মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৪ (২)
নওরিন কবির তিশা
খুলনায়…..
চৌধুরী আবাসনের সকালটা আজ অন্য রকম। প্রতিদিনের তুলনায় আজ যেন চারপাশে ব্যস্ততা অনেকাংশে কম। ডাইনিং টেবিলে একসাথে সকালের নাস্তা করছেন পরিবারের সদস্যরা। ইমরান চৌধুরী আর ইয়াকুব চৌধুরী বসে আছেন পাশাপাশি। নিঃশব্দে খাবার খাচ্ছেন তারা। আজকে কেউই অফিসে যাবেন না, তাই বাড়ির মহিলাদের ব্যস্ততাও আজ কম।তাদের বিপরীত পাশে বসা নিঝুম, নির্ঝর আর ইয়ালিনা। হঠাৎই হাসনা খান বললেন,
— নির্ঝর।
নির্ঝর মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে বলে,
— জ্বী আম্মু।
— আগের দিন তোদের কলেজে যে মেয়েটা রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিল না, ডুয়েট করেছিল তোর সাথে… মিষ্টি করে মেয়েটা… ওর নাম কী?
হাসনা খানের একটা কথায় যেন বোমা বিস্ফোরিত হলো গোটা ডাইনিংয়ে। সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকলো নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর কোনো মেয়ের সাথে ডুয়েট গান গেয়েছে—এটা যেন কারোই বিশ্বাস হতে চাইলো না।
ইমরান চৌধুরী কপাল কুঁচকে বললেন,
— কী! নির্ঝর ডুয়েট করেছে?
সামনে থেকে নিঝুম বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— জ্বী আব্বু। তাও একটা মেয়ের সাথে। খুব সম্ভবত ভাইয়ার কলেজের স্টুডেন্ট।তুমি তো সেদিন কলেজে যাওনি, প্রিন্সিপাল আঙ্কেল বারবার কল করছিল, যেতে বলছিল। তাই আমি আর আম্মু গিয়েছিলাম।কিন্তু গিয়েই দেখলাম ভাইয়া একটা আপুর সাথে ডুয়েট গান গাইছে। কী গান জানো?
“আমারো পরানো যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো…”
নিঝুমের কণ্ঠে একরাশ দুষ্টুমি।নিঝুমের কথায় নির্ঝর রাগী চোখে একবার নিঝুমের দিকে তাকালো। তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে।সামনে যদি পরিবারের বড়রা না থাকতেন, নিশ্চিত ওখানেই নিঝুমের কান মলে দিতো।কিন্তু এখন সামনে বাড়ির বড়রা আছে বলে নিঝুমকে কিছুই বলতে পারল না নির্ঝর।কেবল চোখের চাহনিতেই ওর ওপর ঝাড়ি দিল সে।নিঝুম ভেতরে কিছু ঘাবড়ে গেলেও মুখে সেটার প্রকাশ করল না। কারণ, সে খুব ভালো করেই জানে নির্ঝর তাকে যতই বকাঝকা করুক, আব্বুর সামনে কিছুই বলবে না।এদিকে ইমরান চৌধুরীর বিস্ময় যেন কাটছেই না।
তিনি অবিশ্বাস্য নয়নে ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই নির্ঝর দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— মা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, গেলাম।
— কী দেরি হয়ে যাচ্ছে? খাবারগুলো অন্তত শেষ করে যা।
— রেখে দাও, আমি এখন আর খেতে পারব না। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
— আর মাত্র দু’চারটা কামড়! খেয়ে যা।
— সময় নেই।
দ্রুত বেরিয়ে গেল নির্ঝর। যেন এক মুহূর্তে সবার প্রশ্নবিদ্ধ চোখ আর কণ্ঠ থেকে মুক্তি পেতে চাইল।সে বেরিয়ে যেতেই শিউলি হক অবাক গলায় বলল,
— সত্যি আপা? আমাদের নির্ঝর গান করেছিল?
— তো আমি কি মিথ্যা কথা বলছি? তোকে তো আগের দিন বললাম যাওয়ার কথা। কিন্তু তোরই তো সময় ছিল না।
— না আপা, আসলে সেইদিন মাইগ্রেনের ব্যথাটা চড়ে গিয়েছিল। এজন্যই যেতে পারিনি। কিন্তু নির্ঝর গান সত্যিই করেছিল?
