মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১২
নওরিন কবির তিশা
সকাল ৭:০০ টা
ম্লান আলোয় ঢাকা ঘরটা। জানালার পর্দার ফাঁকা দিয়ে সূর্যের হালকা রোদ এসে শিশিরের মুখে পড়ছে। ঘুমন্ত শিশিরের পাশে মোবাইল বারবার কাঁপছে—”Incoming Call: Anaya”।
শিশির চোখ কচলে মোবাইলটা তুলে— ১০টা মিসড কল! চোখ কপালে উঠে যায় তার। সে দ্রুত আনায়াকে কল করে। এবার ফোনের ঐপাশ থেকে একটা শক্ত কন্ঠ ভেসে আসে,,
-কি ব্যাপার কতগুলো কল দিতে হয় তোকে?? কাল রাত থেকে কল দিয়েই যাচ্ছি একবারও ধরার প্রয়োজন বোধ করিস নি??
শিশির অসহায় স্বরে বলে,,
-কি হয়েছে জান?? তুমি এত রাগ করেছো কেন??
আনায়া এবার শক্ত কন্ঠে বলে,,
-জান মাই ফুট। তোকে কতবার কল দিছি তাই দেখ।
-কি হয়েছে সেটা তো বল।
-হয়েছে আমার মাথা তোর মুন্ডু। ভার্সিটিতে আসা তো একেবারে ছেড়ে দিয়েছিস। প্রত্যেকদিন নোটসটা আমিই পাঠাই।কখনো খোঁজ-খবর নিস কিছু?? আজকে যে প্রেজেন্টেশন আছে সেটাও গুলে খেয়ে ফেলছিস?
এই বলেই কল কেটে দিল আনায়া।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শিশিরের আবার নিজের মাথায় নিজেরই গাড্ডা মারতে ইচ্ছা করে। আজকে তার ভার্সিটির ফার্স্ট প্রেজেন্টেশন। আর সে কিনা ব্যাপারটা একেবারে ভুলে গেল। সে দ্রুত উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজের ড্রেস পাল্টে নেয়। ভাগ্যক্রমে সেদিন আনোয়ার সাহেব কে দিয়ে বইগুলো এনেছিল। না হলে আজকে আবার বাসায় যাওয়া লাগতো। রেডি হয়ে নিচে এসে দেখে বাসায় কেউ নেই। তখনই তার মনে পড়ে আজকে আন্টিরা একটা ফ্যামিলি পার্টিতে গিয়েছে। তার মানে বাসায় কেউ নেই। আর গাড়ি দাও তো আন্টিরা নিয়ে গিয়েছে। তখনই তার মাথায় আসলো বাসায় নাহিয়ান আছে। তখনই শিশির নিজেকে নিজে বলল,,
-তুইও না শিশির?? কার কাছ থেকে কি আশা করছিস?? যে সেদিন সন্ধ্যায় তোকে বিপদে ফেলে চলে আসতে পারে। সে আজকে থেকে সাহায্য করবে??হাহ।
পরক্ষণে শিশিরের চোখ যায় দেওয়াল ঘড়িটার দিকে যেখানে টিকটিক করে সময়ের কাঁটাগুলো জানান দিচ্ছে যে এখন সকাল সাড়ে সাতটা। শিশিরের মনে পড়ে তার ক্লাস তো ৮ টা থেকে শুরু। এখন আর অহংকার করলে চলবে না নাহিয়ান যা ইচ্ছা বলুক তাকে এখন নাহিয়ানের কাছে সাহায্য চাইতে হবে। সে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। পা বাড়ায় নাহিয়ানের রুমের উদ্দেশ্যে।
রুমের সামনে এসে থমকে যায় শিশির। দরজা খুলতে গেলে তার মনে পড়ে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি। তাই সে দরজায় দুইবার টোকা মারে। ভেতর থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,,
-কে??
নাহিয়ানের কণ্ঠ। শিশির কিছুটা ইতস্তিত গলায় বলে,,
-আমি। শিশির।
নাহিয়ান নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলে,,
-Come in.
