মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ৫
নাবিলা ইষ্ক
হাঁটুতে যে কম্পনটা ধরল তাতে মনে হলো আমি হাঁটু ভেঙে বসে পড়বো সিঁড়িতেই, তার পায়ের সামনেই। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তা হলো না। মস্তিষ্ক কাজ করার আগে আমার পা-জোড়া কাজ করে বসল। আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে, আশেপাশে না তাকিয়ে —অন্ধের মতন তাকে পাশ কাটিয়ে ছুটলাম। পেছনে তাশরিক ভাইয়া তখনো মিহি কণ্ঠে হাসছেন। ওই হাসির শব্দে যেন আমার অস্থিরতা বাড়ল। আমি নিচে চলে এলাম এক দৌড়ে। ভাগ্যিস অপ্রস্তুত আমাকে কেউ লক্ষ্য করেনি। লিভিংরুমে সবাই তখনো আলোচনায় মহা ব্যস্ত। মা আর আন্টি হাসছিলেন কিছু একটা নিয়ে। আমার শ্বাসপ্রশ্বাস তখনো রুদ্ধ। ধড়ফড় করছিলো হৃৎপিণ্ড। হাত-পা কাঁপছিলো সমানে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। কোনোভাবে পারছিলাম না। ধীর কদমে গিয়ে বসলাম মায়ের পাশে। মা তাকালেন আমার শুকনো মুখের দিকে। ভ্রু দুটো কুঁচকে হাতটা বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেন কপাল,
‘মুখটা এমন লাল হয়ে আছে কেনো? ঘেমেও তো একাকার হয়ে আছিস। আর ছোটাছুটি করিস না।’
প্রত্যুত্তরে আমি দুর্বল হেসে মাথা দোলালাম। আন্টি আমার দিকে এক প্লেট ফ্রুটস বাড়িয়ে ধরলেন। আমি হেসে নিলাম। ভদ্রতার খাতিরে এক পিস আপেল কোনোরকমে গলা দিয়ে নামিয়েছি। আর খাওয়া সম্ভব হয়নি। বারবার কানে বাজছিলো তার বলা কথাগুলো।
‘I’m chasing you.’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমি মাথা নাড়ালাম ক্রমাগত। এই ভাবনাগুলো সরাতে চাইলাম। আড়চোখে একটিবার তাকালাম সিঁড়ির দিকে। তাশরিক ভাইয়া আসেননি। যাক! আমি এযাত্রায় গলায় গুটিয়ে রাখা এক স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। এই বাড়ি থেকে বেরুনোর আগ পর্যন্ত আমি আর বসা থেকে উঠিনি। সাহস হয়নি, জোর পাইনি। আমাদের বেরুতে বেরুতে রাতের দশটা। একপর্যায়ে আমি ফুলের তোড়ার কথা ভুলেই বসেছিলাম। গাড়িতে উঠে বসতেই অহনা আপুর বান্ধবী প্রিয়াঙ্কা আপু ফুলের তোড়া হাতে ছুটে এলেন। আপু কেমন দুষ্টুমি ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসছিলেন। আমার হঠাৎই বেশ লজ্জা লাগল। আমার পাশের জানালার কাঁচটা নামানো ছিলো। তিনি হেসে ফুলের তোড়া আমার হাতে ধরিয়ে বললেন,
‘আবার দেখা হবে আমাদের। সাবধানে যেও।’
আমি হেসে মাথা দোলালাম। বললাম, ‘ভালো থাকবেন আপু।’
প্রিয়াঙ্কা আপু চলে গেলেন। আমাদের গাড়িটা তখনো ছাড়েনি। ভাইয়া কথা বলছিলেন তাশরিক ভাইয়ার বাবার সাথে। ইতোমধ্যে আমাদের পেছনের দুটো গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে। আমি আনমনাই দোতলার দিকে চাইলাম। স্তব্ধ হলাম। কুণ্ঠিতবোধ করলাম। তাশরিক ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। সেই বিকেলে যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেভাবেই। দাম্ভিক ভাবে। সম্ভবত এদিকেই চেয়ে আছেন। আমার অনুমান ভুল নয়, তিনি চেয়েই ছিলেন। আমি আচমকা ফুলের তোড়া হাতে সিট ছেড়ে নিচে বসে পড়লাম গুটিশুটি মেরে। লুকিয়ে নিজেই আশ্চর্য হলাম। আপনমনে নিজেকে বকলামও নিজের বোকামির জন্য। কেমন দেখালো? ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে এসে বসেছেন। আমাকে এভাবে গুঁজো মেরে বসে থাকতে দেখে হেসে ফেললেন,
‘এমন করে আছিস কেনো?’
