মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৬০

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৬০
নওরিন কবির তিশা

কুয়াশার ঘোমটা সরিয়ে, পুব আকাশের সিঁদুররাঙা আলো তখন মেখেছে সদ্য ফোটা বকুল গুচ্ছ।শিশিরের মুখের এক পাশে এসে পড়েছে শীতের ভোরের সেই প্রথম রোদ্দুরের নরম ছোঁয়া। সুস্নিগ্ধ রোদের সেই উষ্ণতায় ঘুম ভাঙলো শিশিরের।
নাহিয়ানের উন্মুক্ত দেহের শক্ত বাহুডোরে আবদ্ধ শিশির তাকিয়ে দেখল তার প্রিয় পুরুষ তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নাহিয়ানের মুখেও রোদ এসে পড়েছে, কপালে লেপ্টে থাকা চুলের গোছা রোদের নরম আলোয় সোনালি দেখাচ্ছে। ঘুমন্ত নাহিয়ানকে এক অদ্ভুত ঘোর লাগা সুদর্শন লাগছে। হঠাৎই তার দৃষ্টি কেড়ে নিলো নাহিয়ানের বুকের বাঁ পাশে লেগে থাকা রঞ্জকের গাঢ় রং।

মুহূর্তেই গত রাতের কথা মনে পড়ে লাজে রাঙা হলো তার ফর্সা মুখশ্রী। লাজুক হাসলো শিশির—-সে হাসিতে যেন মিশে আছে এক প্রেমময় নিশীথ-জাগরণের সুর। হঠাৎই শিশিরের বোধগম্য হলো তারা এখনও সেই ব্যালকনিতে,আর তার শরীরে জড়ানো নাহিয়ানের শার্ট‌খানা।
সে কাউচ থেকে নামার জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগলো।কিন্তু কিছুতেই নাহিয়ানের শক্ত বাঁধন থেকে নিজেকে সরাতে পারল না।অন্যদিকে শিশিরের এমন ‌সঞ্চালনে,ঘুম ভাঙলো নাহিয়ানের। তৎক্ষণাৎ শিশিরকে আরো শক্তভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে সে বলল,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

——“উফ বউ… এত নড়ো কেন?”
শিশির কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,,
——“সরুন তো উঠবো!”
নাহিয়ান চোখ দুইটা বন্ধ রেখেই বলল,,
——“ কি বললে?”
শিশির:“উঠবো!”.
নাহিয়ান দুষ্টু হেসে বলল,
——“আপাতত আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না মিসেস নাহিয়ান চৌধুরী।”
শিশির বুঝলো নাহিয়ান এখন কোনোমতেই ভালোয় ভালোয় তাকে ছাড়বে না। কিন্তু এখন যে করেই হোক তাকে গোসলটা সারতে হবে। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই শিশিরের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে সামান্য চিৎকার করে বলল,,

——“উফস!”
সঙ্গে সঙ্গে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল নাহিয়ান। উদ্বিগ্ন কন্ঠে সে শুধালো,,
——“কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?বলো?”
ব্যাস নাহিয়ানের এমন উদ্বিগ্নচেতাকেই কাজে লাগালো শিশির। শিশিকে দেখতে যখনই নাহিয়ান তার বাঁধন শিথিল করলো তৎক্ষণাৎ শিশির এক পলকে কাউচ থেকে নেমে দ্রুত রুমের দিকে দৌড় দিয়ে বলল,,
——“ইট ওয়াজ আ ট্রিকস মিস্টার এআর!”
নাহিয়ান শিশিরের এমন কান্ডে ঠোঁট কামড়ে তার পিছন পিছন দৌড়ে গিয়ে বলল,,
——“তবে রে!”
শিশির ততক্ষণে রুম পেরিয়ে,ওয়াশরুমে ঢুকে,দরজা লক করে দিয়েছে। নাহিয়ান ওয়াশরুমের বাইরে থেকেই বলল,,
——“আম ওয়েটিং ডার্লিং!তুমি জাস্ট বাইরে বের হও! বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি!”
শিশির ওয়াশরুমের ভেতর থেকে বলল,,
——“বের হলে তো!”

