মায়াবতী পর্ব ১০
ইসরাত জাহান ইকরা
চারিদিকে সন্ধ্যা কেটে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, সেই অন্ধকার আকাশ থেকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে,মাঝে মাঝে কিছু মেঘের খন্ড চাঁদকে বার বার ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে। সেই সময়টায় কারেন্ট নেই বাসায়, টেবিল হাতড়ে ম্যাচবক্স টা বের করে মুমবাতি ধরালো মেঘা, মাটি জানালা খুলে দিতেই এই শীতল হাওয়া ঘরে প্রবেশ করে, মেঘা তাই হাত দিয়ে মুমবাতিটা আড়াল করে ফেললো।
মেঘা মুমবাতিটা টেবিলে রেখে মাটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখলো মাটি মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘা মাটির উদ্দেশ্য বললো _ এমন চাঁদের মতো মুখটা আঁধার হয়ে আছে কেন?
মাটি কিছু না বলে মেঘা কে ফট করে জরিয়ে ধরে, কান্না করে দিল। আকস্মিক এমন ভাবে জরিয়ে ধরায় মেঘার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। মেঘা মাটির মুখটা দু হাতে উঁচু করে ধরে বলে উঠলো _ কি হয়েছে মাটি তুই এভাবে কাঁদছিস কেন? মাটি মেঘা কে আরেকটু জোরে জরিয়ে ধরে বলে উঠলো _ সরি আপু।
মেঘা _ ওমা,, সরি কেন?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাটি _ এই যে তোকে আলিফ ভাইয়া ঠকাইছে বলে মাঝে মাঝে আমি মজা করে বলতাম তুই ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গিয়েছিস, এবং বিভিন্ন কথায় খুচা দিতাম এই ব্যাপার টা নিয়ে। তাই সরি, কারন আমি আগে বুঝতাম না ভালোবাসা জিনিস টা কি,আর এতোদিন তোর সেই ভালোবাসার জন্য কি পরিমান কষ্ট সহ্য করতে হইছে তোকে সেটা ও বুঝতে পারছি?
মেঘা ভ্রু উঁচু করে কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো, কিছুক্ষণ পর মেঘা মাটির উদ্দেশ্য বলে উঠলো _ দেখ মাটি তোর কথায় বুঝতে পারছি তুই কাউকে ভালোবাসিস। ভালোবাসি কথাটা বললে ভুল হবে, হয়তো কাউকে তোর এখন ভালোলাগে, কিন্তু সেই ভালোলাগা আর ভালোবাসার মাঝে গুলিয়ে ফেলেছিস, এখন তোর বয়সটাই এমন, কোনটা মোহ আর কোনটা ভালোবাসা সেটার পার্থক্য বুঝবি না। তাই এসব থেকে দূরে সরে যা? একদম পড়াশোনায় ফোকাস কর?
মাটি এই কথা শুনে ফট করে মেঘা কে ছেড়ে দিল, তারপর রেগে বলে উঠলো _মোহ আর ভালোবাসার পার্থক্য আমি বুঝি, আর আমি শিউর আমি মারাত্মক ভাবে ফেঁসে গেছি, তাও আবার ওয়ান সাইড লাভ,সে ভালো বাসে কি না বুঝার আগেই একটা ছোট্ট করে হালকার মাঝে ঝাপসা ছ্যাকা খেয়ে গেছি।
মাটির কথায় মেঘা ফিক করে হেসে দিল। তারপর মেঘা বলে উঠলো _ ওহ্ আচ্ছা তাই,,খোলাসা করে বলতো কি হইছে,আর কে সে,তোর ওয়ান সাইড লাভার? নাম কি?
