মায়াকুমারী পর্ব ২৫
মেহেরিন আনজারা
শাওয়ার নিয়ে বাথরোব পরে বেরিয়ে এলো নিশু। চুলের পানি নিলো না। বিছানায় বসতেই দ্যুতি তাকালো। নিশুর চোখ-মুখ লাল এবং ফোলা ফোলা।
“কী হয়েছে নিশু?”
“আমি তাকে রিজেক্ট করেছি।”
“কেন?”
“সাড়ে এগারো বছর পর এসে কোনো কথাবার্তা,আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছাড়াই সেই আমার সাথে ইন্টিমেন্ট হতে চায় এটা কেমন কথা?”
“তো কী হয়েছে?সে তোর স্বামী তার আদেশ মানতে তুই বাধ্য! একশো বার বাধ্য। ইসলাম ধর্মেও এটা বলা হয়েছিল। এখন তো তুই অবশ্যই গুনাহগার হবি। কারণ এটা তোর দায়িত্ব। নারী পুরুষ যেই হোক,বিয়ে প্রধানত মানুষ ফিজিক্যাল নিড পূরণের জন্যই করে। সেটাই যদি না করতে পারে তাহলে আর লাভ কী? তুই নিজেকে আকর্ষণীয় করে ভাইয়ার কাছে উপস্থাপন করতে পারতি,নিজেই এগিয়ে যেতে পারতি,নিজের চাহিদাগুলো নিজে বুঝে নিতি।”
“কীসের স্বামী সে আমার?সে না আমায় ডিভোর্স দিয়েছিল?”
“তোকে বলেছে?”
“সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য খাম পাঠালো।”
“খুলে দেখেছিস?”
“দেখব না। ডিভোর্স তো হয়ে গিয়েছে আর কী! এখন কেন সে বাসর করতে চায়! আমি যখন তার জন্য ওয়েট করেছিলাম সাড়ে তিন বছর আগে তখন কেন এলো না?”
“এত জিদ দেখালে তো হবে না। আর হয়তো তখন আনইজি ফিল করেছিল কিংবা সময় চেয়েছিল অথবা তোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সময় চেয়েছিল। আর সেদিন বাসর করতে চাইলে নিষেধ করতে নাকি তুই স্বইচ্ছায় দিতি! তাহলে আজ এমনটা কেন করলি? স্বামীর অবাধ্য হওয়াটা কি তোর ঠিক হয়েছে?তোকে এইসব শিক্ষা দিয়েছে আমার বাবা-মা? আব্বু-আম্মু তোর এই বেয়াদবীর কথা জানলে মনঃক্ষুণ্ন হবে।”
“তোর ভাই আমাকে সস্তা ভাবলো তাই না? সাড়ে এগারো বছর পর এসে বললেই আমি আত্মসম্মানহীন মেয়েদের মতো শুয়ে-বসে যাবো! আমার কোনো আত্মসম্মান নেই?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“স্বামীর কাছে কীসের আত্মসম্মান? বলতে দৃষ্টিকটু হলেও এটা সত্যি যে,যার সামনে পুরো কাপড় খোলা যায় তার সাথে কীসের লজ্জা,কীসের আত্মসম্মান? সারা দুনিয়ার সাথে লজ্জা গ্রহণযোগ্য কিন্তু স্বামীর কাছে নয় বরং তাকে যৌনতা দিয়ে মুগ্ধ করে রাখা উচিৎ। অবশ্য মনে রাখতে হবে যৌনতাকে চাপিয়ে রাখা হলে শারীরিক অনেক রোগও তৈরি হতে পারে যদি মিলনে সুযোগ থাকে তবে কেন কষ্ট করা? স্বামী চাইলে ইন্টিমেন্ট হওয়া আবশ্যক। কিন্তু সেটা যদি স্ত্রীর আগ্রহে হয় তবে উত্তম আরকি। আর এগুলি আমাদের দেশে স্ত্রীরা বুঝতে পারে না বলে এত অশান্তি লেগে থাকে সংসারে। এটা বুঝতে হবে তোকে। আর শোন না বলেও পারছি না,তোদের দু’জনেরই অহংকার। কেউ কাউকে বুঝতে চায় না। কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। যে যার যার মতো অ্যাটিটিউড নিয়ে আছিস! একজন আগুন হলে একজনকে পানি হতে হয়। ও পুরুষ মানুষ ওর তো মেজাজ চড়া থাকবেই তুইও যদি এমন করিস কেমনে কী! মনে রাখিস,পুরুষ মানুষ কষ্ট পেলে নষ্ট হয়ে যায়। আর সেটা যদি হয় শখের নারী থেকে।”
“তুই বলতে চাচ্ছিস আমি তার আহ্বানে সাড়া দিতাম?”