লম্বা একটা শাওয়ার নেওয়া শেষে প্রায় অর্ধ ঘন্টা পর ওয়াশরুম থেকে বের হলে শিশির। তার পরনে মেরুন কালার সুতি শাড়ি যার পাড় জুড়ে সুক্ষ্ম এমব্রয়ডারির কারচুপি। ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই একবার রুমে উঁকি দিল শিশির।নাহিয়ান উদাম শরীরে পাশ ফিরে শুয়ে আছে বিছানায়।
নাহিয়ানকে ঘুমাতে দেখে মুচকি হাসলো শিশির। অতঃপর ড্রেসিং টেবিল থেকে নিজের কানের দুল,আর গলার নেকলেসটা পড়ে,ভেজা চুলগুলো ছাড়িয়ে নিলো চিরুনির আলতো আঁচড়ে। নাহিয়ান তখনো বালিশে মুখ ডুবিয়ে। হঠাৎ শিশিরের মনে এক অন্যরকম দুষ্টু বাসনা জাগলো। সে নিজের চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে না শুকিয়ে;বরং একটা টাওয়াল দিয়ে জলসিক্ত চুলগুলো এলোমেলোভাবে মুছতে লাগলো‌।

যার দরুন সেই চুলের বিন্দু বিন্দু জলকণা ছিটকে গিয়ে পড়ল নাহিয়ানের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে। এক-দু’ফোঁটা নয়, একেবারে যেন বর্ষার জলধারা। চোখ পিটপিট করে খুলল নাহিয়ান। তবে তাকে কিছু বলতে না দিয়ে শিশির টাওয়াল টা নিচে ফেলেই দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নাহিয়ান শুধু মুচকি হাসলো তার যাওয়ার পানে চেয়ে। এমন একটা স্নিগ্ধ সকালই তো বরাবরের বাসনা ছিল তার। যে সকালে শিশিরের ভেজা চুলের বিন্দু বিন্দু পানির নরম স্পর্শে ঘুম ভাঙবে তার।

খানম কুঞ্জের রান্না ঘরের সামনের বিশাল ডাইনিং এ একত্র হয়েছে সবাই। আজকে সবাই একসঙ্গে বসেছে খাবার টেবিলে, এমনকি বাড়ির মহিলারাও। আর তাদের সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে শিশির একা হাতে। এটা অবশ্য চৌধুরী আবাসনেরই একটি রীতি, বিয়ের পরদিন নববধূর সবাইকে পরিবেশন করে খাওয়াতে হবে। অবশ্য রান্নাটাও নিজের হাতে করার নিয়ম,তবে শিশিরকে রান্না করতে দেননি নওরিফা খানম।

রান্নাবাড়ার সমস্ত কাজ তিনি,শিউলি হক,রোদেলা জামান সানজিদা সুলতানা আর হাসনা খানই সামলিয়েছেন। তবে পরিবেশনটা শিশিরকেই করতে হবে। শিশির নিজের শাড়ির আঁচল টা মাথায় দিয়ে পাক্কা গিন্নির মতো একে একে সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে। নাহিয়ান অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার গিন্নিসাহেবার দিকে। নাহিয়ান অবশ্য তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের ধমকে বর্তমানে লক্ষী ছেলের মতো বসে আছে সে।
একে একে সবাইকে খাবার পরিবেশন শেষে শিশির নাহিয়ান এর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। নাহিয়ান তার দিকে চেয়ে বলল,,

——“তুমি বসবা না?”
শিশির কিছু বলার আগেই হাসনা খান,নওরিফা খানমের দিকে চেয়ে বলল,,
——“আপা, তোমার ছেলে তো দেখছি একদমই বউ পাগলা!”
হাসনা খানের এমন কথায় উপস্থিত সবাই শিশিরের দিকে চেয়ে হাসলো। শিশির কিছুটা রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নাহিয়ানের দিকে। তা দেখে নাহিয়ান বাচ্চাদের মত মুখ করে বল,,
——“তাকাচ্ছ কেন বউ? আমি আবার কি করলাম?”
শিশির দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

