মহাপ্রয়াণ পর্ব ৯+১০

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৯+১০
নাফিসা তাবাসসুম খান

কনকনে ঠাণ্ডায় থেকে থেকে মৃদু কেপে উঠছে ক্যাথরিন। শেষ রাতে হওয়া তুষারপাতের ফলে পরিবেশ খুব শীতল হয়ে আছে। তুষারপাত কম তুষার ঝড় বলা বেশি যুক্তিগত। সেই ঝড় বয়ে গিয়েছে আরোণের হৃদয়েও। গত দু রাত ধরে এক দণ্ডের জন্যও ক্যাথরিনের পাশ থেকে নড়ে নি সে৷ কক্ষে কারো প্রবেশও নিষেধ করে দিয়েছে। মার্থা মাঝে কয়েকবার এসে ক্যাথরিনের জন্য খাবার ও আরোণের জন্য কাঁচের পাত্রে করে তাজা পানীয় রক্ত দিয়ে গিয়েছে।

বারান্দার দরজা হয়ে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস বন্ধ করার জন্য ক্যাথরিনের পাশ ছেড়ে উঠে এসে দরজা লাগিয়ে দেয় আরোণ। এসে আবার ক্যাথরিনের পাশে বসে তার নিষ্প্রভ মুখের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রয়। সারা মুখে চার পাঁচটা বড় বড় আঁচড়ের দাগ আরোণের চোখে আটকে থাকে। দু-দিন আগেও যাকে অসহায় অবস্থায় দেখার পৈশাচিক ইচ্ছে মনে পুষে রেখেছিলো আজ তার এই অবস্থা ই আরোণকে সমুদ্রের অতলে নিয়ে ফেলেছে। হাত বাড়িয়ে ক্যাথরিনের একটি হাত নিজের হাতে গুজে নেয় সে। খুব সন্তপর্ণে হাতের উল্টো পিঠে ওষ্ঠ দ্বারা স্পর্শ করে আবার ক্যাথরিনের পানে তাকায় । গত দু দিনে এই কাজ এপর্যন্ত অসংখ্যবার করেছে আরোণ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার দুষ্প্রবেশ্য অরণ্যের সমতুল্য হৃদয়ে সকল বদ্ধ প্রবেশদ্বার ভেঙে ক্যাথরিন প্রথম দর্শনেই নিজের জায়গা করে নিয়েছিলো। এই উপলব্ধি আরোণ করেছে সেই রাতে ক্যাথরিনকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে যখন তার বুক হুহু করে কেঁদে উঠে। সে অনুভব করে তার হৃদয় প্রথমবারের মতো অন্য কাউকে হারানোর ভয়ে স্পন্দন করছে। বুঝে যায় ক্যাথরিনকে ছাড়া তার গতি নেই। বুকের ভেতর থেকে অনুভূতি দলা পাকিয়ে চোখ দিয়ে অশ্রুরূপে গড়িয়ে পড়ে। ভুলে যায় নিজের স্বত্তা সম্পর্কে।

কিন্তু এই মুহুর্তে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই অনুভূতি ক্যাথরিনের জন্য হয়ে দাঁড়াবে বিষ সমতুল্য। বিষ যেমন মানুষের সম্পূর্ণ শরীরে ছড়িয়ে ভিতর থেকে জীবনকে কুড়ে খায় ঠিক তেমনই এই অনুভূতির ফলে ক্যাথরিনেকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নিলেও প্রতি মুহূর্তে ক্যাথরিনের জন্য ওঁৎ পেতে থাকবে মৃত্যু। আরোণ আর যাই হোক ক্যাথরিনের জীবন নিয়ে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। যতদিন না ক্যাথরিনকে সম্পূর্ণ নিরাপদ নিশ্চিত করতে পারছে ততদিন ক্যাথরিনকে এখানেই বাসকোভ প্রাসাদে নিজের চোখের সামনেই রাখবে সে। একবার শত্রু চিহ্নিত করে তাকে নিঃশেষ করতেই সে ক্যাথরিনকে মুক্ত করে দিবে। ফিরে যেতে দিবে তার পরিবারের কাছে। ক্যাথরিনের মা বাবাকে আরোণ ফিরিয়ে দিতে না পারলেও ক্যাথরিনের ভাই বোন আছে। তাদের সাথে ক্যাথরিন নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। হয়তো একটা সময় বিয়ে করে নিজ সংসারেও মন দিবে।