মাটি কিছু বলতে যাবে তখনি, আয়েশা দরজায় নক করলো।
আয়েশা _ মাটি ঘরে আছিস, দরজা টা খোল তো।
মেঘা টেবিলের উপর থেকে মোমবাতি টা হাতে নিয়ে দরজা খুললো, দরজা খুলতেই আয়েশা বলে উঠলো _ মেঘা আপু মাটি কে নিয়ে মেহমিদ ভাই বাড়ির ছাদে যেতে বলেছে। আয়েশার কথা শুনে মেঘা চিন্তিত সুরে বলে উঠলো _ কেন রে এই রাতে ছাদে কি? তাও আবার মাটি কে নিয়ে।
তখনি ছাদ থেকে বক্সের আওয়াজ ভেসে এলো মেঘার কানে। কেউ বক্সের মধ্যে গান লাগিয়েছে _ তোমার কোন কোন জায়গায় ব্যাথা গো বান্ধবী ললিতা।
এমন গান শুনে মাটি হেসে কুটিকুটি, আয়েশা বলে উঠলো _ আরে মেহমিদ ভাইয়ার দুই বন্ধু আসছে সন্ধ্যায় শহর থেকে আর অনু আপুর দুই বান্ধবী। তাই ছাদে আড্ডার আসর জমিয়েছে। আমাকে পাঠিয়েছে তোমাদের নিয়ে যেতে।
মাটি বলে উঠলো _ কারেন্ট নাই ওরা বক্স বাজাচ্ছে কি করে।
আয়েশা_ কীভাবে আবার আই পি এস এর সাহায্যে।
মাটির মনে পড়লো সারা বাসায় আই পি এস এর কানেক্টেড আছে শুধু মাটিদের রুমে দেইনি চাচী।
মেঘা বলে উঠলো _ আচ্ছা আমরা আসছি তুমি যাও। আয়েশা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।
মেঘা দরজা লাগিয়ে ড্রয়ার খুলে ভালো জামা খুলে রাখলো, আর মাটি কে বলতে লাগলো _ মাটি সুন্দর করে সেজেগুজে রেডি হো। এই বলে মেঘা ওয়াশ রুমে চলে গেল।
এদিকে ছাদের চারিদিকে লাইটিং ফাইটিং করে এলাহি কান্ড। ছাদের মাঝখানে চাদর বিছানো হয়েছে। মেহমিদ বলে উঠলো এই লাইটিং এর ব্যাবস্থা না করে চারিদিকে মোমবাতি জ্বালালে আরো সুন্দর হতো না। অনু বলে উঠলো _ আর সেই আগুনে আমরা পুড়ে মরি তাই না।
পাশ থেকে অনুর বান্ধবী অন্তরা বলে উঠলো _ পুড়বে কেন, বরং ভালোই হতো।
অনুর অপরজন বান্ধবী বলে উঠলো _ আগুন কখন কীভাবে ছড়ায় বলা তো যায় না। তাই রিস্ক নেওয়ার দরকার কি।
তখনি বক্সে এমন উদ্ভট গান শুনে, মেহমিদ কপাল কুঁচকে বক্স কে বাজাচ্ছে তার পানে তাকালো। মেহমিদের পাশে দাঁড়িয়ে মেহমিদের সাথে কথা বলছিলো,মেহমিদের আরেক বন্ধু। সে বলে উঠলো _ কিরে মেহমিদ নিশ্চয়ই সানি এসব গান, বাজাচ্ছে।
মেহমিদ বলে উঠলো _ এছাড়া আর কোন বলদ বাজাবে।
সানি বলে উঠলো _ মেহমিদ তুই কিন্তু আমাকে ভদ্রভাবে গালি দিচ্ছিস। এখানে কিন্তু আমি থাকবো না।
আবির বলে উঠলো _ এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন যা তোর বান্ধবী ললিতার শরীরে মালিশ করে দিয়ে আয়।
সাথে সাথে সবাই জোরে হেসে দিল।
তখনি ছাদে আয়েশা প্রবেশ করলো। আয়েশা মেহমিদের উদ্দেশ্য বলে উঠলো _ ভাইয়া মেঘা আপু কে বলেছি, ওরা রেডি হয়ে আসছে।
মেহমিদ _ ঠিক আছে, এখন বসো।
মেঘার কথা শুনেই অনু রেগে গেল। রেগে মেহমিদ কে বলতে লাগলো _ আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারসদের মধ্যে ওদের আসতে বলেছিস কেন।
মেহমিদ কপাল কুঁচকে বলে উঠলো _ কেন, মেঘা,মাটি ওরা আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারস নয়।
অনু মেহমিদের এই কথার কোন উত্তর দিতে পারবে না জেনে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অন্য দিকে তাকালো। তখন অনুর বান্ধবী সিমিন বলে উঠলো _ এই মেঘা,মাটি কে রে অনু?