“একশো বার দিবি। সে দেশ-বিদেশে ছিল। তার কাছে কিন্তু বেটার অপশন কম ছিল না। নিজ থেকে তোর কাছে এসেছিল এর মানে বিশেষ কিছু ছিল। এছাড়াও বাসর রাতটা একজন পুরুষের সারা জীবনের স্বপ্ন। আর এই রাতে বউ যদি কোনো ওজর ছাড়া স্বামীকে নিজে থেকে দূরে রাখে তখন সেই পুরুষের সারা জীবনের একটি স্বপ্নের ভঙ্গ হয়। এই সারা জীবনের স্বপ্নটা যদি অবাস্তবই থেকে যায় তবে বিয়ে করে আর কী লাভ? তবে হা শারীরিক কোনো সমস্যা থাকলে সেটা ভিন্ন কথা।”
“সব বুঝলাম তাহলে ডিভোর্স?”
“সেটা আমরা কেউই ক্লিয়ার নয়। সেটা আব্বু আর ভাইয়া জানে। তবে তোকে যেহেতু গভীরভাবে চেয়েছে এর মানে ডিভোর্স হয়নি! মুসলিম ধর্মে ডিভোর্স সেন্সিটিভ ব্যপার। একবার ডিভোর্স হলে দ্বিতীয়বার জোড়া দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আমার ভাই মূর্খ না যে সে ভুল কিছু করবে তাও আবার তোর সাথে!”
“সে এতগুলো বছর সে আমার সাথে কথা বললো না,দেখতেও চাইলো না,খোঁজখবর নিলো না,ফোন করলো না,ফিরে তাকালো না,মনে রাখেনি সব ভুলে গেছে। এখন দেখা মাত্রই শুয়ে-বসে যেতে চাইবে আর স্ত্রী স্বামীর অধিকার মেনে শুয়ে-বসে যাবে এটা কেমন যুক্তি হলো? ইসলাম স্ত্রীকে স্বামীর অধিকার আদায় করতে বলছে হ্যাঁ তবে স্বামীকে কি বলেনি স্ত্রীকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে,সম্মান দিতে,তার ভালোমন্দের খবর নিতে?এই দায়িত্ব কি একতরফা? বুঝলাম চিঠি পড়িনি সে দেশে আসার পর একবারও কি আমাকে ডেকেছে না কথা বলেছে তার মুখ কি কেউ ধরে রেখেছিল? তাকে বাধ্য করা হয়েছে,তার মত ছিল না,দায়িত্ব নেয়ার বয়স হয়নি সব বুঝলাম,কথা বলার ক্ষমতাও কি ছিল না তার? নাকি কেউ বাঁধা দিয়েছে? স্বামী চাইবা মাত্রই তার সাথে শুয়ে-বসে যেতে হবে এবার সে যেমন স্বামীই হোক না কেন! আল্লাহর বিধান একতরফা নয়। তুই একটু ভেবে দেখ তো কোনো মেয়ের কিংবা তোর সাথে এমনটা হলে তুই কি মেনে নিতে পারতি? যদি একবারও আমাদের মধ্যে কথপোকথন হতো,একবারও যদি তার মধ্যে আমাকে গ্রহণ করার প্রকাশ দেখাতো তাহলে ঠিক ছিল। মনে মনে প্রেমে পড়ে মনে মনে গ্রহণ করে ফেললে তো হবে না। উপর মানুষটাকেও জানতে হবে তার মধ্যে কী চলছে অপরজনকে নিয়ে। স্বামী হয়ে গেলেই তার সব কিছু জায়েজ হয়ে যায় না। ইসলামের দোহাই দিয়ে স্বামীদের সব কিছু জায়েজ করে ফেলা ঠিক না। আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মানেই শুধু ইন্টিমেট হওয়া না। এর চেয়েও অনেক বিশাল এই সম্পর্ক। দায়িত্ব অন্যের শরীর মন ভালোমন্দের খোঁজ রাখা,বোঝাপড়া আরো অনেক কিছু। তোর কথাগুলো ভীষণ অপমানজনক!
