মায়াকুমারী পর্ব ৫৬

মায়াকুমারী পর্ব ৫৬
মেহেরিন আনজারা

বাড়ির গেটের সামনে এসে ব্রেক কষল ধ্রুব। গাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত বাসার ভেতরে ঢুকে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলল রিনা। ঘুমঘুম চোখে ধীরাজ উঠে বসল কিন্তু চোখে জেগে আছে অদৃশ্য উৎকণ্ঠা।
“নিশুমনি কোথায়?”
ধীরাজ চোখ মেলে তাকাল,মস্তিষ্কে সম্ভবত অক্সিজেন পৌঁছায়নি,তাই কী বলল বুঝতে পারল না।
“কীরে?”
ধমক খেতেই কেঁপে উঠল।
“এখানেই তো ছিল।”
ধ্রুব চারপাশে চোখ বুলাল কিন্তু নিশুর কোনো ছায়া নেই।
“কই?”
অপ্রস্তুত হলো ধীরাজ।
“কোথায়?”
আমতাআমতা করল।
“রিনা,নিশুমনি কোথায়?”
“ভাইজান,আমি তহন সোফায় বইতে কইয়া পাকের ঘরে কাজ করতাছিলাম।”

মেজাজ খারাপ হলো ধ্রুবর। তিনজনই পুরো বাড়ি ঘুরে দেখল। প্রতিটি ঘর,প্রতিটি জানালা,প্রতিটি অলিন্দ কিন্তু নিশুর কোনো চিহ্ন নেই। শ্বাস আঁটকে এলো ধ্রুবর। নীরবতা চারপাশে ঘেঁষে দাঁড়াল,যেন সময় থেমে গিয়েছে। বাতাসে লেগেছে অদ্ভুত কম্পন।
“নিশু! নিশু!”
কিন্তু ফিরে এলো শুধু নিঃশব্দ। হৃদয় জড়িয়ে ধরেছে অচেনা আতঙ্ক। ধীরাজ চোখ বড় করে তাকাল,রিনা বুক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে- তিনজনের মনে একটাই ভয়,নিশু ঠিক আছে তো? প্রতিটি কোণ যেন নিশুর খোঁজ চেয়ে চুপচাপ নড়ছে। বাতাসের সঙ্গে মিলিত হয়ে নীরবতা ধীরে ধীরে তাদের মধ্যেই প্রবেশ করছে। ধ্রুব এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়াল। মনে হলো,নিশু কোনো অদৃশ্য শক্তির হাতে আঁটকে গিয়েছে এবং সময় যেন তাদের কাছ থেকে সব নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিচ্ছে। শুধু একটি কথা বাকি,নিশু কোথায়? দ্রুত ছাঁদের দিকে পা বাড়াল ধ্রুব। একদম উপরে পৌঁছাতেই চোখ পড়ল তাহমিদের দিকে। সে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। ধ্রুবর চোখ ঠিক ট্যাঙ্কির উপর গিয়ে আঁটকাল। নিশু এখনও বকা দিচ্ছে তাহমিদকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ছ্যাঁছড়া ছেলে কোথাকার! মেয়েমানুষ দেখলেই তাকিয়ে থাকতে মন চায়! যত্তসব ফাউল!”
শ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইল তাহমিদ। তবে নিশুর বলা শব্দগুলো যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ধ্রুবর শ্বাস আঁটকে গেল,মনে হলো শ্বাসনালীতে কাঁটা লেগেছে। ধ্রুবের উপস্থিতি টের পেতেই অপ্রস্তুত হয়ে সরে দাঁড়াল তাহমিদ। নিশুকে এমন অবস্থায় রেখে ফিরে যেতে বিবেকে বাঁধছিল তার। আবার ধরে নামাতে গেলে যদি নিশু খারাপ কিছু বলে তাই সে দোটানায় ছিল। এমনিতেও তার মানসম্মান নিয়ে টান দিয়েছে মেয়েটা। নীরবতা,উত্তেজনা,আর অপ্রত্যাশিত দেখা সব মিলিয়ে ছাঁদে যেন সময় থেমে গিয়েছে।
“নিশু,কী করছিস?”
ধ্রুবকে দেখতেই চমকে উঠে বড় বড় করে তাকাল।

