মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৩

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৩
নওরিন কবির তিশা

সময়গুলো যেন রূপকথার সোনালী পালকের পাখির ন্যায় আকাশে ডানা মেলে উড়ে চলেছে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটি মাস। সেদিনই তো অপরাজিতারা খানম কুঞ্জে আসলো।আর চোখের পলকের মাঝে তিনটি মাস কি করে যে পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারল না কেউ।
প্রথম প্রথম অপরাজিতার মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। তবে খানম পরিবারের সবাই এত বেশি আন্তরিক যে ধীরে ধীরে সে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে সে। তাদের বিয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাড়ি ফিরেছিলো এই বংশের একমাত্র বংশধর নিহিল খানম। পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরেই থাকে সে।

হাসি,আড্ডা, মজায় পেরিয়ে গেছে দিনগুলি। তবে কিছুদিন আগেই কানাডায় ব্যাক করেছে নওরিফারা তখন থেকেই অপরাজিতার মনটা ভীষণ বিষন্ন। নওরিফার সাথে বেশ বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। বিশেষ করে নাহিয়ান তো সর্বক্ষণ তার পিছন পিছন মামিমা-মামিমা করতো।
নওরিফা চেয়েছিলো আরো কিছুদিন থেকে যেতে। কিন্তু ইমতিয়াজ চৌধুরীর ব্যবসার কাজে;ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও চলে যেতে হয়েছে তাদের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজকে সকালটা যেন বিষন্নতায় মুড়ে আছে। সকাল থেকেই পরিবারের সবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে অপরাজিতার।ছোট্ট চাঁপার মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো, দাদির দেওয়া পুরানো দিনের গল্প গুলো,পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলে মায়ের দেওয়া বকা, বাবার মিষ্টি শাসন। সবচেয়ে বেশি রোদেলার সাথে দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটির কথা।তারউপর নরশদও বাড়িতে নেই আজ প্রায় এক সপ্তাহ।একটা মিশনে জাফলংয়ের বাইরে আছে সে।
সব মিলিয়ে নিজেকে বেশ একা একা লাগছে অপরাজিতার। নরশদের বিশাল কক্ষে বসে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সুদীর্ঘ সোনালী কেশরাজিতে চিরুনি চালাচ্ছে সে। হুট করে দরজায় এসে দাঁড়ালো কেউ। কোমল কন্ঠে বলল,,
——“ভাবি আপনাকে সবাই নিচে ডাকছে।”
অপরাজিতা পিছন ঘুরে দেখল পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মারজা। মারজাকে দেখে অপরাজিতা বলল,,
——“তুমি নিচে যাও।আমি আসছি।”
অপরাজিতার সুদীর্ঘ সোনালী কেশরাজি দিয়ে যেন সৌন্দর্যেরা উপচে পড়ছে। সে পানে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে মারজা বলল,,

——“ভাবি! আপনার চুলগুলো যে এত সুন্দর!কি বলব!”
মারজার এহেন কথায় অপরাজিতা মুচকি হেসে বলল,,
——“তোমার চুলগুলোও তো অনেক সুন্দর মারজা। মাশাআল্লাহ!কি সুন্দর ঢেউ খেলানো কৃষ্ণকালো। আমার তো অমন চুলই ভালো লাগে।”
জীবনে এই প্রথম হয়তো মাহেজাবিন মায়া ব্যতীত অন্য কেউ মারজার প্রশংসা করলো। শ্যাম বর্ণের মেয়েটি ছোটবেলায় বাবা-মা হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো এই খানম বাড়িতে। তখন থেকেই মাহেজাবিন মায়া নরশদ আর নওরিফার সাথে তাকেও বহু যত্নে রেখেছে। শ্যাম কন্যা হয়ে এমন ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যের অধিকারিনীর কাছ থেকে নিজের চুলের প্রশংসা শুনে লজ্জায়,ভালোলাগায় তার মুখ চিক চিক করে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো অপরাজিতা হয়তো তার মন রাখার জন্য মিথ্যা কথা বলছে।

