মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৩

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৩
নওরিন কবির তিশা

সময় যেন এক চলমান খরস্রোতা যা বয়ে চলে অবিরাম, অপেক্ষা করে না কারো জন্য।এজন্যই হয়তো বলে সময় এবং স্রোতে কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আসলে প্রবাদটা যে কতটা সত্যি সেটা আজ শিশির অনুভব করতে পারছে। এইতো দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরো পনেরোটা দিন। কিন্তু সেদিন ওয়েডিং অ্যানিভার্সারি থেকে আসার পর থেকেই তার কি যেন একটা হয়েছে.. সে নাহিয়ানের চোখে তাকাতে পারে না,কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করে…. কিন্তু সেটা কি শিশির ঠিক বুঝে উঠতে পারে না তবে এটুকু বুঝতে পারে যে এখন আর তার নাহিয়ানের প্রতি তার আগের মতো ঘৃণা কাজ করে না বরং সে স্পর্শ করলে শিশিরের অন্যরকম এক শিহরণ জাগে কিন্তু সেই অনুভূতি ব্যাখ্যা করার মতো,‌সেই শিহরণ সংজ্ঞায়িত করার মতো কোন শব্দ শিশিরের জানা নেই, কি এক অদ্ভুত অনুভূতি তাই না..?

আচ্ছা এটা কি তবে,সবাই যেমন বলে বিয়ের পরে নাকি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত একটা ভালোবাসা বর্ষিত হয় তাই…..?শিশির হেঁটে যাচ্ছিল নাহিয়ানের রুমের সামনে দিয়ে আর নিজ মনে এসব ভাবছিল। তারপর নিজের এসব চিন্তার জন্য সে নিজেই নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,,
—”কি সব ভাবছিস,শিশির?ওই অসভ্য লোকের সাথে থাকতে তোর চিন্তা ভাবনা গুলোও অসভ্য হয়ে গেছে। ওইটা কি কোনো বিয়ে ছিল নাকি..?আর যদিও বিয়ে হয়ে থাকে তবে এটা কোনদিনই নওরিফা আন্টিরা মানবে না.. বরং সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে… না,না কি সব ভাবছিস..”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তখনই সে টের পেল সে নাহিয়ানের রুমের একেবারে সামনে চলে এসেছে।একবার রুমের দিকে উঁকি মেরে দেখলো পুরো রুম অগোছালো। আশেপাশে কোথাও নাহিয়ান নেই, তাই সে রুমে প্রবেশ করলো। নাহিয়ান কোথায় সেটা দেখার জন্য বেলকনির দিকে পা বাড়াতেই ওয়াশরুমের ভেতর থেকে নাহিয়ান বলল,,
—”শিশির…আমার টাওয়েলটা একটু দিয়ে যেতে পারবে..?”
শিশিরের পা থেমে গেল। নাহিয়ান কি করে বুঝল এখানে সে.? পরক্ষণেই তার মনে পড়ল পুরো কটেজে তো সে আর নাহিয়ান একাই থাকছে এতদিন ধরে। ভেতর থেকে নাহিয়ান আবারও বলল,,
—”কি হলো একটু দিয়ে যাও না প্লিজ… আসলে আমি যেটা এনেছিলাম সেটা নিচে পড়ে ভিজে গেছে…”
শিশির মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে বলল,,

—”সামান্য টাওয়াল টাও ঠিক করে রাখতে পারেনা…”
সে এগিয়ে গিয়ে আলমারি খুলে আরেকটা টাওয়েল বের করল। তারপর সেটা হাতে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। ওয়াশ রুমের সামনে এসে সে ‌টাওয়েলটা দিতে হাত বাড়াতেই নাহিয়ান এক ঝটকা মেরে তাকে নিজের দিকে টান দিল, শিশির ভারসাম্য হারিয়ে ‌গিয়ে পরলো তার উন্মুক্ত প্রশস্ত লোমশ বুকে,যেখান থেকে এখনো গড়িয়ে পড়ছে জল বিন্দুরা উপরের রেইন শাওয়ার থেকে ‌পানি পড়ছে ঝর্ণার মতো,‌অবিরত।ভিজে যাচ্ছে শিশির নাহিয়ান দুজনেই। নিজের বন্ধ করা চোখ আস্তে আস্তে খুললো ‌শিশির,নাহিয়ানের পুরো শরীর উন্মুক্ত,শুধুমাত্র কোমরে জড়ানো একখানা সাদা টাওয়াল, কপালের উপর পড়া সামান্য লম্বা চুল ভিজে একাকার।শিশির দৃষ্টি সরিয়ে বলল,,

