মহাপ্রয়াণ পর্ব ২৯+৩০

মহাপ্রয়াণ পর্ব ২৯+৩০
নাফিসা তাবাসসুম খান

ক্যামিলোকে হঠাৎ নিজের কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে রিকার্ডো বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
” কিছু বলবে মা? ”
” মেয়েটাকে যেতে দে। ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” কোন মেয়ে? ”
” আনাস্তাসিয়া। যাকে নিয়ে তুই আর ম্যাথিউ খেলা শুরু করেছিস। ”
” খেলছি আমি না, খেলছে তোমার ছেলে। তাও আগুন নিয়ে। ওকে বলে দিও ভ্যাম্পায়ারদের কাউন্ট আমি। আমার কোনো সিদ্ধান্তে যেন সে নাক না গলায়। ”

” কি সিদ্ধান্ত তোর? ”
” মেরে ফেলবো মেয়েটাকে। ”
” মেরে ফেলবি নাকি বাঁচাবি? ”
রিকার্ডো অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
” মানে? ”
” মেয়েটাকে যে তুই বাঁচাচ্ছিস তা অস্বীকার করিস না। ”
” কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো? ”
ক্যামিলো রিকার্ডোর চোখে চোখ রেখে বলে,
” আমি তোর মা। আমার থেকে কিছু লুকানোটা বোকামি হবে। যদি মেয়েটাকে বাঁচাতেই চাস তাহলে লুকিয়ে ওকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দে। এই প্রাসাদে বাকি কোভেনদের নজর কিন্তু ওর উপর আছে ভুলে যাস না। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি ওকে বাঁচাতে চাইছি? ”
ক্যামিলো হালকা হেসে বলে,
” সেদিন রাতে আনাস্তাসিয়া যখন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে তখন তুই ওকে বাঁচিয়েছিলি। এখন এটাও অস্বীকার করে বসবি না। ”
রিকার্ডো কোনো কথা বলতে পারে না। চোখ সড়িয়ে ফলে সে। ক্যামিলো যে তার উপর নজর রাখছিলো তা বুঝতে বাকি নেই তার। ক্যামিলো বেরিয়ে যাওয়ার আগে এগিয়ে এসে রিকার্ডোর গালে আলতো করে হাত রেখে বলে,
” চিন্তা করিস না। আমি কাউকে বলবো না। কিন্তু এতটুকু তুইও জানিস আমিও জানি যে আনাস্তাসিয়ার এই দূর্গে থাকা অনুচিত হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে ট্রান্সিলভেনিয়া থেকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দে। ”
ক্যামিলো চলে যাওয়ার পর রিকার্ডো বসে মাথা নত করে কিছু ভাবতে থাকে।

রাত গভীর হয়েছে। ক্যাথরিন পায়ে একটি রুমাল দিয়ে আরোণের দেওয়া খঞ্জরটা বেধে নেয়। আজ রাতেই সে এই প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাবে। নিজেকে মনে মনে বোকা বলে সম্বোধন করে সে। এই প্রাসাদে থেকে বন্দী জীবন মেনে নেওয়াটা তার ভুল ছিলো। সে কেন এই প্রাসাদে থাকবে? তার পরিবার আছে, ভাইবোন আছে। সে কেন তাদের কাছে মৃত হয়ে এই প্রাসাদে পড়ে থাকবে? তাই আজ রাতেই সে এই প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যাবে।
ক্যাথরিন দরজা খুলে বের হতেই প্রহরীরা তাকে প্রশ্ন করে সে কোথায় যাচ্ছে। ক্যাথরিন খুব সাবলীল গলায় জবাব দেয়,

” লোল্যান্ডার কক্ষে যাচ্ছি। ঘুম আসছে না আমার। ”
প্রহরী দুইজন একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। ক্যাথরিন ওদের উদ্দেশ্য করে বলে,
” তোমাদের মধ্যে একজন চাইলে আমার সাথে ওর কক্ষ পর্যন্ত যেতে পারো৷ ”
প্রহরী দুজন এতে রাজি হয়। একজন ক্যাথরিনের সাথে নিচে আসে লোল্যান্ডার কক্ষের সামনে। ক্যাথরিন বিনা শব্দে কক্ষে প্রবেশ করে এবং সেই প্রহরী কক্ষের বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকে। ক্যাথরিন কক্ষে প্রবেশ করে দেখে লোল্যান্ডা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। ক্যাথরিন ধীরে ধীরে লোল্যান্ডার ক্যাবিনেট থেকে একটি হুডেড ক্লক হাতে নিয়ে নেয়। তারপর দরজার কাছে গিয়ে সেটা আধা খুলে মাথা বের করে বলে,

” আমাদের জন্য খাওয়ার কিছু পাঠাও। ”
প্রহরীটা হালকা ভ্রু কুচকে তাকাতেই ক্যাথরিন তাড়া দিয়ে বলে উঠে,
” তাড়াতাড়ি যাও। এতো অবাক হওয়ার কি আছে? ”
প্রহরীটা চুপচাপ মাথা নত করে চলে যেতেই ক্যাথরিন ধীরে ধীরে কক্ষ হতে বেড়িয়ে পড়ে। উপরে এসে আরোণের কক্ষে লুকিয়ে প্রবেশ করে। আরোণ প্রাসাদে নেই। সেই যে বিকেলে গিয়েছে এখনো ফিরে নি। এটাই মোক্ষম সুযোগ। ক্যাথরিন আরোণের কক্ষের আলমারির সামনে এসে দাঁড়িয়ে একবার মনে করে গতবার আরোণ কিভাবে তাকে ক্রিয়াসের সাথে লুকিয়ে পালাতে সাহায্য করেছিলো।

ক্যাথরিন আলমারির পাশের দেয়ালের একটা বিশাল পাথর ধরে টান মারে। সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালটি দু দিকে সরে গিয়ে সুরঙ্গ পথ বেরিয়ে আসে। ক্যাথরিন আরোণের কক্ষ হতে একটি লণ্ঠন নিয়ে সুরঙ্গ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। নিচে নেমে আবার একইভাবে পাথর টান দিয়ে দেয়ালের একাংশ খুলতেই সে বেড়িয়ে পড়ে। তারপর সেই সুরঙ্গ দ্বার বন্ধ করে ভ্যালেন্টাইনের দিকে এগিয়ে যায় সে। বিকেলে আরোণ বেড়িয়ে যাওয়ার পর যখন সে সিদ্ধান্ত নেয় এই প্রাসাদে সে আর থাকবে না তখনই সে নিচে গিয়ে ভ্যালেন্টাইনকে খাওয়ানোর বাহানায় তাকে লুকিয়ে প্রাসাদের পিছনের দিকে এনে বেধে রেখেছিলো। শুধু মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছিলো যেন আরোণ তাড়াতাড়ি প্রাসাদে না ফিরে আসে। তাহলেই একমাত্র সে এখান থেকে পালাতে পারবে।
ক্যাথরিন ভ্যালেন্টাইনের গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

