মায়াকুমারী পর্ব ৩৮

মায়াকুমারী পর্ব ৩৮
মেহেরিন আনজারা

সিঁড়ি দিয়ে নামতেই মুখোমুখি হলো ধূসরের। অপ্রস্তুতবোধ করে মাথা নুয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো নিশু। সেদিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো ধূসর। রুমে ঢুকে শুয়ে পড়লো দ্যুতি। শরীরটা কেমন নেতিয়ে এলো পুইলতার ন্যায়।
“এখন কী করবো দ্যুতি?”
মৌন রইলো সে।
“শাড়িগুলো কে নিতে পারে কিছু চিন্তা করেছিস?”
দ্যুতি নিরুত্তর। জাহান্নামে যাক শাড়িগুলো। শাড়ি দিয়ে কী করবে? তার জীবনের রঙ যেখানে মলিন,ধূসর সেখানে শাড়ি জাহান্নামের চুলোয় যাক!
“মেজ ভাইয়া শুনতে পেলে খুব সিনক্রিয়েট করবে। তুই কিছু বলিস না। আমরা বরং ওই শপে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো ওমন শাড়ি আর আছে কিনা!”

নীরব রইলো দ্যুতি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্রতিটি কথা বিষের ন্যায় লাগছে। একপলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশু। চিরুনি নিয়ে দ্যুতিকে তুলে চুলগুলো আঁচড়ে শক্ত করে বেঁধে দিলো। কেমন ঝট বাঁধিয়ে গিয়েছে চুলগুলো। হাত ধুয়ে ডাইনিংয়ে গেল। হটপটের ঢাকনা তুলতেই দেখলো ভাত ভরা। ফুপা-ফুপি সামান্য খেয়েছিল ঔষধ খাওয়ার জন্য। ধূসর খায়নি। কেন খায়নি তার উপর রাগ করে বোধহয়। মুখটা মলিন হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করার অধিকার হারিয়ে ফেললো সকালে তাই নীরব রইলো। প্লেটে ভাত বেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো।
“আবারও শুয়ে পড়লি কেন উঠ।”
চোখ বুজে রইল দ্যুতি। সকাল থেকে উপবাস দু’জন। এত ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার রুচি কি হয়? নিশুর শরীর কাঁপছে!
“উঠ না।”
হাত ধরে উঠায়। ভাত মেখে মুখের সামনে ধরলো। দ্যুতি নিলো না।
“প্লিজ একটু খা।”
“খিদে নেই।”
“আমার খিদে পেয়েছে। আমার জন্য একটু খা।”
“খাব না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“দ্যুতি মেজাজ খারাপ করিস না। সকাল থেকে অভুক্ত দু’জন। আমি আজকে একটা মেডিসিনও নিইনি। শুনতে পেলে খবর আছে। হাঁ কর।”
জোর করে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। দ্যুতির চোখে পানি ছলছল করছে। বাম হাত দিয়ে মুছে দিলো।
“থাক মনখারাপ করিস না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন কাঁদলে তো কিছু হবে না। দোয়া কর যাতে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখে।”
দ্যুতিকে খাইয়ে নিশু নিজেও খেয়ে নিলো। শুয়ে পড়লো দ্যুতি। প্লেট ধুয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকলো। কাল রাত থেকে শরীর স্বাস্থ্য খুব খারাপ তার। কী হয়েছে বুঝতে পারছে না নিশু। তলপেটটা ছিড়েখুঁড়ে যাচ্ছে কিন্তু নিশু স্থির। পাকনামি করে ধূসরের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট করেছে এখন না পারছে সহ্য করতে না পারছে বলতে! হাত ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজতেই ভেসে উঠলো ছোট্ট বেলার স্মৃতি। ধূসরের বইখাতার মধ্যে আঁকিবুঁকি করতো,বইয়ের মধ্যে থাকা মানুষগুলোর ছবিতে টিপ,চুড়ি,লিপস্টিক এগুলো করতো। ধূসর বকাবকি করলেও কখনও গায়ে হাত তুলতো না। নিশু মার সহ্য করতে পারতো না। ছোটবেলায় ধ্রুবর মার খেয়ে বেশ কয়েকদিন বিছানায় ছিল। সেই থেকেই এলার্ট থাকে ধূসর। আজ হঠাৎ কী বুঝে থাপ্পড় মা’রলো! চোখজোড়া জলে টইটম্বুর হয়ে গেল ভরা বর্ষার বিলের মতো। কীভাবে পারলো তার গায়ে হাত তুলতে! অভিমানী হয় নিশু। আর কখনও কথা বলবে না মানুষটার সঙ্গে। চোখজোড়া ভেঙ্গেচুরে এলো।

