মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩+৪

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩+৪
নওরিন কবির তিশা

শিশির একদম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল,
“আপনি তো দেখছি মারাত্মক অসভ্য! ফলো করতে করতে এবার আমার বাসায় পর্যন্ত চলে এসেছেন!”
লোকটি কিছু বলল না, শুধু গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখে কোনো ভাবান্তর নেই, যেন সে শুনছেও না।
নওরিফা খানম দরজা বন্ধ করে ভিতরে এসে বললেন,
“কি হয়েছে এত চিৎকার-চেঁচামেচি? বাসায় ঢুকেই শুরু করলি?”
শিশির হাত গুটিয়ে একেবারে রসিকতার সুরে বলল,
“আন্টি, আর বলো না! এই লোক হচ্ছেন ‘শুদ্ধ পুরুষ’! গাড়িতে কোনো মেয়েকে এলাও করেন না, এমনকি বিপদে পড়লেও না!”

তারপর আবার সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করে বলল,
“কিন্তু, কী মজার ব্যাপার জানো, মিস্টার শুদ্ধ পুরুষ? গাড়িতে মেয়েদের উঠতে দেন না, অথচ নিজে তাদের পিছু নিয়ে বাসা পর্যন্ত চলে আসেন! হাউ ফানি!”
নওরিফা খানম এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন,
“কি বলছিস তুই? ঠিক করে বল তো! তোর দেরি হলো কেন?”
শিশির হাত নাড়িয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আসলে রাস্তায় আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি সাহায্য চাইছিলাম এই লোকের কাছে, আর উনি কি বললেন জানো? ‘আমি আমার গাড়িতে কোনো মেয়ে এলাও করি না!’ ভাবা যায়!”
নওরিফা এবার সত্যিই অবাক হলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, লোকটি এতসব কথার মাঝেও একটুও নড়ল না, তার চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, যেন সে এক অনড় পাথর।
এইবার নওরিফা খানম একটু রাগান্বিত স্বরে বললেন,
“তুই এমনটা করলি কেন?
লোকটি,এতক্ষণ চুপ ছিল। এবার ধীর, ঠান্ডা গলায় বলল,
“মা, তুমি কি এখানে দাঁড়িয়ে এই মেয়ের সঙ্গে ফালতু কথা বলবে, নাকি আমাকে আমার রুমটা দেখিয়ে দেবে? আমি অনেক ক্লান্ত।”
শিশির একেবারে চমকে উঠল।

“এই লোক আন্টির বাসায় কেন রুম চাইছে?”
ঠিক তখনই নওরিফা খানম বললেন,
“তুই যা করেছিস, নুয়া’র সঙ্গে সেটা একদম ঠিক হয়নি। যদি কোনো সমস্যা হতো?” আসলে তিনি ছোটবেলা থেকে শিশির কে নুয়া‌ বলে ডাকে। শুধু সে নয় শিশিরের মা বাবা এমনকি এই পরিবারের সবাই তাকে নুয়া বলে ডাকে।
নওরিফা খানম এবার শিশিরের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
“আর তুইও, নুয়া, এটা নাহিয়ান। তোর নাহিন ভাই। ভুলে গেছিস? অবশ্য ভুলে যাওয়ারই কথা। এ কোন ছোটবেলায় দেখেছিস থাক, এখন এসব বাদ দে। নাহিয়ান, তুই ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি তোর জন্য খাবার তৈরি করি। কিন্তু তুই তো বলছিলে কালকের ফ্লাইটে আসবি।”
বলেই তিনি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
কিন্তু শিশির তখনো স্থবির..

“এটা… এটা কীভাবে হতে পারে? এই লোক… এই খাইস্টা বেয়াদব, যার মধ্যে বিন্দুমাত্র সৌজন্যবোধ নেই, সে-ই আমার প্রাণবন্ত নাহিন ভাই?! যে ছোটবেলায় আমাকে হাসাতো, যার সঙ্গে কত স্মৃতি ছিল?”
শিশির অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল, নাহিয়ান নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর পিছন থেকে ডেকে উঠল,
“আপনি কি আসলেই নাহিন ভাই? কিন্তু নাহিন ভাই হলে আমাকে ভুলে গেলেন কী করে?”
নাহিয়ান থেমে গেল।
ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়াল, চোখ তুলে তাকাল শিশিরের দিকে।
গভীর, রহস্যময় দৃষ্টি।
তারপর ঠান্ডা, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,

“Why? Are you a special one? যে তোমাকে আমার মনে রাখতে হবে?”
শিশির কপাল কুঁচকে ফেলল, “মানে?”
নাহিয়ান এবার একদম নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“আমি জীবনে অনেক মানুষকে চিনতাম, কিন্তু যারা গুরুত্বপূর্ণ না… তাদের মনে রাখার প্রয়োজন নেই।”
এক মুহূর্ত।
কথাটা যেন শিলার মতো শিশিরের মনে আঘাত করল।
নাহিয়ান কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল, নিজের রুমের দিকে।
শিশির হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর ধীরে ধীরে মুঠো বন্ধ করল।

“ওহ! তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমি অপ্রয়োজনীয়? গুরুত্বহীন?”
শিশির ধীরে ধীরে হেসে উঠল, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে কিছু একটা অদ্ভুত ছিল—একটা প্রতিজ্ঞা।
“বেশ! এবার আমি এমন কিছু করব, যাতে সারা জীবন আমাকে মনে রাখতে হয়, মিস্টার নাহিয়ান!”
নাহিয়ান তখনও সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছিল, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।
তার চোখে হালকা ঝলক খেলল।
তারপর, এক রহস্যময় মৃদু হাসি ঠোঁটে নিয়ে সে দরজা বন্ধ করে দিল।

রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যে যার মতন ঘুমাতে চলে গেছে।
কালকে এই বাড়িতে অনেক লোকজন আসবে।
পরশুদিন একটা ছোট্ট গেট-টুগেদার…
সাধারণত পারিবারিকভাবেই হবে, কারণ নাহিয়ান অনেক ছোটবেলায় পড়াশোনার তাগিদে বিদেশ চলে গিয়েছিল।
এরপর সে সিআইডি টিমে যোগ দেয় এবং তার কাজ অত্যন্ত নিখুঁত ও দক্ষ হওয়ার কারণে বড় বড় কেস সলভ করতে পাড়ায় মাত্র দুই বছরের ভেতরেই প্রমোশন পেয়ে যায়।
যার ফলে সে দেশে আসার সুযোগ পায়নি।
এরই মধ্যে পরিবারের অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক অনেকটা ছিন্ন হয়ে গেছে।

তাই এবার গেট-টুগেদারের মাধ্যমে সবার সঙ্গে তার দেখা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নাহিয়ানের বাবা-মা।
নাহিয়ানের বাবা, ইমতিয়াজ চৌধুরী, একজন বিশাল ব্যবসায়ী।তিনি “চৌধুরী গ্রুপস অফ ইন্ডাস্ট্রিজ”-এর সিইও। তার পর এই দায়িত্ব আসার কথা ছিল নাহিয়ানের ওপর… কিন্তু সে সিআইডির বড় পোস্টে চলে যাওয়ায় ব্যবসায় কোনো আগ্রহ নেই।
গেট-টুগেদারে শিশিরের বাবা-মারও আসার কথা ছিল…
কিন্তু শিশিরের বাবা, সিকদার শাহ, ব্যবসার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট মিটিংয়ের জন্য কালকেই বিদেশে যাচ্ছেন।
আর শিশিরের মা, রোদেলা জামান, স্বামীর সঙ্গে ব্যবসার শুরু থেকেই সহযোগিতা করছেন… তাই তাকেও যেতে হবে।

এজন্য তারা কালকের গেট-টুগেদারে থাকতে পারবেন না।
তাদের অনুপস্থিতিতে শিশিরও কিছুদিন তার আন্টির বাসায় থাকবে।
তবে এটা শিশিরের কাছে নতুন কিছু নয়…
শিশিরের বাবা-মা যখনই কোনো ক্লায়েন্ট মিটিং বা ব্যবসায়িক কাজে অন্য কোথাও যান, তখন তাকে নাহিয়ান মঞ্জিলে রেখে যান।
নওরিফা খানম এবং ইমতিয়াজ চৌধুরী শিশিরের বাবা-মার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড…
ঢাকা শহরের একমাত্র বিশ্বস্ত জায়গা নাহিয়ান মঞ্জিল, তাই এখানে শিশিরকে রেখে গেলে তারা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকেন।
তবে ইমতিয়াজ চৌধুরী ও নওরিফা খানম কেউই ঢাকার বাসিন্দা নন।
তাদের বাড়ি খুলনায়…

ব্যবসায়িক কারণে তারা এখানে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন এবং পরে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন।
তবে ইমতিয়াজ চৌধুরীর বাকি দুই ভাই, ইমরান চৌধুরী ও ইয়াকুব চৌধুরী, খুলনায় থাকেন।
তারা কালকে এখানে আসবেন। ইমরান চৌধুরীর দুই ছেলে-মেয়ে, নির্ঝর ও নিঝুম—তাদের সাথে শিশিরের বেশ ভালো সম্পর্ক।কিন্তু ইয়াকুব সাহেবের মেয়ে, ইয়ালিনা—ছোটবেলা থেকেই শিশিরকে সহ্য করতে পারে না!কেন? শিশির আজও তা বুঝতে পারেনি…
রাত গভীর……
চারপাশ নিস্তব্ধ……
ঘরের সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন…….
কিন্তু শিশিরের চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই।
সে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
এক পর্যায়ে সে উঠে ছাদের কার্নিশে এসে দাঁড়াল…
ঠাণ্ডা বাতাস তার চুলে আলতো স্পর্শ করছিল…
হঠাৎই…
নীরবতা ভেঙে তার কানে ভেসে এলো একটি গানের সুর।

🔹 তাইতো প্রেমের গান লিখেছি,
🔹 আর তাতে তোর নাম লিখেছি,
🔹 মাঝরাতে বদনাম হয়েছে মন!
গানের গলাটা অদ্ভুত রকমের পরিচিত…
শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে গেল শিশির…
কাছে যেতেই গান আরও স্পষ্ট হলো…
🔹 যেই না চোখের ইচ্ছে হলো,
🔹 তোর পাড়াতে থাকতে গেল,
🔹 ডাকনামে তোর ডাক গেলো মন!
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে…

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১+২

তারপর যা দেখল, তাতে তার ঠোঁট কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল!
এক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থেকে সে মনে মনে বলল—
“এই বেডা আবার কার প্রেমে পড়ল?! আল্লাহই জানে, কোন মেয়ের কপাল পুড়ল…”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫+৬