শোন,আমাদের দুজনের মধ্যে অনেক দূরত্ব। তাই শারিরীক মিল হওয়ার আগে অবশ্যই একবার কথোপকথন হওয়া জরুরী ছিল। তারপরে কাছাকাছি আসলে সেটা আকর্ষনীয় লাগতো তখন মনে হতো না যে শুধু শারিরীক চাহিদা গুরুত্ব পেয়েছে। মানুষটা কেবল আমাকে শারীরিকভাবেই চাইলো তাহলে কি মর্যাদা থাকে আমার আর?এতই ঠুনকো আমরা স্ত্রীরা? তুইও তো একটা নারী। আর একটা নারী হয়ে কীভাবে পারলি এমন কথা বলতে! এতগুলো বছর আমার পাশে থেকেও কষ্ট আর অপমান যদি না বুঝিস তবে তোর মেয়ে হওয়াই বৃথা! আবার বলছিস বেয়াদবি করেছি,মানে তোর কাছে ইন্টিমেট হয়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? তবে আর কথার প্রয়োজন কী,বোঝাপড়ার প্রয়োজন কী একজন আরেকজনকে চেনা-জানার প্রয়োজন কী! তাহলে প্রেম করে সেক্স করে ফেলে যারা তারা ব্রেকআপ করে কেন?
আর ডিভোর্সও হয় কেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে?যেকোনো মেয়ের জন্যই এটা অপমানজনক। নিজেকে কেবল একটা ভোগ্যবস্তু মনে হওয়া ছাড়া কিছুই না। তুই বললি ওর সুযোগ ছিল অন্য মেয়ের সাথে না শুয়ে-বসে আমার কাছে আসছে তাই শুয়ে-বসে যেতে হবে এটা আরেকটা অপমান ছাড়া কিছুই না! আমার কিন্তু কম সুযোগ ছিল না। আমার জন্যও অনেক ছেলে পাগল হয়ে আছে। বিয়ে করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কই আমি তো ওমন কিছু করার কথা ভাবিনি। পুরুষকে যদি কেবল শরীর দিয়ে বাঁধা লাগে তাহলে আর মনের দরকার কী,দায়িত্বের দরকার কী,দিনরাত সেজেগুঁজে মনোরঞ্জন করলেই হয়। তোর কথায় আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে!”
“আমার ভাই যদি তোকে অন্য মেয়ের চোখে দেখতো তাহলে মনে করতাম এটা শুধুমাত্র তোর সাথে ইনজয়ের জন্য করতে এসেছিল। সেই মন থেকে তোকে ভালোবাসে। তখন তার মধ্যে ওতোটাও ম্যাচুরিটি আসেনি। সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত এবং তোর যোগ্য করে তবেই এসেছে।”
“আর বাকি কথাগুলো?”
প্রতিত্তোর করলো না।
“এবার সে বুঝুক অবহেলা করার পরিণাম কত ভয়াবহ আর যন্ত্রণার। আমি তো একদিনে এমন হইনি! কষ্ট পেতে পেতে মোম থেকে পাথর হয়েছি।”
উল্টোমুখ করে শুয়ে রইলো দ্যুতি। চোখ বুজে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো নিশু। সে ভুল না ঠিক বুঝতে পারছে না কিন্তু জিদ সামলাতে পারেনি! ঠিকই তো কোনো যোগাযোগ কিংবা কথাবার্তা ছাড়াই সে কেন ইনভলভ হতে চাইবে! আর ডিভোর্স যদি না হয় তাহলে সেই খামে কী ছিল? ইমোশনাল হয়ে পড়লো নিশু। অপ্রত্যাশিত ভাবে মানুষটাকে কাছে পেতেই হঠাৎ কেমন রিয়েক্ট করবে বুঝে উঠতে পারলো না। অর্থাৎ সবটাই ছিল আনএক্সপেক্টেড! অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করলো নিশু। পাশ ফিরলো দ্যুতি।
“কী হয়েছে তোর?”
“শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে!”
ঘাবড়ে গেল দ্যুতি। উঠে বসলো।
“কেন?”
“জানি না! কেমন জানি লাগছে!”
“শান্ত হো! মাথা ঠান্ডা কর! দেখ কিচ্ছু হয়নি!”
তবুও নিশু শান্ত হলো না। হঠাৎ পেয়ে আবার হারিয়ে ফেললো জিনিসটা কেমন জানি নিতে পারছে না! নিশুর একবার মনে হচ্ছে ঠিক হয়েছে আবার মনে হচ্ছে ঠিক হয়নি! দোষারোপ করতে লাগলো নিজেকে। নিশু নার্ভাসফিল করছে এই না প্যানিক অ্যাটাক হয়!