আমি বানিয়ে চটপট একটা মিথ্যে বলে বসলাম, ‘আমার আংটিটা পড়ে গেছে।’
ভাইয়া আর প্রশ্ন করলেন না। গাড়ি স্টার্ট করেছেন। গাড়িটা ধীরেসুস্থে খান বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে বসলাম সিটে। চোখ বুজে সিটে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। আমি ওখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় দমবন্ধ হয়ে, না-হয় হৃৎপিণ্ডের তাড়নায় ম রেই যেতাম। এতো বাজেভাবে সারাটা সময় হৃৎপিণ্ড কাঁপছিলো। অথচ কাঁপার আহামরি কোনো কারণ ছিলো না। আসলেই কী ছিলো না? নিজ মনই প্রশ্ন করলাম। পুনরায় ভাসল ওই লোকটার বাঁকা হাসতে থাকা, দুষ্টুমি করে বলতে থাকা মুখটা। ইশ! বদমায়েশ ব্যাটাছেলে। আমার চেয়ে কতো বড়ো! এমন ছোটো একটা মেয়েকে পটাতে চাইতে লজ্জা করল না? তারই তো বন্ধুর আদরের ছোটোবোন আমি। সেই হিসেবে তারও তো বোন হই নাকি? পরেই মনে পড়ল আমার ভাইয়া নিজেই বন্ধুর ছোটো বোনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। আশ্চর্য! আমি অসহায় চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া কী বুঝলেন কে জানে! এক হাতে হুইল ধরে অন্যহাতে আমার মাথাটা বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ক্লান্ত লাগছে? চোখ বুজে থাক।’
ভাইয়ার কথামতো চোখ বুজলাম। চোখ বুজে থাকতে থাকতে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভাইয়ার ডাকে অস্পষ্ট ভাবে চোখ মেলে তাকালাম। আমরা পৌঁছে গেছি। আমি নামলাম ফুলের তোড়াটা দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। হঠাৎ ভাইয়া ডাকলেন,
‘আদর, একটু দাঁড়া।’
আমি ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়ালাম। ভাইয়া ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এলেন। পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে আলোর দিকটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ওখানে গিয়ে দাঁড়া। দুটো ছবি তুলে দিই ফ্লাওয়ার বুকে হাতে।’
আমার ঘুমটা ছুটে গেল। ড্যাবড্যাব চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বুঝলাম না কিছুই। হঠাৎ ছবি তুলতে হবে কেনো? তাও এমন রাত করে। বিপরীতে ভাইয়া তাড়া দিলেন ব্যস্ত গলায়,
‘কীরে? যা দাঁড়া। সুন্দর লাগছে।’
আমি বাধ্য মেয়ের মতন গিয়ে দাঁড়ালাম বাগিচার বেশ কাছে, সাদা বাল্বের নিচে। ভাইয়া কয়েকটা ছবি তুললেন। ছবি তোলা শেষ করে বললেন,
‘যা ভেতরে।’
আমি ফুলের তোড়া হাতে বাড়ির ভেতরে চলে এলাম। ভেবেছিলাম ভাইয়া গাড়ি পার্ক করে ফিরবেন। অথচ শুনতে পেলাম তিনি বেরিয়ে যাচ্ছেন এই রাতবিরেত। এদিকে ফুপু আর চাচা ব্যতীত লিভিংরুমে কেউ নেই। আমি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলাম। আমার ঘরে ইতোমধ্যে সুফিয়া, রুমি আপু ওরা শুয়ে ফোন টিপছিলো। আমাকে দেখেই সবাই একসাথে ফোন রেখে উঠে বসলো। আমি এতোগুলোর দৃষ্টির সামনে মিইয়ে গেলাম। সুফিয়া আমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসালো। আমি সংকোচ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কী হয়েছে?’
রুমি আপু আমার চোখে চোখ রেখে চোখ রাঙালেন। আমার গাল দুটোতে আঙুল ডুবিয়ে মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘আমাদের আপনাকে আর ওই রহস্যময় তাশরিক খানকে নিয়ে সন্দেহ আছে। বুঝেছেন?’