মারজা:“মন রাখার জন্য মিথ্যা কথা বললেন ভাবি? আমি তো কালো!”
অপরাজিতা:“মিথ্যা কেন বলব?পৃথিবীর সবাই নিজে নিজের মতো করে সুন্দর,মারজা। দেহের বর্ণ, আকৃতি কোনো কিছুই বিষয় নয়। শুধু সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য নিজের দৃষ্টিকে সুন্দর রাখলেই,পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিস তার কাছে সুন্দর।”
অপরাজিতার এমন কথায় বড্ড মুগ্ধ হল মারজা। মেয়েটার বাইরের সৌন্দর্য ঠিক যেমন,তার থেকেও সুন্দর তার মনটা। আল্লাহ তাকে যেমন রুপে লাবণ্যময়ী করেছেন,তেমনি তার মনটাও করেছেন সুন্দর, স্নিগ্ধ ও পবিত্র।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল অপরাজিতা। নিচে কথার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে উপর থেকেই। অপরাজিতা নিজের মাথার ঘোমটা টা বেশি করে টেনে দিল। সাধারণত এই সময় বাড়িতে নুরুজ্জামান খানমসহ তার বিভিন্ন ব্যবসাহিক সঙ্গী সাথী থাকেন। অপরাজিতাকে নিচে নামতে দেখে মাহেজাবিন মায়া ডেকে বললেন,,
——“দ্রুত নিচে এসো অর্ণিমা। দেখো কারা এসেছে!”
এবাড়িতে সবাই তাকে অর্নিমা বলে ডাকে।একমাত্র নরশদই অপরাজিতা বলে। অপরাজিতা দ্রুত নেমে আসলো। শেষ সিঁড়িটায় পা দিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেলো সে। চাঁপা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,,
——“অপু আপু!”
অপরাজিতা অবাক কন্ঠে তাকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ছুটে এলো টগর। সে অপরাজিতা কে জড়িয়ে ধরে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বললো,,

——“আপু!”
অপরাজিতা বিস্মিত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখলো সেখানে উপস্থিত তালুকদার বাড়ির সবাই। এতদিন পর সবাইকে দেখে আবেগ আটকে রাখতে পারলো না অপরাজিতা। টগর আর চাঁপার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে;সে এগিয়ে গেল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালবাসা, তার জীবনের প্রথম ভালবাসা তার বাবা রাজ্জাক তালুকদারের কাছে।
রাজ্জাক তালুকদার এতদিন পর মেয়েকে দেখে আর শান্ত থাকতে পারলেন না। যে মেয়েকে প্রতিদিন সকাল-বিকাল নিয়ম করে না দেখলে কাজে মন বসত না তার।সেই মেয়ে আজ এতটা দূরে। এতদিন পর দেখল তাকে। অপরাজিতা দৌড়ে এসে বাচ্চাদের মতো মুখ লুকালো বাবার বক্ষদেশে। ব্যাস কে সামলাবে এখন তাদের? বাবা-মেয়ে দুজনেরই চোখ বেঁয়ে একসাথে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুকণারা। রাজ্জাক তালুকদার নিজেকে ধাতস্থ করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,,

——“কেমন আছিস অপুবুড়ি?আমার মা!”
অপরাজিতা হেঁচকি তুলে বললো,,
——“তোমাকে ভীষণ মিস করেছি আব্বা। এতদিন আসনি কেন তুমি? জানো প্রত্যেকদিন আমার তোমার কথা মনে পড়তো। প্রতিদিন সকালে তো তুমিই আমার ঘুম ভাঙ্গাতে। কিন্তু এখন কেন আসে না আব্বা তুমি?”
মেয়ের কথায় ফের অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল রাজ্জাক তালুকদারের দুচোখ বেয়ে। সে নিজেকে সামলাতে পারল না। বাবা মেয়ের এমন কান্ডে মা বনলতা বেগম হেসে এগিয়ে এসে বলল,,
——“হ্যাঁ হ্যাঁ শুধু তো আব্বার কথাই মনে পড়বে?একটা মাকে যে ফেলে রেখে এসেছিলে তা কি তোমার মনে আছে?”

