মায়াকুমারী পর্ব ৪২

মায়াকুমারী পর্ব ৪২
মেহেরিন আনজারা

ওয়াশরুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে নামাজ আদায় করে বুশরাকে ডাকতে গেল দ্যুতি। কেবিনে ঢুকতে নিতেই ডোরের ফাঁক দিয়ে দেখলো বুশরা কাঁদছে কিন্তু ধূসর নির্লিপ্ত। পা ঘুরিয়ে চলে আসতেই শুনতে পেলো,”আপনি কি সত্যি নিশুকে বিয়ে করবেন?”
নীরব রইলো ধূসর। পিছু ফিরে তাকায় দ্যুতি।
“আপনি কি সত্যি নিশুকে ভালোবাসেন?”
প্রতিত্তোর করলো না।
“নিশু বলল আপনি তার প্রেমে পড়েছেন,তাকে ভালোবাসেন এটা কি সত্যি?”
মৌন রইলো ধূসর। ভীষণ কাঁদে বুশরা। হিচকি উঠলো একপর্যায়ে।
“আমার ভাই জীবন-মরণের সম্মুখে,মায়ের অবস্থা জটিল,সবকিছুর মায়া ছেড়ে সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে আপনার কাছে ছুটে এলাম। আর আপনি কিনা নিশুকে ভালোবাসেন?”

যেটার জন্য ভয় পাচ্ছিল সেটাই বোকা,গাধী নিশু হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে ছেড়েছে। তরতর করে ঘামতে লাগলো ধূসর। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ তার। এই নিশু মাথামোটা গাধী মেয়েটা যে কী ওফ! খুবই বিরক্ত লাগছে তার। সিরিয়াসলি একটা মেয়ে কীভাবে এত গাধী হয়! মেয়েটার মাথার মধ্যে কয়েকশো মণ গোবর। সবদিকে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। বুশরা তাকে নিঃস্বার্থভাবে পাগলের মতো ভালোবাসে এতে সন্দেহ নেই। এটা আজ-কালকার অনুভূতি নয় অনেক বছর আগের। হতে পারে ক্লাস এইট,নাইন,টেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে বুশরার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিবে যেহেতু মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। আরেকটা কারণ হচ্ছে এক রাত তার বেডে ঘুমালো। এক রুমে একটা ছেলেমেয়ে থাকা দৃষ্টিকটু তো বটেই। যদিও সে বুশরাকে খারাপভাবে স্পর্শ করেনি বেডে তু্লে শুইয়ে দেওয়া এবং হাত ধরা ছাড়া। এরপর আর থাকতে দেয়নি সে। তাদের জন্য আলাদা ভিআইপি কেবিন বুকড করেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আচমকা দু’হাতে জড়িয়ে ধরতেই অপ্রস্তুত হলো ধূসর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।”
কেবিনে ঢুকলো দ্যুতি।
“বড় ভাইয়াকে জেলাশ করানোর জন্য নিশু এটা বলেছে তুই সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন?”
চমকে তাকায় বুশরা।
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। পাগল নাকি তুই! আমরা দু’জন দুই মায়ের পেটের এটা কখনো কেউ বলবে বল? আমরা সবসময়ই মায়ের পেটের বোনের মতো ছিলাম। আর ভাইয়া সবসময়ই নিশুকে বোনের চোখে দেখে এসেছে। আজ বড় ভাইয়াকে জেলাশ করানোর জন্য এগুলো বলেছে।”
মাথা নোয়ায় ধূসর।

“আরে আমিই নিশুকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম এমনটা বলতে। বড় ভাইয়ার রিয়েক্ট দেখিসনি?”
বুশরার মনে হলো বুকের উপর থেকে পাথর নেমে গেল। তবুও অবিশ্বাসী মন যে মানে না। ফুলেফুলে সুগন্ধি লেবুফুলের মতো কাঁদে। কাঁদলে মেয়েটার ফর্সা মুখটা কেমন লাল হয়ে যায়। তখন ভীষণ কিউট আর আদুরে লাগে দেখতে। আকস্মিক গালের মধ্যে দাবাং মার্কা থাপ্পড় পড়তেই হতভম্ব হয়ে তাকালো বুশরা। কানটা হঠাৎ বিটিভির মতো ঝিরঝির করে উঠে বন্ধ হয়ে গেল। গালে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেল। রুদ্রমূর্তির রূপ ধারণ করে রয়েছে তার বাবা। বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো সবাই। এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ। হতভম্ব চোখ-মুখ সবার। রিয়েক্ট করতে ভুলে গেল বুশরা। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ধূসরের। আচকা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বুশরাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলেন তিনি।