—”টাওয়াল তো আপনার কাছেই ছিল মিথ্যা কেন বললেন..?
নাহিয়ান বাঁকা হেসে বলল,,
—”মিথ্যাটা না বললে কি আপনি আসতেন ম্যাম..??”
শিশির নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগল,নাহিয়ান তা দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,,
—”উসসস… এত নড়ো কেন জান..? ডিস্টার্ব…আমি কি কিছু করছি নাকি..? আর একবার যদি নড়ো তাহলে কিন্তু এখানেই…”
নাহিয়নের এমন কথায় কিছুটা ভড়কে গেল শিশির। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে বলল,,
—”এ-এ-এখানেই ক-ক-কি..?”

নাহিয়ান আর কোনো কথা বলল না বাঁকা হেসে সামান্য নিচু হয়ে নিজের অধরদ্বয় দিয়ে তীব্রভাবে দখল করলো শিশিরের নরম কোমল ওষ্টদ্বয়। শিশিরের চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম,হৃদস্পন্দন যেন ছন্দ হারিয়েছে,যেন এক্ষুনি হাতে বের হয়ে আসবে হৃৎপিণ্ডটা। এক সেকেন্ড,দুই সেকেন্ড তারপর শিশির আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল। তার মনে বেজে উঠলো,,
বাতাসে গুনগুন…
এসেছে ফাগুন…
বুঝিনি তোমায়…
শুধু ছোঁয়ায়….
এত যে আগুন….

ভার্সিটির ক্লাস শেষে সবে ক্যাম্পাসে পা রাখল আনায়া। যখনই পাশ থেকে আশা বললো,,
—”দোস্ত..ওই দেখ জিজু!”
আশার কথা অনুযায়ী আনায়া সামনে তাকাতেই দেখতে পায় নিজের বাইকে হেলান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে রিদিত।আনায়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। এটা তার কাছে নতুন কিছু না। বিগত এক মাস ধরে এটা যেন রিদিতের রুটিনে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন ভার্সিটি শেষে তাকে নিজের বাসায় পৌঁছে দেওয়া। আনায়া অনেকবার বারণ করেছে তাকে। কিন্তু রিদিত কি আর কথা শোনার পাত্র! আনায়া এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,,
—”আজকেও আবার কেন এসেছেন…?আপনাকে না বারণ করলাম..”
রিদিত মুচকি হাসে তার দিকে হেলমেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে,,

—”শুনবো শুনবো তোমার সব কথা শুনবো আগে বিয়েটা হোক। কিন্তু তার আগে তোমাকে আমার কথাই শুনতে হবে… যদি চাও আমি তোমার কথা শুনি তাহলে চলো কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলি তারপর যা বলবে তাই করব! গড প্রমিস!”
আনায়া:”বাজে বকা বন্ধ করুন..”
রিদিত:”দেখলে তো শুনলে না.. তাহলে আর কি এখন আমার কথাই শুনতে হবে.. বাইকে কি নিজে থেকে উঠবে নাকি আমি কোলে করে নিয়ে উঠাবো…”
আনায়া:”উঠবো না..!”
রিদিত:”ও তার মানে তুমি সত্যিই চাচ্ছো.. আমি তোমাকে কোলে নিই তা আগে বলবে না… ওকে!”
রিদিত তার দিকে এগিয়ে আসতেই আনায়া দ্রুত বলে,,

“ক-ক-কি করছেন..?”
রিদিত:”কেন তোমার ইচ্ছা পূরণ করছি..!”
আনায়া:”আমি আপনাকে কখন বললাম আমার ইচ্ছা পূরণ করতে…”
রিদিত:”এইতো মাত্রই বললে, তাই তো তোমাকে কোলে…”
আনায়া চিৎকার করে বলল,,
—”অসভ্য লোক… হেলমেট দিন আমার কাছে।আর সরে যান আমার কাছ থেকে…”
রিদিত বাইকে বসে মুচকি হেসে একটা লেডিস হেলমেট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,,
—”এই নাও..!”
আনায়া এক ঝটকায় তার থেকে হেলমেটটা নিল,তারপর সেটা মাথায় দিয়ে চুপচাপ বাইকের পিছনে গিয়ে বসলো। রিদিত মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিল।

