মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৭
নওরিন কবির তিশা
পুরো নাহিয়ান মঞ্জিল জুড়ে হইচই আর কলরব,সবার হই হট্টগোলে মুখরিত চারিপাশ। সেখানে উপস্থিত চৌধুরী আবাসনের সবাই, সাথে যুক্ত হয়েছে শিশিরের মামা বাড়ির পরিবার এমনকি রিদিত-আনায়ারাও। কালকে সকালেই সবাই মিলে রওনা হবে জাফলং এর উদ্দেশ্যে।
সারা সন্ধ্যাটা তাদের গল্প করেই কেটে গিয়েছে,শিশিরদের বিয়েতে কে কি পড়বে?কোথায় কোথায় ফটোশুট হবে? জাফলং এ কোথায় কোথায় তারা ঘুরতে যাবে?মূলত এসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল তাদের।
যেহেতু কাল বেশ ভোরে রওনা হবে তারা,এজন্যই রাত আটটার ভিতর খাওয়া-দাওয়া সারতে হবে,সেই উদ্দেশ্যেই নাহিয়ান মঞ্জিলের বিশাল ডাইনিং টেবিলে একত্র হয়েছে সবাই। সবাইকে খাবার পরিবেশন করছেন নওরিফা খানম,রোদেলা জামান,সানজিদা সুলতানা আর হাসনা খান।
নাহিয়ান এর সামনাসামনি বসেছে শিশির, শিশিরের ডানপাশে রিদিত, তার পাশে আনায়া, আর বাম পাশে ফারিন-নির্ঝর। নাহিয়ান খাচ্ছে কম শিশিরকে দেখছে বেশি। অন্যদিকে শিশির নিজ মনে খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে আনায়া আর ফারিনের সাথে গল্প করছে।
হঠাৎই নাহিয়ানের মাথায় দুষ্টু চিন্তা-ভাবনারা হানা দিতে শুরু করলো। সে দুষ্টু হেসে নিজের পা টা টেবিলের নিচ দিয়ে সামনের দিকে সামান্য এগিয়ে,পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুল দ্বারা সামনে বসা শিশিরের পায়ে সামান্য ধাক্কা দিল। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে এতে কোনো হেলদোল নেই শিশিরের। সে নিজ মনে আনায়ার সাথে কথা বলেই যাচ্ছে! নাহিয়ানের এবার মেজাজটা কিছুটা খারাপ হলো,, যেখানে সে সেই কোন সময় থেকে শিশিরের দিকে তাকিয়ে আছে সেখানে শিশিরের পায়ে ধাক্কা দেওয়ার পরও সে একবারও নাহিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নাহিয়ান নিজের কার্যক্রমটা একই ধারায় পুনরাবৃত্তি করল বার দুয়েক।তবে এখনো শিশির স্থবির,কোনোরকম প্রতিক্রিয়াকাণ্ড দেখা যাচ্ছে না,শিশিরের চোখে মুখে। নাহিয়ান বেশ অবাক হলো,যেখানে তার লাজুক লতা বউকে একবার বউ বলে ডাকলেই লজ্জায় নুইয়ে পড়ে সেখানে এতবার নাহিয়ানের স্পর্শে তার কিছুই হচ্ছে না? নাহিয়ান যখন এ সকল চিন্তায় নিমগ্ন ঠিক তখনই শিশিরের পাশ থেকে রিদিত বলল,,
——“হায়রে কি জামানায় এসে পড়লাম! এখনকার যুগের এত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, স্মার্ট হ্যান্ডসাম সিআইডি অফিসারও নাকি আসল মানুষের পা খুঁজে পাচ্ছে না? হায় আল্লাহ এদের হাতেই নাকি আবার আমাদের নিরাপত্তা!!!নিরাপদ নইরে নিরাপদ নই! আমরা কাদের হাতে নিজেদের নিরাপত্তা ন্যাস্ত করেছি?”
খাওয়ার মাঝে হঠাৎ এই রিদিতের এমন কথায় সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।সবাই অবাক হলেও নাহিয়ান বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে তার কথার মানে। তার মানে কি সে এতক্ষণ রিদিতের পায়ে ধাক্কাধাক্কি করছিল? হায়রে! যাইহোক নাহিয়ান কি লজ্জা পাওয়ার কিছু করেছে নাকি? সে তো ভেবেছিল এটা তার বউয়ের পা।সে রিদিতের কথার জবাবে বলল,,
——“স্টুপিটের মত কথা বলিস না গাধা! তুই বসে আছিস এক জায়গায় পা দিয়েছিস অন্য জায়গায় কেন হ্যাঁ? ওইখানে তো শিশিরের পা থাকার কথা ছিল!”
