মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১১
নওরিন কবির তিশা
দেখতে দেখতে কেটে গেছে ৩ দিন।আজ বিকালে খুলনায় ফিরে যাবে নিঝুমরা। তাই সকাল থেকেই নিঝুম মন খারাপ করে বসে আছে শিশিরের রুমে। শিশিরের ও যে মনটা খুব ভালো তাও না । কিন্তু নিঝুমকে এভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে সে বললো,
-এতো মন খারাপ করার কি আছে? আবার তো আসবি। আর কিছুদিন পরেই তোর প্রি-টেস্ট পরিক্ষা। নাহলে আমি তোকে রেখে দিতাম। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি তোর পরিক্ষার পরই আমি তোকে নিজে গিয়ে নিয়ে আসব।তখন নাহয় কিছুদিন আমার কাছে আমার বাসায় থাকিস।
-হুম।
-কি হুম??এখনও মন খারাপ করে থাকবি?
-না আপু। আমি শুধু ভাবতেছি লিনা আপু তোমার সাথে কি করে এরকম করল? ঠিক সময় যদি ভাইয়া না আসতো তাহলে তোমার সাথে কতটা খারাপ হতে পারতো?
শিশির একটু চুপ করে থেকে মৃদু হাসল, যেন কিছুই হয়নি।
-ওটা নিয়ে আর ভাবিস না। দেখছিস তো, কিছুই হয়নি।
-যদি হতো?
– হয়নি তো। আর শোন এই কথাটা কাউকে বলবি না। শুধু
শুধু ঝামেলা হবে।
-ঠিক আছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শিশির মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। সে খুব ভালো করেই জানে ইয়ালিনা কেন এই কাজটি করেছিল। কিন্তু সে চায় না এই ব্যাপারটা জানাজানি হোক আর এই নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক। ইয়ালিনা যে কারণেই কাজটি করে থাকুক না কেন এটা ছিল তার ব্যক্তিগত আক্রোশ। আর শিশির ও তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই শিশির এই নিয়ে কোন ঝামেলা চায় না। যদিও শিশির খুব ভালো করে জানে সেদিন যদি নাহিয়ান ঠিক সময় মত না আসতো তাহলে আজকে তাকে হাসপাতালে বেডে থাকতে হতো।
২ দিন আগে…….
রাত প্রায় বারোটা। পুরো বাড়ি তখন ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছে। কিন্তু শিশিরের চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। পিপাসা পেয়েছে ভীষণ। তাই বেডসাইড টেবিল থেকে গ্লাস তুলে পানি খেতে গিয়েই দেখল, গ্লাস ফাঁকা। পাশে রাখা পানির জগও খালি। কিন্তু ঘুমাতে আসার আগেই সে নিজেই তো সেটা ভর্তি করেছিল!!
অগত্যা সে নিজের রুম থেকে বের হয়ে কিচেনের উদ্দেশ্যে নিচে চাচ্ছিল। অন্ধকার সিঁড়িতে পা রাখতেই মনে হলো, কিছু একটা পিচ্ছিল জিনিসের উপর পা পড়েছে! ভারসাম্য হারিয়ে সে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, তখনই পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ঝাপটে ধরে, উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,,
-ঠিক আছিস তো??কোথাও লাগেনি তো তোর?? কোথায় লেগেছে??দেখা আমায়।
শিশির ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখতে পায়, তার সেই গোমড়ামুখো নাহিন ভাইয়ের মুখে চিন্তার ছাপ। কিন্তু হঠাৎই তার হৃদস্পন্দন কয়েকশ গুণ দ্রুত হয়ে যায়। যখন সে বুঝতে পারে যে, নাহিয়ান তাকে ঝাপটে ধরে আছে। সে দ্রুত নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
-না,না কোথাও লাগে নি। আপনি তো তার আগেই ধরে ফেলেছেন।
নাহিয়ান এবার তার গম্ভীর্য বজায় রেখে শাসনের স্বরে বলে,
-এত রাতে বাইরে কি??
