মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১১
নাবিলা ইষ্ক
এলোমেলো মন নিয়েও আমি বুঝতে পারছিলাম অহনা আপুর উশখুশ আচরণ। তিনি কিছু একটা করতে চাইছেন। কিন্তু কী! ভাবার সময়ও পেলাম না। হঠাৎ করে আমাকে আন্টির ঘরে পাঠালেন। বললেন, আন্টি আমায় ডেকেছেন। আমিও এলাম। আসলেই ডেকেছেন। আমাকে দেখেই আন্টি মুখ ভরে হাসলেন। বিছানায় বসিয়ে আলাপ জুড়লেন। আলাপটা নিশু ভাইয়ার বাচ্চাকাল নিয়ে। ছোটোবেলায় ভাইয়া কতো দুষ্টু ছিলেন— তাই বলছিলেন। একবার নাকি তাদের ড্রয়িংরুমের দামী টি-টেবিলটা ব্যাট দিয়ে আঘাত করে ভেঙেছিলেন। বাবা যখন রাতে বাড়ি ফিরে জানতে পারলেন খুব মে রেছিলেন ভাইয়াকে। নিশু ভাইয়ার আলাপের সুর গিয়ে থামলো তাশরিক ভাইয়াতে।
তিনি বাচ্চাকালে ভীষণ মিষ্টি ছিলেন। মিষ্টি করে কথা বলতেন, হাসতেন। বয়ঃসন্ধিতে একদম বিগড়ে গেলেন। বদমেজাজ, তেজ মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি বনে বসে আছেন। দিনদুনিয়ার পরোয়া নেই, নেই কাউকে ভয় করার কারণ। আন্টি, আংকেল দুজনেই মাটির মানুষ, নরম মানুষ। ওমন বদরাগী ছেলেকে কী শাসন করবেন? ছেলের ভয়েই যেন তাদের জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। আংকেল নাকি এখনো হৃৎপিণ্ড হাতে নিয়ে বসে থাকেন। এই কখন ছেলে তার বাড়িঘর মাথায় তুলে ঝামেলা করে বসে। এসবই বলছিলেন আর হাসছিলেন। আমিও তালে তাল মিলিয়ে হাসছিলাম। জোরপূর্বক নয়। মনের টানেই। শুনতে ভালো লাগছিলো। আরও শুনতে চাইলো আমার মন। বিছানায় দু-পা উঠিয়ে ভারী মনোযোগ দিয়ে গল্প শোনা আমি সময়ের তালই ভুলে বসলাম। হঠাৎ করে তাকালাম ঘড়ির দিকে। এমা, বারোটা ষোলো! কী আশ্চর্যজনক! এতো রাত হয়ে এলো কেউ ডাকতে এলো না। আমাদের তো হলুদের ডালা দিয়েই ফিরে যাবার কথা ছিলো। ওরা সবাই কী তবে আড্ডা দিচ্ছে? আমি ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘আন্টি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে যে এতোটা সময় চলে গেলো বুঝতেই পারিনি।’
আন্টি হেসে নিজেও নামলেন বিছানা ছেড়ে। আমার গাল ছুঁয়ে দিয়ে নাকটা অল্প টেনে বললেন, ‘তাতে এতো তাড়াহুড়োর কী আছে? দেরি হলে হয়েছে। আমরা কী পর নাকি? আমি চাইলে তোকে রেখেও দিতে পারি।’
প্রত্যুত্তরে আমি মিষ্টি করে হাসলাম। আন্টির সাথে বেরিয়ে এলাম। সাথে সাথে চোখ গেল ড্রয়িংরুমের সোফায়। তাশরিক ভাইয়া গোমড়া মুখে বসে টিভি দেখছেন। পায়ের ওপর পা তুলে রেখেছেন। বাম হাতটা সোফার হাতলের ওপর রাখা। ডান হাতে রিমোট চাপছেন। আপদমস্তক তাকে এক আগুনের ফুলকিই মনে হলো। যেখানে একটু কেরোসিন পড়লেই তার সাথে পুরো বাড়িতে আগুন ধরে যাবে। আমি আড়চোখে চেয়ে দৃষ্টি নামালাম। আন্টি আর আমি ড্রয়িংরুম পেরিয়ে বেরিয়ে যাবো ওসময়ে অহনা আপু ঢুকলেন। দুষ্টু করে হেসে বললেন,
‘এতো কী আলাপ করলি এতক্ষণ? কটা বাজে হুঁ? বাড়ির সবাইতো সেই কখন চলে গেল।’
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। চ্যাঁচালাম প্রায়,
‘কীহ!’
