হয়েছে। অন্তি এবার অনার্স ৩য় বর্ষে। মনে মনে ভেবে নেয় এ মাসে তার আর কি কি খরচ আছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
–‘মাত্র কিছুদিন সামলাতেই আমি হিমশিম খাচ্ছি অথচ বাবারা কত বছর ধরে এভাবে হিসাব করে বাঁচে!’
কলিং বেল দিতেই অন্তির মা দরজা খোলেন। অন্তি বাজারের ব্যাগটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
–‘আম্মু, আব্বুর প্রেসক্রিপশনটা একটু পর দিও। আমি ফার্মেসীতে যাবো।’
অন্তির মা রেহেনা বেগম মাথা নাড়িয়ে বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রাখতে যান। অন্তির বাবা আনোয়ার সাহেব সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন। মেয়ের ক্লান্ত মুখ দেখে তাঁর বড্ড মায়া হয়। কিছু করতে না পারার আফসোস হয়। কিন্তু সেও নিরুপায়। অন্তি রুমের দরজা থেকে বলে,

–‘আব্বু, একদম নিজের দিকে কোনো দোষ নিবা না। নয়তো আমি অবনী আপুকে সব বলে দিবো।’
আনোয়ার সাহেব হেঁসে বলেন,
–‘তুই কিভাবে বুঝে যাস রে মা, যে আমি কি ভাবছি?’
–‘কারণ আমি আপনার মা হই, জনাব।’
আনোয়ার সাহেব হাসেন। অন্তি নিজেও হেঁসে রুমে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে মুখে পানি দিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তন্ময় আজ সারাদিনেও একটা কল কিংবা টেক্সট করেনি। অবশ্য এর কারণ অন্তি জানে। ভার্সিটিতেই সে শুনেছে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে কল লাগায় তন্ময়ের ফোনে। ওপাশ থেকে কল তুলতেই তন্ময় বলে,

–‘বলো।’
তন্ময়ের শান্ত গলা শুনে অন্তি হাসে। নিজেও বেশ শান্ত গলায় শুধায়,
–‘মেয়ে পছন্দ হয়েছে?’
তন্ময় খানিকটা চমকায়। ভাবে অন্তি কিভাবে জানলো! পরক্ষণেই মনে পরে হয়তো ভার্সিটির কারোর থেকে জেনেছে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে আগের মতোই বলে,
–‘মেয়ে সুন্দরী। বাবা-মায়ের পছন্দ।’
–‘আর আপনার?’
তন্ময় কতক্ষণ চুপ থাকে। অন্তি বুঝে যায় জবাব। তাই নিজ থেকেই আবার বলে,
–‘নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা, তন্ময়।’
এ কথার বিপরীতে তন্ময় বলে,
–‘তোমাকে অনেকবার বলেছিলাম আমরা বিয়ে করি। তুমি রাজি নও, অন্তি। এরপর আমার বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করলে আমার দোষ কী?’

–‘আমি তো আপনার দোষ একবারও দেইনি, তন্ময়। একবারও বলিনি আপনি বিশ্বাসঘাতক। আমার বাবার কি অবস্থা আপনার সবটুকুই জানা। অবনী আপুর বিয়ে হয়েছে মাত্র ১৫ দিন হলো। আমিও যদি বিয়ে করে চলে যাই তবে আমার বাবা-মা’কে কে দেখবে? আপনি সবসময় বলেছেন ‘চলো বিয়ে করি’ কিন্তু কখনো তো বলেননি ‘তোমার বাবা-মা তো বিয়ে হয়ে গেলে আমারও বাবা-মা হবে। তখন দুজন মিলে দেখবো।’ বলেছেন কখনো?’
তন্ময় চুপ থাকে। তন্ময়ের বাবা-মা সম্পর্কে অন্তি ভালো ভাবেই জানে। তাই বিয়ের পর যে সে অন্তিকে জব-ও করতে দিবে না এটা তার জানা। অন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষ একবার বলে,

