মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৭ (৩)
নওরিন কবির তিশা
নিউইয়র্ক রাত ৯ টা…..
নাহিয়ানের শ্যাডো হ্যাভনের বেজমেন্টে বসে আছে ২ জন স্পেশাল অপারেটিভ,২ জন ডেটা অ্যানালিস্ট আর একজন নতুন ইন্টার্নসহ এ আর নাহিয়ান চৌধুরী নিজেই। পুরো বেজমেন্ট জুড়ে গা ছমছমে নিস্তব্ধতা, ঠিক যেমন সিংহের গর্জন শেষে পুরো বনের প্রাণীরা ভয়ে চুপিসারে নিজের আস্তানায় গিয়ে লুকায় আর বনকে ঘিরে থাকে এক ভয়াল নিস্তব্ধতা ঠিক তেমন।
নিস্তব্ধতার কারণ একজনই নাহিয়ান। কিছুক্ষণ আগেই তার দেওয়া হুংকারে এখনো ভয়ে শিটিয়ে আছে উপস্থিত সকলের।বিশেষ করে ফিওনা নামক নতুন ইন্টার্নটি। ডেটা অ্যানালিস্টের দুজনই জাতীয়তায় জার্মানি,আর স্পেশাল অপারেটিভ এর মধ্যে একজন নাহিয়ান এর পুরাতন ফ্রেন্ড তনয়া আর অন্যজন আমেরিকান বিখ্যাত অপারেটিভ টিমের হেড, মার্ক রিডার।
কিছুক্ষণ আগে নাহিয়ানের ফোনে কল করে শেজাহান আর তাতেই রেগে গিয়ে সেলফোনটা সজোরে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারে নাহিয়ান,তাতে কেঁপে ওঠে উপস্থিত সকলে। তবে তনয়া শান্ত কারণ এটা তার খুব ভালো করেই জানা যে কাজের সময় নাহিয়ান কে ফোন করে ডিস্টার্ব করা নাহিয়ানের একদমই পছন্দ নয়।
আমেরিকায় বিগত কয়েক মাসের সন্ত্রাসী চক্র আর শিশু পাচারের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল নিয়ে কাজ করছিল তারা নিঃসন্দেহে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর এই সময় ফোন করে তাকে ডিস্টার্ব করা একদমই পছন্দ নয় নাহিয়ানের।এটা শেজাহান খুব ভালো করেই জানে তবুও কি জানি তার স্মৃতিভ্রম হয়েছিলো কিনা? তবে সেটা জানার প্রয়োজন বোধটুকু করেনি নাহিয়ান।
হঠাৎই নীরবতা ভেদ করে প্রাজ্ঞ জার্মান সাইবার-ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট অ্যানসেল্ম রিশটার বলল,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
——”এ আর,সাম্প্রতিক ডেটাগুলো দেখাচ্ছে মিশিগান আর নেভাডা অঞ্চলে হঠাৎ করে ডার্ক ওয়েবে তৎপরতা বেড়ে গেছে। এটা শুধু মানব পাচার নয়… কিছু এনক্রিপটেড চ্যাটে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক অপহরণের সম্ভাবনাও রয়েছে।”
তৎক্ষণাৎ পাশ থেকে গ্রেটা নামাক আর একজন ডেটা এনালিস্ট বলল,,
——”আরেকটা প্যাটার্ন আছে।আমরা কয়েকটা ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেট ট্রেস করেছি যেগুলো কিছু সন্দেহভাজন এনজিওর সঙ্গে জড়িত, যারা সন্ত্রাসে সহানুভূতিশীল। এই ফান্ডগুলো খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন সীমান্তে।”(ইংরেজি কনভারসেশন গুলোকে বাংলায় দিলাম)
নাহিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের গম্ভীর স্বরে বলল,,
——”আমরা কয়েক সপ্তাহ চুপ থাকলেই ইঁদুরগুলো নাচতে শুরু করে।অপারেশন রিকুইটাল’চালু করো। গ্রেটা, আমি লোকেশন চাই।”
তারপর সে অ্যানসেল্মের দিকে ফিরে বলল,,
——”অর্থের গতিপথ ম্যাপ করুন। আমার নজরদারিতে কেউ হারিয়ে যায় না।”
অ্যানসেল্ম:”স্যার, হোমল্যান্ডকে জানানো হবে কি? নাকি এটা পুরোপুরি অফ-দ্য-রেকর্ড থাকবে?”
নাহিয়ান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,,
——”আই থিঙ্ক হোমল্যান্ডকে এখন কিছু না জানালেও চলবে বিকজ এটা পুরোটাই আমার পরিকল্পনা, এখানে আমি কারো হস্তক্ষেপ চাইনা! আশা করি বোঝাতে পেরেছি!”
তখনই মার্ক রিডার বলল,,
——”বাট স্যার আই থিঙ্ক হোমল্যান্ডকে না জানিয়ে আমাদের কোনো কিছু করা ঠিক হবে না!”
নাহিয়ান:”সেটা আমি বুঝবো!”
মার্ক রিডার মাথা নিচু করে বলল,,
——”ওকে স্যার!”