” এই যাত্রায় তুই আমার একমাত্র সঙ্গী। পথে আসা যেকোনো বিপদে আমাদের নিজেদেরই একে অপরকে রক্ষা করতে হবে ভ্যালেন্টাইন। আজ থেকে আমরা মুক্ত। ”
হাতে থাকা হুডেড ক্লকটা পড়ে সেটার হুড টেনে মাথায় তুলে দেয় ক্যাথরিন। তারপর ভ্যালেন্টাইনের উপর চড়ে বসে তার লাগাম ধরে জঙ্গলের ভিতরে যাত্রা শুরু করে সে। গতবার ক্রিয়াসের সাথে যাওয়ার সময় ভালো করে পথ চিনে রেখেছিলো সে। তার উদ্দেশ্য বুখারেস্টে পৌঁছানো। বুখারেস্টে একবার পৌঁছাতে পারলেই বন্দর হতে সমুদ্র পথে গ্রীকে পৌঁছে যাবে সে। সমুদ্র পথে কখনোই আরোণ তাকে খুঁজে পাবে না।

হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ পেতেই লোল্যান্ডা চোখ ডলতে ডলতে বিছানা ছেড়ে নেমে দরজা খুলে। দরজার সামনে খাবারের ট্রে হাতে প্রহরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকায় সে। সে কি ঘুমের ঘোরে খাবার চেয়েছে নাকি? তার তো মনে পড়ছে না। লোল্যান্ডা প্রশ্ন করে,
” এগুলো কার জন্য? ”
” ক্যাথরিন খাবার নিয়ে আসতে বললো। ”
” এটা ক্যাথরিনের কক্ষ নয়। তার কক্ষ তো উপরে। ”
” কিন্তু ক্যাথরিন তো মাত্র তোমার কাছে আসলো। ”
লোল্যান্ডা বিস্ময় নিয়ে বলে,
” আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। ক্যাথরিন তো আসে নি। ”
প্রহরীর মুখে সাথে সাথে ভয় ফুটে উঠে। সে হাতের খাবারের ট্রে ফেলে বাতাসের গতিতে উপরে চলে যায়। লোল্যান্ডা দৌড়ে গিয়ে ক্রিয়াসের কক্ষের কড়া নাড়তে শুরু করে। ট্রে পড়ার শব্দে ততক্ষণে প্রাসাদে উপস্থিত বাকি নেকড়েরাও তাদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। ক্রিয়াস দরজা খুলতেই লোল্যান্ডাকে আতঙ্কিত দেখে ঘাবড়ে যায়। প্রশ্ন করে,

” কি হয়েছে? ”
” ক্যাথরিন। ”
” ক্যাথরিন কি? কি হয়েছে ক্যাথরিনের? ”
ততক্ষণে সেই প্রহরী এসে পিছন হতে বলে উঠে,
” ক্যাথরিন প্রাসাদে নেই। ”
সকল নেকড়েদের মুখে আতংক ফুটে উঠে। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠে,
” প্রাসাদে নেই মানে কি? খুঁজো সবাই মিলে। প্রাসাদের বাহিরে প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে সে কোথায় যাবে? ”
সকলেই সাথে সাথে বাতাসের বেগে প্রাসাদে ক্যাথরিনকে সন্ধান করা শুরু করে দেয়। ক্রিয়াস দৌড়ে গিয়ে প্রাসাদের মূল দরজার সামনে দাঁড়ানো নেকড়েদের জিগ্যেস করে ক্যাথরিন বাহিরে বেড়িয়েছে নাকি। তারা জানায় তারা এতক্ষণ ধরে এখানেই আছে, ক্যাথরিনকে বের হতে দেখে নি। সকলেই সম্পূর্ণ প্রাসাদ খুঁজে ফেলে কোথাও ক্যাথরিনকে পায় না। সকলের চোখে মুখেই আতংক বিরাজ করছে।
বলা হয় যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আরোণ সবেমাত্র দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে। সামনে তাকাতেই সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠে। সকলে একত্রে এই মাঝরাতে কি করছে? আরোণকে দেখে সকলে আরো ঘাবড়ে যায়। আরোণ প্রশ্ন করে,

” কি হয়েছে? সকলে এখানে কি করছো? ”
ক্রিয়াস ঘাবড়ানো কণ্ঠে জবাব দেয়,
” আলফা ক্যাথরিন নেই। ”
আরোণ ভীত স্বরে বলে,
” নেই মানে? ”
” ক্যাথরিন প্রাসাদে নেই। কোথাও ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ”
আরোণ এক মুহূর্ত দম নেয়। তার মস্তিষ্ক শূন্য মনে হচ্ছে। ক্রিয়াসের ডাকে স্তম্ভিত ফিরে পেতেই সে গর্জন করে বলে উঠে,
” সকলে বেড়িয়ে জঙ্গলে খুঁজো ক্যাথরিনকে। যেকোনো মূল্যে ওকে খুঁজে নিয়ে আসো। ক্যাথরিনকে যদি খুঁজে না পাই তাহলে একজনকেও জীবিত ছাড়বো না আমি। ”
সাথে সাথে আরোণ বেড়িয়ে পড়ে জঙ্গলে। বাকিরাও তার পিছনে পিছনে বেড়িয়ে পড়ে। ক্রিয়াস বেড়িয়ে যাওয়ার আগে লোল্যান্ডাকে বলে,
” তুমি তোমার কক্ষে গিয়ে বসো। ভুলেও বের হবে না। ”

ভোরের আলো ফুটতে আর কিছু সময় বাকি। আরোণসহ সকলে প্রাসাদে ফিরে আসে। সমগ্র জঙ্গল খুঁজেও ক্যাথরিনের কোনো অস্তিত্ব পায় নি কেউ। আরোণকে দেখতে একদম বিধস্ত দেখাচ্ছে। হাতে শরীরে মুখে রক্ত লেপ্টে আছে। চোখে হতাশার ছায়া। সকলেই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। হঠাৎ আরোণ সেই প্রহরী দুজনকে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই গর্দান আলাদা করে মেরে ফেলে। হুংকার দিয়ে বলে উঠে,
” ক্যাথরিনের শরীরে একটা আঁচ লাগলেও আমি সকলকে সেই মৃত্যু দিবো যা কেউ কল্পনাও করতে পারে নি। ”
এটুকু বলেই আরোণ উপরে নিজের কক্ষে চলে যায়। কক্ষে প্রবেশ করতেই আরোণ রাগে ভাঙচুর শুরু করে। ভাঙচুর করতে করতে হঠাৎ লক্ষ্য করে তার আলমারির পাশের সেই সুরঙ্গ পথ খোলা। আরোণ সেদিকে তাকিয়ে সাথে সাথে বুঝে যায় ক্যাথরিন কোথায় যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে সে নিচে গিয়ে সকলকে বলে,