——“আপনি কি খাবেন?”
নাহিয়ান:“তোমাকে ছাড়াই?”
শিশির:“হ্যাঁ!”
নাহিয়ান:“আচ্ছা!”
নাহিয়ান খেতে শুরু করলো। উপস্থিত সবাই তখন ঠোঁট চেপে হাসছে। ফারিন নির্ঝরের দিকে ইশারা করে বোঝালো,,
——“আপনিও তো একটু এরকম হতে পারেন নাকি?”
প্রতুত্তরে নির্ঝর ইশারায় কিছু একটা বলল ফারিনকে,যা মাথার এক হাত উপর দিয়ে গেল তার।

খেতে খেতে হঠাৎই নওরিফার দিকে ফিরে নাহিয়ান বলল,,
——“মা!”
নওরিফা খানম:“জ্বী!”
নাহিয়ান:“কত ঝাল দিয়েছো? জানো না আমি ঝাল খেতে পারিনা!”
বলেই গ্লাস থেকে পানি নিয়ে ঢক ঢক করে তা খেতে থাকল নাহিয়ান। নওরিফা খানম হাসনা খান, সানজিদা সুলতানা,রোদেলা জামান সহ সবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। কই তারা তো রান্নার সময় সেভাবে ঝাল দেয়নি! আর না তো অন্য কারো ঝাল লেগেছে তাহলে নাহিয়ানের ঝাল লাগলো কিভাবে?
নওরিফা খানম তাকে কিছু বলার আগেই দ্রুত সেখান থেকে উঠে ঝালে মৃদু আর্তনাদ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল নাহিয়ান। নওরিফা খানম দ্রুত শিশিরের দিকে ফিরে বলল,,

——“নুয়া,মা দেখ ফ্রিজে আইসক্রিম আছে, দ্রুত নিয়ে আয় তো!”
নওরিফা খানমের বলতে দেরি, শিশির দ্রুত রান্নাঘরের ফ্রিজ থেকে আইসক্রিমের বাটিটা নিয়ে দৌড়ে গেল নাহিয়ানের রুমের উদ্দেশ্য। পিছন পিছন আনায়া আর ফারিন যেতে গেলেই নির্ঝর আর রিদিত তাদের ডেকে বলল,,
——“যেও না, ভাইয়ার যে ঝাল লেগেছে সেটা একমাত্র শিশিরই ঠান্ডা করতে পারবে।”
তাদের সবার আর বুঝতে বাকি রইল না নাহিয়ানের এমন অকারনে অতিরিক্ত ঝাল লাগার কারণ। একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তারা।
এদিকে……..
শিশির নাহিয়ানের পিছন পিছন দৌড়ে এসে আইসক্রিমের কৌটাটা খুলে তার থেকে সামান্য, আইসক্রিম নিয়ে নাহিয়ানের দিকে এগিয়ে গেলেই নাহিয়ান খপ করে ধরে বসলো তার হাত। শিশির উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,,

——“দ্রুত এটুকু খেয়ে নিন। দেখবেন ঝালটা কম লাগবে।”
নাহিয়ান:“কিসের ঝাল?”
নাহিয়ানের এমন প্রশ্নে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো শিশির।
শিশির:“আপনার না ঝাল লেগেছে?”
নাহিয়ান:“লেগেছে নাকি?”
শিশির:“ঝাল লেগেছে বলেই তো,ডাইনিং থেকে ওভাবে উঠে আসলেন!”
নাহিয়ান:“হ্যাঁ লেগেছেই তো।”
শিশির:“সেজন্যই তো বলছি, আইসক্রিমটা খান। কম লাগবে।”
নাহিয়ান শিশিরের হাত থেকে আইসক্রিমের বক্সটা নিয়ে বেড সাইট টেবিলের উপর রেখে তার দিকে ফিরে বলল,,

——“তুমি থাকতে আইসক্রিম কেন? ইউ নো ইউ আর মাই ফেভারিট আইসক্রিম! আই ওয়ান্না টেস্ট ইউ, ডার্লিং!”
নাহিয়ান এর এমন কথায় ‌শিশির চমকে তাকালো। কম্পিত ঠোঁটে সে কিছু বলার আগেই নাহিয়ান তীব্রভাবে দখল করলো তার ঠোঁটজোড়া।কিঞ্চিৎ কম্পিত হলো শিশিরের ক্ষীণ শরীর। লজ্জায় মিইয়ে পড়লো সে!!!