উহ! না। আর ভাবতে পারছে না আরোণ। আপাতত যতদিন তার ক্যাথ তার কাছে আছে ততদিন নিজের প্রতিটা মুহূর্ত সে ক্যাথরিনের সাথেই পার করতে চায় সে।
ক্যাথরিনের শরীর আবার কেপে উঠছে। আরোণ এবার চুপচাপ উঠে কোমড় সমান টেনে রাখা চাদর আরেকটু টেনে ক্যাথরিনের গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয়। মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে দিয়ে কক্ষের দরজা খুলে নিশব্দে বেড়িয়ে আসে। ক্রিয়াসকে ডেকে পাঠাতে আদেশ দেয় কামরার সামনে দাঁড়ানো প্রহরীকে।

” আমি বাহিরে খেলতে যাচ্ছি গ্র্যানি। ”
” কোথাও যাওয়া চলবে না তোমার। ”
সঙ্গে সঙ্গেই প্রতুত্তর করে অফিলিয়া। লিয়াম কিছুটা মন খারাপ করে মুখ ফুলিয়ে নিজের কক্ষে ফেরত যায়। অফিলিয়া আবার রান্নায় মন দেয়। আনাস্তাসিয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করে। অফিলিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছুড়ি নিয়ে চটপট গাছের সতেজ কিছু চেরি কেটে নেয়। দেলিলাহ সকাল বেলায় ওরিয়নকে দিয়ে কিছু চেরি ও হানিবেরি পাঠায় লিয়ামের জন্য। দেলিলাহ সহ বর্গেস পরিবারের সবাই ই খুব ভালো মনের অধিকারী। সম্ভ্রান্ত পরিবারের হয়েও তাদের মধ্যে নূন্যতম অহংকারবোধ নেই। আর এই গ্রামের সকলেই একে অপরের জন্য বিনা স্বার্থে সকল পরিস্থিতিতে পাশে থাকে।

এইযে লিয়ামকে পাওয়া যাচ্ছিলো না সবাই মিলে কতই না সাহায্য করলো অফিলিয়া ও আনাস্তাসিয়াকে। যদিও লিয়ামকে খুঁজে পাওয়ার পিছনে একটি বিশেষ ধন্যবাদ ম্যাথিউ নামক সেই আগুন্তকঃ প্রাপ্য তবুও সেই সুযোগ হয়ে উঠে নি আনাস্তাসিয়ার। সেদিন রাতে আলাদা আলাদা তারা তিনজন জঙ্গলের বিভিন্ন স্থানে খুঁজে লিয়ামকে। কিন্তু শেষমেশ ম্যাথিউই লিয়ামকে খুঁজে এনে দেয়। লিয়ামকে পেয়ে আনাস্তাসিয়া যখন আবেগপ্রবণ হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে সেই ফাঁকেই ম্যাথিউ একদম উধাও হয়ে যায়। হয়তো কোনো তাড়া ছিলো তার। তাই আনাস্তাসিয়া বিষয়টাকে আর না ঘাটিয়ে ওরিয়নের সাথে লিয়ামকে নিয়ে ফিরে আসে।
অফিলিয়া খেয়াল করছিলো যে আনাস্তাসিয়া কোনো গভীর ভাবনায় মগ্ন। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে আনাস্তাসিয়ার গলায় সেই ক্রুশের হারটি নেই। অফিলিয়ার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। সে সাথে সাথে আনাস্তাসিয়াকে প্রশ্ন করে,

” অ্যানা! তোমার গলার ক্রুশটি কোথায়? ”
আনাস্তাসিয়ার চিন্তায় ফোড়ন কাটে। সে অফিলিয়ার দিকে তাকায়। তার প্রশ্নটা বুঝতে পেরে নিজের গলার দিকে তাকায়। কিছু একটা মনে পড়ে এমনভাবে সে বলে,
” ওহ! আমি গোছল শেষে সেটা আর পড়ার কথা খেয়াল ছিলো না। ”
” আমি তোমার ও লিয়ামের জন্য চার্চে গিয়ে ফাদারের কাছ থেকে এই ক্রুশের হার দুটি নিয়ে এসেছি। ফাদার বলেছেন এই ক্রুশের হার তোমাদের কাছে থাকলে ঈশ্বরের কৃপায় তোমরা সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু লিয়াম ভুলবসত সেদিন এটা বাসায় ফেলে যায় এবং সেদিনই বাচ্চাটা এতো বড় বিপদে পড়ে। আমি শুধু এতটুকুই চাই আমার সন্তানের শেষ আমানত দুজন সুরক্ষিত থাকুক। আমার ক্যাথরিনকে আমি হারিয়েছি। তোমাদের হারাতে চাই না আমি। ”