“কত বড় সাহস তোমার! আমার মেয়ে হয়ে কিনা তুমি ছিঃ ছিঃ ছিঃ! মানসম্মান সব ধূলোয় মিশিয়ে দিলে।”
“ছাড়ো আমাকে! কোথাও যাব না আমি।”
“নির্লজ্জ মেয়ে!”
টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে এয়ারপোর্টে নিয়ে গেলেন। গাড়ি থেকে নামতেই মুখোমুখি দাঁড়ালো ফরহাদ ইশতিয়াক।
“নিয়ে যাও।”
“কোথায় নিয়ে যেতে বলছো আমাকে?”
“জাহান্নামে।”
“কোথাও যাব না আমি।”
“ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও মামা বাকিটা আমি দেখছি।”
ধরতে নিতেই আচমকা সরে গিয়ে গলা চেপে ধরলো শাফায়াতের। দাঁত-মুখ পিষিয়ে বলল,”তোমাকে আমি দেখে নিবো মাইন্ড ইট।”

কাঁধ,গলা সহ বুকের দিকটায় খামছে দিতেই জ্বলে উঠে রক্ত বেরুতে লাগলো তবুও রিয়েক্ট করলো না। শক্ত করে বাহু চেপে ধরে প্লেনে তুললো। কিছুক্ষণ পর চোখের সামনে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে উড়ে গেল প্লেনটি। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাকিয়ে রইলো শাফায়াত। শুধুমাত্র মেয়েটার জন্য সে এসিস্ট্যান্টের চাকরি নিয়েছে। নয়তো এই চাকরির মাইরে বাপ! তার যেইসব সার্টিফিকেট রয়েছে সেগুলো দিয়েই বাংলাদেশে কয়েক লাখ টাকা স্যালারির জব করতে পারবে সে। প্ল্যান করেছিল ইফতেখার মির্জার কুকর্ম সম্পর্কে জেনে ব্ল্যাকমেইল করে বুশরাকে বিয়ে করবে কিন্তু মন্ত্রী সাহেব তার থেকেও এক কাঠি উপরে। এই অব্ধি তেমন কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারলো না। যা বিয়ে ভেঙেছে সে সেটা না হয় গোপন থাকুক। কিন্তু শেষমেশ এই ছেলে এলো কোথ থেকে? মেজাজ খারাপ হলো।

ঝুপ করে সন্ধ্যা নামলো সেই কোন বেলায়। বুশরার কথা ভেবে ভীষণ খারাপ লাগছে দ্যুতির। যেভাবে এগ্রেসিভ হয়ে থাপ্পড়টা মা’রলো ওভাবে না দিলেও পারতো! মেয়েটা অনেক কেঁদেছিল। হয়তো পিতার ওমন রূপ সত্যিই সে নিতে পারেনি কিংবা তার বাবা কখনো তার গায়ে হাত তুলবে এটা ছিল অবিশ্বাস্য। কে জানে এই থাপ্পড়ের কারণে জিদের বশবর্তী হয়ে কী করে বসে! মেয়েটা এমনিতেই একটু বেশি আবেগপ্রবণ,আহ্লাদী,চুপচাপ আর শান্তশিষ্ট স্বভাবের হলেও কিছুটা জেদিও বটে। এক বাবার এক মেয়ে আহ্লাদী তো হবেই। এখন কোথায় আছে কে জানে! বেডের ওপর পড়ে আছে আইফোনটা। তুলে নিয়ে সুইচ চাপতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো তাদের তিনজনের একসাথে তোলা হাসিমাখা ছবি। বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বাইরে ধীরে ধীরে রাত ঘনিয়ে আসছে। ফিনাইলের বিচ্ছিরি গন্ধের মাঝেও মৃদু মৃদু হাওয়ায় থাইফুলের সুগন্ধি ভেসে আসছে। খাবারগুলো যেমন ছিল তেমনই পড়ে আছে কারোর মুখে আর ওঠেনি কিছুই। চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে ধূসর।

