মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৭
নওরিন কবির তিশা
“তোকে প্রত্যেকবার বাইকে ওঠার সময় বলে দিতে হয় যে ধরে বস।”
নাহিয়ানের গলা ঠান্ডা, তবে স্বরের ভেতরে একটা নিরব অধিকার মিশে আছে।
শিশিরও কম যায় না। শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
— “আপনাকেও কি প্রত্যেকবার বলতে হয় যে আমি পারবো?”
নাহিয়ান এবার মুখে কোনো শব্দ না এনে হঠাৎ বাইকের গতি বাড়িয়ে দিল। প্রস্তুত না শিশির, আর তাই সামনের দিকে হেলে পড়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাত রাখল তার কাঁধে।
নাহিয়ান মুচকি হাসল। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা টেনে বলল,
— “কি হলো মিস শিশির শাহ? এইটুকুতেই সব শক্তি শেষ? আপনি তো বলেছিলেন, আমাকে ধরার দরকার নেই। অথচ প্রত্যেকবার এই ভাবেই আমার কাঁধেই এসে পড়েন।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না—‘মচকাবে তবু ভাঙবে না।’ আপনার জন্যই যেন তৈরি।”
শিশিরের গা জ্বলে গেলেও, নাহিয়ানের ভুল প্রবাদ শুনে এক মুহূর্ত হেসে ফেলল।
— “এই যে মিস্টার বিদেশি, দয়া করে বাংলার প্রবাদ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট না করলেই ভালো করবেন। অসম্মান করতে নেই। প্রবাদটা হচ্ছে, ‘ভাঙবে তবু মচকাবে না।’”
নাহিয়ান একটু থেমে বলল,
— “মানে আমি ভুল বলেছি?”
— “না শুধু ভুল না, এমন ভুল বললে বাংলা একাডেমি আপনাকে শো-কজ করতে পারে।”
নাহিয়ান মুখ বাঁকিয়ে বলল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “ওহ, থ্যাঙ্ক ইউ মিস গ্রামার কুইন,”
শিশির এবার একটু বেশি গম্ভীর হয়ে বলল,,
— “আর একটা কথা, আমি ইচ্ছা করে আপনার কাঁধে পড়ি না। বরং আপনি ইচ্ছা করে বাইক এমনভাবে চালান যাতে আমি পড়ি। I think it’s your plan.”
নাহিয়ান হালকা হাসল, কিন্তু এবার কণ্ঠটা ঠান্ডা, একটু রহস্যময়—
— “তুই কি নিজেকে খুব স্পেশাল ভাবিস, হ্যাঁ? আমি বাইক চালাচ্ছি যাতে তুই আমার কাঁধে পড়িস? Seriously? আর যখন এমন সন্দেহ হয়, তখন উঠলি কেন?”
শিশির এবার কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
— “আমি কখন বলেছি আমি স্পেশাল? বরং আপনি যেরকম ভাবেন, আমি সেটা একদমই না।
আর হ্যাঁ, আপনার বাইকে আমি ইচ্ছা করে উঠিনি, গাড়িটা খারাপ না হলে আপনার বাইকে উঠতামও না।”
এই বলে শিশির সামান্য দূরে তাকায়। বাইকের গতির ভেতরও একটা ঠান্ডা যুদ্ধ যেন বয়ে চলেছে তাদের মাঝখানে।
নাহিয়ান মনে মনে হেসে বলে,
— “তোমাদের গাড়িটা তো খারাপ হওয়ারই ছিল… না হলে আমি এই রাগ আর রাগের নিচে লুকিয়ে থাকা মায়াটা কোথায় দেখতাম!”