আমি আমার নরমসরম গাল দুটো ছাড়িয়ে দ্রুতো উঠে দাঁড়ালাম। ফুলের তোড়াটা টি-গ্লাসের ওপর কোনোরকমে রেখে ওয়াশরুম ঢুকে পড়লাম। পেছনে সুফিয়া আমাকে ধমকালো। দাঁড়ানোর জন্য গর্জন ফেললো। কে শোনে কার কথা! আমি তখনো ভ্রমে আছি। হঠাৎ করে কেনো এমন করছেন তাশরিক ভাইয়া? কানের কাছে তার বলা একেকটা বাক্য প্রতিধ্বনি তুলছে বার বার করে। না চাইতেও আমার চোখমুখ উষ্ণ হয়ে উঠছে। ভেতরটা ধড়ফড় করে যাচ্ছে। কী যে অশান্তি লাগছে! আমি আমার এতটুকু জীবনে এমন অনুভব করিনি। এতোটা উদ্বিগ্ন হইনি। কাউকে নিয়ে এতটা ভাবিনি। আমার ছোটো দুনিয়া। এই দুনিয়াতে বাবা, মা, ভাইয়া ব্যতীত কেউ ছিলো না। আমার সব ভাবনা ছিলো তাদের নিয়েই। অথচ হঠাৎ করে কেউ একজন জোরপূর্বক আমার দুনিয়ায় ঢুকতে ব্যাকুল। আমার দুনিয়া এলোমেলো করে দিতে তৈরি। এবেলায় দরজায় টোকা পড়ল। সুফিয়া চ্যাঁচামেচি করছে,
‘ঢুকে বসে থাকিস না, আদর। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয়।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ওদের থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ বিষয় নয়। রাত ভরে আমাকে জ্বালাবে। প্রধান দোষী কে এসবের পেছনে? যেই মানুষটা মেইন কালপ্রিট সে তো দিব্যি ঝামেলা মুক্ত। এখন আমার মতন অসহায় একজনকে এরা পেয়ে বসেছে। র ক্ত চুষে খাবে রীতিমতো। কাপড়চোপড় বদলে, হাতমুখ ধুয়ে বেরুতেই সুফিয়া আমাকে টেনে নিয়ে ফের বিছানার ওপরে বসালো। ওরা সবাই মিলে ঘিরে বসল আমাকে। মণি আপু জিজ্ঞেস করলেন গুরুতর গলায়,
‘উনি কি তোকে পছন্দ করেন?’
আমি চোখ নামালাম। মিনমিন করে বললাম, ‘আমি কীভাবে জানবো?’
সুফিয়া, মণি আপু, রুমি আপু, আইরিন আপু মিলেমিশে আমাকে আপদমস্তক দেখে নিজেরা আলাপে বসলেন। এমন রহস্যময়ী বিষয়ে তাদের নাকি একটা বিহিত করতেই হবে। এই সম্পর্কে তারা পুরোপুরি জেনেই তবে দম ফেলবেন বলে ঘোষণা দিলেন। আমি এতে বেশ ভীত হলাম। আমিতো তাদের সব সত্য বলিনি। উদ্ভট সব চিন্তাভাবনা নিয়ে আমি ঘুমুতে পারলাম না সে রাত। এইজন্য সকাল সকাল ঘুমও ভাঙতে চাচ্ছিলো না। ভাইয়া্র যখন ডাক পড়লো তখনো ঘুম পুরোপুরি কাটেনি আমার। ঘড়ির কাঁটা নয়টা উনিশে ঘুরছিলো। আমি উঠে ওয়াশরুম গেলাম। দাঁত মেজে, হাতমুখ ধুয়ে নিচে নেমে এলাম। ডাইনিং টেবিলে ইতোমধ্যে সবাই নাস্তা খেতে বসেছে। আমি দুর্বল শরীরে বাবার পাশের চেয়ার টেনে বসলাম। স্যান্ডউইচ সবেমাত্র এক কামড় খেয়েছিলাম ওসময়ে বড়ো চাচা শুধোলেন,
‘রাতে বুঝি ভালো ঘুম হয়নি, আমার চাচ্চুর? চোখ দুটো এমন লাল হয়ে আছে কেনো?’
বড়ো চাচার প্রশ্নে বাবাও তাকালেন আমার মুখের দিকে। রক্তিম চোখ দুটো দেখে চিন্তিত হলেন। কিছু বলবেন এর আগে ভাইয়া বলে ফেললেন, ‘রুম শেয়ার করেছিস বলে কী ঘুম হয়নি? আমার রুম খালি করে দেবো?’
