মহাপ্রয়াণ পর্ব ৪৫+৪৬
নাফিসা তাবাসসুম খান
মাত্র বুখারেস্ট পৌঁছালো রিকার্ডো। মনে তার সংশয় কাজ করছে প্রবল। এমন নয় যে সে আগে কখনো বুখারেস্ট শহরে আসে নি৷ অগণিতবার এই শহরে আসা হয়েছে তার। তবে এবার তার বুখারেস্ট আসার উদ্দেশ্য ভিন্ন। এবার তার গন্তব্য কেবল বুখারেস্ট নয় বরং বুখারেস্ট প্রাসাদও। সেই প্রাসাদ যেই প্রাসাদে তার মা বাবা থাকতো। সেই প্রাসাদ যা তার নিজের ঘর হওয়ার কথা ছিলো। যে প্রাসাদে তার বেড়ে উঠার কথা ছিলো। এসব ভাবতেই রিকার্ডোর অন্যরকম অনুভূতি হয়। এক অজানা নামহীন অনুভূতি।
বুখারেস্টে পৌঁছে সর্বপ্রথম বাজারে চলে আসে রিকার্ডো। একটি ভোজনশালায় এসে কিছু খাবার দিতে বলে বসে পড়ে সে। বাজার এবং ভোজনশালা হলো এমন দুটি জায়গা যেখানে সকলেই রাজ্যের খুটিনাটি নিয়ে আলাপ আলোচনা করে। রিকার্ডো চারিপাশে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। আশেপাশে আরো অনেক পুরুষ বসে আছে। সকলেই আড্ডায় মশগুল। হঠাৎ রিকার্ডো খেয়াল করে তার পাশের গদিতে বসা দুজন পুরুষ আলাপ করছে,
” আমার তো মনে হয় আমাদের সাম্রাজ্যে আবার কারো অভিশাপ লেগেছে। ”
” আমারও তাই মনে হয়। নাহলে এমন নৃশংস খুন কিভাবে সম্ভব? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” ঠিক এক শতাব্দী আগে এমনই এক অভিশাপ এই সাম্রাজ্যে এসেছিলো। সেই দূর্যোগে কাউন্ট লিও এবং কাউন্টেস ম্যারি সেই অভিশপ্ত ট্রান্সিলভেনিয়াতে মারা গিয়েছিলেন। লোকমুখে শুনেছি কাউন্টেস ম্যারি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। উনার সেই সন্তান জীবিত থাকলে তো এই সাম্রাজ্য কখনোই হেনরিকসরা দখল করতে পারতো না। আজও এই সাম্রাজ্যে আলবার্টরা রাজ করতো। ”
” ঠিক। হেনরিকসরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজ্যে খুন এবং লুটপাট একদম চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ”
” আচ্ছা যা হওয়ার হয়েছে। অন্তত কাউন্ট লোনেলের ছেলে প্রিন্স ড্রাগোস তো জীবিত আছেন। নাহয় হেনরিকসদেরও বংশ বিলুপ্ত হয়ে আবার নতুন কোনো শাসক আসতো। ”
রিকার্ডো এতটুকু কথা শুনেই সেখান থেকে প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে সে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ পিছন থেকে একটি যুবকের কথা শুনতে পায়,
” আমি গ্রীক হতে যুদ্ধ বন্দী সকল মেয়ে কোন কোন দাস বাজারে বিক্রি হয়েছে জানতে চাই। ”
রিকার্ডো ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায় কৌতুহলবসত। দেখে একটি যুবক একজন ত্রিশার্ধো লোকের সাথে কথা বলছে। লোকটা জবাবে বলে,
” কি যে বলেন না সাহেব। এটা কি কোনো সামান্য কথা? গ্রীক থেকে যুদ্ধবন্দী হয়ে কয়েকশো মেয়ে এসেছে। তাদেরকে আলাদা আলাদা বিভিন্ন দাস বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। সেখান হতে প্রায় সব মেয়েই বিভিন্ন মনিবের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। আর বাকি মেয়েরা অভুক্ত থেকে দাস বাজারে পড়ে মরেছে। আপনাকে আমি কিভাবে সকল মেয়ের খোঁজ দিবো? ”
রিকার্ডো দেখে যুবকটা লুকিয়ে ক্লকের ভেতর হতে একটা ছোট থলি বের করে। সেটা দেখিয়ে ওই লোকটাকে বলে উঠে,
” তোমার যত অর্থ প্রয়োজন আমি দিবো। তবুও আমার কাজ করে দাও। ”
স্বর্ণ মুদ্রার থলি দেখে লোকটার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। হাত বাড়িয়ে দিতে নেয় সেটা নেওয়ার জন্য। তখনই রিকার্ডো সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই থলেটি নিজের হাতে নিয়ে বলে উঠে,
” আমি খোঁজ দিতে পারবো। ”
মুহূর্তেই লোকটার চেহারায় আধার নামে। যুবকটি রিকার্ডোকে প্রশ্ন করে,
” সত্যি খবর দিতে পারবে তুমি? ”
রিকার্ডো মাথা নেড়ে প্রশ্ন করে,
” আপনার নাম? ”
” ওরিয়ন বর্গেস। আপনার নাম? ”
রিকার্ডো জবাব না দিয়ে বলে,
” আমরা অন্য কোথাও যেয়ে কথা বলতে পারি? ”
” অবশ্যই। ”
এই বলে ওরা দুজন সেই ভোজনশালা থেকে প্রস্থান করে। পেছনে সেই লোকটার মুখ অন্ধকার হয়ে থাকে। সে ভেবেছিলো খোঁজার নাম করে ওরিয়নের থেকে কিছু মুদ্রা হাতিয়ে নিবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে সেই আগুন্তকঃ এসে তাদের কথার মাঝে বাগড়া দিয়ে তার সকল পরিকল্পনা ভেস্তে দিলো।
” আপনি বসুন, আমি আপনার জন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ”
সাথে সাথে রিকার্ডো নাকোচ করে বলে উঠে,
” শুধু শুধু ব্যস্ত হবেন না। আপনি বসুন। আমি আপনার সাথে কথা বলেই চলে যাবো। আমার আবার তাড়া আছে। ”
ওরিয়ন রিকার্ডোর সামনে বসতে বসতে বলে উঠে,
” আপনার নামটা বললেন না যে? ”