রিদিত:“পাল্টি মাইরো না মামা? তুমি যে নিজের বউয়ের স্পর্শ চিনতে পারো না সেটা স্বীকার করো! আর নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হিসেবে পরিচয় দেওয়া বন্ধ করো!”
নাহিয়ান: “একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না রিদিত। তবে এখানে পা দিতে কে বলেছে হ্যাঁ?”
রিদিত:“আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি পা দিয়েছি, তুই কেন চিনলি না?”
নাহিয়ান:“আমি ঠিকই আমার বউয়ের স্পর্শ চিনি,তাইতো বলি আমার নরম কোমল বউয়ের পা টা হঠাৎ করে এমন কাঠের মত শক্ত কেমন করে হলো?”
রিদিত:“চুপ কর বেডা! এখনো বউয়ের স্পর্শ চিনিস না, আবার বড় বড় ডায়লগবাজি করিস! কত কিনা সহ্য করতে হয়েছে তোর জন্য আমাকে? সারাদিন আমার কানের কাছে আমার হৃদয়েরশ্বরী,আমার হৃদয়েরশ্বরী বলে কেন ঘ্যান ঘ্যান করতিস,আর আমি বেচারা সিঙ্গেল মানুষ চুপ করে তোর পাগলামি দেখতাম!”
নাহিয়ান:“আর এক কথা বলবি তো এখানে কিন্তু…”
তাদের এমন তীব্র মুহূর্তে ইমতিয়াজ চৌধুরী বললেন,,
——“আহ নাহিয়ান! কি হচ্ছেটা কি? খেয়ে নাও চুপচাপ!”
নাহিয়ান বাবার কথা শুনে আর কিছু বলল না। রিদিতও শান্ত হলো। এদিকে নাহিয়ানের এমন কান্ডে ইতিমধ্যে লজ্জায় নুইয়ে পড়েছে শিশির। আর পড়বে নাই বা কেন, ফারিন আর আনায়া বিশেষ করে ফারিন যেভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে তাতে লজ্জা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সময়টা মাঝরাত…শীতের প্রহর প্রায় মাঝখানে এসে থেমেছে। চারদিক নিঝুম, কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হিমেল হাওয়ার এক-একটা ঝাপটা যেন দূরের কোনো অজানা সুরের মতো শরীরের কাঁপুনি জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে,আকাশটা নিরাভরণ, কেবল জোনাকির মতো জ্বলজ্বলে তারাগুলো মিটমিট করে চেয়ে আছে।
রাত করে ঘুমানোর অভ্যাস শিশিরের, পড়াশোনার জন্য বেশিরভাগ দিনই প্রায় রাত বারোটা বা একটাই ঘুমানো হয় তার। তবে আজ একটু বেশি তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হয়েছিল তাকে।ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে নয়টা ছোঁয়ারও মিনিট পাঁচেক আগে ঘুমিয়ে ছিল সে।
তাই হুট করেই মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল তার। আর ঘুম ভেঙে গেলে শিশিরের একটাই স্বভাব সারা রুম জুড়ে পায়চারি করা,অথবা বেলকনি কিংবা ছাদে গিয়ে দাঁড়ানো। শিশির ধীরেসুস্থে বিছানা থেকে নামলো। আজকে রোদেলা জামান আর নওরিফা খানমের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল সে।
তবে ঘুমানোর আগের মুহূর্তটা আরো বেশি মজার। নাহিয়ান আর নওরিফা খানম একপ্রকার যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলো, সবার সামনে নির্লজ্জের মত নাহিয়ান বলেছিল,,
——”বউ আমার,তবে কেন তোমাদের সাথে ঘুমাবে?”
নওরিফা খানম রেগে গিয়ে বলেছিল,,
——“আগে ভালো করে বিয়েটা কর তারপরে বউ বলিস। তখন আর কেউ তোর কাছ থেকে তোর বউকে সরাবেনা!”
