মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৩

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৩
নাবিলা ইষ্ক

আমি ভেবেছিলাম তাশরিক ভাইয়া আমাকে একপ্রকার জোর করবেন নামার জন্য। আসলে ভাববো নাইবা কেন? উনাকে ওমনই লাগে। যে সবকিছু নিজের মন মর্জি মোতাবেক করিয়ে ছাড়েন। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই করলেন না। কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন। আমি পর্দার আড়ালে দেখালাম তার গাড়িটা হাইস্পিডে চলে যাচ্ছে। ফোন স্ক্রিনে তার মিনিট খানেক আগের করা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটা ভেসে আছে। লিখেছিলেন –
‘Why were you so scared, like a little rabbit? I didn’t mean to bite you. Not yet.’
মেসেজটা পড়ে লজ্জা পেয়েছিলাম। তখন ওমনভাবে বললেন দেখেইতো আমি উদ্ভট কিছু ভেবে বসেছিলাম। অন্ধকার বারান্দায় এসে ছোটো করে জবাবে লিখলাম –

‘ভয় পাইনি।’
মেসেজের জবাব তখুনি আশা করিনি। কারণ আমি জানি, তিনি ড্রাইভ করছেন। মাত্রই তো রওনা হলেন। কিন্তু মুহূর্তে জবাব এসেছে। মেসেজে নয়, ভয়েজে। খুব ছোটো করে জিজ্ঞেস করেছেন –
‘Ummm, Do you want me to come back then? Hmm?’
বাক্যটুকু আমার কাছে অনেকটা ধমকির মতনই মনে হলো। উনার বলবার ধরনটাই যে ওমন। কেমন রাশভারী কণ্ঠে বললেন। কিছুটা অপ্রস্তুত, লাজুক আমি আলাদাভাবে লুকিয়ে এমন রাত করে একলা তার সাথে দেখার করার মতো সাহস যুগিয়ে উঠতে পারবো না। আমার সময় লাগবে, সম্ভবত তিনিও আমায় ততটুকু সময় দেবেন। তার আজকের কাণ্ডই আমাকে সেই ভরসা যুগিয়েছে। আনমনাই হেসে প্রত্যুত্তরে লিখলাম –

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘উহুঁম, দেখেশুনে ড্রাইভ করুন।’
বারান্দা থেকে ঘরে প্রবেশ করে চোখ গেল টি-টেবিলে। তাশরিক ভাইয়ার দেয়া ফুলের তোড়া গুলো একসাথে সাজানো। আমাকে বোধহয় কোনো এক ভূতে ধরল তখুনি। আমি আশ্চর্যজনক কাজ করে বসলাম। খুব সুন্দরভাবে ফুলের তোড়া গুলোর একত্রে ছবি তুলে আমার ফেইসবুকে পোস্ট করে ফেললাম। অবশ্য কোনো ক্যাপশন দিইনি। শুধু ছবিগুলো। এতেই যেন ঝামেলাটা হলো। আমার সব কাজিনরা এসে হামলা করল কমেন্টে। সবাই সারিবদ্ধ ভাবে লিখে গেছে। যেমন,
Sufiya molla – ‘Tashrik dulabhai, jindabaad.’
Rumi molla putul – ‘Tashrik dulabhai, jindabaad. (2)’
Robin Molla – ‘Tashrik dulabhai, jindabaad. (3)’