ভেতরে অস্থিরতা,অজানা এক উৎকণ্ঠা। বুশরার জন্য তারও খারাপ লাগছে। এই এক সপ্তাহ মেয়েটা তার কাছাকাছি ছিল,কথার পিঠে কথা বলে কানের পোকামাকড় সব বের করে দিয়েছিল। অজান্তেই একটু মায়াও জন্মে গিয়েছিল। অবশ্য সে চেয়েওছিল এমন কিছু হোক। কারণ এমন কিছু হওয়া দরকার। এতদিন বুশরা চেয়েছিল ধূসর চায়নি। এখন দু’জনেই চায় কিন্তু হঠাৎই পরিবার এসে দেয়াল হয়ে দাঁড়ালো। উসকোখুসকো হয়ে উঠে এগিয়ে গেল নিশুর কেবিনের দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দ্যুতি,বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে অসহনীয় লেলিহান অগ্নিশিখায়। নিশু চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে। গলা খাঁকারি দিতেই চোখ মেলে তাকায়। ফোনটা এগিয়ে দিতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

“সরি বল।”
নীরব রইলো নিশু।
“নে।”
“না।”
“বেশি আঘাত দিয়ে ফেলেছিস রাগ করে আছে।”
“করুক।”
“ও শান্ত আছে মানে ভয়ংকর কিছু। সরি বল।”
“না,কখনো না।”
“বুঝিস না কিছু?”
“লাগবে না।”
“ও এখন চুপচাপ মানে ভেতরে ভেতরে খুব রেগে আছে। হয়তো অপেক্ষা করছে কখন তুই রাগ ভাঙ্গাবি। আর এটা তোর দায়িত্ব।”
নিজের সিদ্ধান্তে অনড় নিশু। সে কেন রাগ ভাঙ্গাবে? রাগ ভাঙ্গাবে ছেলেরা! হ্যাঁ এটাই তো নিয়ম তাই না! স্ত্রী দোষ করবে আর স্বামীরা তোষামোদ করে ভাঙ্গাবে এবং সরি বলবে। অভিমানী হয়। হতাশ হয়ে ফিরে গেল ধূসর। অভিমানী নিশু নিতে পারছে না ধ্রুবর ওমন ব্যবহার। হ্যাঁ,রাগের মাথায় অনেক কথা বলে ফেলেছিল ঠিকই এখন তারও গিল্টিফিল হচ্ছে। সে যাইহোক,তাই বলে এভাবে চলে যেতে হবে? স্ত্রীরা তো রাগ করে অনেক কথা বলে তাই বলে সব কথা কানে তুলতে হবে? স্বার্থপর মানুষ একটা! শব্দ করে নাক টানে নিশু। মাথা ভার হয়ে গিয়েছে,চোখ-মুখ ফুলে ঢোল। নিশু তার একপাক্ষিক,একগুঁয়ে জেদে অটল রইলো।

মায়া বড়ই নিষ্ঠুর। একবার কারও প্রতি জন্মালে তা চাইলেও ভোলা যায় না। হাজারটা ভুল,অন্যায় এমনকি পাপ করলেও মনের ভেতরে সেই মানুষটা ঠিকই থেকে যায়। নিশুর সঙ্গে ধ্রুবর বিয়ে ছিল কেবলই নামমাত্র। সেই যে সাড়ে এগারো বছর আগে মুখোমুখি হয়েছিল তারপর আর কখনও দেখা হয়নি। প্রেম সেখানে ছিল না তবে অদৃশ্য এক বন্ধন ছিল। তিন কবুল বলে তৈরী হওয়া এক সম্পর্ক যার ওজন হয়তো দু’জনেই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি। ঘটনাগুলো এমন জটিল ছিল যে কাউকে একতরফাভাবে দোষ দেওয়া যায় না। হয়তো নিশু তাকে না বুঝেই কথাগুলো বলেছিল রাগে-দুঃখে,কষ্টে-অভিমানে। ধ্রুব যদি সত্যিই স্বার্থপর হতো তাহলে সে কোনোকিছু না ভেবেই দ্রুত সাইন করে দিতো রিয়েল-ফেইক এইসব ভাবার অবকাশ থাকতো না। সে নিশুর রূপে নয় সে হারিয়ে গিয়েছিল সেই অমীমাংসিত বন্ধনে। বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অনেক রাত হয়েছে। দাঁড়িয়ে রইলো একটি ম্যাগনোলিয়া গাছের নিচে। মন দুলছে দ্বন্দ্বে,সিঙ্গাপুরে ফিরে যাবে কি না। ফিরে গেলে নিশুর অভিমান হয়তো আরও তীব্র হবে। পিছু হটে দু-কদম এগুতেই কানে বেজে উঠলো,”আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”