মায়ের কন্ঠে মুখ তুললো অপরাজিতা। মা বনলতা বেগম দুই হাত বাড়াতেই অপরাজিতা বাবাকে ধরা অবস্থাই মাকে জড়িয়ে ধরল। তাদের তিনজনের এমন ভালোবাসায় মুগ্ধ হলো উপস্থিত সকলে। নুরুজ্জামান খানম মাহেজাবিন মায়া কে কিছুটা আদেশের সুরে বললেন,,
——“মায়া যাও! চাচা চাচির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো। কত দূর থেকে এসেছেন!”
মাহেজাবিন মায়া বাড়ির কিছু কর্মচারীদের ডেকে বললেন,,
——“রুবি,ফাহি,শাহী,মনা তোরা চাচা চাচির বসার ব্যবস্থা কর। আর সিদ্দিকা তুই আমার সাথে চল এখানে খাবার গুলো এনে দিবি।”
তারা সবাই মিলে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের থেকে।
বাবা-মা আর মেয়ের কথা শেষে নরশদ অপরাজিতার দিকে এগিয়ে এসে বললো,,
——“অপরাজিতা? তোমার জন্য একটা স্পেশাল গেস্ট আছে।দেখবে না?”
অপরাজিতা নরশদের দিকে ফিরে বলল,,

——“কে?”
নরশদ দরজার দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অপরাজিতা সে দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সিকদারের সাথে ঝগড়া করতে করতে ঢুকছে রোদেলা। রোদেলাকে দেখে বিষ্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছালো অপরাজিতা। রোদেলাও অপরাজিতা কে দেখে সিকদারের সাথে ঝগড়া বন্ধ করে ছুটে এসে জাপটে ধরল অপরাজিতা কে।দুই নিবিড় সখীর দেখা হল প্রায় তিন মাস পর।
আবেগে আপ্লুত হলো দুজনেই। কিছুটা হাসি কিছুটা পুরাতন দিনের স্মৃতি,কিছু মজা আর কিছুটা ভালোবাসার মুহূর্তের সিক্ত হলো সকালটা।

সারাদিনটা অপরাজিতার কেটে গেছে অন্যরকম আবেশে। এতদিন পর নিজের বোনকে;নিজের প্রিয় বান্ধবীকে,বাবা-মাকে কাছে পাওয়ার পর সারাদিন জুড়ে গল্প গুজব করেছে তারা। এতকিছুর মাঝে নরশদকে সময়ই দিতে পারেনি সে।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে রোদেলার সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প দেওয়া শেষে;রুমে প্রবেশ করলো অপরাজিতা। কিছুটা ভীতি কাজ করছে তার মাঝে।নরশদও তো প্রায় সপ্তাহখানেক পর বাড়ি ফিরল। সারাদিন তো তার সাথে একটা কথাও বলতে পারেনি অপরাজিতা। আলতো হাতে দরজাটা খুলে কক্ষে প্রবেশ করল সে। কিন্তু কি ব্যাপার? নরশদ কোথায়? গোসলখানায় নাকি? কিন্তু সেখান থেকে তো পানি পড়ার শব্দ আসছে না?
এবার বেশ চিন্তা হল অপরাজিতার। সে হাতের পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে,ঝুল বারান্দার দিকে ফিরে বলল,,
——“এই যে শুনছেন আপনি কি বারান্দায়?”
কোনো সাড়াশব্দ না আসায় অপরাজিতা উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলো ঝুল বারান্দা টার দিকে। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই পিছন থেকে কেউ একজন বেশ শক্ত করে জাপটে ধরল অপরাজিতাকে। হঠাৎ এমন স্পর্শে কিছুটা কেঁপে উঠল সে। কম্পিত কণ্ঠে সে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,