শিশির নাহিয়ানকে এমন মুহূর্তেই গম্ভীর রূপে ফিরে আসতে দেখে মনে মনে বললো,
-গিরগিটিও মনে হয় এত তাড়াতাড়ি রং বদলাতে পারে না, যত দ্রুত এই লোক নিজের মেজাজ পরিবর্তন করতে পারে।
অন্যদিকে শিশির এরকম চুপ হয়ে থাকতে দেখে নাহিয়ান বিরক্তি নিয়ে বলল,
-কি হলো?? কথা বলিস না কেন??
-না আসলে আমার রুমে পানি ছিল না। তাই নিচে নিতে আসছিলাম।
-তো চোখ কি বন্ধ করে হাঁটিস??
নাহিয়ানের এমন কথা শিশিরের মেজাজ গরম হয়ে গেল। সেও কড়া স্বরে বলল,,
-চোখ কেন বন্ধ করে হাঁটতে যাব হ্যাঁ?? এখানে কে তেল ফেলে রেখেছে। তো আমি কি করে জানব??
শিশিরের কথায় নাহিয়ান নিচে তাকিয়ে দেখলো প্রথম সিঁড়ির অনেকটা জায়গা জুড়ে তেল ফেলানো। তখনই পিছন থেকে নিঝুম দৌড়ে এসে শিশিরকে বলল,,
-আপু, তুমি এখানে? আমি তো তোমার রুমে গিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি ছিলে না!
-কি হয়েছে??এত দৌড়াদৌড়ি করতেছিস কেন?? আর এত রাতে আমার কাছে কি??
-না মানে, আজকে রাতে আমি ইয়ালিনা আপুর সাথে শুয়ে ছিলাম তো কিন্তু হঠাৎ দেখে ইয়ালিনা আপু আমার পাশে নেই। তাইতো আমি আপুকে খুঁজছিলাম খুঁজতে খুঁজতে তোমার রুমের সামনে গিয়ে দেখি তোমার রুমের ও দরজা খোলা এজন্য।
নাহিয়ান নিঝুম এর দিকে তাকিয়ে বলল,,
-ইয়ালিনা নিজের রুমে নেই??
-না তো।
নাহিয়ান এবার কোন কথা না বলেই ইয়ালিনার রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। নিঝুম আর শিশিরও তার পিছন পিছন গেল। নাহিয়ান ইয়ালিনার রুমে ঢুকে সোজা ও ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ওর তেলের কন্টেইনারটা হাতে তুলল। সে যা ভেবেছিল ঠিক তাই কন্টেইনারটার অর্ধেকের বেশি তেল শেষ। শিশিরের এবার আর বুঝতে বাকি রইল না যে কাজটি ইয়ালিনাই করেছে। নিঝুম প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে সে সবই বুঝতে পেরেছে।
এসব কিছু মনে করে শিশির শুধু ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল।
রাকিবের সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চেয়ারেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে একটি মেয়ে। রাকিব মেয়েটিকে খু*ন করতে পারেনি। মেয়েটার চোখে মুখে এক অদ্ভুত মায়া আছে। তাইতো যে রাকিব এতদিন এতগুলো খু*ন করেছে কোনদিন তার কোনরকম লাগেনি সেই রাকিবেরই এই মেয়েটাকে খু*ন করতে গিয়ে হাত কেপেছে। এটা কি নিতান্তই মায়া নাকি অন্য কিছু??
রাকিব একদৃষ্টে চেয়ে আছে ঘুমন্ত মেয়েটির পানে। আর এসব ভাবছে। হঠাৎই চোখ পিটপিট করে উঠে মেয়েটি। রাকিবের ধ্যান ভাঙলো। মেয়েটি আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। রাকিব তার পাশে বসে একটা মেয়েকে আদেশ দেয় মেয়েটির মুখের বাঁধন খুলে দিতে।
মুখের বাঁধন খুলে দিতে মেয়েটি চিৎকার করে ওঠে,
-ছেড়ে দেন আমাকে। দয়া করে আমাকে মারবেন না। আমি আসলে বুঝতে পারিনি, দয়া করে আমাকে মারবেন না।
-শান্ত হও। তোমাকে মারবো না বলেই এতক্ষণ বাঁচিয়ে রেখেছি। এখন বল তোমার নাম কি??