থমকে গেল ধ্রুব। যেন হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া একটি ছু’রির ফল ভেতর থেকে নাড়ায় সবকিছু। আর তাতে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে বিঁধে ছিন্নভিন্ন হয়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়। কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মস্তিষ্ক। সেও বোধহয় ক্লান্ত বিশ্রাম চাই তার। হঠাৎ চোখ পড়লো একটি ফ্লাওয়ারশপের দিকে। দু-কদম এগুতেই রঙ-বেরঙিন টিউলিপের গুচ্ছ দেখতেই মুহূর্তেই মন জুড়িয়ে গেল। আপ্লূত হয় ধ্রুব। নিঃশব্দে আরও কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে কিনে নিলো ফুলগুলো। তারপর ধীরপায়ে হাঁটা শুরু করলো। হসপিটালের নিচে এসে হঠাৎ প্রবেশপথের সামনে থমকে দাঁড়ালো। মুখোমুখি হবে? যদি নিশু আবারও রিয়েক্ট করে? অস্বস্তি হয় ধ্রুবর। সময়টা হঠাৎ যেন স্থির হয়ে গেল। তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। লাল রঙের ট্যাক্সি,সাদা অ্যাম্বুলেন্স,চেকড প্যাটার্নের ইউনিফর্ম পরা নার্সদের হাঁটাচলা সবকিছু যেন কোনও ধীরগতি সিনেমার দৃশ্য। এর পাশে ছোট্ট একটা ক্যাফে। কিছু আত্মীয় সেখানে চুপচাপ বসে। আছে কারও মুখে দুশ্চিন্তা তো কারও মুখে কান্না চেপে রাখা।

দূরে একজন ভদ্রলোক ফোনে কথা বলছে,চোখে-মুখে অজানা শোক আর চাপা আতঙ্ক ছড়ানো। হসপিটালের পেছনের অংশটা একটু ফাঁকা। দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু হাইরাইজ বিল্ডিং নির্বাক,নিঃশব্দ পাহারাদারের মতো। একরাশ হিমেল হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল তার খরশান চোয়ালদ্বয়। সিল্কি চুলগুলো একটু উড়লো। একটি ম্যাগনোলিয়া গাছের পাশে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। চোখ বুজে যেন প্রার্থনায় ডুবে আছেন কারও জন্য। হয়তো তিনিও কাউকে হারিয়ে আজও ফিরে আসার অপেক্ষায়। আর ধ্রুব! সে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রবেশপথের সামনে একগুচ্ছ টিউলিপ হাতে,মনে হাজারও প্রশ্ন। নিশুর কাছে যাবে নাকি ফিরে যাবে চিরকালের মতো? হাসপাতালের সাদা দেয়াল যেন ধ্রুবর ভেতরটা আরও বেশি সাদা করে দিলো শূন্য আর শব্দহীন।

কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে অবশেষে ভেতরে পা রাখলো। টিউলিপের গুচ্ছটা ধ্রুবর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। আঙ্গুলে জোর বাড়ে ঠিক যেমন বুকের ভেতর চাপা ব্যথায় দম বন্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে। ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো ওই কর্নারের দিকে। কেবিনের কাঁচের দরজায় দাঁড়াতেই দেখলো জানালার পাশে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্যুতি। পরনে পাকিস্তানি কামিজ আর প্লাজু। দোপাট্টা দিয়ে টেনে রাখা মাথায় আধ ঘোমটা। আধশোয়া হয়ে আছে নিশু। চোখের নিচে গভীর কালি। শরীর আরও শুকিয়ে গিয়েছে যেন। ধ্রুবর পা আঁটকে গেল। তার চোখে জল এসে যায়,অবাক হয়ে নিজেকেই দেখে এতটা দুর্বল সে আগে কখনো হয়নি। উপস্থিতি টের পেতেই চোখ মেলে তাকায় নিশু। মুহূর্তেই চোখে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হলো দু’জন। তবে দুই চোখের মাঝে অজস্র স্মৃতি ভিড় করে এলো হঠাৎ। নিঃশব্দে এগিয়ে দিলো টিউলিপের গুচ্ছটা। অবজ্ঞা নিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো নিশু।