” ক্যাথরিন বুখারেস্টের উদ্দেশ্যে গিয়েছে। এই মুহুর্তে সকলে বুখারেস্ট যাবো আমরা। ”
বলে সাথে সাথে সে নিজের নেকড়ে রূপ ধারণ করে। বাকিরাও আর কোনো প্রশ্ন না করে নিজেদের নেকড়ে রূপ ধারণ করে আরোণের পিছনে বেরিয়ে পড়ে। ক্রিয়াস বের হওয়ার আগে লোল্যান্ডার কক্ষে গিয়ে তাকে বলে,
” প্রাসাদে প্রহরী নেকড়েরা আছে। আমি না আসা পর্যন্ত তোমার বের হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিছু দরকার হলে তাদের বলবে। ”
লোল্যান্ডা বলে,
” ক্যাথরিনকে নিয়ে তবেই ফিরে এসো। ”

সকালে নাস্তা করে উপর হতে নিচে নেমেই সকল শক্তি শেষ আনাস্তাসিয়ার। মনে মনে এই দূর্গ ও রিকার্ডোর গুষ্টি উদ্ধার করছে সে। গোছল করার সেই জায়গা পরিষ্কার করতে করতে আনাস্তাসিয়া বলতে থাকে,
” অসভ্য কোথাকার। দূর্গ তোর, কাউন্ট তুই। তাহলে তুই নিজে পরিষ্কার কর না। আমাকে দিয়ে দাসীর মতো খাটাচ্ছিস। ঈশ্বর তোকে দেখে নিবে। আমাকে দেখলে ছোট বেলায় আমার শিক্ষকদেরও মায়া লাগতো আর তুই কোথাকার কোন ভ্যাম্পায়ার তোর মায়া লাগলো না? পাষাণ কোথাকার। খালি যদি তুই ভ্যাম্পায়ার না হয়ে মানুষ হতি তাহলে বুঝতি প্রতিদিন তোর এই দুইশো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার মজা কতো। ”
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলে উঠে,

” আমার কোনো সন্দেহ নেই এসব আমাকে বলা হচ্ছে। ”
আনাস্তাসিয়া তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে দেখে রিকার্ডো দাঁড়িয়ে আছে। আনাস্তাসিয়া আরো বিদ্রুপ করে বলে,
” হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। আপনি আমার জীবন এতো প্রশান্তিময় করে তুলেছেন যে খুশিতে আপনাকে ধন্যবাদ সরূপ এসব বলছি। ”
এটা বলে আনাস্তাসিয়া আবার নিজের কাজে মন দেয়। রিকার্ডো বলে,
” সাহস বেশি বেড়ে গিয়েছে? এতো মুখ চালানো কোথা থেকে শিখেছো? ”
আনাস্তাসিয়া প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো বলে,
” কিছু মানুষের স্বভাব কখনো বদলায় না। ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে বলে,

” এটা তুমি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছো? ”
” এখানে আর কেউ আছে? ”
” আমার কোন স্বভাব নিয়ে বলছো তুমি? ”
” হুটহাট পিছন থেকে এসে ভুতের মতো কথা বলে উঠার স্বভাব সম্পর্কে বলছি। ”
” তুমি আমার মুখের উপর আমাকে নিয়েই বদনাম করছো? এতো সাহস হয়েছে? একদম নিয়ে… ”
আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর কথা থামিয়ে দিয়ে বলে,
” জানি জানি আমায় মেরে কৃষ্ণ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। এখানে আসার পর থেকে এটা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে আমার। কৃষ্ণ সাগরকে তো আমার এখন নিজের শ্বশুর বাড়ি মনে হয়। কিছু বললেই সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি পাই শুধু। ”
রিকার্ডো আর কিছু বলবে তার আগেই আনাস্তাসিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

” কাজ শেষ। এখন আমার যাওয়ার অনুমতি আছে? দুইশো সিঁড়ি পেরিয়ে এখন উপরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করা কি আমার কপালে জুটবে? ”
এটুকু বলেই রিকার্ডোর উত্তরের অপেক্ষা না করে আনাস্তাসিয়া বের হয়ে যেতে থাকে বিড়বিড় করে।
রিকার্ডো স্পষ্ট শুনতে পায় আনাস্তাসিয়া বলছে,
” আমি অনুমতি কেন চাচ্ছি? কেউ আমায় অনুমতি না দিলেও এখন আমি বিশ্রাম করতে যাবো। এসব ভ্যাম্পায়ারদের জাত কি বুঝবে মানুষের কষ্ট। ”
রিকার্ডো বোকার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এইমাত্র আনাস্তাসিয়ার তাকে শুনিয়ে যাওয়া সবগুলো কথা তার কানে বাজতে থাকে। সে বলে উঠে,
” কৃষ্ণ সাগর? শ্বশুর বাড়ি? ”
এটুকু বলতেই রিকার্ডোর মুখে হাসি ফুটে উঠে। হাসতে হাসতে সে বলে,
” কাজ করতে গিয়ে ও সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নামতে গিয়ে এই মেয়ের মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ”

বুখারেস্ট শহরের বিশাল বাজারে হাঁটছে ওরিয়ন। তার হাত ধরে সাথে হাঁটছে নিকোডিমাস। একটি ভোজনশালায় এসে দুজনেই বসে পড়ে কিছু খাওয়ার জন্য। খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নিকোডিমাস ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” আমরা কাস্টোরিয়া ছেড়ে কেন এসেছি ভাই? ওখানে আমাদের বাসা ছিলো। এখানে আমরা কি করবো? ”
পরিবারের মৃত্যুর পর থেকে ওরিয়ন একদম চুপ হয়ে পড়েছে। তেমন একটা কথা বলছে না নিজ থেকে। নিকোডিমাস প্রশ্ন করতেই সে হাতের ক্রুশের হারটির দিকে তাকিয়ে বলে,
” একজনকে খুঁজতে এসেছি আমরা। তাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না আমি। তাকে নিয়ে আমরা কাস্টোরিয়ায় ফিরবো। ”

” তুমি অ্যানাকে খুঁজতে এসেছো তাই না? ”
ওরিয়ন এই প্রশ্নের আর জবাব দেয় না। নিকোডিমাস বুঝে নেয় নীরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ। তাই সে আর কোনো প্রশ্ন না করে খাওয়ায় মন দেয়।
ওরিয়ন যখন যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সকলের লাশ পায় তখন সে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো। সমগ্র কাস্টোরিয়া যেন ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছিল। নিজের ভাইকে বুকে জড়িয়ে যখন সে দায়িত্বশীল বড় ভাইয়ের মতো শান্তনা দিচ্ছিলো তখন সে হঠাৎ লক্ষ্য করে যে এতো লাশের মধ্যে আনাস্তাসিয়া নেই। তার মনে আশা জাগে যে আনাস্তাসিয়া হয়তো বেঁচে আছে। আশেপাশে যারা জীবিত ছিলো তাদের প্রশ্ন করে সে জানতে পারে আনাস্তাসিয়াকে রোমানিয়ান সৈন্যরা তুলে নিয়ে গিয়েছে। আরো অনেককেই এরকম তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের সকলকেই দাস বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
ওরিয়ন মনে মনে বলে,
” ঈশ্বর আনাস্তাসিয়াকে খুঁজে পেতে আমাকে সাহায্য করো। ওর জীবন রক্ষা করো। ”