— হ্যাঁ। গান তো করেছিল। কিন্তু আমার তো মেয়েটাকে খুব ভালো লেগেছে। দেখতে কী ভীষণ মিষ্টি! আমার তো নির্ঝরের জন্য খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ওর নামটা…
পাশ থেকে নিঝুম বলল,
— আম্মু, আপুটার নাম ফারিন। প্রিন্সিপাল আঙ্কেল নিজেই তো বলেছিলেন যে মেয়েটা ভালো ছাত্রী, আর দারুণ গান করে।
— হ্যাঁ হ্যাঁ, ফারিন…
গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ে ফারিনের দিকে।
ছায়াপথে আলো-ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে হেঁটে যাচ্ছে সে, চুলে রোদের ঝিলিক , ঠোঁটে সেই চিরচেনা, সরল মিষ্টি হাসি তবে তার সাথে নেই নেহা,ইমন কিংবা তার অন্যকোনো ক্লাসমেট। আছে রিশান।ফারিন তার কথা মনোযোগে শুনছে , আর মাথা হেলিয়ে হেসে উঠছে ।ফারিনের সাথে রিশানকে দেখে নির্ঝরের ভেতরে হঠাৎ চাপা এক স্রোত নামে।কোনো শব্দ নেই, তবু দুচোখে রক্তিম আগুন জ্বলে ওঠে।হাতের আঙুলগুলো নিজে থেকেই মুঠো পাকিয়ে যায়। কিন্তু কেন? নির্ঝরের তা জানা নেই।
চোয়াল শক্ত করে তাদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল সে তখনই হঠাৎ কথা বলতে বলতে হোঁচট খায় ফারিন।ঝটকায় শরীরটা সামনের দিকে হেলে পড়ে। রিশানের হাত তখনও বাঁকা হয়ে আছে—ছুঁতে পারেনি।তার আগেই যেন এক অদৃশ্য বাতাসে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কেউ— দুই হাতে আঁকড়ে ধরে তাকে।ফারিন ধরা পড়ে নির্ঝরের বুকে। নিঃশ্বাসগুলো তীক্ষ্ণ, স্পর্শটা তীব্র।একটা মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সময়। ফারিন মাথা উঁচু করে তাকে ধন্যবাদ জানাতে যাবে তার আগেই নির্ঝর বলে,,
—”চোখ কোথায় থাকে তোমার? দেখে শুনে চলতে পারো না।?”
—”সরি স্যার… আসলে দেখতে পারিনি।”
—”তা পাবে কীভাবে?মানুষের সাথে গল্প করতে করতে তো একেবারে…”
কথা শেষ করে না নির্ঝর। একঝটকায় ফারিনকে ছেড়ে দিয়ে সোজা চলে যায় টিচার্স রুমের দিকে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে ফারিন।চোখে বিস্ময়, বুকের ভেতর ধুকপুকানি। সে বুঝতে পারে না এই মানুষটা হঠাৎ হঠাৎ ঝড়ের বেশে কোথা থেকে আসে?
ভার্সিটির ক্লাস শেষে ধীরে ধীরে ভবন থেকে বেরিয়ে আসে শিশির, আনায়া আর সাইফ। তবে লিমা আজ অনুপস্থিত। শিশির ঘাড় ঘুরিয়ে সাইফের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“কি ব্যাপার রে সাইফ? লিমা আসল না কেন?”
“আরে সেটা তো জানিনা।”
—“মানে কী? একই বাসায় থাকিস অথচ জানিস না?”
—“আরে বাবা, কী করে জানব? ওরা পাঁচ তলায় থাকে আর আমরা দুই তলায়। দেখা-সাক্ষাৎ তেমন হয় না।”
শিশির কিছু বলার আগেই সাইফ নিজেই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
— “তা আগে তোরা বল, কালকে কখন বের হবি?”
—“কখন যাবি মানে? কোথায় যাব?”
—“কেন, আনায়া তোকে বলেনি?”
—“না তো?”
শিশির এবার আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—“কিরে আয়ু? কোথায় যাবি তোরা?”
আনায়া হালকা হাসি নিয়ে উত্তর দেয়,
— “আরে, ওরা একটা ডে-আউট প্ল্যান করছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আঙ্কেল-আন্টি তোকে যেতে দিতে রাজি হবে তো?”
— “কেন, দেবে না কেন?”
— “মানে, আঙ্কেল-আন্টি কি এত সহজেই ছাড়বে?”