বারবার কলিংবেল বাজতেই ডোর খুললো রিনা খালা। বাসায় প্রবেশ করলেন একজন লোক,চিনতে পারলো না তিনি।
“আপনে কেডা?”
“আসাদ সাহেব আছে?”
“হ।”
“উনাকে ডাকো।”
“আইচ্ছা আপনি বসেন।”
উপরে এসে আসাদ সাহেবকে বিস্তারিত জানালো রিনা খালা। টেনশনে একটু শুয়েছিলেন। চোখ লেগে আসতেই কাঁচা ঘুমে ব্যঘাত ঘটায় বিরক্ত হলেন। চোখ রগড়ে চশমা পরে লিভিং স্পেসের দিকে এগিয়ে যেতেই থমকালেন। মেজাজ খারাপ হলো উনার। একশো চুল্লির আগুনের ন্যায় দপদপ করতে লাগলো মস্তিষ্ক।

“তুমি!”
“হ্যাঁ।”
“কেন এসেছো?”
“নিশুকে নিতে।”
“কী বললে?”
“আমার মেয়েকে নিতে এসেছি।”
চোয়াল শক্ত করলেন আসাদ সাহেব।
“কেন?”
“আমার মেয়েকে নিয়ে যাব।”
“কীসের জন্য?”
“আপনার ছেলে স্ত্রীর মর্যাদা দিলো না এখানে রেখে কী লাভ?”
মুষ্টিবদ্ধ করলেন হাত।
“তোমাকে জানতে হবে না আমার পরিবার সম্পর্কে।”
“নিশু আমার মেয়ে।”
কষিয়ে একটা থাপ্পড় মা’রলেন উনার গালে।
“লম্পট!”
অগ্নি চোখে তাকালো নিশুর বাবা।
“তোর দুঃসাহস দেখে অবাক হচ্ছি!”

বাকবিতণ্ডা শুনতেই লিভিং স্পেসের দিকে এগিয়ে গেল ধূসর। ঘুম ভেঙে গেল দিলরুবা খাতুন সহ নিশু-দ্যুতির। এক এক করে লিভিং স্পেসে জড়ো হলো সবাই। নিজের বাবাকে দেখতেই চমকায় নিশু।
“আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব।”
“কোন অধিকারে?”
“আমার মেয়ে এই বাড়িতে কোনো অধিকার পেলো না,স্ত্রীর মর্যাদা পেলো না। কাজের লোকের মতো দিন-রাত খাটাচ্ছ!”
স্তব্ধ হলো নিশু। নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ধূসর। দিলরুবা খাতুন বললেন,”এইসব তুই কী বলছিস?”
“মিথ্যা কই বললাম?”
“তোর কীসের মেয়েরে? এই তোর মেয়ে আছে? তোর বউ মেরে ফেলতে নিয়েছিল একবার তখন কই ছিলি? আমি চিকিৎসা করে যখন সুস্থ করলাম,পুত্রবধূর মর্যাদা দিলাম এখন এসেছিস মেয়ে দাবি করতে? এতবছর কই ছিলি?”
“আমার সাথে ঝামেলা করো না। আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব।”
“কোন সাহসে?”

“আমার মেয়েকে বিয়ে দিবো। চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে ওকে পছন্দ করেছে।”
আচমকা ফুলদানি নিয়ে উনার মাথায় আঘাত করলেন আসাদ সাহেব।
“কত বড় সাহস তোর! আমার বাড়ির বউকে নিয়ে তুই বিয়ে দিবি! সেই কথা আবার আমার সামনে বড় গলায় বলছিস! জ্বীভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।”
এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগলেন। অবশ্য সকাল থেকে মন্ত্রী সাহেবের উপর মেজাজ চটে আছে উনার।
“আমার টাকায় তোর সংসার চলে। গাঞ্জুরি,জুয়ারি,নেশাখোর! চাকরিবাকরি কিছু নাই সেই আমিই তোকে চালাই। আমি টাকাপয়সা না দিলে ভিক্ষা করা লাগতো তোর। আল্লাহর পরে আমি যদি তোদের দয়া না করতাম তাহলে তোরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে কলকাতার রানু মন্ডলের মতো রাস্তাঘাটে বসে চুল থেকে উঁকুন ধরে ধরে মারতি! মেয়েকে পুঁজি করে আর কত টাকাপয়সা হাতাবি!”
“হাতানো লাগবে না। আমার মেয়ে এখন অনেক সম্পত্তির মালিক।”

