মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩২
নওরিন কবির তিশা
সুইজারল্যান্ডের Zurich শহর থেকে ঘণ্টাখানেক দূরে গাড়ি ছুটে চলেছে A4 Highway ধরে—চারপাশে সবুজ বনভূমি, মাঝে হালকা কুয়াশায় ঢাকা ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম, আর পথের দুই পাশে ছড়িয়ে থাকা সোনালি আলোয় ভেজা শরতের গাছেরা যেন নীরবে ছুঁয়ে যাচ্ছে গাড়ির জানালা।নাহিয়ান গাড়ি চালাচ্ছে দক্ষ হাতে।তার পড়নে আজ সাদা হাই-কলার শার্ট, ওপরে ক্রিস্প ব্ল্যাক ব্লেজার, আর চুলগুলো পেছনে ক্লাসিক হেয়ারক্রিমে গোছানো।তার পাশের সিটে বসে আছে শিশির। সে আজ একেবারে অন্যরকম।
তার গায়ে ব্ল্যাক কালার সিল্কের শাড়ি,যার প্রত্যেক এক ইঞ্চি নিচে নিচে ব্ল্যাক স্টোন বসানো, ব্লাউজের ডিজাইনটা একটু মডার্ন,তবে তাতেও দৃশ্যমান ব্ল্যাক স্টোন।
তারা আজ যাচ্ছে এক অত্যন্ত বিশেষ আমন্ত্রণে—এলিসিয়া আর লুকাসের প্রথম ওয়েডিং অ্যানিভার্সারিতে।
এলিসিয়া আর লুকাস দুজনেই নাহিয়ানের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা একসাথে পড়াশোনা করেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার সেই বিখ্যাত ছায়াঘেরা ক্যাম্পাস-University of Southern California (USC)-তে।কিন্তু এলিসিয়ার সঙ্গে নাহিয়ানের সম্পর্ক আরও পুরনো, আরও গভীরে গাঁথা।যখন নাহিয়ানের বাবা-মা যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন, তখন এলিসিয়ার বাবা ছিলেন নাহিয়ানের বাবার বিজনেস পার্টনার। সেই সূত্রে দুই পরিবারের সম্পর্ক ছিল প্রায় আত্মীয়তার মতোই—স্মৃতিতে ভরা, ঈর্ষাজনকভাবে সহজাত, অথচ কখনও কখনও জটিল ইঙ্গিতে বাঁধা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অন্যদিকে লুকাস, সুইস বংশোদ্ভূত এক কর্পোরেট প্রতিভা। USC-তে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স শেষ করে সে এখন সুইজারল্যান্ডের নামকরা একজন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী।তাদের বিবাহিত জীবনের এক বছর পূর্ণ হলো আজ।
আর সেই প্রেমের বর্ষপূর্তির উপলক্ষে লুকাস আর এলিসিয়া এ আয়োজন করেছে আল্পসের পাদদেশের একটি একান্ত, অভিজাত, বিলাসবহুল হোটেলে,যেখানে আকাশ নেমে আসে পাহাড়ের গায়ে, আর প্রতিটি বাতাসে থাকে এক অলিখিত কবিতার গন্ধ।আর সেই প্রেমময় স্মৃতির আবেশে আমন্ত্রিত অতিথিদের একজন—নাহিয়ান, এবং তার সদ্য বিবাহিতা “মিসেস”।
নাহিয়ান গাড়ি চালাতে চালাতে একবার শিশিরের পানে চাইল। হঠাৎই তার হৃদস্পন্দন যেন থমকে গেল।তার শিশিরবিন্দু আজ শাড়ি জীবনে প্রথমবার শাড়ি পড়েছে তাও তার নিজের পছন্দ করা শাড়ি,সে নিজের হাতে হালাল অধিকারে তার শিশিরবিন্দুকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে।একথা ভাবতেই প্রনয়ের এক উষ্ণ পবন দোলা দিয়ে যায় তার হৃদয়ে।সে মুচকি হেসে বলল,,
—”কি ব্যাপার ম্যাম..??এখনো সকালের ব্যাপারে ভাবছেন নাকি..??”
