মায়াকুমারী পর্ব ৫৭

মায়াকুমারী পর্ব ৫৭
মেহেরিন আনজারা

“তোর তো দেখি অনেক সাহস,নিশু!”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকিয়ে রইল সে।
“আমাকে নীলির বাপ বানিয়ে ছাড়লি!”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে পৃথিবীর সব নারী তোমার জন্য হারাম! নিষিদ্ধ!”
চমকে তাকায় ধ্রুব। চোখ বড় হয়ে গেল।
“কী বললি!”
“আমি আর তোমার বোন ছাড়া পৃথিবীর সব মেয়ে তোমার মা,খালা,কাকী,জেঠি,মামী,তোমার বোন,মেয়ে।”
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ধ্রুব। এত দেখছে জাতে মাতাল তালে ঠিক।

“ভালোবাসিস আমাকে?”
মাথা নাড়ায় নিশু।
“অন্য মেয়েকে জেলাশ করিস?”
ফের মাথা নাড়ায়। তীক্ষ্ণ ও কল্পনাপ্রসূত ধ্রুব প্রথমে চুপ করে রইল; যান্ত্রিক কোনো হাসি ধীরে ধীরে বিকশিত হলো তার ঠোঁটে।
“তুই নিশ্চয়ই জানিস,এমন বিবৃতি দেওয়ার আগে একটা বিশেষ পারমিট লাগে।”
কপাল কুঁচকে তাকাল নিশু।
“পারমিট! কী পারমিট?”
ধ্রুব ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গি করল।
“লাইফ-লাইসেন্স। ছাড়া কারও প্রেমে একচেটিয়া অধিকার দাবি করা যায় না।”
“আর ওই লাইসেন্সটা কার হাতে থাকে?”
“আমার হাতে। তবে এটা পেতে হলে,প্রতিদিন অন্তত একবার একটা শর্ত মানতে হবে।”
“কী শর্ত?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিশু আগ্রহে এগিয়ে এলো। ধ্রুব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল,”প্রতিদিন অন্তত একবার আমাকে অকারণে চুমু দিতে হবে।”
নিশুর গাল লাল হয়ে গেল কিন্তু চোখ নামাল না। ধ্রুব গভীর চোখে চোখ রেখে বলল,”তা হলে পারমিট পাস করার জন্য আজকেই শুরু করা উচিত,তাই না?”
নিশু নিরুত্তর। একটানা তার দিকে তাকিয়ে রইল ধ্রুব।
“শুরু করবি?”
নিশু কিছু বলল না। ফোন রেখে নিশুর দিকে হাত বাড়াল।
“আয়,এখন তোর চুলগুলো আঁচড়ে দিই। পরেরটা পরে দেখা যাবে।”
নিশু কিছু বলল না,মাথা এগিয়ে দিলো। ধ্রুব চিরুনি ধরে,ধীরে ধীরে টেনে দিলো ঘন কালো লম্বা চুলের জট। প্রতিটি টানেই চুল আরও জট পাকাচ্ছিল কিন্তু বিরক্ত হলো না।

“আরে! এত লম্বা চুল কীভাবে আঁচড়াস! একেবারে মহাভারতের কাহিনী হয়ে যাচ্ছে!”
নীরব রইল নিশু। ধ্রুব হাতে অ্যালোভেরা জেল লাগিয়ে ধৈর্য ধরে জটগুলো খুলতে লাগল। কপালে ঘাম জমছিল তবু থামল না। অবশেষে চুলগুলো পুরোপুরি মসৃণ হলো,ধ্রুব চিরুনি দিয়ে আলতো করে আছড়ে নামাল। তারপর আনাড়ি হাতে বেণী করতে শুরু করল। শুরুতে বিপত্তি- দুই হাত জটিল হয়ে যাচ্ছিল,ফাঁস ঠিক মতো বাঁধা যাচ্ছিল না। শেষে হাল ছেড়ে ইউটিউব দেখে নিলো। মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখে ধীরে ধীরে আবার চেষ্টা করল। আঙ্গুল অভ্যস্ত নয়,তবু যত্ন এত নিখুঁত যে,শেষ পর্যন্ত একটি পাকা,মোটা পাটের রশির মতো বেণী তৈরি হলো। নিশু আয়নায় তাকিয়ে রইল। বেণী কোমরের নিচে নামছে। ধ্রুব হাত ঝেড়ে আয়নার দিকে তাকাল।

“ওমা.. কত বড় বেণী!”
মনে হলো,এত দীর্ঘ বেণী সে প্রথম দেখল।
“কেমন হলো,বল তো?”
নিশু কিছু বলল না। শুধু নীরবে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। বুকের ভিতর উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল,যেন চুলের প্রতিটি গোছা দিয়ে ধ্রুব তার হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে ধ্রুব হঠাৎ বেণীতে হালকা টান দিলো।
“এই যে,এখন থেকে তোর এই পাকা মোটা রশিটা দিয়েই তোকে বেঁধে রাখব। পালানোর কোনো সুযোগ নেই!”
“আমি পালাতেই বা চাই কোথায়?”
“আগে তো শুধু পালাতি। আমাকে দেখলেই পালিয়ে বেড়াতি। দশ-এগারো বছর পর সামনে এলি।”
“তুমিই তো দেখতে চাওনি।”