নাহিয়ান:”আর…”
আর কিছু বলতে পারলো না সে তার আগেই তার পার্সোনাল সেল ফোন টা বারংবার ভাইব্রেট হতে লাগলো। সাধারণত এই নাম্বার পরিবারের লোকেরা ছাড়া আর কেউ জানে না, প্রায় তিনবার ভাইব্রেশন শেষে নাহিয়ান একবার ফোনটা হাতে নিয়ে তার স্কিনের দিকে তাকালো। তৎক্ষণাৎ চক্ষু চড়ক গাছ!স্কিনের উপর জ্বলজ্বল করছে তার সেট করা নিক নেম ‘Heartline’ অর্থাৎ শিশির।
ইতিমধ্যেই তিনবার কল দেওয়া হয়ে গিয়েছে তার, নাহিয়ান কিছুটা শংকিত কন্ঠে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে দ্রুত বলল,,
——”Excuse me, I’m sorry to say but I can’t talk anymore in this moment!”
কথাটা বলেই দ্রুত সেখান থেকে উঠে গেল নাহিয়ান। সকলে বেশ অবাক যে একটু আগে ফোন দেওয়ার জন্য সেল ফোনটা ছুড়ে মারল সেই কিনা একটা কলে এতটা ভয় পেয়ে গেল।ফিওনা তনয়ার দিকে ফিরে আবাক কন্ঠে শুধালো,,
——”Who called Sir, Mam?”
তনয়া নাহিয়ানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলল,,
——”I think Shishir!”
ফিওনা:”who is Shishir?”
তনয়া:”His everything!”
এদিকে নাহিয়ান দ্রুত বেজমেন্টের বাইরের একটা রুমে গিয়ে রিসিভ করলে ফোনটা। ভীত কন্ঠে সে বলল,,
——”I love you…”
বউ কথাটা বলার আগেই ফোনের ওই পাশ থেকে ভেসে আসলো এক বজ্র কন্ঠ,,
——”একদম নাটক করবেন না। উমম আইছে !I love you বউ!একদম ঐসব নাটক দেখাবেন না! গা জ্বালা করে আমার!”
একনাগারে কথাগুলো বলে থামলো শিশির। অতঃপর নাহিয়ান ভীত বলল,,
—”সরি ম্যাম! আসলে আমি খেয়াল করিনি…”
শিশির:”তা খেয়াল করবেন কেন? বিয়ে তো করেছেন লোক দেখানোর জন্য।না,না লোকও তো আপনি দেখান নি! বিয়ে করেছিলেন আমার জীবনটা নষ্ট করার জন্য!”
নাহিয়ান:”রাগটা কি একটু বেশিই হয়েছে?”
শিশির:”না না, রাগ কেন হবে? আমার তো সবকিছু মধু মধু লাগছে!”
নাহিয়ান:”আসলে…”
শিশির:”আসলে!কি আসলে? এখন তো এটাই বলবেন না যে আপনি খেয়াল করেননি, ফোন অফ ছিল অথবা ফোন আপনার কাছে ছিল না? এতই যখন অজুহাত আপনার কাছে রেডি আছে,তো আমাকে কেন বিয়ে করেছিলেন হ্যাঁ? আপনি যেমন টাইম পাসের জন্য আমার সাথে কথা বলেন সেরকম টাইম পাস এর জন্য অন্য কোনো একটা মেয়েকে বিয়ে করতেন। সেও আপনার সাথে দুই বেলা কথা বলে টাইম পাস করতো! আমার না টাইম পাস এর জন্য না পার্মানেন্ট একটা লোকের দরকার ছিল!”
নাহিয়ান:”বুঝেছি!”
শিশির:”কি বুঝেছেন?”
নাহিয়ান:”বউকে একটু বেশি বেশি টাইম দিতে হবে!”
শিশির তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,,
——”আবার ঢং করে বউ বলা হচ্ছে? বর হিসেবে কোন দায়িত্বটা পালন করেন আপনি? জানেন এখানে সবাই কি পরিমান মজা করছে? ইনায়া আপু জাহিদ ভাই, নির্ঝর ভাই ফারিন, অন্যদের কথা তো বাদই দিলাম রিদিত ভাই আনায়াকে না দেখে থাকতে পারেনা বলে হলুদের দিন মহিলাদের ছদ্মবেশে আনায়ার সাথে দেখা করতে এসেছিল! আর আপনি! হাহ”
একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসলো শিশিরের বুক চিরে, মোবাইলের ওই পাশ থেকেও নাহিয়ান সেটা অনুভব করতে পারল। নাহিয়ানেরও মন খারাপ হলো বেশ। কিন্তু সে নিরুপায়। সে যে কেন এখানে এসেছে সেটা তো শুধু সেই জানে।ব্যাপারটা এতটাই গোপনীয় যে শিশিরের সাথেও সেটা শেয়ার করতে পারছে না সে। কিন্তু এই মুহূর্তে শিশিরের রাগ ভাঙ্গানোটা অতীব জরুরী।
নাহিয়ান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল শিশিরের রাগ যদি না কমে তাহলে এক রাতের জন্য হলেও নাহিয়ান বাংলাদেশ ব্যাক করবে। সে নরম কোমল কন্ঠে শিশির কে বলল,,
——”I love you বউ!”
শিশির: চুপ করুন আপনি আপনার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই আমার!”
নাহিয়ান:”I love you বউ!”
শিশির:”বললাম তো চুপ করুন!”
নাহিয়ান:”I love you বউ!”
শিশির:”ফোনটা কিন্তু এবার কেটে দিবো!”