কিছুক্ষণ আগে 🌺 🌺
আজ সাজিদ ও ইলমার বিয়ে। দুপুর থেকেই যেন বাড়ির আঙিনায় বসন্ত নেমেছে। উঠানে রঙিন আলপনা চারদিকে সাজানো বাতি, গানের আওয়াজ, আর মানুষে মানুষে উচ্ছ্বাস।বালিশের মতো তুলতুলে মেঘের নিচে শাড়ি-পাঞ্জাবির মেলায় বর্ণিল হয়ে উঠেছে চারদিক।
ইলমা আজ একেবারে রাজকন্যার মতো। লাল-কাঁচাপাকা রঙের লেহেঙ্গায় রুপকথার পুতুল বলে মনে হয় ওকে। কপালে বড় টিপ, হাতে গ্লিটারি চুড়ি, আর ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি।
সাজিদ— একদম ক্লাসিক ধাঁচে সাদা শেরওয়ানি পরে, চোখেমুখে আনন্দ আর গর্বের আভা।
শিশির পুরোটা সময় ইলমার পাশে ছায়ার মতো ছিল।
সব অনুষ্ঠান শেষে, নবদম্পতি যখন সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে রওনা হচ্ছে সাজিদের বাড়ির পথে, তখনই গাড়ির ব্যবস্থা নিয়ে একটু ঝামেলা বাঁধে।
শিশির, ড্রাইভার আংকেল আর ইলমার দুই বোন একসাথে একটা গাড়িতে উঠেছিল। গাড়িটা ছিল পুরনো মডেলের—চলতে না চলতেই শুরু হয় সমস্যা। রাস্তায় হঠাৎই গাড়ির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়।
ড্রাইভার মাথা চুলকে বলল,
— “মামনি, গাড়িটা আর চালানো যাবে না। ইঞ্জিনে সিরিয়াস সমস্যা।”
ইলমার ছোট দু’জন বোন একটু চিন্তিত হলেও সাজিদের এক চাচাতো ভাই ঠিক তখনই অন্য গাড়ি নিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল। ইলমার দুই বোনের দিকে তাকিয়ে বলল
— “গাড়িটাতে তো জায়গা কম তোমাদের নিয়ে নিচ্ছি,ওকে পরে কেউ নিয়ে আসুক।”
শিশির ওদের উঠিয়ে দিল সেফলি, কিন্তু ওর নিজেকে একা দেখে খানিকটা দিশাহারা লাগছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে… যেন নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক নির্দিষ্ট একজন আসে।
কালো হেলমেট মাথায় দিয়ে নাহিয়ান একপাশ থেকে বাইক নিয়ে ধীরে ধীরে তাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। থেমে গেল গাড়ির সামনেই।
হেলমেটটা খুলতেই শিশির দেখতে পেল পরিচিত সেই কঠিন চোখজোড়া।
নাহিয়ান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
— “গাড়ি তো চলবে না বুঝতেই পারছিস। উঠবি?”
শিশির ইতস্তত করছিল। কিন্তু চারপাশের দৃষ্টি, রাতের নিরাপত্তাহীনতা, আর মনের গোপন একটা অজানা স্পন্দন—সব মিলিয়ে বাইকে উঠতে হলো তাকে।
গভীর রাতে সেই বাইকের সিটে এখন বসে আছে সে। বাতাসে উড়ছে তার ওড়না, আর নাহিয়ানের কাঁধে রাখা হাতের স্পর্শে একটা অজানা অস্থিরতা বাজছে ভেতরে ভেতরে।
আজ প্রায় দুই সপ্তাহ পর আবার সেই ঘৃণ্য, নরকতুল্য জায়গাটিতে গিয়েছিল রাকিব। যতবার যায়, ততবারই মনে হয় সে নতুন করে জাহান্নাম দেখছে। জায়গাটা যেন সময়ের সাথে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। প্রতিবারের মতোই আজও সেখানে পা রাখতেই বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়।
সেই জায়গাটা—পৃথিবীর বুকেই নেমে আসা এক টুকরো জাহান্নাম, যেখানে র*ক্তের গন্ধ বাতাসে গলিত হয়ে মিশে আছে। যেখানে নরপিশাচরা সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নারীকেও পরিণত করেছে লাশের সমান এক মাংসপিণ্ডে।
প্রথমবার যখন রাকিব সেখানে গিয়েছিল, সে ভেবেছিল—এটা কি সত্যি? নাকি কোনো দুঃস্বপ্ন?