“বিয়ের সময় তুই যে হাড়জিরজিরে হাড্ডিসার ছিলি,তোর কথা মনে উঠলেই মেজাজ খারাপ হতো। ভেবেছিলাম একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করব,তার আগেই তুই হাজির।”
“তো যাও না,এখন প্রেম করো গিয়ে!”
“কীভাবে! তুই তো বাপ বানিয়ে দিয়েছিস।”
“নয় তো প্রেম করতে?”
“হ্যাঁ।”
ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে হঠাৎ মেঘ গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো। ঘর হালকা অন্ধকারে ডুবে গেল,শুধু জানালার বাইরে টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিশুর মুখের দিকে তাকাল ধ্রুব। অন্ধকারে তার গালের রাগি আভা আর চোখের দীপ্তি যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এক মুহূর্তে ধ্রুবর মনে হলো,এই মেয়েটার চুলে বেণী বাঁধা নয় যেন সে নিজেকেই বাঁধনহারা করে দিয়েছে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আরও জোরে নামতে লাগল।
“বাইরে ঝড় উঠেছে মনে হচ্ছে।”

ধ্রুব ধীরে ধীরে তার কাছে ঝুঁকে এলো। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি রেখে বলল,”ভিতরেও তো ঝড় উঠেছে,নিশু।”
বৃষ্টি যেন ঝমঝম করে নেমে এলো। জানালার কপাট দুলে উঠল,ভেতরে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে নিশুর লম্বা বেণীটা দুলাতে লাগল। আর কিছু চুল চোখে-মুখে এসে আঁচড়ে পড়তেই ধ্রুব এক ঝটকায় হাত বাড়িয়ে সেইগুলো সরিয়ে দিলো। তার আঙুল ছুঁয়ে যেতেই নিশুর গায়ে কাঁটা দিলো। ঘর অন্ধকার,শুধু আকাশের বিদ্যুতের ঝলকানি মাঝে মাঝে দু’জনের মুখে আলো ফেলে যাচ্ছে। ধ্রুব আস্তে নিশুর হাতটা ধরল। প্রথমে নিশু চমকে উঠল কিন্তু ছাড়াল না। ধ্রুব মৃদু গলায় বলল,”তুই বুঝিস,আমি যদি তোকে ছেড়ে দিই,বাইরের ঝড় যেমন সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়,তেমনই তুইও একদিন হারিয়ে যাবি।”

“আর যদি না ছাড়ো?”
ধ্রুব আরও কাছে ঝুঁকে গেল,নিশুর হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরল।
“তাহলে এই ঝড় আমাদের কিছুই করতে পারবে না।”
হঠাৎ এক ঝাপটা হাওয়া এসে জানালার পর্দা উড়িয়ে দিলো। নিশু ধ্রুবর আরও কাছে এসে দাঁড়াল। দু’জনের নিঃশ্বাস মিশে গেল,বৃষ্টির শব্দের ভিতর তাদের নীরবতা গুনগুন করে উঠল- যেন ঘরজুড়ে শুধু একটি অদৃশ্য প্রতিজ্ঞা ভেসে বেড়াচ্ছে। ধ্রুবর হাতের মুঠোয় নিশুর ফর্সা লতানো আঙ্গুলগুলো কাঁপছিল। বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে নামছে,বজ্রের গর্জন ঘর কাঁপিয়ে দিচ্ছে অথচ ভেতরে নিস্তব্ধতা আরও ঘন হয়ে উঠল। ধ্রুব ধীরে ধীরে ঝুঁকে এলো নিশুর চোখের দিকে গভীরভাবে তাকাল। সেই চোখে ভয় নেই,কেবল এক অদ্ভুত নীরব সম্মতি। নিশুর বুক ওঠা-নামা করছে দ্রুত ছন্দে,তার শ্বাস ধ্রুবর ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রায়।

এক ঝলক বিদ্যুৎ ঘর আলোকিত করে দিলো। সেই আলোয় ধ্রুব এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল। মনে হলো সময় থেমে গিয়েছে। তারপর নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে আরও একটু এগিয়ে এলো। নিশু চোখ বুজল এবং ঠিক তখনই তাদের ঠোঁট মিশে গেল বৃষ্টির গর্জনের ভিতরে। মুহূর্তটা যেন দীর্ঘ,অবিরাম। বাইরের ঝড় জানালায় আছড়ে পড়ছে,ভেতরে অন্যরকম এক ঝড় জন্ম নিচ্ছে যা বাঁধন ভাঙছে অথচ তাদের একে অপরের ভিতরেই বেঁধে ফেলছে। চুম্বন ভাঙার পর নিশু ধীরে ধীরে চোখ খুলল। জানালার বাইরে ঝড় এখনও বয়ে যাচ্ছে কিন্তু ঘরের ভেতরে নীরবতা যেন গাঢ় কোনো প্রতিজ্ঞার মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিশু ফিসফিস করে বলল,”ইউটিউব দেখে শুধু বেণী করতেই শিখলে নাকি?”