——“নরশদ?”
পিছন থেকে নরশদ বলল,,
——“মিসেস নরশদ? ঘরে যে আপনার একটা স্বামী আছে সেটা কি ভুলে গিয়েছিলেন? সারাদিন কোথায় থাকেন হ্যাঁএতদিন পর ফিরলাম কোথায় একটু আদর-যত্ন করবেন। তা না!”
অপরাজিতা লাজুক কন্ঠে বলল,,
——“ছাড়ুন আমায়!”
নরশদ আরো শক্ত করে তাকে জাপটে ধরে বলল,,
——“উহু! এমনিতেই এতদিন পর বাসায় ফিরছি আপনার দেখা নেই। তার উপর এতক্ষণ পর আপনাকে কাছে পেয়েছি। আজকে রাতে তো আপনার ছাড়া নেই ম্যাম!”
অপরাজিতার ফর্সা মুখশ্রী মুহুর্তে বদলে গেল রক্তিম কৃষ্ণচূড়ায়। লজ্জাবতী লাজুকতার ন্যায় নুইয়ে পড়ল সে। নরশদ যেন এই মুহূর্তটারই অপেক্ষা করছিল। সে অপরাজিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার কপালে দীর্ঘ এক প্রেম পরশ এঁকে দিলো। অপরাজিতাও চোখ বন্ধ করে পরম আবেশে গ্রহণ করল নরশদের প্রেম স্পর্শ। বাইরের দূর হ্রদের কল কল শব্দ, আর রাতের সুস্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে গেল একজোড়া প্রেমযুগলকে।

রাত্রি তার পূর্ণতায় মগ্ন,নিদ্রালস সময়;চারিদিক নিস্তব্ধ শুনশান। হুট করে রাতে ভীষণ পানির তেষ্টা পেয়েছে রোদেলার। ভুলবশত নিজের ঘরে পানি নিতেই ভুলে গিয়েছিল সে। এখন এই রাতে কাউকে ডাকাও সম্ভব নয়। নরশদ দের বাড়িটা বেশ আধুনিক। বিদেশি ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো বাড়িতে,সার্বক্ষণিক একটা টিম টিমে আলো প্রজ্বলিত থাকে।

সেই আলোকেই নির্দেশক মেনে রোদেলা এগিয়ে চলল রান্না ঘরের দিকে। দুই তলার পূর্ব দিকের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে শুনতে পায় কারো কথার গুঞ্জন। রোদেলা কিছুটা থামে। সে বুঝতে পারে এটা কোনো স্বাভাবিক কথা নয় খুব সম্ভবত কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে প্রেমময় ছন্দে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে।
রুমটা দেখে রোদেলার মনে পড়ে,এটাতো নিহিলের কক্ষ। দুপুরের খাওয়া শেষে বেশ কিছুক্ষণ জুড়েই তার সাথে গল্পগুজব করেছে রোদেলা, অপরাজিতা টগর আর সিকদার‌। তাদের কথা শুনে তো মনে হলো নিহিল খুব সম্ভবত বিদেশ থাকে।তাহলে কি নিহিলেরই কারো সাথে? যাইহোক এতে রোদেলার কি? বিদেশী মানুষজন বলে কথা একটা-আধটু প্রেমিকা থাকবে না! তা কি কখনো হয় নাকি?
রোদেলা ফের হাঁটা লাগাতে যাবে তখনই কারো একজনের সাথে বেঁধে নিচে পড়ে যেতে চায় সে, সামনের হাত জোড়া তাকে ধরতে গিয়েও ছেড়ে দেয়।ফলে ধপাস করে নিচে পড়ে কোমরে ভীষণ জোরে ব্যথা পায় রোদেলা। মুখ দিয়ে না চাইতেও ‘ওমাগো’ শব্দটা বের হয়ে যায়। সামনের ব্যক্তিকে ধিক্কার জানানোর আগেই সামনের ব্যক্তিটি বলে,,