নাহিয়ানের কথায় শিশির কপালের উপর পড়া ছোট ছোট এলোমেলো চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিতে দিতে তার দিকে ফিরতেই নাহিয়ান বিমোহিত নজরে শিশিরের দিকে তাকালো। শিশিরের ফর্সা মুখশ্রী রক্তলাল বর্ণ ধারণ করেছে।ঠিক যেন কোনো সদ্য ফোঁটা কৃষ্ণচূড়া । সে নেশাক্ত কন্ঠে বলল,,
—”ম্যাম… আপনি তো পুরাই রেড চেরি হয়ে গেছেন…এখন যদি এই চেরি টেস্ট করতে গিয়ে আমি কন্ট্রোললেস হয়ে যাই! তাহলে এর দায়ভার কে নেবে..? এমনিতেই রেড চেরি আবার আমার ফেভরিট তো…”
নাহিয়ানের এমন লাগামহীন কথায় কান লাল হয়ে যায় শিশিরের।তার মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ আগের কিছু অদ্ভুত সুন্দর মূহুর্তের কথা।
কিছুক্ষণ আগে 🥀🥀
শিশিরের প্রথম থেকেই অ্যানিভার্সারির পার্টিতে যাওয়ার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি ছিল কিন্তু সেই আপত্তিই যেন এক প্রকার জেদে পরিনত হয় যখন নাহিয়ান তাকে শাড়ি পরার কথা বলে। কিন্তু নাহিয়ান কি আর শিশিরের জেদের ধার ধারে?সে যখন একবার মুখ দিয়ে বলেছে তখন পুরো দুনিয়া উল্টে গেলেও সেটাকে সে সত্যি করেই ছাড়বে।আর শিশিরই বা কম কিসে?সেও শাড়ি পরবে না মানে পরবেই না।এটা নিয়েই সকাল থেকে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছিল কপোত-কপোতীর। তখনই হঠাৎ নাহিয়ান রেগে গিয়ে বলল,,
—”তুই যদি নিজে থেকে না পড়িস তাহলে কিন্তু আমি তোকে জোর করে পড়িয়ে দিতে বাধ্য হব শিশির!”
তার কন্ঠছিল গম্ভীর-স্তরবদ্ধ।কিন্তু তাতে নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়ল না শিশির। বরং সেও রেগে গিয়ে বলল,,
—”যা ইচ্ছা করুন!”
তার কথায় সামান্য বাঁকা হাসল নাহিয়ান। গভীর কন্ঠে সে বলল,,
—”ওকে…ম্যাম…আপনার যেমন ইচ্ছা!”
সে আর কোনো কথা না বলে সোজা এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। কার্বাড থেকে সযত্নে বের করল শাড়িটি।তার পর ধীর পায়ে এগিয়ে আসল শিশিরের দিকে। এদিকে নাহিয়ানকে শাড়ি হাতে এগিয়ে আসতে দেখে শিশিরের চোখ কোঁটোর থেকে বের হয়ে আসার উপদ্রব,এখন যদি সত্যি নাহিয়ান তাকে নিজ হাতে শাড়ি পরায়,সে যা তাতে কিছুই অসম্ভব নয় তার কাছে,না-না আর কিছুই ভাবতে পারল না শিশির,শুকনো ঢোক গিলে,হাত বাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে বলল,,
—”দ..দ..দিন।আমার কাছে দিন!”
নাহিয়ান:”কেন?”
শিশির:”দ..দ..দিন বললাম তো!”
শিশিরকে এমন তোতলাতে দেখে নাহিয়ান বাঁকা হেসে বলল,,
—”এইটুকু তেই ভয় পেয়ে গেলেন…ম্যাম!”
—”ভয় আর আপনাকে? কখনোই নয়!”
কথাটা বলেই এক ঝটকায় নাহিয়ানের হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিল শিশির। নাহিয়ান তার যাওয়ার পানে চেয়ে নিজের ঘাড়ে বাঁ হাত রেখে,বাঁকা হেসে ফিসফিস করে বলল,,
—”ডিয়ার প্যারট..দেখবি একদিন তুই ঠিকই ভয় পাবি, তবে আমাকে না…আমার তীব্র প্রেমময় পাগলামিকে, আমার দেওয়া ভালোবাসার যন্ত্রণা কে! কিন্তু সেই পাগলামি দেখতে আর ভালোবাসার যন্ত্রণা পেতেই তুই পাগলপারা থাকবি……!”
নাহিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ব্লেজারটা ঠিক করে নিল তারপর একবার রুমের ঘড়ির দিকে তাকাল,রোমান সংখ্যার ঘড়ির কাঁটাগুলো জানান দিচ্ছে কেটে গেছে ৩০টা মিনিট। কিন্তু এখনো কোনো খোঁজ নেই শিশিরের। নাহিয়ান এবার বিরক্ত হয়ে শিশিরের রুমের দিকে পা বাড়াল। দরজার সামনে এসে তাতে হালকা টোকা দিল নাহিয়ান। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে সে এবার বেশ জোরেই ডেকে বলল,,
—”শিশির।”
সে আবারও ডাকল,,
—”শিশির, রেডি হয়েছো?”
তবুও নীরবতা।
নাহিয়ানের কণ্ঠ একটু নিচু, কিন্তু শীতল,,
—”তুই যদি এখনই সাড়া না দিস, তাহলে কিন্তু দরজা ভেঙে ঢুকে যাবো আমি, শিশির শুনতে পাচ্ছিস?”
আরও কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।তারপর ভেতর থেকে আস্তে একটা গলা ভেসে আসে,,
—”প্লিজ… আসবেন না… ”
কিন্তু ততক্ষণে ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে নাহিয়ানের।
সে দরজায় জোরে ধাক্কা দেয়,আর মুহূর্তেই শব্দ তুলে দরজাটা খুলে যায়। সে ভিতরে ঢুকে পড়ে।ভেতরের দৃশ্য দেখে তার চোখ থেমে যায়। রুমের স্নিগ্ধ আলোর মাঝে ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শিশির। এলোমেলো চুল, শাড়িটা অদ্ভুতভাবে শরীর ঘেঁষে জড়ানো, এক অংশ বুকের ওপর আটকে আছে, বাকিটা কোমরের পাশ ঘেঁষে পড়ে আছে।
নাহিয়ানকে দেখে শিশির লজ্জায় দ্রুত পিছন ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু নাহিয়ান চোখ সরায় না।ঠাণ্ডা-স্পষ্ট আর সামান্য রাগী কণ্ঠে সে বলে,,
—”তুই যে একা শাড়ি পড়তে পারিস না এটা আমাকে আগে বলতে পারিস নি,ইডিয়েট?”
শিশির সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলল,,
—”আপনি জানেন না আমি আগে কখনো শাড়ি পরি নি.?তাহলে…”
তার কথাটা সম্পন্ন না করতে দিয়েই নাহিয়ান বলল,,
—”এদিকে আয়।”
—”কেন?”
—”বলেছি, তাই।”
—”না… আপনি বাইরে যান আমি শাড়িটা ঠিক করে পড়ে আসছি!”
শিশির দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে নাহিয়ান পেছনে আছে কিনা তা দেখার জন্যে সামান্য ঘুরিতেই তার পিলে চমকে উঠে, নাহিয়ান একেবারে তার কাছাকাছি চলে এসেছে,সে আতঙ্কে এক পা পিছিয়ে যায়, নাহিয়ান আরো এক পা এগিয়ে আসে তার দিকে,সে পিছোতে থাকে আর নাহিয়ানও তার সাথে ছন্দ মিলিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। হঠাৎই তার পিঠ দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো,আর পিছানোর জায়গা নেই এদিকে নাহিয়ান তার দিকে এগিয়ে আসছে,লজ্জায়,আতঙ্কে সে দ্রুত চোখ বন্ধ করে নেয়,নাহিয়ান তার এমন অবস্থা দেখে মুচকি হেসে তার দিকে এগিয়ে আসে,ধীরে ধীরে এক হাতে তার শাড়ির আঁচল তুলে নিয়ে কাঁধের উপর রাখে,তারপর নিচু হয়ে বসে কোমরের পাশে পড়ে থাকা শাড়ির অংশটা আলতো হাতে তুলে কুচি ঠিক করতে থাকে। শিশির তখনো চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নাহিয়ানের প্রতিটি স্পর্শ এ যেন কোনো সাধারণ স্পর্শ নয় এ স্পর্শ শিশিরের আত্মা অব্দি ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার।তার হৃদ গহীনে তৈরি করছে দোলাচলের এক নীরব যুদ্ধ।
কুচি ঠিক করা শেষে নাহিয়ান যখন তা গুছিয়ে দিতে যাবে তখনই বাঁধে এক বিপত্তি,সে লক্ষ্য করে শিশিরের নাভির ঠিক বাঁ পাশে গাঢ় ত্বকের মধ্যে ছোট্ট একটা তিল,যা তাকে আকৃষ্ট করছে তীব্রভাবে,তার চোখ থেমে যায়,ঘোরাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকল তিলটির দিকে। সে শেষমেষ নিজেকে আর সামলাতে না পেরে বলল,,
—”আম সরি ডার্লিং কিন্তু তোর এই ছোট্ট তিলটা… আমার পুরো আত্মসংবরণ পুড়িয়ে দিচ্ছে, আম সরি ফর মাই কন্ট্রোলেসনেস!!”
