মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৪
নওরিন কবির তিশা
প্রায় তিন মাস পর নিজের বাড়ি দেখেই খুশিতে মন নেচে উঠল শিশিরের। দারোয়ান আফিফ গেট খোলার সাথে সাথে সে আনন্দে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে চিৎকার করে বলল,,
—”আঙ্কেল আঙ্কেল এখানেই দাঁড় করান.. প্লিজ..!
ড্রাইভার আংকেল:”কিন্তু মামনি আর একটু…!”
পাশ থেকে নাহিয়ান ড্রাইভার আংকেল কে বললো,,
—”আঙ্কেল থাক! আপনি গাড়ি এখানেই থামান ..!”
ড্রাইভার আঙ্কেল বেশি কথা না বাড়িয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। অন্যদিকে গাড়ির শব্দে শিশির কুঞ্জের ভেতর থেকে বের হয়ে আসলো নওরিফা খানম, ইমতিয়াজ চৌধুরী রোদেলা জামান,সিকদার শাহ,ইলমা সহ শিশিরের মামা বাড়ির প্রত্যেকে।আনায়া আর নির্ঝরাও এসেছে। শিশিরকে দেখে আনায়া ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। খুশির আবেগে তার গলা ভেঙে আসলো সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল,,
—”কোথায় হারিয়ে গেছিলিস শয়তান… বল কোথায় গেছিলিস আমাকে রেখে..? তুই কি খারাপ রে.. আমাকে রেখে চলে গেলি একবারও ভাবলি না আমার কথা..”
সত্যি সত্যি কান্না করে দিল আনায়া। তা দেখে শিশির আনায়ার পিঠে হাত বুলিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে বলল,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—”এমনভাবে কাঁদছিস মনে হচ্ছে আমি তোর হাজবেন্ড.. আর আমি হারায় গেলে তুই বিধবা হয়ে যাবি.. আমি তোর হাজবেন্ড না রে, তোর হাজবেন্ড তো রিদ…”
শিশির থেমে গেল। আনায়া শিশিরের পিঠে থাপ্পড় মেরে বলল,,
—”তুই কোনদিন ভালো হবি না তাই না রে..”
শিশির:”হব হব আমিও একদিন ভালো হব…”
একে একে সবার সাথে কথা বলল শিশির। সবাই তাকে জড়িয়ে ধরল, আদর করল, যেন সে ওই পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে।রোদেলা জামান আর নওরিফা খানম তো চুমু দিতে দিতে তার মুখশ্রী একেবারে ভরিয়ে তুলছিল।শেষমেষ শিশির বলল,,
—”নাও আমার মায়েরা এবার মাফ কর আমি হারাই যাই নি বেঁচে আছি আর তোমাদের সামনেই আছি ..”
একে একে শিশির কুঞ্জে প্রবেশ করলো সবাই।
শিশিরের রুমে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিল। সবাই বলতে শিশির, আনায়া,ইলমা আর নিঝুম। বড়রা নিচে কাজ করছে। শিশির নিঝুমের মায়ের হাতের সেমাই এর বরফি অনেক পছন্দ করে। তাই হাসনা চৌধুরী বরফি বানাচ্ছেন আর তাকে হেল্প করছেন নওরিফা খানম,আর পাশে রোদেলা জামান শিশিরের ফেভারিট পাস্তা বানাচ্ছে,সেই সাথে সৌজন্যের আম্মু টুকিটাকি হেল্প করছে সবাইকে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে গল্প করছেন ইমতিয়াজ চৌধুরী, সিকদার শাহ আর ইমরান চৌধুরী। নির্ঝর, সাজিদ আর নাহিয়ান মিলে গল্প করতে করতে ছাদে উঠেছে সেই সন্ধ্যায়। এখনো নামেনি। রোদেলা জামান রিয়াকে ডেকে বলল,,
—”রিয়া.. মা..যা তো তোর নির্ঝর ভাইয়া, সাজিদ ভাইয়া আর নাহিয়ান ভাইয়াকে কফি তিনটা দিয়ে আয় তো।
রিয়া:”আম্মু… আমাকে নুয়া আপু ডাকতেছিল উপরে…”
রোদেলা জামান:”একটুখানি দিয়ে আয় না মা.. তারপর যাস দেখ আমি এমনিই ব্যস্ত…”
রিয়া:”আচ্ছা…”
রোদেলা জামান পাশ থেকে সৌজন্যের আম্মু অর্থাৎ সানজিদা জামান কে ডেকে বলল,,
—”সানজু কফি তিন টা দে তো রিয়ার কাছে..”