নাহিয়ান:”I love you বউ!”
শিশির:”But I hate you!”
নাহিয়ান খুব ভালো করেই জানে শিশির এটা অভিমানে বলছে, তবুও তার মুখের ঘৃণার শব্দটা নাহিয়ানের বুকে যেন বিষাক্ত তীরের মতো বিধছে। সে ফের বলল,,
——” I love you বউ!”
শিশির আর কিছু বলতে পারল না, সে খুব ভালো করেই জানে সে যতবার নাহিয়ান কে ঘৃণার কথা বলবে নাহিয়ান ততবারই একই ভালবাসার দাবি সেই একই গভীর কন্ঠে পুনরাবৃত্তি করবে। আর হাজার হলেও শিশির নাহিয়ান কে ভালবাসে। তাই তাকে বারবার ঘৃণার কথা বলা সম্ভব হবে না শিশিরের পক্ষে। আর এটাও তো সঠিক নাহিয়ান দিনের ভিতর অন্তত ৫ বার শিশিরকে কল করে।
মাঝে মাঝে তো শিশিরের পক্ষেই ধরা সম্ভব হয় না। তাই প্রথমবারের মতো নাহিয়ান কে মাফ করে দেওয়াই যায়। সে শান্ত কন্ঠে বলল,,
——”আচ্ছা নিন হইছে! এবারের মতো মাফ করলাম কিন্তু ফর দ্যা ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট টাইম! পরের বার যদি আর কখনো এরকম হয় তবে কোনদিনই আর কথা বলবো না আপনার সাথে!”
নাহিয়ান:”এ দেখো কানে ধরছি আর কখনো হবে না!”
শিশির:”মনে থাকে যেন!”
নাহিয়ান:”সারা জীবন মনে থাকবে ম্যাম!”
শিশির কিছুক্ষণ থেমে তারপর বলল,,
——”এখন তো নিউওয়ার্কে রাত তাই না?”
নাহিয়ান:”জ্বি! রাত প্রায় সাড়ে নয়টা!”
শিশির:”ও আচ্ছা! খেয়েছেন আপনি?”
নাহিয়ান:”না!”
শিশির:”কেন?”
নাহিয়ান:”কাজ একটু ব্যস্ত ছিলাম।আর বউটাও পাশে নেই।থাকলে হয়তো নিজের হাতে খাইয়ে দিত আমায়!
শিশির:”ঠিকই হয়েছে!আর একটু বউকে রেখে,যান অন্য দেশে!”
নাহিয়ান:”তাই তো দেখছি।বউকে রেখে আসা একদমই উচিত হয়নি! এরপর থেকে যেখানেই যাই বউকে সাথে নিয়েই তবে যাব!”
শিশির:”ঠিক আছে! এবার তাহলে খেয়ে নিন গিয়ে!”
নাহিয়ান:”না এখন খাব না!”
শিশির:”কেন?”
নাহিয়ান:”একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিংয়ে ছিলাম। সেটা শেষ করে তারপর!”
শিশির অবাক কণ্ঠে বলল,,
——“আপনি মিটিংয়ে ছিলেন?”
নাহিয়ান:“হুমম!”
শিশির:“ওওহ সিট! সেটা আপনি আগে বলবেন না! নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং? আমি সব বানচাল করে দিলাম!”
নাহিয়ান:“আপনার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়!”
শিশির:“আপনি রাখুন তো!আর যান দ্রুত মিটিংয়ে যান! আল্লাহ আমার জন্য!”
নাহিয়ান:“As your wish mam!”
শিশির:“হ্যাঁ,রাখুন!”
কথাটা বলেই সে ফোন কেটে দেওয়ার আগে নাহিয়ান আবারও বলল,,
——“আর At last I love you!”
শিশির তার কথায় ফোন কেটে দিয়ে আনমনে মুচকি হাসলো। এই লোকটাও না!
আজকের রাতে আনায়াদের মেহেদী কালকে বিয়ে। পুরো বাড়ি জুড়ে এক চাঞ্চল্যকর পরিবেশ, সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে, কেউ ডেকরেশনের লোককে গাইড দিচ্ছে, কেউবা রাতে মেহেদী তে কি পড়বে তাই নিয়ে আলোচনা করছে। ফারিন সারা সকাল শিশির আর আনায়ার সাথে গল্প শেষে দুই তলার করিডোর দিয়ে সবে নিচে যাচ্ছিল। তখনই হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডাক দিল,,
——“ফারু আপি!”
ফারিন পিছন ফিরে দেখল তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সিমরান। বয়স হয়তো ছয় অথবা সাত। ইদানিং ফারিন এর সাথে বড্ড ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। তবে এটা নতুন কিছু নয় বড়দের চেয়ে বাচ্চাদের সাথে ফারিনের একটু বেশি ভালো সম্পর্ক অতি দ্রুত তৈরি হয়।তাকে দেখে ফারিন এক গালে হেসে বলল,,
——“আরে সিমু! কিছু বলবে?”
সিমরান হাতে একটা গাজরা আর একটা চিঠিমতো কিছু নিয়ে এগিয়ে আসলো তার দিকে।
সিমরান:“হ্যাঁ আপি!”
ফারিন:“কি?বলো!”
সিমরান গাজরা সহ চিঠিটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,
——“একটা ভাইয়া তোমাকে এটা দিতে বলেছে!”