তার সামনে শয়ে শয়ে নারী আর শিশুকে আটকে রাখা হয়েছে। কেউ জীবিত, কেউ মৃত। অথচ এমনকি মৃ*ত্যুও তাদের মুক্তি দিতে পারেনি।সেখানে মৃ*ত নারীর শরীরেও থামে না নিপীড়নের উৎসব।
শিশুর চোখ দিয়েও র*ক্ত বের হয়…
আর তাদের কান্না…
শুধু ফাঁকা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।
সেদিন, রাকিব একবার নিজের চোখের পাতা ফেলেছিল
সেদিন রাকিব নিজের চোখে দেখেছিল—দুইটা মৃ*ত নারীর দেহকে ঘিরে ধরেছিল চারজন জানোয়ার, যারা নির্লজ্জ উল্লাসে সেই দেহগুলোতেও চালিয়েছিল তাদের বিকৃত কামনা। মৃ*ত নারীরাও সেদিন লজ্জায় কেঁদে উঠেছিল—
আজ আবার সেখানে গিয়ে সেই দৃশ্যগুলো আরও নিঃসংশভাবে ফিরে এসেছে চোখে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তবুও বের হতে পারেনি।
কারণ একবার ঢুকে পড়লে এই জাহান্নাম থেকে আর ফিরে আসা যায় না।
এই নেটওয়ার্ক, এই সাম্রাজ্য—যার হাতের জাল সারা দেশের বুকে বিস্তৃত, যার পেছনে ক্ষমতা, অর্থ আর র*ক্তপিপাসু মানুষ—তাদের চোখ ফাঁকি দেওয়া কোনো সাধু-সাধিকার বিষয় না। আর কেউ বেরিয়ে যেতে চাইলেই… হয় নিজে মরে, নয়তো নিজের প্রিয়জনদের লাশ গোনে।
টাকার পাহাড়, আর নারীর শরীর—এই দুই জিনিসের জন্য সাধারণত কেউ এই পেশা থেকে নিজেকে আলাদা করে না। কারণ এটা শুধু পেশা নয়—এটা এক নরকের রাজত্ব, যেখানে র*ক্তই কারেন্সি। ভয়ংকর? নিঃসন্দেহে। কিন্তু ঠিক সেই ভয়ই তো শক্তি। আর শক্তির কাছে টাকাও আসে, নারীরাও। জীবিত কি মৃত—ভেদটা কে করে? যাদের মন পচে গেছে, তাদের কাছে নারীর শরীর কেবলই এক টুকরো মাংস। নাড়ির স্পন্দন না থাকলেই বা কী আসে যায়? এ পেশায় মৃত্যুই ব্যবসা, আর লা*শই ভোগের বস্তু।
এখানে মৃ*ত নারীর শরীরও দামি পণ্যে পরিণত হয়েছে।
তবুও—রাকিব বদলায়নি।
তার ভেতরটায় এখনো একটা মানুষ বেঁচে আছে, একটা ঘৃণা জমেছে এই নরকের প্রতি।
নিজেদের বারান্দায় বসে কপালে হাত ঠেকিয়ে এসব কথাই ভাবছিল রাকিব। শহরের আলো-আঁধারি যেন তার চিন্তাভারের তুলনায় অনেকটাই হালকা। কিন্তু তার মনে চলছিল এক তীব্র ঘূর্ণিপাক— রক্তের, ভয়াবহতার, আর অপরাধের।
ঠিক তখনই সে টের পায়— তার পাশেই এসে বসেছে কেউ একজন। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে, সাবিহা।
ভীতসন্ত্রস্ত চোখে সে তাকিয়ে আছে রাকিবের দিকে। যেন তার বুকের ভেতর কোনো অজানা আতঙ্ক সাঁই সাঁই করে ছুটে বেড়াচ্ছে।
রাকিব এক চিলতে মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “কিছু বলবে?”
সাবিহা শব্দ করে কিছু বলল না, নিঃশব্দে মাথা নাড়ল কেবল।
রাকিব বুঝে যায়, সাবিহা ভয় পাচ্ছে। তাই সে শান্ত গলায় বলে,
— “ভয় নেই, বল। আমি কোনো জানোয়ার নই, যে তোমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবো। আমিও মানুষ, তেমনি। নির্ভয়ে আমাকে বলতে পারো।”
সাবিহা কিছুটা সাহস নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “আপনি কি কোনো কারণে চিন্তিত?”