সানজিদা জামান:”কোথায় রাখছিস রোদ…”
রোদেলা জামান:”ঐতো কিচেন কাউন্টারের কাছে…”
সানজিদা জামান:”আচ্ছা..”
সানজিদা জামান রোদেলা জামানের সম্পর্কে বড় হলেও তারা এইরকমই বান্ধবীর মতো। সানজিদা জামান কফি তিনটা রিয়ার কাছে দিয়ে হাসনা চৌধুরীর কাছে শুধালো,,
—”আচ্ছা আপা আপনারা আসলেন শিউলি আপারা আসলো না..”
হাসনা চৌধুরী বরফির শেপ দিতে দিতে তার দিকে ফিরে বলল,,
—”না আপা আসলে ইয়ালিনার সকাল থেকে মাথায় যন্ত্রণা করছিল এই জন্য..”
সানজিদা জামান:”ও আচ্ছা..”
এদিকে শিশিরের রুমে…
আনায়া:”শিশির তুই কি একটা গুড নিউজ জানিস?”
শিশির:”কিসের গুড নিউজ?”
আনায়া:”ইলা আপু আমি বলব নাকি তুমি বলবা?”
ইলমা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,,
—”তুমিই বলো..”
আনায়া:”আচ্ছা..”
এদিকে শিশির তাদের কথাবার্তার কিছু না বুঝে উদগ্রীব হয়ে বলল,,
—”আরে বলনা..”
আনায়া:”ম্যাম আপনি ফুপ্পি হতে চলেছেন!”
শিশির:”কিইই!”
সে ইলমার থেকে ফিরে বলল,,
—”সত্যি আপু!”
ইলমা মুচকি হেসে বলল,,
—”হুমম..”
শিশির আর নিজেকে সামলাতে পারল না ইলমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
—”congratulation আপু…আমি সত্যিই ফুপ্পি হব!
ইলমা:”হুম বনু!”
শিশির তাকে ছেড়ে দিয়ে আবদারের স্বরে বলল,,
—”শোনো..আপু ছেলে হলে নাম রাখব সাজ্জাদ আর মেয়ে হলে নাম রাখবো শাওলিন..”
ইলমা শিশিরের এমন বাচ্চামিতে হেসে বলল,,
—”আচ্ছা রেখো..!”
পাশ থেকে আনায়া বলল,,
—”নাম পরে রাখিস আগে তোর ভাই কি করেছে তাই শোন”
শিশির:”কি করেছে?”
আনায়া:”ইলা আপু এটা তুমিই বলো”
ইলমা:”তোমার ভাই আমাকে অ্যাসিডিটির ওষুধ এনে দিয়েছিল”
শিশির:”কেন?”
ইলমা:”ওইযে আমার বারবার বমি হচ্ছিল তাই”
শিশির এবার হেসে উঠলো।নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল,,
—”আমার ভাই যে হাবলা সেটা জানতাম কিন্তু এটা কি.!”
ইলমা:”তাহলেই বোঝো কাকে নিয়ে সংসার করি আমি! সেসব কথা বাদ দাও তুমি আগে বলো সুইজারল্যান্ড এ কেমন দিন কাটল তোমাদের?”