বলতে বলতে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অফিলিয়ার। আনাস্তাসিয়ার মুখটাও মলিন হয়ে যায়। সে অফিলিয়ার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” আমি এখনই গিয়ে পড়ে নিচ্ছি গ্র্যানি। তুমি আর মন খারাপ করো না। ”
হঠাৎ বাহিরে মানুষের চেচামেচির আওয়াজে অফিলিয়া ও আনাস্তাসিয়া দুজনেই হকচকিয়ে উঠে। লিয়ামও নিজের কক্ষ থেকে নিচে নেমে এসে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” গ্র্যানি তুমি ও লিয়াম ঘরেই থাকো আমি দেখে আসছি কি হয়েছে। ”
বলেই আর কথা না বাড়িয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয় সে। বেড়িয়ে দেখতে পায় সবাই প্যাথরোজদের বাসার সামনে জোড়োসড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷। ভীড় ঠেলে আনাস্তাসিয়া ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় তার সমবয়সী একটা মেয়ের দেহ বাড়ির সামনে উঠোনে পড়ে আছে। মেয়েটিকে সে চিনে। ইভি প্যাথরোজ মেয়েটির নাম। তার সাথে মাঝে মাঝেই কথা হতো। কিন্তু মেয়েটার চেহারা এতো ফ্যাকাসে কেন আর উঠোনেই বা তার দেহ কি করছে? এমন সময়ই পাশের থেকে একজন বলে উঠে,

” গতকালই তো মেয়াটা হাসিখুশি বাজারে গিয়ে তার ভাইয়ের বিয়ের জন্য কেনাকাটা করে আনলো। কে জানতো আজ সকালই তার মৃতদেহ দেখতে হবে? ”
বিস্মিত হয়ে যায় আনাস্তাসিয়া। আবার সামনে তাকায় সে। ইভির পাশেই তার মা দেবোরাহ প্যাথরোজ বসে কান্না করছে। তার স্বামী হ্যানরি প্যাথরোজ দূরে বসে নিরবে চোখের জল ফেলছে। ভীড় হতে আরেকটি কণ্ঠ শুনা গেলো,
” মেয়েটার ঘাড়ে ওই দাগ দেখে তো মনে হচ্ছে সাপ কামড়েছে। নাহয় আর কিভাবে মারা যাবে? ”

আনাস্তাসিয়া আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পায় ওরিয়ন ভীড় হতে খানিকটা দূরেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সেও চুপচাপ সেখান থেকে ভীড় ঠেলে বেড়িয়ে ওরিয়নের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ওরিয়ন আনাস্তাসিয়াকে খেয়াল করে বলে,
” সবাই ভাবছে ইভির মৃত্যুটা হয়তো কোনো বিষধর সাপের কামড়ে হয়েছে। কিন্তু সেটা সত্যি না। ”
আনাস্তাসিয়া প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় ওরিয়নের দিকে। ওরিয়ন সেই দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলতো থাকে,
” ইভির চেহারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ। একদম ফ্যাকাসে হয়ে আছে। যদি তাকে সাপে কামড়াতো তাহলে তার শরীর বিষের প্রভাবে নীল হয়ে থাকতো। আর আমি পরীক্ষা করে দেখেছি তার শরীরে রক্তশূন্যতা। যেন মৃত্যুর পূর্বে কেউ তার দেহের সম্পূর্ণ রক্ত শুষে নিয়েছে। ”

” তুমি চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছো? ”
” এখনও পড়ছি। ”
” এসব তথ্য তুমি সবাইকে জানাচ্ছো না কেন? ”
” কারণ আমি যা নিয়ে সন্দেহ করছি তা নিয়ে আগে নিশ্চিত হতে চাই। ”
” কি সন্দেহ? ”
” তুমি আমার সাথে আমাদের বাসায় চলো আপত্তি না থাকলে। সেখানেই আমি বিস্তারিত তোমাকে সব জানাবো এবং কিছু একটা দেখাবো। ”

আনাস্তাসিয়া কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে যায় ওরিয়নের সাথে তার বাসায় যেতে। অফিলিয়াদের বাসার তুলনায় অনেক বড় ওরিয়নের বাসা। ইটের তৈরি দোতালা দালান। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ উভয় দিক দিয়েই বেশ বড়। বাড়ির ভেতরের মেঝে সিড়ি সবই উন্নতমানের কাঠের তৈরী। নিচতলায় রান্নাঘর, খাবারঘর, বসারঘর সহ আরো তিনটি কক্ষ আছে। যেগুলোর একটিতে ওরিয়নের দাদি রেবেকা বর্গেস ও তার দাদা বেঞ্জামিন বর্গেস থাকে। বাকি দুটি কামরা অতিথি কক্ষ হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। ওরিয়নের বাসায় পৌঁছে আনাস্তাসিয়া দেখে নিকোডিমাস বসার ঘরে রেবেকার সাথে বসে আছেন। ওরিয়ন এগিয়ে এসে রেবেকার সাথে আনাস্তাসিয়ার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,