তখন নাহিয়ান বলেছিল,,
——“বিয়ে আমি করেছি, কাবিননামা সাথে সাক্ষীও আমার কাছে আছে, তারপরও আবার বিয়ে করে তবে বউকে কাছে পাবো এটা কেমন অবিচার?তোমাদের নামে তো দেখছি আমাকে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে!”
নওরিফা খানম হাই তুলতে তুলতে বলেছিলেন,,
——“যা ইচ্ছে কর, আপাতত সর আমার রুমের সামনে থেকে। ঘুমাবো এখন কালকে আবার ফজরের শেষে রওনা হতে হবে!”
বলেই দরজাটা আটকে দিয়েছিলেন তিনি। নাহিয়ান তখনো রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলছিল,,
——“আজ থেকে তোমাদের নামে বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম আমি!মামলা ঠুকবো তোমাদের নামে,আমার বউকে আমার কাছ থেকে আলাদা রাখা তো,এর ফল ভোগ করবে তোমরা!”
নওরিফা খানম:“যা ইচ্ছা কর গে!”
নাহিয়ান যে কতক্ষণ রুমের সামনে বসেছিল তার ঠিক নেই।
এসব ভেবেই আনমনে মুচকি হাসলো শিশির। হঠাৎ এসে লক্ষ্য করল হাঁটতে হাঁটতে ইতিমধ্যেই চিলেকোঠার সর্বশেষ সিঁড়ি পেরিয়েছে সে। ছাদের দরজাটা খোলাই ছিল। শিশির আলতো হাত রাখতেই দরজা খুলে হিম বাতাসের এক এক ঝাপটা এসে লাগে তার শরীরে,কিঞ্চিৎ কম্পিত হয় ক্ষীন শরীরটা। সে বেশ অবাক হয় এত রাতে ছাদের দরজা খোলা কেন? নাকি নওরিফা খানম আজ তাড়াহুড়োয় দরজা দিতে ভুলেই গিয়েছেন?
যাই হোক,এত রাতে ছাদে আসাটা বাকিদের জন্য বোকামি ভিন্ন অন্য কিছু না হলেও শিশিরের জন্য বেশ স্বাভাবিক। কেননা রাতে ছাদে আসার অভ্যাস আছে তার, আর সেটা যদি হয় নাহিয়ান মঞ্জিল এর ছাদ তাহলে তো কথাই নেই। নাহিয়ানদের বাসার ছাদটা একটু বেশি সুন্দর, বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছাদটির একপাশে নানারকম ফুলের বাহার, নয়নতারা, গোলাপ, বেলি,রজনীগন্ধা গন্ধরাজসহ নানা নাম না জানা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের ফুল।
তবে সবচেয়ে সুন্দর বিষয়টি হচ্ছে ছাদের রেলিং জুড়ে লাইটিং করা।কোনো বিশেষ দিন তার উদ্দেশ্য নয়, বরং সারা বছরই ছাদটা এভাবেই সজ্জিত থাকে আলোকরশ্মিতে। ছাদে পা রাখতেই শিশিরের মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো,সে ভেবে নিল বেশ কিছুক্ষণ এখানেই কাটাব সে। অতঃপর যদি ঘুম আসে তবে ভালো না হলে চিলেকোঠার পাশের ছোট্ট রুমটাতে সজ্জিত উপন্যাসের বইগুলো পড়েই রাত কাটিয়ে দেবে।
যেই ভাবা সেই কাজ শিশির রজনীগন্ধার গাছগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো,রজনীগন্ধার মোহনীয় ঘ্রান চারিদিকে স্নিগ্ধ মায়াজাল রচনা করেছে।এক অদ্ভুত সুন্দর সুঘ্রাণ রাতের নির্জন প্রকৃতিকে যেন আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
হঠাৎই শিশির নিজের পিছনে কারো অস্তিত্ব উপলব্ধি করল,সঙ্গে সঙ্গে হিমেল হাওয়ার পরশে কম্পিত নবকিশলয়ের মতো,কম্পন সৃষ্টি হলো তার দেহ জুড়ে। ভয়ে আশঙ্কায় পিছনে ঘুরতেই সে দেখতে পেল তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে তার অসভ্য-নির্লজ্জ পুরুষ; নাহিয়ান।
নাহিয়ান কে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল শিশির। অন্যদিকে এত রাতে শিশিরকে ছাদে দেখে কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে নাহিয়ান বলল,,
——“এত রাতে ছাদে কেন? দেখছো না হিম পড়ছে? ঠান্ডা লাগবে তো!”
