মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১২

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১২
নাবিলা ইষ্ক

আমি মিইয়ে গেলাম হাওয়াই মিঠাইয়ের মতন। লজ্জায় লাল হয়ে আসা মুখ লুকোতে ফুলের তোড়াটা মুখের সামনে ধরলাম। হেসে ফেললাম নিঃশব্দে। তার কথাগুলো তখনো কানে বেজে যাচ্ছিলো। ফুলের তোড়া থেকে চমৎকার ঘ্রাণ আসছে। হরেকরকম ফুলের ঘ্রাণ একত্রিত হয়ে একটা দারুণ ঘ্রাণের উৎপত্তি ঘটেছে। আমি শুকলাম আনমনা। হৃৎপিণ্ডের লাফালাফি সামলে কোনোরকমে আওড়ালাম,
‘বু-বুকেটা রেখে আসি ঘরে?’
ততক্ষণে আন্টি, আংকেলও বেরিয়ে এলেন গাড়ির ব্যাকসিট থেকে। তারা যে এসেছেন তাই জানতাম না। আমি দ্রুতো ফুলের তোড়াটা লুকোতে চাইলাম। বড়োদের সামনে তার কীর্তিকলাপ আমাকে আসলেই অসহায় করে তুলছে। বাবা ইতোমধ্যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আংকেল তাশরিক ভাইয়ার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হেসে বলেন,

‘মামণি, হাও ওয়াজ ইওর স্লিপ লাস্ট নাইট? ডিড ইউ স্লিপ ওয়েল?’
আমি একপলক পাশাপাশি দাঁড়ানো দুজনকে পরখ করে নিলাম। ভেতরে ভেতরে আবারো হাসলাম। এতো মিল যে অনেকটা হাস্যকর লাগে। ইংরেজি ছাড়া যেন তারা কথাই বলতে পারেন না। অথচ অহনা আপু, আন্টি তারা তো কী সুন্দর শুদ্ধ, স্পষ্ট বাংলা বলেন। সচরাচর একটা ইংরেজি শব্দ তাদের মুখে শোনা যায় না। আমি মৃদু হেসে জানালাম,
‘জি। আপনার ভালো ঘুম হয়েছে তো, আংকেল?’
আংকেল চমৎকার করে হাসছেন। হাত দুটো পিঠে বাঁধা। তিনি বেশ উৎফুল্ল গলায় বললেন, ‘আমি সবসময়ই ভালো ঘুমাই, মামণি। তবে তাশরিক কিন্তু সারারাত ঘুমোতে পারেনি। ফোনে রাতভর ফটর ফটর করেছে।’
আমি ভড়কালাম। সংকোচিত বোধ করলাম। কার সাথে? আড়চোখে একবার তাকালাম তাশরিক ভাইয়ার দিকে। তিনি সরু চোখে ডান ভ্রু তুলে আংকেলের দিকে চেয়ে আছেন। আংকেল সেদিকে চাইলেন না। তিনি আমার দিকেই চেয়ে আছেন মিষ্টি করে। আমি অপ্রস্তুত হয়েই আওড়ালাম,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ফটর ফটর?’
আংকেল উৎসাহের সাথে বললেন, ‘হ্যাঁ। ফোন মুখের সামনে নিয়ে জিজ্ঞেস করছিলো— ‘How to pursue a beautiful, gentle young women with respect and in a gentlemanly manner.’
সবাই একসাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠেছে। আমার বাবা চ্যাঁচালেন, ‘সো সুইট!’
বাবার এমন প্রতিক্রিয়ায় আমার লজ্জা বাড়লো। তাশরিক ভাইয়া তখন সাবলীলভাবে আংকেলের কাঁধ জড়িয়ে ধরে তাকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে নিতে স্নেহের সাথে বললেন,
‘বাবা, তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে না ডক্টর মুখার্জির চেম্বারে? আমরা আজই সন্ধ্যায় যাবো কেমন?’
আংকেল আঁতকে উঠলেন, ‘কবে? কখন? কেনো? বললাম না আর খারাপ লাগছে না? সুস্থ হয়ে গেছি। দিব্যি আছি আমি। আই এম অ্যাবসোলুটলি ফাইন।’
তাশরিক ভাইয়ার কণ্ঠের সুর স্নেহের সাগরে ঢেউ তুলল যেন, ‘রিস্ক নেয়াটা ভালো হবে না, তাই না বাবা? দ্য ডক্টর শুড চেইক ওন ইউ টু বি শিয়র।’