রিকার্ডো শান্ত স্বরে নিজের নাম জানিয়ে প্রশ্ন করে,
” আপনি কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন জানতে পারি? ”
” আমার বন্ধু। খুব ভালো একজন বন্ধু। সেই যুদ্ধের সময় ওর পরিবারকে মেরে ওকে তুলে আনা হয় রোমানিয়ায়। ”
রিকার্ডো এবার গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
” তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট তাই তুমি করেই বলছি। তুমি যেভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছো তাতে তোমার সকল স্বর্ণ মুদ্রা শেষ হয়ে যাবে তবুও তুমি তাকে খুঁজে পাবে না। কারণ যাদের ভরসায় খুঁজতে চাইছো তারা ওই মেয়েকে খুঁজে দিতে না পারলেও তোমার সব মুদ্রা ঠিকই হাতিয়ে নিবে। আর দাস বাজার হতে বিক্রি হওয়া কোনো মেয়ের ঠিকানা পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। ”
ওরিয়নের চেহারায় হতাশা এবং রাগ ফুটে উঠে। সে প্রশ্ন করে,
” তাহলে আমাকে মিথ্যা বললেন কেন যে আপনি খুঁজে দিতে পারবেন? ”
” ওই লোকের থেকে পিছু ছাড়ানোর জন্য। ”
ওরিয়ন রাগে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
” আপনি তাহলে আসতে পারেন। ”
রিকার্ডো কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছাকাছি যেতেই সে পিছনে একটা বাচ্চার কণ্ঠ শুনে থেমে যায়।
” ভাই অ্যানাকে আজকেও পাও নি? ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে পিছনে ফিরে তাকায়। একটি বাচ্চা ছেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে প্রশ্নটি করে। ওরিয়ন চোখে মুখে হতাশা নিয়ে জবাব দেয়,
” পাইনি কিন্তু খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবো৷ ”
রিকার্ডো সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
” তোমরা যাকে খুঁজছো তার সম্পূর্ণ নাম কি? ”
নিকোডিমাস উত্তর দিয়ে বলে উঠে,
” আনাস্তাসিয়া অ্যালভেজ। কিন্তু আপনি কে? ”
ওরিয়ন বিরক্তির সুরে রিকার্ডোকে বলে উঠে,
” আপনি এখনো যান নি? ”
রিকার্ডো আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সেখান থেকে চলে আসে মনে হাজারটা ভাবনা এবং প্রশ্ন নিয়ে।
জুন এবং জেনির সাথে উঠানে তলোয়ার প্রশিক্ষণ করছে আনাস্তাসিয়া। তিনজনের হাতেই কাঠের তলোয়ার। বাচ্চা দুটো এখনো ছোট তাই আনাস্তাসিয়া তাদের হাতে কাঠের তলোয়ারই তুলে দিয়েছে প্রশিক্ষণের জন্য। আনাস্তাসিয়া আজকে বেশ অন্যমনস্ক। কোনো গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে। জুন আর জেনি তা লক্ষ্য করে। নীরবে তারা হাতের তলোয়ার মাটির উপর রেখে দৌঁড়ে গিয়ে আনাস্তাসিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে। আনাস্তাসিয়া চমকে তাকায়। জুন আদুরে স্বরে প্রশ্ন করে,
” তোমার মন খারাপ অ্যানা? ”
আনাস্তাসিয়া সামান্য হেসে জুন এবং জেনির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তারপর উত্তর দেয়,
” তোমাদের এমন কেন মনে হলো? ”
জেনি পাশ থেকে বলে উঠে,
” কারণ তুমি আজকে অনেক চুপচাপ। ”
আনাস্তাসিয়া মলিন হেসে বলে,
” আসলে আমি কিছু একটা নিয়ে ভাবছিলাম। আজকের জন্য এতটুকুই থাক? বাকি প্রশিক্ষণ আমরা কালকে করবো? ”
জুন এবং জেনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
বাসার বারান্দায় বসে জোসেফ দেখে সম্পূর্ণ দৃশ্য। সে জানে আনাস্তাসিয়া কি নিয়ে ভাবছে। রিকার্ডো তাকে গতরাতে ডেকে নিজের এবং আনাস্তাসিয়ার সম্পর্ক সমন্ধে জানায়। জোসেফ প্রথমে খানিক অবাক হয়। কিন্তু পরে সে হিসেব কষে দেখে এরকম আভাস তো সে আগেই পেয়েছিলো। কিন্তু তখন সে তেমন একটা গায়ে মাখে নি। রিকার্ডো জোসেফকে সব জানিয়ে তাকে স্পষ্ট করে বলে দেয়,
” আমি যতদিন না ফিরছি তোমার দূর্গে আসার প্রয়োজন নেই। বাসায় থাকবে এবং নিজের পরিবারের খেয়াল রাখবে। আর আনাস্তাসিয়া আমার কাছে কতটা মূল্যবান তা আশা করছি আলাদা করে তোমাকে বলতে হবে না। ”
জোসেফ মাথা নেড়ে বলেছিলো,
” আনাস্তাসিয়া আমারও পরিবারের অংশ। কোনো অবহেলা হবে না নিশ্চিত থাকুন কাউন্ট। ”
ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে জোসেফ। তারপর আবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
” এই জংলী বিড়াল শেষমেশ আমাদের কাউন্টকে কাবু করেই ছাড়লো। কাউন্টকে কৃষ্ণ সাগরে ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করতে করতে এখন নিজেই কাউন্টকে সহ প্রেমের সাগরে ডুব দিয়েছে। ভালোই হয়েছে। এখন থেকে ও কাউন্টের মাথা খাবে আমি আরামে থাকবো। ”