শিশির: “আরে এসবে কিছু হবে না? কিন্তু আপনি এত রাতে এখানে কেন?”
নাহিয়ান:“কি আর করব? বউকে ছাড়া তো আর ঘুম আসে না, তাই ভাবছি এভাবে বিয়ের আগ পর্যন্ত দিনগুলোর ছাদেই কাটিয়ে দেবো!”
শিশির:“তা ছাদে আপনার জন্য আপনার কোন বউ বসে আছে,শুনি?”
নাহিয়ান কিছুটা বাঁকা হেসে শিশিরের হাত ধরে টান দিয়ে তাকে নিজের কাছাকাছি এনে বলল,,
——“বউ আমার একটাই! তাই কোন বউ বলে অযথা বিভ্রান্ত করবেন না ম্যাম!”
নাহিয়ানের এমন কাছাকাছি উপস্থিতি নিঃশ্বাস যেন আটকে দিল শিশিরের। নাহিয়ান এর কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার সামান্য কুণ্ঠিত প্রয়াসে সে বলতে লাগলো,,
——“ছাড়ুন আমায়! কেউ চলে আসবে তো!”
নাহিয়ান:“উসস.. নারীজাতির এই একটাই দোষ জানো.. তারা জানে,যে এখন কেউ আসবে না তবুও তাদের বলতেই হবে,,‘ছাড়ুন কেউ চলে আসবে’!এখন মাঝরাত; এই সময় ছাদে কে আসবে শুনি?”
শিশির নিজের কথার জন্য নিজেই বোকা হলো। কিন্তু কি আর করার এখন তো রুমে যেতেই হবে না হলে নওরিফা খানম রোদেলা জামান কেউ যদি একবার টের পায় তাহলেই তো!!ফের নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে শিশির বলল,,
——“ছাড়ুন, ঘুম আসছে আমার আমি রুমে যাবো!”
নাহিয়ান:“ওকে!”
কথাটা বলেই নাহিয়ান কোলে তুলে নিলো শিশিরকে। শিশির বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল,,
——“কি করছেন টা কি?”
নাহিয়ান তাকে কোলে করে নিয়েই হাঁটতে হাঁটতে বলল,,
——“মাত্রই না বললা ঘুম আসছে? তাই রুমে দিতে যাচ্ছি!”
শিশির:“তাই বলে এভাবে?”
নাহিয়ান:“আর নয় তো কিভাবে? শোনো আমি কোন রিক্স নিতে চাই না, দেখা গেল এখান থেকে নামতে গিয়ে তোমার প্রায় সামান্য ব্যথা লাগল, সেগুলোর চিকিৎসা করতে গিয়েই তো আরো দুইদিন পিছিয়ে যাবে,তারমানে আরো দুই দিন এক্সট্রা আমাকে,বউ ছাড়া থাকতে হবে, না বাবা, এমনিতেই প্রায় পাঁচ ঘন্টা ২৮ মিনিট হয়ে গিয়েছে বউকে ছাড়া আছি!”
শিশির:“আপনার কি মুখে কিছু বাধে না? এত লাগামহীন কথাবার্তা বলেন কেন আপনি?”
নাহিয়ান:“আমি শুধু লাগামহীন কথাবার্তা, লাগামহীন কর্মকাণ্ডও সংগঠিত করি জানপাখি, শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়েটা হতে দাও না! তারপর তুমিও দেখতে পাবে!”
শিশির আর কোনো কথা বলতে পারল না, এই লোকটা যে এতটা নির্লজ্জ!সে লজ্জায় মাথা লুকালো নাহিয়ানের বুকের দিকের উন্মুক্ত দুইটি বোতামের ফাঁক গলিয়ে তার প্রশস্ত বক্ষদেশে।
আকাশে তখনো ঘন নীলিমার ঘোর কাটেনি,তার মাঝেই পূবের দিকটা যেন একটু একটু করে সলজ্জ হয়ে উঠছে। গাছের পাতার উপর শিশির বিন্দুরা মুক্তোর মতো ঝলমল করছে,আর চারপাশের হিমেল বাতাস যেন এক এক করে নতুন প্রাণের স্পর্শ বয়ে আনছে। পৃথিবী তখনও শান্ত, নিস্তব্ধ, কেবল দূর থেকে ভেসে আসছে দু-একটি পাখির ভোরের গান।
নানা তর্ক বিতর্ক শেষে নাহিয়ান মঞ্জিল কে পিছনে ফেলে হাওয়ায় বালুর ঝড় তুলে এগিয়ে যাচ্ছে একে একে ১০ টা গাড়ি,গন্তব্য জাফলং। প্রথম গাড়িগুলোতে বাড়ির নবীন সদস্যগন,সাথে রিয়া আর তহুরা আর শেষ গুলোয় বাড়ির প্রবীনেরা আর নাহিয়ান মঞ্জিলের সব কর্মচারীবৃন্দ।
সর্বশেষ গাড়ি টায় নওরিফা খানম আর রোদেলা জামানের সঙ্গে শিশির। শিশিরকে এক টাকার জোর করেই নিজের গাড়িতে তুলেছেন নওরিফা খানম।এই
নিয়ে নাহিয়ানের একসাথে এক প্রকার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গিয়েছিল তার। কিন্তু জবাব নওরিফা খানমের একটাই,,
——“যখন আমাদের অসম্মতিতে আমাদের মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছিলিস তখন মনে ছিল না?”
নাহিয়ান শেষমেষ রেগে নিজের মার্সিডিজ টা নিয়ে একাই বেরিয়ে গিয়েছিলো,যে স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিল তাতে তো মনে হচ্ছিল এতক্ষণে জাফলং পৌঁছে সেখানকার স্পেশাল চা টাও টেস্ট করা হয়ে গিয়েছে তার।
শীতের আকাশে সূর্যে মামা টার উপস্থিতিতে অতি ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে আছে চারিপাশে। ঘড়ির কাটায় হয়তোবা সকাল দশটা পেরিয়েছে, তবে আশপাশ দেখে বোঝার উপায় নেই,কুয়াশায় মোড়ানো প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে তবে সকাল সাতটা হবে হয়তো। সকালের খাবারের জন্য শিশিররা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামল।
হাইয়ের পাশের রেস্টুরেন্টটা বাইরে থেকে ভালোই চাকচিক্যময়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা শিশিরদের জন্য বেশ উপযোগীই হবে। আর এমনিতেও সকালে অনেক ভোরে রওনা হওয়ার কারণে ঠিকমতো নাস্তাটাও করতে পারেনি কেউ।
যথারীতি সবাই গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রবেশ করল। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল নাহিয়ান, সামনের দিকের প্রথম ডায়নিংটাতেই বসে আছে সে,কফিতে আবারো এক চুমুক দিয়ে তবে সে পিছনে ঘুরল। তাকে দেখে বেশ অবাক হলো সবাই, সবার বিষ্ময়দৃষ্টি দেখে নাহিয়ান হেসে বলল,,
——“হোয়াটস,আপ? কি মা অবাক হচ্ছ? আমি বেশ ভালো করেই জানতাম যে তোমরা এখন এখানে থামবে তাই আর কি আগে থেকেই এসে বসে ছিলাম!”
নওরিফা খানম ছেলের কথার কোন জবাব না দিয়ে শিশিরকে নিয়ে দূরের একটা ডাইনিং এ গিয়ে বসলো। নাহিয়ান কি যেন একটা ভেবে মাথা নিচু করে বাঁকা হাসলো।
নাস্তা শেষে সবাই যখন বিল মেটাতে ব্যস্ত,তখনই নাহিয়ান শক্ত করে চেপে ধরে শিশিরের হাত। তা অনুভব করে শিশির অবাক হয়ে কিছু বলার আগেই নওরিফা খানম পাশ থেকে বলে ওঠে,,
——“সবার সামনে যদি নিজের মান-সম্মান না খোয়াতে চাস তাহলে ওকে ছেড়ে দে!”
নাহিয়ান কোনরূপ হেলদোল না দেখিয়ে বলে,,
——“মান সম্মান তো আমি তোমাদের রেখেছি, এখন যদি পাবলিক প্লেসে নিজের ছেলে বউয়ের রোমান্স না দেখতে চাও তাহলে চুপ থাকো।”
নওরিফা খানম:“নাহিয়ান!”