খানম কুঞ্জের সন্ধ্যাটা আজ নিয়ে এসেছে সবচেয়ে বেশি স্নিগ্ধতা।দোতলার দক্ষিণ সাইডের লেকের উপরের বিশাল ব্যালকনিতে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। হাসি মজা আর ঠাট্টায় ভিজে যাচ্ছে মুহূর্তগুলো। মূলত আর কিছুদিনের মাঝেই জাফলং ছাড়বে তারা,এজন্যই এখনো কোথায় কোথায় ঘোরা বাকি আছে তাই নিয়েই আলোচনা হচ্ছে,সেই তখন থেকে।
এত আনন্দের মাঝেও শিশির খেয়াল করলো নিশ্চুপ আনায়া।সে এগিয়ে গিয়ে আনায়ার পাশে বসে বলল,,

——“Any problem আয়ু?”
আনায়া জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল।
আনায়া:“না না, তেমন কিছুই না আসলে শরীরটা একটু…”
কথাটা শেষ করতে পারল না সে। দ্রুত সেখান থেকে দৌড় দিয়ে কমন ওয়াশরুমটায় প্রবেশ করল,সবাই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শিশিরের পানে। শিশির ইশারায় বোঝালো সে কিছুই জানে না। মুহূর্ত কয়েক পর চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো আনায়া। সবার অবাক চক্ষু তার ওপর নিবদ্ধ। সে অপ্রস্তুত হেসে সবার উদ্দেশ্যে বলল,,

——“কি হয়েছে?সবাই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
শিশির দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,,
——“আর ইউ ওকে বেবি?”
আনায়া:“হুমম!”
ফারিন:“হঠাৎ কি হলো আপু তোমার?”
আনায়া ফারিনের দিকে ফিরে হালকা হেসে বলল,,
——“তেমন কিছুই না, আসলে ইদানিং কিছু খেলেই বমি চলে আসে, আর সকাল থেকে অনেক কিছু খাওয়া পড়ছে তো এই জন্য।”
ইলমা‌ তার দিকে এগিয়ে এসে বাম ভ্রুটা সামান্য উঁচিয়ে বলল,,

——“বলো কি? মাথা-টাথা ঘোরায় নাকি?”
আনায়া:“হ্যাঁ আপু, তা তো একটু ঘোরায়!”
বোকা আনায়া বুঝলোই না ইলমা কি উদ্দেশ্যে তার থেকে প্রশ্নটা করেছে? তবে আনায়ার কাছ থেকে জবাব পাওয়ার সাথে সাথে ইলমা রিদিতের দিকে ফিরে বলল,,
——“ট্রিট দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ভাইয়া! আমরা খালামণি হতে চলেছি!”
রিদিত অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,
——“কেমনে কি?”

ইলমা:“মেডিকেলের প্রতি আমার একটু ঝোঁক ছিল ভাইয়া। তবে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ না হলেও এসব ছোটখাটো সিমটমস আমি দেখেই রোগ ধরতে পারি! আর আয়ুর কথা অনুযায়ী মনে হচ্ছে আপনি বাবা হতে চলেছেন! যদিও আমি শিওর না, একজন ডাক্তার দেখালে ভালো করবেন! কিন্তু আমার মনে হয় ইনশাল্লাহ নতুন একটা সদস্য আসতে চলেছে!”
রিদিত তখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনায়ার দিকে।
প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে……………

ডক্টর যে সকল টেস্ট দিয়েছিল তার সবগুলোই পজেটিভ এসেছে। তার মানে ইলমার কথাই ঠিক।আনায়া সত্যিই প্রেগন্যান্ট। রিদিত বিশ্বাসই করতে পারছে না যে,সে বাবা হতে চলেছে, তাদের ঘরেও তাদের ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপহারটা আসতে চলেছে! খুশিতে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে রিদিতের।
এতক্ষণ শিশির,ফারিন ইলমাসহ বাড়ির সব গুরুজনরা এখানে উপস্থিত থাকায়, শান্ত ছিল সে। তবে তারা বেরিয়ে যেতেই রুমের দরজা বন্ধ করে, আনয়ার কাছে এসে বসে, টুকরো টুকরো চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলো, আনায়ার সুস্নিগ্ধ মুখশ্রী। আনায়া লাজুক হেসে বলল,,
——“কি করছেন টা কি?”