হতবিহ্বল আমি দেখলাম মা, চাচি, মামি তারা সবাই আন্টির কাছে গিয়ে রীতিমতো আলাপ শুরু করেছেন এখানে দাঁড়িয়েই। নিশু ভাইয়া এসে দাঁড়ালেন বাবার পাশে। দৃষ্টি তার গাড়িতে বসা অহনা আপুর দিকে। এরমধ্যে হুড়োহুড়ি জুড়ে আমি কাজিনরা হাজির হলো একেক করে। সুফিয়া এসেই মিষ্টি করে সালাম দিলো,
‘আসসালামু আলাইকুম, দুলাভাই।’
ইশ! মেয়েটার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। এখানে বড়োরা আছেন না? আমি লজ্জায় মুষড়ে গেলাম প্রায়। তাশরিক ভাইয়াকে অবশ্য স্বাভাবিকই লাগলেন। উৎসাহিত হয়ে সালামের জবাব দিলেন,
‘ওয়ালাইকুমস সালাম, শালিকা।’
নিশু ভাইয়া আলাপের মধ্যে আমাাকে বললেন, ‘বুকেটা গাড়িতে রাখিস।’
আমি বাধ্য মেয়ের মতো ফুলের তোড়া নিয়ে উঠে বসলাম ড্রাইভিং সিটের পাশে। এইযাত্রায় বাবা-ছেলের কাণ্ড ভেবে পুনরায় হাসলাম। তাশরিক ভাইয়ার গম্ভীর মুখটা ভেবে শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে হলো। আবার আংকেলের কথাগুলো ভাবলাম। আসলেই কী ওমন একটা বাচ্চাদের মতন কাজ করেছেন তিনি? ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে এসে বসতেই জিজ্ঞেস করলাম রয়েসয়ে,

‘উনারা কী সবসময় এমন বাচ্চাদের মতন ইনভিসিবল আর্গিউ করেন?’
ভাইয়া গাড়ি স্টার্ট করেছেন। পেছনে আমার কাজিনরা কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে। গাড়িটা বের করতে করতেই বললেন,
‘ইনভিসিবল নয়। ভিসিবল ভাবেই করে। বাসায় তো এর চেয়ে বেশি।’
আমার খুব আগ্রহ হলো জানার তাদের নিয়ে। ভীষণ আকর্ষণ কাজ করছে। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা লাগছে। তাই চুপ করে গেলাম। আমাদের গাড়ির পাশাপাশি এসে ছুটছে তাশরিক ভাইয়ার গাড়ি। কাঁচ নামানো। সানগ্লাস চোখে। তার ধারালো, দৃঢ় দৃষ্টি রাস্তায়। অহনা আপু জানালা দিয়ে হাত বের করে— দু-বার হাত নাড়ালেন বাচ্চাদের মতন। নিশু ভাইয়া ড্রাইভ করতে করতে কেমন চাপা তবে উচ্চ গলায় বললেন,
‘হাত ভেতরে!’