চমকান আসাদ সাহেব।
“কী বললি?”
কাল মোবাইলে নিশুদের ছবি দেখে আইডিয়া করলো এইসব। তাই ঢাকায় আসা। কোনো একভাবে জানতে পারলেন নিশুর নামে সম্পত্তি দিয়েছেন আসাদ সাহেব। তাই ভাবলেন নিশুকে নিয়ে গেলে দুরকম লাভ হবে। চেয়ারম্যানের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সম্পত্তিটুকুও লিখিয়ে নিবেন। আর চেয়ারম্যানের ছেলে নিশুর জন্য পাগল হয়ে রয়েছে। সাড়ে তিন বছর আগে দেখেছিল। নিশুকে বিয়ে দিলে বলেছে অনেক টাকাপয়সাও দিবে যেটা দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আরামসে সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবেন।
“কার থেকে শুনলি?”
প্রতিত্তোর করলেন না।
“দিলরুবা তুমি বলেছো?”
“আমি কেন বলবো! ওর মনের মধ্যে এমনিতেই শয়তানি! আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে হয়তো।”
“এই লোভী কী বললো এটা?”
“ওরে ভালো করে একটা রামধোলাই দিন। যত যন্ত্রণা দিয়েছে নিশুর মা আর ওকে। সেগুলো ওর পিঠের উপর দিয়ে দিন।”

পিতলের ফুলদানি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললেন। অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি।
“ধূসর,এই কীটপতঙ্গটাকে ময়লার বাগাড়ে ফেলে দিয়ে আয়। খবর্দার হসপিটালে না। শেয়াল-কুকুর ছিড়েখুঁড়ে খাক ওকে।”
সিকিউরিটি গার্ডের মাধ্যমে রাস্তা ফেলে দিয়ে এলো উনাকে। রাগে-জিদে কাঁপতে লাগলেন আসাদ সাহেব। সাহস কত! দশ বছর বয়স থেকে পেলেপুষে এত বড় করলেন,প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা খরচা করছেন মেয়ের পিছনে। ভালো স্কুল,কলেজ,ভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন। প্রতিমাসে দেশ-বিদেশে নিয়ে বিদেশী ডাক্তার,ঔষধ সব মিলিয়ে কম খরচা যায় নাকি মেয়েটার পেছনে! রাজরানির হালে রেখেছেন তাও ওমন কথা। কখনো কেউ নিশুর সঙ্গে দুঃসাহস দেখায়নি উনার মা-বোন ছাড়া। আর এগুলো পছন্দ না উনার। কাঠ কাঠ গলায় এবার নিষেধ করে দিয়েছিলেন। আর সবাই ভালোবাসে মেয়েটাকে।

উনার পরিবারটাই ভালোবাসাময়। তিনি কখনো ভাবেননি নিশু উনার মেয়ে কিংবা পুত্রবধূ। বরং সবসময়ই আপন ভেবেছেন। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলো নিশু। খারাপ লাগলেও নীরব রইলো। কেন জানি বাবার জন্য মায়া লাগলো না। সাড়ে তিন বছর আগেও যখন গ্রামে গিয়েছিল তখন একটাবারও তার সঙ্গে কথা বলেনি মানুষটা। তার সৎ মা এবং ভাইবোনেরা অপমানসূচক কত কথা বলেছিল প্রতিবাদটুকু করলো না। আসার দিনও কথা বলেনি। এরপর আর গ্রামে যায়নি,সিদ্ধান্ত নিলো যাবেও না। রুমে ফিরে ব্যালকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। জলপ্রপাতের ন্যায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে দু-গাল বেয়ে। অশ্রুরা আজ বাঁধ মানছে না কিছুতেই! আজ সকালটাই কেমন জানি যাচ্ছে তার। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন আজ শুধু খারাপই ঘটেছে একটা ভালো কিছু ঘটলো না।