“যা হয়েছে এখন টেনশন করে কী হবে! সকালে সরি বলে নিস।”
কিন্তু শান্ত হলো না নিশু। সে যে আচরণ করেছে মনে হচ্ছে ধ্রুব এবার তাকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই শ্বাস আঁটকে এলো। কিন্তু সে-তো ধ্রুবকে ভালোবাসে,মায়া করে! সাড়ে এগারো বছরের মায়া সে কীভাবে কাটাবে?
“দ্যুতি আমি কি ভুল করেছি?”
নীরব রইলো দ্যুতি। সে-তো সেখানে ছিল না কী বলবে এখন। এতক্ষণ এইসব বলার মানে নিশু যাতে পুনরায় বেয়াদবী করার সাহস না পায়! এইরকম জেদ করতে থাকলে আজীবন দ্বন্দ্ব লেগেই থাকবে! কীভাবে ঠিক হবে তাদের দাম্পত্য জীবন? তার বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। নিশুকে নিয়ে অনেক টেনশন করেন দু’জন। প্রতিক্ষায় রয়েছেন কবে তাদের মিলন দেখবে,কবে সুন্দর একটা সংসার দেখবে! নাতিপুতির আশায় রয়েছেন বয়স্ক দু’জন মানুষ। তার বাবা-মায়ের নাতিপুতির সঙ্গে মজা করার বয়স এখন। এদের এক করতে না পারলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার মায়ের অনেক আগ্রহ নিশু এই বাড়ির বউ হয়ে থাক!
“গিল্টিফিল হচ্ছে?”
“জানি না।”
“তাহলে ভাইয়ার কাছে যা সরি বল। একজন সরি বললেই দেখবি তোদের সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে। ইগো ধরে রেখে কী লাভ সেই কষ্ট তুই পাস আমরা তো আর পাই না! একটু ছোট হয়েও যদি তোরা তোদের সম্পর্ক ঠিক করতে পারিস আমার মতে অন্যায়ের কিছু না। ভালোবাসিস তো তাকে। ভালোবাসার মানুষের কাছে আত্মসম্মান দেখাতে নেই যদি মানুষটা সঠিক হয়।”
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো নিশু। ঠিক কী করা উচিত বুঝতে পারছে না! নিশুর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ঘাবড়ে গেল দ্যুতি। এই না আবার ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বসে। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেল নিশু। সামান্য একটা ব্যপার মেয়েটা ইজিভাবে নিতে পারে না। বাবা-মা ঘুমাচ্ছে ডাকলে টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়বে। ধ্রুবর মেজাজ ঠিক নেই বোধহয়। এমন অপমানের পর কীভাবে ঠিক থাকবে! একটু আগে কিছু ভাঙার শব্দ টের পেয়েছে। বুঝতে পারছে কিয়ামত হচ্ছে সেই ঘরে। উঠে ধূসরের রুমের দিকে পা বাড়ালো। নক করতেই সঙ্গে সঙ্গে খুললো। যেন প্রস্তুতই ছিল।
“ভাইয়া একটু আসবে?”
“নিশু ঠিক আছে?”
ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায়। কত উদ্বিগ্নতা!
“ভাইয়া নিশু অস্বাভাবিক আচরণ করছে! একটু আসো।”
একপ্রকার ছুটে এলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো সত্যিই নিশু আবোলতাবোল বকছে! ঘাবড়ে গেল ধূসর। দ্রুত এগিয়ে গেল। চিবুক তুলে ধরলো।
“নিশু কী হয়েছে? ঠিক আছিস।”
বসা অবস্থায় আচমকা দু’হাতে জড়িয়ে ধরতেই বুক কেঁপে উঠলো।
“ভাইয়া,আমি ওকে রিজেক্ট করেছি! আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল আগের কথাগুলো ভেবে। তাই নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি।”
“এটার জন্য টেনশনের কী আছে! নরমাল ব্যপার। হি ডিজার্ভ দিস।”
ডুকরে কাঁদে নিশু।
“পেয়েও হারিয়ে ফেললাম!”