——“কেমন লাগলো মিস গোবর ঠাসা? সেদিন যখন আমার মাথায় পেয়ারা গুলো মেরেছিলে না তখন আমার এর থেকেও জোরে ব্যথা লেগেছিল!”
সিকদারের এমন কথায় বেশ চটে গেলো রোদেলা। সিকদার চাইলেই রোদেলাকে ধরে বাঁচাতে পারতো।কিন্তু তা না করে এখন কিনা এসব বলছে? এক ঝটকা উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর সিকদারের দিকে ফিরে বলল,,
——“বেডা খচ্চর! আমি কি আপনার মাথায় ইচ্ছা করে পেয়ারা মেরে ছিলাম নাকি?”
সিকদার:“ইচ্ছা করে হোক আর অনিচ্ছাকৃত মেরে ছিলে তো।”
রোদেলা কিছু একটা বলতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে। নিজেকে বহু কষ্টে ধাতস্থ করে সে বলল,,
——“এর শোধ আমি সুদে আসলে নেব। শুধু অপেক্ষা করুন!”
কথাটা বলেই সেখান থেকে চলে গেল রোদেলা। সিকদার তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলল,,
——“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও যাও! দেখে নিব!”
পরদিন সকালে…🪻🪻🪻

সকাল সকাল পুরো খানম বাড়ি জুড়ে তোড়জোড়। আজকে সবাই মিলে ঘুরতে যাবে জাফলং এর বিখ্যাত ‌খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ে। শুধুমাত্র অপরাজিতার বাবা-মা, মেহজাবিন মায়া আর নুরুজ্জামান খানম ব্যতীত। যদিও অপরাজিতা বেশ কয়েকবার জোর করেছে মায়াকে। তবুও তার এক কথা,তাদের নাকি এখন আর বয়স নেই। একসময় প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছেন তারা। এখন আর শরীরের সায় দেয় না। শেষমেষ অপরাজিতা এক প্রকার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে তাদের কাছ থেকে।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিয়েছে সবাই। অপরাজিতা আজকে পড়েছে গাঢ় নীল অপরাজিতা রঙ্গা ট্রান্সপোর্টেড সিল্ক শাড়ি। এটা নরশদই উপহার দিয়েছিলো তাকে। শাড়ি পড়ে না বলে কখনো সেটা পড়তে পারেনি। তবে আজ যেহেতু তারা একসাথে কোথাও যাচ্ছে এজন্য তার দেওয়া শাড়িটাই পড়েছে অপরাজিতা। অন্যদিকে চাঁপা টগর দুজনের পরনেই বেগুনি রঙের সালোয়ার কামিজ, রোদেলার পরনে হালকা নীলরঙা সাদা পাড়ের সুতি শাড়ি।
সাজসজ্জা শেষে সকলে একে একে রওনা দিয়েছে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের দিকে। নরশদ আর অপরাজিতা যাচ্ছে নরশদের ছাদ খোলা জিপ গাড়িতে। বাকিরা নিহিল আর সিকদারের গাড়িতে।
চলতি পথে হঠাৎই নরশদ অপরাজিতার দিকে ফিরে বলল,,

——“তোমাকে আজকে একটু বেশি সুন্দরী লাগছে, তিলোত্তমা!”
নরশদের এমন কথায় লজ্জায় মাথা নোয়ালো অপরাজিতা। তা দেখে নরশদ মুচকি হেসে ফের গাড়ি চালানোতে মনোনিবেশ করে বলল,,
——“তিলোত্তমা?আমার না একটা গান মনে আসছে গাই?”
অপরাজিতা মাথাটা সামান্য তুলে বলল,,
——“কি গান?”
নরশদ গলা খাঁকারি দিয়ে গেয়ে উঠলো,,
🎶 এই পথ যদি না শেষ হয়…..
তবে কেমন হতো তুমি বলতো…
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়…
তবে কেমন হতো? তুমি… বলতো…🎶
অপরাজিতা কিছুটা লজ্জায় কিছুটা ভালোলাগায় মাথা নিচু করে সামান্য হাসলো। সেদিকে তাকিয়ে নরশদও মুচকি হাসলো‌।