—“হ্যাঁ, আগের দিন তো বাবাই শুনতে ছিল যে—
‘তোমরা ভার্সিটি থেকে কোথাও ট্যুরে যাবে না। আমাদের সময় তো আমরা প্রায়ই বন্ধুদের সাথে day out এ যেতাম।’”
“বরং আমিই আর কিছু বলতে পারলাম না। কারণ, সবার সঙ্গে এমন পরিচয় নেই। অনেককেই ঠিকভাবে চিনি না—এই জন্য…” “তবে, যখন শুনবে সবাই যাচ্ছে, তখন অবশ্যই যেতে দেবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে—রাত্রে থাকলে বা night out করলে হবে না, আর ঢাকা থেকে বেশি দূরে গেলেও হবে না।”
সাইফ হেসে বলল,
— “আরে পাগল, আমরা তো শুধু দিনের জন্য যাচ্ছি। আমাদের বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের সবাই যাবে। সবার সাথে পরিচিত হওয়া যাবে।এটা একটা ইনফর্মাল গেট টুগেদারও বলা চলে। আর আমরা তো গজারিয়া মেঘনা বিচে যাব। মুন্সিগঞ্জে, বেশি সময় লাগবে না—মাত্র দুই ঘণ্টার রাস্তা।”
শিশির চোখে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে,
— “ও তাই নাকি? তাহলে তো অবশ্যই যাব!”
সাইফ এবার আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—“কিন্তু আনায়া, তোর কী অবস্থা? তুই যাবি না?”
আনায়া সামান্য দ্বিধায়,
—“আমি এখনো শিওর না। বাবা-মাকে কিছু বলা হয়নি।”
পাশ থেকে শিশির বলল,
—“কি শিওর না? আমি আন্টি-আঙ্কেলের সাথে কথা বলবো।”
—“আচ্ছা, তাহলে কালকে তোরা যাচ্ছিস, তাইতো?”
—“হুম।”
শিশিররা কথা বলতে বলতে ভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাইরে চলে আসে। ঠিক তখন একটি বাইক এসে থামে তাদের সামনে। শিশির তীক্ষ্ণ নজরে তাকায় বাইকের উপর বসা ছেলেটির দিকে। সে বুঝতে পারে যে এটা তানিম। তানিম হেলমেট খুলতেই শিশির বলে,
—“আপনি এখানে?”
—“হ্যাঁ, আমি। আসলে অফিস থেকে ফিরছিলাম তখন ভাবলাম তোমাদের তো এই টাইমেই ছুটি হয়, তাই একেবারে তোমাকে নিয়েই যাই।”
— “ধন্যবাদ, তবে আমি আনুচুর সঙ্গে যাব।”
— “কিন্তু আনোয়ার আঙ্কেল তো এখনো আসেনি। এই রোদে মধ্যে দাঁড়িয়েই বা কেন থাকবে?”
— “আসবে, আর দেরি নেই।”
— “তোমার এমন দাঁড়িয়ে থাকাটা ভালো লাগছে না, চলো বাইকে উঠো।”
—“থ্যাঙ্ক ইউ, কিন্তু আমি বাইকে কমফোর্টেবল না।”
—“এখানে কমফোর্টের কী আছে? শুধু ধরে বসে থাকলেই হলো।”
তাদের কথোপকথনের মাঝে চলে আসে আনোয়ার সাহেব। তাকে দেখে শিশির বলে,
—“ওই তো চলে এসেছে আনুচু।”
সাইফ আর আনায়াকে বিদায় জানিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ায় সে। আনায়া আর সাইফও ধীরে ধীরে চলে যায়। শুধু একা দাঁড়িয়ে থাকে তানিম, বাইকের উপর চুপচাপ। তার চোখে একরাশ অভিমান, ভেতরে গুমরে ওঠে না বলা কথাগুলো। শিশিরের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থেকে সে ধীরে গলায় ফিসফিস করে বলে:
“তুমি আমাকে আর কতদিন এভাবে উপেক্ষা করবে, শিশির কনা? তোমার এই সামান্য এড়িয়ে চলাও পাহাড়সম কষ্ট দেয়… তুমি জানো না, তোমার না বলা অনুভূতিগুলোই আমাকে বিক্ষিপ্ত করে তোলে। এই মন, আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না… তবু বিশ্বাস রাখো, একদিন… একদিন ঠিকই জয় করব তোমাকে। ভালোবাসা যেমন নীরব, জয়ও তেমনি নিঃশব্দেই আসবে।”
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।গোধূলি লগ্নে রক্তিম রঙা সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে।ভার্সিটি থেকে ফিরে আনায়া সোজা চলে এসেছিল তার আপুর ছাত্রীর বাসায় তাকে পড়াতে কাজ শেষে সে ফিরছিল পার্কের একপাশ ঘেঁষে তখনই দেখতে পায় একটা ছোট্ট বিড়াল ছানা একটু দূরে আহত অবস্থায় পড়ে আছে। বিড়ালের বাচ্চাটাকে এমন অবস্থায় দেখে আনায়ার ভীষণ মায়া হল। এগিয়ে গিয়ে বিড়াল ছানাটিকে কোলে নিল। তার মাথায় আদর করতে লাগল। তখনই কেউ একজন তার পাশ থেকে বলল,,
—বিড়াল ছানা পছন্দ?