সবেমাত্র বুখারেস্টে প্রবেশ করেছে ক্যাথরিন। পথিমধ্যে একবার শুধু থেমে ভ্যালেন্টাইনকে পানি পান করিয়েছিলো। নিজেও কিছুটা পানি পান করে নিয়েছিলো। সেটা ছিলো সকালের ঘটনা। এখন বিকাল প্রায়। এতক্ষণ ধরে যাত্রা করে সে খুব ক্লান্ত। কিন্তু বন্দরেও যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে হবে তাকে। বাজারে এসেই সে অনুভব করে তার খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু তার কাছে কোনো মুদ্রা নেই যে কিছু কিনে খেতে পারবে। ক্যাথরিনের মুখ কালো হয়ে আসে। সে ভুল করেছে একটা। জঙ্গল হয়ে আসার সময় তার উচিত ছিলো কিছু ফল জোগাড় করে নেওয়া। সেটাতে মুদ্রার প্রয়োজন হতো না। ভ্যালেন্টাইনের গলার লাগাম ধরে ধীরে ধীরে বাজার হয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। কাউকে জিগ্যেস করতে হবে তার বন্দর কোন দিকে।
একটি দোকানের সামনে এসে সে এক দণ্ড দাঁড়ায়। এদিকে বাকি দোকানের তুলনায় ভীড় কম। একজন বাচ্চা, আর দু তিনজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে কেবল। ক্যাথরিন দোকানের একটি মাটির তৈরী ঘোড়া হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে দোকানদারকে প্রশ্ন করে,

” আচ্ছা এখানে সমুদ্র বন্দরটা কোন দিকে? ”
দোকানদার লোকটা ক্যাথরিনকে একবার পরখ করে নিয়ে প্রশ্ন করে,
” কোথায় যাবেন? ”
” গ্রীক যাবো। সীমান্তঞ্চল মেসিডোনিয়ার বন্দরে পৌঁছাতে পারলেই হবে। ”
লোকটা একবার ক্যাথরিনের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় তার সাথে আর কেউ আছে নাকি। যখন বুঝতে পারে সে একা তখন লোকটা দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,
” বন্দরে আমার লোক আছে পরিচিত। কাল সকালেই মেসিডোনিয়ার উদ্দেশ্যে একটি জাহাজ যাত্রা করবে। আপনি চাইলে ওই জাহাজে করে যেতে পারেন। ”
ক্যাথরিন নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবে ভেবে খুশি হয়। কিন্তু পরক্ষণেই কাল সকালে জাহাজ শুনে তার মন খারাপ হয়ে যায়। কাল সকাল পর্যন্ত সে কিভাবে আরোণের থেকে পালিয়ে থাকবে? ক্যাথরিনের ভাবনার মাঝেই লোকটা বলে উঠে,

” কিন্তু আপনার কাছে মুদ্রা আছে? ”
ক্যাথরিনের হুশ হয়। নিজের বোকামির উপর লজ্জিত অনুভব করে। মলিন মুখ করে বলে,
” না আমার কাছে কোনো মুদ্রা নেই। ”
লোকটা হালকা বিদ্রুপ করে হেসে বলে,
” আহা! আপনি মন খারাপ করছেন কেন? ”
” আপনার কাছে মুদ্রা না থাকলেও সমস্যা নেই। মেসিডোনিয়ায় পৌঁছে জাহাজের মুদ্রা পরিশোধ করতে পারবেন তো? ”
ক্যাথরিন মনে মনে ভাবে একবার মেসিডোনিয়ায় পৌঁছাতে পারলে একটা না একটা ব্যবস্থা সে অবশ্যই করতে পারবে। তাই সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। লোকটা বলে,

” আচ্ছা তাহলে কালকে সকাল সকাল আপনি আমার দোকানে চলে আসবেন। আমি আপনাকে বন্দরে পৌঁছে জাহাজে তুলে দিয়ে আসবো। ”
ক্যাথরিন আমতা আমতা করে বলে,
” যদি কিছু মনে না করেন একটা সাহায্য করবেন দয়া করে? ”
লোকটি প্রশ্ন করে,
” কি? ”
” আজকে রাতে আমার থাকার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন দয়া করে? আমি মেসিডোনিয়ায় পৌঁছেই আপনাকে মুদ্রা পরিশোধ করে দিবো। ”
লোকটার মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠে। হাসতে হাসতে বলে,
” অবশ্যই। আপনি চাইলে আজকের রাতটা জাহাজে পাড় করতে পারেন। কোনো অসুবিধা নেই তো আপনার? ”
ক্যাথরিন মাথা নেড়ে বলে,

” না। আমার কোনো সমস্যা নেই। ”
লোকটি হাঁটা শুরু করতেই ক্যাথরিন তার পিছনে হাঁটা ধরে ভ্যালেন্টাইনকে সহ। হঠাৎ নিজের গাউনের নিচের দিকে টান অনুভব করতেই পাশ ফিরে নিচে তাকায় সে। একটি বাচ্চা ছেলে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স সাত-আট সম্ভাব্য। বাচ্চাটি হাতের ইশারায় ক্যাথরিনকে নিচের দিকে ঝুঁকতে বলে। ক্যাথরিন কিছুটা ইতস্তত করে নিচু হতেই বাচ্চাটি তার কানে কানে কিছু একটা বলে। ক্যাথরিন বাচ্চাটির কথায় ভীত হয়ে সামনের দিকে তাকায়। লোকটা এখনো লক্ষ্য করে নি যে ক্যাথরিন পিছনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাচ্চাটি আবার এক ইশারা করতেই ক্যাথরিন ধীরে ধীরে পিছন থেকে ভ্যালেন্টাইন সহ আড়াল হয়ে আসে। বাজারের ভেতর হয়ে অন্য এক গলিতে প্রবেশ করে তাড়াতাড়ি রাস্তা বদলে ফেলে। অন্য গলিতে আসতেই বাচ্চাটি বলে,

” আরেকটু হলেই তুমি ফেসে যেতে। ”
ক্যাথরিন বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” ধন্যবাদ তোমাকে। ”
তখনই সেই নীরব গলিতে আরেকটি যুবক প্রবেশ করে হাঁটতে হাঁটতে। ক্যাথরিন পাশে ফিরে যুবকটার দিকে তাকাতেই বাচ্চাটি বলে,
” ধন্যবাদ আমি নই আমার ভাই প্রাপ্য। সে ই আমাকে বলে তোমাকে ওই লোকের চক্র থেকে বাঁচিয়েছে। ”
ওরিয়ন সামনে এসে বলে,
” আপনি গ্রীক হতে এসেছেন? ”
ক্যাথরিন ইতস্তত করে বলে,
” হ্যাঁ। ”

” পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। আমিও গ্রীক হতে এসেছি। মেসিডোনিয়ার কাস্টোরিয়ায় আমার বাড়ি। আমার নাম ওরিয়ন এবং আমার ভাইয়ের নাম নিকোডিমাস। ”
” কাস্টোরিয়া? কাস্টোরিয়ায় আমার গ্র্যানির বাসা। ”
ওরিয়ন অবাক হয়। প্রশ্ন করে,
” আপনাকে আগে কখনো কাস্টোরিয়ায় দেখিনি আমি। কোন পরিবারের আপনি? ”
ক্যাথরিন হেসে বলে,
” আমি কাস্টোরিয়ার স্থানীয় নই। আমার গ্র্যানির নাম অফিলিয়া। অফিলিয়া কোলান। ”
সাথে সাথেই ওরিয়নের মুখ কালো হয়ে আসে। সে প্রশ্ন করে,

” আপনার নাম ক্যাথরিন অ্যালভেজ? ”
” জ্বি। ”
নিকোডিমাস পাশ থেকে অবাক সুরে প্রশ্ন করে,
” তুমি ক্যাথরিন? লিয়াম ও অ্যানার বোন? তুমি তো মারা গিয়েছিলে। লিয়াম আমায় বলেছিলো। ”
নিজের বোন ও ভাইয়ের কথা শুনে ক্যাথরিন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। উতলা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
” তুমি তাদের চিনো? ওরা কেমন আছে? আমার গ্র্যানি কেমন আছে? ”
ওরিয়ন মুখ কালো করে বলে,
” দেখুন ক্যাথরিন আমি নিজ দায়িত্বে আপনাকে গ্রীকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিতাম। কিন্তু আমার কথা শুনার পর আপনি গ্রীক ফিরতে চাইবেন নাকি তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ”
ওরিয়নের কথা শুনে অবাক হয় ক্যাথরিন। প্রশ্ন করে,
” কি কথা? ”
” এখানে বলা ঠিক হবে না। আপনি চাইলে সামনেই আমি একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি সেখানে বসে কথা বলতে পারি। নিকোডিমাসের সামনে কথা বলাটা ঠিক হবে না। ”
ক্যাথরিন নিজের কৌতুহল মনে চেপে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। মনে মনে ভাবতে থাকে ওরিয়ন তাকে কি বলতে পারে? তার পরিবার সম্পর্কিত কোনো খবর? তার পরিবারের সকলে ঠিক আছে তো?

” জ্যাকসন কখনোই একজন হাইব্রিডে পরিণত হতে পারবে না। ”
খুব ঠান্ডা স্বরে কথাটি বলে কপালের থেকে হাত সরায় রিকার্ডো। হলরুমের সকল কোভেনদের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে। ম্যাথিউ ঘাড় বাকা করে বলে,
” আপনার মনে হয় না কাউন্ট আপনি জ্যাকসনকে খুব হালকাভাবে নিচ্ছেন? ”
রিকার্ডো বলে,

” কি ব্যাপার কোভেন ম্যাথিউ? আজকাল হলরুমে কোভেনদের আলোচনায় আপনার মনোযোগ যেন শতভাগ বেড়ে গিয়েছে। আগে তো আপনাকে দূর্গেই দেখতে পাওয়া যেত না। ”
” কেন? আমায় এখানে দেখে আপনার ভালো লাগছে না বুঝি? ”
” আমার কেন খারাপ লাগবে? কোভেনদের প্রতি আপনার আগ্রহ দেখে মুগ্ধ আমি। রক্ত পান ছাড়াও যে ভ্যাম্পায়ারদের জীবনে আরো কাজ আছে তা আপনার মনে পড়েছে সেটাই বড় বিষয়। ”
ক্যামিলো ছেলেদের এমন ত্যাড়া কথা থামানোর জন্য বলে উঠে,
” কিন্তু আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে জ্যাকসন হাইব্রিড ক্ষমতা লাভের জন্য যেকোনো সীমা অতিক্রম করতেও দ্বিধা বোধ করবে না। ”
রিকার্ডো বলে,

” জ্যাকসন হাইব্রিড ক্ষমতা লাভ করতে চাইলে তার আদি ভ্যাম্পায়ারকে প্রয়োজন পরবে যে জীবিত নেই আর। কিন্তু আদি ভ্যাম্পায়ার নিজের সকল শক্তি আমায় সমর্পণ করে গিয়েছেন মারা যাওয়ার আগে। আর আমি কখনোই জ্যাকসনকে ভ্যাম্পায়ার ক্ষমতা দান করে হাইব্রিড হতে সহায়তা করবো না। ”
ড্যানিয়েল নিজের আসনে বসে থেকে ঠাট্টার স্বরে বলে,
” আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন কাউন্ট যে শুধু আদি ভ্যাম্পায়ার নয় বরং অন্য আরেকটা রাস্তাও জ্যাকসনের কাছে খোলা আছে যদি সে হাইব্রিড হতে চায়। ”

সবাই ড্যানিয়েলের দিকে তাকায়। সকলের দৃষ্টি নিজের দিকে আকর্ষণ করতে পেরে ড্যানিয়েল হেসে বলে উঠে,
” কোনো ভ্যাম্পায়ার নারী নিজের গর্ভে জ্যাকসনের সন্তান ধারণ করলেও কিন্তু সেই সন্তান একজন হাইব্রিড হয়ে জন্ম নিবে। আর আমি নিশ্চিত জ্যাকসন নিজে হাইব্রিড না হতে পারলে প্রয়োজনে এই রাস্তা অবলম্বন করার চেষ্টা করতেও বাদ রাখবে না। ”
রিকার্ডো চোখ পাকিয়ে তাকায় ড্যানিয়েলের দিকে। বাকি সকলকে আদেশ করে হলরুম থেকে বেরিয়ে যেতে। সকলে বেরিয়ে গেলেও ক্যামিলো এবং ম্যাথিউ রয়ে যায়। রিকার্ডো দাঁত চেপে ড্যানিয়েলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” তুমি কি সকল ভ্যাম্পায়ার নারীদের মনে করিয়ে দিচ্ছো যে তারা চাইলে গিয়ে জ্যাকসনের সন্তান গর্ভে ধারণ করে সর্বশক্তিমান হতে পারে? ”

ড্যানিয়েল হালকা হেসে বলে,
” আমি শুধু সত্যিটা বলছিলাম রিকার্ডো। ”
রিকার্ডো কয়েক কদম সামনে এগিয়ে এসে ড্যানিয়েলের চোখে চোখ রেখে ক্ষুদ্ধ স্বরে বলে,
” মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি নামে মাত্র আমাকে নিজের ছেলে বলে বেড়াও। কিন্তু তোমার মনে আমাকে নিয়ে বিষ পুষে রেখেছো। কিন্তু ভুলে যেও না আমি কে। রিকার্ডো আমি৷ শত্রু মিত্র উভয়ের সকল পদক্ষেপের জরিপ করে রাখি আমি। ”
ক্যামিলো রাগান্বিত স্বরে বলে,