“কী হয়েছে?”
“লাগবে না তোমার ফুল এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
অভিমানী কণ্ঠস্বর হলেও সেখানে প্রচণ্ড অধিকারবোধ। নীরব রইলো ধ্রুব।
“তুমি তো স্বার্থপর। তোমার ভোলার ক্ষমতা আছে আমার ছিল না। সাড়ে এগারো বছরের মতো আজও তোমার অপেক্ষায় চাতকীর ন্যায় ছটফট করেছি। কী পৈচাশিক আনন্দ পাও আমায় কষ্ট দিয়ে?”
মায়া মায়া চোখে তাকায় ধ্রুব।
“তুমি সত্যিই স্বার্থপর। কাউকে ভালোবাসতে আর অনুভব করতে মন লাগে কিন্তু আফসোস আল্লাহ তোমাকে এগুলো দেয়নি। শুধু শুধু বিয়ে করে আমার জীবনটা নষ্ট করে ফেলেছো।”

টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নিশুর চোখ থেকে। পিঠের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে উঠিয়ে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে বুকের সঙ্গে মাথা রাখলো। গুচ্ছটি দিলো কোলে। আদ্র হয়ে ভেঙেচুরে এলো নিশুর বুকটা। বাম হাতে ঝাপটে ধরলো পিঠ। বুকে মাথা রাখতেই যেন স্বর্গসুখ অনুভব করলো। ফুঁপিয়ে কাঁদে নিশু। এই স্বার্থপর,শক্ত,মুডি মানুষটাকে সে এতটাই ভালোবাসে যে কিছুতেই ভুলতে পারে না; ঘৃণা করার পরেও না। অভিমানী নিশু কান্না আঁটকাতে পারে না মুহূর্তেই আরও ইমোশনাল হয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। নির্মল শান্ত,অদৃশ্য আদ্রচোখে তাকায় ধ্রুব।
“প্রতিবার আমাকে কেন ছেড়ে যাও বলো?”
কত কষ্ট,কত দুঃখ,কত অভিমান আর কতশত অভিযোগ সেখানটায়।
“তুই আমাকে এত ভুল কেন বুঝিস? আমি তোকে কীভাবে বুঝিয়ে বলবো বল?”
“তুমি সবসময়ই আমাকে হিংসা করতে,একটুও সহ্য করতে পারতে না। আমাকে কখনো তোমার যোগ্য বলে মনে করোনি। এখন আমাকে দেখামাত্রই প্রেমে পড়েছো।”

কিছুক্ষণ নীরব রইলো ধ্রুব।
“আমার যখন পনেরো বছর বয়স তখন তোর দশ। অর্থাৎ বলা যায় বাচ্চা বয়সে বিয়ে হয়েছে আমাদের। কে বা মানতে পারবে ওমন বিয়ে! দুঃখ আমার এটাই যে তোরা কেউই আমাকে বুঝতে চাস না। সবাই সবার অভিযোগ আমার মাথায় বোঝার মতো চাপিয়ে দিয়ে খালাস হয়ে গেলি। পনেরো বছর বয়সে একটা মানুষের বোধবুদ্ধি কতটুকু থাকে জানিস তুই? তুই শুধু তোরটা দেখলি অথচ আমারটা দেখলি না। তোর পরিবার না থেকেও আমার বউ হয়ে তুই সব পেলি। অভাব কী জিনিস তুই দেখিসনি। আমার পরিবার থাকার পরেও আমি কেবল তোর জন্য নিঃসঙ্গভাবে সাড়ে এগারোটা বছর এতিমের মতো পার করেছি। পরিবার থেকেও না থাকার কী যন্ত্রণা তুই কী বুঝবি! জিজ্ঞেস করিস কোনো অনাথ,এতিমকে তাহলে টের পাবি।”
ভেঙ্গেচুরে এলো ধ্রুবর বুক।