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে আনায়া পাশে ফিরে দেখল তার পাশেই নিঃশব্দে হাঁটু গেড়ে বসে আছে রিদিত।এই পথ ধরেই ক্লায়েন্ট মিটিং শেষে বাসায় ফিরছিল সে। হঠাৎ চোখে পড়ে—রাস্তায় পাশে একটা মেয়ে একটা আহত বিড়াল ছানাকে কোলে তুলে নিচ্ছে।এক মুহূর্তেই রিদিত বুঝে যায়—এ মেয়েটিই তার আরাধ্য মানুষ, যার দৃষ্টির গভীরে রিদিত বারবার হারিয়ে যেতে চেয়েছে, যার নিঃশ্বাসে, যার হাসিতে সে খুঁজে পায় জীবনের সবটুকু সংজ্ঞা।যে নিজের চোখে লিখে রেখেছে রিদিতের ভালবাসার প্রতিটি ব্যাকরণ এটাই তার প্রিয়তমা তার আয়নিন।একটি অসহায় প্রাণীর প্রতি এমন নিঃশর্ত স্নেহ, এমন কোমল যত্ন দেখে সে আবারও মুগ্ধ হয়।গাড়ি থেকে নেমে আনায়ার পাশে এসে পৌঁছে। অন্যদিকে রিদিতকে দেখে আনায়া বলে,,
—”আপনি?”
—”হ্যাঁ আমি।”
—”আপনি এখানে কি করছেন?”
—”আমি কি করছি মানে?আগে বলো তুমি এখানে কি করছো? আর বিড়াল ছানা পছন্দ?”
—”সে প্রশ্নের উত্তর আমি আপনাকে দিতে যাব কেন?”
—”আমাকে কেন দিতে যাবে মানে? আমাকে ছাড়া আর কাকে প্রশ্নের উত্তর দেবে প্রিয়তমা?”
—”দেখুন একদম বাজে কথা বলবেন না। আর সরে যান আমার সামনে থেকে যেতে দিন আমাকে।”
—”উহু এত সহজে তোমাকে কি করে যেতে দিই বলো? এখনো তো আমার মনে ইচ্ছাটাই পূরণ হলো না”
আনায়া নাকশিটকে বলে,
—”কি ইচ্ছা?”
রিদিত গলা খাঁকারি দিয়ে গেয়ে ওঠে,,
ইচ্ছে করে….একটা ঘরে
থাকবো দুজনায়….
গড়ব ভিটে..খুশির ইটে
সঙ্গী হবি আয়…
জনসমক্ষে রিদিতের এমন হঠাৎ গানে থমকে যায় আনায়া। চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে,ভাগ্য ভালো, রাস্তায় মানুষের ভিড় নেই, গাড়িঘোড়ার চলাচলই বেশি।তাই রিদিতের এমন পাগলামি কারো নজরে পড়িনি এটা ভেবেই স্বতির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ধাতস্থ হয়ে রিদিতের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, ,,
—”আপনি কি পাগল? রাস্তার ভিতরে এভাবে গান গাইছেন। লোকজন দেখলে কি বলবে।”
—”কে কি বলল কে কি ভাবলো সেখানে আমার বিন্দুমাত্র মাথায় ব্যথা নেই প্রিয়তমা। আমার মাথা ব্যাথা শুধু তুমি আমাকে নিয়ে কি ভাবলে সেটা নিয়ে।”
—”বাজে বকা বন্ধ করুন পাগল লোক কোথাকার!”