নিঝুম এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার সে বলল,,
—”হ্যাঁ বলো না আপু আমি তো তোমার কাছে সেই গল্প শোনার জন্যই বসে আছি”
এদিকে সুইজারল্যান্ডের নাম শুনতেই শিশিরের মনে পড়ে গেল গতকালের সেই সুন্দর মুহূর্ত টার কথা। যখন নাহিয়ান তাকে…..সে আর কিছু ভাবতে পারল না লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেল। এদিকে তার এমন হঠাৎ লাল হয়ে যাওয়ায় সবাই তার দিকে আড়চোখে তাকালো। তা দেখে শিশির বলল,,
—”কি ব্যাপার তোমরা এভাবে তাকাচ্ছ কেন?”
আনায়া তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,,
—”সুইজারল্যান্ডের নাম শুনেই তুই এমন লাল হয়ে গেলি কেন? ব্যাপার কি?”
শিশির:”ক-ক-ক-কই”
আনায়া:”আবার তোতলাচ্ছিস!এই সত্যি কথা বল কি হয়েছে?”
শিশির এই মুহূর্তে কি বলবে বুঝতে পারল না তখনই দরজার বাইরে থেকে সৌজন্য তাদের ডেকে বলল,,
—”ইলা আপু আয়ু আপু আর শিশির আপু রিদিত ভাইয়া এসেছে তাই সবাই তোমাদের নিচে ডাকছে..”
রিদিতের নাম শুনেই থমকে গেল আনায়া।সবার হয়ে জবাব দিয়ে শিশির বলল,,
—”সৌজ্য তুই যা আমরা আসছি”
সৌজন্য:”না ফুপ্পি আর আম্মু বলছে তোমাদের নিয়ে যেতে।”
শিশির সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
—”চলো তাহলে..”
ইলমা:”হুম চলো”
একে একে বেরিয়ে গেল সবাই। কিন্তু বের হয়নি এখনো নিঝুম। সৌজন্য তাকে ডেকে বলল,,
—”এই যে মিস গোবরিনি…আসবেন নাকি চলে যাব?”
নিঝুম বের হতেও যাচ্ছিল। কিন্তু সৌজন্যের এমন কথায় মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। সে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হয়ে সৌজন্যে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলল,,
—”কি বললেন আপনি? রিপিট করুন..”
সৌজন্য দুষ্টু হাসি হেসে বললো,,
—”কই কিছু নাতো!”
নিঝুম কিছু বলতে যাবে তার আগেই সিঁড়ি থেকে শিশির তাদের ডেকে বলল,,
—”কিরে তোরা আসবি না নাকি?”
নিঝুম সেদিকে ফিরে বলল,,
—”আসছি আপু তোমরা যেতে লাগো।”
তারপর ফের সৌজন্যের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”আপু ডাকল বেঁচে গেলেন না হলে বুঝিয়ে দিতাম আমাকে গোবরানি বলার ফল..”
নিঝুম দুপদাপ পায়ে নেমে চলে গেল। সৌজন্য সেদিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসলো।
—”তুই কি জানিস না হেডকোয়ার্টারের অবস্থা বহুত খারাপ চলতাছে।এই অবস্থায় যদি আজকে রাইতের ভিতরেই পাঁচটা বাচ্চা আর দুইটা মাইয়া জোগার না হয় তাহইলা নিজেদের কবর খোঁড়ার জন্য মানুষ রেডি কইরা রাখিস।”
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল ওই পাশে থাকা লোকটা। রাকিব ধপ করে বিছানার উপরে বসে পড়ল। ইদানিং অনেক বেশি চাপাচাপ চলছে। প্রথমত যেখানে তারা মহিলা আর বাচ্চাগুলো পাচার করে সেখানটা এখন সিআইডির নজরে আছে। বিভিন্ন এজেন্ট ছড়িয়ে রেখেছে গোপনে। কখন যে হামলা চালাবে তার কোনো ঠিক নেই। তার ওপর মালিকের এই চাপাচাপ।দেশের বর্তমান পরিস্থিতির ভিতর প্রতিদিন এইভাবে কিডন্যাপিং করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে তাদের পক্ষে। রাকিব বিছানার উপর বসে নিজের চুল টেনে ধরল। তখনই রুমে প্রবেশ করল সাবিহা।
সাবিহা:”আপনি কি ক্লান্ত?”