এটুকু বলেই জোসেফ আরাম করে পিছনের দিকে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রয়। হঠাৎ কানের কাছে জোরে কারো চিল্লানোর শব্দে ধরফরিয়ে চোখ মেলে উঠে বসে সে। তার সামনে আনাস্তাসিয়া, জুন এবং জেনি দাঁড়িয়ে আছে। জোসেফ বিরক্তির সুরে তিনজনকে একবার দেখে নিয়ে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
” এতো জোরে চেঁচামেচি করছো কেন আমার কানের কাছে এসে? ঈশ্বর আমার কানের পর্দা মনে হয় ফেটে গেলো। ”
আনাস্তাসিয়া মুখে ভেংচি কেটে বলে,
” চিল্লিয়েছি বেশ করেছি। ”
জোসেফ বিরক্তির সুরে বলে উঠে,
” নিজে তো আস্ত এক জংলী আমার মেয়েদেরকেও নিজের মতো বানিয়ে ফেলছো। ”
ওদের চেঁচামেচিতে বাড়ির ভেতর থেকে জোয়ান্দ্রা বেরিয়ে আসে। সে এসে প্রশ্ন করে,
” এখানে কি চলছে? এতো চেঁচামেচি কেন করছো সবাই? ”
আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” আমরা তো কেবল জোসেফকে ডাকছিলাম জোয়ান্দ্রা। ”
জোসেফ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” আমাকে কেন? ”
আনাস্তাসিয়া, জুন এবং জেনি মুখটা হাসি হাসি করে বলে উঠে,
” আমরা ঘুরতে যেতে চাই। ”
জোসেফ ভ্রু কুচকে বলে উঠে,
” কোথাও যাওয়া চলবে না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকো। ”
আনাস্তাসিয়া জুন এবং জেনির দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই তারা জোসেফের দুহাত ধরে টানতে থাকে। আনাস্তাসিয়া হেসে বলে,
” আমরা তো যাবোই এবং তুমি আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। ”
ওদের কাণ্ড দেখে জোয়ান্দ্রা না হেসে পারে না৷ আনাস্তাসিয়া আরো বলে,
” একে তো তুমি সচরাচর বাসায় থাকো না। ফিরো অনেক রাত করে। এখন যেহেতু বাসায় আছো তাই তোমার উচিত পরিবারকে সম্পূর্ণ সময় দেওয়া। ”
জোসেফ মাথা নাড়িয়ে না না করতে থাকে। হঠাৎ জোয়ান্দ্রা পাশ থেকে বলে উঠে,
” চলো না আজ সবাই মিলে বের হই। ”
ব্যস এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো জোসেফকে রাজি করানোর জন্য। সে সাথে সাথে সবাইকে তৈরি হয়ে আসতে বলে। বাচ্চারা হৈ হুল্লোড় করে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে যায় তৈরি হতে। আনাস্তাসিয়াও হাসতে হাসতে তাদের পিছু চলে যায়। বিয়ের এতো বছরেও জোয়ান্দ্রা কখনোই জোসেফের কাছে মুখ ফুটে তেমন কিছুই চায়নি। আর না জোসেফ কখনো এতো আয়োজন করে জোয়ান্দ্রার জন্য কিছু করতে পেরেছে কখনো। উল্টো সে আরো বাসায় কখনো তেমন একটা সময় দিতে পারে না বললেই চলে। বাচ্চা দুটোকে জোয়ান্দ্রা একা হাতেই সামলায় সবসময়৷ তবুও কখনো কোনো অভিযোগ করে নি। তাই আজ জোয়ান্দ্রা নিজ থেকে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলায় জোসেফ আর মানা করে নি। সাথে সাথে উল্টো রাজি হয়ে যায়। এই বাহানায় আনাস্তাসিয়ার মনও নাহয় কিছুটা ভালো হয়ে যাবে।
গভীর নীরব রাত। ক্যাথরিন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। আরোণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার পাশে শুয়ে তাকে দেখছে। কক্ষে জ্বলজ্বল করা কিছুসংখ্যক মোমবাতির আলোয় ক্যাথরিনের আবছা মুখশ্রী বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। ঘুমের মাঝে আচমকা ক্যাথরিন আর্তনাদ করে জেগে উঠে বসে। আরোণ চমকে যায়। বিচলিত স্বরে প্রশ্ন করে,
” কি হলো ক্যাথ? ”
ক্যাথরিন জবাব দিতে পারে না। পেটে হাত দিয়ে সে আর্তনাদ করতে থাকে। আরোণের কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। আরোণ আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে তাড়াতাড়ি কক্ষের দরজা খুলে বেরিয়ে প্রহরীদের আদেশ দেয় নেকড়ে পালের সদস্য হান্নাহকে ডেকে আনতে। আদেশ দিয়েই সে ফিরে এসে ক্যাথরিনের পাশে বসে তাকে আঁকড়ে ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হান্নাহ কক্ষে এসে প্রবেশ করে। ক্যাথরিনের পাশে বসে সে আরোণকে বলে,
” কিছু মনে না করলে আলফা আপনি একটু বারান্দায় গিয়ে অপেক্ষা করবেন? ”
আরোণ নাকোচ করে না। কেবল যাওয়ার আগে বিচলিত কণ্ঠে বলে যায়,
” কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে আমায় ডাকবে। ”
বেশ অনেকক্ষণ ধরে ক্যাথরিনকে বারবার পরীক্ষা করে দেখছে হান্নাহ। আরোণের পর সে হলো দ্বিতীয় নেকড়ে মানবী। নেকড়ে মানবী হওয়ার পাশাপাশি সে একজন চিকিৎসকও। পরীক্ষা শেষে কিছুটা চিন্তিতভাবে তাকায় সে ক্যাথরিনের পানে। আর্তনাদ করতে করতে কিছুক্ষণ আগেই ক্যাথরিন আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ তার। হান্নাহ ক্যাথরিনকে আরেক নজর দেখে নিয়ে উঠে বারান্দায় চলে আসে সোজা। আরোণের সামনে এসে দাঁড়াতেই আরোণ চিন্তিত সুরে প্রশ্ন ছুড়ে বসে একের পর এক। ক্যাথরিনের কি হয়েছে, এখন কেমন আছে ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন করে ক্ষান্ত হয় সে। হান্নাহ জবাবে স্পষ্ট জানায়,