“কী করছিস এখানে?”
“কিছু না।”
“এখানে কেন এলি?”
ধ্রুবর গলায় ক্ষোভ,ভীত চোখে তাকায় নিশু; তবে কোনো শব্দ বের হলো না। যেন হঠাৎ সব শক্তি খসে গিয়েছে।
“কী জিজ্ঞেস করলাম তোকে?”
ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে রইল নিশু।
“নাম!”
নিশু বসে রইল।
“নাম বলছি!”
ধ্রুবর চোখগুলো কেমন লাল। আতঙ্কিত হয় নিশু। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষল।
“নিশুর বাচ্চা,নাম তাড়াতাড়ি!”
নিশু আস্তে আস্তে ছাঁদে নামল। ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরতেই চেঁচিয়ে উঠল,”মেরো না!”
“এখানে কেন এলি?”

ধমকে উঠতেই কেঁপে কেঁপে উঠল।
“কেন এলি?”
“হাওয়া খেতে।”
“নিশুর বাচ্চা,পাগল করে ফেলবি আমাকে।”
দু’জনের দিকে তাকাল তাহমিদ। ধ্রুবকে নিশুর কাজিন মনে হলো তার। চেহারায় কিছু মিল চোখে পড়ল। নিচের দিকে পা বাড়িয়ে চলে গেল।
“তোর ওড়না কোথায়?”
আতঙ্কিত হয়ে নিজের দিকে তাকাল।
“নিশুর বাচ্চা,এইসব কী পরে আছিস?”
“স্কার্ট।”

“তোর মাথা! পেটিকোট আর টি-শার্ট পরে পাগলির মতো দাঁড়িয়ে আছিস। আর কখনো যদি তোকে টি-শার্ট পরতে দেখি তাহলে চড়িয়ে তোর গাল লাল করে দিবো। চল!”
নিশুর হাত ধরে টেনে বাসার ভেতরে ঢুকল। ওদের রুমের সামনে এসে বলল,”তোর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। ওয়াশরুমে ঢুকে দ্রুত গোসল কর।”
ওদের রুমের দরজা খুলতেই চমকে উঠল ধ্রুব। চোখে পড়ল বিশৃঙ্খল অবস্থা। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।
“এইসব কী,নিশু?”
নিশু কিছু বলল না,শুধু শ্বাস আঁটকে ভীত চোখে তাকিয়ে রইল। এই না কষিয়ে থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে দেয়!
“এই ঘন্টাখানেক সময়ের মধ্যে এ কী করলি,তুই?”
শ্বাস নিতে ভুলে গেল নিশু। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ধ্রুবর।

“রিনা! রিনা!”
“জ্বী,ভাইজান।”
রিনা ছুটে এলো।
“জ্বী,বলেন।”
“এই অবস্থা কেন ঘরের?”
“আপামনি এমন করছে।”
“তুই জানতি?”
“জ্বী।”
“তো কেন পরিষ্কার করলি না?”
ধমকে উঠতেই কেঁপে উঠল রিনা। ভয়ার্ত গলায় বলল,”খালুজানের খাওনের সময় হইয়া গেছিল,তাই ভাবছিলাম পরে করমু।”

হাত মুষ্টিবদ্ধ করল ধ্রুব।
“কেয়ারলেস মানুষ আমার পছন্দ নয়।”
রিনা কিছু বলতে পারল না,মাথা নুয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
“দশ মিনিটের মধ্যে রুমটা পরিষ্কার কর।”
“জ্বী।”
নিশুর হাত ধরে টান দিলো।
“নিশুর বাচ্চা,কী করলি এইসব?”
নিশু কিছু বলতে পারল না। অপরাধীর মতো মাথা নুয়ে,শ্বাস আঁটকে রইল। তার ভিতরের অস্থিরতা,আর ভয় যেন বাতাসে ঘ্রাণ হয়ে মিলিয়ে গেল। নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল ধ্রুব। একটি বড় হোয়াইট কালারের টাওয়াল বাড়িয়ে ধরল নিশুর দিকে।
“ধর। দ্রুত পনের মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে নিবি।”
নিশু চুপচাপ ওয়াশরুমের দিকে এগোল। ভেতরে ঢুকেই পানি ছিটাতে শুরু করল। বিছানায় বসে দু’হাত পেছনে দিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিলো ধ্রুব। ঘরের নীরবতা,নিশুর অনির্বচনীয় চাপ এবং ধ্রুবর উত্তেজনা- সব মিলিয়ে যেন সময় থেমে গিয়েছিল। ততক্ষণে প্রায় হাতে ধরা পনের মিনিট পেরিয়ে গেলেও নিশু ওয়াশরুম থেকে বেরোল না। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল ধ্রুবর। উঠে ওয়াশরুমের দরজায় নক করল,”নিশু,কী করিস?”
প্রতিত্তোর এলো না।