–‘আপনি বিয়েটা করে নিতে পারেন, তন্মায়। আমার পক্ষ থেকে কোনো বাঁধা থাকবে না। ভালো থাকবেন।’
কল কেটে দেয়। তন্ময় চাইলেই তাদের দুজনের বিয়েটাও হতো। তাদের প্রায় ১ বছরের সম্পর্ক। ফার্স্ট ইয়ার থেকে তন্ময় তার পিছে পিছে ঘুরেছে। একসময় অন্তিরও মায়া হয়। এরপর সবকিছু হঠাৎ হয়ে যায়। আর আজ বিচ্ছেদও হঠাৎ করেই হলো। অন্তি চায়নি এখনই বিয়েটা করতে। সে শুধু বলেছিলো আর কয়েকটা মাস অপেক্ষা করতে। বাবার অবস্থা খানিকটা উন্নত হোক আর সেও এই সংসারের হালটা খানিকটা ধরে দিক। কিন্তু তন্ময়ের হয়তো মনে অন্য সাধ জেগেছে। তাই তো তার ওপর দোষটা চাপিয়ে ঝাড়া হয়ে এখন অন্য নারীকে বিয়ে করছে। অন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখ দুটো জ্বলতে থাকে। চোখের কোণ বেয়ে গড়তে থাকে অশ্রু। বাহির থেকে রেহেনা বেগম ডাকেন। অন্তি তাড়াহুড়ো করে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ওয়াশরুমে যায়। চোখে মুখে পানি দিয়ে মুখটা মুছে হাসি হাসি মুখ করে মায়ের সামনে যায়। রেহেনা বেগম তাকে দেখেই বলেন,

–‘কিছু খেয়ে তারপর ফার্মেসীতে যাস।’
–‘আমার ক্ষুধা নেই আম্মু। পরে খাবো। এখন প্রেসক্রিপশন দাও।’
রেহেনা বেগম তবুও খেতে বললেন। অন্তি পরে খাবো বাহানা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। বিল্ডিং থেকে দু মিনিট হাঁটলেই মোড়। সেখানেই ফার্মেসীর দোকান। অন্তি ভালো ভাবে মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে আনমনে হাঁটতে থাকে। তারা থাকে ৩ তলায়। অন্যমনষ্ক ভাবে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হুট করেই ধাক্কা খেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। সে সামলেছে বললে ভুল-ই হবে। সামনে থাকা পুরুষটিই বরং সামলে নিয়েছে। অন্তি মাথা উচু করে পুরুষটির দিকে তাকালেই সে বলে,
–‘এভাবে ম’রা মানুষের মতো হাঁটছেন কেনো? সামনে তাকিয়ে হাঁটুন।’
মন মেজাজ বেশি ভালো না থাকায় সে ভাবে এড়িয়ে যাবে। সরি বলতে গেলেও মাথায় ঘুরতে থাকা অন্য একটি জবাব মুখ থেকে বের হয়ে যায়,
–‘হাঁটবো না। আপনার সমস্যা?’
অন্তি নিজের মুখ চেপে ধরে। সামনে থাকা পুরুষটি অবাক হয়ে তাকায়। পিছন থেকে আরেকজন মহিলা এগিয়ে এসে শুধান,

–‘তাইমুর, এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? চলো!’
তাইমুর নামক পুরুষটি মাথা নাড়ায়। অন্তিকে পাশ কাটিয়ে তারা চলে যায়। অন্তির মাথায় ‘তাইমুর’ নামটা ঢুকতেই অদ্ভুত একটা কথা মনে হয়। নামটা কোথাও সে শুনেছে। কোথায় শুনেছে? মাথায় চাপ দিয়েও মনে করতে পারে না। একবার পিছে ফিরে তাকিয়ে আবার নিজের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। তখনো সে ভাবছে কোথাও এ নামটা সে শুনেছে। পরক্ষনেই ভাবে এক নাম তো কতজনেরই হয়। শুনেছে হয়তো কোথাও। অন্তি দু দিকে মাথা নাড়িয়ে নিজেকে শান্ত করে নেয়। এরপর দ্রুত হেঁটে এগিয়ে যায় ফার্মেসির দিকে। দোকানে গিয়ে প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। ফার্মেসিতে থাকা দুজন নিজেদের মাঝেই বলছিলো,

–‘ডক্টর তাইমুর আহসান নাকি এখানে শিফ্ট করেছে!’
দুজনের মাঝে আরও কথা হলেও অন্তির কানে কেবল ‘ডক্টর তাইমুর আহসান’ নামটাই ঢুকলো। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে। তাইমুর আহসান! এবার সে বুঝতে পারে নামটা কেনো তার এতো পরিচিত লাগলো! একবার নিজেদের বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে নিজেই আওড়ায়,

–‘তাইমুর ভাই! আবার! কিন্তু কেনোই বা ফিরে আসলো?’
অন্তির চোখে ভাসে ৫ বছর আগের ঘটনা। যখন অন্তি ইন্টার ১ম বর্ষে। তখন দমকা হাওয়ার মতো জীবনে এসেছিলো তাইমুর আহসান। এবং দমকা হাওয়ার মতোই মিলিয়েও গিয়েছিলো সে। শুধু কানে বাজে তাইমুরের শেষ এক বাক্য,
–‘মনে রেখ এ আমারে।’

মনে রেখ এ আমারে পর্ব ২