মুখের মধ্যে থাকা এক কামড় স্যান্ডউইচ দ্রুতো গিলে আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম, ‘কীসব বলছো, ভাইয়া! ওমন কিছু না। আপুদের সাথে রুম শেয়ার করে আমি আনন্দ পাই উল্টো। গতকাল মাথাটা ব্যথা করছিলো বলে বেশ রাত করে ঘুমিয়েছিলাম।’
ভাইয়া আর কিছু বললেন না। দুটো ডিমপোজ একসাথে কাটাচামচে তুলে একেবারে মুখে পুরে ফেললেন। এমন দৃশ্য সহস্রবার দেখলেও আমি মনে মনে আশ্চর্য হই। ভাইয়ার ওটা মুখ নাকি ছোটোখাটো গহব্বর? বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মিহি গলায় বললেন,
‘শপিং-য়ে যাবে কীভাবে তাহলে? আজ শপিং করতে যাওয়ার কথা ছিলো তো। এংগেজমেন্টের জন্য অনেক কেনাকাটা করার আছে।’
আমি বলতে চাইলাম, আমি আজ যাবো না তাহলে। অথচ মুখের কথাগুলো বলতে পারিনি পূর্বে মা বললেন, ‘শপিং থেকে এসে আরাম করে ঘুমোবে। ও না গেলে কীভাবে হবে?’
ভাইয়াও মায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বললেন, ‘তৈরি হয়ে নে। সকাল সকাল বেরুবো। ফিরে ঘুমিয়ে নিস কেমন?’
ভাইয়ার কথার বিপরীতে আমি কখনো দ্বিমত প্রকাশ করেছি নাকি? আজও সম্ভব না। নাস্তা করে নিজের ঘরে এলাম তৈরি হতে। অথচ আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না। ইচ্ছে করছিলো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে। আইরিন আপু আর রুমি আপু তৈরি হতে হতে হট্টগোল করছেন। সুফিয়া ঘুরে ঘুরে ঘড়ির কাঁটা দেখছিলো। প্রায় দশটা যখন বাজল— ও এবারে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলো। দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। ওর ল্যাগেজ নিচ তলায়—ফুপিদের ঘরে। এইপর্যায়ে আমিও গোলাপি রঙের অল্প কাজ করা লিলেনের একটা কামিজ পরে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম।
আমাদের ইতোমধ্যে অনলাইনে পছন্দ করা আছে যা নেবার। এবার শুধু মল গুলো ঘুরে সংগ্রহ করা বাকি। সবাই তৈরি হয়ে একসাথে বেরুলাম। গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের করা হয়েছে। আমি ভাইয়ার গাড়িতে, ভাইয়ার পাশে উঠে বসেছি। পথিমধ্যে অহনা আপুদের গাড়ি আমাদের সাথে যোগ হবে। হলোও তাই। ফ্লাইওভারে পাওয়া গেলো তাদের গাড়ি। তাশরিক ভাইয়া ড্রাইভ করছিলেন। তার পাশে অহনা আপু। আমি পেছন দিকে মাথা এলিয়ে জানালার কাঁচ থেকে দূরে থাকতে চাইলাম। দ্বিতীয় বার ভুলেও তাকালাম না আমার পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে। আমাদের গাড়ি সোজা বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে থামল। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম অহনা আপু মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। আমিও হেসে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম তার হাতটা।
আন্টি, আংকেলও এসেছেন। মা- বাবার সাথে দিব্যি আলাপ জুড়ে দিয়েছেন। আমি চোখের দৃষ্টি সামনে রাখলাম। কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলাম আমার পেছনেই ভাইয়ার সাথে তাশরিক ভাইয়াও আছেন। কথা বলতে বলতে এগুচ্ছেন। আমি অন্যমনস্ক হলাম। শুধু পুতুলের মতন অহনা আপুর সাথে এগিয়ে চললাম। স্টল ঘুরেফিরে যে এতো কেনাকাটা হচ্ছে, কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। মা কয়েকবার ডেকে এটা-ওটা দেখালেন। সুফিয়া একটা সুন্দর গাউন দেখালো। অথচ ওসবে যেন আমার আগ্রহই নেই। শুধু বুঝলাম কিছু একটা আমার ভেতরে হয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে আমাদের ওপরের তলায় যাওয়ার ছিলো। এসকেলেটরে উঠেছিলাম ওই আনমনা হয়েই। জুতার সাথে জুতো লেগে বেশ বিশ্রী ভাবে ব্যথা পেলাম। হাড় বোধহয় বাঁকা হয়ে গেছে। পায়ের পাতা নাড়ানো সম্ভব হচ্ছিলো না। পা ছিলেও গিয়েছে কিছুটা। তখন সবার আমাকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল। ভাইয়া এসে ধরলেন আমাকে। এখুনি আমাকে নিয়ে যাবেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে, পার্কিং লটে। গাড়িতে নিয়ে বসাবেন। তাশরিক ভাইয়া আমার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবারে বললেন,
‘অহনার এংগেজমেন্ট গাউন এখনো কেনা হয়নি। তুই যা সবার সাথে—আমি আদরকে নিয়ে পার্কিং লটে যাচ্ছি।’
আমার হৃৎপিণ্ডের ধড়ফড়িয়ে উঠল। দ্রুতো বলতে চাইলাম, আমি যাবো না। কিন্তু তা আর বলাই হলো না। বাবা বেশ চিন্তিত হয়েও স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
‘তাহলে তাশরিকের সাথে যাও, মামণি। গাড়িতে বসে পা-টাকে রেস্টে দাও। আমরা একটুপরই ফিরছি, কেমন?’