অনু বলে উঠলো _ আরে আমাদের বাসার চাকরানী, দয়া করে থাকতে দিয়েছি আর ,সব দায়িত্ব আমার বাবা নিয়েছে তাই মেহমিদ এমনকি বাড়ির সবাই ওদের ফ্যামেলি মেম্বার ধরে নিয়েছে।
এটা মেহমিদ শুনতে পেয়ে ভিশন রেগে গেল। পাশ থেকে মেহমিদ এর বন্ধু আবির শুনতে পেয়ে বলে উঠলো _ মিথ্যা বলছিস কেন, মেঘা মাটি তো তোদের কাকা শাহিনের মেয়ে, তো পর হলো কি করে?
অনু _ যা জানিস না বলিস না, দাদা শাহিন কাকা কে ছেলে বলে অস্বীকার করেছে, এমনকি বাড়ি থেকে যেদিন বের করে দিয়েছে সেদিন থেকেই ওরা এই বাড়ির পর হয়ে গেছে।
এদিকে মেহমিদের রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। মেহমিদ রেগে চিৎকার করে বলে উঠলো _ অনু, আর একটা কথা বললে থাপ্পর মেরে তোর গাল লাল করে দিব. কতটুকু জানিস তুই, তোর কোন আইডিয়া আছে শাহিন কাকার সম্পর্কে, শেষ পর্যায়ে দাদা তার ভুল বুঝতে পেরেছে,আর তাই সব ছেলেদের থেকে সম্পত্তির ভাগ দাদা তার ছোট ছেলে শাহিন কাকা কে দিয়ে গেছে।
এদিকে মেহমিদ এর এমন রাগ দেখে ভরকে গেল অনু, ভয়ের চেয়ে অপমানিত বোধ করলো বেশি। মেঘার জন্য এতো কথা অনুকে শুনাচ্ছে মেহমিদ ভাবতেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।
এদিকে মেহমিদ রাগে ফুঁসছে, যা দেখে মেহমিদের বন্ধুরা তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে পানি এগিয়ে দিল। আর আবির অনু কে ইশারায় চুপ থাকতে বলছে, কেননা এমনভাবে চলতে থাকলে পুরো আয়োজন টা বৃথা যাবে। তাছাড়া বন্ধুমহলের সবাই কালকে চলে যাবে,তাই সেই সময়টা ঝগড়া করে কেউ নষ্ট করতে চায় না।
অনু চুপ করে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলো, এখন কিছু বলা ও যাবে না। মেঘা কে পড়ে দেখে নিবে সে, কিন্তু মেহমিদ কে কীভাবে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলবে? এভাবে চলতে থাকলে তো মেহমিদ হাতের বাইরে চলে যাবে।
এবার থেকে নতুন প্ল্যান কষতে হবে, মেহমিদের চোখে ভালো সাজতে হবে। তবেই মেহমিদের মন জয় করা সম্ভব।
তখনি ছাদের গেট পেরিয়ে মাটি আর মেঘা ছাদে প্রবেশ করলো। চারিদিকে এতো লাইটিং ফাইটিং, সুন্দর ডেকুরেশন দেখে মেঘা অবাক হয়ে চারপাশ টা দেখতে লাগলো। মেঘা কে ছাদে দেখে মেহমিদের রাগ উধাও হয়ে গেল, মেহমিদ মেঘা কে দেখে চোখ ফেরাতে পারছে না এমন অবস্থা হয়ে গেল। সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছে মেঘা, পড়নে হাফসিল্ক জর্জেট থ্রী পিচ, তাতে পাথরের কাজ করা, মেঘার গায়ে আলো পড়তেই সাদা রঙের থ্রী পিচ এর পথর গুলো চিকচিক করে উঠছে । মেঘা,মাটি সেম পোষাক, মাটি ছাদে উঠে মাহিদ কে কোথাও দেখতে পেল না। তখনি গেট পেরিয়ে মাহিদ চলে আসলো, হাতে মুড়ি চানাচুর কোক এর বোতল।