কলেজের ক্লাস শেষে রোজকার মতন আজও পাশের একটা দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে খেতে খেতে প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ফারিন তবে আজ তার সাথে কেউ নেই। নেহা অসুস্থতার কারণে কলেজেই আসেনি,আরার স্টুডেন্টের সামনে পরিক্ষা তাই সে কলেজ থেকে সরাসরি স্টুডেন্টের বাসায় গেছে আর লিসা আর ইমনের বাসা তো অন্য রাস্তায়।ফারিন নিজ মনে আইসক্রিমটা খাচ্ছে আর গুনগুন করে গান করতে করতে যাচ্ছে। তখনই হঠাৎ একটা বাইক এসে থামল ওর পাশে।ও ততটা খেয়াল না করেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল তখনই পিছন থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসল,,

—”ফারিন.!”
ব্যাস্ত রাস্তায় নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়ায় ফারিন।পাশ ঘুরতেই সে দেখতে পায় বাইকের উপর বসা একজন যুবক। ফর্সা বর্ণের যুবকটির গায়ে কালো টি-শার্ট, তাতেই ফারিন বুঝে যায় এটা ইফরাত কারন ইফরাত সবসময়ই কালো কাপড় পড়ে।সে কিছু বলার আগেই ইফরাত বলে,,
—”আজ একা কেন..?”
ফারিন:”সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আপনাকে দিতে যাব কেন?”
ইফরাত:”না…মানে অন্যান্য দিন তো মাহেরা(নেহা),আরা থাকে তোমার সাথে তাই আর কি..!”
ফারিন:”হ্যাঁ,থাকে কিন্তু আজ নেই..কোনো সমস্যা..?”
বিয়াই:”আচ্ছা তুমি কি কখনো ভালো করে কথা বলতে জানো না..সবসময় শুধু ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর..!একটু রসকস দিয়ে,ভালোবেসেও তো কথা বলা যায় নাকি..?”
ফারিন:”কেন আপনি কি আমার বিয়াই লাগেন যে আপনার সাথে আমার রসকস দিয়ে ‌কথা বলতে হবে…?”
ইফরাত‌:”ধুর কি বলো বিয়াই কেন লাগতে যাব.?আমি তো আর কিছুদিন পর তোমার বোনের দুলাভাই হব..!”
ফারিন:”ভালো তা আমার বোন কি আপনি বানিয়ে নিয়ে আসবেন..?”

ইফরাত‌:”মানে..”
ফারিন:”মানে আমার কোনো‌ বোন নেই..!আর রাস্তায় মাঝখানে নাটক করবেন না,এখানে কোনো শুটিং চলছে না…যদি নাটক করার একান্ত প্রয়োজন হয় তাহলে যান সামনেই একটা থিয়েটার আছে…সেখানে যান আপনারও লাভ সাথে পরিচালকদেরও এমননিতেও তারা আপনার মতো ড্রামাবাজকেই খুঁজছে…”
ইফরাত‌:”আমার ভালবাসাকে তোমার নাটক মনে হয়…?
ফারিন:”উহু… একটুখানি ভুল হলো বাংলা সিনেমার নায়ক আছে না সাকিব খান ওর দেওয়া স্বস্তা ডায়লগ এর মতো ‌মনে হয়.!সবদিক থেকেই সেম শুধু একটা বুবলির অভাব….”
ইফরাত‌:”কিইইইই!”
ফারিন:”হুমমম..!”

ইফরাত‌:”আচ্ছা মানলাম আমি সাকিব খান তা তুমি কি হবে আমার বুবলি…”
ফারিন:”উহু… একদমই না। আমি তো ‌অপু বিশ্বাস হব আপনি যান কোনো বুবলিকে খুঁজে তার পিছনে পড়েন আর আমায় মাফ করেন…”
ইফরাত‌:”আমি ‌কোনো বুবলির সাথে ধলাধলি করলে তোমার কষ্ট হবে না বুঝি….?”
ফারিন:”হ্যাঁ হবে তো তখন আমি পেঁয়াজ কাটতে কাটতে কাঁদব আর গান গাইব,,
ফাইটা যায়…
বুকটা ফাইটা যায়…”

আর কোনঝ কথা না বলে ধুপধাপ পা ফেলে সেখান থেকে চলে যায় ফারিন। ইফরাত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।সে জানত ফারিন একটু দুষ্টু প্রকৃতির তাই বলে এতো! অন্যদিকে তাদের থেকে কিছুটা দূরে নিজের গাড়ির লুকিং গ্লাস দিয়ে ‌একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লক্ষ্যপাত করছিল সবটা।ফারিনের কান্ড দেখে সামান্য হাসির ঝলক ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে। কিন্তু পরক্ষণেই সে হাসি মিলিয়ে গেল,স্টিয়ারিংয়ের উপর থাকা হাতটা শক্ত হয়ে গেল। শুধু একটা শব্দে,,
—”I love you Farin. Love you from the deep in my heart…”
ফারিন ততক্ষণে অনেকটা দূরে চলে গেছে।তাই হয়তো শুনতে পায় নি। কিন্তু গাড়ির ভেতরে থাকা ব্যাক্তিটির চোখ আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।সে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ফারিনের সামনে চলে যায়। গাড়ি থামিয়ে ফারিনকে বলে,,
—”গাড়িতে উঠো…”