” আনাস্তাসিয়াকে আমি উপরে ঘরটা ঘুরিয়ে আনি গ্র্যানি? ”
” হ্যাঁ অবশ্যই যাও। ”
অনুমতি পেয়ে আনাস্তাসিয়া ওরিয়নের সাথে সিড়ি বেয়ে উপরে আসে। উপর তালায় আরো তিনটি কক্ষ আছে। ওরিয়ন বলে,
” বামপাশের দুটি কক্ষ নিকোর ও মা বাবার। আর ডান পাশের কক্ষটি আমার। ”

ওরিয়ন এবং আনাস্তাসিয়া কক্ষে প্রবেশ করে। বেশ গোছানো একটি কক্ষ। ওরিয়নের ব্যক্তিত্ব যেন ফুটে উঠেছে তার কক্ষের প্রতিটি দেয়াল জুড়ে। কক্ষের যে অংশটি আনাস্তাসিয়ার নজর কাড়ে তা হলো একপাশের দেয়াল জুড়ে থাকা বড় কাঠের তৈরী বইয়ের তাকে। যদিও আনাস্তাসিয়ার কখনোই বইয়ের প্রতি তেমন একটা ঝোক ছিলো না কিন্তু ক্যাথরিন খুব বই পড়ুয়া ছিলো। যাকে বলা হয় বইপোকা। ওরিয়ন বইয়ের তাকের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ খুঁজে একটি বই বের করে সেই তাক থেকে। বইটা দেখতে বেশ পুরনো মনে হচ্ছে। ওরিয়ন আনাস্তাসিয়াকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে বলে কাছে আসতে। আনাস্তাসিয়া ওরিয়নের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ওরিয়ন বই খুলে কয়েক পাতা উল্টোতেই একটি পৃষ্ঠায় গিয়ে থামে সে। সেই পৃষ্ঠায় কিছু একটা আঁকা।

গোল বৃত্তকে কেন্দ্র করে তারাকৃতির একটি চিত্র। তার আশেপাশে রোমানীয় ভাষায় কিছু সংখ্যা লেখা। আনাস্তাসিয়া রোমানীয় ভাষা বলতে এবং লিখতে জানে। তাই সংখ্যাগুলো বুঝতে তার কোনো সমস্যা হয় নি। কিন্তু সে এটা বুঝতে পারছে না এগুলো এবং এই চিত্র দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? সে ওরিয়নের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। ওরিয়ন কোনো কথা না বলে পরের পৃষ্ঠা উল্টায়। এখানে রোমানিয়ান ভাষায় কিছু একটা লিখা আছে। আনাস্তাসিয়া হালকা শব্দ করেই পরে,

” এখান থেকেই এই যাত্রা শুরু, এই অভিশাপ শুরু। যার শেষ কোথায় তা আমি নিজেও জানি না। কিন্তু সবকিছুরই যেহেতু একটি ইতি আছে তেমনই এই অভিশাপের ও নিশ্চয়ই একটি ইতি ঘটবে। রোমানিয়ান সাম্রাজ্য নিশ্চিত অভিশাপ মুক্ত হবে। ”
লেখাটা পড়ে আপনা আপনি আনাস্তাসিয়ার চোখ কুচকে আসে। সে ওরিয়নকে প্রশ্ন করে,
” এর সাথে ইভির ঘটনার কি যোগসূত্র আছে? ”
” আছে। আমি নিশ্চিত না কিন্তু সন্দেহ করছি। ”
” কিভাবে? ”

ওরিয়ন আরো কিছু পাতা উল্টে আরেকটি পৃষ্ঠা বের করে। আনাস্তাসিয়া দেখে সেই পৃষ্ঠায় একটি চিত্র আঁকা। কিন্তু এটি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না আনাস্তাসিয়ার। একটি মানব দেহকে আরেকটি কালো কাপড় পড়া মানুষ ঘাড় বরাবর কামড়ে ধরে আছে। তার উপরের দুটি সূচালো দাঁত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুখে লেপ্টে আছে রক্ত৷ কি বিভৎস দৃশ্য! আনাস্তাসিয়া ওরিয়নের হাত থেকে বইটি নিয়ে সেটি বন্ধ করে দেয়। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে ওরিয়নকে বলে,
” এসব অদ্ভুত চিত্রকর্ম এবং লেখালিখি কে করেছে? ছাইপাঁশ যত। ”
” এগুলো কোনো ছাইপাঁশ নয় আনাস্তাসিয়া। এটি সত্যি। তারা এখনো এই পৃথিবীতে বিচরণ করছে। তাদের একজনই মেরেছে ইভিকে৷ ”
” কারা ওরিয়ন? কাদের কথা বলছো তুমি? এই বইয়ের চিত্র হতে উঠে আসা অদ্ভুত এই মানবীর? ”
” অদ্ভুত মানবী নয়। ভ্যাম্পায়ার। ভ্যাম্পায়ার বলা হয় এদের। ”