” ক্যাথরিন মা হতে চলেছে আলফা। ”
আরোণ থমকায়। বাকহারা হয়ে পড়ে। বারান্দার বিশাল খোলা দরজা দিয়ে কক্ষের ভিতরে তাকায় সে। ক্যাথরিন ঘুমোচ্ছে আবার। অদ্ভুত অনুভূতি হয় আরোণের। কাপা কাপা স্বরে প্রশ্ন করে,
” তুমি নিশ্চিত হান্নাহ? ”
” জ্বি আলফা৷ আপনার সন্তান আসতে চলেছে। ”
আরোণ বেশ খুশি হয়। অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে তার। অতি খুশিতে শরীর ঝিমঝিম করছে। হঠাৎই আরোণ চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায় হান্নাহর দিকে। প্রশ্ন করে,
” ক্যাথরিন? ওর কিছু হবে না তো? ”
হান্নাহ জবাব দেয়,
” বাচ্চাটা আর দশটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতো হবে না আলফা। সে একজন নেকড়ের সন্তান। আর ক্যাথরিন একজন মানুষ। একজন মানুষের পেটে নেকড়ে বেড়ে উঠার মানে হচ্ছে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় কয়েক গুন বেশি কষ্ট হবে ক্যাথরিনের। আর নেকড়ে হওয়ার ফলে বাচ্চা পেটে খুব দ্রুত বেড়ে উঠবে। তিনমাস পরই সে পৃথিবীতে এসে পড়বে। কিন্তু ক্যাথরিনের কিছু হতে দিবো না আমি নিশ্চিত থাকুন। একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে কেবল। আর আমি ওর জন্য যা যা প্রয়োজন সব করার ব্যবস্থা করছি। ”
আরোণ মাথা নেড়ে বলে,
” তুমি এখন আসতে পারো। আমি কাল তোমার সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো। ”
হান্নাহ সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে যেতে নেয়। আরোণ পিছু ডাকতেই আবার ফিরে তাকায়। আরোণ বলে,
” আপাতত কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই সকলকে জানিয়ে দিবো। ”
হান্নাহ মাথা নাড়িয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। হান্নাহ বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই আরোণ কক্ষে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে ক্যাথরিনের পাশে গিয়ে বসে সে। আপনাআপনি তার হাত চলে যায় ক্যাথরিনের পেটের উপর। মসৃণ কাপড় ভেদ করে সে যেন পেটের ভেতর বেড়ে উঠা এক ছোট্ট প্রাণকে অনুভব করতে পারে। আরোণ মাথা ঝুঁকিয়ে সেখানে বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চুমু খায়। ক্যাথরিন সামান্য নড়ে উঠে এতে। আরোণ ফিসফিসিয়ে ক্যাথরিনের পেটের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠে,
” বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি জান। ”
সাথে সাথেই সে উঠে ক্যাথরিনের পাশে শুয়ে তার কপালে পরম আবেশে অধর ছোঁয়ায়। একইভাবে আবার ক্যাথরিনের কানের কাছে গিয়ে ধীর স্বরে আওড়ায়,
” তোমাকেও অসম্ভব ভালোবাসি ক্যাথ৷ আমাকে এতো বড় খুশি দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে ”
এটুকু বলেই আরোণ ক্যাথরিনের চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। মনে মনে ভাবতে থাকে কাল ক্যাথরিন এতো বড় খুশির খবর পেয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া করবে। আজকের পূর্বে তারা কখনোই এই বিষয়ে কথা বলে নি। না কোনো পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু এখন আরোণের মনে অসংখ্য ভাবনা উঁকি দিচ্ছে ক্যাথ আর তার অনাগত সন্তানকে ঘিরে।
ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ক্যাথরিন। আনমনেই পেটের উপর হাত রেখে ধীর স্বরে আহ বলে উঠে। আরোণ সাথে সাথে উঠে বসে ক্যাথরিনকে প্রশ্ন করে,
” খারাপ লাগছে বেশি? ”
ক্যাথরিন অস্পষ্ট স্বরে বলে,
” রাতে পেট কেমন ব্যথা করে উঠছিলো। এখনো সামান্য করছে। হান্নাহ না এসেছিলো? ও কি বলেছে? ”
আরোণ বলে উঠে,
” পরে বলছি। তুমি আগে তৈরি হয়ে নাস্তা করে নাও। ”
ক্যাথরিন আর কিছু বলে না। তার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। মনে মনে কিছুটা অবাকও হয় সে। সাধারণ তার কখনো এতো সহজে খিদে পায় না। অথচ আজ মনে হচ্ছে খিদে একদম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ক্যাথরিন চুপচাপ বিছানা ছেড়ে নেমে তৈরি হতে চলে যায়। আর এদিকে আরোণ সুযোগ বুঝে চুপচাপ কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।
গতরাত থেকে সকাল হয়ে গিয়েছে। রিকার্ডো আড়ালে থেকে সারা রাত প্রাসাদের মূল ফটকের দিকে নজর রাখছে। তাকে কারো দেখার সুযোগ নেই এমনভাবেই অবস্থান নিয়েছে। নিজের প্রাসাদকে মন ভরে দেখছে রিকার্ডো।