নাহিয়ান:“ আহা মা, তুমি রিনা খানের মত দজ্জাল শাশুড়ির রোল প্লে করতে যেও না;তোমাকে মানাবে না। তুমি বরং চুপ থাকো, না হলে এখানে কিন্তু তোমার মেয়েকে অর্থাৎ আমার বউকে সবার সামনে কোলে করে নিয়ে যাব।তখন কি ব্যাপারটা ভালো দেখাবে?”
নওরিফা খানম কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কেননা তিনি নিজের ছেলেকে খুব ভালো করেই চেনেন। এখন যদি নাহিয়ান সবার সামনে শিশিরকে কোলে তুলে নেয় তাহলে মান সম্মান যাওয়া বাকি আছে তাও যাবে। এমনিতেও ছেলের এমন লাগামহীন কথাবার্তায় আশেপাশের লোকজন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।তাই আর তিনি বিশেষ বাধা দিলেন না অপরদিকে নাহিয়ান নিজের শিশির বিন্দু কে নিয়ে এগিয়ে গেল নিজের মার্সিডিজের দিকে।
গাড়ি চলছে ব্যস্ততম সড়ক গুলো পেরিয়ে এক নির্জন রাস্তা দিয়ে। শিশির তখন থেকে রাগে ফুঁসছে। ব্যাপারটা বেশ অনেকক্ষণ ধরেই পর্যবেক্ষণ করছেন নাহিয়ান। শেষমেষ হেসে সে বলল,,
——“কি ব্যাপার মিসেস নাহিয়ান চৌধুরী?এভাবে বসে আছেন কেন?কাউকে খু*নটুন করার ইচ্ছে আছে নাকি?”
শিশির রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,,
——“অবশ্যই আছে!”
নাহিয়ান:“কাকে?”
শিশির:“আপনাকে!”
নাহিয়ান: “লিখব তোমার হাতে…
আমি আমার মরণ”
শিশির: “নাটক করিয়েন না তো? সেই সময় সবার সামনে ওভাবে কেন বললেন হ্যাঁ? আপনি না হয় নির্লজ্জ আমিও কি তাই?”
নাহিয়ান:“ভুল হয়ে গেছে বউ আর হবে না!”
শিশির কোনো কথা না বলে চুপ করে গেল। কিন্তু নাহিয়ান কি আর থেমে থাকার পাত্র? সে শিশিরকে খোটাতেই থাকলো।
নাহিয়ান: “বউ? ও বউ? বউ পাখি?”
শিশির এক প্রকার অতিষ্ঠ হয়ে বলল,,
——“কি হয়েছে? ঘ্যান ঘ্যান করছেন কেন?”
নাহিয়ান:“রেগে আছো বউজান?”
শিশির: “না রাগ করবো কেন? আপনি কি রাগ করার মতো কিছু করেছেন নাকি?এ মা? যত্তসব!”
নাহিয়ান শিশিরের এমন কথায় খানিক হাসলো অতঃপর বলল,,
——“বউজান, বলুনতো আই মানে কি?”
শিশির:“এ বাবা কি কঠিন শব্দ? আমি তো এর আগে কখনো শুনিই নাই? কি করে বলবো বলুন আই মানে কি? আমি তো ৩ বছরের বাচ্চা!”
নাহিয়ান:“আহা… রাগ করোনা নোশির মাম্মা।”
নোশির মাম্মা সম্মোধনটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল শিশিরদের। এই লোকটাও না!কখন যে কি বলে? শিশির ঝটপট উত্তর দিল,,
——“আমি!”
নাহিয়ান:“ লাভ মানে?”
শিশির:“ভালোবাসা অথবা ভালোবাসি!”
নাহিয়ান:“আর ইউ মানে!”
শিশির: “আপনার কি মাথায় সমস্যা হয়েছে? কি সব উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে যাচ্ছেন;তখন থেকে?”
নাহিয়ান:“আহ এত বেশি কথা বলো কেন?যা বললাম তার উত্তর দাও।”
শিশির:“আপনি বা তুমি অথবা আপনাকে বা তোমাকে!”
নাহিয়ান এক অন্যরকম ভঙ্গিতে হেসে বলল,,
——“যাহ দুষ্টু! আমাকে ভালোবাসো সেটা সরাসরি বললেই হতো!এমন ভনিতা করে বলার কি ছিল? যাই হোক আই লাভ ইউ টু বউ পাখি,ভীষণ ভালোবাসি তোমায় জীবনের থেকেও বেশি!”