সাবিহা রাকিবের পাশে বসলো। রাকিব আলগোছে তার মাথাটা সাবিহার উরুর উপর রেখে চোখ বুজে বলল,,
—”আমি বিষন্ন সাবিহা”
সাবিহা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,
—”তাহলে বের হয়ে আসুন না এই পাপের রাস্তা থেকে। একদিন তো সবটা শেষ হয়ে যাবে বলুন পাপ কোনোদিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না”
রাকিব:”তোমার বয়স কম সাবিহা.. তুমি জানো না এই জীবনে কি কি দেখেছি আমি। কি বিষাক্ত আমার ইতিহাস। কি বিষাক্ত আমার অতীত..”
সাবিহা:”কিন্তু সেই বিষাক্ততা কাটানোর জন্য তো আমি আছি। বিশ্বাস করুন… একবার আপনি এই পাপ থেকে বের হয়ে আসুন আমি আপনার হাতে হাত ধরে সে বিষাক্ততাকে সুভাষিত ফুল করে তুলব।”
রাকিব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,,
—”এটা সম্ভব নয় সাবিহা। আমি এমন পর্যায়ে চলে গেছি যেখান থেকে মৃত্যু ব্যতীত অন্য কোন কিছু আমাকে এই পাপ থেকে আলাদা করতে পারবে না।”
রাত বারোটার কিছু বেশি।শিশির কিচেনে এসেছিল পানি নিতে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধতায় মোড়া। ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। দুই তলার করিডোর দিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিল সে হঠাৎই
উত্তর পাশের রুমটায় একবার উঁকি মেরে দেখলো। রুমেটাতে ঘুমিয়ে আছে নাহিয়ান।লাইটটা পর্যন্ত অফ করেনি সে। শিশির ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। নিঃশব্দে,যাতে নাহিয়ানের ঘুম না ভাঙ্গে। রুমে ঢুকে লাইট অফ করার পূর্বে শিশির একবার নাহিয়ানের দিকে তাকালো-এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে সে মাথার নিচে বালিশটাও ঠিক নেই, শিশির এগিয়ে গিয়ে বালিশ ঠিক করে দিতে দিতে নাহিয়ানকে পরখ করে দেখতে লাগল ঘুমিয়ে আছে নাহিয়ান,চোখে মুখে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা,শিশির তাকিয়েই থাকলো কি অপূর্ব লাগছে ঘুমন্ত নাহিয়ান কে। শিশির মনে মনে নিজেই নিজেকে ধমকিয়ে বলল,,
—”ছিঃ শিশির এভাবে হ্যাংলার মতো একটা পুরুষের দিকে তাকিয়ে আছিস। লজ্জা করছে না!”
পরক্ষণেই তার মনে হলো কিসের লজ্জা?এটা তো তার হালাল পুরুষ, তার একান্ত নিজের পুরুষ,তাহলে যদি সে তাকায়ও তাতে কি সমস্যা?আচ্ছা এত সুন্দর পুরুষটি সত্যিই তার হালাল পুরুষ!সে তাকিয়েই রইলো মুগ্ধভাবে। হঠাৎই নাহিয়ান গেয়ে উঠলো,,
“Aise Na mujhe tum Dekho…
Sine se laga lunga..
Tumko main chura Lunga tumse…
Dil mein chhupa Lunga…”
ঘুমে জড়ানো এক অদ্ভুত ঘোর লাগা কন্ঠ নাহিয়ানের। হঠাৎ নাহিয়ানের কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গল শিশিরের সেই সাথে ঘাবড়ে গেলে সে। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নাহিয়ান এক ঝটকায় তার হাত ধরে টান দিয়ে তাকে নিজের বুকের উপর ফেলে বলল,,
—”ঐভাবে কি দেখছিলেন ম্যাম?ক্রাস খেলেন নাকি?ক্রাস খেলেও লাভ নাই আমার ঘরে অলরেডি একটা সুন্দরী বউ আছে”
শিশির আমতা আমতা করে বলল,,
—”আ-আ-আপনি না ঘু-ঘুমিয়ে ছিলেন?”