রাকিবের এমন অদ্ভুত শান্ত গলা শুনে মেয়েটা কিছুটা ভয় পেয়ে আনতা আমতা করে বলে,
-আ..আমি সাবিহা।
-এই মেয়ে তোতলাচ্ছো কেন? কিছু করেছি আমি?
হঠাৎই তার ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে নামটা দেখেই তার ভ্রু কুঁচকে যায়। মালিক।
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক কর্কশ কণ্ঠ, ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা আর শুদ্ধ ভাষার মিশেলে,
— “হ্যালো , রাকিইবা! কি ব্যাপার? মালটা শেষ করছস তো?”
রাকিব এক ঝলক সাবিহার দিকে তাকিয়ে, বলে,
-হ্যাঁ। আপনাকে তো ছবিও পাঠিয়েছি।
– হুঁ, ছবিখান দেখলাম কিন্তু মুখে অত পরিমাণ অ্যাসিড বোঝাই তো যাচ্ছেনা।
-আপনি তো বলেছিলেন নৃশংসভাবে হত্যা করতে। তাই করলাম।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। ভালো করছস।
এই বলেই সে কল কেটে দিল। রাকিব ফোন রাখতেই তার পাশে থাকা ছেলেটি ফিসফিস করে বলল,
-ভাই,মালিককে এত বড় মিথ্যা কথা বলা কি ঠিক হয়েছে? যদি বুঝে যায়?
-কি করে বুঝবে? উনি কি সাবিহার ছবি দেখেছে নাকি? আর তাছাড়াও আমি উনার কাছে একটা মেয়ের লা*শের ছবিই পাঠিয়েছি। তাই আমাকে সন্দেহ করার কোনো প্রশ্নই আসে না।
-কিন্তু ভাই, মালিক কে তো আপনি ভালো করেই চেনেন। আর ওনার ইতিহাস..
ছেলেটিকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে রাকিব ধমকের সরি বলে উঠল,,
-হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ জানি ওনার ইতিহাস। আর এটাও খুব ভালো করে জানি। যে ঐদিন উনি কিভাবে খুনগুলো করেছিল। উনি যদি এতটাই সাহসী হত তাহলে পুরো পরিবারকে ড্রাগস খাইয়ে, কাপুরুষের মতন মারতো না। বাঘের মতন সামনাসামনি মারতো। আর তাছাড়া ওনার এক ইতিহাস আর শোনাতে আসিস না তো এমনি মেজাজ গরম আছে।
রাকিবের ধমক শুনে ছেলেটি শান্ত হয়ে গেল। এরপর মাথা নিচু করে আস্তে করে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। রাকিবের মুখের উপর কথা বলার সাধ্য তার নেই। ছেলেটি বের হয়ে যেতেই রাকিব সাবিহার দিকে তাকালো। সাবিহা তখনো ভয়ে কাঁপছে। সে সাবিহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
-এই মেয়ে আবার ভয় পাচ্ছ কেন কিছু বলছি আমি তোমায়? শান্ত হও, শান্ত হও বললাম।
রাকিবের ধমকের তোপে মেয়েটি আরো জোরে জোরে কাঁপতে লাগল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-আপনি আমায় মারলেন না কেন?? এ..এখন ক..ক.কি করবেন আমার সাথে??
রাকিব নিজেও জানিনা সে কেন মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে চায় না মেয়েটির সামনে সে কোনো অস্বস্তিতে পড়ুক। তাই সাবিহার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা রুম থেকে বের হয়ে যায় সে।
রাত প্রায় দশটা। নিঝুমরা বিকেলেই চলে গেছে, কিন্তু শিশিরের মন এখনো ভারী হয়ে আছে। বাড়িটা হঠাৎই যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিঝুমের হাসি-ঠাট্টা, অনবরত কথা বলা সব মিলিয়ে পুরো বাড়িতে একটা আলাদা উষ্ণতা ছিল, যা এখন আর নেই। শিশির মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ আনায়াকে কল দেওয়ার কথা ভাবলো, কিন্তু তার আগেই মনে পড়ল, বাবা-মায়ের সাথে অনেকদিন কথা বলা হয়নি। তারা কবে আসবে, আদৌ এই মাসে আসবে কি না এসব কিছুই জানে না। তাই একটুখানি অভিমান নিয়েই বাবার নাম্বারে কল দিলো।
ফোন বেজে উঠতেই ওপাশ থেকে পরিচিত এক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
— “হ্যালো?”