‘কী নয়…জি। তাদের বলেছি তোকে তাশরিক ভাইয়া পরে দিয়ে আসবেন।’
আমি চমকে তাকালাম পাশে। তাশরিক ভাইয়া যেন শোনেননি। ক্রমাগত চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন। মনে হয় রিমোটটা তিনি ভেঙে ফেলবেন। আন্টি আমার মাথা বুলিয়ে তাকালেন সোফার দিকে। বললেন,
‘কীরে? বসে আছিস কেনো এখনো? ওঠ…আদরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়।’
শ্বাস গলায় এসে আটকে থাকলো আমার। হৃৎপিণ্ডও যেন থমকেছে। উনি নিশ্চয়ই বলে বসবেন, ‘পারবো না।’ অথচ তেমন কিছুই বললেন না। সুড়সুড় করে উঠে দাঁড়ালেন। যেন তিনি এখানে বসেই ছিলেন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্যে। হেঁটে বেরিয়ে গেলেন বাইরের দিকে। অহনা আপু মুচকি মুচকি হেসে আমায় ঠেলে দুয়ারের দিকে নিচ্ছেন। তাশরিক ভাইয়া গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করেছেন। আমি ইতস্তত করলাম। আড়চোখে ওমন গম্ভীরমুখটা দেখে সংকোচ করলাম। একপর্যায়ে নিঃসংকোচে ড্রাইভিংয়ের পাশে উঠে বসলাম। আন্টি, অহনা আপু দুয়ারে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতন খিলখিল করে হেসে হাত নাড়ছেন। প্রত্যুত্তরে আমি হাসতে পারলাম না। বুকের ভেতরটায় ঝড় বইছিলো। গাড়িটা চলতে শুরু করলো ধীর গতিতে। বেরিয়ে এলো খান বাড়ি ছেড়ে মেইন রাস্তায়। নীরব রাস্তাঘাটের মতন গাড়ির ভেতরটাও নীরব। পিনপতন নীরবতা বয়ে গেল অনেকটা সময়। তাশরিক ভাইয়ার ব্যান্ডেজ করা হাতটা হুইলে। অন্য হাতে স্টিয়ারিং। তার ব্যান্ডেজ করা হাতটাই বারবার আমার চোখে লাগছে। আমি–আমি নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারিনি শেষমেশ। উত্তর দিবেন কি-না জানি না। তবুও ফিসফিস করে একসময় জিজ্ঞেস করেই বসলাম,
‘হাতে.. হাতে ব্যথা পাচ্ছেন না?’
উনার ছোটোখাটো জবাবটা এলো প্রায় সাথে সাথে, ‘পাচ্ছি।’
আমি একটু হকচকালাম। তাকালাম একপলক তার মুখের দিকে। এখনো চোখমুখ গম্ভীর হয়ে আছে। দৃঢ় দৃষ্টিতে সামনে চেয়ে আছেন। উনার জবাবটা বেশি সত্য হয়ে গেলো না? এভাবে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই বলতো, ‘আরেহ না। এতটুকু কখনো আমায় ব্যথা দিতে পারে না।’ আমি মাথায় এমন একটা জবাবই ভেবে রেখেছিলাম। তাই তার এমন সত্য জবাবে কিছুটা থমকাই, উত্তর জানা সত্ত্বেও ইতস্তত নিয়ে শুধাই…
‘কীভাবে হলো এমন!’
এবারো আমার কথার বিপরীতে সাথে সাথে জবাব এলো তার, ‘গাড়ির গ্লাসে ঘুষি মে রেছি।’
আমি আশ্চর্যই হলাম। তাকালাম তার দিকে, ‘কেনো?’
তিনি ফিরে তাকাননি। এতে বরংচ আমার জন্য ভালোই হলো। উনি ফিরে তাকালে আমি যে আর তাকিয়ে থাকতে পারতাম না। মাথাটা পুনরায় নুইয়ে ফেলতাম, দৃষ্টি লুকোতাম। তাশরিক ভাইয়া অসন্তুষ্ট গলায় করে বললেন,
‘তোমার ভাইয়ের মুখের ওপর তো মার তে পারছিলাম না তাই গাড়িতে মে রেছি। যতোই হোক, শীঘ্রই দু-দুটো সম্পর্কে জড়াচ্ছেন তিনি আমার সাথে। এসময়ে মে রে মুখ ভেঙে দিলে তো আমারই লস।’
আমি হতবিহ্বল। চোয়াল ঝুলে এলো। তোতলালাম একপ্রকার,
‘কীজন্যে?’