রাকিব চোখ তুলে তাকাল আকাশের দিকে। নীরবতা যেন কিছুক্ষণ ওদের মাঝে টানটান হয়ে ঝুলে থাকল। তারপর সে হালকা হেসে বলল,
— “কিসের চিন্তা আবার? চিন্তা আর আমার? আমি তো এখনো বেঁচে আছি। এটুকুই যথেষ্ট।”
সাবিহা এবার কিছুটা সাহসিকতার সাথে, তবে স্বরে একটা স্পষ্ট মাধুর্য নিয়ে বলল,
— “দেখুন, আমি বুঝতে পারি আপনি ঠিক ঐমানুষদের মতো নন। আপনি ভেতর থেকে আলাদা। আপনাকে দেখে কখনোই আমার ওসব নরপশুদের মতো মনে হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—তবুও কেন আপনি এমন নৃশংস, জঘন্য একটা কাজে নিজেকে আটকে রেখেছেন? কেন আপনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসছেন না?”
রাকিব এবার সরাসরি সাবিহার চোখে তাকাল। চোখে একধরনের গা ছমছমে ক্লান্তি, গাঢ় অন্ধকার।
সে মৃদু হেসে বলল,
— “তোমার বয়স কম, সাবিহা। এখনো দুনিয়ার অনেক কিছু তোমার চোখে পড়েনি, যা আমার দৃষ্টির পাতায় অনেক আগেই দাগ কেটে বসে আছে।
তুমি এখনো জানো না, এই পৃথিবীর নৃশংসতা ঠিক কতটা গভীর হতে পারে। পৃথিবীর নৃশংসতার কিঞ্চিত অংশও তুমি দেখনি যা আমি অনেক আগে ভোগ করেছি। তুমি ভাবো, এইসব কাজ ভুল… অথচ আমি তা মুখস্থ করে ফেলেছি অনেক বছর আগেই।
তুমি প্রশ্ন করছো, আমি কেন বেরোই না?
আমি হাসি।
কারণ, এই রাজত্ব থেকে কেউ স্বেচ্ছায় বেরোতে পারে না। একবার ঢুকে পড়লে, শুধু দেহ নয়, আত্মাটাও বন্দী হয়ে যায়।”
রাকিব আর কিছু বলে না
শুধু নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে রাতের নীরবতা ছুঁয়ে গেল।
সিগারেট ফেলে দিলো ঘাসে…
আর দূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল।
ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন দশটা ছুঁই ছুঁই। আকাশজুড়ে ছড়িয়ে আছে ঘন কালো মেঘ, সঙ্গে মাঝে মাঝে গর্জে ওঠা বজ্রের তাণ্ডব। ঠিক যেন কোনো অতৃপ্ত আবেগের হাহাকার, যেটা অন্ধকার আকাশ ভেদ করে বুক চিরে ঝরে পড়তে চায়। এই শহরের রাত্রিরা সাধারণত শান্তিতে ঘুমাতে শেখেনি, কিন্তু আজ যেন অন্যরকম। ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তা আজ অস্বাভাবিক নিঃস্তব্ধ, যেন শহরটাও কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চারদিকে এক ধরণের অজানা প্রতীক্ষার শব্দ—শুধু বাইক আর তাতে বসে থাকা একজোড়া নিরব জুটির নিঃশ্বাসে কাঁপছিল নীরবতা।
বাইক চালাচ্ছে নাহিয়ান, পেছনে বসে শিশির। চারদিক এতটাই ফাঁকা, যেন এই রাস্তা, এই শহর, এই রাত—সব শুধু ওদের দু’জনের জন্য সাজানো এক অন্তরঙ্গ দৃশ্যপট। হঠাৎই ঝরে পড়ল বর্ষার প্রথম ফোঁটা—তারপর যেন আকাশের সমস্ত আবেগ ঝরে পড়ল বৃষ্টির ধারা হয়ে। বৃষ্টির অনভ্যস্ত প্রবাহে প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠল নাহিয়ান। কিন্তু পেছন থেকে আসা এক অনাবিল হাসি, এক অনাহুত আনন্দ তাকে স্থির করে দিল।
শিশির!
বৃষ্টির শব্দ পেরিয়ে শিশিরের কণ্ঠে এক শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস—“বাইক থামান… প্লিজ!”