রিদিত:“আমি তোমার কাছে সত্যিই ঋণী আয়নিন, তুমি আমাকে আজ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ খবরটা দিলে। ভালোবাসি তোমায় প্রিয়তমা, সত্যিই ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।”
আনায়া মুচকি হেসে বলল,,
——“আমিও ভীষণ ঋনী আপনার কাছে, আপনিই আমাকে নতুন করে ভালবাসার মানে শিখিয়েছেন, আমাকে এই নিয়ামতের অধিকারীনি বানিয়েছেন, আপনাকেও আমি ভীষণ ভালোবাসি প্রিয় পুরুষ, সত্যিই ভালোবাসি!”
রিদিত আনার কপালে দীর্ঘ এক প্রেমপরশ এঁকে দিল। আনায়া মুচকি হেসে পরম আবেশে গ্রহণ করল তা।

সন্ধ্যা রাত তখন আটটার কাঁটায়।দোতালার পুবের পাশের বেশ বড় রুমটা,যেখানে ভেসে আসে দূর পাহাড়ের পাখির কিচিরমিচির শব্দ। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইছে ফারিন।রুমটা তাদেরই, তবে এখানে থাকা পড়েছে কিঞ্চিৎ, কদাচিৎ! শুধু রাতে শোবার সময়টুকুই এখানে কাটিয়েছে তারা, বাদবাকি সার্বক্ষণিক বিভিন্ন কাজে আর ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত ছিল সবাই। যার দরুন রুমটার সৌন্দর্য উপভোগের সময়ই হয়নি তার পক্ষে।

ফারিনের কানে ব্লুটুথ হেডফোন,যাতে গান বাজছে পূর্ণ ভলিউমে। নির্ঝর দরজার বাইরে থেকে বেশ কয়বার ফারিনকে ডাকলো,তবে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে রুমে প্রবেশ করল সে। ফারিন রুমে কোথাও না থাকলেও নির্ঝর ব্যালকনিতে রানী গোলাপি রঙা ওড়নার পাড় উড়তে দেখে বুঝতে পারলো ফারিন নিশ্চিত সেখানেই আছে।
নির্ঝর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সে দিকে। ব্যালকনিতে এসেই একটা মেয়েলী সুরেলা কন্ঠে থমকালো সে।ফারিন গুনগুনিয়ে গাইছে,,
🎶 মরণ দেখি আমার….ওগো তোমার ওই চোখে!!!
পাগল দাও না করে…. এই রাতে আমাকে….🎶
নির্ঝর ফারিনের এমন গানে, বাঁকা হাসলো। অতঃপর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই পেছন থেকে জাপটে ধরল তাকে, হঠাৎ এমন স্পর্শে ভয়ে কম্পিত হলো ফারিনের শরীর। তবে কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সে বুঝলো এটা নির্ঝর ভিন্ন আর কেউ নয়। ফারিন দ্রুত তো নিজের কান থেকে হেডফোন নামিয়ে নির্ঝরের উদ্দেশ্যে বলল,,

——“কি হয়েছে?”
নির্ঝর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বেশ জোরে এক কা’ম’ড় বসালো তার গ্রীবা দেশে। ব্যথায় সামান্য কুকিয়ে উঠলো ফারিন। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না তার। ঠিক তখনই নির্ঝর বলল,,
——“কি গান জানি গাইছিলে? ওহ ,“পাগল দাও না করে…. এই রাতে আমাকে….!!”ওকে, অ্যাজ ইউর উইস মিসেস নির্ঝর চৌধুরী!! আজকে ঠিক তাই,তাই হবে যা তুমি চাও!”
নির্ঝরের এহেন কথায় ফারিন এর চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। ভয়ার্ত ঢোক গিলে সে নির্ঝরকে কিছু বলার আগেই নির্ঝর কোলে তুলে নিলো তাকে। ব্যালকনি থেকে রুমে গিয়ে বিছানার উপর আলতো ভাবে তাকে ফেলে দিয়ে,নিভিয়ে দিলো রুমের আলো! নিস্তব্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই রুমের চারিধারে ভেসে বেড়ালো ফারিনের মৃদু হাসির রিনরিনে শব্দ!!!!

শীতের কুয়াশায় মোড়ানো এক অদ্ভুত গভীর রজনী। নিদ্রাচ্ছন্ন প্রকৃতি, স্তব্ধ চারিপাশ! গগনে মেঘের দস্যিপনায় লুকায়িত চঁন্দ্রের রূপালী কিরণ। সেই কুয়াচ্ছন্ন রাতের মাঝেই ইয়ামাহা খচিত নেভি ব্লু কালার বাইকটা এগিয়ে চলেছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে। যার উপর বসে আছে এক জোড়া প্রেম-যুগল।
গাড়ি যখন প্রায় মাঝ রাস্তায় তখন আর কৌতূহল সামলাতে পারল না শিশির, এতক্ষণ জল্পনায় কল্পনায় হাজারটা প্রশ্ন বুনেছে সে। যে কেন এত রাতে নাহিয়ান তাকে নিয়ে বের হল? তারা কোথায় যাচ্ছে,কেনোই বা যাচ্ছে?শেষমেষ প্রশ্নগুলো করেই বসলো সে,,

——“আমরা কোথায় যাচ্ছি? আর এত রাতে কেন?”
নাহিয়ান তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং বলল,,
——“নাউ উই আর ম্যারিড,সো লজ্জা না পেয়ে শক্ত করে ধরো,সামনেই পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা!”
শিশির নাহিয়ানের কাঁধে রাখা হাতটা আর একটু দৃঢ়ভাবে রাখল। অতঃপর ফের বলল,,
——“আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি! বলুন না কোথায় যাচ্ছি এত রাতে?”
নাহিয়ান: “সেটা গেলেই দেখতে পারবে, মিসেস নাহিয়ান চৌধুরী!”
শিশির নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে মুখ গোমড়া করে বসে থাকলো। সে ভালো করেই জানে এখন নাহিয়ান কে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার মনের প্রশ্নগুলোই বা শান্ত হবে কিভাবে? ঘড়ির কাঁটায় হয়তোবা রাত সাড়ে এগারোটার কিছু বেশি। হ্যাঁ প্রায় মাঝরাতই! আর এখনই নাহিয়ানের হঠাৎ মনে হলো, তার প্রাণনাশিনীকে নিয়ে বাইক রাইডিং এ বের হওয়া প্রয়োজন!

শিশির অবশ্য এত রাতে বের হওয়া নিয়ে,বেশ অনেকবার বারণ করেছিল তাকে, কিন্তু নাহিয়ান কি শোনার পাত্র নাকি? সে যখন ভেবেছে তখন সেটাকে বাস্তবায়ন করেই ছাড়বে! কি আর করার শেষমেষ ‌এক প্রকার বাধ্য হয়েই শিশিরকে বেরুতে হয়েছে তার সাথে!
শিশিরের পরনে নেভি ব্লু কালার পাকিস্তানি ড্রেস, ড্রেসটা অদ্ভুত রকম সুন্দর, সমগ্র ড্রেসটা জুড়ে অদ্ভুত সূক্ষ্ম পাথুরে কাজ, পাথরগুলোও এক রঙা হওয়ায় সহজে দেখেই তার সৌন্দর্য বোঝার উপায় নেই। নাহিয়ানের পরনেও নেভি ব্লু কালার সাটিন শার্ট! মুহূর্ত কয়েকের মাঝেই বাইক এসে থামলো এক পাহাড়ি পাদদেশ। নাহিয়ান শিশিরের উদ্দেশ্যে বলল,,