এভাবে রীতিমতো মন্তব্য দিয়ে ভরে গেলো। আমার দারুণরকমের অনুশোচনা হলো। ইশ, কেনো যে আবেগে ভেসে আপলোড করলাম। এখন তো সবাই আমাকে এভাবেই জ্বালাবে। যখনই ভাবলাম আর আমার গায়ে লাগছে না, লজ্জা পাচ্ছি না…ওমন সময় আরেকটি নতুন মন্তব্য যোগ হলো –
Toufik Molla – ‘তাশরিক আমাদের সুইট বয়।’
বাবা! ফোন সহ আমি মুখ ঢেকে বসলাম। কী কারণে আপলোড করতে গেলাম? কোন দুঃখে? এখন ডিলিট করলে কী খারাপ দেখাবে? কিন্তু কেনো যেন ইচ্ছে করছে না ডিলিট করতে। অথচ আমার লজ্জা করছে। তবে ভাগিস, তাশরিক ভাইয়া আমার সাথে অ্যাড নেই। নাহলে তো আরও লজ্জা পেতাম। মুখই বোধহয় দেখাতে পারতাম না। সবগুলো যা শুরু করেছে কমেন্টে। সবাই একসাথে লিভিংরুমে বসে এমন করছে নিশ্চয়ই! আমি দুয়ারে গিয়ে একটু উঁকিঝুকি মার লাম। ঠিক ধরেছি, সবাই হিহি করে হাসছে। আমার মজা নিচ্ছে! ঘরে ফিরে এসে বিছানায় বসলাম। ফোনটা সুদূরে রাখলাম। আর দেখবোই না।

সে-রাত আমাকে নিয়ে কাজিনদের মজার শেষ নেই। এমনকি আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও চলল। পরদিন ফের আমাদের সারাদিন মলে মলে দিন পেরিয়েছে। আগামীকাল ভাইয়ার বিয়ে। বেশ ব্যস্ততা। বাড়িতে ভাইয়ার সেই বান্ধবী নামক মেকআপ আর্টিস্টই আসবেন। তার সাজানোর হাতটা দারুণ।
রাতে সবাই নিজেদের ড্রেস, অর্নামেন্টস গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত হলো। বিয়েতে কোনো ড্রেস কোড রাখা হয়নি। পছন্দ মতন। তবে, অহনা আপু সেহেতু লাল টকটকে জামদানী শাড়ি পরবেন। তাই আমরা অন্য রঙের অল্প কাজের লেহেঙ্গা পছন্দ করেছি। যেমন আমার লেহেঙ্গার রং এমেরাল্ড গ্রীন। আমি এটার সাথে তাশরিক ভাইয়ার দেয়া ওই নেকলেস সেটটাই পরবো। যখন বের করলাম, সুফিয়া, রুমি আপু হুড়মুড়িয়ে কাছে এসে জ্বলজ্বল চোখে নেকলেসের সেটটা দেখলেন। সুফিয়া মুগ্ধ গলায় বলল,

‘কীরে কবে কিনলি? দেখালি না তো।’
আমি মিনমিনে গলায় বললাম, ‘তাশরিক ভাইয়া দিয়েছিলেন।’
সবাই বড়ো চোখে চেয়ে বড়ো করে শ্বাস টেনে নিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভাণ ধরে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হলো। আমি আপনমনে হাসলাম। আমার আগামীকালের প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে রাখলাম। রাতে একবার তাশরিক ভাইয়া ভয়েজ দিয়েছিলেন। আমি সবার সামনে শুনতে পারিনি। কারণ উনিতো সচরাচর ভদ্র কিছু বলেন না। কীসব বলে বসেন! অন্যের সামনে শোনাও লজ্জার হয়ে দাঁড়াবে। একটু একলা হতেই ভয়েজটুকু শুনে লাল হয়ে এলাম। রীতিমতো গাল জ্বলছিলো। লোকটা এতো দুষ্টু! নাহলে কেউ কী এমন করে বলে?
‘I haven’t seen you for just a day, yet it feels like it’s been years.’
আমি অনেকবার টাইপিং করতে গিয়েও এমন একটা ভয়েজের জবাব দিতে পারলাম না। কী লিখবো ভেবে ভেবেই রাতটা কেটে গেলো। সকাল থেকে শুরু হলো বিয়ে নামক লড়াই। এতো দৌড়ঝাঁপ, হট্টগোল। বাবা একবার এসে মিষ্টি করে শুধিয়েছেন –