রাত প্রায় দশটা।প্রধান সড়ক থেকে ভেসে আসছে গাড়ির হর্নের আওয়াজ।বাড়ি জুড়ে অদ্ভুত‌ ‌নিস্তব্ধতা।সেই ‌নিস্তব্ধতার মাঝে নিজের নুপুরের ঝনঝন শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে রিমঝিম,হাতে একটা কাচের বোলে পায়েস জাতীয় কিছু।দুই তলার করিডোরের শেষ প্রান্তে এসে সে থামল। এটা তার জন্য কোনো সাধারণ কক্ষ নয়। এটা তার সবচেয়ে নিবেদিত মানুষটার কক্ষ। আর প্রাণ প্রিয়তমের কক্ষ। সে দরজার উপর আস্তে করে হাত রাখে, সামান্য ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে না দেওয়া দরজাটা খুলে যায়। রিমঝিম প্রবেশ করে রুমে। পুরো রুম অন্ধকার শুধু টিমটিম করে জ্বলছে একটা লাল ডিমলাইট। রিমঝিম পাশের একটা টেবিলে কাছের বোলটা রাখল। বিছানার উপর শুয়ে আছে তার নিবেদিত মানুষটি, অন্ধকারে ভালো করে দেখা না গেলেও রিমঝিম ঠিকই বুঝতে পারছে বিছানার উপর উপুর হয়ে শুয়ে আছে সে। রিমঝিম এগিয়ে গিয়ে দেখল মানুষটি কানে ব্লুটুথ হেডফোন গুঁজে শুয়ে আছে,পাশে ফোনে গান চলছে। দুষ্টুমি করে সে ফোন থেকে ব্লুটুথ কানেকশন অফ করে দিল। সাথে সাথে জোরে বেজে উঠলো গানটি,,
বিরহ নীলে নীলে বাধে বাসা…

অজানা ব্যথায়…
অধরা তারা গুলো কাঁদে বেদনায়…
খেয়ালী তুমি কোথায়….
মুহূর্তেই বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে রিমঝিমের ‌মুখে। অন্যদিকে জোরে গান বেঁজে ওঠায় দ্রুত চোখ মেলে তাকায় তানিম। রিমঝিম কে দেখে কিছুটা রাগী স্বরে বলে,,
—”তুই এখানে কি করছিস..?”

রিমঝিম:”কেন..? শিশিরের আসার কথা ছিল বুঝি…”
তানিম ঠিক হয়ে উঠে বসতে বসতে বলে,,
—”বাজে কথা বলিস না!আর কেন এসেছিস..?”
রিমঝিম মলিন হেসে বলে,,
—”এসেছিলাম তুমি কিছু খাওনি শুনে। কিন্তু এসো তো দেখছি…”
তানিম:”হয়ে গেছে না খাবার দেওয়া। এবার যা…”
রিমঝিম:”চলেই তো যাচ্ছি, এভাবে বলছ কেন? আচ্ছা শিশির আসলেও কি এভাবে বলতে..?”
তানিম:”বাজে বকিস না তো। আর যা এখান থেকে..”
রিমঝিম ভাঙা গলায় উঠলো,,

—”বলো না তানিম ভাই কি আছে শিশিরের মধ্যে যা আমার মাঝে নেই… কি এমন আকর্ষণশক্তি আছে ওর কাছে যা তোমাকে এত দূর থেকেও আকর্ষণ করে। বলোনা তানিম ভাই…বলো..বলো..”
রিমঝিম চিৎকার করে উঠলো চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। তানিম একবার তার দিকে তাকালো। মিষ্টি করে দেখতে মেয়েটি। গায়ের রং শিশিরেরই মতো কিন্তু সামান্য চাপা। উচ্চতা শিশিরের থেকে সামান্য বেশি। কোনো দিক থেকেই শিশিরের থেকে কম নয়। কিন্তু তবুও কেন জানি তানিমের চোখে সে কখনো শিশিরের মত হয়ে ধরা দিতে পারেনি। শুধু সে কেনো পৃথিবীর কোন অপরুপাই ধরা দিতে পারেনি। সে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে বলে,,
—”রিমঝিম…পাগলামি করিস না তুই দেখবি তুই একদিন আমার থেকেও ভালো কাউকে খুঁজে পাবি…”
রিমঝিম কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,,