ক্রিয়াসের সঙ্গে নিজ কক্ষে গোপন কথা বলার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলো আরোণ সেই সকাল বেলা। কিন্তু ক্রিয়াস সারাদিন প্রাসাদে ছিলো না৷ গতরাতে আলফার দেয়া কাজে ব্যস্ত থাকায় তার শিকারে যাওয়া হয় নি। সকাল হতেই সর্বপ্রথম সে শিকারে বেরিয়ে পড়ে। আজকে বণের দুটি বণ্য হরিণ শিকার করে খেয়েছে সে। তারপর বুদা শহরের দাস বাজারে গিয়ে একটি দাসী কিনে জঙ্গলে নিজের মানব রক্তের ক্ষুধাও মিটিয়ে নিয়েছে। খুশিমনে সন্ধ্যায় প্রাসাদে ফিরতেই সে শুনতে পায় আলফা সেই সকাল বেলা তাকে দেখা করার আদেশ দিয়েছে। ভীতসন্ত্রস্ত ক্রিয়াস জলদি আরোণের কক্ষের বাহিরে এসে দু বার দরজায় কড়া নাড়ে। ভিতর হতে প্রবেশের আদেশ পেতেই সে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। আরোণ তার দিকে পিঠ করে দুহাত পিছনে ভাজ করে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিয়াস পিছনে এসে এক হাঁটু ভাজ করে তার উপর হাত ভর করে নত হয়ে বলে,

” ক্ষমা করবেন আলফা। আমি প্রাসাদের বাহিরে ছিলাম। আপনি আমায় স্মরণ করেছেন সেই সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। ”
” তোমার ক্ষমার পর্ব শেষ হলে এখন আসল কথায় ফিরো৷ যা বলেছি তা কি হয়েছে? ”
” এখনো কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় নি আলফা। কৌতুহল মার্জনা করবেন কিন্তু আপনার কেন মনে হচ্ছে সে ফিরে এসেছে? ”
” একমাত্র তার মতো নির্বোধের দ্বারাই সম্ভব লুকিয়ে লড়তে আসা। তাও আমার উপর আক্রমণ করার দুঃসাহস নেই সেই নির্বোধের। আক্রমণ করেছে আমার শিকারের উপর। ”

” তা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি সেই সামান্য মানবী ক্যাথরিনকে নিয়ে এতোটা উদ্বিগ্ন কেন হচ্ছেন আলফা? ”
সাথে সাথে আরোণ চোখ পাকিয়ে ক্রিয়াসের দিকে তাকায়। ভয়ে জমে যায় ক্রিয়াস। বুঝতে পারে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। নিজের উপর বিরক্ত হয় সে। এভাবেই গত কদিন ধরে আলফার মেজাজ সপ্তম আকাশে উঠে আছে। এমন অবস্থায় তাকে অহেতুক প্রশ্ন করে রাগিয়ে দেয়াটা যে খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় তা সে ভুলেই গিয়েছিল। আরোণ সামনে এগিয়ে মুখ শক্ত করে প্রশ্ন করে,

” আমি কবে থেকে তোমার কাছে জবাব দিতে বাধ্য? ”
” ক্ষমা করবেন আলফা। ”
” দূর হও এখান থেকে আর তোমাকে দেয়া দায়িত্ব সম্পর্কে যদি অন্য কেউ জানতে পারে তাহলে তোমার গর্দান নেওয়ার আগে আমি এক দন্ড ভাববো না। ”
ক্রিয়াস তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে কামরা থেকে। আজকের রাতটাও তার একটু আরাম করার সুযোগ নেই। খুব সাবধানে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ তাদের কথা শুনে ফেলেছে নাকি। ঘুটঘুটে অন্ধকার করিডোরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। নেকড়েদের এই এক সুবিধা। যতই অন্ধকার হোক তারা নিজেদের প্রখর দৃষ্টিশক্তির ফলে সব দেখতে পায়। আশেপাশে কাউকে না দেখে সে সেখান থেকে প্রস্থিত করে।