সাদা এবং নীল রঙের বিশাল প্রাসাদ। সুউচ্চ বিশাল প্রাসাদের চারিদিক ঘিরে রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেনা এবং প্রহরীদের আনাগোনা ভেদ করে একটি পাখির ও ভেতরে যাওয়ার সুযোগ নেই। যাওয়ার চেষ্টা করলেই প্রহরীদের তীর নাহয় তলোয়ারের আঘাতে সাথে সাথে মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু রিকার্ডোর বেলায় সেই পন্থা কাজে লাগবে না৷ সামান্য তীর এবং তলোয়ারের ক্ষমতা নেই রিকার্ডোকে ছোঁয়ার। কিন্তু সকলের দৃষ্টিগোচরে প্রবেশ করতে হলে রিকার্ডোকে আজকে রাতের অপেক্ষা করতে হবে। রাতের মধ্য প্রহরে অন্ধকারের সুযোগ নিয়েই প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু কাল রাত থেকে এই পর্যন্ত রিকার্ডো একবারও প্রিন্স ড্রাগোসকে বের হতে দেখে নি। হয়তো সে প্রাসাদেই অবস্থান করছে। এসব ভাবতে ভাবতেই প্রাসাদের দিকে আবার দৃষ্টি ফেলে রিকার্ডো।
নাস্তা শেষেই ক্যাথরিনকে নিয়ে বের হয় আরোণ। ভ্যালেন্টাইনের পিঠে চড়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। ক্যাথরিন বার কয়েক প্রশ্ন করলেও আরোণ তাকে গন্তব্য সম্পর্কে জানাতে নারাজ। তাই ক্যাথরিন আর কিছু প্রশ্ন না করে চুপচাপ বসে রয় ঘোড়ার পিঠে আরোণের বাহুডোরে। গন্তব্যের কাছাকাছি যেতেই ক্যাথরিনের চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তার সবথেকে প্রিয় জায়গায় আরোণ তাকে নিয়ে এসেছে। আরোণের ভাষ্যমতে যার নাম বরফ খামে ক্যামেলিয়ার লাজ। নামটা বেশ অদ্ভুত লেগেছিলো প্রথমে ক্যাথরিনের কাছে। কিন্তু এখন তার মনে হয় এই নামটা এই জায়গার সাথে অদ্ভুত হলেও মানানসই।
আরোণ প্রথমে নিজে নেমে তারপর খুব স্বযত্নে ক্যাথরিনকে নামায়। ক্যাথরিন খুশি হয়ে আরোণকে প্রশ্ন করে,
” আজকে কি বিশেষ কিছু? ”
আরোণ মৃদু হেসে বলে,
” এমন কেন মনে হলো? ”
” কারণ আগে যে দুইবার এখানে এসেছি সেই দুইবারই এখানে বিশেষ কিছু ঘটেছে। প্রথমবার যখন তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসো সেদিন প্রথম মনের অজান্তে তোমার প্রতি অনুভূতি হানা দেয় আমার হৃদয়ে এবং দ্বিতীয়বার যখন নিয়ে এসেছিলে তখন আমাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছো তুমি। তাই আমার মনে হচ্ছে আজও বিশেষ কিছু হতে চলেছে। ”
আরোণ হেসে কোনো কথা না বলে সামনে এগিয়ে যায়। ক্যামেলিয়া গাছ থেকে একটি ডালা ভেঙে ক্যাথরিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্যাথরিন সেই ফুলের ডালাটি হাতে নিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে আরোণ তাকে কাছে টেনে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তারপর প্রশ্ন করে,
” এই ডালে কয়টি ফুল আছে ক্যাথ? ”
ক্যাথরিন হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হয়। তবুও হাতে থাকা লাল ক্যামেলিয়া ফুলের ডালটিকে একবার দেখে নিয়ে উত্তর দেয় তিনটি। আরোণ হাতের ছোঁয়া আরেকটু গভীর করে প্রশ্ন করে,
” এখানে এই মুহুর্তে কয়জন উপস্থিত আছি? ”
ক্যাথরিন ভ্রু কুচকায়। আরোণের এমন প্রশ্নের মানে খুঁজে পায় না সে। তবুও জবাব দেয়,
” দুজন। ”
আরোণ এবার ক্যাথরিনের পেটের উপর গভীর স্পর্শ করে উত্তর দেয়,
” ভুল উত্তর ক্যাথ। দুজন নয় তিনজন। আমাদের সাথে আরেকজন উপস্থিত আছে এখানে। ”
ক্যাথরিনের এক মুহূর্ত সময় লাগে আরোণের কথার মানে বুঝতে। বুঝতে পেরে সে সাথে সাথে জমে যায়। আপনাআপনি তার হাত চলে যায় আরোণের হাতের উপর যা এই মুহুর্তে তার পেটে বিচরণ করছে। অন্য একটা প্রাণের উপস্থিতি টের পায় নিজের শরীরের ভেতর। টের পেতেই অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
” আরোণ আমাদের সন্তান? ”
আরোণ হ্যাঁ জানাতেই ক্যাথরিনের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। অতি খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয় সে। এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে ঈশ্বর এতো বড় খুশি তার ভাগ্যে বর্ষণ করে দিয়েছে। ক্যাথরিন আরোণের দিকে ঘুরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কাপা কাপা স্বরে বলে উঠে,
” আমাদের পরিবার পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আমরা আর একা থাকবো না। ”
আরোণ হেসে ক্যাথরিনকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায়ই মুখ নামিয়ে তার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। তার নিজেরও অসম্ভব প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। সে কখনো ভাবে নি এতো বছর এই একাকিত্বের জীবন পার করার পর ঈশ্বর তার জীবনে ক্যাথরিন নামক খুশির খোরাক পাঠাবে যে কিনা তার জীবনের সকল অসম্পূর্ণতা পূরণ করে দিবে। আরোণ ফিসফিসিয়ে বলে,
” আমাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতির সাথে পরিচয় করানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ক্যাথ। ”
এটুকু বলেই আরোণ ক্যাথরিনের কোমর জড়িয়ে তাকে সামান্য উঁচুতে তুলে ঘুরতে শুরু করে। ক্যাথরিনের হাসির শব্দ এবং জলপ্রপাতের পানির ধারার শব্দে প্রকৃতি খুশির গান গেয়ে উঠে।
বারান্দায় বসে বিভিন্ন শীত মরসুমের ফুল দিয়ে মালা বানাচ্ছে আনাস্তাসিয়া। প্রথমে গোলাপি এবং বেগুনি রঙের ফুল দিয়ে মালা এবং মাথার তাজ বানিয়ে জুন এবং জেনিকে পড়িয়ে দেয় সে। বাচ্চারা খুশি হয়ে দৌঁড়ে বাসার ভেতরে চলে যায় মা বাবাকে দেখানোর জন্য। আনাস্তাসিয়া নিজের জন্য তৈরি করা জেসমিন ফুলের গয়না গলায়,মাথায় এবং হাতে পড়ে নেয়। ফুলের মালা পড়তেই তার রিকার্ডোর কথা মনে পড়ে যায়। আজকাল রিকার্ডোর সাথে এই বিচ্ছেদ তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। একবার আসুক আনাস্তাসিয়া সুদে আসলে সব শোধবোধ করবে। কিন্তু আপাতত নিজের বিরহ কমানোর জন্য সে চলে যায় গোরস্থানের পিছনের সেই জঙ্গলে। সেখানে গিয়েই আনাস্তাসিয়া সেদিন যেখানে বসে ছিলো সেই একই জায়গায় বসে পড়ে। থমথমে গলায় বলে উঠে,
” শত্রু নিধন করতে গিয়ে নিজের ভালোবাসাকে পিছনে ফেলে গিয়েছো সে কথা কি স্মরণে আছে মহামান্য কাউন্ট? দু’দিন তোমাকে ছাড়া দুই শতাব্দী সম অনুভব হচ্ছে। আর কত অপেক্ষা করাবে? ফিরে আসো এবার। ”
মলিন চেহারা নিয়ে বসে থাকে আনাস্তাসিয়া। হঠাৎ লক্ষ্য করে তার থেকে অনেকটা দূরে ম্যাথিউ দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ম্যাথিউকে হঠাৎ দেখে আনাস্তাসিয়া কিছুটা ভড়কে যায়। মনে পড়ে যায় গতবারের কথা। ম্যাথিউর সেই হিংস্র দৃষ্টি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। আনাস্তাসিয়া উঠে দাঁড়িয়ে জোরে প্রশ্ন করে,
” তুমি এখানে কি করছো? ”
ম্যাথিউ কোনো জবাব দেয় না। সে আনাস্তাসিয়ার গলার ক্রুশের হারটির দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আনাস্তাসিয়া ম্যাথিউর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের গলার ক্রুশের হারটির দিকে তাকায়। তারপর বলে উঠে,
” দেখো ম্যাথিউ তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই। আমি জানি তোমাদের খাদ্য হচ্ছে রক্ত। তাই তোমার খিদে পেলে তুমি কোনো বিশাল হাতির রক্ত পান করতে পারো। তোমার খিদাও মিটবে আমার জানও বাঁচবে। আর যদি তোমার আমার রক্ত খাওয়ার শখ জেগে থাকে তাহলে যেখানে আছো সেখানেই থাকো। আমি কিন্তু আত্মরক্ষা করতে জানি। একদম মেরে তক্তা বানিয়ে তোমাকে কৃষ্ণ সাগরে ভাসিয়ে দিবো বলে দিলাম। ”
ক্রুশের হার থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকায় ম্যাথিউ। মৃদু হেসে বলে উঠে,
” আমি অন্য কারণে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। ”
আনাস্তাসিয়া দু হাত কোমরে রেখে ভ্রু কুচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। ম্যাথিউ বলে,
” সেদিনের জন্য অনুতপ্ত আমি। ইচ্ছে করে আমি তোমার ক্ষতি করতে চাই নি। আমার কেবল নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। বেহুশের মতো তোমায় আঘাত করে বসি। এজন্য আমি লজ্জিত। তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। ”
আনাস্তাসিয়া সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
” তুমি নিশ্চিত তো আমার রক্ত পান করার জন্য আসো নি তো? ”
” হ্যাঁ আনাস্তাসিয়া। ”
আনাস্তাসিয়ার মনে পড়ে যায় রিকার্ডোর বলা সেদিন সকল ঘটনা। ড্যানিয়েল কিভাবে ম্যাথিউর মনে হিংসার বীজ রোপণ করে। সব মনে পড়তেই আনাস্তাসিয়া সামনে তাকায়। দেখে ম্যাথিউ চলে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। আনাস্তাসিয়া পিছু ডাকতেই ম্যাথিউ ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” কিছু বলবে? ”
আনাস্তাসিয়া কথা না বলে নিজের গলার ক্রুশের হারটি খুলে নিচে রাখে। ম্যাথিউর ভ্রু জোড়ার মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে। হারটি রেখে আনাস্তাসিয়া ম্যাথিউর দিকে এগিয়ে যায়। ম্যাথিউ প্রশ্ন করে,
” ক্রুশের হারটি খুলে ফেললে কেন? ”
” কারণ আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার ক্ষতি করবে না। ”
অবাক হয় ম্যাথিউ। প্রশ্ন করে,
” এমন কেন মনে হলো তোমার? ”