সেদিনটা তাদের কেটে গিয়েছিল প্রকৃতিমন্ডিত, সবুজ শ্যামলে সিক্ত আবহে। তারা সবাই মিলে জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে এক স্বপ্নীল মুহূর্ত অতিবাহিত করেছিল।তবে তাদের ভ্রমণে সবচেয়ে সুন্দর দিকটি ছিল খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সংঘটিত খাসিয়া পল্লীর মৃৎশিল্পীদের তৈরি বিভিন্ন মৃৎশিল্পের মেলা।
নরশদ তার তিলোত্তমাকে ‌হাতে হাত রেখে অতিযত্নে মেলাসহ গোটা খাসিয়া পল্লী ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। নিজ হাতে মেলার সবচেয়ে সুন্দর কারুকার্য খচিত কিছু মৃৎশিল্পকর্ম সে উপহার স্বরূপ দিয়েছিল তার তিলোত্তমাকে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বনফুল সংগ্রহ করে নিজের হাতে গাজরা তৈরি করে পরিয়ে দিয়েছিল তার অপরাজিতাকে!
দিনটা অপরাজিতার কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, যদি কোনো কিছু মূল্যে সময়টাকে বেঁধে রাখা যেত বা কখন সময়কে ফিরে পাওয়ার জন্য তাকে জাদুশক্তি দেওয়া হতো। তাহলে সে নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তগুলোকেই বারবার ফিরে পেতে চাইতো!
কেটে গেছে প্রায় অর্ধ মাস……….

কালকে তালুকদার বাড়ির লোকজন সহ রোদেলা ফিরে যাবে তাদের নওগাঁয়। তাই মনটা বেশ খারাপ রোদেলার।জাফলং এর অভিজ্ঞতাটা নেহাতই মন্দ নয়। দিনভর অপরাজিতার সাথে গল্পগুজব। মাহেজাবিন মায়ার আদর-যত্ন, তার হাতে তৈরি খাবার, নিজ হাতে যত্ন করে তাকে আর অপরাজিতা কে একসাথে খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদির শূন্যতা ভীষণভাবে অনুভব করবে রোদেলা।
তবে তার সবচেয়ে বেশি যেটা মনে পড়বে সেটা হচ্ছে সিকদারের সাথে করা খুনসুটি গুলো। সারাদিন রাত‌ ২৪টা ঘন্টা তার পিছনে লেগে থাকা। কখনো কখনো তার খাবারে বেশি করে ঝাল মিশিয়ে দেওয়া, কখনো বা নুনের তীব্রতায় তাকে মাঝসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ানো।
খানম বাড়ির বিশাল ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে এসবই ভাবছিল রোদেলা। হঠাৎ সে অনুভব করল চিলেকোঠার দরজা খুলে কেউ তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পিছনে ঘোরার প্রয়োজন হলো না তার। আগন্তুকের উপস্থিতিই তাকে টের পাইয়ে দিল এটা সিকদার ভিন্ন অন্য কেউ নয়। সে আকাশের পানে দৃষ্টি রেখেই বলল,,

——“কি বলবেন? আবার ঝগড়া করবেন? কালকেই তো চলে যাব! এরপর আপনি কার সাথে ঝগড়া করবেন; শুনি?”
সিকদার ভেবেছিল পিছন থেকে এসে রোদেলা কে ভয় দিবে। কিন্তু রোদেলার এমন কথায় মনটা ভীষণভাবে ভারাক্রান্ত হলে তার। সে নিজেও তো রোদেলাকে ভীষণ বাজেভাবে মিস করবে। তার শূন্যতা সারাক্ষণ পোড়াবে সিকদারকে। কিন্তু কি আর করার?সে কি কখনো রোদেলাকে জানাতে পারবে তার মনের অব্যক্ত অনুরক্তিটা? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মলিন হেসে সে বলল,,
——“পিছনে না ঘুরেই আমাকে চিনতে পারলে?”
রোদেলা:“আপনাকে চেনার জন্য আমার আপনাকে সামনাসামনি দেখার প্রয়োজন হবে না। আপনার নিঃশ্বাসের উপস্থিতি আমার কাছে আপনার পরিচয় বহন করে!”
সিকদার:“পুরাই তো দেখছি সিনেমার নায়িকাদের মতো ডায়লগ বলছো।তা তুমি কি সুচিত্রার মতো আমার প্রেমে পড়ে গেলে নাকি?”
রোদেলা মলিন হেসে বলল,,