“নিশু! নিশু!”
এবারও নীরব নিশু। ধ্রুবর মেজাজ চটল।
“নিশুর বাচ্চা,দরজা খোল। নয়তো ভেঙ্গে ফেলব।”
চট করে দরজা খুলে ফাঁক করে উঁকি দিলো নিশু।
“কী?”
“গোসল করেছিস?”
নীরব রইল নিশু।
“তোর চুল শুকনো কেন?”
এবারও কিছু বলল না।
“গোসল করিসনি?”
ভীত চোখে তাকাল। ভেতরে চোখ পড়তেই দেখল বালতি ভরে অনবরত পানি পড়ছে।
“হায় আল্লাহ! কী শুরু করলি! একদিনেই তো পাগল করে ফেলবি আমাকে। তোকে সামলানো তো খুব টাফ। এত বছর নিশ্চয়ই সবার মাথা খেয়েছিস।”
পূর্বের ন্যায় ভীত চোখে তাকিয়ে রইল নিশু। ধ্রুব ওয়াশরুমে ঢুকল,দেখল নিশু গোসল করেনি,শুধু পানি ছিটিয়েছে আর সাবান ফেনা করেছে।

“কী করব তোকে নিয়ে!”
বালতির পানিগুলো ফেলে দিয়ে নতুন করে ভরতে দিলো। এরপর প্লাস্টিকের টুল এগিয়ে দিলো।
“জামাকাপড় খুলে,টাওয়ালটি পেঁচিয়ে বস।”
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ধ্রুব আলমারি খুলল,নিশুর জন্য আনা শ্যাম্পু,কন্ডিশনার,শাওয়ার জেল,একটি ফেসওয়াশ এবং একজোড়া স্যান্ডেল বের করল। ততক্ষণে নিশু জামাকাপড় খুলে বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত টাওয়াল পেঁচিয়ে টুলে বসে রইল। ওয়াশরুমে ঢুকল ধ্রুব।
“স্যান্ডেল পর।”

নিশু স্নিগ্ধভাবে স্যান্ডেল পরল। শ্যাম্পু-কন্ডিশনার,শাওয়াল জেলের বোটলগুলো রেখে টি-শার্ট খুলে নিজের টাউজারের গোঁড়ালি হতে হাঁটু অব্ধি ভাঁজ করে এগিয়ে এলো ধ্রুব। তারপর মগ কেটে পানি ভরে ঝুঁকে নিশুর মাথায় ধীরে ধীরে ঢালল। ভিজে উঠল নিশুর চুল,ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল কাঁধ বেয়ে। শ্যাম্পু মেখে নিলো হাতে তারপর কোমল ভঙ্গিতে লাগাতে লাগল নিশুর চুলে। প্রতিটি আঁচল,প্রতিটি গোছ যত্নে ফেনা হয়ে উঠতে লাগল ধ্রুবর হাতে। ফেনাগুলো যেন সাদা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু। চুলের ভিতরে আঙুল চালিয়ে সে যেন শুধু শ্যাম্পুই মাখাচ্ছিল না,এক অদৃশ্য যত্ন আর মমতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল নিশুর সারা অস্তিত্বে। আবেশে চোখদুটো ধীরে বুজে নিলো নিশু। ধ্রুবর স্পর্শে বুঝতে পারছিল,যেন কোনো অচেনা আবেশ তার সমস্ত দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বাইরের পৃথিবী তখন নিস্তব্ধ শুধু শ্যাম্পুর মিষ্টি গন্ধ,পানির টুপটাপ ধ্বনি আর দু’জনের নিঃশ্বাসের অদৃশ্য সুর মিলেমিশে ভরিয়ে তুলছিল পুরো ওয়াশরুমটিকে। এরপর বডি স্ক্র্যাবারে শাওয়ার জেল ঢেলে হাতের তালুতে ফেনা তুলল। আলতো করে নিশুর হাত-মুখ মেজে দিলো,তারপর গলার কাছে নামাল আঙুল। নিশু চোখ বন্ধ করে শুধু নিঃশ্বাস ফেলল।