” কারণ তুমি নিষ্ঠুর নও। ”
ম্যাথিউ বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। আনাস্তাসিয়া নিজ থেকেই বলে উঠে,
” সকলেই এই পৃথিবীতে নিষ্পাপ হয়ে জন্মায় ম্যাথিউ। পরিস্থিতি মানুষকে কঠিন বানিয়ে তুলে। কিন্তু কঠিন আর খারাপ হওয়ার মাঝে পার্থক্য আছে। তুমি কঠিন হতে পারো তবে খারাপ নও। আর কঠিন মানুষরা পানির মতো হয়। কখনো এরা কঠিন অবস্থায় বরফের রূপে সেজে থাকে। কখনো এরা তরল অবস্থায় পানির মতো হয়ে যায়। আর কখনো এরা একদম বাষ্পীয় রূপে ধোঁয়াশা হয়ে রয়। ”
ম্যাথিউ থমথমে গলায় প্রশ্ন করে,
” তুমি আমাকে এসব কেন বলছো? ”
” কারণ আমার মনে হচ্ছে তুমি এখন তরল অবস্থায় আছো। ”
” মানুষ পড়তে পারো তুমি? ”
” উহু। তবে মানুষের মনে কি থাকে তা চোখে স্পষ্ট প্রকাশ পায়। সেটা দেখতে পারি। ”
ম্যাথিউ শান্ত এবং ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,
” আমার চোখে কি দেখতে পাচ্ছো? ”
আনাস্তাসিয়া ঝটপট নিঃসংকোচ উত্তর দেয়,
” নম্রতা। আকুলতা। আড়ষ্টতা। ”
ম্যাথিউ আনাস্তাসিয়ার চোখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। ধরা পড়ার ভয়ে নিজের নীরব অনুভূতি মনের গহীনে লুকিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করতে করতে বলে উঠে,
” এক্ষুনি গিয়ে নিজের ক্রুশের হারটি পড়ে নাও আর বাসায় ফিরে যাও। একা জঙ্গলে ঘুরাফেরা বন্ধ করো। ক্রুশের হার কেবল তোমায় ভ্যাম্পায়ারদের থেকে রক্ষা করতে পারবে, জন্তু জানোয়ারদের থেকে নয়। ”
এটুকু বলেই চোখের পলকেই দৃষ্টি সীমানা রেখার বাহিরে চলে যায় সে। আনাস্তাসিয়া ম্যাথিউর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। নিচ থেকে ক্রুশের হারটি তুলে গলায় পড়ে নেয়। হয়তো আরেকটু খেয়াল করলেই দেখতে পেত দূর হতে একজোড়া দৃষ্টি আড়াল হতে তার নিরাপদে ফেরার পাহাড়া দিচ্ছে।
বাসকোভ প্রাসাদে ফেরার পর থেকেও এক মুহূর্তের জন্য একা ছাড়া হচ্ছে না ক্যাথরিনকে। আরোণ প্রাসাদে ফিরেই সকলের সামনে ঘোষণা করে ক্যাথরিন এবং তার অনাগত সন্তান সম্পর্কে। সকল নেকড়ে পাল বেশ খুশি৷ প্রথমবারের মতো এই প্রাসাদে কোনো শিশুর কান্নার ধ্বনি বাজবে ভাবতেই সকলে বেশ খুশি হয়ে পড়ে। আরোণ সেই যে হান্নাহর সাথে কথা বলতে গেলো এখনো ফিরে নি। ক্যাথরিনের সাথে কক্ষে ক্রিনা এবং ক্রিয়াস আছে। ক্রিয়াসের চোখে উপচে পড়া খুশি। সে নিজেও কাউকে নিয়ে এমনই স্বপ্ন সাজিয়েছিলো যা কখনো পুরো হয় নি। কিন্তু সে খুব করে চেয়েছিলো আরোণ যেন তার ভালোবাসার মানুষটাকে পায়। চোখের সামনে প্রথম কোনো নেকড়ে মানবের সফল প্রণয়গাথা দেখে মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নেয় আরোণের সন্তানকে সে নিজে তার মা বাবার গল্প শুনাবে। এক মানবী এবং নেকড়ে মানবের গল্প। ঘৃণা থেকে ভালোবাসার যাত্রা। প্রণয় থেকে পরিণতির গল্প।
ক্রিনা ক্যাথরিনের সামনে বসে আপনমনে বলতে থাকে,
” আমি কখনো কোন বাচ্চা কোলে নেই নি জানো? ইশ ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিবো ভাবতেই আমার খুব খুশি লাগছে। এই তিনমাস বেশ দীর্ঘ হবে। ”
ক্রিয়াস হেসে বলে উঠে,
” এই সম্পূর্ণ অবদান আমার। বিয়েটা কিন্তু আমিই করিয়েছি। ”
ক্রিয়াসের কথা শুনে ক্যাথরিন হেসে দেয়। তখনই আরোণ কক্ষে প্রবেশ করে। আরোণ প্রবেশ করতেই ক্রিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
” ক্রিয়াস আমাদের তো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো। চলো এখন যেতে হবে। ”
ক্রিয়াস মনে করার ভঙ্গিতে বলে উঠে,
” তাই নাকি? আমার তো মনে পড়ছে না। ”
আরোণ হালকা ভারী স্বরে প্রশ্ন করে,
” আমি মনে করাবো? ”
সাথে সাথে ক্রিয়াস কক্ষ ছেড়ে হাওয়ার গতিতে বেরিয়ে যায়। ক্রিনাও হেসে পিছন পিছন বেরিয়ে পড়ে। আরোণ এসে ক্যাথরিনের পাশে বসতেই ক্যাথরিন বলে উঠে,
” আমি ভাবছিলাম অ্যানাকে এখানে নিয়ে এসে যদি জানাতে পারতাম। ও খুব খুশি হবে শুনলে। ”
আরোণ হেসে ক্যাথরিনের গালে হাত রেখে বলে,
” আমি ইতিমধ্যে ফিটনসহ দুজনকে পাঠিয়ে দিয়েছি অ্যানাকে নিয়ে আসার জন্য। ও আসলে তুমি নিজে ওকে এই খুশির সংবাদ জানিয়ো। ”
ক্যাথরিন খুশিতে আত্মহারা হয়ে আরোণকে জড়িয়ে ধরে। আরোণও জড়িয়ে ধরতে নিবে সাথে সাথে ক্যাথরিন আহ বলে উঠে। আরোণ চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে ক্যাথ? ”
ক্যাথরিন আরোণের হাত নিজের পেটের উপর নিয়ে রাখতেই ভেতর থেকে আবার আরেকটা লাথি অনুভব করে। ক্যাথরিন ভীত স্বরে প্রশ্ন করে,
” এটা কিভাবে সম্ভব? এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা কিভাবে লাথি মারবে? ”