রাত গভীর হওয়ায় আরোণ ক্যাথরিনের কক্ষের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্যাথ নিশ্চয়ই এখন ঘুমাচ্ছে। সে অন্ধকারে একপলক দেখে চলে গেলেও ক্যাথরিন টের পাবে না। মার্থা সন্ধ্যায় এসে বলেছে যে ক্যাথরিনের জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই নাকি কোনো কথা বলে নি। মার্থা যা খাবার নিয়ে গিয়েছে তাও নাকি ছুয়ে দেখে নি। মেয়েটা এমন করছে কেন? এভাবেই বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। না খেয়ে কি সুস্থ হয়ে উঠার শেষ আশাটাও গুড়িয়ে দিতে চায়? এসব ভাবতে ভাবতে নিশব্দে দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করে আরোণ। দরজা লাগিয়ে দিয়ে ভেতরে গিয়েই দেখে বিছানা খালি। সম্পূর্ণ কক্ষে নজর বুলিয়ে নেয়। উহু! ক্যাথরিন নেই।

আরোণ দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হতে নিয়েও ফিরে আসে। ধীর পায়ে বারান্দার দরজার কাছে আগায়। বারান্দার দরজার কাছে যেতেই যে দৃশ্য সে দেখতে পায় তাতে তার বুক জ্বলে উঠে। ক্যাথরিন বারান্দার মোটা রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। ভুলবসত এক পা সামনে বাড়ালেই ভয়ংকর মৃত্যুফাদ। আরোণের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠে কি হতে পারে ভেবে৷ তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে লাফাতে থাকে। সে সামনে এগোতেই নিবে কিন্তু তার হাত দরজার সাথে লেগে নিশ্চুপ পরিবেশে কর্কশ শব্দ করে উঠে। ক্যাথরিন চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। সাদা গাউন, সারা শরীর এবং মুখে বিভিন্ন আঁচড়ের দাগ, নির্লিপ্ত দৃষ্টি সব মিলিয়ে ক্যাথরিনকে যে কেউ এই অবস্থায় দেখলে এখন অশরীরী ভেবে বসবে।
আরোণ দ্রুত পায়ে সামনে আগায়। ক্যাথরিনও তার পা পিছিয়ে নেয়৷ আরোণ উচ্চস্বরে আর্তনাদ করে উঠে,
” ক্যাথ! ”

নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে রিকার্ডোর রাগে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলার দৃশ্য দেখে বেশ উপভোগ করছে ম্যাথিউ। তার মতে কোনো নারী সঙ্গের তুলনায় রিকার্ডোর রাগে ফাটা দৃশ্য তার কাছে বেশি উপভোগ্য। স্বভাবতই রিকার্ডো খুব ঠান্ডা মস্তিষ্কের। তার চাল চলন সব কিছুতেই সেটা স্পষ্ট ফুটে উঠে। তার এই আচরণের ফলে সবাই ভাবে সে খুব ছন্নছাড়া স্বভাবের। যে কোনো কিছু নিয়েই পরোয়া করেনা। কিন্তু ম্যাথিউ কেবল জানে যে রিকার্ডো সব কিছু নিয়ে কতো পরোয়া করে। এইযে তার প্রমাণ হচ্ছে রাগে এখন রিকার্ডোর অস্থির হয়ে উঠা। এমন অতি ঠান্ডা মস্তিষ্কের একজনকে রাগিয়ে তুলতে পারাটা ম্যাথিউর কাছে রুক্তপানের থেকেও বেশি তৃপ্তিদায়ক।

” তোর সাহস কি করে হলো ম্যাথিউ? তুই আমাকে খুঁজতে আসিস? ”
” শত্রুদের মুখে কোভেনদের ছেড়ে দিয়ে তুমি এখানে ভ্রমণযাত্রায় বেরিয়েছো? ”
” কোভেনরা কবে থেকে এতো দূর্বল হয়ে পড়েছে যে নিজেদের রক্ষাও নিজে করতে পারে না? ”
” তুমিও একজন কোভেন আর তার উপর আমাদের কাউন্ট। তাই কোভেনদের তোমার থেকে সামান্যতম দায়িত্বশীলতা আশা করাটা নিশ্চয়ই বোকামি নয়? আর বাকিদের কথা জানিনা কিন্তু আমার রক্ষক আমি নিজে। আমার কাউকে নিজের রক্ষাকবচ হিসেবে চাই না৷ ”
ম্যাথিউর কথা শুনে রিকার্ডোর রাগী চেহারায় হালকা হাসি ফুটে উঠে। সে ম্যাথিউর দিকে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে বলে,