‘মামণি, মাথা ধরেছে? এমন হট্টগোলে তুমিতো অভ্যস্ত নও।’
বাবা ভুল বলেননি। আমি আসলেও অতিরিক্ত হট্টগোলপছন্দ কোনোকালে করিনি। তবে আমার ভাইয়ের বিয়ে তো রোজ হবে না তাই না? জীবনে একবার। আমার শত কষ্ট হলেও আম উপভোগ, আনন্দ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবো। মাথা ব্যথাটা কমাতে নাজু বুয়াকে এক মগ কফি বানিয়ে দিতে বললাম। তিনি কফিটা বানিয়ে দিয়ে গেলেন। কফি খেতে খেতেই দেখলাম ঘড়ির কাঁটা একটায় এসে ছোঁবে প্রায়। আজকের দিনটা কেমন উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। আমার কেমন একটা অনুভব হচ্ছে। আমার ভাইয়ার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! অবশ্য তিনি চলে যাবেন না, বউ নিয়ে বাড়িই আসবেন। তাও কেনো যেনো বেশ আবেগী হয়ে উঠছিলাম। তখুনি দেখলাম ভাইয়া ঢুকছেন মাথা ধরে। সম্ভবত তার মাথা ব্যথা করছে। প্রবেশ করেই ডাকলেন,

‘আদর!’
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম দ্রুতো। ‘জি, জি ভাইয়া।’
‘ফোন কোথায়? ঘরে? গিয়ে একটু চেইক কর।’
আমি মাথা দুলিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলাম। ফোনটা খুঁজে পেলাম টেবিলের ওপর। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসে আছে অহনা আপুর। লিখেছেন –
‘Tor bhaiyake ami biye korbo na. Biyeta cancel.’
আমি চোখ বড়ো করে চাইতেই দেখলাম ভাইয়া এসেছেন আমার পেছনে। অসহায় গলায় বললেন – ‘ওর সাথে একটু কথা বল। আমার কল রিসিভ করছে না।’
আমি আশ্চর্য হয়ে আছি একপ্রকার। ‘হয়েছে কী? আপু এসময়ে এমন বলছেন কেনো?’
নিশু ভাইয়া কপাল ডলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন –
‘সাধারণ ব্যাপার। একটু কথা বল, ঠিক হয়ে যাবে।’

ভাইয়া চলে গেলেন। আমি দ্রুতো আপুকে কল করলাম। প্রেসার হাই। এমন সময়ে যদি ঝামেলা হয়? আল্লাহ! কলটা সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে অহনা আপু শুধালেন,
‘তোর গুণধর ভাই কী আছে না গেছে?’
আমি তখন উতলা, ‘চলে গেছে। কী হয়েছে আপু?’
অহনা আপু নাক সিঁটকালেন, ‘কী আর হবে বল? সবই আমার পোড়া কপালের দোষ। আনরোমান্টিক একটা সেধেপড়ে ঘাড়ে তুললাম। তোর মতন এমন মিষ্টি ননদ না পেলে আসলেই বিয়েটা ক্যান্সেল করতাম। এমন এক আস্তো জলদস্যু বিয়ে করতে আমার ঠেকা পড়েছে!’

আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলে আপুকে অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা বলিয়ে বোঝালাম। ততক্ষণে তাকে সাজাতে মেকাআপ আর্টিস্ট চলে এসেছেন। আমি তাকে সাজতে বলে কল কাটলাম। সুফিয়া লেহেঙ্গা পরে ঘরজুড়ে ঘুরছিলো। ইতোমধ্যে আমাদের মেকআপ আর্টিস্টরাও চলে এসেছেন। সুফিয়া গেস্টরুমে ছুটে গেলো। আমি গোসলে ঢুকলাম। সবার পরে সাজতে বসবো বলে তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে তৈরি হয়েছি। আমি পুরো তৈরি হতে হতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা গড়ালো। তখনো গাড়ি সাজানো হচ্ছে। মোট আটটা গাড়ি বেরুবে। ভাইয়ার সাদা গাড়িটা খুব সাধারণ ভাবে, শুধু সামনে কিছু ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ভাইয়া এযাত্রায় তৈরি হয়ে নামলেন। শেরওয়ানি পরেছেন। পাগড়িটা হাতে। মা তাকে দেখে আবেগী হয়ে উঠলেন। বাবা কাধ ধরে মুগ্ধ গলায় বললেন –