শিশির ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি টেনে এনে বলল,
— “What’s up, মিসেস সিকদার শাহ? সরি, কিন্তু আমি আপনার সাথে কথা বলতে একদমই ইচ্ছুক নই। প্লিজ, ফোনটা আমার বাবার কাছে দিন!”
রোদেলা জামান মেয়ের এই ইয়ার্কিভরা কণ্ঠ শুনে মুচকি হেসে বললেন,
— “তুই আর ভালো হবি না, তাই না? দুষ্টু মেয়ে! আমি একবার দেশে আসি, কানটা মলে এমন একটা অবস্থা করব, তখন নিজের মাকে নাম ধরে ডাকার ফল বুঝবি!”
শিশির নাক সিঁটকে বলল,
— “হুম, কি বলল আপনি আমার মা?? আপনি তো আমার মা নন! আপনি তো মিসেস সিকদার শাহ! তাই দয়া করে মিসেস, ফোনটা আমার বাবার কাছে দিন!”
রোদেলা জামান কিছু বলার আগেই পেছন থেকে একটা ভারী, অথচ উষ্ণ কণ্ঠ শোনা গেল।
— “কে ফোন দিয়েছে?”
— “এই নাও, তোমার মেয়ে। সে তো আমার সাথে কথা বলবেই না! সব কথা তোমার সাথেই হবে!”
সিকদার শাহ মুচকি হেসে রোদেলা জামানের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নরম গলায় বললেন,
— “What’s up, my princess? কেমন আছো তুমি?”
শিশির মুখ ফুলিয়ে বলল,
— “উমম… এসেছে আমার খোঁজ নিতে! ফোন দিয়েছি, তাই এখন প্রিন্সেস বলছো! একবার নিজে থেকে কল দিয়ে কখনো শুনেছো আমার কি অবস্থা?”
সিকদার শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়ের অভিমানী কণ্ঠ শুনে মৃদু হেসে বললেন,
— “ওহোহো, মাই প্রিন্সেস! বাবা খুব ব্যস্ত ছিল, তাই তোমাকে সময় দিতে পারিনি। কিন্তু কথা দিচ্ছি, দেশে ফিরেই তোমাকে তোমার ফেভারিট পার্ক থেকে ঘুরিয়ে আনবো, ওকে?”
শিশির গলার স্বর খানিকটা নরম করে বলল,
— “বাবা, তুমি হয়তো ভুলে গেছো, আমি এখন বড় হয়ে গেছি। এখন পার্কে গিয়ে কি করব?”
— “ও মাই প্রিন্সেস! তাহলে তুমি যেখানে চাও, আমি তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাব। ওকে?”
শিশির একটু ভেবে নিয়ে বলল,
— “হুমম… কিন্তু বাবা, তোমরা আসবে কবে?”
— “আমরা কালকের ফ্লাইটেই চলে আসব। কিন্তু এখন তুমি রেস্ট নাও, সারাদিন হয়তো অনেক লাফালাফি করেছো। ভার্সিটি গেছো?”
— “না বাবা, আমি এই কয়দিন ভার্সিটি যেতে পারিনি। আনায়া আমাকে সব নোটস পাঠিয়ে দিয়েছে। তোমরা কালকে আসলে আমি পরশু থেকে যাব।”
— “ওকে, মাই প্রিন্সেস। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট!”
— “গুড নাইট, বাবা!”
