মায়াকুমারী পর্ব ৫১

মায়াকুমারী পর্ব ৫১
মেহেরিন আনজারা

আইসিইউর ভেতর তখনও যন্ত্রের শব্দে ভারী বাতাস। মনিটরের টিকটিক শব্দ,স্যালাইনের ধীর প্রবাহ আর ভেন্টিলেটরের মৃদু শোঁ শোঁ আওয়াজ মিলেমিশে এক অদ্ভুত চাপা নিস্তব্ধতা তৈরি করেছে। অনিক শুয়ে আছে নিশ্চল,তবে বুক ওঠা-নামার ছন্দ এখন স্পষ্ট। তবুও ডাক্তাররা বলেছেন,পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। ঠিক তখনই দরজায় নক পড়ল। নার্স ধীরে ধীরে উঠে দরজা খুলল। মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আদনীন ফেরদৌস। চোখদুটো ভেজা,গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু। ক্লান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,”আই ওয়ান্ট টু সি মাই সান।”-(আমার ছেলেকে দেখব।)

নার্স সশ্রদ্ধ মাথা নেড়ে সরে দাঁড়াল।
“ওহ শিওর! প্লিজ,কাম ইন।”
ধীর পদক্ষেপে,যেন প্রতিটি পদক্ষেপে পাহাড়ের ভার,তিনি রুমে প্রবেশ করলেন। নীরবতার ভিতর উনার শাড়ির খসখস শব্দও যেন ভারী হয়ে বাজল। হসপিটালের সাদা আলোতে উনার সুশ্রী মুখখানি আরও বিবর্ণ দেখাল। ধীরে ধীরে ছেলের শয্যার পাশে এসে বসলেন। দীর্ঘক্ষণ অনিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন,যেন বছরজুড়ে জমে থাকা অশ্রু এক নিমিষে চোখে ভেসে উঠেছে। হাত বাড়িয়ে ছেলের আঙুলগুলো নিজের মুঠোয় নিলেন। কাঁপা ঠোঁটে কোনো শব্দ বেরোল না,শুধু এক নিঃশ্বাস দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎই চোখ ভিজে গেল আবারও। অজান্তেই একটি অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল অনিকের শিথিল হাতের ওপর। সেই স্পর্শে যেন এক ঝলক আলো ফুটে উঠল অনিকের অচেতন দেহে। ধীরে ধীরে তার চোখের পাতায় নড়াচড়া হলো। নার্স কাছে এগিয়ে এলো,মনিটরে দৃষ্টি রাখল। আদনীন ফেরদৌস অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। পিটপিট করে তাকাল অনিক। তাকিয়েই রইল মায়ের অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে। বুক ভেঙে এলো উনার। তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বা..বাবা!”
অনিকের ঠোঁট শুকিয়ে এলো।
“পা..পানি..”
নার্স দ্রুত এগিয়ে এলো। চামচে করে কয়েক ফোঁটা পানি অনিকের ঠোঁটে ছোঁয়াল। পানির স্বাদে তার গলা ভিজল,প্রাণ যেন আস্তে আস্তে ফিরে এলো। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল অনিক। আদনীন ফেরদৌস চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন,”মাই সান উইল সারভাইভ,ওয়োন্ট হি?”-(আমার ছেলেটা বেঁচে উঠবে তো?”
মৃদু হাসল নার্স।

“হি স্টিল নিডস আ লট অব কেয়ার। হি হ্যাজ রেসপন্ডেড,অ্যান্ড দ্যাট ইটসেল্ফ ওয়াজ দ্য গ্রেটেস্ট মিরাকল। হাওএভার,হিজ কন্ডিশন ইজ নট স্টেবল ইয়েট। ফোর নাউ,হি উইল স্টে ইন দ্য আইসিইউ ফোর অবজার্ভেশন অ্যান্ড সাপোর্ট। ইফ হিজ কন্ডিশন ইমপ্রুভস,হি উইল বি মুভড টু দ্য এইচডিইউ অ্যান্ড দেন গ্রাজুয়ালি টু আ নরমাল কেবিন।”-(উনার এখনও অনেক যত্নের দরকার। তিনি সাড়া দিয়েছেন আর এটিই সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনা। তবে এখনও পুরোপুরি স্থিতিশীল নয়। আপাতত আইসিইউতে থাকবেন পর্যবেক্ষণ আর সহায়তার জন্য। যদি অবস্থার উন্নতি হয়,তাহলে উনাকে এইচডিইউতে নিয়ে যাওয়া হবে,তারপর ধীরে ধীরে সাধারণ কেবিনে।)
আদনীন ফেরদৌস কাঁপা হাতে অনিকের কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। চোখ ভেজা অথচ ঠোঁটে ছোট্ট হাসি। যেন বছরের পর বছর জমে থাকা বেদনা একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। ছটফট করল অনিক কিন্তু গলা ভীষণ শুকনো। নার্স এগিয়ে এসে ভেজা তুলায় ঠোঁট ভিজিয়ে দিলো। রুমে তখন এক অদ্ভুত পরিবেশ। যন্ত্রের শব্দের ভিতর জীবনের সুর,অশ্রুর ভিতর হাসি,আর মৃত্যুর ছায়ার আড়াল থেকে ফিরে আসা এক অসম্ভব আলো।