নাহিয়ান:”হুমমম ছিলাম।তো?”
শিশির:”তা-তা-তাহলে বুঝলেন কি করে যে এখানে আমি?”
নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল,,
—”যতক্ষণ এই দুনিয়ায় বুকে আমার শ্বাস চলছে ততক্ষণ আমি যেই অবস্থাতেই থাকি না কেন আপনার অস্তিত্ব ঠিকই টের পাবো ম্যাম!”
শিশির মলিন হেসে কিছুটা অভিমানী কন্ঠে বলল,,
—”আপনার সুহাসিনীকেই কি এসবই বলেছিলেন নাকি….”
তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে তার ঠোঁটে নিজের তর্জনী আঙ্গুল ঠেঁকিয়ে নাহিয়ান বলল,,
—”আপনিই আমার হৃদয়ের বাগানে থাকা একমাত্র গোলাপ,যে প্রচন্ড শীতের রাতেও আমার জন্য ছড়িয়ে যায় গ্রীষ্মের উত্তাপ”
শিশির আর কিছু বলতে পারল না। নিজেকে লুকিয়ে নিল নাহিয়ানের বুকে।নাহিয়ান মুচকি হেসে বেড সাইড সুইচ দিয়ে লাইট অফ করে দিল।
সকালে ডাইনিং টেবিলে শিশির ব্যাতিত উপস্থিত সকলে।নিঝুমরা ব্রেকফাস্ট সেরেই রওনা হবে খুলনার উদ্দেশ্যে। আজকে ফোর্থ পিরিয়ডে ফাস্ট ইয়ারের হায়ার ম্যাথ ক্লাস আছে নির্ঝরের।আর সে কোনো মতেই ক্লাস মিস করতে পারবে না,কারন সামনেই ফাস্ট ইয়ারের টেস্ট। সকলে সেই তোড়জোড়েই ব্যাস্ত কিন্তু এখনো আসেনি শিশির। তা দেখে আনায়া বলল,,
—”আন্টি শিশির ওঠে নি?”
রোদেলা জামান কিঞ্চিত অবাক হয়ে বললেন,,
—”শিশির তো তোমার সাথে ঘুমিয়েছিল তা আমি কি করে বলবো ও উঠছে নাকি উঠে নি?”
আনায়া:”কি?আমি আর ও তো ওর রুমেই ঘুমিয়ে ছিলাম কিন্তু আন্টি ও তো পরে রুমে ছিলো না তাই আমি ভাবলাম হয়তো আপনার কাছে গিছে।”
রোদেলা জামান:”কই আমার রুমে তো আসে নি!”
আনায়া:”তাহলে ও গেল কোথায়?”
রোদেলা জামান সহ উপস্থিত সকলে অবাক হলো শিশির যদি নিজের রুমে না থাকে তাহলে গেল কোথায়?অন্যদিকে নিজের মনে নাস্তা খাচ্ছে নাহিয়ান।যেন এখানকার কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে। কিছুক্ষণ পর রিয়া সিঁড়ি দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”ঐতো নুয়া আপু”
সকালে সিঁড়ির দিকে তাকাল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে শিশির কোমর ছাড়ানো সোনালী চুলগুলো বাঁধনহারা।তাকে দেখে রোদেলা জামান বললেন,,
—”কোথায় ছিলি নুয়া?”
শিশির নামতে নামতে বলল,,
—”কেন রুমে”
রোদেলা জামান:”তা তো জানি কিন্তু কোন রুমে?”
শিশির:”কেন আমা..”