‘সুদর্শন লাগছে। তাহলে চলো, যাওয়া যাক। আরেকটা মেয়ে নিয়ে আসি বাড়িতে।’
সবাই একসাথে হাসছে। গাড়িতে গান বাজছে। ভাইয়া আজও ড্রাইভ করছে। আমি পাশে। পেছনে আমার সব কাজিনরা। চিৎকার করে গান গাইছে। সাথে আমিও আওড়াচ্ছিলাম –
Mehndi laga ke rakhna
Doli saja ke rakhna
Lene tujhe o gori
Aayenge tere sajna
Mehndi laga ke rakhna
Doli saja ke rakhna
Oh.. ho.. oh.. ho..

আমরা পৌঁছে আংকেল, আংকেলদের গোষ্ঠীর অনেককেই পেলাম। সবাই আপ্যায়নের জন্য দাঁড়িয়েই ছিলেন। ভাইয়া নামতেই হৈচৈ পড়ে গেল পুরোদমে। অহনা আপুর কাজিনরা একসাথে বাঁধা দিয়ে দাঁড়িয়েছে। দুষ্টুমি করছিলো। আমাদের থেকে পাল্টা জবাব দিচ্ছিলো কাজিনরা। কনেদের থেকে অজানা একজন হঠাৎ করে বলল –
‘দুলেরাজার ছোটোবোন কিছু বলে না ক্যা? আমাদের ভালো লাগে নাই?
আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালাম। একটা ছেলে। আমার চেয়ে হয়তোবা দু-এক বছরের বড়ো হবেন। আমি কিছু বলবো পূর্বেই পেছন থেকে তাশরিক ভাইয়া এসে ছেলেটার ঘাড় ধরে প্রায় উঁচু করার মতন অবস্থায় এনে জোরপূর্বক হেসে বললেন –

‘না। লাগে নাই। ওর শুধু আমাকে দেখলে ভালো লাগে। ফট!’
বাবা আর আংকেল হাসছেন। সুফিয়া শিশ বাজালো জোরসে। তাশরিক ভাইয়ার হাতে ফুলের তোড়া। গোলাপি রঙের ফুল। কী নাম আমি জানি না! তবে ভীষণ সুন্দর! এমন ব্যস্ততার মধ্যেও উনার ফুল আনা লাগবে? সবাইকে তিনক হাতের ইশারায় সরিয়ে দিলেন-
‘ধুউর, এমন গোরুর মতো সবগুলো ঝামেলা করছিস কেনো? ভেতরে যা, ভাগ।’

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১২

তিনি সবাইকে সরাতেই আমাদের বরযাত্রী ঢুকতে পারলো। আমি মাথা নুইয়ে হাসছিলাম। উনি শুভ্র রঙা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আছেন। সুদর্শন দেখাচ্ছে বেশ। এযাত্রায় খেয়াল করলাম কীভাবে যেন সবাইকে সরিয়ে আমার পাশে চলে এসেছেনফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে ধরেছেন। মাথা নুইয়ে আমার মুখের দিকে আরও কাছ থেকে চাইতে চেয়ে বললেন,
‘বেয়াইন, আপনাকে দেখে তো আমার হার্টবিট চারশো চার ডিগ্রিতে ইউ টার্ন নিচ্ছে। সো পেইনফুল।’
বাকিটা বিড়বিড় করলেন – ‘Won’t you take responsibility? hm?’

মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ১৪