—”আমার তোমার থেকে ভালো কাউকে নয়.. তোমাকেই লাগবে…”
তানিম:”এটা কখনোই সম্ভব নয় রিমঝিম। কারণ এই জীবনে আমার পক্ষে শিশির ব্যতীত অন্য কোনো নারীকে ভালোবাসাতো দূর পছন্দ করাও অসম্ভব….”
রিমঝিম:”তাহলে নাহয় আমি তোমার জন্য পরের জন্ম অব্দি অপেক্ষা করলাম…”
তানিম:”পরের জন্ম বলে আর কিছু হয় না রে পাগলি… আর হলেও আমি সেই জন্মেও শুধু শিশিরকেই চাইতাম…”
রিমঝিম আর কোন কথা বলতে পারলো না।সে এক দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। তানিম তার যাওয়ার মানে তাকিয়ে মনে মনে বলল,,
—”পারলে আমাকে মাফ করে দিস রিমঝিম.. তুই আমার জন্য অনেক কিছু করেছিস কিন্তু এর প্রতিদান হিসেবে আমি কখনোই তোকে ভালবাসতে পারব না…”

সন্ধ্যা নামতে চলল গোধূলী লগ্নে সূর্যটা যেন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সেই রক্তিম রঙা সূর্যের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে ব্রেঞ্জার লেকের স্বচ্ছ নীল পানিতে। আশপাশ থেকে ভেসে আসছে পাহাড়ি বিভিন্ন নাম না জানা ফুলের মিষ্টি সুবাস। প্রাকৃতিক এক অভূতপূর্ব সুন্দর মুহূর্তে একটা বৃত্তাকার দোলনার মাঝে বসে আছে শিশির।দোলনাটা অদ্ভুত সুন্দর,বৃত্তের চারিদিকে ফুলের মালার দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাজানো। এতো সুন্দর প্রাকৃতির মধ্যেও বিষণ্ন তার মন। যদিও সে খুশি, তবুও এক অন্যরকম বিষন্নতা জেঁকে আছে তাকে। আজকে রাতের ফ্লাইটেই বাংলাদেশ ফিরছে তারা। এটা নিঃসন্দেহে তার জন্য একটা খুশির খবর কিন্তু এতদিন এই কটেজে থেকে তারপর মায়া জন্মে গেছে শিশিরের। চলে যেতে হবে শুনেই কেন জানি খুব খারাপ লাগছে তার। তাই তো সেই বিকেল থেকেই এখানে এসে বসে আছে সে। হঠাৎই সে অনুভব করল তার পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। শিশিরের পিছন ফেরার প্রয়োজন হলো না ভেসে আসা রোজউড,চন্দন কাঠ,ভ্যানিলা, অ্যাম্বার এবং ভেটিভারের মিশলে সৃষ্ট একটি উডি এবং উষ্ণ সুগন্ধেই সে বুঝতে পারল তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান। নাহিয়ানের উপস্থিতি টের পেয়ে সে উঠে যেতে গেলেই ওড়নায় সামান্য টান লাগে।

শিশির:”কি হলো..ওড়না ধরেছেন কেন?”
নাহিয়ান নিশ্চুপ। শিশির আবার তাকে কিছু বলতে গিয়ে পিছন ঘুরতেই দেখতে পেল নাহি আর নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। তার ওড়নাটা দোলনার সাইটের একটা সূচালো জায়গার সাথে বিঁধে গেছে। সে নিজের বোকামির জন্য নিজেই লজ্জা পায়। তারপর ওড়নাটা ছাড়াতে যাওয়ার আগেই নাহিয়ান তা ছাড়িয়ে ওড়না সহ তাকে নিজের দিকে টান মারে। ওড়না সামলাতে গিয়ে শিশিরও তার দিকে চলে আসে। কাছাকাছি আসতে নাহিয়ান তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। শিশির কেঁপে ওঠে। তারপর নাহিয়ান আর কোন কথা না বলে তাকে কোলে তুলে নেয়। শিশির কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার আগেই নাহিয়ান বলে,,

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩২

—”অপবাদ যখন দিয়েছেন তখন একটু বেশি করেই নেই…..এমনিতেও অল্পতে এই নাহিয়ান চৌধুরীর হয় না…..”
শিশির আর কিছু বলতে পারেনা লজ্জায় নিজের মুখ লুকিয়ে নেয় নাহিয়ানের বুকের। নাহিয়ান মুচকি হেসে কটেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়….

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৪