——“পড়লেও বা,কি? অনুভূতিটা শুধুই আমার নিজস্ব!”
রোদেলা কথাটা এতটাই আস্তে বলেছে যে সিকদার ভালোভাবে বুঝতে পারল না তার কথা। তবে সিকদার আর কথা না বাড়িয়ে বুকপকেট থেকে একটা জোড়া পুঁথির কারুকার্য খচিত কানের দুল বের করে দিয়ে বলল,,
——“এই নাও।এটা তোমার জন্য!”
রোদেলা সিকদারের দিকে চেয়ে বেশ অবাক হয়ে বলল,,
——“কি উপলক্ষে?”
সিকদার:“মানুষকে কিছু দিতে হলে উপলক্ষ থাকা লাগে বুঝি? যাইহোক যদি তুমি উপলক্ষ জানতে চাও তাহলে তা এটাই যে এতদিন ধরে তুমি আমার মতো একটা মানুষকে কিভাবে সহ্য করলে! এর থেকে বড় উপলক্ষ আমার কাছে মনে হয় না আর থাকতে পারে। তোমার কি মনে হয়?”
রোদেলা:“আমার কিছুই মনে হয় না!”
সিকদার:“তবে বেশি কথা না বলে চুপ থাকো!”
কথাটা বলেই সিকদার রোদেলার দিকে এগিয়ে এসে সামান্য ঝুঁকে রোদেলার কর্ণমূলে পুঁতির কারুকার্যখচিত সেই সুদৃশ্য কানের দুলটি পরিয়ে দিলো।রোদেলা অবাক দৃষ্টিতে কিছু বলার আগেই সিকদার সাবধানতার স্বরে বলল,,
——“উসস!”

রোদেলা থমকে গেল। মুখ দিয়ে টু শব্দটি বের হলো না তার। কানে দুলটি পড়ানো শেষে আর কোনো কথা না বলে সোজা সেখান থেকে প্রস্থান করল সিকদার। রোদেলা তখনো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার যাবার পানে।
সিকদার যখন চিলেকোঠার সিঁড়ি বেয়ে নামছিল তখনই তার ‌মুখোমুখি দেখা হয় অপরাজিতার সাথে। অপরাজিতা তখন রোদেলাকে ডাকার জন্য ছাদে আসছিল। অপরাজিতা সিকদারকে ছাদের দেখে বেশ অবাক হলো। সিকদারও বেশ অপ্রস্তুত হলো অপরাজিতা কে দেখে। সে মুখে কোনো রকমে একটা হাসির রেখা টেনে অপরাজিতা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে নেমে চলে গেলো।
অপরাজিতা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে সেদিকে তাকালো তারপর ছাদে এসে রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল,,
——“রোদ?”
রোদেলা তখন ব্যস্ত ছিল নিজের কানের দুলটাকে হাত দিয়ে অনুভব করতে। হঠাৎ অপরাজিতার এমন ডাকে কিছুটা কেঁপে উঠল সে। তা দেখে অপরাজিতা তারদিকে এগিয়ে এসে বলল,,

——“তুই কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস রোদ?”
রোদেলা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,,
——“ক-ক-কই না তো!”
অপরাজিতা:“তুই আমার থেকে কিছু লুকাতে পারিস না রোদ। তারপরও কেন মিথ্যা চেষ্টা করিস? তোকে তোর নিজের থেকেও ভালো করে আমি চিনি। একটা সত্যি কথা বলতো,তুই কি সিকদার ভাইকে পছন্দ করিস?”
অপরাজিতার এমন কথায় রোদেলার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। রোদেলা এখনো নিজেও ভালো করে জানে না সে সিকদারকে পছন্দ করে কিনা? তবে তার মনের সুপ্ত;কোন যেন বলছে! হয়তোবা এটা শুধু ভালো লাগাতে থেমে নেই গড়িয়ে গেছে আরও‌ অনেক দূরে।
কিন্তু একথা সে অপরাজিতাকে কি করে বলবে? রোদেলা চুপ থাকলো। তা দেখে অপরাজিতা হেসে এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,,