নীলির মেসেজ,থাপ্পড় খাওয়া,অনিকের স্বাস্থ্যের অবনতি,আত্মহ’ত্যা করতে গিয়ে বাঁধা,মা’র্ডার কেইসের মামলা খাওয়া এবং পুলিশি ঝামেলা,এরপর শাড়িগুলো চোরে নিয়ে গেল; এখন তার বাবার ভয়ংকর অবস্থা। সব মিলিয়ে ডিপ্রেশনে চলে গেল নিশু। সত্যি এত এত টেনশন নিতে পারছে না। অনিকের রক্তাক্ত মুখ,দ্যুতি-বুশরার অশ্রুসিক্ত মুখ,ধূসরের না পাওয়ার শোক,তার ফুপির হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া,স্মৃতিস্বরূপ শাড়িগুলোর জন্য খুব খারাপ লাগা,তার বাবার জন্যও খারাপ লাগা,মায়ের কথা ভীষণ করে মনে পড়া; কেমন জানি লাগছে! এরমধ্যে রাত থেকে প্রসাবের সঙ্গে ব্লাড যাচ্ছে কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না নিশু। ধ্রুবর বলা কথাগুলো মনে পড়ছে! পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে তাকে নিয়ে সংসার করবে! নিশু যে অধীর আগ্রহে রয়েছে; সেই সময়গুলো কেন যেন পুরাচ্ছে না বুঝতে পারছে না। উৎকণ্ঠা হয়ে আছে সে। শ্বাস আঁটকে অশ্রুসিক্ত মলিন চোখে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। কি সুন্দর চাঁদের আলো! হাজার তারকার মেলা। কত হাজারবার যে এই চাঁদটাকে দেখা হয়েছে তার তবুও মুগ্ধতা কমে না। চিনচিন করে উঠলো তলপেটে। কুঁকড়ে উঠে আর্তনাদ করে উঠলো। এশার নামাজ আদায় করে মোনাজাতরত ছিল দ্যুতি। নিশুর আর্তনাদ শুনতেই ঘাবড়ে গেল। জায়নামাজ উঠিয়ে দ্রুত ছুটে গেল।

“নিশু কী হয়েছে?”
হাত-পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসা নিশুর শরীর দিয়ে কেমন ঘাম বেরুচ্ছে। চিবুক তুলে ধরতেই নিশুকে কেমন জানি দেখালো।
“নিশু,কী হয়েছে?”
“আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে!”
“ঘেমে গেলি কেন?”
“খারাপ লাগছে!”
ভীতসন্ত্রস্ত হয় নিশু। নেতিয়ে পড়তেই জড়িয়ে ধরলো।
“আমি বাঁচতে চাই! বাঁচতে চাই! আমাকে হসপিটালে নিয়ে চল।”
ঘাবড়ে গেল দ্যুতি। ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না।
“মাকে একবার দেখে মরতে চাই!”
“তুই একটু শক্ত থাক। আমি ভাইয়াকে ডেকে আনছি।”
হাত ধরে ফেললো নিশু।

“না। দরকার নেই।”
“তোকে অসুস্থ দেখাচ্ছে নিশু।”
“দেখাক।”
নিশু কেমন ঘামছে! শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি কমছে!
“এক মিনিট প্লিজ।”
দেয়ালের সঙ্গে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে ধূসরের কাছে গেল।
“ভাইয়া! ভাইয়া দৌঁড়ে আসো।”
চমকায় ধূসর।
“কী হয়েছে?”
“ভাইয়া নিশু কেমন জানি করছে!”
“মানে!”
“আসো।”

ছুটে গেল দ্যুতি। সিগারেটটা পায়ের তলায় পিষে লম্বা লম্বা কদম ফেলে এগিয়ে গেল। নিশুর আর্তনাদ শোনা গেল। ভড়কায় ধূসর। কী হচ্ছে এইসব?
“তাড়াতাড়ি আসো।”
ব্যালকনিতে যেতেই দেখলো নিচে অস্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে নিশু। নিজেকে ধাতস্থ করে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। নিশুর ঘর্মাক্ত শরীর এবং অশ্রুসিক্ত মুখ দেখতেই চমকায়।
“কী হয়েছে ওর?”
“বুঝতে পারছি না।”
সকালের ব্যপারটা ইগনোর করলো ধূসর। বিপদের সময় এতকিছু মনে রাখলে সংকোচ তৈরি হবে ইভেন হচ্ছেও। গালে হাত রাখলো।
“কী হয়েছে নিশু?”
ঝাপসা চোখে তাকায় নিশু।
“কিছু না তুমি যাও। যাও তুমি। দেখতে চাই না তোমাকে।”
“ভাইয়া হসপিটালে নিয়ে চলো।”

দ্যুতিকে কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সব দোষ তার। এইসব অঘটন তার জন্য হচ্ছে। নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো দ্যুতি। চোখ-মুখ উল্টে ফেললো হঠাৎ। ঘাবড়ায় দু’জন।
“ভাইয়া নিশুকে হসপিটালে নিয়ে চলো।”
কাঁদতে লাগলো দ্যুতি। একদিকে অনিক অন্যদিকে নিশু দু’জন আপন মানুষের কষ্ট দেখতে পারছে না সে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হারানোর ভয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ধূসর ভাবলো নিশু হয়তো তার বাবার জন্য এমনটা করছে! যত যাইহোক,জন্মদাতা তো! কিন্তু মানুষটা সত্যিই একজন বদমানুষ। কীভাবে পারলো ওইসব মনস্তাপ পোষণ করে এখানে আসতে! আকস্মিক পাঁজাকোলে তুলতেই চমকে উঠলো৷ রক্তে ভেসে গেল নিশুর এত সুন্দর শাড়িটা! ভীত চোখে তাকায় দু ভাইবোন।

“ভাইয়া,এইসব কী!”
চিৎকার করে উঠলো দ্যুতি। বিচলিত হলো দু’জন।
“আমি বাঁচতে চাই! আমাকে বাঁচাও! আমি ম’রতে চাই না!”
ডুকরে কেমন করে ফুলেফুলে কাঁদে মেয়েটা। যেন একটা সুগন্ধি লেবুফুল! এভাবে কাঁদলে সহ্য করতে পারে না ধূসর। এই কান্নাটুকুই তো তাকে মায়ায় পড়তে বাধ্য করলো। দীর্ঘ সাড়ে এগারোটি বছর ধরে সে এই কান্না দেখে আসছে,হজম করে আসছে,এই কান্না তার ভীষণ পরিচিত! তাই তো মেয়েটার মায়ায় না পড়ে সে থাকতে পারলো না। নিষিদ্ধ জেনেও প্রণয়ের অন্তরালে ভেসেছিল দিবারাত্রি।
“আমি বাঁচতে চাই! বাঁচাও! এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না!”
সমুদ্রের ভাটার মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেল সব।
“ধ্রুব! ধ্রুব!”

ভেজা গলায় ডাকে নিশু কিন্তু মানুষটা নেই! কোথাও নেই! এমন একটা মুহূর্তে মানুষটার কত দরকার কিন্তু মানুষটা নেই। ডুকরে কাঁদে নিশু। সেলফিশ মানুষটা সবসময়ই তাকে একা ফেলে চলে চায়! প্রতিবারই! তবুও বোকা নিশু ধরতে চায়,ছুঁতে চায় কিন্তু পারে না। ছায়া তো কখনো ছোঁয়া যায় না! ধ্রুব হলো তার জন্য ছায়া। দেখা যায় ছোঁয়া যায় না। তবুও বোকা নিশু তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। বাঙালি যে! বাঙালি নারীরা স্বামীর মার খেয়ে এক হাতে চোখের জল মুছে আরেক হাতে ভাতের লোকমা মুখে পুরে কষ্টের সঙ্গে গিলে নেয়। ধ্রুবর দেওয়া শত দুঃখ,কষ্ট,অবহেলা বোকা নিশুও সব ভাতের দলার মতো গিলে নিয়েছে একটা সংসার করার আশায়। হসপিটালে নেওয়া হলো। নিশুর অবস্থা ভীষণ জটিল। আইসিইউতে নেওয়া হলো এবং এরমধ্যেই পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হলো হঠাৎ কেন এমনটা হয়েছে! রিপোর্টগুলো আসতে আসতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে গেল। ডক্টরকে রিপোর্টগুলো দেখাতেই তিনি যা বললেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো ধূসরের মাথায়। যেন থমকে গেল পুরো দুনিয়া। চোখ বুজে নিজেকে ধাতস্থ করলো। সুগন্ধি লেবুফুলের মতো শুভ্র বেডে ঘুমাচ্ছে নিশু। তার পাশে একটি চেয়ারে বসে চোখ বুজে বসে রইলো দ্যুতি। কেবিনে ঢুকলো ধূসর। পরপর গালের মধ্যে আকস্মিক তিনটি থাপ্পড় পড়তেই হতভম্ব হয়ে তাকালো দ্যুতি। কম্পন ছড়িয়ে পড়লো পুরো শরীরে। গাল দু-খানি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যেতে লাগলো। এগ্রেসিভ দেখালো ধূসরকে। ঝাপসা হয়ে গেল চোখজোড়া।

“খুব বেড়েছিস!”
ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না দ্যুতি। গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইল। আরও দুটি থাপ্পড় মা’রলো। চোখ নামিয়ে ফেললো। টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো প্রবল ঝর্ণাধারার ন্যায়। কিছু বুঝতে পারলো না হঠাৎ এমন আচরণ কেন করছে তার ভাই!

ব্যাংকক পৌঁছালো ধ্রুব প্রায় ঘন্টা তিনেক হলো। ইফতেখার মির্জার সঙ্গে দেখা হলেও গুরুত্ব দিলেন না তিনি। বরং মনে হলো সাপের সঙ্গে বেজির দেখা। দম্ভে ফুলেফেঁপে উঠলেন। আদনীন ফেরদৌসের সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ হলো না ধ্রুবর। ভদ্রমহিলা পুত্রশোকে ভালোই মূহ্যমান হয়ে পড়েছেন। ডক্টরের সঙ্গে কথা বলে সুবিধা করতে পারলো না। তবে এতটুকু জানলো সেন্স ফিরেনি। সম্ভবত কোমায় চলে গিয়েছে বলে আশঙ্কা করলেন। অনিককে দেখতে পারলো না আইসিইউতে সে তাই দেশে ফিরলো না ওরা। এসেছে যেহেতু অনিককে একবার দেখে না গেলে কেমন হয়! যত যাইহোক,অনিক ম’রে গেলে নিশু-দ্যুতির জেল হবে। সেটা ছাড়াও অনিকের মায়ের কথা ভেবে ভীষণ খারাপ লাগলো। এছাড়াও তার বোনটাও যে আরও ভেঙে পড়বে! মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। টেনশনে অস্থির লাগছে ধ্রুবর। মনে মনে দোয়া করলো,অনিক যেন খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কেন জানি! হোটেল বুকড করলো,আজ তারা থেকে যাবে। অনিককে দেখা অব্ধি কাল-পরশু পর্যন্ত না হয় এখানে থাকবে। নিশুর কথা,দ্যুতির কথা বারবার মনে পড়ছে! আসার সময় কথা দিয়ে এসেছিল নিশুকে। পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক হয় দোয়া করলো।

মায়াকুমারী পর্ব ৩৭

মা’র্ডার কেইসের আসামি হওয়ায় পুলিশি পাহারায় রয়েছে ওরা দু’জন। তাই দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়াটাও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ছিল। সেইসব হ্যান্ডেল করে রাতেই এয়ার এম্বুল্যান্সের মাধ্যমে নিশুকে ব্যাংকক হসপিটালে পাঠিয়ে দিলো। এর দু-ঘন্টা পর ওরা দু’জনও ব্যাংকক ফিরলো। আসাদ সাহেব এই ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে কিছু বলল না ধূসর। শুধু বলেছিল বিশ্বাস রাখতে এইটুকুই। উনাদেরকে নিশুর অসুস্থতার কথা জানানো হয়নি তাই ভাবলেন ওরাও হয়তো ব্যাংকক যাচ্ছে। যেহেতু ধ্রুব,ধীরাজ অলরেডি রয়েছে তাই বাঁধা দিলেন না তিনি।

মায়াকুমারী পর্ব ৩৯