” তাইতো তুই এখন এখানে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস। তাইনা? ”
” তোমার মা এবং বাবা তোমাকে খুঁজে নিয়ে যেতে বলেছে সাথে করে। তারা ভয় পাচ্ছে শত্রুরা তোমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিবে। ”
” ভয়ের কোনো কারণ নেই। কেউ কোনো সুযোগ নিতে পারবে না। ”
” সেটা তুমি তোমার মা বাবাকে বুঝাও গিয়ে। ”
” তুই এক্ষুনি রোমানিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবি। আমি পরে ফিরে আসবো। ”

” তোমার আদেশ আমি আজ পর্যন্ত পালন করেছি যে আজ করবো? আমার যতদিন ইচ্ছে আমি থাকবো। ”
বিরক্ত হয় রিকার্ডো। ম্যাথিউ এরকম ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের এটা তার জন্য নতুন কিছু না। কিন্তু তার সমস্যা হচ্ছে ম্যাথিউর মানব রক্তের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি। বিশেষ কারণে ম্যাথিউ বাকি ভ্যাম্পায়ারদের তুলনায় নিজের রক্ত পিপাসার উপর নিয়ন্ত্রণে খুব দুর্বল। আজকেও গ্রামে যে মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছে সেই মেয়েও কাল রাতে ম্যাথিউর হিংস্রতার শিকার হয়েছে তা নিয়ে নিশ্চিত রিকার্ডো। এজন্যই সে চাচ্ছে না ম্যাথিউ এখানে থাকুক। তাদের দ্বারা হওয়া সামান্যতম ভুলের ফলে সে শত্রুর এতো কাছে এসেও তাকে হারাতে চায় না। কিন্তু এই বিষয়ে এই মুহুর্তে কোভেনদের কিছু জানাতে চায় না রিকার্ডো। আবার চিন্তিত হয়ে কপালে হাত রেখে সে পায়চারি করতে থাকে। রিকার্ডোকে এরকম অস্থির ও চিন্তিত রূপে দেখে তার হতে কয়েক হাত দূরে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ম্যাথিউ ক্রুর হেসে উঠে।

প্রকৃতিতে যেন কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। প্রতিটা মুহূর্ত শ্বাস নেওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে। মস্তিষ্কের সকল ভাবনা এলোমেলো হয়ে পড়ছে। আরোণ ক্যাথরিনের এমন নির্লিপ্ত ব্যাবহার নিতে পারছে না। তার হৃদয় পূর্বের ক্যাথরিনকে দেখার আশায় পুড়ছে। যে ক্যাথরিনের চাল চলনে তেজ ফুটে উঠে। যার কথা তীরের মতো তীক্ষ্ণ। কিন্তু এই ক্যাথরিন খুব অপরিচিত আচরণ করছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরও তার মুখ দিয়ে একটি টু শব্দও বের হচ্ছে না। আরোণ গত আধ ঘন্টা ধরে ক্যাথরিনের কক্ষে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের পলক পড়ছে না। অল্পের জন্যই পিছনে পড়তে নিলেও আরোণ বাতাসের গতিতে এসে ক্যাথরিনের হাত ধরে টান দিয়ে ভিতরে নিয়ে আসে। আকস্মিক ঘটনায় ক্যাথরিন ও আরোণ দু জনই বারান্দার মেঝেতে পড়ে যায়। আরোণ ক্যাথরিনকে কিছু বলবে তার পূর্বেই ক্যাথরিন চুপচাপ সেখান থেকে উঠে কক্ষে ফিরে আসে। আরোণ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বুকের বা পাশে ডান হাত রেখে কিছুক্ষণ জোরে নিশ্বাস নেয়। তারপর সে ও কক্ষে প্রবেশ করে। কক্ষে প্রবেশ করতেই সে দেখে ক্যাথরিন বিছানার মাঝামাঝি হাটু ভেঙে বসে আছে। তার দৃষ্টি ঝুঁকে আছে।

ক্যাথরিনের কোনো হেলদোল না দেখে আরোণ এগিয়ে আসে তার কাছে। হাত বাড়িয়ে ক্যাথরিনের মুখের সামনে এসে থাকা চুলগুলো সড়িয়ে দিতে নেয়। চকিতে ক্যাথরিন হকচকিয়ে ভয়ে সড়ে যায় বিছানার অপরপাশে। আরোণের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আরোণ ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায়। ক্যাথরিনের ঘৃণাভরা দৃষ্টির সঙ্গে পূর্ব পরিচিত আরোণ কিন্তু তার এই ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে আরোণের চোখ জোড়া শিথিল হয়ে আসে।