“না,চুমু দেওয়াটাও ইউটিউবেই শিখে নিয়েছি।”
লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেল নিশুর।
“এখনও কি মনে হয়,আমি পালাতে পারব?”
ধ্রুব তার কপালে আলতো চুমু দিয়ে ফিসফিস করল,”না,তুই এখন আমার ঝড়ের ভিতর বাঁধা। চিরদিনের জন্য।”
ধ্রুবর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল নিশু। বৃষ্টির ছন্দ তাদের নীরবতাকে ঢেকে দিলো কিন্তু ভিতরের ঝড় থামল না,সে চিরদিনের জন্য তাদের ভিতরেই বন্দি হয়ে রইল। নিশুকে বুকে নিয়ে চোখ বুজে রইল ধ্রুব। নিশুর স্পর্শে ধ্রুব যেন এক মুহূর্তের জন্য পুরো দুনিয়াকে ভুলে গেল। হাসপাতালের নীরব শোরগোল,বাবা-মা,ভাই-বোনের চিন্তা,সব দায়িত্ব- সব অদৃশ্য। কেবল নিশু,তার শীতল হাত,নরম স্পর্শ এবং নীরব উপস্থিতি- যা ধ্রুবর অন্তরকে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভাসিয়ে দিলো।

ক্ষণিকের জন্য হলেও সমস্ত কষ্ট,দুশ্চিন্তা,ভয়- সব মিলিয়ে গিয়েছে। বিপদের এই সময়ে আল্লাহ যেন মনে করিয়ে দিলেন,স্ত্রীর সংস্পর্শই আত্মার শান্তি,হৃদয়ের বিশ্রাম। ধ্রুব বুঝতে পারল,স্ত্রী শুধু সঙ্গী নয়; সে বিপদের ছায়ায় আশ্রয়,বেদনার মাঝে শান্তি এবং জীবনের অন্ধকারে আলো। আল্লাহ সত্যিই উচ্চতম জকাত দিয়ে স্ত্রীর সৃষ্টি করেছেন। যে এক স্পর্শে মানুষকে সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তি দেয়,হৃদয়কে প্রশান্তি দান করে এবং ক্ষণিকের জন্য হলেও দুনিয়ার বোঝা হ্রাস করে। নিশুর মধ্যে ধ্রুব খুঁজে পেল তার সব সুখ,শান্তি,প্রশান্তি। তাই বোঝা যায়,আল্লাহ কেন স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী,আত্মার ছায়া,পোশাকের মতো সান্ত্বনার আচ্ছাদন বলেছেন। নিশু এখনও ওইভাবেই ধ্রুবর বুকে মুখ লুকিয়ে রইল,বাইরে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু তাদের মুহূর্তের শান্তি কোনো ঝড়ে ক্ষুণ্ণ হতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ পর ধ্রুব হঠাৎই নিশুকে আলতো করে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

কোনো কথা না বলে আলমারির দরজা খুলল। ভেতরে ঝুলে থাকা পোশাকগুলোর মধ্যে থেকে খুঁজে নিলো ড্রেসের সঙ্গে মানানসই একটি নরম হিজাব। ফিরে এসে নিশুর সামনে দাঁড়াল। অদ্ভুত মমতায় হিজাবটা তার মাথায় পরিয়ে দিলো। আঙুলে একে একে ভাঁজগুলো গুছিয়ে দিলো,যেন কাপড় নয় তার হৃদয়েরই নিখুঁত রূপ এঁকে দিচ্ছে। নিশু আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠল; মনে হলো,ঝড়ের অন্ধকারে হিজাবের প্রতিটি ভাঁজে ধ্রুবর ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। ধ্রুব ড্রেসিং টেবিল থেকে পারফিউমের বোতল তুলে বাতাসে হালকা ছিটিয়ে দিলো। সেই সুবাস নিশুর চুল আর হিজাব ভরিয়ে দিলো। ঝড়ের গন্ধের ভিতরেও যেন লুকিয়ে রইল কোমলতার একটি আবরণ। এরপর নিজের কেডস তুলে পরে নিয়ে শরীরে বডি স্প্রে করে হাত বাড়িয়ে নিশুর আঙ্গুলগুলো নিজের মুঠোয় টেনে নিলো