” রিকার্ডো! তুই ভুলে যাচ্ছিস তুই তোর বাবার সাথে কথা বলছিস? ”
রিকার্ডো চেচিয়ে বলে উঠে,
” তোমাকে আমি মা মানি। তুমি আমাকে মায়ের ভালোবাসা দিয়েছো। কিন্তু এই লোক কখনো আমায় পিতার স্নেহ দেয় নি। বুঝ হওয়ার পর থেকেই এই লোক আমাকে প্রতি পদে পদে বুঝিয়ে এসেছে যে আমি তার সন্তান নই। তাই তার সাথে সন্তান স্বরূপ আচরণ করতে পারছি না। ”
ড্যানিয়েল চলে যেতে যেতে বলে,

” কিছু মানুষ চিরজীবন অকৃতজ্ঞই রয়ে যাবে ক্যামিলো। যেই সন্তানকে জীবন রক্ষা করে তুমি নিজের কোলে তুলে নিয়েছিলে আজ সেই সন্তানই তোমার স্বামীর উপর প্রশ্ন তুলছে। অনাথকে পালার প্রতিদান দিচ্ছে৷ ”
এটুকু বলেই ড্যানিয়েল হলরুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়। ক্যামিলো একবার মুখ তুলে রিকার্ডোর দিকে তাকায়। রিকার্ডোর মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। শুধু তীব্র গতিতে সে হলরুম থেকে বেরিয়ে যায়। ম্যাথিউ এতক্ষণ দূরে বসে এসব কিছুই দেখছিলো। হালকা স্বরে সে বলে উঠে,
” অনাথ হয়েও তুমি মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হও নি কখনো। আর মা বাবা থাকা সত্ত্বেও কখনো তাদের ভালোবাসা অনুভব করি নি আমি। কি অদ্ভুত ভাগ্য আমাদের। ”

একটি দোতালা বাসার ভেতরে বসার ঘরে বসে আছে ক্যাথরিন। নিকোডিমাসকে উপরে পাঠিয়ে দিয়ে ওরিয়ন ক্যাথরিনের সামনে এসে বসে। তারপর বলে,
” আপনি বেঁচে আছেন কিভাবে? ”
ক্যাথরিন নিজের রোমানিয়ায় আসার পর থেকে এপর্যন্ত তার সাথে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা মনে করে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
” আমি জীবিত আছি এটাই কি বড় বিষয় না? ”
ওরিয়ন বুঝতে পারে ক্যাথরিন এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই সে আর আগ বাড়িয়ে এই সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করে না। কথা ঘুরিয়ে সে বলে,

” দেখুন ক্যাথরিন প্রথম কথা হচ্ছে এটা আপনার নিজের দেশ নয়। তাই এখানে কারো উপর ভরসা করার আগে নিজেকে একশো বার প্রশ্ন করে নিবেন। এই বাজারে বেশিরভাগ লোকই দালাল প্রকৃতির। আপনি একা বুঝতে পেরে লোকটা আপনাকে ফাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। হয় আপনাকে দাস বাজারে বিক্রি করে সে অর্থ উপার্জন করতো অথবা আপনার সাথেও অশোচনীয় কোনো কাজ করতে পারতো। ”
ওরিয়নের শেষের কথার মানে বুঝতে পেরে ক্যাথরিনের শরীর হিম হয়ে যায়। কিন্তু তার কাছে তখন ভরসা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না। ওরিয়ন বলে,
” আপনাকে যা বলতে নিয়েছিলাম তখন তা হচ্ছে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে কিছুদিন আগে রোমানিয়া ও গ্রীকের মাঝে যুদ্ধ হয়েছে? ”

ক্যাথরিন হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়। ওরিয়ন বলতে থাকে,
” সেই যুদ্ধ গ্রীকের সীমান্ত অঞ্চলের উপর দিয়ে বেশ খারাপ প্রভাব ফেলেছে। সেখানে সব প্রায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে। এখনো সেখানে বাতাসে বারুদের গন্ধ ভেসে বেরাচ্ছে। ”
ক্যাথরিনের মনে পড়ে মেসিডোনিয়াও গ্রীকের সীমান্ত অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। সে আর্তনাদ স্বরে প্রশ্ন করে,
” আমার পরিবার? ”

ওরিয়ন এই মুহুর্তে অনুভব করে পৃথিবীর সবথেকে কঠিন কাজ হলো কোনো মানুষকে তার পরিবারের মৃত্যুর সংবাদ জানানো। কিন্তু এই কঠিন কাজটাই এখন তার করতে হবে। ওরিয়ন শীতল স্বরে বলে,
” সেই যুদ্ধে রোমানিয়ান সৈন্যদের হাতে আপনার পরিবার নৃশংসভাবে খুন হয়। ”
ক্যাথরিনের মনে হয় এক মুহূর্তের জন্য সব থমকে গিয়েছে। কিছু অনুভব করতে পারছে না সে। তার পরিবার আর নেই এই কথাটা তার কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অক্সিজেনের মাত্রা কি কমে এসেছে হঠাৎ করে? তাহলে সে শ্বাস নিতে পারছে না কেন? ক্যাথরিন জোরে জোরে দুবার শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে। ক্যাথরিনের এমন অবস্থা দেখে ওরিয়ন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে উঠে তাড়াতাড়ি বলে,

” আপনি বসুন ঠান্ডা হয়ে। আমি আপনার জন্য পানি নিয়ে আসছি। ”
এটা বলেই ওরিয়ন দৌড়ে রান্নাঘরে যায় পানি আনতে। পাত্র থেকে গ্লাসে করে পানি নিয়ে বসার ঘরে আসতেই সে দেখে বসার ঘর সম্পূর্ণ খালি। ক্যাথরিন কোথাও নেই। ওরিয়ন দৌড়ে দরজার বাহিরে গিয়ে তাকিয়ে দেখে বাহিরে ঘোড়াটাও নেই। তারমানে ক্যাথরিন চলে গিয়েছে। ওরিয়নের পক্ষে সম্ভব হয় না ক্যাথরিন কোথায় খুঁজতে যাওয়া। নিকোডিমাসকে একা রেখে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ওরিয়ন মনে মনে বলে,
” পুরোটা না শুনেই চলে গেলেন আপনি। আপনার বোন এখনো জীবিত আছে এবং রোমানয়াতেই আছে। আর আমার বিশ্বাস আনাস্তাসিয়া যেখানেই আছে ভালো আছে। ”

ঘোড়া নিয়ে দিক বেদিক ভুলে ছুটছে ক্যাথরিন। বুখারেস্টের একটি জঙ্গলে প্রবেশ করেছে সে। জঙ্গল পেরিয়ে আরেকটু সামনেই পাহাড়ের বিশাল খাদ। কিন্তু ক্যাথরিনের সেদিকে ধ্যান নেই। তার কানে এখনো সেই একই কথা বাজছে যে তার পরিবার খুন হয়েছে। তার ছোট ভাই, লিয়াম, তাকে মারার সময় কি পাষাণদের মনে একবারও দয়া হয় নি? কিভাবে মেরেছে তারা তার ভাইকে? লিয়াম কি বাঁচার জন্য কাদছিলো? ছটফট করছিলো? অ্যানা? তাকেই বা কিভাবে মেরেছে তারা? বর্বর সৈন্যরা তার বোনের নরম শরীরে কি তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেছিলো? গ্র্যানিকেই বা কিভাবে মারতে পারলো তারা? এসব ভাবনায় সামনে থাকা খাদ খেয়াল করে না ক্যাথরিন। পাহাড়ের খাদের একদম কাছাকাছি এসে পড়ে সে এমন সময়ই বাতাসের মতো তীব্র বেগে কেউ একজন লাফ দিয়ে ক্যাথরিনের পিছনে বসে লাগাম টেনে ধরে ঘোড়া ঘুরিয়ে ফেলে অন্যদিকে। নিরাপদ জায়গায় এনে ঘোড়া থামিয়ে আরোণ সাথে সাথে নিজে নেমে পড়ে এবং ক্যাথরিনের কোমর ধরে তাকেও টেনে নিচে নামায়।