শিশির রুমে প্রবেশ করে,
ঘর জুড়ে কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ। নাহিয়ান পুরো ফরমাল ড্রেসে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে—ঘড়ি পরে নিচ্ছে। নাহিয়ান শিশিরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলে,,
-কি হয়েছে??
শিশির শান্ত গলায় বলে,,
-আজকে আমার ভার্সিটির ফার্স্ট প্রেজেন্টেশন আছে। আর বাসায়ও কেউ নেই।
-তো আমি কি করতে পারি??
নাহিয়ানের গম্ভীর কন্ঠ। এমন প্রশ্নের জবাবে অন্য সময় হলে শিশির নিশ্চিত কোন কড়া কথা শুনিয়ে দিত। কিন্তু এখন আর সময় নেই। তাই সে যথেষ্ট শান্তভাবে বলে,,
-আপনি যদি আমাকে একটু পৌঁছে দিতে পারতেন।
নাহিয়ান কোন জবাব না দিয়ে সোজা রুম থেকে বের হয়ে যায়। শিশির শুধু তাকিয়ে থাকে সেদিকে। সে বুঝতে পারে তাকে যে করেই হোক একাই যেতে হবে প্রেজেন্টেশন কোনভাবেই মিস করা যাবে না। নাহিয়ান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সেও রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায় তখন বাড়ির নিচ থেকে ভেসে আসে বাইকের হর্ন। শিশির দ্রুত বেলকনিতে যায়। সে দেখতে পায় নাহিয়ান একটা বাইক নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে। শিশিরকে বেলকনিতে দেখে নাহিয়ান নিচ থেকে বলে,,
-আসবি নাকি ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি??
শিশির হা হয়ে যায়। এই লোককে বোঝা তারপক্ষে সত্যিই অসম্ভব। দ্রুত পায় নিচে নেমে আসে। নাহিয়ানের পিছনে বসতেই, নাহিয়ান বলে,,
-আগে কোনদিন বাইকে উঠেছিস??
-না।
-তাহলে ধরে বসিস নি কেন??
-লাগবে না। আমি পারবো।
নাহিয়ান আর কোন কথা না বলে বাইক স্টার্ট দেয়। সামান্য গতি বাড়তেই শিশির হুমড়ি খেয়ে পড়ে নাহিয়ানের পিঠের উপর । শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নাহিয়ানের শার্ট।
একটা মুহূর্ত… নিঃশব্দ, ধরা পড়ে না এমন একটা স্পর্শ, একটা শীতল সকাল গলে যায় হঠাৎ উষ্ণ হয়ে ওঠা হৃদয়ের ধাক্কায়। হেলমেট এর মধ্য দিয়েও এক চিমটি মুচকি হাসির ঝলক ফুটে ওঠে নাহিয়ানের ঠোঁটের কোণে..
সেদিন রাতে ফুয়াদ মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছে। এখন সে অনেকটাই সুস্থ, কিন্তু শরীর এখনো ভীষণ দুর্বল। ডাক্তার বলেছে, পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। তবু ফুয়াদ আর এক মুহূর্তও এই হাসপাতালের ঘরবন্দি জীবনে কাটাতে চায় না।
সকালে তার পরিবার তাকে বোঝানোর শেষ চেষ্টা করছে—
“ফুয়াদ, আর মাত্র এক সপ্তাহ থাকলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
“এক সপ্তাহ?” ফুয়াদ একরকম হেসেই ফেলে, যেন কথাটা অবিশ্বাস্য ঠেকে তার কাছে। “আমি এক সপ্তাহ তো দূরের কথা, এক ঘণ্টাও আর এখানে থাকতে পারব না!”