ফারিন কিঞ্চিৎ কুঁচকে গাজরা আর চিঠিটা হাতে নিল। চোখ সরু করে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে সে সিমরানকে বললো,,
——“কোন ভাইয়া?”
সিমরান:“ওই যে লম্বা করে ভাইয়াটা!”
ফারিনের মনে যেন বসন্তের পবন দোলা দিলো।তার মানে সে যা ভাবছে সেটাই কি সত্যি! নির্ঝরই তাকে? সে আর কিছু ভাবতে পারলো না।সিমরানের দিকে চেয়ে সে উত্তেজিত কন্ঠ শুধালো,,
——“ভাইয়াটা কী শ্যামলা? মানে একটু কালো করে?”
সিমরান স্বভাবসুলভ হেসে মাথা নাড়ালো। ব্যাস সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল ফারিন। এবার সে নিশ্চিত হলেও কাজটা নির্ঝরই করেছে! মানে নির্ঝর তাকে চিঠি সহ গাজরা দিয়েছে! এটাতো তার কল্পনাতীত! দ্রুত সিমরানকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেল রুমের দিকে।
রুমে এসে ফারিন দেখতে পায় কোথাও নেই নির্ঝর। হয়তো ওয়াশরুমে গিছে। কিন্তু সেসব বিষয় নিয়ে আর কিছু না ভেবেই ফারিন গাজরাটা হাতে পড়ে নিল, অতঃপর চিঠিটা খুলে একটু জোরে জোরেই পড়তে লাগলো।
আমার প্রাণপ্রিয়তমা
হ্যাঁ ফারিন তোমাকেই বলছি!আসলে আমি নিজের অনুভূতি সম্মূখে প্রকাশ করতে ব্যর্থ।তাই তোমার সামনে থাকা সত্ত্বেও তোমাকে নিজের মনের অভিব্যক্তি জানাতে পারিনি।যাই হোক আজ এই চিঠির মাধ্যমে আমি তোমাকে আমার অনুভূতি আমার হৃদয়ের তীব্র বাসনা জানাতে চাই।
I Love……
বাকিটা আর পড়তে পারল না ফারিন।তার আগেই তড়িৎ বেগে তার দিকে এগিয়ে এসে তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে তা টুকরো টুকরো করে ফেলে নির্ঝর।ফারিন হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে মূহূর্ত খানিক পর বলে,,
——“এটা কি করলেন?”
নির্ঝরের চোখে তখন আগ্নেয়গিরির রক্তিম আভা। ভয়ে এক পা পিছিয়ে যায় ফারিন। থতমত খেয়ে সে বলে,,
——“না মানে ওভাবে ছিঁড়লেন…”
নির্ঝর:“তাহলে কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাসলীলা দেখতাম?”
ফারিন:“মানে কি?চিঠিটা সিমরানের কাছে আপনি দিয়েছিলেন না?”
নির্ঝর:“আমি মেরুদন্ডহীন নই।যে নিজের স্ত্রীর কাছে ভালোবাসার বার্তা পাঠাতে মাধ্যম ব্যবহার করব।আমি যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে স্ত্রীকে ভালোবাসার প্রমানক নিজে দিতে সক্ষম!”
নির্ঝর এমন কঠিন কঠিন কথা মাথার এক হাত উপর দিয়ে গেল ফারিনের। তবুও একটা জিনিস সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারল যে চিঠিটা নির্ঝরের লেখা নয়।তবে কার লেখা?সে নির্ঝরকে প্রশ্ন করে যাওয়ার আগেই শক্ত হাতে তার হাতটা চেপে ধরল নির্ঝর।ফারিন অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই নির্ঝর শুধু বলল,,
——“চলো..”
ঘন্টাখানেক পর
ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বহুমান্য স্বর্ণালঙ্কার বিপণী’রূপভূষণ জেমস অ্যান্ড জুয়েলস’।ঠিক যেন রাজপ্রাসাদের মতো এক দীপ্তিমান অট্টালিকা। প্রাসাদের মতো সেই স্থাপনার কাঁচে ঘেরা সুদৃশ্য শো-রুমে পা রেখেই ফারিনের চোখ ঝলসে গেল। চারিদিকে সোনার ঝলমলে আলোকচ্ছটা, অভিজাত সৌরভ, আর ভেতরে প্রবেশমাত্র কাস্টমারদের উদ্দেশ্যে মাথা নোয়ানো নম্র বিক্রয় সহকারীরা——সব মিলিয়ে এক রাজকীয় আবহ।
নির্ঝর তার ডানহাতে ফারিনের হাতটা শক্ত করে ধরে ভেতরে প্রবেশ করলো। আর ভিতরে প্রবেশ করতেই ফারিনের চোখ কপালে ওঠার দশা।ঝলমলে আলোর নিচে থরে থরে সাজানো আছে শত সহস্র হীরা, পান্না, চুনি আর খাঁটি সোনার দ্যুতিময় অলংকার।আশপাশে জড়ো হয়ে গেল তিন-চারজন স্টাফ। কোনো কথার অপেক্ষা না করেই নির্ঝর বলল,,
——“আপনাদের এখানে যতরকম বালার কালেকশন আছে, সবগুলো বের করুন। আর এখানে তো নোজ রিংয়ের কালেকশন ভালো তাই না?”