——“এবার নামতে পারেন ম্যাম, আশা করি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছেন!”
শিশির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো নাহিয়ানের দিকে, যার অর্থ,,“এত রাত্রে পাহাড়ে কেন?”
নাহিয়ান তার কথার জবাব না দিয়ে,কোলে তুলে নিলো তাকে। শিশিরের কৌতুহল দ্বিগুণ হলো,সে তীব্র কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নাহিয়ানের দিকে। পাহাড়ের মধ্যিখানের এক সর্পিল পথ দিয়ে তাকে কোলে করে নিয়েই উপরের দিকে এগিয়ে চলল নাহিয়ান।

নির্জন পাহাড়ি এক আলোক সজ্জিত উপত্যকায় এসে থামলো নাহিয়ান। পুরো উপত্যকাটা সজ্জিত হয়েছে, রঙিন আলোক সজ্জায়, অন্ধকার আকাশের পটভূমিতে ‌মিটিমিটি জ্বলছে অসংখ্য রঙিন ফানুস,যেন তারার মেলা নেমে এসেছে মাটিতে। পাহাড়ের পাদদেশটা ঠিক যতটা আধারচ্ছন্ন,উপরটা ঠিক ততটাই সজ্জিত।

নাহিয়ান সযত্নে নিজের কোল থেকে নামালো শিশিরকে। শিশির বিস্ফারিত চোখে দেখছে সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য। আলোক ঝলমলে‌ সেই জায়গাটায়,একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ,এক স্নিগ্ধ আলো পড়লো সামনের মসৃণ পাথরটার উপরে।প্রথমে একটা আবছা ছবি, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো – শিশিরের মিষ্টি হাসিমাখা মুখশ্রী।
মুগ্ধ বিস্ময়ে শিশির তাকিয়ে থাকল। একের পর এক ছবি ভেসে উঠতে থাকলো মসৃণ পাথরের সেই পাতাটায়। প্রতিটি ছবিতেই শিশিরের জীবনের কোনো না কোনো সুন্দর মুহূর্ত ধরা আছে–কখনো সে একা হাসছে, কখনো বা নাহিয়ানের পাশে,তবে বেশিরভাগই তার সিঙ্গেল ফটোগ্রাফি।আর প্রতিটি ছবির পরেই ভেসে উঠছে তিনটি জাদুকরী শব্দ – “আই লাভ ইউ আমার প্রাণনাশিনী, মায়াপুর্ন দৃষ্টির অধিকারিনী আমার সুহাসিনী”।
ঠিক তখনই পিছন থেকে নাহিয়ান বলতে থাকে,

“আজ আমার ভালবাসার দশম বছর পূর্ণ হলো, আজ থেকে ৩৬৫০ দিন,৮৭৬০০ ঘন্টা,৫২৫৬০০০ মিনিট আর…….”
একবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকানো সে, সময় ঠিক বারোটার কাটার উপর স্থির হয়েছে, তারপর সে আবারও বলল,,
“আর ৩১৫৩৬০০০০ সেকেন্ড পূর্বে ৯ বছর বয়সী এক ছোট্ট নীল পরীর প্রেমে অন্ধ হয়েছিলাম আমি…!! ১৮ বছর বয়সী আমার ‌তারুণ্যের উদ্যম হৃদয়ে তীব্র ঝড় তুলেছিল সে..!!!সেদিন থেকেই নীল হয়েছিল আমার প্রিয় রং….!!! তার কথাগুলো হয়েছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতার সুর…..!!! বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম তাকে….তবে তাকে পাওয়ার পথটা এতটা সহজ ছিল না,, বহু কষ্ট শেষে আজ সে আমার, আমার একান্তই ব্যক্তিগত…..সেটা আর কেউ নয়.. তুমি হ্যাঁ তুমিই!আমার প্রাননাশীনি আমার চিত্তহারিনী…..!!”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৯

এমন অদ্ভুত সুন্দর ভালোবাসার প্রকাশ ভঙ্গি শিশিরের হৃদয় ছুঁয়ে গেল, চোখের কোনে চিকচিক করে উঠল আনন্দঅশ্রু। হৃদয়ে দোলা দিল একটি মাত্র শব্দ,,,“সে আসলেও ভাগ্যবতী,কারন বিচ্ছেদের এই যুগেই তার এমন একটা পুরুষ আছে, যে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে উন্মাদের মতো ভালোবাসা তাকে!!

মাঝরাতের রোদ্দুর শেষ পর্ব