“ব্যথা করছে না তো?”
“না.. ব্যথা না,শুধু একটু অচেনা লাগছে।”
এরপর পা দুটো সুন্দরভাবে ঘষে ধুয়ে দিলো। এরপর চুল ধুয়ে কন্ডিশনার মাখিয়ে আবার চুল ধুয়ে দিয়ে ফেসওয়াশ মাখল। সবশেষে মগভর্তি পানি তুলে ঢেলে দিলো নিশুর শরীর জুড়ে। পানি গড়িয়ে পড়তেই যেন সব ধুলো-মলিনতা সরে গিয়ে ভেসে উঠল এক অনাবিল স্বচ্ছতা। গোসল সম্পন্ন করাল। আনাড়ি হাতে যতটুকু পারল ধ্রুব করল। এরপর হাত-পা ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে আরেকটি টাওয়াল এবং বাথরোব বাড়িয়ে দিলো।
“ধর,শরীরের পানি মুছে বাথরোব পরে দু-মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আয়।”
নিশু চুপচাপ তাই করল এবং দ্রুত বেরিয়ে এলো। সেদিকে তাকাল ধ্রুব। চোখ গেল পায়ের দিকে। সদ্য গোসল নেওয়া নিশু যতই এগিয়ে আসছে ততই যেন তার প্রতি কদমে কামিনী ফুল ফুটছে। বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। টাওয়াল হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে নিশুর ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে লাগল।

“এত লম্বা চুল সামলাস কীভাবে?”
নিশু কিছু বলল না। আরাম পেয়ে চোখ বুজে রইল। টাওয়াল রেখে ধ্রুব আলমারি থেকে হেয়ার ড্রায়ার,ময়েশ্চারাইজার এবং ফেস-ক্রিম বের করল।
“আমেরিকা থেকে আসার সময় তোর জন্য এনেছিলাম সব। কিন্তু তুই তো তু-ই! ইগো দেখিয়ে নেসনি। ভাবলাম আর দিবোই না তোকে।”
অল্প অল্প করে ক্রিম তুলে আলতো করে মাখিয়ে দিলো নিশুর স্নিগ্ধ মুখে,এরপর হাত-পায়ে ময়েশ্চারাইজার মেখে দিতে লাগল। ধ্রুবর আঙুলের ছোঁয়ায় নিশুর ত্বক যেন নতুন এক উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল। এরপর হেয়ার ড্রায়ার চালিয়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে দিলো চুলগুলো। বাতাসের সাথে ভেসে উঠল শ্যাম্পু,ফেস-ক্রিম,ময়েশ্চারাইজারের মিষ্টি গন্ধ,মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবেশে ঢেকে দিলো চারপাশ। তারপর আলমারি থেকে এক সেট ল্যাভেন্ডার কালারের টপস আর স্কার্ট বের করল। সফট পিঙ্ক শিফন,ফুলের নকশা সহ,হালকা সিল্কের লাইন,কোমর বাঁধানো ফিটেড ডিজাইন।