নাহিয়ান জানে, মেয়েটার বৃষ্টির প্রতি দুর্বলতা অনেক পুরোনো। সেই ছোটবেলা থেকেই একরাশ বৃষ্টি মানেই ওর চোখে একরাশ তারার ঝিলিক। বকুনি, ধমক—কিছুই থামাতে পারেনি ওর বৃষ্টির প্রেম। আজও পারল না। নাহিয়ান কিছু বলল না, বাইকটা ধীরে থামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল একটা নির্জন ছায়াঘন রাস্তায়। চারপাশে ছায়া ছায়া আলো, কোথাও নেই কোনো কোলাহল—শুধু গাছের পাতায় বৃষ্টির টুপটাপ ধ্বনি, আর দু’জন মানুষ।
শিশির বাইক থেকে নেমেই ছুটে গেল একটু সামনে। তার সালোয়ার-কামিজ ভিজে একাকার, মাথার চুল এলোমেলো হয়ে পিঠে জড়িয়ে পড়েছে। হাতের মুঠোয় ধরা একগুচ্ছ রজনীগন্ধা—যেটা সে ইলমার বিয়ের বাড়ি থেকে নিজের করে এনেছিল। সেই ফুলের ঘ্রাণ আর বৃষ্টির টুপটাপ গলে গিয়ে শিশিরকে করে তুলেছে এক অনন্য দৃশ্য।
সে হাত মেলেছে আকাশের দিকে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন ওর গালে কবিতা লিখছে।
দূর থেকে তাকিয়ে আছে নাহিয়ান।
তার চোখে ঠিক বৃষ্টির ফোঁটার মতো নরম হয়ে আসে একরাশ অনুভব। বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করে ওঠে। ঠিক তখনই ভেতরটা ফিসফিস করে বলে ওঠে,
“নিজে এক রজনীগন্ধা হয়ে, অন্য রজনীগন্ধার ঘ্রাণে এমন মুগ্ধতা!
তুই কি জানিস, তুই আমার—
“মন গহিনের রজনীগন্ধা,
বৃষ্টিস্নাত অলকানন্দা…”
তখনই আশেপাশের কোন এক পুরনো কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করে ভেসে আসে এক পুরনো দিনের গান—
“ওওও আগে কত বৃষ্টি যে
দেখেছি শ্রাবণে,
জাগেনি তো এত আশা
ভালোবাসায় বুকে…
সেই বৃষ্টি ভেজা পায়
সামনে এলে হায়,
ফোটে কামিনী
আজ ভিজতে ভালো লাগে
শূন্য মনে জাগে প্রেমের কাহিনী…”
নাহিয়ানের ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি খেলে যায়। সে চোখ বন্ধ করে শুধু শুনতে থাকে। বাতাসে ভাসছে শিশিরের হেসে উঠা শব্দ, রজনীগন্ধার ঘ্রাণ, আর বৃষ্টির সুরেলা কবিতা। সবকিছু মিলেমিশে এক অপার্থিব আবহ।
সেই মুহূর্তে আর কিছু বলার থাকে না।
শুধু অনুভবটা থেকে যায়—
একটা নির্জন বৃষ্টির রাত।
একটা ভেজা প্রিয় মুখ।
আর এক বুক অদেখা প্রেম…
অন্যদিকে—
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্ট পেরিয়ে, এক বিদেশী আগন্তুক ধীর পায়ে বেরিয়ে এল। চারদিক আলোয় ঝলমল করলেও তার চোখে ছিল একরাশ অন্ধকারের ছাপ। ঠোঁটে একপাশে বাঁকা হাসি।
পায়ের নিচে বাংলাদেশি মাটি ছোঁয়াতেই সে নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলল—
“I’m back… Mr. Nahiyan.
This time, not to play fair—
but to finish what you started.”
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৬
(“আমি ফিরে এসেছি… মিস্টার নাহিয়ান।
এইবার আর খেলতে নয়—
তুমি যেটা শুরু করেছিলে,
তার ইতি টানতেই এসেছি।”)
একটা বিদ্যুৎ চমকের মতো হালকা ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল বিমানবন্দরের আকাশে।
ঠিক তখনই কফারের মতো এক কালো গাড়ি থেমে দাঁড়াল তার সামনে। দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে।