মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৮ (৪)

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৮ (৪)
নওরিন কবির তিশা

শিশির আর নাহিয়ানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন আজ। হৃদয়ের প্রেম কাব্যে স্বর্ণাক্ষরে খচিত মূহুর্তটি সংঘঠিত হবে আজ। তাদের অপেক্ষার প্রহরের অবসান ঘটবে আর মূহুর্ত খানেকের মাঝেই;পূর্ণতা পাবে তাদের প্রনয়।
তবে আজ আর খানম কুঞ্জে নয়,সেই পূর্ণতার তিথি সংঘঠিত হতে চলেছে সুরমা নদীর তীরবর্তী এক শান্ত শাখায়;নগরের কোলাহল থেকে কিছুটা দূরে, সবুজের ছায়া আর নীলাকাশের ‌নিচের এক শান্ত, মোহময়,নির্জন নিহারীকায়।যার কাঁচের দেয়ালগুলোতে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা ঠিকরে পড়ে সৃষ্টি করে এক অলীক কল্পনার স্বপ্নপুরী।
সিলেটের বক্ষস্থলে দাঁড়ানো সোনালি আলোয় মোড়া এক বিশাল প্রাসাদ—-নাম কুশিয়ারা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হল। শুধু সিলেট নয় বলতে গেলে গোটা বাংলাদেশের বিখ্যাত ওয়েডিং ভেনু এটি। আর হবেই না বা কেন? এর সৌন্দর্য আর দাম্ভিক স্তম্ভের আধিপত্য এটি যে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ওয়েডিং ভেনু তার প্রমাণক হিসেবে কাজ করে।

এটিকে প্রথম দেখায় মনে হবে যেন বাংলাদেশের মাঝেই নেমে এসেছে এক পাশ্চাত্য কোনো উন্নত দেশের ওয়েডিং এরিয়া।এটির ভেতরের সৌন্দর্য যেন বাইরের সৌন্দর্যের থেকেও কয়েকশো গুণ বেশি। সম্পূর্ণ অন্য এক জগতের সৃষ্টি সেখানে—-ঝাড়বাতির ঝলকানিতে ছাদটা রূপকথার আকাশের মতো দীপ্ত,দেয়াল জুড়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ,‌মেঝের ঝকঝকে মার্বেল যেন আয়নার মতো সবকিছু প্রতিবিম্বিত করে।
এমনই এক রাজকীয় পরিবেশে বিশাল পুষ্প আর আলোকসজ্জিত আসনে বসে আছে শিশির।তার পরনে অফ হোয়াইট কালার পাকিস্তানি ওয়েডিং লেহেঙ্গা,যার প্রতিটি ভাঁজে পাথরের সূক্ষ্ম কারচুপি। লেহেঙ্গাটার বিশেষত্ব হচ্ছে এটা শুধুমাত্র শিশিরের জন্যই তৈরি, পাকিস্তানি একজন স্পেশাল ফ্যাশন ডিজাইনার প্রায় অর্ধ মাসের বেশি সময় ধরে তৈরি করেছে এটি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শিশিরের মাথায় অফ হোয়াইট কালার দোপাট্টা যাতেও দৃশ্যমান একই রকম সূক্ষ্ম পাথুরে কাজ। তার কানে রুবির বাহুবালি ঝুমকা,কপালে পাকিস্তানি ঝাপটা,ডান নাসাপুটে শোভা পাচ্ছে ঝুমকো নথ। গোলাপি অধরদ্বয় আজ আবৃত ডার্ক মেরুন লিপস্টিকে। মধুরঙ্গা মনে বিশিষ্ট চোখের পাতা আজ সজ্জিত গাঢ় আইলাইনারের সূক্ষ্ম আচরে।
ঘড়ির কাঁটাটা সবে সকাল দশটা ছুঁয়েছে। হঠাৎই শিশির শুনতে পায় আনায়া আর ফারিনের কলরব,,
——“নাহিয়ান ভাইয়া এসেছে,নাহিয়ান ভাইয়া!”
নাহিয়ানের নাম কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই লাজুক হাসে শিশির। আসলে শিশিররা একটু দ্রুতই চলে এসেছিল কনভেনশন হলে, এটা অবশ্য পূর্বপরিকল্পিত, কেননা নওরিফা খানম চান বিয়েটা আর পাঁচটা বাঙালি বিয়ের মতোই হোক যেখানে বরকে শাশুড়ি নিজে বরণ করে, বিবাহের শুভ উদ্বোধন করবে।

তাই তারা যদি একসাথে আসে তাহলে এটা কখনোই সম্ভব হবে না, এমন চিন্তাধারা থেকেই শিশিররা ঘন্টাখানেক আগে এসেছে কনভেনশন হলে। বাড়ির সকল মেয়েরা কনেপক্ষ আর ছেলেরা বরপক্ষ।
হলের প্রবেশদ্বারে রোদেলা জামানের বরণ শেষে নাহিয়ানসহ বাড়ির প্রত্যেকটা ছেলেকে একপ্রকার ঘিরে দাঁড়ালো প্রত্যেকটা মেয়ে। সবার মধ্য থেকে ফারিন বলল,,
——“উহু! ভাইয়া এত সহজ তো আপনার হাতে আমার চন্দ্রমুখী আপুটাকে তুলে দিতে পারব না! খরচ তো চাইই চাই!”
নাহিয়ান কিছু বলার আগেই নির্ঝর বলল,,

——“কি হচ্ছেটা কি এটা?”
ফারিন:“আপনি চুপ থাকুন। এটা আমার আর আমার দুলাব্রোর ব্যাপার!”
নির্ঝর:“দুলাব্রো আবার কি জিনিস উনি ভাসুর তোমার!”
ফারিন:“ওই হলো একটা!”
তাদের এমন খুনসুটিতে নাহিয়ান হেসে বলল,,
——“তো শালিকা ওরফে চৌধুরীদের ছোট গিন্নি কি লাগবে তোমাদের?”
ফারিন:“বেশি কিছু না ভাইয়া! এই ধরুন আমরা ছয়জন আছি ছয় জনকে দশ হাজার করে ৬০ হাজার;আপনি না হয় দশ হাজার কম করে ওই ৫০ হাজার টাকাই‌ দেন!”
নির্ঝর:“ভাইয়া। তুমি শুধু আমাকে অনুমতি দাও,ওকে আমি ৫০ হাজার টাকার পরিবর্তে ৫০ বার তোমার সামনে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছি!”
নাহিয়ান হেসে বলল,,

——“ব্যাপারনা! ব্যাপারটা যখন আমার বউকে নিয়ে তখন তো আর কোনো অপশনই থাকেনা!”
সে তার বর্তমান পিএ তাসরিফকে ডেকে বলল,,
——“ওরা যা চাইছে তার ডাবল দিয়ে দাও!”
ফারিন অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। নাহিয়ান ভাইয়া এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেল। তাও আবার তাদের টাকার দ্বিগুণ দিতে চাইছে! সে নির্ঝরের দিকে ফিরে মুখ বাকিয়ে বলল,,
——“দেখেছেন ব্যাটা করলা সবাই আপনার মত হয় না! মিস্টার নিরামিষ কোথাকার!”
তাসরিফ নাহিয়ানের কথা অনুযায়ী দ্রুত গাড়ি থেকে টাকা এনে ফারিনদের হাতে তুলে দিল।তারা সবাই নাহিয়ানকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।

নাহিয়ান আর শিশিরের মাঝে বিশাল এক পুষ্প পর্দার ব্যবধান। পর্দার ঐ পাশে বসা শিশির আর এই পাশে নাহিয়ান। নাহিয়ান শত চেষ্টার পরও শিশিরকে দেখতে না পেয়ে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে কাজী সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,,
——“বিয়েটা একটু তাড়াতাড়ি পড়ান চাচা!যদিও আমরা আগে থেকেই বিবাহিত! যাই হোক একটু দ্রুত করুন;অনেকক্ষণ হয়ে গেল বউটাকে দেখেনি!”
নাহিয়ান এর এমন কথায় একসঙ্গে হেসে উঠল সবাই। কাজী সাহেব দরুদ পড়া শেষে বিবাহ কার্যসম্পন্ন করলেন। অতঃপর নব দম্পতির জন্য দুআ শেষে কাজী সাহেব নাহিয়ানের দিকে ফিরে বলল,,
——“এবার তুমি তোমার বউকে দেখতে পারো বাবা!”
নাহিয়ান মোনাজাত সেরে বলল,,,

——“আলহামদুলিল্লাহ!”
সে নিজের সামনে থাকা পুষ্পপর্দাটা দ্রুত এক টান দিয়ে সরিয়ে দিল। কিন্তু শিশির কই? তার তো পর্দার ঐ পাশে থাকার কথা ছিল!নাহিয়ান আশেপাশে উঁকি ঝুঁকি মেরেও ‌শিশিরকে দেখতে না পেয়ে সামনে থাকা ইমতিয়াজ চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলল,,
——“বাবা!”
ইমতিয়াজ চৌধুরী:“হু!”
নাহিয়ান:“আমার বউ কই?”
সবার সামনে ছেলেরা এমন প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন ইমতিয়াজ চৌধুরী।
ইমতিয়াজ চৌধুরী:“তোর বউ কই?তা আমি কি জানি?”
নাহিয়ান বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল,,

——“আমি নিশ্চিত এবারও তোমার বউ অর্থাৎ আমার মা আমার বউকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আই প্রমিস ইউ বাবা মা যদি আজকেও আমার বউকে আমার থেকে দূরে রাখে না! তুফান বয়ে যাবে কিন্তু! তুমি নিজেও কোনোদিন তোমার বউকে আর কাছে পাবে না।”
ছেলের এমন কথায় ইমতিয়াজ চৌধুরী রেগে গিয়ে বললেন,,,
——“চুপ করো অসভ্য ছেলে! তুমি জানো না তোমার মা এখানে আসেনি!”
নাহিয়ান:“ওওহ আসেনি না?”
তারপর সে আশেপাশে তাকিয়ে বাচ্চাদের মত মুখ করে বলল,,
——“কিন্তু আমার বউ কই!”
নাহিয়ানের এমন কাণ্ডে ‌সবাই মুখ চেপে হাসছে। ঠিক তখনই পিছন থেকে সিকদার শাহ বললেন,,
——“এই যে তোমার বউ,বাবা!”

নাহিয়ান পিছনে তাকাতেই দেখতে পারলো শিশিরের হাত শক্ত করে ধরে আছেন সিকদার শাহ। নাহিয়ানকে তাকাতে দেখে তারা এগিয়ে আসলো। সিকদারের শাহ নিজের মেয়ের হাত নাহিয়ান এর হাতে তুলে দিয়ে বলল,,
——“এই নাও, আজ থেকে শিশির শুধুই তোমার। আর কেউ তোমার কাছ থেকে তোমার বউকে আলাদা করবে না। তবে আমাকে এইটুকু কথা দাও আমার মেয়েকে আমি আজ ঠিক যেভাবে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি, এভাবেই যেন জীবনের শেষ মুহূর্তটা পর্যন্ত তুমি ওর হাত আঁকড়ে রাখবে।”
নাহিয়ান শিশিরের হাত শক্ত করে ধরে বলল,,
——“আমি কথা দিচ্ছি, জীবনের শেষ রক্ত কণা টুকু যতক্ষণ আমার শরীরে থাকবে ততক্ষণ এই নাহিয়ান চৌধুরী তার প্রাণনাশিনীকে রক্ষা করে যাবে ইনশাআল্লাহ!”

খানম কুঞ্জটা এখন যেন জনমানবহীন ধু ধু মরুভূমির ন্যায় খা খা করছে! বাড়ির নবীনেরা আজ কেউ এখানে নেই। সবাই গিয়েছে কুশিয়ারা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হলে;এক রাজকীয় বিবাহ অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে।বিশাল বাড়ি জুড়ে হাতেগোনা কয়েকজন। নওরিফা খানম,হাসনা খান, শিউলি হক আর আশপাশের কিছু মহিলারা।
তবে তারা ব্যস্ত নব দম্পতিকে স্বাগতম জানানোর আয়োজন নিয়ে।ঘড়ির কাঁটায় হয়তোবা বেলা বারোটা,ইয়ালিনা দাঁড়িয়ে আছে দোতলার উত্তর প্রান্তের এক নির্জন বারান্দায়। বারান্দাটা ঠিক নিচে কয়েক কদম দুরে বিশাল এক স্বচ্ছ পানির লেক। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে লেকের পানির কল কল শব্দ,তবে সেই শব্দ যেন আর্তনাদের সুরে ইয়ালিনার কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে।

ভেতরটা ভেঙে চড়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার। আজকে সবটা শেষ হয়ে গেল তার! এখন থেকে বেঁচে থাকা মরন যন্ত্রণা থেকেও কঠিন হবে তার জন্য!চোখের সামনে বারংবার ভেসে উঠেছে নাহিয়ানের মুখটা, পরক্ষণেই ইয়ালিনার ভেতর থেকে কেউ যেন তাকে ডেকে বলছে,,“আজ থেকে তোর নাহিয়ান ভাইয়া অন্য কারো, সেই আজ থেকে হালাল হয়েছে শিশিরের নামে।”
নিঃশ্বাসের পদচারণা ক্রমশই লোপ পাচ্ছে তার। বারান্দার রেলিং এ হাত রেখে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে হঠাৎই গেয়ে সে উঠলো,,
🎶 Humne dhadkan dhadkan Karke….
Dil tere Dil se jor liya…Aankhon ne aankhen parh parh ke…..
Tujhe uird bana ke yaad Kiya….
Tujhe pyar Kiya to..Tu hi batha…
Humne kya koi Julum Kiya..?
Aur Julum Kiya hein to hi batha…. Yah julum ki julum ki kya hai saja..??
Tum jeet Gaye ham hare..ham hare aur tum jeete….🎶

গান শেষ করেই পাগলের মতো বিলাপ করে সে চিৎকার করে ফের বলে ওঠে,,
——“সত্যিই তুমি জিতে গেছো শিশির! আমি হেরেছি,হেরেছে আমার ভালোবাসা!জিতে গেছো তুমি শিশির,জিতেছো!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই রেলিংয়ের উপর রাখা ছু*রি*টা নিয়ে যেইনা নিজের হাতের শিরা গুলোর উপর বসাতে যাবে ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন একটা শক্ত হাত আটকে দিল তার কার্যক্রমটা। ইয়ালিনা পাশ ফিরে লোকটাকে কিছু বলার আগেই সপটে তার গালে এক থাপ্পর বসিয়ে দিল সেই ব্যক্তিটি।ইয়ালিনা রেগে তাকে কিছু বলার আগেই সেই জান চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,
——“আর ইউ ক্রেজি? এটা কি করছিলে তুমি? মরার এত শখ তোমার?…..”
তাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে এক ঝটকায় তার হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে ইয়ালিনা বলল,,
——“হু দ্যা হেল আর ইউ! হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মি?”
শেজাহান রেগে গিয়ে বলল,,,

——“এই মেয়ে? ত্যাড়ামি করো ঠিক আছে! কিন্তু মরতে যাচ্ছিলে কেনো?”
ইয়ালিনা:“মাই উইস! আপনি সরুন এখান থেকে। আমাকে থাকতে দেন আমার মত!”
শেজাহান:“অবশ্যই তোমাকে একা থাকতে দিব। তবে এখানে নয়, তোমার রুমে। চলো আমার সাথে!”
ইয়ালিনা:“যাব না!”
শেজাহান:“আমি যার জন্য ম*র*তে যাচ্ছিলে না ইতিমধ্যে সে অন্য কারো হয়ে গিয়েছে। আর এমনিতেও সে তো কখনো তোমাকে ভালোওবাসেনি! তাহলে তার জন্য নিজের এত সুন্দর জীবনটা খোয়ানোর কি মানে?”
ইয়ালিনা অবাক হয়ে তাকালো শেজাহানের দিকে। সে কিভাবে জানলো ইয়ালিনার মনের কথা? ইয়ালিনার অবাক চক্ষু দেখে শেজাহান সামান্য হেসে বলল,,

——“কি ভাবছো আমি এসব কিভাবে জানলাম? আমি হয়তো জানো না আমি এ আর স্যারের পিএ ছিলাম। সো তার প্রত্যেকটা তথ্য আমার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা। আমি তোমার ব্যাপারেও জানতাম, আর শিশির ম্যামের ব্যাপারেও। স্যার যে শিশির ম্যামকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমার থেকে ভালো হয়তো কেউ জানে না। আর রইল বাকি তোমার কথা স্যার তো কখনো তোমার মেসেজগুলোও পড়ে দেখত না। তুমি মেসেজ দিয়ে জ্বালাতন করতে বলে নিজের এফবি একাউন্টটাও নষ্ট করে ফেলেছিলো। বুঝছো কিছু?”
ইয়ালিনার চোখ বেয়ে অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ল। নাহিয়ান ভাইয়া এতটা ঘৃণা করে তাকে? অন্যদিকে শেজাহান ইয়ালিনার কন্দনরত মুখশ্রীর দিকে চেয়ে বলল,,,

——“এত কিছু বলার জন্য আমি রিয়েলি সরি! তবে আমার মনে হলো তোমাকে সত্যটা জানানো উচিত। যাইহোক পরিশেষে তোমাকে একটাই কথা বলবো, জীবনটা অনেক মূল্যবান, এমন মানুষের পিছনে ঘুরে করে জীবনটাকে নষ্ট করো না যাকে তুমি কখনোই পাবে না! বরং তুমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখো,নিশ্চয়ই তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি হয়তো তোমার জন্য এমন কাউকে রেখেছেন যে সবার অজান্তে এমন গভীরভাবে তোমাকে ভালোবেসে যাচ্ছে, যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই স্থান ত্যাগ করল শেজাহান। ইয়ালিনা অবাক নয়নে চেয়ে থাকল তার দিকে। তার বলা প্রথম কথাগুলোতে ইয়ালিনার কষ্ট হলেও শেষ কথাগুলো তার মনে আলোড়নের সৃষ্টি করছে। হঠাৎই তার মনে পড়লো শেজাহানের বলো শেষ কথাটা,,যে সবার অজান্তে এমন গভীরভাবে তোমাকে ভালোবেসে যাচ্ছে, যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না! কার কথা বলল শেজাহান?

খাওয়া দাওয়া, বর কনের আয়নায় মুখ দেখা সহ বিবাহের সমস্ত কার্যক্রম শেষে নাহিয়ান শিশির সহ সবাই এখন রওনা হবে জাফলং এর উদ্দেশ্যে। প্রায় তিন ঘন্টার পথ। তবে নাহিয়ান আর শিশির যাবে হেলিকপ্টারে। বাদবাকি সবাই গাড়িতে।
আসন থেকে উঠে ল্যান্ডিং প্যাডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল নাহিয়ান আর শিশির, তাদের ঠিক পিছনে হেঁটে চলেছে বাকি সবাই।হলের প্রবেশদ্বারের কাছে এসে থামলো শিশির, কস্মিনকালেও হেভি ড্রেস না পড়া তাকে আজ এত হেভি গর্জিয়াস ড্রেস পড়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। শিশিরকে থামতে দেখে থামলো নাহিয়ানও। সে কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,,
——“কোন সমস্যা? কি হচ্ছে? বল আমায়!”
নাহিয়ান কে এতটা চিন্তিত দেখে শিশির হেসে বলল,,
——“আরে তেমন কিছুই না। আসলে লেহেঙ্গাটা অনেক হেভি তো; এইজন্যই আরকি!”
নাহিয়ান:“ওহ এই ব্যাপার!তা আগে বলবা না?”
শিশির:“হ্যাঁ আসলে!”

তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবার সামনে তাকে কোলে তুলে নিলো নাহিয়ান। উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেল নাহিয়ানের এমন কান্ডে। শিশির চোখ বড় বড় করে বলল,,
——“কি করছেন টা কি? নামান বলছি!”
নাহিয়ান:“আর কোনো সমস্যা হচ্ছে,বউ?”
শিশির:“নামান না প্লিজ‌। এখানে সবাই আছে!”
নাহিয়ান:“তোমাকে যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও।”
শিশির:“না!”
নাহিয়ান:“তাহলে আর কি?”
নাহিয়ান মুচকি হেসে শিশিরকে কোলে করে নিয়েই এগিয়ে চলল ল্যান্ডিং প্যাডের দিকে। লাজুক শিশির লজ্জায় নিজের মুখ লুকালো নাহিয়ানের পাথুরে কাজ করা পাঞ্জাবি দ্বারা আবৃত প্রশস্ত বক্ষদেশে।‌কয়েক জোড়া অবাক চক্ষু নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তাদের দিকে। বেরিয়ে গেল তারা।
অন্যদিকে তাদের এমন খুনসুটিতে ফারিন মুগ্ধ নয়নে ‌তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে আনমনেই বলে উঠল,,

——“হাউ কিউট না? নাহিয়ান ভাইয়া কি দারুনভাবে শিশির আপুকে কোলে তুলে নিলো, পুরাই সিনেমাটিক আল্লাহ…!”
অবাক ফারিন খেয়ালই করে নি যে তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝর।বউয়ের এমন কথায় নির্ঝর সামান্য ঝুঁকে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,,
——“তোমারও কি শিশির আপুর মতো এমন সবার সামনে বরের কোলে উঠতে ইচ্ছে করছে?”
তাকে কে প্রশ্নটা করেছে সে দিকে খেয়াল না করেই ফারিন নাক সিঁটিয়ে বলল,,
——“উহ!আর সবার সামনে বরের কোলে ওঠা। একান্তেও কখনো নিলো না!”
নির্ঝর:“ইসস!কি কষ্ট!তাহলে তো আপনার মনোবাসনাটা আজ পূর্ণ করতেই হচ্ছে।”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৮ (৩)

ফারিন চমকে তাকালো নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর এক লহমায় তাকে বিস্ময়ের চূড়ান্তসীমায় পৌঁছে দিয়ে সবার সামনে কোলে তুলে নিলো।ফারিনের হৃদযন্ত্রটা লজ্জায় বেগতিক হারে কাঁপতে লাগলো। নির্ঝর তাকে কোলে করে নিয়ে সবার পাশ কাটিয়ে চলে গেল প্রবেশদ্বার পেরিয়ে।
অন্যদিকে নাহিয়ানের দেওয়া ঝটকা থেকে উঠতে না উঠতেই নির্ঝরের এমন কান্ডে উপস্থিত জনতা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। সাজিদ মুখ বিকৃত করে বলল,,
——“সমস্যা নাই!নাহিয়ান গেছে যেই পথে নির্ঝরও যাবে সেই সাথে।”
রিদিত:“চৌধুরীদের পোলাপাইন মামা…. স্বভাবতই বউ পাগল!”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৯