হঠাৎ করে গাড়িটা নির্জন এই রাস্তার পাশে জোরসে ব্রেক কষলেন। আমি আঁতকে উঠলাম। ধড়ফড়িয়ে উঠল আমার হৃৎপিণ্ড। তাশরিক ভাইয়া সিটবেল্ট খুলে সাপের মতো ফোঁস করে হুড়োহুড়ি জুড়ে আমার দিকে ঝুঁকে এলেন। আমার পিঠ একঝটকায় মিলিয়ে গেলাম জানালার সাথে। শুকতে পেলাম তার পারফিউমের গন্ধ। দু-চোখ শক্ত করে বুজে রীতিমতো শ্বাস আটকে রাখলাম। তিনি গর্জে উঠলেন প্রায়,
‘Are you asking me? Seriously?’
তিনি ঘন করে শ্বাস ফেলে বাতাসের মতো আওড়ালেন, ‘যেমন ভাই তেমনি তার বোন।’
ফের বললেন, ‘Why don’t you use your little brain, Miss? Hm? You were avoiding me and I was dangerously frustrated. I was super upset. Top of that your sweet brother….’
মিস? আমাকে মিস ডাকলেন? আমি অপ্রস্তুত হলাম। তবে চোখ মেলে তাকানোর দুঃসাহস যোগাতে পারলাম না। তিনি থামলেন। দাঁতে দাঁত পিষলেন যেন এখুনি ভাইয়াকে চিবিয়ে খেতে চাচ্ছেন,
‘তোমার গুণধর ভাই আমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছেন। আমি যেন একজন জে ন্টাল ম্যান হই তার বোনের জন্য। তার আদুরে বোনকে যেন কোনোভাবে প্রেসার না দিই। নাহলে তিনি তার বোনকে আমার হাতে তুলে দেবেন না। সাচ আ….’
আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আওড়ালাম, ‘তাই বলে এমন করবেন!’
তিনি আরও ঝুঁকলেন আমার দিকে, ‘করবো। ইন ফিউচার তুমি আমাকে এড়ালে আরও খারাপ কিছু করবো।’
আমি মিইয়ে গেলাম। কাঁচের সাথে মিশে গিয়ে বিড়বিড় করলাম, ‘আ–আমি একটু সময় নিতে চাচ্ছিলাম।’
তাশরিক ভাইয়ার কণ্ঠ নরম শোনালো, ‘দেবো, যতটা সময় প্রয়োজন দেবো। কিন্তু আমাকে এড়ানো যাবে। আই কান্ট বিয়ার ইট। বুঝছো? হু?’
আমি ঢোক গিলে মাথা দোলালাম সমানে। তাশরিক ভাইয়া মিষ্টি করে বললেন, ‘ভদ্র হতে হবে আমাকে তাই তো?’
আমি লজ্জায় কিছুই বলতে পারলাম না। নাহলে বলতাম, আপনাকে পরিবর্তন হতে হবে না। যেমন আছেন, তেমনি ঠিক আছেন। তাশরিক ভাইয়া সরে যেতেই আটকে রাখা শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো আমার। আমি সুন্দর ভাবে বসলাম। তিনি গাড়ি স্টার্ট করেছেন। ড্রাইভ করতে করতেই বললেন,
‘I can do everything for you, everything. I’ll change myself the you want. Just…Just don’t avoid me in the future.’
আমি স্তব্ধ হলাম। শিউরে উঠলাম। কথাগুলো ভেতর থেকে আমাকে নাড়িয়ে দিলো, এলোমেলো ভাবে শুধু বেজে গেলো কানের কাছে। গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। তিনি ভ্রু তুলে চাইতেই আমি নামলাম। কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে এযাত্রায় হাসলেন। আমার চেনা সেই হাসি, উজ্জ্বল সেই স্বরেই বললেন,
‘Good Night.’