আমি অসহায় চোখে তাকালাম। কিন্তু কেউ কী বুঝলো আমার অসহায়তা? বুঝলো না। আমি যে ভেতরে চিৎকার করছি, কেউ শুনলোও না। রীতিমতো ব্যথা ভুলে আমি হাঁসফাঁস করছিলাম এই লোকের সান্নিধ্যে যাবো বলে। তাশরিক ভাইয়া বেশ সাবলীলভাবে নিজের হাতের তালু তুলে ধরলেন আমার জন্য। আমি কোনোভাবেই ওই তালুতে হাত রাখতে পারছিলাম না। অন্যদিকে ব্যথা যেন বাড়ছে সেকেন্ডের ভেতরে। নীল হয়ে যাচ্ছিলাম ব্যথার যন্ত্রণায়। একপর্যায়ে হালকা করে ধরলাম তার কালো শার্টের হাতার একটুখানি অংশ।
বাম পা-টা ফেলাই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। আমি তারপরও দাঁতে দাঁত পিষে এগুচ্ছিলাম। মোটেও তাকে ধরছিলাম না। ভর ফেলছিলাম না। অনেকটা দূরেই চলে এসেছি। পরিবারের দৃষ্টির বাইরে। এসকেলেটর দিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতে গিয়ে এবারে ভয়ই পেলাম। আবার না যেন ভাঙা পা নিয়ে পড়ি। হঠাৎ করে আমার দুনিয়া উল্টে গেলো। কিছু বুঝে উঠবার আগেই নিজেকে শূন্যে পেলাম। ভয়ে চ্যাঁচিয়ে উঠলাম। তাশরিক ভাইয়া আমাকে পাজাকোলে তুলে নিয়েছেন। এতটুকু মগজে ঢুকতেই— আমার পুরো শরীর বরফের মতন জমে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাস ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হলো। হৃৎপিণ্ড দাপিয়ে চলল দ্রুতো গতিতে। আমি ভাষাই হারিয়ে ফেললাম তার এমন কীর্তিকলাপে, তাও আবার এতো মানুষের মধ্যে। মলে! লজ্জায় আমার মস্তিষ্ক কাজ করাই বন্ধ করে দিলো প্রায়। দু’হাতে চোখমুখ ঢেকে দ্রুতো বললাম,
‘না-নামান আমাকে। আপনি কী—কীভাবে পারেন এমন করতে? এগুলো কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না। আমি–আমি ভাই….’
আমার কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। তাশরিক ভাইয়া হাসলেন। শব্দ করে। তার বুকের কাছে থাকা আমি তার বুকের কম্পন অনুভব করে আরও মিইয়ে গেলাম। তিনি বেশ সাবলীলভাবে হাঁটছেন। আমার কানের কাছটায় উষ্ণ নিশ্বাস পড়ল। সেই উষ্ণ নিশ্বাসে আমি শিউরে উঠি। মাথাটা কিঞ্চিত বেঁকিয়ে বসি। তিনি বলেন,
‘My sweetest little pumpkin, How can you be so innocent like a rabbit? hum? You’ve no idea, How I’ve already done everything i could in my power to hold you in my arms this rightfully…..Baby girl.’
মাই লাভ মাই লাইফ পর্ব ৪
ফরফর করে শুধু ইংরেজি বলে। এখানে কী ইংরেজি ক্লাস হচ্ছে? আঙুলের ফাঁক গলিয়ে দেখতে পেলাম এযাত্রায় মাথা সোজা করে সামনে চেয়ে হাঁটছেন। কী বোঝাতে চাইলেন? কীসের ধারণা নেই আমার? কী করেছেন তিনি? আর এসব সম্বোধন কীভাবে করতে পারেন? এতো বড়ো একটা পুরুষ। একটুও লজ্জা নেই, কথাবার্তার লাগাম নেই।