“চল।”
নিশু আর কোনো প্রশ্ন করল না। কেবল তার হাতের উষ্ণ মুঠোয় হাত রেখে এগিয়ে গেল ধ্রুবর সঙ্গে। করিডর অতিক্রম করে আসাদ সাহেবের রুমে ঢুকল দু’জন। তিনি তখন বিছানায় হেলান দিয়ে ছিলেন। ওদের উপস্থিতি টের পেতেই চোখ তুলে সোজা তাকালেন,গলায় বজ্রের মতো গর্জন,”এতক্ষণে আসার সময় হলো তোমাদের?”
“চেঁচাচ্ছেন কেন?”
“দিলরুবা কই?”
“কেন?”
“আমার ঔষধের টাইম হয়ে গিয়েছে সেই কখন।”
“কারো আশায় না থেকে নিজেও নিয়ে খেতে পারেন। পরনির্ভরশীল না হয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন।”
“কী বললে?”
“আমার মাকে আপনার ঔষধের জন্য রাখা হয়েছে নাকি?”
“ত্যাঁড়া কথা কম বলো!”

মেডিসিনের বক্স বের করে এগিয়ে এসে উনার প্রেসার এবং ডায়াবেটিস মেপে দেখল। হাতের মেশিন বীপ দিতে দিতে সংখ্যা দেখাল।
“প্রেসার বেড়ে গিয়েছে। টেনশনের কী আছে এখানে!”
মুখ ঘুরিয়ে নিলেন আসাদ সাহেব। যেন অভিমানী বৃদ্ধ,কথার আড়ালে লুকিয়ে রাখেন নিজের দুর্বলতা। ধ্রুব মেডিসিন বক্স টেনে নিলো,ঔষধ বের করে গ্লাসে পানি ঢেলে উনার হাতে ধরিয়ে দিল।
“নিন,ঝটপট খেয়ে ফেলুন।”
“দিলরুবা কই?”
“জিকির থামিয়ে তাড়াতাড়ি খান।”
“কথা একটা বলতে তোমার মুখে কী সমস্যা?”
গজগজ করতে করতে ঔষধ খেয়ে নিলেন তিনি। নিশু চুপচাপ পাশে বসে তাকিয়ে রইল। নিশুর দিকে তাকালেন তিনি।

“ওর আবার কী হয়েছে?”
প্রতিত্তোর করল না ধ্রুব।
“মেজটারে বলছি ওরে ডাক্তার দেখাতে। সবগুলা ছেলে ঘাড়ত্যাঁড়া,একটা কথাও শোনে না। এই তো সেদিন দেখলাম আজেবাজে কথা বলছে মেয়েটা। স্বামীকে ভাই ডেকেছে।”
এমন কথা বললেও চোখে একধরনের অস্থিরতা ছিল,যেন নিশুর জন্য ভেতরে ভেতরে ভীষণ চিন্তিত তিনি। ঠিক তখনই রিনা নাস্তা নিয়ে এলো।

“শক্ত খাবার খেতে পারবে না,আব্বা।”
“তয় কী খাইবো,খালুজান?”
“চিকেন আর বেবিকর্ন আছে?”
“জ্বী,ভাইজান।”
“সব ফ্রিজ থেকে বের করে রাখ।”
“আইচ্ছা।”
ধ্রুব উঠে কিচেনে গেল। হাতের কাজ যেন অভ্যস্ত,দ্রুত কর্ন স্যুপ বানিয়ে ফেলল। ফোটানো বাটিতে ধোঁয়া উঠছে,সুবাসে ঘর ভরে গেল। ট্রেতে করে এনে বসল উনার পাশে। এক চামচ তুলে ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করল,তারপর উনার সামনে ধরল,”হাঁ করুন।”
আসাদ সাহেব মুখ গোমড়া করে চুপ রইলেন।

“সময় নেই,তাড়াতাড়ি করুন। বেরুতে হবে আমার।”
তবুও নিলেন না তিনি। জোর করে মুখে চামচ ঢুকিয়ে দিলো ধ্রুব।
“সিনক্রিয়েট করা ছাড়া আপনি শান্তিতে থাকতে পারেন না নাকি?এটা কি আপনার অভ্যাস,নাকি বংশগত দোষ?”
“খবরদার,আমার বংশ নিয়ে কথা বলবে না!”
“যেই না পঁচা বংশ!”
তাচ্ছিল্যতা ধ্রুবর চোখ-মুখজুড়ে।
“তোমার গায়েও তো সেই রক্ত বইছে।”

নীরব রইল ধ্রুব। চোয়াল শক্ত। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আসাদ সাহেব ছেলের দিকে চোখ রাখলেন। ধ্রুবর পারফিউমের হালকা ঘ্রাণ ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অদ্ভুত এক আকর্ষণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আঁড়চোখে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করলেন। আর্মিদের মতো লম্বা,গড়নগাড়ন ঝকঝকে,সুগঠিত শরীর। গায়ের রঙ চাপা হলেও,চোখে পড়ার মতো সুদর্শন। খরশান চোয়ালদ্বয়,টানটান চোয়াল- যার একমাত্র দৃষ্টিই একজন যুবকের দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করছে। বুক টানটান,কাঁধ চওড়া,পিঠ সরু এবং কোমর থেকে পায়ের লাইন- সব মিলিয়ে জিম করা বডি,যেন প্রতিটি পেশি নিজের গল্প বলে। হাত-পা লম্বা,ফার্ম ও শক্ত। টি-শার্টের মতো সহজ পোশাকও ধ্রুবর গায়ের রঙ ও গঠনকে অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তোলে।