শিশির ফোন রেখে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মায়ের আদর পেতে মন চাইছে। কিন্তু আর মাত্র একদিন, তারপরই তারা চলে আসবে। এই ভেবে মনটা একটু হালকা হলো।
হঠাৎ দরজার পর্দা সামান্য নড়ে উঠলো…
শিশিরের বুক ধক করে উঠল। যেন কেউ সেখানে দাঁড়িয়েছিল, আর সে ফোন রেখে তাকাতেই দ্রুত সরে গেল।
শিশির তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে আশপাশে তাকাল।
না… কেউ নেই।
কিন্তু… কেন যেন মনে হচ্ছে, এখানে কেউ ছিল। কেউ খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল।
North End Coffee Roasters-এর উষ্ণ পরিবেশে মুখোমুখি বসে আছে ইলমা আর সাজিদ। ক্যাফের দেয়ালে ঝোলানো কাঠের তাকভর্তি কফির বীনের বোতল, আরেক পাশে আর্টিস্টিক পোস্টার—সেখানে লেখা, “Coffee is always a good idea.” ক্যাশ কাউন্টারের পাশেই বড় একটা এসপ্রেসো মেশিন থেকে কফির সুগন্ধ ভেসে আসছে। এক কোণে কিছু বইয়ের শেলফ, যেখানে বসে কেউ একজন মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। এখানকার মৃদু আলো আর জ্যাজ মিউজিকের আবহ অনেকের জন্য আরামদায়ক হলেও, ইলমার জন্য এখন সেটা যেন অস্বস্তিকর।
সে কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
— “সমস্যা কী তোমার, সাজিদ? বললাম না, আমাকে কখনো কল করবে না? সকাল সকাল কল দিয়ে এখন বলছো আমার বাসায় আসছো?
সাজিদ ঠান্ডা স্বরে বলে,
— “সমস্যা আমার না, সমস্যা তোমার। তুমি কী সব উল্টোপাল্টা বলছিলে আমাকে? অন্য কাউকে বিয়ে করবে? মানে??”
— “হ্যাঁ, আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব। নাকি সারা জীবন তোমার জন্য কুমারী হয়ে থাকব—এটাই চাও?”
— “হ্যাঁ, দরকার হলে থাকবে! কোন সাহসে এসব কথা বলছো?”
— “শুধু আমার সাহস? আর কিছুদিন পর যখন বাবা-মা আমাকে অন্য ছেলের হাতে তুলে দেবে, তখন বুঝবে। ব্যাপার না, আমার বিয়ের প্রথম ইনভাইটেশন কার্ডটা তোমাকেই পাঠাবো।”
সাজিদ এবার কফির মগটা রেখে গভীর দৃষ্টিতে ইলমার দিকে তাকায়।
— “কীসব কথা বলছো তুমি?”
ইলমার এবার ধৈর্য হারিয়ে যায়।
— “কীসব বলছি মানে? কতদিন ধরে বলছি বাবা-মার সাথে একবার দেখা করো, আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলো! কিন্তু না, তোমার তো প্রতিষ্ঠিত হতে হবে! হ্যাঁ, তো তুমি প্রতিষ্ঠিত হতে হতে আমার ছেলে-মেয়েরা তোমাকে মামা বলে ডাকবে! আর তুমি কেন ভাবো যে তুমি প্রতিষ্ঠিত না? তোমার ব্যবসা কি খারাপ চলছে? নাকি আমাকে দুই বেলা খাওয়ানোর সামর্থ্য তোমার নেই? নাকি তোমার পরিবারিক অবস্থা খারাপ? কোনটা?”
সাজিদ গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলে,
— “দেখো ইলমা, আমি সব বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার বিজনেসটাকে আরেকটু বড় করতে হবে, একটু সময় দাও।”
ইলমা এবার এক ঝটকায় চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়।
— “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি শুধু তোমার বিজনেস নিয়েই ভাবো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। গুডবাই! আর কখনো আমাকে কল দিয়ে বিরক্ত করবে না।”
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৯+১০
ব্যাগটা কাঁধে ফেলে দ্রুত পায়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসে ইলমা। সাজিদ হতভম্ব হয়ে বসে থাকে, সে অনেকবার ডাক দেয়, কিন্তু ইলমা একবারও পিছনে তাকায় না।
ক্যাফের উষ্ণ পরিবেশের বিপরীতে, বাইরের বাতাসটা কেমন যেন কাঁপুনি ধরানো ঠান্ডা। ইলমা গাড়িতে উঠেই দ্রুত একটা নাম্বারে মেসেজ টাইপ করে:
“Mission successful….”