——“এই সামান্য কথাটা তুই আমাকে বলতে পারিস না, আর তুই বলতিস আমি তোর ব্যক্তিগত ডায়েরি?”
রোদেলা:“এরকম কিছু না অপু আসলে!”
অপরাজিতা রোদেলার হাতে হাত রেখে বলল,,
——“এরকম কিছু নয় মানে? তোর চোখ আমাকে বলে দিচ্ছে যে তুই মিথ্যা কথা বলছিস। আমাকে মিথ্যা বলার কী প্রয়োজন রোদ? চল নিচে চল!”
কথাটা বলেই অপরাজিতা রোদেলার হাত ধরে টেনে নিচের দিকে নিয়ে আসতে লাগলো। রোদেলা অপরাজিতার এমন কাণ্ডে অবাক হয়ে বলল,,
——“কি করছিস? অপু !”
অপরাজিতা:“নিচে চল দেখতে পাবি।”

রোদেলা অপরাজিতার সাথে নিজে আসতেই দেখতে পেল নিচে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। এমনকি সেখানে এসেছে রোদেলার বড় ভাই জহির জামান, সেই সাথে তার সহধর্মিনী সানজিদা সুলতানা। তাদের দেখে বেশ অবাক হলো রোদেলা।এত রাতে তার ভাইরা কোথা থেকে আসলো। আর সবচেয়ে বড় কথা কালকে তো তারা চলে যাবে। সে অবাক হয়ে অপরাজিতার দিকে তাকাতেই অপরাজিতা ইশারা করে তাকে দুই তলার দিকে দেখালো।
অপরাজিতার দৃষ্টি অনুসরণ করে রোদেলা উপরে তাকাতেই দেখতে পেলো নরশদ একপ্রকার টেনে হিচরে নিচে নামাচ্ছে সিকদারকে। নরশদ সিকদারকে নিয়ে নিচে আসতেই অপরাজিতা রোদেলার উদ্দেশ্যে বলল,,

——“তুই নিজেকে কি মনে করিস রোদ? অনেক বেশি চালাক হয়ে গেছিস;যে নিজের অপুর কাছ থেকে নিজের মনোভাব লুকাতে পারবি? আমি আর নরশদ তো সেদিন খাসিয়া মেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম, যে তুই আর সিকদার ভাই একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারবি না। তোরা হয়তো ভেবেছিলি আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তবে তোরা একবারও খেয়াল করিসনি;আমাদের ২ জোড়া চোখ সর্বদা তাদের উপর খেয়াল রাখছিল।”
রোদেলা আর সিকদার বেশ অবাক হলো অপরাজিতার এমন কথায়। তবে তাদের আরও অবাক করে দিয়ে নরশদ বললো,,

——“কি ব্যাপার সিকদার ব্রো? তুমি তলে তলে এসব করছিলে আর ভাবছিলে আমি কিছুই টের পাচ্ছিনা? আমি তো সেদিন মেলা থেকে এসেই অপরাজিতাকে সবটা বলি। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানিস অপরাজিতা আমারও আগে সেটা নোটিশ করছিল। দেখতে হবে না বউটা কার! যাই হোক তারপর দিন সকালেই আমি আর অপরাজিতা মিলে আফজাল চাচাকে নওগাঁয় পাঠিয়েছিলাম রোদেলার বড় ভাই আর ভাবীকে খবর দিতে। কিন্তু জহির ভাই ব্যবসার কাজে ব্যস্ত ছিল বলে আসতে দেরি হলো।”
সবাই অপরাজিতা আর নরশদের এমন কান্ডে যেমন অবাক হলো তার থেকে দ্বিগুণ বেশি খুশি হলো তাদের এমন বন্ধুত্ব দেখে। সবাই নিজের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে দোয়া করলো যেন এমন বন্ধুত্ব যুগ যুগ ধরে বিরল থাকে।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫২

রোদেলা সিকদারের বিয়ে ঠিক হলো। পরের দিন অপরাহ্নে বেশ জমকালো করে ঘরোয়াভাবে বিবাহ সম্পন্ন হলো তাদের। দুই বান্ধবীর জীবনেই আগমন ঘটলো দুই রাজপুত্রের। একজনেরটা কিছুদিন আগে, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে,আরেকজনেরটা দুষ্টুমি পূর্ণ খুনসুটি আর ভালোবাসার মাধ্যমে।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৪