“আমার উপরের রূপটাই শুধু তোরা দেখেছিস ভেতরের অবস্থা কতটা মুষড়ানো সেটা দেখেছিস কখনো? পরিবার থেকেও না থাকার শাস্তি কতটা ভয়াবহ তুই জানিস? তুই তোর অনুভূতিগুলো দেখাতে পারিস আমি তা পারি না। কারণ আমি পুরুষ। আমাদের কাঁদতে মানা। লজ্জা। আমরা পুরুষেরা বাবার লাশ কাঁধে নিয়েও নীরব থাকতে পারি। তাই তো নারীরা মনে করে আমাদের কোনো শোক,তাপ,দুঃখ বলে কিছুই নেই। অথচ নীরবে নিভৃতে ক্রমে ক্রমে দহন হয়ে আমাদের বুকের ভেতর যে চৌচির হয়ে যায় তা কেউ জানে না। কথায় কথায় অভিযোগ করিস সাড়ে এগারো বছরের কথা। তখন তোর দায়িত্ব তো থাক দূরের কথা আমার নিজের দায়িত্ব নেওয়ার কোনো এবিলিটি ছিল নাকি! তখন তো আমি ছোট ছিলাম। আমার বোধবুদ্ধি কতটুকু ছিল! এখন অভিযোগ করলে গ্রহণযোগ্য। হুট করে বিয়ে করিয়ে দিলো। তারপরেও নীরবে সব মেনে নিলাম। কারণ আমি প্রতিক্ষণ আমার বাবার ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার ছিলাম। যবে থেকে বুঝতে শিখলাম তবে থেকে তোকে না দেখেও নীরবে নিভৃতে ভালোবাসতে শুরু করলাম।

ডিভোর্স না দিয়ে তোকে চিঠি দিলাম কারণ অস্বস্তি হচ্ছিল হুট করে তোকে ফেইস করতে। কিন্তু তুই সেটা মূল্যায়ন না করে ছিঁড়ে ফেললি। একটাবারও কি দেখার ইচ্ছে ছিল না আমি কী লিখলাম তোকে? কেবল তোর জন্য আমাকে সেই ছোট্ট বয়সেই ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার হয়ে বিয়ে করতে হয়,বাড়ি ছাড়তে হয়,স্বাধীনতা কী আমি জানি না,নরমাল একটা লাইফ পেলাম না,কারো সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ করতে পারতাম না। পনেরো বছর বয়স থেকেই স্কুল আর বাসা অব্ধি ছিল আমার সীমাবদ্ধতা। এর বাইরে কখনো কোথাও যেতে পারতাম না। দু-মিনিট কোনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে পারতাম না। সারাক্ষণ পড়ার মধ্যে নাক-মুখ ডুবিয়ে রাখতে হয়েছে। যেখানে এই বয়সে ছেলেরা দেশ-বিদেশে ঘুরে,ট্যুরে যায়,পার্টি-পিকনিক করে সেখানে আমি সবকিছু থেকে বঞ্চিত।

সবকিছুতেই ছিল বাবার কঠোর নজরদারি। একটা মেয়েকেও বোধহয় এতটা কঠোরতা দেওয়া হয় না যতটা ছেলে হওয়া সত্ত্বে আমাকে দেওয়া হয়েছিল। কী জানি যদি আমি বিগড়ে যাই তাই। সেখান থেকেই আমার এই একগুঁয়ে স্বভাবের সৃষ্টি। এইসবের কী বুঝবি তুই! কারণ তুই তো আমার উপরের স্বার্থপর রূপটাই দেখলি। একজন পুরুষ বাঁচে কয়দিন! তার পূর্বেই যদি তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় তাহলে তার আর বেঁচে থাকার মানে কী! পুরুষদের এই তীব্র যন্ত্রণা তুই বুঝবি না। এনিওয়ে,এরপর আবারও বিয়ে-বাসর। তারপর আবার ফেইক পেপার দিয়ে ডিভোর্সের নাটক। সবশেষে নিজের জন্মদাতা পিতার কাছে প্রায় ভিক্ষা চাওয়ার মতো করে অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রে গেলাম নিজেকে তোর যোগ্য করে তুলে তোকে ফেইস করতে।