পুরো কেবিনে নেমে এসেছে এক অদ্ভুত নীরবতা। বাইরে বর্ষণমুখর রাতের বৃষ্টি জানালার কাচে টুপটাপ শব্দ তুলছে,মাঝে মাঝে বজ্রের ঝলকানি কেবিনটাকে হঠাৎই আলোকিত করে তোলে,তারপর আবার সব গাঢ় অন্ধকার। আসাদ সাহেব মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। উনার গম্ভীর মুখাবয়ব কঠিন পাথরের মতো,তবু ভিতরের ঝড় চেপে রাখা বোঝা যায়। দিলরুবা খাতুন মুখে আঁচল চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন,যেন দম আঁটকে আসছে বুকের ভিতর। ধূসর দাঁড়িয়ে আছে নিথর- একটি অবাক পাথরের মূর্তি যেন,যার ভিতরকার দহন কেবল চোখের গভীর স্থিরতায় টের পাওয়া যায়। বুশরা মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে,লজ্জা আর অনিশ্চয়তায় তার শরীর কাঁপছে হালকা বৃষ্টির পাতার মতো।

দ্যুতি একপাশে সোফায় বসে সবকিছু দেখছে। তার ভঙ্গিমা যেন স্বাভাবিক কিন্তু চোখে ছায়া জমে উঠছে মুহূর্তে মুহূর্তে। সবটা যেন তার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। এত দ্রুত,এত আকস্মিকভাবে কী ঘটে গেল এই কয়েক ঘন্টায়- তা বিশ্বাস করতে তার সময় লাগছে। এখনও যেন অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে সে। কিন্তু সবচেয়ে অবিশ্বাস্য যে সত্যি,তা হলো- হ্যাঁ,বুশরার সঙ্গে তার ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাও আবার হঠাৎ এত দ্রুত,যেন এই বর্ষণমুখর রাতের মতোই আকস্মিক,অপ্রত্যাশিত,তবু অপ্রতিরোধ্য। আমতা আমতা করে উঠল নিশু। যেন নিজের ভিতরেই লড়ছে। কী করেছে,কেন করেছে।

একটু আগে জেদের বশে নেওয়া সিদ্ধান্তটা এখন তার কাছে পাথরের মতো ভারী হয়ে আসছে। বুকের ভিতর কেমন খচখচ করছে। মনে হচ্ছে সবাইকে ভীষণভাবে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ছুটে গিয়ে দিলরুবা খাতুনকে জড়িয়ে ধরল। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কাঁপা গলায় বলল,”ফুপি,তুমি কি আমার উপর অসন্তুষ্ট? আমি কি তোমাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?”
নীরব রইলেন তিনি। মুখে আঁচল চেপে রেখেছেন। যেন কান্নাটা চেপে রাখার যুদ্ধ করছেন। নিশু আরও অস্থির হয়ে উঠল এবং পা জড়িয়ে ধরল।
“ফুপি,আমি তো তোমার মেয়ে। ভুল করেছি হয়তো কিন্তু তোমার মেয়ে বলে মাফ করে দাও না। আমাকে দূরে ঠেলে দিও না।”

তবুও তিনি নীরব। শক্ত হয়ে বসে রয়েছেন,চোখ নিচে নামানো,ঠোঁট সিল। সেই নীরবতার শাস্তি নিশুর বুক ভেদ করে যাচ্ছে। হঠাৎ উঠে আসাদ সাহেবের পায়ে পড়ল নিশু।
“আব্বু,তুমিও কি রাগ করেছ? তুমি-ও কি আমার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে?”
নিরুত্তর তিনি। উনার বুক ওঠা-নামা করছে কিন্তু মুখ খোলার শক্তি যেন হারিয়ে গিয়েছে। নিশু কাঁপতে কাঁপতে বলল,”আব্বু,আমি তোমার আরেক মেয়ে। তুমি যদি মুখ ফিরিয়ে নাও,আমি কোথায় যাব?কে থাকবে আমার পাশে? প্লিজ আব্বু,আমাকে মাফ করে দাও।”

শব্দগুলো কেঁপে কেঁপে বাতাসে ভাসতে লাগল। পুরো কেবিন নিস্তব্ধ। বাইরে বর্ষণমুখর রাতের বৃষ্টি জানালার কাঁচে আছড়ে পড়ছে কিন্তু সেই শব্দও চাপা পড়ছে নিশুর কান্নার হাহাকারে। নিশু বুক ভেঙে ডুকরে কাঁদতে লাগল।
“তোমরা যদি আমাকে মাফ না করো.. আমি শান্তি পাব না মরেই যাব।”