ক্যাথরিন তাকে ভয় পাচ্ছে? কিন্তু কেন? এতো সব ভাবনার মাঝে সে আবার ক্যাথরিনের কাছে এগিয়ে যায়। ক্যাথরিনকে ছুঁতে নিলেই সে ছ্যাঁত করে উঠে আরোণকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরানোর চেষ্টা করে। আরোণ এক হাত ক্যাথরিনের পিঠের পিছনে নিয়ে ও অন্য হাত দিয়ে ক্যাথরিনের মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
” ক্যাথ শান্ত হও। আমি আরোণ। ভয় পেয়ো না। শান্ত হও। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। এখানে কেউ নেই৷ ঠান্ডা হও। ”

ক্যাথরিন অস্ফুটস্বরে কাদছে আর দু হাত দিয়ে আরোণকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। আরোণ দিশেহারা বোধ করছে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে উপলব্ধি করলো এতো ক্ষমতাবান হওয়ার পরও ক্যাথরিনের ভয় ও কান্নার সামনে সে অসহায়। না সে পারছে ক্যাথরিনের মনের মধ্যে বসে যাওয়া এই ভয় ও তার চোখের এই কান্না দূর করতে আর না পারছে সে এই দুটি জিনিস সহ্য করতে। পুরো জীবন যেই ভয়, কান্না, আহাজারি তার মনে পৈশাচিক আনন্দ এনে দিতো আজকে সেই একই জিনিস তার হৃদয়ে প্লাবন সৃষ্টি করছে।
আরোণ ক্যাথরিনের দু হাত নিজের হাতে শক্ত করে আবদ্ধ করে তার সামনে বসে। আরোণের চোখেমুখে এখনো দিশেহারা ভাব স্পষ্ট। ক্যাথরিনের কান্নার গতি কিছুটা কমে আসে। এখন আর কোনো শব্দও করছে না আর না আরোণকে দূরে ঠেলার চেষ্টা করছে। আরোণ এক হাত বাড়িয়ে ক্যাথরিনের গালে হাত রাখে। কোমল কণ্ঠে বলে,

” ক্যাথ! তাকাও আমার দিকে। ”
ক্যাথরিন মাথা তুলে তাকায় না। আগের মতোই মাথা নিচু করে বসে রয়। আরোণ আগের তুলনায়ও কোমল করে ডাকে,
” ক্যাথ! ”
ক্যাথরিন এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়। ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে আরোণের দিকে। নিষ্প্রাণ সেই দৃষ্টি। আরোণের জানতে ইচ্ছে করে কি কারণে ক্যাথরিন এমন আচরণ করছে। ক্যাথরিনের চোখের জল মুছে দিয়ে তাকে প্রশ্ন করে,

” আমাকে খুলে বলো ক্যাথ সে রাতে কি হয়েছিল? ”
ক্যাথরিন কোনো উত্তর দেয় না। আরোণ আবার প্রশ্ন করে,
” ক্যাথ দয়া করে আমাকে বলো সেদিন কি হয়েছিল? আমার জানা জরুরি। ”
ক্যাথরিন এক ঝটকায় আরোণের হাত নিজের গাল থেকে সড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
” নিজের পালিত জানোয়ারদের দ্বারা আমার সম্মান নষ্ট না করে আমাকে একেবারে মেরে কেন ফেলছো না তুমি? ”
আরোণের শিথিল ভ্রু জোড়া কুচকে আসে।
” সম্মান নষ্ট মানে? ”
ক্যাথরিন কান্না থামিয়ে হেসে উঠে। তার ধারালো হাসি দেখে আরোণ কিছুটা বেকুব বনে যায়৷ মুখে হাসি নিয়েই ক্যাথরিন বলে,

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৭+৮

” কেন? নাটক করছো না জানার? তোমার পোষা নেকড়ে আমাকে শুধু আঘাত করে ক্ষ্যান্ত হয় নি। আমাকে বাজেভাবে ছুঁয়েছে ও। ”
আরোণের মস্তিষ্ক সাথে সাথে দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। মূহুর্তেই তার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। ক্যাথরিন আবার বলে উঠে,
” নাটক কেন করছো তুমি? আর আমাকে বাঁচাতেই বা কেন এলে? বুঝেছি। আগে তুমি নিজের মন কামনা পূরণ করে আমাকে কলুষিত করবে তারপর আমাকে খুন করবে তাইতো? ঠিক ওই যুবকটার মতো আমার হৃদয়ও চিবিয়ে খেতে চাও। ”
আরোণ নিশব্দে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে গিয়েও একবার ফিরে তাকায়। চোয়াল শক্ত করে বলে,
” যেই হাত তোমাকে স্পর্শ করেছে আর তোমাকে আঘাত করেছে সেই হাতজোড়া কেটে এনে তোমার পায়ের সামনে রাখবো। কথা দিলাম। ”

মহাপ্রয়াণ পর্ব ১১+১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here