স্টাফগুলো মাথা নাড়িয়ে বলল,,
——“জ্বী স্যার। আমাদের এখানে সমস্ত রকম স্বর্ণের কালেকশন পাবেন। এগুলো ঢাকার অন্যান্য জুয়েলার্সের থেকে ইউনিক আর রেয়ার!আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে!”
নির্ঝর গম্ভীর মুখে বলল,,
——“গুড! তাহলে নোজ রিংয়ের কালেকশন গুলোও দেখাবেন একসাথে!”
স্টাফ দুটো সম্মতি জানিয়ে চলে যেতেই ফারিন। নির্ঝরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করল। তৎক্ষণাৎ নির্ঝর ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,
——“কি সমস্যা?”
ফারিন:“আপনার কি সমস্যা?”
নির্ঝর:“মানে?”
ফারিন:“মানে.. একটু আগে আপনি চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললেন। মেনে নিলাম সেটা ঠিক আছে।তারপর আবার গাজরাটাও আমার হাত থেকে নিয়ে রাস্তায় পা দিয়ে পিষে দিলেন। আবার এখন এখানে এসে সোনার কালেকশন দেখছেন।কি হয়েছে টা কি আপনার?”
নির্ঝর:“ও তার মানে তুমি গাজরাটা তোমার হাতে রেখে দেওয়া উচিত ছিল এ কথা বলতে চাইচ্ছো?”
ফারিন:“যা বাবা আমি আবার এ কথা কখন বললাম?”
নির্ঝর:“মাত্রই বললে!”
ফারিন:“একদমই না আমি আপনাকে বোঝাতে চেয়েছি যে,কাজটা আপনি ভালো করেননি। কারণ ফুলকে পায় পেষা কোনো স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের কাজ বলে আমার মনে হয় না!”
নির্ঝর গভীর কন্ঠে বলল,,
——“তাহলে মেনে নাও আমি স্বাভাবিক মানুষ নই!”
ফারিন ঠিক বুঝলো না তার কথা। তাই সে ফের প্রশ্ন করল,,
——“মানে?”
নির্ঝর: “কিছু না!”
কিছুক্ষণ পর ডিস্কে সাজানো হলো প্রায় ২৫ জোড়া বালা। নির্ঝর ফারিনের দিকে ফিরে বলল,,
——“দেখো কোনগুলো পছন্দ হয়”
ফারিন:“আমি এসব পরি না!”
নির্ঝর:“তাহলে কি পরো?পরপুরুষের দেওয়া গাজরা!”
ফারিন অবাক হয়ে বলল,,
——“মানে?”
নির্ঝর:“তুমি পরো কি পরো না সেটা আমি জানতে চাইনি আমি জানতে চেয়েছি কোন জোড়া ভালো লাগে দেখো!”
ফারিন:“কোনো জোড়াই ভালো লাগেনি!”
নির্ঝর বুঝলো ফারিনকে প্রশ্ন করে কোনো লাভ হবে না তাই সে আর প্রশ্ন না করে নিজেই সেখান থেকে একজোড়া বালা পছন্দ করে হাতে তুলল অতঃপর ফারিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—“দেখি হাত দুটো?”
ফারিন নির্ঝরের দিকে ফিরে বলল,,
——“হাত দিয়ে কি হবে?”
নির্ঝর ফারিনের এমন বোকা প্রশ্নের রেগে গিয়ে বলল,,
——“বালা নিশ্চয়ই মানুষ মাথায় পরে না? হাতেই পরে! আর বালা যেহেতু তোমাকে সাথে নিয়ে এসে কিনেছি সেহেতু এটা আমি নিজে পরার জন্য নিশ্চয়ই কিনব না! তাই আর কোন কথা না বলে হাত বাড়াও!”
ফারিন:“আমি এসবে কাম্ফোর্টেবল নই আমি এগুলো পরতে পারব না!”
নির্ঝর: “কম্ফোর্টেবল না হলে এখন থেকে অভ্যাস করে নাও। কেননা এখন থেকে তোমার এগুলো পড়া লাগবে। নিয়মিত! ভুলে যেও না তুমি এখন আর আগের মত অবিবাহিত নেই যে এগুলো তোমার অভ্যাস নেই বলে পরবে না! নাউ ইউ আর ম্যারিড উইথ মি! সো এগুলো তোমার পরা লাগবে!”
নির্ঝরের এমন কথা বার্তায় ফারিন কিছুটা অবাক হল। তবে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নির্ঝর তার হাত দুটো সযত্নে নিজের কাছে এনে বালা জোড়া তার দুই হাতে পরিয়ে দিল। ফারিণের ফর্সা হাতে সোনালী বালা জোড়া চিকচিক করছিল। এতটাই মোহনীয় লাগছিল যে মনে হচ্ছিল এই বালাজোড়া তার জন্যই তৈরি! নির্ঝর সেদিকে তাকিয়ে বলল,,
——“পারফেক্ট!”
ফারিন নিজেও তার হাতে তাকিয়ে দেখলো আসলেও বালা জোড়া অনেক সুন্দর মানিয়েছে তার হাতে।। বালা জোড়া পরানো শেষে নির্ঝর আরেকজন স্টাফ কে বলল,,
——“নোজ রিংটা?”