আমার হৃদয় শান্ত হয়ে গেল। অশান্তি, অস্থিরতার বিনাশ ঘটল নিমিষেই। ভালোলাগায় যেন আমার দুনিয়ায় প্রজাপতিরা উড়তে শুরু করলো। গাড়িটা একটানে বেরিয়ে গেলেও আমি তখনো চেয়ে থাকলাম তার যাওয়ার পথে। ভেতর থেকে সুফিয়া এলো, আমাকে টেনে ভেতরে নিলো… তখনো আমি যেন অন্য দুনিয়ায় আছি। সেই রাত আমি বোধহয় স্বপ্নে কাটিয়েছি। ভাবুক, ছন্নছাড়া…. অচেনা আমিতে। সকালবেলা বাবা যখন আমাকে ডেকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘মামণি, তোমার কি অন্য কাউকে পছন্দ আছে?’
আমি চমকে তাকালাম বাবার দিকে। আশ্চর্য নিয়ে দ্রুতো মাথাটা দুলিয়ে বললাম, ‘নায়া, না। কীভাবে থাকবে? বাড়ি থেকে তো বেরুনোই হয় না একা।’
বাবা সন্দেহজনক ভাবে হাসলেন। বিড়বিড় করলেন, ‘কিন্তু মামণি, ফেইসবুক তো চালাও যদি কারো সাথে…’
আমি আরও জোরে আওয়াজ তুললাম, ‘নায়ায়া, ফেইসবুক —ফেইসবুকের অচেনা-অজানা ছেলেকে পছন্দ করবো কীভাবে! এও হয়? আর আমার আইডিতে তো তোমরা ছাড়া বাইরের কেউ নেই।’
বাবা এবারে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। মিচকে শয় তানের মতন কেমন গাল ভরে হেসে তাকিয়ে থাকলেন। যেন চোখমুখ দিয়েই জিজ্ঞেস করছেন, ‘মামণি, তাহলে তো তোমার আর সমস্যা নেই তাশরিককে বিয়ে করতে?’
আমি আলগোছে তার সামনে থেকে উঠে এলাম। বাবা তখন শব্দ করে হাসছেন। দোতলায় উঠে এসে আমিও নিঃশব্দে হেসে ফেললাম। ভাইয়ার বিয়ের আগের এই দু-দিন অর্থাৎ আজ আর কাল আমাদের অনেক শপিং বাকি আছে। আজও সকাল সকাল নাস্তা সেরে আমাদের বেরুতে হচ্ছিলো মলের উদ্দেশ্যে। তৈরি হয়ে বাগিচার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম পরিচিত গাড়ি ঢুকছে সদরদরজা দিয়ে। আমি শুনেছিলাম, ও বাড়ি থেকে অহনা আপু আসবেন শপিংয়ের জন্য। কিন্তু তাশরিক ভাইয়া আসবেন কি-না জানতাম না।
অদূর থেকেই জানালার কাঁচ নামিয়ে অহনা আপু হাত নাড়াচ্ছেন আমার দিকে। বেশ উতলা তিনি। চোখ টিপছেন সমানে। আমার বুকের ভেতরটা ফের ধুকপুক শুরু করলো। তারমানে তাশরিক ভাইয়াও এসেছেন। আমার ভাবনা শেষ হবার আগে গাড়ি থেকে তাশরিক ভাইয়া নেমে এলেন। ধূসর রঙের প্যান্টের সাথে শুভ্র রঙা টি-শার্ট ইন করে পরেছেন। চোখে সানগ্লাস। হাতে অহনা আপুর বলা সেই ষোলো ধরনের ফুলের তোড়া। সেদিনের তোড়া তো এই পর্যন্ত ভালো থাকার কথা নয়। আবার আনিয়েছেন? তিনি এসে ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে ধরলেন। কেমন অপ্রস্তুত গলায় বললেন,
মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১০
‘আসসালামু আলাইকুম, বেবিগার ল…উম..জাস্ট আসসালামু আলাইকুম উদাউট দ্য ওয়ার্ড বেবিগার্ল। ইয়াহ।’
স্তব্ধ হলাম।কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকালাম তার দিকে। তার ভদ্র হওয়ার ধরন দেখে পরপরই আমি মুখে হাত চেপে শব্দ করে হেসে ফেললাম। আমার হাসির শব্দে অহনা আপুও গাড়ি থেকে মাথা বের করে সমানে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন কী হয়েছে! আমি হাসতে হাসতেই মাথা তুলে তাকাতেই থমকালাম, মিইয়ে গেলাম ওমন দৃঢ়, গভীরে দৃষ্টির সামনে। শুনতে পেলাম তার বলা অস্পষ্টক থাগুলো,
‘Do you know what, Babygirl? In this whole world only you…Yeasmin Molla Ador have the power to set my heart on fire….’