কথাগুলো ছু’রির মতো বিঁধে গেল সবার হৃদয়ে। ধূসর দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো,বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে অথচ মুখে কোনো শব্দ নেই। দ্যুতি সোফায় বসে সব দেখছে। অবিশ্বাস,হতভম্ব আর যন্ত্রণার মিশ্রণে চোখের ভিতর কুয়াশা জমেছে। বুশরার বুক আদ্র হয়ে এলো নিশুর কান্নায়। ইচ্ছে করছে নিশুর মতো তারও সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কিন্তু অদৃশ্য কিছু একটা যেন আঁটকে রেখেছে তাকে। দিলরুবা খাতুনের চোখ থেকে টুপটুপ করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। আঁচলের আড়ালে এতক্ষণ চেপে রাখা কান্না ভেসে এলো বাইরে। আসাদ সাহেবের ভিতরের কঠোর মুখোশ ভেঙে পড়ল নিঃশব্দে। চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি,ঠোঁট সিল করা থাকলেও বুকের ভিতর হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছিল। পুরো কেবিনটা যেন এক মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডির মঞ্চে পরিণত হলো। যেখানে ভালোবাসা,অপরাধবোধ,রাগ আর ক্ষমাহীন নীরবতা মিলেমিশে এক ভয়ানক দৃশ্য আঁকল। বাইরে বৃষ্টি আরও তীব্র হয়ে আছড়ে পড়ছে,যেন আকাশও এই কাহিনীর সাক্ষী হয়ে কান্না করছে। হঠাৎই দরজা খুলে কেবিনে ঢুকল ধ্রুব। মুখে ক্লান্তি,চোখে বিরক্তি। কণ্ঠটা ভারী আর দৃঢ়-

“নিশু,যা হয়েছে,এনাফ।”
“না.. আমি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি সবাইকে। মাফ না চাইলে শান্তি পাব না।”
তপ্ত শ্বাস ফেলল ধ্রুব। বাইরে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ যেন তার ধৈর্যের সীমা ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
“অনেক রাত হয়েছে,নিশু। হোটেলে ফিরি চল।”
“তুমি ওদের নিয়ে যাও,আমি এখানেই থাকব।”
ধ্রুব আর কোনো কথা বাড়াল না। এগিয়ে এসে নিশুর হাত শক্ত করে ধরল। নিশু প্রতিরোধ করতে চাইলে-ও ধ্রুবের দৃঢ়তা তাকে টেনে নিলো।

“চল।”
নিশু হতবিহ্বল চোখে উনাদের দিকে এক ঝলক তাকাল,তারপর ধ্রুব তাকে কেবিনের বাইরে নিয়ে গেল। বেরোনোর সময় ধ্রুব থেমে ধূসরের দিকে ফিরল।
“দাঁড়িয়ে রইলি কেন,আয়।”
ধূসর এক মুহূর্ত স্থির রইল,মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। তারপর একবার চোখ বুলাল বাবা-মায়ের দিকে,আবার বুশরার দিকে,শেষে চোয়াল শক্ত করে পা বাড়াল। ধ্রুব আর নিশুর পেছন পেছন সেও বেরিয়ে এলো সে। এরপর বুশরা-ও। দ্যুতি একা রয়ে গেল কেবিনে। ভারী নীরবতা তার কাঁধে চাপিয়ে দিলো অদ্ভুত বোঝা। বাইরে বৃষ্টি আরও তীব্র হয়ে উঠল,কাঁচে ঝমঝম করে আছড়ে পড়তে লাগল।

হোটেলে ফিরল ওরা চারজন। রাত অনেক হয়েছে,লবি নিস্তব্ধ। করিডরে শুধু মৃদু আলো,আর ভেজা জুতোর শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছিল। অবশেষে রুমে ঢুকল ওরা। নিশু চুপচাপ,মুখে ক্লান্তি আর চোখে অশ্রুর দাগ। রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হতেই থমথমে নীরবতা গাঢ় হয়ে উঠল। আলো জ্বলছে ঠিকই কিন্তু পরিবেশটা যেন শূন্য আর নিস্তেজ। বাইরে বৃষ্টির শব্দ টুপটাপ করে কাচে আছড়ে পড়ছে,মাঝে মাঝে দূরের বজ্রপাত জানালার কাঁচ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নিশু বিছানার ধারে এসে বসে পড়ল।

মায়াকুমারী পর্ব ৫০

মাথা নুইয়ে রেখেছে,বুকের ভিতর যেন কেউ ভারী পাথর চাপা দিয়েছে। চোখ শুকনো কিন্তু ভিতরের কান্না যেন অশ্রুর আকার নিয়েই বের হতে চাইছে না। ধ্রুব কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল,”নিশু,তোকে বোঝানো যায় না। আজ যা করেছিস..সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছিস।”

মায়াকুমারী পর্ব ৫২