সে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিশিরের তিলের ঠিক উপরে,নিজের ওষ্টদ্বয় দিয়ে সেই ছোট্ট তিলটার উপর চালায় এক প্রেমময় নিঃশব্দ যুদ্ধ,ধীর নীরব স্পর্শ,যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার মুক্তি।শিশিরের শরীর থেমে যায়।তার মেরুদণ্ড বেয়ে নামে নেমে আসে এক ঠান্ডা তবু উষ্ণ প্রনয় পরশ।শিহরণ জাগে প্রতিটি লোমকূপে,ফর্সা চোয়াল রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। মহা জগতের সবকিছু তার সামনে ঝাপসা হয়ে যায়।পৃথিবী থেমে যায়, কেবল বুকের ভেতরে তীব্র কাঁপুনির মতো শ্বাস উঠে-নামা করতে থাকে।
হঠাৎই ব্রেক করার কারণে সামনে ঝুঁকে পড়তে যায় শিশির। বের হয়ে আসে এক প্রেমময় স্মৃতির আবেশ থেকে।গাড়ির ভেতর তখনও সেই উষ্ণতা লেগে আছে, যে উষ্ণতা একসাথে ঘামিয়ে দেয় শরীর, আর কাঁপিয়ে তোলে আত্মা।
নাহিয়ান :”পৌঁছে গেছি ম্যাম।”
শিশির জানালার বাইরে তাকায় সামনের দিকেই দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল সাদা প্যালেস হোটেল, চোখ ধাঁধানো রাজকীয়তায় নির্মিত।Hotel Villa Honegg-এর আদলে গড়া এই প্রাইভেট হোটেলটি, সুইস আল্পসের কোলঘেঁষে স্থাপিত, বাহিরটা যেন রূপকথার কোনও প্রাসাদ—চুন-সাদা প্রাচীর, বারান্দায় সোনালি কারুকার্য, আর পেছনে গলে যাওয়া জল-বরফে মোড়ানো পাহাড়ের অপার্থিব ছায়া।
গাড়ি এসে থামে পার্কিং স্পটের একদম সামনে।
পাশে সাজানো হাই-এন্ড ব্ল্যাক সেডান, সাদা মার্সিডিজ, রোলস রয়েস।
নাহিয়ান গাড়ি থেকে নেমে এসে শিশিরের জন্য দরজা খোলে।শিশির পা রাখে কুয়াশাভেজা পাথরের ওপর, যেখানে প্রতি ধাপেই লাল গালিচার রাজকীয় অনুভব।হোটেলের প্রবেশপথের চারদিকে প্রজ্বলিত ক্রিস্টাল ল্যাম্প, রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট ঝোপে জ্বলছে fairy lights।মৃদু পিয়ানো টুকরো শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে।এন্ট্রান্সে বিশাল গোলাকার সোনালি ঝাড়বাতি, আর অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে আছে ২ জন ভদ্র স্টাফ।
শিশির আর নাহিয়ান পাশাপাশি হেঁটে যায় লাল গালিচার পথ ধরে,নাহিয়ানের বাহুতে শিশিরের বাহু, তারা প্রবেশ করে হোটেলের ভেতর। পুরো হোটেলটা অদ্ভুত সুন্দর ভাবে সাজানো। পুরো হোটেলের থিম আজ সাদা, সাধারণত খ্রিস্টান বিয়ে অ্যানিভার্সারি গুলো যেভাবে সাজানো থাকে ঠিক সেই রকম, পুরো হল সাজানো সাদা পাহাড়ি ফুলে,প্রবেশদ্বারের দুপাশে বড় ফুলদানিতে রাখা পাহাড়ি সাদা গোলাপ, যার ঘ্রাণ মাদকতা ছড়াচ্ছে পুরো হল জুড়ে,
প্রতিটি অতিথির টেবিলের সেন্টারপিসে রাখা ছোট্ট তারার মতো দেখতে সুইজারল্যান্ডের জাতীয় ফুল,এডেলওয়েইস আর সারা দেয়ালজুড়ে সাদা উইস্টেরিয়া ফুলের পর্দাগুলো যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে হলরুমজুড়ে শুভ্রতা, আর কিছু পাহাড়ি শুভ্র বুনোফুল ঝুলে পড়েছে ছাদের কিনারা,থেকে,একেকটা ফুলের গুচ্ছে যেন নীরব কবিতা লেখা।পুরুষরা পরেছে সাদা টাক্সেডো, মহিলারা সাদা গাউন। তবে ব্যতিক্রম শিশির আর নাহিয়ান শুধুমাত্র এই কপোতা কপতীই আজ কালোতে আবৃত। তাদের দেখে এক অতিথি পাশের একজনকে বলে,,