“নে এগুলো পর। সব দেওয়া আছে ভিতরে। এগুলো পরে চুপচাপ বসে থাকবি,কোনো আকাম-কুকাম করবি না। বুঝলি?”
নীরবে মাথা নাড়ল নিশু।
“নয়তো চড়িয়ে গাল লাল করে ফেলব!”
মলিন চোখে তাকাল নিশু। ওয়াশরুমে ঢুকে ধ্রুব নিশুর ভেজা জামাকাপড়গুলো ধুয়ে নিজেও গোসল করতে লাগল। তখন ভিজে জবুথবু হয়ে গিয়েছিল। ড্রেস পরে নিশু পুরো রুমে একপলক চোখ বুলিয়ে বিছানায় বসল। ধ্রুবর মোবাইল সেখানে পড়ে আছে। হঠাৎ ফোন ভাইব্রেট করল। নিশু তাকাল। আরও কয়েকবার ভাইব্রেট হলো। ফোন হাতে তুলে পিক করতেই ভেসে এলো নীলির গলা,”ধ্রুব,কেমন আছো?”
“তা জেনে কী করবি তুই?”
“হ্যালো,কে তুমি?”
“জেনে কী কাজ তোর?”
“ওই হ্যালো,ধ্রুবর মোবাইল তোমার কাছে কেন?কে তুমি?”
“তাকে দিয়ে কী করবি?”
“আশ্চর্য,কে তুমি?”
“অস্থির হচ্ছিস কেন?এই ধ্রুব কি তোর বাপ লাগে?”
“কী বললে?”
“তাহলে কল দিস কেন?”
স্তব্ধ হয়ে গেল নীলি।

“লম্পট মেয়ে কোথাকার! লজ্জা করে না ছেলেদের ফোনে ছ্যাঁছড়া,বেহায়ার মতো কল দিতে? আর একবার তোর বাবা ধ্রুবকে কল দিলে তোর চুলগুলোকে ছিঁড়ে শেওড়াগাছের প্রেত্নী বানিয়ে দিবো। মনে রাখিস। কল কাট! তোর চাকর-বাকর নেই যে তুই কল দিবি আরেকজন কাটবে! স্টুপিড মেয়ে! ননসেন্স!”
অপমানিতবোধ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল নীলি। নিশু ফোন রেখে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারি খুলে দেখতে লাগল। প্রতিটি তাকে কত রকমের কসমেটিকস। নিশু ধরে ধরে দেখতে লাগল। একটা পারফিউম দেখতেই হাতে তুলে নিতেই ঠিক তখুনি খট করে দরজা খুলে ওয়াশরুম থেকে বেরোল ধ্রুব। কেঁপে উঠতেই ঠাস করে হাত থেকে পড়ে গেল পারফিউমের বোটলটা। আতঙ্কিত চোখে তাকায় নিশু।
“আবার কী আকাম করলি,নিশুর বাচ্চা?”
ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

“দিলি তো আমার পছন্দের পারফিউমটা ভেঙে!”
শ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইল। ব্যালকনিতে গিয়ে দড়িতে কাপড়গুলো মেলে রুমে ঢুকল ধ্রুব।
“নিশুর বাচ্চা,তোকে একটা আছাড় দিতে মন চাচ্ছে।”
দ্রুত টি-শার্ট আর জিন্স বের করে পরে নিলো। ফোন হাতে তুলতেই দেখল আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। টাচ করতেই লেখা,”মেয়েটা কে ছিল?”
ধ্রুব কিছু বুঝল না। দ্রুত কল লগে গেল। দেখল চার-পাঁচ মিনিট আগে সেই নাম্বার রিসিভ কলে শো করছে।
“কে ফোন করেছিল,নিশু?”
ভীত চোখে তাকাল। ধ্রুব যদি সব জানতে পেরে তাকে আছাড় দেয় তাহলে?
“কীরে?”
“একটা মেয়ে কল দিয়েছিল।”
“কে?”
“জানি না।”
ধ্রুব সরাসরি কল রেকর্ডিং বের করল। অডিওটি শুনতেই থমকে গেল। শ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইল নিশু।