চাপা রঙের গায়ের সঙ্গে হালকা ধূসর বা নেভি ব্লু,কখনও কখনও মিল্কি হোয়াইট- সবই যেন ধ্রুবর শরীরের লাইনগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। জিন্সের সঙ্গে সেই টি-শার্টের মিলনে,কেডসের ধীর হাঁটা সব মিলিয়ে এক ধরনের বলিউডের হিরোকে মনে করিয়ে দেয়। আসাদ সাহেব বুঝেন,এই ছেলে শুধু ছেলে নয়,এক প্রজন্মের সব সম্ভাবনা আর সৌন্দর্যের এক অনন্য মিশ্রণ। চোখে দৃষ্টিতে না হলেও,ভিতরে ভিতরে মনে হলো,যদি এই ছেলে কোনও কাজে মন দেয়,পুরো দুনিয়া তার পেছনে থাকবেই। এর ভিতরেই সবটুকু স্যুপ খাইয়ে দিলো ধ্রুব। আসাদ সাহেব বুঝতেও পারলেন না ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে। তারপর বাকি ঔষধগুলোও খাইয়ে দিলো।

“সকাল থেকে দিলরুবাকে দেখি না,ও কই গেল?ফোনটা ওকে দিও।”
ফোন হাতে তুলে নিলো ধ্রুব।
“রেস্ট করুন। আউল-ফাউল টেনশন করার দরকার নেই।”
“কয়বার জিজ্ঞেস করলাম দিলরুবা কোথায়?”
“কী প্রয়োজন আমার মাকে?”
“তোমার মা! তোমরা এলে কোথ থেকে,আকাশ থেকে?”
“আপনার ফাউল কথা শোনার টাইম নেই।”
উনার চোখে ক্ষণিকের ক্ষোভ জ্বলে উঠল।
“শোনো,তুমি নিশুর সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি কম করবে।”
“করলে কী হয়েছে?”

“অনেক তো কাহিনী করেছ। এই বিয়ে মানি না,ডিভোর্স দিবো,ওই-সেই,নানান কিছু,নানান নাটক। তাই বলছি,তোমার না বান্ধবী একটা আছে,ওই যে সেদিন এসেছিল বাসায়। তুমি বরং তাকে বিয়ে করো। নিশুকে ডিভোর্স দাও। আমি ওর বিয়ে ঠিক করে রেখেছি। ধূসর ওকে ভালো বুঝতে পারে। ওর অসুস্থতার সময়ও তো ও-ই দৌড়াদৌড়ি করে। আমার মনে হয়,ধূসরই সামলাতে পারবে নিশুকে। তুমি বরং তোমার বান্ধবী কিংবা মন্ত্রীর মেয়েটাকে বিয়ে করো ধূসরের থেকে ডিভোর্স নিয়ে। সেই মেয়ের জন্য আমাদেরকে না বলে তুমি আমেরিকায়ও চলে গিয়েছ।”
আকস্মিক ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে শক্ত করে নিশুর হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। লম্বা লম্বা কদম ফেলে হাটতে লাগল। তার সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছিল নিশু। গজগজ করতে লাগলেন আসাদ সাহেব,”মুড দেখায়! আমারে মুড দেখায় ছেলে! সত্য কথা বলেছি বলে এখন জ্বলছে!”

ধ্রুবর চোখ-মুখ শক্ত,চোয়ালটা টনটন করছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে টেনে নিচ্ছিল নিশুকে,যেন এক মুহূর্তও আর সেই বাসায় থাকার মানসিকতা নেই তার। করিডোরে পায়ের শব্দ গম্ভীর প্রতিধ্বনি তুলল। বৃষ্টির শব্দ জানালা ভরিয়ে রেখেছে,বাইরে আকাশে যেন অশান্তি জমে আছে। নিশু ভয়ে ভয়ে তার হাত আঁকড়ে ধরেছিল। ধ্রুব কিছু বলছে না,শুধু হাঁটছে,ভিতরে জমে থাকা আগ্নেয়গিরি নীরবতা ভেঙে দিতে চাইছে,তবু সে চেপে রাখছে। হঠাৎ নিশু কাঁপা গলায় বলল,”তুমি রাগ করেছ?”
ধ্রুব কোনো জবাব দিলো না। নীরবতা যেন আরও ভারী হয়ে ঝুলে রইল তার চারপাশে। বৃষ্টি থেমেছে,তবুও টুপটাপ ফোঁটা পড়ে চলেছে গাছের পাতা থেকে,যা মুহূর্তটিকে আরও বিষণ্ন আর চাপা করে তুলছে। বাসা থেকে বেরিয়ে ধ্রুব গাড়ির দরজা খুলতেই নিশু হাত তুলে থামিয়ে বলল,”আমি বাইকে যাব।”
নিশুর দিকে তাকাল ধ্রব।