এরপর নিজেকে তোর যোগ্য করে এক সাহারা তৃষ্ণা চোখে নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাক করলাম কিন্তু তোকে দেখলাম না। তুই পালিয়ে পালিয়ে রইলি। আমাকে ফেইস না করার জিদে অটল রইলি। আমি নিজের স্টাডি চালিয়ে পার্টটাইম জব করে কতটা আবেগ,অনুভূতি এবং ভালোবাসা মিশিয়ে তোর জন্য গিফট আনলাম তুই আমাকে ইনসাল্ট করে ফিরিয়ে দিলি। অস্বস্তি হচ্ছিল বলে দিতে পারিনি তাই বোনের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলাম যেটাতে তোর হক ছিল। কিন্তু তুই আমাকে ভুল বুঝলি। গিফটের জিনিসগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে ইনসাল্ট করলি। সবাইকে দিয়েছি তোকে না দিলে আবার আমাকে খারাপ ভাবতি কিংবা বিষয়টি ছিল দৃষ্টিকটু। একটাবার তুই আমার সামনে এসে কথা বললি না,ভালোমন্দ কিছু জিজ্ঞেস করলি না। বিয়েটা মানি না মানি না করেও আজীবন তোর জন্য নিজেকে লয়্যাল রাখলাম। তুই জানিস কত বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম আমি!

ছেলেরাও ধর্ষণ হয়। হ্যাঁ,আমিও হতে হতে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম ওই এ্যানির গ্যাংদের কন্সপায়ার থেকে। একবার নয় বহুবার। যুক্তরাষ্ট্র আমার কাছে যেমন ছিল স্বাধীন তেমনি ছিল দোযখস্বরূপ। সাড়ে এগারোটা বছরের মধ্যে ওই সাড়ে তিনটি বছরই ছিল আমার জন্য শ্রেষ্ঠ কিংবা মুক্তির জীবন। তেমনি ছিল আরও জঘন্যও। এ্যানি,নীলি সহ আরও বেশকিছু ফরেনার মেয়ে আমার জীবন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে দূর্বিষহ করে তুলেছিল। সবসময়ই আমাকে বাজে অফার করেছিল। হাজারটা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি কখনো আবর্জনার স্রোতে গা ভাসাইনি। কারণ আমি ওইসব ঘৃণা করি। কোনো কাজ করার পূর্বে আমি একশোবার আমার বাবা-মা এবং পরিবারের মানসম্মানের কথা চিন্তা করি। কারণ আমি কখনো চাইনি আবেগে জড়িয়ে আমার একটা ভুলে আমার পরিবারের সম্মান নষ্ট হোক কিংবা নিজ এবং নিজের ভাইবোনের জীবন। যেখানে অন্যান্য ছেলেরা ট্রিও রিলেশনশিপে গিয়ে জীবনকে উপভোগ করে সেখানে আমি তোর জন্য নিজেকে লয়্যাল রেখেছিলাম। কতটা ক্রিটিকাল মোমেন্ট আমি পার করেছিলাম তা তোর জানার কথা নয়।

সব সামলে নিজেকে শুদ্ধ রেখেছি তোর জন্য। কতশত মেয়েকে ইনসাল্ট করেছি তোর জন্য। সেই তুই আমাকে দু’পয়সার মূল্য দিলি না। কতশত মেয়ে আমার জন্য পাগল আমি তাদের ইগনোর করেছি তোর জন্য। কোনো মেয়েকে পাত্তা না দেওয়া সেই আমি আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সেদিন রাত তোর মুখোমুখি হয়েছিলাম। অথচ সেদিন তুই আমাকে অপবাদ দিয়ে স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ফিরিয়ে দিলি। তোর জিদ সবসময়ই উপরে রাখলি। পেয়েছিস তোরা সবাই আমাকে মদন। একা তুই অসুস্থ হয়েছিস আমি কি পরিবারহীন হয়ে খুব সুখে সুস্থ ছিলাম!

মায়াকুমারী পর্ব ৪১

তোর মেডিসিনের খবর সবাই জানে আমিও যে পনেরো বছর বয়স থেকে সাইকিয়াট্রিস্ট শরণাপন্ন হয়েছিলাম এই অব্ধি এবং ডিপ্রেশনে ভুগে এখনও মেডিসিন কন্টিনিউ করছি আমি তো সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্য কাউকে বলিনি। কারণ আমরা পুরুষ আমাদরকে আহ্লাদ দেখার কেউ নেই। সেদিন তোকে চিঠিতে কী লিখেছিলাম নে পড়।”

মায়াকুমারী পর্ব ৪৩