ভোরের ফিকে আলো হাসপাতালের করিডোরে গলে পড়ছিল। কাঁচের দেয়ালে লেগে থাকা শিশিরবিন্দুর মতো সেই আলো আইসিইউ-এর কাঁচের দরজায় প্রতিফলিত হচ্ছিল। ভেতর থেকে হালকা নীলাভ আভা বেরিয়ে এসে করিডোরের নীরবতা ভেঙে দিলো- যেন দীর্ঘ অন্ধকারের পর সূর্যের প্রথম আভাস। রোলার বেডে একেবারে স্থির হয়ে শুয়েছিল অনিক। চোখ আধখোলা,দৃষ্টিতে নিস্তব্ধ ক্লান্তি। বুকে ওঠা-নামা করা নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া শরীরের আর কোনো সাড়া ছিল না। সেই নিঃশ্বাসেই লুকিয়ে ছিল এক অচঞ্চল ছন্দ,যা তাকে ধরে রেখেছিল এতদিনের অবিরাম যন্ত্রণা সত্ত্বেও। ডাক্তার নোটপ্যাড বন্ধ করে শান্ত স্বরে বললেন,”প্রোগ্রেস হ্যাজ ইম্প্রুভড সিগনিফিক্যান্টলি। নাউ হি ক্যান বি ট্রান্সফার্ড টু এসডিইউ।”-(অগ্রগতি অনেক ভালো হয়েছে। এবার তাকে এসডিইউতে স্থানান্তর করা যাবে।)
আদনীন ফেরদৌসের চোখ ভিজে উঠল। মনে হচ্ছিল এক সপ্তাহের অস্থির রাত,অন্তহীন দুশ্চিন্তা,প্রতিটি প্রার্থনা- সব মিলিয়ে যেন হালকা হয়ে গেল এক মুহূর্তে।

“থ্যাঙ্ক ইউ,ডক্টর।”
“ইউ’র ওয়েলকাম।”
অনিকের হাতের ওপর হাত রাখলেন তিনি। আঙুলগুলো শীতল কিন্তু স্পর্শে ছিল উষ্ণ কৃতজ্ঞতার কম্পন।
“বাবা,তুমি আইসিইউ-এর নিস্তব্ধতা ছাড়ছো। এবার খোলা আলোয় যাবে।”
কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না অনিক। স্থির থেকেও নিঃশ্বাস ফেলল। সেই শ্বাসের ভিতরে মিশেছিল দীর্ঘ ক্লান্তি,আবার কোথাও লুকানো প্রত্যাশা। নার্সরা ধীরে ধীরে রোলার বেড ঠেলতে শুরু করল। চাকাগুলোর নরম শব্দ করিডোরে প্রতিধ্বনি তুলল। আইসিইউ-এর ভারি দরজা ঠেলে খোলার সাথে সাথেই আলো হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। স্যাঁতসেঁতে বাতাসের ভিতরে ভেসে এলো জীবনের গন্ধ- দূরে নার্সের মৃদু কথোপকথন,কারও হাঁটার ছন্দ,কোথাও আবার টেলিফোনের টুংটাং। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল নতুন এক জগৎ ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। এসডিইউ-এর কেবিনে পৌঁছাতেই বাতাসে হালকা শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল।

জানালার পর্দা দুলছিল এয়ারকন্ডিশনের নরম হাওয়ায়। সূর্যের আলো বিছানার সাদা চাদরে পড়ে শান্ত ছায়া তৈরি করেছিল। নিস্তব্ধতা এখানে অন্যরকম- ভারী নয় বরং স্নিগ্ধ। মৃত্যুর আচ্ছন্নতা নেই,আছে বিশ্রাম আর পুনর্জীবনের নিঃশ্বাস। আদনীন ফেরদৌস চেয়ারে বসে ছেলের দিকে তাকালেন। উনার চোখে জমে থাকা অশ্রু গলে নেমে এলো গালে কিন্তু ঠোঁটে ফুটল শান্তির আভা।

মায়াকুমারী পর্ব ৫৫

“দেখেছ বাবা,তুমি এসডিইউতে চলে এলে। এখানে আলো আছে,বাতাস আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে- ইনশাআল্লাহ।”
অনিক নড়ল না। কোনো শব্দ নেই,কোনো অঙ্গভঙ্গি নেই। কেবল স্থির দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে রইল। তবুও সেই স্থিরতার গভীরে যেন জমাট বাঁধছিল এক অচেনা দৃঢ়তা। নরম আলো,নিস্তব্ধ বাতাস,শান্ত কক্ষ সব মিলিয়ে তাকে ঘিরে ধরল এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি- জীবন ফিরছে,ধীরে ধীরে,নিঃশব্দে।

মায়াকুমারী পর্ব ৫৭