“আমার কোনো বাইক নেই।”
“ওটায় যাব।”
“ওটা আমার নয়।”
“কিছু হবে না,চলো যাই।”
ধ্রুবর বাহু আঁকড়ে ধরল নিশু। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। তপ্ত শ্বাস ফেলল।
“তোর বাইক পছন্দ,নিশু?”
“হুম।”
“ঠিক আছে.. খুব শিগগিরই তোর জন্য একটা বাইক কিনব।”
“কবে কিনবে?”
আগ্রহী হয় নিশু।
“খুব শীঘ্রই। এখন চল।”
হঠাৎ পেছন থেকে এগিয়ে এসে ধীরাজ বলল,”বাইকে নিয়ে যাও,সমস্যা কোথায়?”
“না।”

নিশু জেদ ধরল,”বাইকে না নিলে আমি যাব না।”
হাতঘড়ির দিকে তাকায় ধ্রুব।
“জেদ করিস না,নিশু।”
“তো তুমি যাও।”
“বাসায় থেকে উল্টাপাল্টা কাণ্ড ঘটাবি তাই না?”
ধীরাজ বলল,”যেতে চাইছে যখন নিয়ে যাও।”
নিশুও জেদ ধরে রয়েছে।
“চাবি দে।”
ধীরাজ দ্রুত ফিরে বাসা থেকে চাবি আর হেলমেট নিয়ে এসে ধ্রুবর হাতে চাবি দিলো। চাবি নিয়ে গ্যারেজ থেকে বাইক বের করল। ধীরাজ হেলমেট এগিয়ে দিলো। নিশুর মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিলো ধ্রুব। এরপর নিজেও হেলমেট পরে নিলো। ভিতরে অস্বস্তি হচ্ছিল,তবুও নিশুর জন্য কম্প্রোমাইজ করল। বাইকের উপর বসল। একটি শপিং ব্যাগও দিলো ধীরাজ।

“নাও। এগুলো নিশু আপুর ওষুধ। সময়মতো খাইয়ে দিও।”
“আব্বার দিকে খেয়াল রাখিস আর উনার কাছেই থাকবি। টেনশন করতে নিষেধ করবি। হাসপাতালের কথা উনাকে বলার দরকার নেই,বুঝেছিস?”
“হুম।”
“দুপুরের দিকে আম্মাকে পাঠিয়ে দিবো। দু’জনের খেয়াল রাখবি। আর ফোন খোলা রাখিস। আপাতত কাউকে বাসায় ঢুকতে দিস না। ইফতেখার মির্জা তার লোকজন দিয়ে ক্ষতি করতে পারে। অপরিচিত কাউকে ভেতরে ঢোকানোর প্রয়োজন নেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসা অব্ধি। তাই সাবধান।”
মাথা নাড়ল ধীরাজ।
“শোন! আমি ডেলিভারি ম্যান দিয়ে লাঞ্চ আর ডিনার পাঠিয়ে দিবো। সিকিউরিটি আংকেল পৌঁছে দিবে। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”
“নিশুর বাচ্চা!”
“হুঁ!”
“আয়।”
নিশু এগিয়ে গেল।
“বসতে পারবি?”
“হুম।”
“উঠ।”
নিশু ধীরে বসল।
“সাবধানে বস। দেখিস.. আবার না রাস্তায় থেকে যাস। তোর বিশ্বাস নেই.. আজ যা করেছিস না!”
নিশু চুপচাপ ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখল।
“ঠিকমত বস। তুই তো রাস্তায় থেকে যাবি!”

নিশু আরেকটু চেপে বসল এবং শক্ত করে কাঁধ ধরল। বাইক স্টার্ট দিয়ে স্পিড বাড়াতেই ভড়কে উঠে দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল ধ্রুবকে। সকালটা তখনও ভেজা ভেজা। বনানীর রাস্তা জুড়ে সদ্য বৃষ্টিতে ধোয়া গাছগাছালির সতেজ সবুজ পাতা চকচক করছে। বৃষ্টি থেমেছে একটু আগে,রোদ ওঠেনি পুরোপুরি,তবে হালকা আলো গাছের ফাঁক দিয়ে পড়ে রাস্তাটাকে সোনালি ঝিলিক দিচ্ছে। ভেজা বাতাসে কাদামাটির গন্ধ মিশে আছে,দূরে কাক আর শালিকের ডাক ভেসে আসছে। চকচকে কালো রাস্তা জলে প্রতিফলিত হচ্ছে,কোথাও কোথাও ছোট ছোট পুকুরচিহ্ন তৈরি হয়েছে। বাইকের চাকার ঘূর্ণনে ছিটকে পড়ছে পানি। আরেকটু গতি বাড়তেই নিশু আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ধ্রুবকে। বনানীর শান্ত সবুজকে পেছনে ফেলে ধ্রুব বাইক ছুটিয়ে দিলো এ্যাপোলোর দিকে। সকালবেলার ভেজা শহরটা যেন তাদের দৌঁড়ের সাক্ষী হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।