শিশির কথা শেষ করার আগেই আনায়া বলল,,
—”আমার সাথে তো ছিলিস না”
শিশির থেমে গেল এবার সে কি বলবে।সে তো বলতে চাচ্ছিল যে আনায়ার সাথে নিজের রুমে ছিলো।সে অসহায় দৃষ্টিতে নাহিয়ানের দিকে তাকালো। কিন্তু নাহিয়ান!সে নিজমনে মজা করে বাটার রোস্ট খাচ্ছে তা দেখে মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল শিশিরের।যার জন্য শিশির এখন এতবড় বিপাকে তারই কোনো হেলদোল নেই। বদমাশ অসভ্য বেহায়া লোক শিশিরের গালি ভান্ডারে যত গালি ছিলো সব দিয়ে সে মনে মনে গালাগাল করল। তারপর নিঝুমের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ল নিঝুম তো কাল রাতে একা ঘুমিয়ে ছিলো সে দ্রুত বলল,,
—”আ-আমি নিঝুমের সাথে ঘুমিয়েছিলাম”
নিঝুম খাচ্ছিল শিশিরের কথায় সে হঠাৎ ভিষম খেল। সবাই তার দিকে তাকাল হাসনা চৌধুরী তার দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলে বললেন,,
—”কি রে নিঝুম?সেই কখন থেকে আমরা শুনেছি নুয়া কোথায়?তুই চুপ করে ছিলি কেন?বলতে কষ্ট হচ্ছিলো যে নুয়া আপু আমার সাথে ছিলো।”
নিঝুম ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে মিনমিন করে বলল,,
—”আমিও কি জানতাম নাকি যে আপু আমার সাথে ছিলো!”
আর কেউ কোনো প্রশ্ন করার আগে শিশির বলল,,
—”আরে কালকে রাতে আমি পানি নিতে কিচেনে এসেছিলাম যাওয়ার সময় দেখি ও জেগে আছে তাই ওর কাছে বসে গল্প করছিলাম। এভাবে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারিনি”
পাশ থেকে নওরিফা খানম বললেন,,
—”আচ্ছা থাক হয়েছে আর এক্সপ্লেইন করতে হবে না।তুই বস নিশ্চয়ই অনেক খুদা পেয়েছে?”
শিশির আনায়ার পাশের চেয়ারটাতে বসতে বসতে বলল,,
—”হ্যাঁ আন্টি ভীষণ”
নওরিফা খানম:”আচ্ছা বস আমি কিচেন থেকে খাবার নিয়ে আসি।”
নওরিফা খানম চলে গেলেন কিচেনের দিকে।
রোদেলা জামান:”আচ্ছা মা তুই কি বাটার রোস্ট খাবি নাকি নুডুলস?আর চুলগুলো এভাবে খুলে রেখেছিস কেন?”
কথা বলতে বলতে তিনি এগিয়ে এসে শিশিরের চুলে হাত রাখলেন। চুল ভেজা শিশিরের।তা দেখে তিনি কিঞ্চিত অবাক হয়ে বললেন,,
—”এতো সকালে তুই শাওয়ার নিয়েছিস?”
আনায়া অবাক দৃষ্টিতে শিশিরের দিকে তাকালো। শিশির আমতা আমতা করে বলল,,
—”হ-হ্যাঁ”
রোদেলা জামান:”কেন?”
শিশির:”এমনি!”
রোদেলা জামান:”এমনি মানে?কি হয়েছে রে তোর?সকাল থেকে এমন অদ্ভুত আচরণ করছিস কেন?”
শিশির:”কই?”
পাশ থেকে সাজিদ হেসে বলল,,
—”ব্যাপার কি রে শিশির? প্রেমে-টেমে পড়ছিস নাকি? শুনছি প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ এরকম উল্টাপাল্টা কাজ করে!”
শিশির:”উল্টোপাল্টা কথা বলো না তো ভাইয়া! আমি আবার কার প্রেমে পড়ব?”
সাজিদ নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”কতজন আছে!”