—”পাগল? হ্যাঁ পাগলই তো। কিন্তু সে পাগলের পাগলামি শুধু তোমাতেই সীমাবদ্ধ। তুমি ছাড়া এই পাগলামি দেখার সৌভাগ্য আর কারো হয়নি আর হবেও না।”
হঠাৎই আনায়া গম্ভীর কণ্ঠে বলে,,
—”দেখুন আমি আপনাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি আমার পেছনে শুধু শুধু সময় নষ্ট করবেন না। আমার জীবনটাই পুরো মাঝরাতের মত অন্ধকারাচ্ছন্ন।”
—”আর সেই অন্ধকারেই যদি আমি রোদ্দুর হয়ে ধরা দি।”
আনায়া এবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,,
—”মাঝরাতের রোদ্দুর? হাহ এটা কোনদিন সম্ভব?”
—”অবশ্যই সম্ভব চেষ্টা করলে আর মনের ইচ্ছা পবিত্র হলে সবকিছুই সম্ভব।”
—”কোন দিনই সম্ভব নয়”
—”যদি আমি সম্ভব করতে পারি?”
—”তাহলে সেদিন থেকে আমিও বিশ্বাস করব যে এখনো পৃথিবীতে পবিত্র ভালোবাসা বেঁচে আছে আর সেদিনই আমি চেষ্টা করব জীবনকে আর একটা সুযোগ দেওয়ার। কিন্তু সাবধান আপনি যদি সামান্যতম ব্যর্থ হন তাহলে হয়তো আর কোনদিন দেখা পাবেন না আমার।”
—”তোমাকে হারানোর কোন প্রশ্নই আসে না আয়নিন। আমি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি শরীরের শেষ রক্ত কণা দিয়ে চেষ্টা করব তোমার বিশ্বাসের পাহাড়ের পুনর্নির্মাণে।”
আলোয় ঝলমল, রাজকীয় অভিজাততায় মোড়া একটি স্থাপনা—The Westin Dhaka। গুলশান-২ এর প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা এই ফাইভ স্টার হোটেল যেন আকাশের গায়ে ঝুলে থাকা কোনো অলৌকিক প্রাসাদ। তার কাঁচে ঘেরা উঁচু গম্বুজ ছাদ, মার্বেলের মেঝেতে আলো-ছায়ার ছায়াচিত্র।এই হোটেলের ২১তম তলার এক কোণার চুপচাপ টেবিলে বসে আছে একজন বিদেশি আগন্তুক।পোশাক পরিচ্ছেদে খাঁটি বিদেশী , তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, চকচকে কাঁচের গ্লাসে হালকা ঝিকিমিকি করছে রেড ওয়াইন—আর তার ঠিক সামনেই রাখা একটি স্লিম ব্ল্যাক ল্যাপটপ।ল্যাপটপের স্ক্রিনে ফুটে উঠছে একটাই ছবি।
শিশির।
ছবিটাতে ক্যাম্পাসের—দিনের আলোয় হাসছে সে। চোখে একরাশ প্রাণ, ঠোঁটে নিঃশব্দ কোনো গল্প। ছবিটার সাথে নিচে ছোট্ট একটা মেসেজ”Biology Dept. Tour – Meghna Riverside Day Out-tomorrow”
আগন্তুক অপলক চেয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে। ঠোঁটের কোণে জমে থাকা হালকা বাঁকা হাসি যেন বলে দিচ্ছে—সে শুধু দেখছে না, গিলছে। এই মেয়েটির প্রতিটি হাসি, প্রতিটি ভঙ্গিমা তার ভিতরে বিস্তার করে রেখেছে এক শীতল আগুন।একটা নিঃশ্বাস ফেলে, একরাশ নির্লিপ্ত কণ্ঠে সে বলে,,
“This is your first… and the last day out of your life baby girl.”
তার আঙুলে ধরা রয়েছে একটি ছোট্ট রিমোট-ডিভাইস,
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৪
টেবিলের পাশে রাখা ব্যাকপ্যাক থেকে সে বের করে একটি চ্যাপ্টা বক্স।তার চোখে এক রহস্যময় উজ্জ্বলতা। মুখে যেন মিশে আছে প্রতিহিংসা আর বিকৃত আকাঙ্ক্ষার এক বিষাক্ত মিশ্রণ।হোটেলের বাইরে তখন ঢাকার চেনা যানজট, কর্কশ হর্ণ, আর উচ্ছ্বল সন্ধ্যার চেনা কোলাহল। কিন্তু এই ঘরের ভেতরে সেই কোলাহলের কোনো ঠাঁই নেই। এখানে গড়ে উঠছে নিঃশব্দ এক ভয়াল মিশন—যার টার্গেট শুধু একজনই …
শিশির…