তার গলার সুরে এমন কিছু ছিল, যা তার মা-বাবাকে আর কথা বাড়াতে দেয়নি। তারা জানে, ফুয়াদ যা একবার ঠিক করে, তা করেই ছাড়ে।
ফুয়াদের চোখ দুটো কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে সে। তার মাথার ভেতর তখন কার মুখ? সেই ভাবনা একমাত্র তারই জানা…
চার দিনের ছুটি কাটিয়ে আজ কলেজে ফিরেছে নির্ঝর। তার প্রথম ক্লাস—প্রথম বর্ষের হায়ার ম্যাথস।
প্রিন্সিপালের রুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসরুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে কথোপকথন কানে আসে।
“এই ফারু, জানিস আজকে নির্ঝর স্যার এসেছে?”
ফারিন বিরক্ত গলায় বলল, “আচ্ছা, তোদেরকে একবার বলছি না আমার সামনে ‘আমার নির্ঝর স্যার’ বলবি না? ওই হিটলার আজ এসেছে জানলে আমি কলেজেই আসতাম না! এসেই দেখবি, সবার আগে আমার ওপর রাগ ঝাড়বে! আল্লাহ জানে উনার বউ উনাকে কীভাবে সহ্য করে!”
“আরে গাধী, উনি আনম্যারিড জানিস না? উনার বউ নেই!”
ফারিন মুচকি হেসে বলল, “ওহ, তাহলে এখনো কোনো মেয়ের কপাল পোড়েনি। শুকরিয়া! কিন্তু আল্লাহই জানে কোন মেয়ের কপাল পুড়বে?!?”
নির্ঝর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল সব। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বাঁকা হাসি খেলে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে গম্ভীর করে নিল।
ক্লাসরুমের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল সে।
তার প্রবেশের সাথে সাথে পুরো ক্লাস থমকে গেল। ফারিনের মুখের হাসিটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। তার মনে হলো, নির্ঝর কি কিছু শুনে ফেলেছে?
কিন্তু নির্ঝরের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। একদম স্বাভাবিক গলায় বলল, “সবাই নতুন চ্যাপ্টার বের করো।”
শ্বাস ফেলল ফারিন। তাহলে স্যার কিছু শোনেননি…
কিন্তু সে জানত না, নির্ঝরের চোখে আজ অন্যরকম কিছু ছিল।
ক্লাস চলাকালীন নির্ঝর একবারও ফারিনের দিকে সরাসরি তাকায়নি। কিন্তু মাঝেমাঝে তার চোখের আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গেঁথে দিচ্ছিল।
ক্লাস শেষে নির্ঝর বাইরে বেরিয়ে গেল। কিন্তু দরজা পেরোনোর আগে একবার ফারিনের দিকে এক চিমটি বাঁকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড।
কিন্তু ফারিন তখন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকায় বুঝতে পারল না কেউ তাকে গভীরভাবে দেখছে……
প্রেজেন্টেশন চললো ৪৫ মিনিটের মত। প্রেজেন্টেশন শেষ করেই শিশির আর আনায়া কার্জন হল এরিয়া পেরিয়ে সামনের দিকে হাঁটছিল। তখনই শিশিরকে আনায়া বলে,,
-জান,ওইটা তোর আন্টির ছেলে না??
শিশির সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে নাহিয়ান বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাটছে। শিশির অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর সেদিকে তাকিয়েই অনায়াকে বলে,,
-হ্যাঁ ওইটা তো নাহিন ভাই। কিন্তু উনি এখনো কি করছে? উনার তো চলে যাওয়ার কথা ছিল।
তখনই পাশ থেকে সাইফ বলে ওঠে,,
-দেখ হয়তো তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়েট করছে।
সাইফের কথা শুনে শিশির একবার তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে,,
-হাহ। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দাঁড়াবে ওই লোক?? যে কিনা…?? থাক হয়তো উনি ওনার কোন ফ্রেন্ডস বা পরিচিত কারো সাথে দেখা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
তখনই নাহিয়ান তাকে ডাক দিয়ে বলে,,
-তুই কি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি?? চলে যাব আমি??