শিশির:”আবোল-তাবোল কথা না বলে খাও তো!আর মা আমি আজ ভার্সিটি যাব তাই সকালে শাওয়ার নিয়েছি।আর তুমি তো জানো আমি ভার্সিটিতে প্রতিদিন গোসল করেই যাই।”
কথাটা বলেই উঠে চলে গেল শিশির। পিছন থেকে নওরিফা খানম ডেকে বলল,,
—”খেয়ে যা নুয়া!”
শিশির পিছন না ঘুরেই বলল,,
—”খুদা নাই”
নওরিফা খানম:”এই তো বললি খুদা পেয়েছে যেই সেই উধাও!”
সাজিদ:”আন্টি আমায় দিন তো বেচারী লজ্জা পেয়েছে!”
পাশ থেকে ইলমা রেগে গিয়ে বলল,,
—”তুমি চুপ করবে সাজিদ”
সাজিদ বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল,,
—”আমি কি করলাম?”
ইলমা:”বুঝতে পারছো না কি করেছো? বেচারি তোমার জন্য খুদা লাগা সত্ত্বেও খেতে পারল না”
সাজিদ:”কেন?আমি কি ওর মুখ আটকে রেখেছিলাম নাকি?”
ইলমা:”খেপাচ্ছিলে কেন?ও তো লজ্জায় খেতে পারল না!”
সাজিদ:”ওতো এইসবে আগে লজ্জা পেত না বরং আরো শখানেক প্রতিবাদী যুক্তি উপস্থাপন করতো যে আমি এইসব পছন্দ করি না,এসব ফালতু জিনিস, ছিঃ এসব কেউ করে নাকি? তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে ও আবার লজ্জা পেতে শুরু করল? তাহলে কি ও সত্যি…?”
ইলমা:”সাজিদ..!”
সাজিদ নিজের মুখে বাচ্চাদের মতো আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে বসে রইল। নাহিয়ান মাথা সামান্য নিচু করে মুচকি হাসলো।
নিঝুমরা চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। শিশির নিজের রুমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব বাঁধ ছিলো। হঠাৎই কোনরকম অনুমতির প্রয়োজন বোধ না করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো নাহিয়ান।তার পরনে ব্ল্যাক কালার টি শার্টের সাথে ব্ল্যাক কালার জিন্স। চুলগুলো এলোমেলো কিন্তু যথেষ্ট স্টাইলিশ। হাতের উপর ব্ল্যাক ব্লেজারটা ঝুলিয়ে রাখা।শিশিরের বিছানার উপর বসে হাতের ঘড়িটি ঠিক করতে করতে শিশিরের কাছে প্রশ্ন করল,,
—”হয়েছে আপনার?”
শিশির হিজাব বাঁধতে বাধঁতে আয়নায় একবার নাহিয়ানের প্রতিবিম্বের তাকালো শেষ পিনটা লাগিয়ে সে নাহিয়ানের দিকে ফিরে বলল,,
—”আমার হয়েছে কি হয়নি কি আপনার কাজ কি?”
নাহিয়ান তার দিকে ফিরে বলল,,
—”আমার কাজ কি মানে? আমার সাথেই তো যাবেন!”
শিশির:”আপনার সাথে যাবো মানে?আমি কি একবারও বলেছি আপনার সাথে যাবো?”
নাহিয়ান:”আমার সাথেই যাবেন এজন্য বেশি তর্ক না করে তাড়াতাড়ি রেডি হন টাইম হয়ে গেছে!”
শিশির:”আচ্ছা আপনি এরকম কেন!”
নাহিয়ান:”কি রকম?”
শিশির:”দুই মুখো সাপের মতন!”
নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল,,
—”তাই নাকি?”
শিশির:” হ্যাঁ অবশ্যই!”
নাহিয়ান:”তা আমি দু মুখো সাপ হওয়ার মত কি করলাম শুনি?”
শিশির মুখ বাঁকিয়ে বলল,,
—”ঢং! জানেন না কি করেছেন?”