আরোণ হেসে জবাব দেয়,
” এটা আমার সন্তান ক্যাথ। ওর মধ্যে নেকড়ের রক্ত এবং শক্তি বিদ্যমান। তাই ওর বৃদ্ধিও খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছে। ”
ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,
” আসলেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই তো? ”
” আমার উপর বিশ্বাস রাখো। কিছু হবে না। আর তাছাড়া আমার মনে হয় আমার ছোট জান অ্যানার নাম শুনে খুশি হয়ে গিয়েছে। হয়তো ওর অ্যানাকে পছন্দ। ”
আরোণ এতটুকু বলতেই আবার পেটে একটা লাথি অনুভব করে তারা। এবার দুজনেই একসাথে হেসে দেয়।
রাত গভীর হয়েছে। সুযোগ বুঝে প্রহরী এবং সৈন্যদের চোখ ফাকি দিয়ে রিকার্ডো প্রাসাদে প্রবেশ করে। প্রাসাদে পা রাখতেই ওর শরীর শীতল হয়ে আসে। অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে। কিছুটা আবেগের বসে এসে সে প্রাসাদের দেয়াল ছুঁয়ে দেখতে থাকে। চোখ বুজে মনে মনে বলে উঠে,
” আমার কখনো তোমাকে বা বাবাকে দেখার সুযোগ হয়নি মা। কিন্তু এই প্রাসাদে আসার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এখানের প্রতিটা কোণে আমি তোমাদের অনুভব করতে পারছি। এই প্রাসাদে নিশ্চয়ই তোমাদের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে? আফসোস আমি তা কখনোই জানতে পারবো না। ”
এটুকু বলেই চোখ খুলে রিকার্ডো। দূর হতে কিছু দাসীকে আসতে দেখে সাথে সাথে সে লুকিয়ে পড়ে। দাসীগুলো চলে যেতেই সে আড়াল হতে বেরিয়ে চারিদিক দেখতে থাকে। রাতের বেলা হলেও সম্পূর্ণ প্রাসাদ মোমবাতি এবং আগুনের মশালের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। রিকার্ডো খুবই সাবধানে প্রধান হলঘর পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এসে পৌঁছায়। এত কক্ষের মাঝে কোথায় সে ড্রাগোসকে খুঁজবে এবং কোথায় ড্যানিয়েল আর জ্যাকসনকে পাবে ভেবে চিন্তিত হয় সে। আরো অবাক করার বিষয় হলো একটি কক্ষের সামনেও কোনো প্রহরী নেই। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। অথচ বাহিরে কি কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো। সামান্য খটকা লাগে রিকার্ডোর। তবুও সে এক এক করে সবগুলো কক্ষ খুঁজতে থাকে।
একটি কক্ষের সামনে এসে রিকার্ডো থেমে যায়। তার মনে হয় এই কক্ষে কেউ আছে৷ রিকার্ডো সাবধানে সন্তর্পণে কক্ষের দরজা খুলে প্রবেশ করে। দরজা খুলতেই রিকার্ডো দেখে এই কক্ষ বাকি সব কক্ষের তুলনায় অধিক বড়, সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। রিকার্ডোর চোখ যায় কক্ষের সাথে লাগোয়া বিশাল বারান্দার দিকে। বারান্দায় থাকা ডিভানে একজন বসে আছে। তার অবয়ব দেখে রিকার্ডো বুঝার চেষ্টা করে কে। কিন্তু রিকার্ডোকে অবাক করে দিয়ে সেই অবয়বটা বলে উঠে,
” স্বাগতম প্রিন্স রিকার্ডো। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ”
কণ্ঠ অপরিচিত লাগছে রিকার্ডোর কাছে। আরও অবাক হয় সে তাকে প্রিন্স হিসেবে সম্বোধন করায়। রিকার্ডো প্রশ্ন করে,
” কে তুমি? ”
অবয়বটি বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে রিকার্ডোর দিকে ঘুরে কক্ষের ভেতর এগিয়ে আসে সে। কক্ষের ভেতর পা রাখতেই কক্ষের মোমবাতির আলোয় তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠে। ভরাট কণ্ঠে জবাব দেয়,
” প্রিন্স ড্রাগোস। তোর জীবনের কাল। ”
সম্পূর্ণ বিষয় বুঝতে রিকার্ডোর এক মুহুর্ত সময় লাগে। জ্যাকসন এবং ড্যানিয়েলের সাথে ড্রাগোসও যুক্ত বুঝতে পেরে ওর চেহারা হিংস্র রূপ ধারণ করে। চোয়ালের সূক্ষ্ম ধারালো দাঁত দুটি বেরিয়ে আসে। ড্রাগোস বলে উঠে,
” এই কক্ষেই এক সময় তোর মা বাপ থাকতো। আজ এই কক্ষেই তোর সমাধি গড়ে তুলবো আমি। ”
মহাপ্রয়াণ পর্ব ৪৩+৪৪
এটুকু বলেই ড্রাগোস লুকিয়ে রাখা একটা ক্রুশ বের করে রিকার্ডোর দিকে তাক করে ধরে। ওটি ধরে রেখেই সে কক্ষের দু দিকের দেয়ালের পর্দা টান দেয়। সাথে সাথে পর্দা সড়ে গিয়ে দেয়াল বেরিয়ে আসে। দু দেয়ালে অসংখ্য ছোট বড় আকারের ক্রুশ ঝুলানো। রিকার্ডো জোরে আর্তনাদ করে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে। হিংস্র স্বরে হুংকার দিয়ে উঠে সে। সকল ক্রুশ দৃশ্যমান হয়ে উঠতেই ড্রাগোস নিজের পিঠের পিছন হতে একহাতে একটি ধারালো তলোয়ার বের করে। আজ এই সাম্রাজ্যকে সে কেবল নিজের করে নিবে। এই সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে মেরে সিংহাসনে নিজে আরোহন করবে ভেবেই তার ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটে উঠে।