—“Who are they…? The black couples …? they look like a storm in the middle of a snowfield…”
তখনই হঠাৎ মাইক্রোফোনে কেউ একজন বলে,,
—”ladies and gentleman এতক্ষণ ধরে আমরা যাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমার বহুল প্রতীক্ষিত অতিথিরা উপস্থিত হয়েছেন। একজন আমার ভার্সিটির বেস্ট ফ্রেন্ড, আর বর্তমানে ইউএসএ’র বিখ্যাত সিআইডি অফিসার এআর নাহিয়ান চৌধুরী এবং অন্যজন তার প্রাণপ্রিয়তমা মিসেস শিশির চৌধুরী।”
(এখানের কথোপকথন গুলো ইংলিশে ছিল আমি বোঝার সুবিধার্থে বাংলায় দিলাম। আপনাদেরও সুবিধা সাথে আমারও🙂)
তখনই পুরো হলের সমস্ত আলো নিভে গেল। আর একটা তীক্ষ্ণ সোনালী আলো এসে পড়ল নাহিয়ান আর শিশিরের উপর সবাই তাদের দিকে ঘুরল। গোল্ডেন ফেইরী আলো তাদের দুজনকে যেন স্বর্গছোঁয়া জুটি করে তুলছে,যেন স্বপ্নস্ফীত যুগল। সকলে অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালো।এলিসিয়া আর লুকাস এগিয়ে আসলো তাদের দিকে। নাহিয়ান দুজনের সাথে আলিঙ্গন করলো। অতঃপর
এলিসিয়া শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”তাহলে এই সেই অপ্সরা, যার জন্য আমাদের নাহিয়ান কোনো মেয়েকে পাত্তা দিত না!”
শিশির সামান্য লজ্জা পেলো তার কথায়, তারপর এক ঝলক নাহিয়ানের দিকে তাকালো নাহিয়ান বরাবরের মতোই ঘায়েল করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল, তারপর এলিসিয়া আর লুকাসকে মুচকি হেসে অ্যানিভার্সারির শুভেচ্ছা জানালো।
একটা শ্বেত পাথরের টেবিলের উপর বসে সফট ড্রিংকস খাচ্ছিল শিশির,পাশেই নাহিয়ান একজন সুইস নাগরিকের সাথে আলাপ জমাচ্ছিল,তখনই হঠাৎ মাইক্রোফোনে এলিসিয়া বললো,,
—”অ্যাটেনশন প্লিজ এভরি অন, আজকে আমাদের ফার্স্ট অ্যানিভার্সারি এজন্যই আমরা একটা স্পেশাল ইভেন্টের আয়োজন করেছি, ইভেন্টের প্রধান আকর্ষণ কাপল ডান্স,আর এটার স্পেশালিটি হচ্ছে এখানে প্রত্যেককে তার পার্টনারের চোখে চোখ রেখে,ক্লোজলি সম্পূর্ণ ডান্স টা পারফর্ম করতে হবে।”
এলিসিয়ার আনাউন্সমেন্ট শেষ হতে না হতেই পুরো হল করতালিতে মুখরিত হলো। তবে তাতে শিশির কোনো হেলদোল দেখালো না,সে নিজের মনে সফট ড্রিংকস খাচ্ছিল। তার আর কি সে ভাবল সবাই ডান্স পারফর্ম করবে আর সে দেখবে। কিন্তু তার সেই আশার গুড়ে যেন বালি ঢেলে দিল এলিসিয়ার একটা কথা,,
—”আর হ্যাঁ এখানে প্রত্যেকটা কাপলকেই অংশগ্রহণ করতে হবে।”
কথাটা শুনেই ভীষম লাগলো শিশিরের।নাহিয়ান তা দেখে মুখ সামান্য নিচু করে মুচকি হাসলো।
কিছুক্ষণ পর…🌼🌼
এলিসিয়ার অনুরোধে শিশির বাধ্য হয়েছে নাহিয়ানের সাথে ডান্স করতে। কিন্তু তার ভিষন অস্বস্তি হচ্ছে এমনিতেই সে এসবে অভ্যস্ত নয়,তার উপর আবার পড়েছে সিল্কের শাড়ি,মনে হচ্ছে সব যেন এবার খুলেই যাবে।তার এমন অস্বস্তিবোধ অনুভব করে নাহিয়ান সামান্য নিচু হয় তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,,
—”ডোন্ট ওয়ারি মিসেস,আপনার এই মিস্টার যতক্ষণ আপনার সাথে আছে ততক্ষণ আপনি কোন অস্বস্তিকর পরিস্থিতে পরবেন না! ইনশাআল্লাহ..”