তারা নির্ঝরের বর্ণনা অনুযায়ী একটা ডায়মন্ডের নোলক এনে তার সামনে রাখলো। নোলকটা আকৃতিতে ছোটও না আবার বেশি বড়ও না মাঝারি আকৃতির বলা চলে। নির্ঝর নোলকটা হাতে নিয়ে ফারিনের নাকের দিকে হাত বাড়াতেই ফারিন তুমুল বিরোধিতা করে বলল,,
——“দেখুন স্যার। বালা পর্যন্ত মেনে নিয়েছি কিন্তু এই নোলক পড়া আমার পক্ষে একদম অসম্ভব!”
নির্ঝর:“ইউ নো ভেরি ওয়েল দ্যাট আমি এক কথা দুই বার বলতে পছন্দ করি না।তবুও শুধুমাত্র তোমার জন্যই বলছি অভ্যাস না থাকে তো অভ্যাস করে নাও। কেননা এটা মুসলমান মেয়েদের ম্যারিড সাইন। আর সারাদিন যেভাবে কুমারীদের মত ঘুরে বেড়াও কে দেখলে বলবে যে তোমার বিয়ের দুই মাস পূর্ণ হয়েছে!”
ফারিন আস্তে করে বলল,,
——“যে বিয়ে? বাসর রাতে হায়ার ম্যাথ!”
ফারিনের শেষে বলা বাসর রাতে হায়ার ম্যাথ কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই নির্ঝর কিছুটা নিচু হয়ে ফারিন এর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,
——“ডোন্ট ওয়ারি! এবার বাসায় চলো বাসর রাতের অরজিনাল ক্লাসটাই নিব তোমার!”
ফারিন চমকে তাকালো নির্ঝরের দিকে মাত্র নির্ঝর কি বললো!এটা কি সত্যি? নাকি সে আবার দিবাস্বপ্ন দেখছে। তবে সে কোনো প্রশ্ন করতে যাওয়ার আগেই নির্ঝর তার ডান হাতে নথটি ধরে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে ফারিনের নাকের ছিদ্রের প্রান্তরেখার দিকে ইঙ্গিত করলো। তার স্পর্শে ফারিনের সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। নির্ঝর অত্যন্ত সাবধানে,পরম মমতায় ফারিনের নাকের পাটিতে সেই হীরা বসানো স্বর্ণের নথটি পরিয়ে দিল।
নথ পরানোর সময় নির্ঝরের নিশ্বাস ফারিনের মুখে এসে পড়ছিল, সেই উষ্ণ নিশ্বাসের স্পর্শে ফারিনের হৃদয়তন্ত্রীতে যেন এক অচেনা সুর বেজে উঠলো।
ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ জানান দিচ্ছে সন্ধ্যা সাতটার। ড্রয়িং রুমে সব মেয়েরা মিলে ব্যস্ত মেহেদী লাগাতে, সাউন্ড বক্সে বিভিন্ন সময় বাসে বিভিন্ন গান। দুই তলার করিডোর থেকে একজন প্রবীণ বয়স্কা বলল,,
——“লাগাও লাগাও মেহেদি লাগাও।আজ বোঝা যাবে কারো স্বামী তাকে কতটা ভালোবাসে!”
আনায়া তার দিকে ফিরে বলল,,
——“বুবু তুমিও লাগাও! দেখি আমাদের দাদু তোমায় কত ভালোবাসে?”
বয়স্কা মহিলা টি বলল,,
——“আমাদের ভালোবাসা তো আর এই যুগের ভালোবাসা না। তখন আর তোমাদের মতো দেখা-সাক্ষাৎ হতো না আমাদের চিঠির মাধ্যমে কথোপকথন হতো তাই আমাদের ভালোবাসা একটু বেশিই গাঢ়! দেখা গেল মেহেদির রং এতটা গভীর হলো যে আমার হাত দুইটা ধরেই কালো হয়ে গেল!”
তার কথায় শিশির হেসে বলল,,
——“বাব্বা! কি কনফিডেন্স?”
বয়স্কা মহিলাটি:“কনফিডেন্স তো অবশ্যই আছে!”
মহিলাটি চলে গেল। শিশির ফারিন এর দিকে ফিরে বলল,,
——“আচ্ছা ফারু?”
ফারিন মেহেদি লাগাতে লাগাতে বললো,,
——“হুম আপু?”
শিশির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,
——“আজকে তোমাকে কেমন অন্যরকম লাগছে? না মানে নাকে নথ, হাতে বালা! পুরাই বাঙালি বধূদের মত লাগছে! তা তুমি হুট করে এত কিছু কোথায় পেলে। আর আমি যতদূর জানি দুপুরের দিকে তোমরা বাসায় ছিলে না। তুমি আর নির্ঝর ভাই কোথাও কি গিয়েছিলে?”
দুপুরের কথা মনে পড়তে ফারিন লজ্জায় মাথা নোয়ালো। শিশিরও কি কম যায়?সে দুষ্টু হেসে ফের শুধালো,,
——“এই বলো বলো লং ড্রাইভ এ গিয়েছিলে নাকি?”
ফারিন:“আরে সেরকম কিছু না আপু আসলে…”
শিশির বাম ভ্রুটা নাচিয়ে বলল,,
——“আসলে কি?হুম!”
ফারিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে আগমন ঘটে জিসানের। এসেই শিশিরের মাথায় একটা গাট্টা মেরে সে বলে,,
——“তোর এই অতিরিক্ত গোয়েন্দাগিরি করার মাত্রাটা কোনোকালে কমবে না বল? যাকে দেখিস তাকেই তোর জেরা করতে বসতে হয়? তুই জীবিকার না নিয়ে পড়ে ল নিয়ে পড়তে পারতিস!ট্রাস্ট মি তোর ঐ শকুনের মতো চোখ দুইটার খবল থেকে কোনো দোষী বেঁচে ফিরতে পারত না!”
শিশির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,,
——“শা*লা হাঁদারাম! আগে বল আমার মাথায় গাট্টা কেন মারলি?”
জিসান শিশির আর ফারিন এর সামনের সোফাটিতে বসতে বসতে অলস ভঙ্গিতে বলে,,
——“ইচ্ছা করছিল তাই!”
শিশির:“ইচ্ছা তো আমারও অনেক কিছু করছে। কিন্তু হাতে মেহেদি বলে আজকে বেঁচে গেলি!”
জিসান এক ঝলক ফারিন এর দিকে তাকায়। মেয়েটাকে আজকে অন্যান্য দিনে তুলনায় আরো বেশি সম্মোহনীয় লাগছে। অন্যরকম সৌন্দর্যের আবেশ ঘিরে আছে তাকে। জিসান নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলো ফারিন এর দিকে।
জিসান যখন ফারিনের দিকে তাকিয়ে ছিল ঠিক তখনই একটা ওয়াটার পট হাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নাম ছিল নির্ঝর। জিসান কে ফারিনের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল তার। ইচ্ছা করলো মেরে জিসানের মুখের নকশা বদলে দিতে।
কিন্তু এখানে মারামারি করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এখানে শক্তি নয় বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে। তাই নির্ঝর জিসানকে কিছু না বলে ফারিনের দিকে ফিরে বলে,,
——“ফারিন!”
ফারিনসহ উপস্থিত সকলের অবাক দৃষ্টিতে নির্ঝরের দিকে তাকায়। ফারিন কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,,
——“কিছু বলবেন?”
নির্ঝর:“মেহেদি দেওয়া কমপ্লিট?”
ফারিন: “এইতো আর একটু বাকি!”
নির্ঝর:“আর হাতের মাঝে আমার নামটা লিখেছে তো?”
নির্ঝরের এহেন কথায় বিষম লাগে ফারিনের। তা দেখে শিশির বলে,,
——“সামলে সামলে! আর নির্ঝর ভাই তুমিও না? বউটা যেহেতু তোমার হাতে নামটাও নিশ্চয়ই তোমারই লিখবে অন্য কারো লিখবে না! তাই এভাবে বাচ্চা মেয়েটাকে সবার সামনে লজ্জায় না ফেলে দিলেও পারতে। দেখতো লজ্জায় পুরো বিষম লেগে গেছে!”
নির্ঝর: “আমি কি বললাম আমিতো জাস্ট ওকে মনে করিয়ে দিলাম!”
অতঃপর নির্ঝর রুমে যাওয়ার আগে ফারিনের দিকে ফিরে ফের বলল,,
——“দ্রুত মেহেদি লাগিয়ে রুমে এসো! মাথাটা ভীষণ ধরেছে মাসাজ করে দিতে হবে!”
কথাটা বলেই নির্ঝর চলে যায় সেখান থেকে। এদিকে ফারিন পরে মহা লজ্জায়। লজ্জার পাশাপাশি কিছুটা হচকিত হয় সে। তার গম্ভীর খাইস্টা হিটলারের এত দ্রুত এমন পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পায় না সে।
এদিকে শিশির তো ফারিনকে ক্ষ্যাপাতে ব্যস্ত। অন্যদিকে জিসানের চোখ বিষ্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়। তারমানে ফারিন ম্যারিড। আরও নির্ঝরের ওয়াইফ। ওফ সিট! শেষ পর্যন্ত জিসান কিনা একটা বিবাহিত মেয়ের উপর ক্রাশ খেলো! তাও আবার প্রফেসর নির্ঝরের মতো গুরুগম্ভীর এক প্রফেসরের স্ত্রীয়ের উপর?
ঘড়ির কাটায় প্রায় রাত সাড়ে বারোটা ছুঁই ছুঁই। আর মাত্র কিছু মুহূর্ত তারপর শেষ হবে রিদিত,আনায়ার অপেক্ষার প্রহর। কালকে তাদের প্রণয় পূর্ণতা পাবে।মেহেদি দেওয়া শেষে গল্প করতে করতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেছে টেরই পায়নি কেউ। অতঃপর যে যার রুমে ঘুমাতে চলে গেছে।কালকে তো আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
আনায়ার রুমে সবাই ঘুমে নিমগ্ন। শুধুমাত্র শিশির ছাড়া। চোখে এক বিন্দু ঘুম নেই তার। সে ফোনের গ্যালারি থেকে কিছুক্ষণ পূর্বে তোলা ছবিগুলো ক্রল করে করে দেখছিল। পোস্টও করল কিছু ছবি, কিন্তু হঠাৎই তার দৃষ্টিগত হলো তার একার তোলা একটা ছবি। বাম হাতের উল্টো পৃষ্ঠ দ্বারা মুখটা ঢেকে রেখেছে সে,ড্রয়িং রুমের আলোকরশ্মি সরাসরি তার হাতের উপর এসে পড়েছে ফলে হাতের নীচ পৃষ্ঠে লেখা ‘N’ অক্ষরটি জ্বলজ্বল করছে।
শিশির মনে মনে কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসে, অতঃপর নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে দ্রুত ছবিটা আপলোড করে আর উপরে ক্যাপশন দেয়,,
“মেঘের খামে আজ তোমার নামে…
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম….