“মোটেও না সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হবে না।”
“খারাপ লাগলে ভাইয়ার কাছে যা। সরি বলে মিটমাট করে নে।”
“না যাব না।”
মাথায় হাত রাখলো। অকপটে নিশুর কম্ফোর্টজোন ধূসর। যার সঙ্গে সে সব শেয়ার করতে পারে। ধূসর একটা খোলা বই তাদের জন্য।
“দ্যুতি ওর মেডিসিনগুলো দে।”
বক্সটা এগিয়ে দিলো। মেডিসিন নিয়ে খাইয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর নিশু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে ঘুমিয়ে পড়তেই ঠিক করে শুইয়ে দিলো। গায়ে নকশীকাঁথা টেনে দিলো।
“জাগানোর প্রয়োজন নেই। যতক্ষণ ঘুমায় ঘুমাক বুঝলি?”
“হুম।”
“আব্বা-আম্মাকে বলিস না।”
একপলক তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ধূসর। কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না! পৃথিবীর নিয়মটা বড়ই অদ্ভুত! যখন মেয়ে মেনে নেয় তখন ছেলে নেয় না। যখন ছেলে মেনে নেয় তখন মেয়ে নেয় না। যখন দু’জনেই মেনে নেয় তখন পরিবার মানে না। যখন সবাই মেনে নেয় তখন সৃষ্টিকর্তা বোধহয় মেনে নেয় না। যেকোনো একজনকে নিয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ালো।
সকাল প্রায় সাড়ে আটটা। নাস্তা করতে বসলো সবাই কিন্তু ধ্রুব নেই! বারবার ডাকলেও খেতে আসেনি। নিশু এখনও ঘুমাচ্ছে তাই কেউ জাগায়নি।
“রিনা ধ্রুবর রুমটা গুছিয়েছিস?”
“না যাইতাছি।”
“তাড়াতাড়ি গুছিয়ে রুম পরিষ্কার করে আয়। তারপর মাছ-মাংস ভিজিয়ে রাখ। আর দেখ ফ্রিজে কী কী সবজি আছে!”
“আইচ্ছা।”
নাস্তা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সবাই। শলার ঝাড়ু নিয়ে ধ্রুবর রুমে ঢুকলেন রিনা খালা। দেখলেন ফুলদানীগুলো সব ভেঙ্গে চৌচির! কাঁচগুলো তুলে ফ্লোর পরিষ্কার করে বিছানা গুছাতে নিতেই আচমকা চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
“আল্লাহ গো! ছিঃ! ছিঃ! ইতা কিতা কী হইতাছে বাসার মধ্যে!”
চমকান দিলরুবা খাতুন।
“বউ থাকনের পরেও অন্য ছেমরি লইয়া ফষ্টিনষ্টি! ছিঃ! ছিঃ!”
দ্রুত উপরে উঠে এলেন দিলরুবা খাতুন।
“কী হয়েছে রিনা চেঁচাচ্ছিস কেন?”
“এই দ্যাখেন কী অবস্থা! আপনার পুতে অন্য ছেমরির লগে আকাম-কুকাম করছে!”
কান গরম হয়ে গেল দিলরুবা খাতুনের। ব্লাউজ-পেটিকোট ঝুলিয়ে ধরলেন। ঠিক সেই সময় ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকলো ধ্রুব।
“মাথা খারাপ হয়েছে তোর?”
ভ্রু কুঁচকালেন।
“মুই হাঁচা কথা কইলাম! বউ থাকনের পরেও বড় মামা অন্য ছেমরির লগে আকাম-কুকাম করছে! ছিঃ! ছিঃ! আর হেই ছেমরির ছোড ছোড ডেস রাইখা গেছে নিতে ভুইল্যা গেছে গা!”
চট করে ঘুম ভেঙে গেল নিশুর। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে রুম থেকে বেরুতেই দেখলো ব্লাউজ-পেটিকোট ঝুলিয়ে ধরে রেখেছে। মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে গেল চোখজোড়া। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ধ্রুবর।
“হেইদিন একটা ছেমরি আইছিল এগুলা হের ডেস।”
শ্বাস আঁটকে রইলো নিশু। এত খারাপ ধ্রুব! দ্রুত উঠে এলো দ্যুতি। দাঁতে দাঁত চাপলো। চট করে জিনিসগুলো হাতে নিয়ে গোল বলের করে ফেললো! তার পিছু পিছু এলো ধূসরও।
“তোমার লজ্জা করে না খালা কী শুরু করলে?”
“মুই হাঁচাই তো কইলাম।”
“তোমার মাথা বলেছো!”
“এডি ওই ছেমরির আমি জানি। হেই দিন মামার রুমে ঢুকছিল। ডেসগুলা নিতে ভুইল্যা গেছে গা! হায় আল্লাহ ওই ছেমরি খালি গায়ে বাসায় গেছে কেমনে!”