দিলরুবা খাতুনের পাশে নিশ্চুপ বসে আছে দ্যুতি আর বুশরা। তাদের নিঃশব্দ উপস্থিতিই যেন রুমটিকে আরও গভীর নীরবতায় ঢেকে রেখেছে। এক কোণে তরুণ ডাক্তার শুভ্র ফাইল উল্টেপাল্টে দেখছে,চোখে আছে কাজের ফোকাস কিন্তু মন বারবার ছুটে যাচ্ছে দ্যুতির দিকে। তাকাতে না চাইলেও চোখ নিজেই চলে যাচ্ছে সেদিকে। ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আঁড়চোখে একবার তাকাতেই বুকের ভিতর অদ্ভুত এক আলোড়ন জেগে উঠতেই দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলল। তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলের উপর রাখল। লম্বা,হালকা পাতলা,সুগঠিত শরীর- চুপচাপ বসে থাকা অবস্থায়ও যেন কোনো একটা আলাদা আকর্ষণ ছড়াচ্ছে। কান্নায় ভেজা মুখ,লালচে চোখ,তবু নির্মল,তবু মিষ্টি। কান্না করলে মেয়েদের এত সুন্দর লাগে তা আগে কখনও লক্ষ্য করেনি সে। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে নিশুর হাত ধরে ভেতরে ঢুকল ধ্রুব। সঙ্গে সঙ্গে রুমে এক চাপা উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। ধ্রুবের চোখ ছুটে গেল মায়ের দিকে। দিলরুবা খাতুনের চোখ লালচে,মুখে অসহায়তার ছাপ। নিঃশব্দে বসে আছেন,বুকের ভিতর জমে থাকা বেদনা ধীরে ধীরে অশ্রুজলে ভেসে উঠছে। ধ্রুব কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। মুহূর্তের জন্য দম বন্ধ হয়ে এলো।

“আম্মা,সকাল থেকে কিছু খাওনি। চলো,কিছু খাবে।”
দিলরুবা খাতুন মাথা নাড়লেন। নিস্তেজ কণ্ঠে বললেন,”খিদে নেই।”
ধ্রুব আলতো করে উনার হাত ধরল। চোখে কোনো রাগ নেই,শুধু নিঃশব্দ দায়িত্ব আর মমতার ছাপ। মায়ের হাত টেনে তুলল,তারপর চোখের ইশারায় বাকিদের ফলো করতে বলল। ওরা সবাই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো। রাস্তার ওপারে ক্যাফে সোশ্যাল এ্যাপোলোতে ঢুকল সবাই। ভেতরে হালকা মিউজিক ভেসে আসছে,চারদিকে কফির মৃদু গন্ধ আর ভেজা সকালের আবহ ছড়িয়ে আছে। ধ্রুব সবাইকে বসতে ইশারা করল। ওয়েটার এগিয়ে আসতেই ধ্রুব নিজেই খাবার অর্ডার করল। দিলরুবা খাতুনের চোখ আবার ভিজে উঠল। নীরব কান্না থামছিল না। কিছুক্ষণ পর খাবার এসে টেবিল ভরে গেল। ধ্রুব মায়ের সামনে প্লেট এগিয়ে দিয়ে আলতো কণ্ঠে বলল,”আম্মা,খাও।”
নির্বিকার রইলেন তিনি। ধ্রুব ধীরে ধীরে চামচ তুলে উনাকে খাইয়ে দিতে লাগল। প্রতিটা চামচের সঙ্গে যেন নিজের হৃদয়ের সান্ত্বনা মিশিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু চোখের জলে ভিজে যাওয়া গাল দেখে বোঝাই যাচ্ছিল মায়ের গলাধঃকরণ কঠিন হয়ে উঠেছে।

“তোরা বসে আছিস কেন,খাওয়া শুরু কর।”
ইতস্তত করে ধীরে ধীরে মুখে খাবার তুলল ওরা ঝামেলা করল না। সময়টায় যে এখন অন্যরকম। ওরা তিনজন চুপচাপ খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই,শুধু চারপাশে চাপা আবেগ আর নীরবতার ওজন। ধ্রুব সবার দিকে নজর রাখছিল।