নাহিয়ানের কথা শুনে শিশির,আনায়া,সাইফ সবাই অবাক হয়ে যায়। সাইফ এবার মুচকি হেসে বলে,,
-দেখলি??বললাম না উনি তোর জন্যই দাঁড়িয়েছিল। যা দ্রুত যা বেচারা তোর জন্য ৪৫ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
শিশির সাইফের কথার কোন জবাব না দিয়ে শুধু একবার তার দিকে কটমট করে তাকালো। এরপর নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,,
-আসছি।
শিশির নাহিয়ান এর কাছে গিয়ে বলল,,
-আপনি তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?? চলে যেতে পারতেন। আমি না হয় সাইফের সাথে চলে যেতাম।
নাহিয়ান এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকলেও সাইফের নামটা শোনার সাথে সাথে তার মেজাজ জানো বিগড়ে গেল। সে শিশিরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,,স
-হেলমেটটা পড়ে গাড়িতে বস।
শিশির ও আর কথা না বাড়িয়ে নাহিয়ানের কাছ থেকে হেলমেটটা মাথায় দিয়ে বাইকের পিছনে বসল। শিশির বসার সাথে সাথেই নাহিয়ান শাঁ করে টান দিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেল।
বাইক এসে থামলো ঢাকার একটা বিখ্যাত পাঁচ তারকা রেস্টুরেন্টের সামনে । শিশির কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো নাহিয়ানের দিকে। এরপর বলল,,
-এখানে…??
-হ্যাঁ এখানে। মা বলছে আজকে বাসায় ফিরতে পারবে না। আর তোকে দেখে তো মনে হয় না তুই রান্নাবান্না কিছু পারিস। তো এখান থেকে খাবার খেয়ে না গেলে আর নিয়ে না গেলে সারাদিন আমাকে অভুক্ত থাকতে হবে। আর আমি সেটা পারব না।
-আপনি কি আমাকে অপমান করলেন,???
-তোর যা মনে হবে তাই।
-ফর ইউর কাইন্ড ইনফর্মেশন আমি রান্নাবান্না ঠিকই করতে পারি, শুধু বাবা-মা কোনদিন করতে দেয়নি।
-হুমমম তা খুব ভালো করেই জানি।
তাদের কথোপকথনের মাঝে একজন ওয়েটার এসে বলল,,
-স্যার বলুন আপনাদের জন্য কি আনতে পারি??
-এই রেস্টুরেন্টের ইউনিক যে আইটেম গুলো আছে সেইগুলো নিয়ে আসুন।
-ওকে স্যার।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয় নাহিয়ান। শিশির অনেক আগেই বের হয়ে এসেছিল। বিল দিতে গিয়ে নাহিয়ানের একটু দেরি হয়েছে। সে দেখতে পায় শিশির তার বাইকের কাছে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট বাচ্চার সাথে দুষ্টুমি করছে। সে এগোতে গেলেই পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডাক দিয়ে বলে,,
-আরে লিডার।
পিছন ঘুরতেই নাহিয়ান দেখতে পায় এক পরিচিত মুখ। তার কলেজের এক জুনিয়র। সে এগিয়ে এসে নাহিয়ান এর সঙ্গে আলিঙ্গন করে।
-কেমন আছিস ইয়াসির???
-ওতো ভাই চলছে কোন রকম। তুমি কেমন আছো?
-এইতো।
-তুমি বিডি কবে আসলে???
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১১
-এই তো কিছুদিন। তুই এখানে??
-রিনার সাথে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি?? একা এসেছো??
ইয়াসিরের প্রশ্নের জবাবে নাহিয়ান শিশিরের দিকে তাকালো। ইয়াসিরও নাহিয়ানের দৃষ্টি অনুসরণ করে শিশিরকে দেখল। পরক্ষণেই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলো,,,
-তাই উনিই কি তোমার সেই..???
শিশির তখনো বাচ্চাটার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। নাহিয়ান সে দিকে এক ঝলক তাকালো।পরক্ষণেই মুচকি হেসে বলল,,,
-হুমমম….