” তোমার এতো মরার ইচ্ছে করছে তাহলে আমাকে বললেই পারতে। এতো কষ্ট করে পালিয়ে বুখারেস্ট এসে মরার কষ্ট কেন করতে গেলে তুমি? তোমাকে বাসকোভ প্রাসাদেই মরার ব্যবস্থা করে দিতাম আমি। ”
রাগে থরথর করে কাপছে আরোণ। দু চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে তার। আরেকটু হলেই কি হতে পারতো ভেবেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ততক্ষণে আরো অনেকগুলো নেকড়ে তাদের চারিপাশ দিয়ে এসে ঘিরে দাঁড়ায়। সকলেই নিজের নেকড়ে সত্ত্বা বদলে মানুষের রূপ ধারণ করে। আরোণ আবার চেচিয়ে উঠে,
” তোমার কি মনে হয়েছে আমার থেকে পালানো এতো সহজ? পৃথিবীর যে কোণায় গিয়ে লুকাবে সেখানেই আমাকে পাবে তুমি। ”

সকল নেকড়েরা ক্যাথরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ক্যাথরিনের স্বভাব অনুযায়ী তার কখনোই এই মুহুর্তে চুপ থাকার কথা না। উল্টো আরোণের সাথে ঝগড়া করার কথা তার। কিন্তু তার কান দিয়ে যেন কোন কথা যাচ্ছেই না। আরোণ ক্যাথরিনের কাধে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
” এখন কি চুপ থেকে আমাকে জ্বালানোর ফন্দি এঁটেছো? ”
” ছুঁবে না আমায়। ”
খুব সাধারণ তিনটা শব্দ। খুব শান্তস্বরে বলে ক্যাথরিন। কিন্তু তার বলার মাঝে কিছু একটা ছিলো। তাইতো আরোণের হাত আপনাআপনি সড়ে গেল। আরোণ এতক্ষণে মাথা ঠান্ডা করে ক্যাথরিনের দিকে লক্ষ্য করে। ক্যাথরিন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আরোণ প্রশ্ন করে,

” কি হয়েছে ক্যাথ? ”
ক্যাথরিন একইভাবে বলে,
” আমার পরিবার খুন হয়েছে। নৃশংসভাবে। কারা করেছে জানো? তোমার দেশের অমানুষ সৈন্যরা। ”
আরোণ সময় নেয়। সে এখনো বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। ক্যাথরিন চোখ বুলিয়ে আশেপাশে সব নেকড়েদের দেখে নেয় একবার। আত্মসমর্পণ করে বলে,
” আমার সাথে যা ইচ্ছা হয় করতে পারো তোমরা। মারতে পারো, বন্দী করতে পারো। যা ইচ্ছা হয় তোমাদের। ”
আরোণ এগিয়ে এসে ক্যাথরিনের দু কাধে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে খুলে বলো ক্যাথ। ”
ক্যাথরিন ঝাড়ি মেরে আরোণের হাত সরিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠে,

” আমাকে ছুঁতে মানা করেছি। তোমার ছোঁয়া বিষের দানার মতো লাগছে আমার। ঘৃণা করি আমি তোমাদের সকলকে। ওই বর্বর সৈন্য আর তোমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তোমরা আমার মা, বাবাকে মেরেছো আর তারা আমার ভাইবোন ও গ্র্যানিকে মেরেছে। তোমরা সবাই খুনী। ”

ক্যাথরিন কথা বলতে বলতে ফোসফাস করছে। আশেপাশের সকল নেকড়েরা নিজেদের মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের কারো কাছেই বলার কোনো ভাষা নেই। আরোণ বুঝতে পারছে না ক্যাথরিনের ভাইবোন যদি মারা গিয়ে থাকে তবে সেই খবর সে কিভাবে জানলো? পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়েছিলো তার? কিন্তু এই ভাবনা বেশিক্ষণ তার মাথায় টিকে না। ক্যাথরিনের দৃষ্টি তার বুকে গিয়ে আঘাত করে। মেয়েটা কষ্টে আছে। কিন্তু এই কষ্টের কোনো ওষুধ আরোণের কাছে নেই। আরোণের বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। সে ক্যাথরিনের কাছে যাওয়ার সাহস করতেও পারছে না আর না পারছে ওকে এই অবস্থায় দেখতে। ক্যাথরিন নিজে দু কদম এগিয়ে আসে আরোণের দিকে। খুবই শীতল কণ্ঠে সে বলতে থাকে,

” আমার বোন অ্যানা। তুমি ওকে দেখেছো নিশ্চয়ই? প্রথম সাক্ষাতেই তো তাকে আর লিয়ামকে দেখেছো তুমি। আমার বোন খুব চঞ্চল স্বভাবের। ছোট থেকে এই পর্যন্ত আমার বোনকে আমি যথাসম্ভব আগলে রাখতাম। তার সামান্য জ্বর হলেও সারা রাত আমি তার পাশে বসে কেদে ভাসাতাম। আমার সেই বোনকে তোমার দেশের বর্বরা মেরে ফেলেছে আরোণ। আমার ভাই লিয়াম। খুব ছোট আর খুব আদরের আমার। সেই নিষ্পাপ ছোট শিশুকেও তারা ছাড় দেয় নি। মায়া দেখায় নি। মেরে ফেলেছে। আমার ভাই নিশ্চয়ই যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো। কিন্তু তারা মেরে ফেললো আমার ভাইটাকে। ”
এতটুকু শুনেই সকলে স্তব্ধ হয়ে আছে। কারো কাছেই বলার কোনো ভাষা নেই। সকলেই নির্বাক। ক্যাথরিন নিজেই আবার বলে,

” নিজের সম্পূর্ণ পরিবারকে হারিয়ে আমার এখন কি করা উচিত? তুমি বলো আরোণ? ”
আশেপাশে বাকি নেকড়েদের দিকে তাকিয়েও ক্যাথরিন একই প্রশ্ন করে।
” তোমরা বলো আমার এখন কি করা উচিত? তোমাদের সবার তো অভিজ্ঞতা আছে। তোমরা সকলেই তো নিঃস্ব, পরিবারহীন। তোমাদের কেমন লাগে নিঃস্ব হয়ে বেঁচে থাকতে? আমিও সেভাবেই থাকবো। কান্না করা উচিত আমার? ক্রোধে আক্রোশে ফেটে পড়া উচিত আমার? তোমাদের সকলকে খুন করে প্রতিশোধ নেওয়া উচিত আমার? আমার জায়গায় তোমরা হলে কি করতে? ”
কেউ কোনো রা শব্দ করে না। ক্যাথরিন চিল্লিয়ে উঠে এবার,
” বলছো না কেন তোমরা? কি করবো আমি? ”