কথাটা বলে নাহিয়ান শিশিরকে নিজের আরও একটু কাছে টেনে নিল। তারপর বলল,,
—” হিলটা খোলেন.. ম্যাম!”
শিশির অবাক কন্ঠে শুধালো,,
—”কেন..?”
—”খুলতে বলছি তাই…”
সে আর কথা বাড়ালো না। আস্তে করে নিজের হিলটা খুলে রাখলো পাশে। এমনিতেও এই হাই হিল পড়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার।
নাহিয়ান:”এবার আমার পায়ের উপর পা রাখেন!”
শিশির বুঝলো নাহিয়ান কে প্রশ্ন করে লাভ হবে না। তাই সে নাহিয়ানের কথামতো নিজের পা দুটি নাহিয়ানের পায়ের উপর রাখল, শিশির পা রাখতেই নাহিয়ান তার বাঁ হাত নিজের কাঁধের উপর আর নিজের বাঁ হাত শিশিরের কোমরে রাখল,যার ফলে তার হাত গিয়ে লাগলো শিশিরের উন্মুক্ত কোমরে,শিশির কেঁপে উঠল,নাহিয়ান এবার শক্ত করে তার কোমর জাপটে তাকে নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসলো,যার ফলে শিশিরের রুদ্ধশ্বাস এসে লাগলো তার প্রশস্তলোমশ বুকে,এদিকে শিশিরের প্রাণ যায় যায় অবস্থা, শ্বাস যেন গলার কাছে এসে আটকে আসছে, নাহিয়ানের এত কাছাকাছি আসায় সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে নাহিয়ানের শরীর থেকে ভেসে আসা তীব্র এক পুরুষালীর মাদকীয় ঘ্রান।যা তাকে অস্থির করে তুলছিল,নিজে মাতাল মাতাল লাগতে শুরু করলো তার। ডান্স শুরু হলো,নিয়ম অনুযায়ী সকলকে নিজের পার্টনারের চোখে চোখ রেখে ডান্স করতে হবে তাই শিশির নাহিয়ানের চোখে চোখ রাখল—কিন্তু….কিন্তু একি..? শিশির থমকে গেল,এ যেন কোনো চোখ নয় এ যেন সেই কৃষ্ণগহ্বর যেখানে কিছু একবার প্রবেশ করলে আর বের হতে পারে না,এমন কি আলোক রশ্মিও না।
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩১
সকলে নিজের সঙ্গীর সাথে নাচে ব্যাস্ত। পিয়ানোতে বাজছে আশিকি মুভির সেই বিখ্যাত রোমান্টিক,hum tere bin গানের টিউন।সেই সুরে তাল মেলাচ্ছে সবাই। কিন্তু শিশিরের চারপাশ যেন থমকে গেছে সে নাহিয়ানের সাথে তাল মেলাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার অস্তিত্ব যেন ধীরে ধীরে বিলীন যাচ্ছে নাহিয়ানের চোখ নামক সেই কৃষ্ণগহ্বরের মাঝে।ছন্দ হারাচ্ছে তার হৃদস্পন্দন।