মাহিদ মাটি কে দেখে থমকে দাঁড়ালো,আজ কেমন জেনো পুতুলের মত দেখাচ্ছে, তারপরও মাহিদ চোখ সরিয়ে নিয়ে মেহমিদ এর কাছে গিয়ে বলে উঠলো _ তোমার কথা মতো সবকিছু এনেছি ভাইয়া।
মাহিদের কথায় মেহমিদ এর ধ্যান কাটলে, মেহমিদ সবার সাথে মেঘা, আর মাটির পরিচয় করিয়ে দিল ।
তারপর সবাই মিলে মুড়ি বানাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল,কেউ পেয়াজ কাটছে,কেউ টমেটো কাটছে,কেউ শসা কাটছে তো কেউ পলিথিন ব্যাগ খুলছে । মেঘা সবার হাতে হাতে হেল্প করতে গিয়ে মেহমিদের মাথার সাথে নিজের মাথায় ঠাস করে বাড়ি খেলো, এতে দুজনেই ভরকে গিয়ে পরক্ষনেই ফিক করে হেসে দিল।
এদের এমন হাসাহাসি দেখে অনুর ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া কি বা করবে।
মেহমিদের বন্ধু আবিরের সাথে মাটির ভাব হয়ে গেল, যা দেখে দূরে দাঁড়িয়ে মাহিদ কেন জেনো রাগে ফুলছে, যা দেখে মাটি মজা নিচ্ছে,।
তারপর সবাই গোল হয়ে ছাদে বসে মুড়ি মাখা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। এই হাসি তামাশার মাঝে একজন রাগে ফুঁসছে, সে হলো অনু।
,, অবশেষে, আড্ডার আসর ভেঙে যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেল।
ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে, বুকে ফু দিয়ে মেঘা পুকুর পাড়ে চলে গেল, মেহমিদ সেখানে দাঁড়িয়ে ভোরের এই সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো,পাশে মেঘার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বলে উঠলো _আজ থেকে তোমার টাইপিং ক্লাস শুরু, নিজেকে নিজে তৈরি করো, ।।
এই বলে মেহমিদ ধাপে ধাপে মেঘা কে শিখাচ্ছে কিভাবে কোন আঘাতের বিপরীতে নিজেকে রক্ষা করা যায়, । এভাবে ক্লাস শেষ হোওয়ার পর, মেঘা ক্লান্ত শরীর নিয়ে পুকুরপাড়ের সিরিতে বসে পড়লো। পুকুরের পানিতে হাত মুখ ধুয়ে দেখতে পেলো মেহমিদ ও মেঘার মতো করে পুকুরের পানিতে হাত মুখ ধুচ্ছে।
মেঘা মেহমিদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে, মেহমিদ ইশারায় জিগ্গেস করলো কি দেখছে এভাবে সে, সাথে সাথে মেঘা চোখ সরিয়ে নিলে মেহমিদ মুচকি হেসে সেখান থেকে উঠে চলে যায় ।
মেঘা অনেক্ষণ যাবত লজ্জায় নদীর পানির দিকে তাকিয়ে ছিল নিশ্চুপ হয়ে, তখনি পেছন থেকে মেহমিদ বলে উঠলো _ মেঘা যাবে আমার সাথে?
মায়াবতী পর্ব ৯
মেঘা ফট করে মেহমিদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো _ কোথায়?
মেহমিদ _ নৌকা করে ঘুরতে যেতে।
সাথে সাথে মেঘা রাজি হয়ে গেল, মেহমিদ মেঘার হাত ধরে টান দিয়ে বলে উঠলো _ চলো নদীর ঘাটে,।
এই বলে মেঘা আর মেহমিদ নদীর ঘাটের উদ্দেশ্য দৌড় দিল, দৌড়ে গিয়ে একটা নৌকায় উঠে বসলো, । নৌকায় উঠে বসতেই মেঘা দেখতে পেলো _ সে নৌকায় আলিফ আর তিশা ও আছে।