ধ্রুবর চোখে চোখ পড়তেই ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিশু। রুমের ভেতর ঢুকে গেল।
“এইসব কী হচ্ছে দ্যুতি?”
“আম্মু এগুলো নিশুর।”
“নিশুর ব্লাউজ-পেটিকোট ওর রুমে কেন?”
আড়ষ্ট হলো দ্যুতি। তার দিকে তাকিয়ে রইলেন দিলরুবা খাতুন।
“মানে,কাল রাতে ইয়ে আরকি..!”
“ওই রুমে ছিল?”
“হুম।”
ভীষণ খুশি হলেন কিন্তু প্রকাশ করলেন না।
“রিনা তোর কি লজ্জা শরম নেই?”
“মুই কী করলাম?”
“সবখানে তোর ফাইজলামি! বিবাহিত ছেলেমেয়ে ঘরে। স্বামীর ঘরে বউয়ের জিনিস না থাকলে কার জিনিস থাকবে ফাজিল একটা! এটার জন্য আনুষ্ঠানিকতা করে চেঁচানোর কী আছে!”
“মুই জানতাম নাকি!”
“তোর গলা মাইকের মতো কেন?”
“কিতা করলাম?”
“অসভ্য একটা! ঘরের ভিতর তিন-চারজন পুরুষ মানুষ আস্তে কথা বলা যায় না! কী ভাববে ওরা ছিঃ! ছিঃ! এইরকম আজেবাজে কথা ছড়ালে তোকে তো আমার বাসায় এক মিনিটও রাখব না রিনা! আজই তোকে কাজ থেকে গেট আউট করে দিব।”
“ছরি!”
“রাখ তোর সরি।”
রাগে গজগজ করে রুমের দিকে পা বাড়ালেন। রুমে ঢুকলো দ্যুতি। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে নিশু।
“কীরে কাঁদছিস কেন?”
“তোর ভাই একটা জঘন্য!”
“কী করেছে?”
“কাল রাতে আমার সাথে যা করলো তা বাদ কিন্তু এর আগে সে অন্য মেয়ের সঙ্গে! ছিঃ!”
“তোর গায়ে মনে হয় রিনা খালার বাতাস লেগেছে! দু’জনেই ফাউল! ধর তোর জিনিস!”
ছুঁড়ে ফেললো বিছানার উপর।
“নিজের জিনিস নিজে চিনিস না। এত নাটক যখন করবি তো রেখে এলি কেন রাতে?”
বিরক্ত হলো দ্যুতি। চুপসে গেল নিশু।
“যা নাস্তা করে নে ভার্সিটিতে যাব।”
হাত-পা ছেড়ে শুয়ে রইলো নিশু। ব্যালকনির গাছগুলোয় পানি দিলো দ্যুতি। ভেজা শাড়িগুলোর পানি ঝরতেই টান টান করে মেলে দিলো দড়িতে। রুমে ঢুকতেই দেখলো নিশু কেমন করে শুয়ে আছে। হাত ধরতেই দেখলো ঠাণ্ডা হয়ে আছে।
“নিশু কী হয়েছে?”
“দূর্বল লাগছে!”
“অহেতুক তুই টেনশন করিস। অথচ প্রতিটি ঘটনাগুলো চাইলে তুই নরমালভাবে নিতে পারিস। টেনশন করে,ওভার রিয়েক্ট করে আদোও কোনো লাভ হয় তোর বল! হসপিটালে যাবি?”
নীরব রইলো নিশু।
“হসপিটালে চল। বাথরোব পরে আছিস সেই রাত থেকে।”
রুম থেকে বেরুতেই দেখলো ধূসর নিচে যাচ্ছে।
“ভাইয়া শোনো।”
“কী?”
“ওকে হসপিটালে নিয়ে যাও। অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
“কী হয়েছে আবার?”
“দূর্বল হয়ে পড়েছে!”
মায়াকুমারী পর্ব ২৪
রুমে ঢুকলো ধূসর। কপালে হাত রাখতেই নিভু নিভু চোখে তাকালো। শরীরে জ্বর এসেছে।
“খারাপ লাগছে?”
তাকিয়ে রইলো নিশু।
“হসপিটাল যাবি?”
কিছু বললো না।
“রেডি হয়ে নে তোরা।”
বেরিয়ে গেল ধূসর। নিশুকে রেডি করে দ্যুতি নিজেও রেডি হলো।