কেবিনে প্রবেশের পর অনিক অনেকক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইল। যেন এক দীর্ঘ নিদ্রার ভিতরে সে এখনও ডুবে আছে। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো ভেতরে এসে পড়ছিল। আমেরিকায় বসন্তকাল শেষ হয়ে আর্লি সামার শুরু হয়েছে কিছুদিন থেকে। বাংলাদেশে যখন কোকিলের গান আর কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে চারদিক ভরে ওঠে,এখানে তখন গাছে গাছে নরম সবুজ পাতা,মাঠে ছড়িয়ে থাকা বুনো ডেইজি আর টিউলিপের সমাহার। শীতের তুষার গলে গিয়ে নদীগুলো আবার স্রোতস্বিনী হয়েছে। হাওয়ায় আছে নরম উষ্ণতার গন্ধ,পাখিরা নতুন কণ্ঠে গান গাইছে- চঞ্চল রোবিন,কার্ডিনাল আর ব্লু-জের ডাকে চারপাশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অনিক যেন সবই টের পাচ্ছিল চোখ বুজে শুয়েও। হঠাৎ ঠোঁট কেঁপে উঠল,”আম্মা!”
চমকে তাকালেন আদনীন ফেরদৌস। বুক ধক করে উঠল।

“কী বাবা?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলল,”দ্যুতি আসে নাই?”
স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। ভাবতেও পারেননি কোমা থেকে ফেরার এক সপ্তাহ পর অনিকের প্রথম প্রশ্ন হবে দ্যুতিকে নিয়ে। গলা শুকিয়ে এলো,আমতাআমতা করলেন,”আ.. আসলেই..”
মায়ের চোখের দিকে তাকাল অনিক। দুর্বল অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
“আসে নাই তাই না?”
দোটানায় পড়লেন তিনি। যদি বলেন আসেনি অনিক হয়তো মানসিক ধাক্কায় আবারও অচেতন হয়ে যেতে পারে।
“হ্যাঁ,এসেছিল।”
“কখন?”
“আসলেই.. আমরা এখন দেশের বাইরে।”

“ওহ.. তার মানে আসে নাই!”
“এসেছিল।”
“মিথ্যা বলো না,আম্মা।”
“সত্যি বলছি।”
“তোমার চোখ বলছে তুমি মিথ্যা বলছো।”
“আরেহ.. সত্যি বলছি,এসেছিল।”
অনিক চোখ বন্ধ করে নীরব হয়ে গেল তারপর আবারও চট করে চোখ মেলে উনার চোখে চোখ রাখল।
“কেউ মিথ্যা বললে আমি বুঝতে পারি,আম্মা।”
ধক করে কেঁপে উঠল উনার বুকের ভিতর। হাত বুলিয়ে দিলেন অনিকের কপালে।

“ভুল বুঝছো কেন,বাবা। শোনো.. আমরা আমেরিকায় আছি। আর দ্যুতি কীভাবে আসবে এখানে? বললেই আমেরিকায় আসা সহজ নাকি! এখানে আসতে হলে ভিসার জন্য এপ্লাই করতে হয়,প্রসেসিং টাইম মাসের পর মাস চলে। আমেরিকান সিটিজেনশিপ বা গ্রিনকার্ড না থাকলে কাউকে ইনভাইট করলেও সহজে ঢোকা যায় না। তাছাড়া এদেশের ইমিগ্রেশন নিয়ম খুব কঠোর- কারো মেডিকেল ট্রিটমেন্টের জন্য ভিজিট করতে হলে স্পন্সর থাকতে হয়,ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাতে হয়,ভিসা ইন্টারভিউ পাস করতে হয়। এক্ষুণি তো সেটা সম্ভব নয়। স্কলারশিপ বা স্টুডেন্ট ভিসা ছাড়া ওর পক্ষে এখানে আসা সম্ভব নয়। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ। এছাড়াও আরও অনেক কিছু রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যম ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্যুতির পক্ষে ঢোকা অসম্ভব। এছাড়াও..”
দ্যুতির নামে মামলা আছে- তা বলতে নিয়েও থেমে গেলেন। পাছে না অনিক বাপের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে আবারও মানসিক চেতনা হারিয়ে কোমায় ফিরে যায়।

“থামলে কেন?”
“এছাড়াও.. মানে এই সব আরকি। তাই দ্যুতি এখানে আসেনি।”
উনার দিকে তাকিয়ে রইল অনিক।
“ভুল বুঝো না.. প্লিজ। বাবা,তুমি সুস্থ হও। তোমার সুস্থতা জরুরি।”
“আমি একা থাকতে চাই।”
“বাবা,তুমি..”
“একা থাকতে চাই।”

মায়াকুমারী পর্ব ৫৬

“বাবা,তুমি হাইপার হয়ো না.. প্লিজ। তোমার ক্ষতি হবে। মায়ের কথা শোনো।”
“একা থাকতে চাই!”
চেঁচিয়ে উঠল অনিক। কেঁপে উঠলেন তিনি। অনিকের শব্দ কেবিনের ভেতরে দীর্ঘক্ষণ প্রতিধ্বনি করল,যেন কোনো সেকেন্ডের জন্য সময় থমকে দাঁড়াল। বিমর্ষ মুখে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

মায়াকুমারী পর্ব ৫৭ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here