শিশির অবাক দৃষ্টিতে তাকালো নাহিয়ানের পানে। সে কখন বললো ভালোবাসার কথা? তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়লো এতক্ষন ধরে নাহিয়ান তাকে কি কি প্রশ্ন করছিল। মুহূর্তেই শিশির বুঝে গেলো, নাহিয়ানের চালাকি। কটমট দৃষ্টিতে নাহিয়ানের দিকে তাকালো সে। নাহিয়ানের দৃষ্টি তখন বাইরের পরিবেশে নিবদ্ধ। ঠোঁটের কোণে দৃশ্যমান দুষ্টু হাসির রেখা।
বেলা প্রায় দুইটার দিকে খানম কুঞ্জের সামনে এসে থামল ১১ খানা দামী গাড়ি। বাড়ির পুরনো পাহারাদার রহিম সাহেব চোখে কম দেখেন, বিছানার পাশ থেকে হাতরে চশমাটা নিয়ে সে পড়ে এগিয়ে গেলেন প্রধান দরজার দিকে। খানমরা সপরিবারে নিহত হওয়ার পর, ভয়ে সবাই চলে গেলেও তিনি এই বাড়িতেই রয়ে গেছেন।
কোথায়ই বা যাবেন তিনি?আপন বলতে তো আর কেউ নেই তার। তাই এই ভিটে আঁকড়েই পড়ে আছেন তিনি। আজ থেকে প্রায় সপ্তাখানেক আগে এইবাড়ির ছোট মেয়ে প্রায় ১৮ বছর পর ফোন করে তাকে বলেছে তারা নাকি এখানে আসছে।
রহিম সাহেব বেশ অবাক হয়েছিলেন। কেননা তার জানামতে খানমদের ছোট মেয়ে সপরিবারে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। তবে তিনি বেশ অবাক সাথে আনন্দিত হয়েছেন এটা শুনে যে তাদের নরশদের একমাত্র মেয়ে নওয়ারও বেঁচে আছে, আর তার আর নাহিয়ানের বিয়ের জন্য এখানে আসছে সবাই।
এই এক সপ্তাহে নিজের সবটুকু দিয়ে বাড়িটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তিনি। কেননা বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত থাকায় নোংরা জমেছিল বাড়ির প্রতিটি কোনে, তিনি সেইগুলো সব পরিষ্কার করে এক সপ্তাহে বাড়ির রুপটাই বদলে ফেলেছেন।
এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই তিনি এগিয়ে গেট খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে দৃশ্যমান হল এই বাড়ির ছোট কন্যা নওরিফা খানম আর তার স্বামী ইমতিয়াজ চৌধুরী সহ একগুচ্ছ নক্ষত্রেরা। সবাই কুশল বিনিময় করল তার সাথে।অতঃপর রওনা দিলো বিশাল খানম কুঞ্জের দিকে।
নওরিফা খানম এত বছর পর নিজের পিত্রালয় পা রেখে আবেগ আটকে রাখতে পারলেন না। তার চোখ বেয়ে অবিরত ধারায় গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণারা। তার মনে পড়ে গেল এখানে কাটানো প্রত্যেকটা স্মৃতি। বাড়ির প্রতিটি জড় বস্তুও যেন তাকে চিনতে পেরেছে।যে বাড়ির প্রত্যেকটা কোন তার চেনা ছিল, এই বাড়িতে কতকাল পর পদার্পণ করল সে। প্রতিটি ইটের গাঁথুনি যেন তাকে প্রিয় ভাই ভাবিদের নির্মম মৃ*ত্যু*র কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৬
অন্যদিকে জীবনে প্রথম নিজের বাবার বাড়িতে পা রাখল শিশির। যেন এক অদ্ভুত রকম অনুভূতি। এটাই নাকি তার বাবা বাড়ি যেটা সম্পর্কে কিছুদিন আগে পর্যন্তও সবকিছু ধোঁয়াশা ছিলো তার সামনে।
বাকি সবাই অপলক দৃষ্টিতে বাড়িটিকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। কি বিশাল বাড়িটা!যেন পুরনো কোনো দাম্ভিক রাজার তৈরি স্থাপত্য শৈলী।