ক্যাথরিনের চোখ হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু হয়। টলতে টলতে হাঁটু গেড়ে মাটির উপর বসে পড়ে সে। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কাদতে থাকে সে। দু’হাতে মাটি আঁকড়ে ধরেছে। চিৎকার করতে করতে সে বলতে থাকে,
” কি করবো আমি? আমার ভাইবোন নিষ্পাপ ছিলো। কেন মারলো তাদের? ”
কান্নারা বাধ ভেঙেছে। চারিদিকে এতজন থাকা সত্ত্বেও ক্যাথরিন কেবল শূন্যতা অনুভব করে সে। হাত দিয়ে মাটি খুড়ে নিজের কষ্ট কমানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। উল্টো মাটির মাঝে থাকা গাছের ছোট চিকন ডালের টুকরোর সাথে লেগে তার হাত কেটে জায়গায়। তবুও তার সেদিকে ধ্যান নেই। আরোণ এই পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে ক্যাথরিনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে দুহাত দিয়ে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না সে। ক্যাথরিন ছটফট করে চিৎকার করতে করতে হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়। আরোণ হালকা করে ডাকে,

” ক্যাথ? ”
ক্রিনা এগিয়ে এসে ক্যাথরিনের গালে হাত রেখে বলে,
” চেতনা হারিয়েছে আলফা। ”
আরোণ একবার ক্যাথরিনের মুখশ্রী পানে চায়। নিস্তেজ, নির্বাক ক্যাথরিনকে দেখে তার অপারধবোধ শতগুণে বেড়ে যায়। মনে মনে সে বলে,
” ভুল ছিলাম আমি। আমি সর্বশক্তিমান নই। ক্যাথরিনের কষ্ট দূর করার শক্তি আমার মাঝে নেই। যত দিন যাচ্ছে এই কষ্ট আরো প্রবল হচ্ছে। ”

অনাথ। একটি সামান্য শব্দ কাউকে কিভাবে এতটা কষ্ট দিতে পারে? জানে না রিকার্ডো। খুব ছোট থাকতেই সে জানতে পারে ক্যামিলো এবং ড্যানিয়েল তার আসল মা বাবা নয়। তার আসল মা বাবা মৃত। ক্যামিলো ও ড্যানিয়েল কেবল তাকে পেলে বড় করছে। এই সত্যিটা তাকে ম্যাথিউ জানায়। ছোট বেলা থেকেই তাদের মাঝে ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকতো। সেই ঝগড়া হতো সবসময় কারণ তাদের একই জিনিস পছন্দ হতো। সেই জিনিস নিয়ে ঝগড়া, মারামারি করাটা তাদের অভ্যাস ছিলো। এরকই একদিন ঝগড়ার মাঝে রাগের মাথায় ম্যাথিউ রিকার্ডোকে বলে বসে তার জীবনের সবথেকে বড় সত্যি। যাদের সে নিজের পরিবার ভাবতো তারা তার সত্যিকারের পরিবার না। ছোট ম্যাথিউকে যে ড্যানিয়েল এই সত্যি জানিয়েছিলো তা নিশ্চিত ছিলো রিকার্ডো।

কিন্তু এতকিছুর মাঝে আজও সে তার আসল মা বাবা কে ছিলো সেই সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি নি। ক্যামিলোকে যখন সে নিজের মা বাবার পরিচয় সম্পর্কে জিগ্যেস করে তখন ক্যামিলো বলেছিলো প্লেগ মহামারিতে সকলের যখন প্রাণ যাই যাই অবস্থা তখন প্রাণ নিয়ে পালানোর সময় জঙ্গলে একটি দম্পতির সঙ্গে দেখা হয় তাদের। সেই দম্পতি জানায় তারা অসুস্থ অনুভব করছেন তাই ক্যামিলো যেন তার সন্তানকে নিয়ে যায় নিজেদের সাথে। প্লেগ রোগের শঙ্কা করে ক্যামিলো সেই শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য নিজের কোলে তুলে নেয়। নিজের সাথে নিয়ে আসে।
এসব ভাবতে ভাবতে দূর্গের প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছায় রিকার্ডো। রাত এখন খুব গভীর। রিকার্ডোর চোখ যায় দক্ষিণ দিকে দূর্গের সবথেকে উঁচুতে অবস্থিত কক্ষের দিকে। কক্ষের জানালা দিয়ে আলোর আভা দেখতে পাচ্ছে সে। আনাস্তাসিয়া এতো রাত পর্যন্ত জেগে কি করছে তা ভাবে রিকার্ডো। এই মেয়ের তো সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্তিতে এখন ঘুমে তলিয়ে সপ্নে রিকার্ডোর বংশ উদ্ধার করার কথা।

রিকার্ডো দূর্গে প্রবেশ করে। নিশব্দে সোজা চলে যায় আনাস্তাসিয়ার কক্ষের সামনে। দরজার সামনে জোসেফকে দেখতে পায় সে। নিচে বসে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। রিকার্ডো সেদিকে ধ্যান না দিয়ে দরজার দিকে তাকায়। দরজা হালকা ফাঁকা হয়ে আছে। রিকার্ডো নিশব্দে সেই ফাঁকা দিয়ে কক্ষের ভেতর উঁকি দেয়। আনাস্তাসিয়া ঘুমোচ্ছে বিছানার উপর। চোখে মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট। শরীরে পরিহিত সাদা গাউনটা কিছুটা উপরে উঠে আছে। যার ফলস্বরূপ তার ধবধবে সাদা পা দৃশ্যমান। সাদা চাদরের উপর সোনালী চুলগুলো ছড়িয়ে আছে।

মহাপ্রয়াণ পর্ব ২৭+২৮

রিকার্ডো কক্ষে প্রবেশ উদ্দেশ্যে দরজা কিছুটা খুলতে নেয় হঠাৎ সে লক্ষ্য করে কক্ষের একপাশে জানালার পাশে বসার জায়গায় ম্যাথিউ পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। তার দৃষ্টি আনাস্তাসিয়ার দিকেই। এই দৃষ্টি চিনে রিকার্ডো। মোহিত দৃষ্টি। রিকার্ডো সাথে সাথে সেখান থেকে সড়ে যায়। বাতাসের গতিতে নিজের কক্ষে ফিরে আসে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভাবতে থাকে মাত্র দেখে আসা দৃশ্যটি নিয়ে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
” আর নয় ম্যাথিউ। এবার ছাড় দিবো না আমি। নিজের জিনিস নিজের করে নেওয়া ভালো করেই জানি আমি। ”

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৩১+৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here