নাহিয়ান:”না তো একটু বলুন না ম্যাম!”
শিশির:”আপনি একটা পাক্কা লেভেলের ধড়িবাজ লোক সকালে আপনার কারণে আমি এত বড় বিপদে পড়লাম আর আপনারই কোনো হেলদোল ছিল না মন তো বলতেছিল আপনাকে গিয়ে ঠাটিয়ে দুইটা থাপ্পর মারি!”
নাহিয়ান:”ওমা ওইখানে আমার দোষ কি ছিল?”
শিশির:”জানেন আপনাকে দোষ ছিল কালকে রাত্রে আপনিই আমাকে নিজের রুমে আসতে দেননি সকালে যখন সবাই শুনতে ছিল তখন নিজের মনে বাটার টোস্ট খাচ্ছিলেন!”
নাহিয়ান তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,,
—”তো আপনি কি চাচ্ছিলেন আমি সবাইকে বলি যে আমার বউ আমার সাথে ছিলো?”
নাহিয়ানের এমন এগিয়ে আসায় শিশির কিছুটা পিছিয়ে আমতা আমতা করে বলল,,
—”আমি কখন বললাম এটা বলতে আমি তো চাচ্ছিলাম আপনি অন্তত আমার দিকে তাকিয়ে একটু ভরসা দিন!”
নাহিয়ান আরো এক ধাপ এগিয়ে এসে বলল,,
—”সরি ম্যাম কিন্তু আমি তখন কোনো মতেই আপনার দিকে তাকাতে পারতাম না!”
শিশির আর এক ধাপ পিছিয়ে।
—”কেন?”
নাহিয়ান:”তখন তো আপনি আর নিজেকে দেখতে পারছিলেন না আপনি লজ্জা পুরো লাল টমেটো হয়ে গেছিলেন!আর ঐ অবস্থায় আমি যদি আপনার দিকে তাকাতাম তাহলে আই সয়ার আমি কন্ট্রোললেস হয়ে যেতাম!তখন ঐ ডায়নিং ভর্তি লোকজনের সামনেই…”
শিশির:”চুউউউউপ..”
কান লাল হয়ে গেল তার। নাহিয়ানের মুখ কি পরিমান লাগামহীন! আল্লাহ শেষমেষ তার কপালেই এমন একটা লাগামহীন, অসভ্য লোক পাঠালো! নাহিয়ান মুচকি হেসে তার দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে এসে বলল,,
—”এতক্ষণ আমায় অনেক কথা বলেছেন ম্যাম আমি সবটা মেনে নিয়েছি এবার আমার পালা আমার কাজটা আমায় নির্বিঘ্নে করতে দিন তো!”
নাহিয়ান শিশিরের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। তাদের দুজনের মধ্যে আর মাত্র দুই ইঞ্চি ফাঁকা।নাহিয়ানের এতো কাছাকাছি চলে আসায় তার শরীর থেকে ভেসে আসা তীব্র পুরুষালীর গন্ধে শিশিরের মাতাল মাতাল লাগছে।সে বহু কষ্টে নিজেকে সামলে বলল,,
—”ক-ক-কি করবেন?”
নাহিয়ান বাঁকা হেসে গেয়ে উঠলো,,
“lip kiss se te likhe dibo”
“lip kiss se te likhe dibo”
“dill ka love letter….”
শিশির কেঁপে উঠল।নাহিয়ান নিচু হয়ে শিশিরের অধরে নিজের অধরে মিলাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজার বাইরে থেকে রিয়া শিশিরকে ডেকে বলল,,
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩৩
—”নুয়া আপু তোমার হয়েছে?আয়ু আপু তোমায় নিচে ডাকছে!”
শিশির লজ্জায় দ্রুত সেখান থেকে সরে গেল। নাহিয়ান নিজের কাজে সফল হতে না পেরে তীব্র বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে অসন্তোষে উচ্চারণ করল,,
—”damn it!”