পড়ে নিও..
তুমি মিলিয়ে নিও…
খুব যত নে তা লিখেছিলাম!”
পোস্ট করার এক মিনিটের মধ্যেই তাতে লাভ রিয়েক্ট দিল নাহিয়ান। শিশির কিছুটা হচকিত হয়, তার মানে নাহিয়ান কি এতক্ষণ তার প্রোফাইল এ ঘোরাঘুরি করছিল নাকি?তবে সে আর কিছু ভাবার আগেই তার মেসেঞ্জারে কল দেয় নাহিয়ান। শিশির দ্রুত কল রিসিভ করে বলে,,
——“হ্যালো!”
নাহিয়ান বরাবরের মতো একই জবাব দিয়ে বলে,,
——“আই লাভ ইউ বউ!”
শিশির:“কিছু বলবেন?”
নাহিয়ান: “এত রাতে না ঘুমিয়ে ফেসবুক চালানো হচ্ছে?”
শিশির: “ঘুম আসছিল না?”
নাহিয়ান: “কেন ম্যাম? কাউকে মিস করছিলেন নাকি?”
শিশির পাশ ফিরে শুয়ে বলে,,
——“কিছুটা!”
নাহিয়ান: “তা ম্যাম কি চিঠি লিখলেন?”
শিশির: “লিখলাম কিছু একটা!”
নাহিয়ান: “বুঝলাম!হাতের মেহেদির রং তো বেশ ভালোই এসেছে! তারমানে আপনার হাসবেন্ড মেবি আপনাকে অনেক ভালোবাসে?”
শিশির দুষ্টু হেসে বলে,,
——“মেইবি না একটু বেশিই ভালোবাসে?”
নাহিয়ান: “তা মিসেস নাহিয়ান আপনার হাতে ‘নাহিয়ান’ নামটা কই?”
শিশির:“লিখেছি তো। ‘N’!”
নাহিয়ান:“এন ফর তো কত কিছু হতে পারে! আমি বলেছিলাম সরাসরি আমার নামটা লিখতে। আপনি কই লিখেছেন?”
শিশির: “উমমম, আইছে!আবদার কত? আপনার নাম লিখলে যখন আন্টি আমার হাতে আপনার নামটা দেখতো তখন আমি কি বলতাম?”
নাহিয়ান: “বলতেন আমি আমার হাতে আমার হাসবেন্ডের নাম লিখছি!”
শিশির: “মামা বাড়ির মোয়া পেয়েছেন! হাসবেন্ড আপনি আমার।এটা আমি আপনি ব্যতীত আর কে জানে? পেরেছেন রিদিত ভাই যেমন আনায়াকের সবার সামনে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে। তেমন আমাকে সবার সামনে সাড়ম্বরে আপনার স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা দিতে?”
নাহিয়ান:“আচ্ছা একবার শুধু আমাকে বিডি ব্যাক করতে দিন! শুধু পরিবারের সামনে না পুরো দেশের সামনে আপনাকে এ আর নাহিয়ান চৌধুরীর স্ত্রীর মর্যাদা দিব আমি!”
শিশির নিরুত্তর। নাহিয়ান ফের বলল,,
——“ভাবতেছি আপনার নামে আমেরিকা জর্জ কোর্টে একটা মামলা দিব!”
শিশির: “মানে?”
নাহিয়ান: “মানে এই যে,আপনি এ আর নাহিয়ান চৌধুরীর কথার অবাধ্য হয়েছেন। এজন্যই আপনার নামে জজ কোর্টের একটা মামলা দিব! আপনার কোনো আপত্তি আছে?”
শিশির: “না না কিসের আপত্তি? আপনি বরং আমার হয়েও একটা মামলা দিয়ে দিয়েন?”
নাহিয়ান:“কি মামলা?”
শিশির: “তাদের বিখ্যাত সিআইডি অফিসার এ আর নাহিয়ান চৌধুরী একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছে। শুধু তাই নয়, বিয়ের পর আবার সেই মেয়েটাকে একা রেখে নিজেই আমেরিকা চলে গেছে!”
নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল,,
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪৭ (২)
——“আম সরি ম্যাম! কিন্তু আপনার এই সমস্যার সমাধান একমাত্র এ আর নাহিয়ান চৌধুরীই করতে পারবে! কোনো কোর্ট,জজ,মিনিস্টার এগুলোর সলভ করতে পারবেনা।”
শিশির:“তাহলে তাকেই বলুন আমার কেসটা সলভ করতে!”
নাহিয়ান:“আর কিছু মাস পর সে দেশে এসেই আপনার সমস্যার সমাধান করবে। ডোন্ট ওয়ারি অ্যান্ড আই লাভ ইউ!”
নাহিয়ানের কথায় শিশির মুচকি হাসে। পুরো রাতটা তার কেটে যায় এক অন্যরকম প্রেমময় আবেশে।