অহনা আপুকে মোটেও চমকাতে দেখা গেলো না। উল্টো জিহ্বা বের করে ভাইয়াকে ভেঙিয়ে বিপরীত দিকে ফিরে গেলেন। আমি মুহুর্তে আরও ভদ্র হয়ে বসলাম। ধমক খাবার ইচ্ছে আমার নেই। আমাদের গাড়িটা এসে পৌঁছেছে মলে। আমাদের ইতোমধ্যে ভাবা আছে, পছন্দ আছে। শপ ঘুরে ঘুরে কেনার পালা। পার্কিং লটে গাড়ি থামতেই আমি নামলাম। বুকেটা রেখে এলাম গাড়িতে। তাশরিক ভাইয়া বাবার সাথে আলাপ করতে করতে এগিয়ে আসছে। বেশ ভদ্রভাবে শুনছেন। আমি অহনা আপু, সুফিয়া, রুমি আপু বাকিরা একসাথেই জোট বেঁধে ভেতরে ঢুকছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে তাশরিক ভাইয়া চলে এলেন। সবার মধ্যে কেমন দারুণ ভাবে মিলে গিয়ে ঠিক আমার পাশে এসে হাঁটছেন। ওমনি আমার জ্ঞানী কাজিনরা আলাদা হয়ে গেল আমার থেকে। রুমি আপু যাওয়ার সময় আমাকে চিমটি কেটে গেলেন। অহনা আপুও সামনে চলে গেছে মায়ের সাথে। সবার মিটিমিটি নীরব হাসি দেখে লজ্জায় আমার মুখ থেকে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করল। এমনিতে তাশরিক ভাইয়া আমার চেয়ে ভীষণ লম্বা। আমি হয়তোবা তার বুকে কোনোরকমে পৌঁছাবো। আমার সাথে কথা বলতে হলে তার মাথাটা ঝুঁকাতে হয়। এই বিষয়টাও আমাকে লজ্জা দেয়। তিনি আপাতত মাথাটা একটু নুইয়ে কিছু একটা বলতে চাইলেন,

‘বেই…উম.. ধুর…’
ফের আওড়ালেন, ‘আবার সালাম দিব? কী ডাকবো? নিশুর বোন নাকি আদর?’
আমি বেশ সাহস নিয়েই বিড়বিড় করে বলে ফেললাম, ‘আপ– আপনাকে পরিবর্তন হতে হবে না। যেমন আছেন তেমনি ভালো।’
তাশরিক ভাইয়া হঠাৎ কেমন দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি আর তাকানোর, দাঁড়ানোর সাহস করলাম না। তার হতভম্ব হওয়ার সুযোগে ছুটে মায়ের পাশে চলে এলাম। জড়িয়ে ধরলাম তার হাত। মা পাশ ফিরে হেসে আমার মাথাটা বুলিয়ে ফের আন্টি, মামিদের সাথে আলাপে ব্যস্ত হয়েই হাঁটছেন। কিছুক্ষণ বাদই তাশরিক ভাইয়াকে দেখা গেলো। তিনি আংকেল, বাবা, ভাইয়ার পাশে হাঁটছেন ঠিক তাকাচ্ছেন এদিকেই। আমি ওই দৃষ্টি এড়িয়ে বেড়ালাম। শপিং শেষে আমরা এসকেলেটরে চড়লাম। তিন তলায় যাবো। জুয়েলারি শপে।

স্বর্ণ কিনবেন নতুন বউয়ের জন্য। সেখানেই ঘণ্টাখানেক সময় পেরিয়ে যায়। আংকেল আমাকে একটা সুন্দর আংটি গিফট করেন জোরাজুরি করে। ভাইয়া আর বাবার আপত্তি না দেখে অবশেষে নিয়েছি। আংটিটা আমার আঙুলেই আছে। শপিং শেষে আমরা সবাই রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করেছি। আমাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্নেমে এসেছে। এরমধ্যে তাশরিক ভাইয়া বেশ চেষ্টা করেছেন আমাকে একা পাবার। কিন্তু আমি সুযোগ দিইনি। বলতে লজ্জা লাগলেও, আমি তার সাথে এক থাকতে নার্ভাস অনুভব করছিলাম। ভীষণ ভাবে লজ্জা লাগছিলো। বাড়িতে প্রবেশ করে অবশ্য কেমন অনুশোচনাও হলো। কী বলতেন!

নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চাইছিলেন? আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছিলো। কাপড়চোপড় বদলে যখন বিছানায় বসলাম সুফিয়া দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলো। ওর হাতে আমার ফোন। ফোনটা চোখের সামনে ধরে মিটিমিটি হাসছে। চোখ টিপছে। তাশরিক ভাইয়ার নাম্বার ভাসছে। আমি দ্রুতো ফোনটা কেড়ে নিলাম। ওদের সরিয়ে সোজা বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দা্র দরজা লাগাতেই পুরো অন্ধকার হয়ে গেলো।নার্ভাস হলাম। কল রিসিভ করলাম শেষপর্যায়ে। ফোন কানে তুলতেই শ্বাস গলায় রোধ হয়ে এলো। ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনো শব্দই এলো না শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্বনি ছাড়া। আমিও একটা টু-শব্দ করতে পারলাম না। এবেলায় তিনি মুখ খোলেন। ফোনে তার কণ্ঠ আরেকটু গম্ভীর শোনায়। কেমন হাস্কি ধাঁচের।

‘তখন যা বলেছো ভেবে বলেছো তো?’
আমি ঘাবড়ে গেলাম। ইতস্তত করেই মাথা দুলিয়ে নাকমুখে শব্দ তুললাম, ‘হুম।’
‘মাই সুইটেস্ট লিটল আদর, তুমি আমায়…এই তাশরিক খানকে সামাল দিতে পারবে তো? হুম? ক্যান ইউ?’
তিনি থামলেন। লম্বা শ্বাস নিয়ে ফের আওড়ালেন,
‘আমাকে আমার মতন চলতে দিলে কিন্তু তোমার জন্য সর্বনাশ, বেবিগার্ল। চুজ ওয়াইজলি। পরে যদি আবার এড়াতে চাও, আমি কিন্তু আর ভদ্র থাকবো না। কিছু একটা করে ফেলবো।’
আমি কাঁপলাম। কাঁপল আমার সত্তা। চোখ বুজে রাখলাম শক্ত করে। তাশরিক ভাইয়ার মনে হয় অনেক বাড়তি সময়। তিনি আমাকে তাড়া দিলেন না। চুপচাপ অপেক্ষা করলেন। আমি নিজেকে শান্ত করে নিলেও আমার কণ্ঠ কাঁপল,

‘কী- কী আর করবেন? ওইতো বিভিন্ন নামে ডাকবেন তাইতো!’
তাশরিক ভাইয়া হাসলেন। সেই কণ্ঠে আমি আরও মিইয়ে গেলাম।
‘So naive. Why don’t you come down, Babydoll? I’ll give you a live example.’
আমি চমকে তাকালাম নিচে। অন্ধকারে জ্বলে উঠল গাড়ির লাইট। তাশরিক ভাইয়ার গাড়ি বাড়ির বাইরে। তিনি দাঁড়িয়ে আছে গাড়িতে হেলান দিয়ে। তার কানে ফোন। হাতটা তুলে ইশারা করলেন। আমি আতঙ্কে প্রায় বেকুব হয়ে আছি। পাগলেও নিজের ভালো বোঝে। আর আমি বুঝবো না? জীবনেও নামবো না। আমি এক দৌড়ে বারান্দা থেকে চলে এলাম। ফোনে বিড়বিড় করলাম,

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১১

‘আ- আমি আমার তখনকাকথাগুলো ফিরিয়ে নিচ্ছি।’
তাশরিক ভাইয়া শব্দ করে হাসছেন। হাসি থামিয়েদৃঢ়ভাবে বললেন,
‘তা আর সম্ভব না।’

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৩