মায়াবতী পর্ব ১৬
ইসরাত জাহান ইকরা
মেঘার জ্ঞান ফিরতেই দেখতে পেলো মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে, পরক্ষনেই কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়লো,সে তো এখন বিবাহিত আর চাইলে ও মেহমিদের সাথে কখনো দেখা করতে পারবে না, আলিফের কাছ থেকে ধোকা খাওয়ার পর মনে হয়েছিল মেহমিদ ই তার জন্য পারফেক্ট, কিন্তু জীবন টা এভাবে ভাসাতে ভাসাতে তাকে এই পরিস্থিতির সামনে নিয়ে আসবে কে জানতো। এইসব প্রেশার না নিতে পেরে মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনায় তখন জ্ঞান হাড়িয়েছিল মেঘা , তখনি পাশ থেকে কেউ পুরুষকন্ঠে বলে উঠলো _ মিস মেঘা, আপনি কি ঠিক আছেন, জীবনে দেখেনি কারো বিয়ে হলে এভাবে জ্ঞান হাড়ায়।
মেঘা বুঝতে পারলো এটা সৌরভ, কিন্তু তৎক্ষণাৎ বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। এই কন্ঠস্বর তার চিরপরিচিত ফট করে মেঘা পাশে তাকালো, দেখলো মেহমিদ মাথার চুল মুছতে মুছতে এসে সোফায় বসলো,লেপটপ টা অফ করে ভ্রু কুঁচকে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘা চোখ ডলে আবার সামনে তাকালো, এখনো মেঘা কল্পনার জগতে আছে কি না তা যাচাই করার জন্য নিজের গালে স্বজোরে থাপ্পর মারলো। কিন্তু না মেঘা থাপ্পড়ে ভিশন ব্যাথা অনুভব করলো, মেঘা বলে উঠলো _ মেহমিদ সত্যিই কি আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?
মেহমিদ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো _ কেন আমাকে দেখে কি সৌরভ মনে হচ্ছে?,বলেই কোনরকম হাসিটা কন্ট্রোল করলো মেহমিদ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেঘা বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড় গিয়ে মেহমিদ কে জরিয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল _ আর বলতে লাগলো আপনি এতোক্ষণে এসেছেন আমাকে নিতে, আমি আপনাকে কতো টেক্সট দিয়েছি, কই আপনি তো আমার কোন খোঁজ নিলেন না। তারপর মেঘা রেগে মেহমিদ কে ধাক্কাতে লাগলো আর বলতে লাগলো _ এখন আর আপনাকে দরকার নেই, আপনি চলে যান, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
মেহমিদ জোর করে মেঘার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্ধি করে বলে উঠলো _ আরেহ,এতো দেখছি আমাকেই আমার ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে।
সাথে সাথে মেঘা থমকে গেল আর বলতে লাগলো _ আপনার ঘর মানে? কি যাতা বলছেন?
মেহমিদ বলে উঠলো _ জ্বী ঠিক শুনতে পেরেছেন, আমিই মেহমিদ আর আমিই সৌরভ।
মেঘা এটা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লো _সাথে সাথে বলে উঠলো আপনি মিথ্যা বলছেন তাই না? আপনি সৌরভ হতে যাবেন কেন, সৌরভ তো আমার মামাতো ভাই।
মেহমিদ বলে উঠলো দাঁড়াও সব ক্লিয়ার করছি আমি _ এই বলে মেহমিদ আনসার রহমান কে ডাক দিলো_ বাবা একটু এদিকে আসো তো, মেঘার জ্ঞান ফিরেছে।
আনসার রহমান তাড়াতাড়ি করে ঘরে প্রবেশ করলেন,আর বলতে লাগলেন _কই মেঘার জ্ঞান ফিরেছে, দেখলি তো তোর জন্য মেয়েটার অবস্থা কি হলো। মেঘা এভাবে এদের স্বভাবিক পরিবার সূলভ কথা বলতে দেখে কপাল কুঁচকে বলে উঠলো _ মামা তুমি মেহমিদ কে চিনো, আর ওর সাথেই আমাকে বিয়ে দিলে? কিন্তু সৌরভ, সৌরভ তো তোমার ছেলে,মেহমিদ কি করে তোমার ছেলে হয়?
আনসার রহমান থতমত খেয়ে বলতে লাগলেন _ আসলে তোমাকে আরো আগেই জানানো উচিত ছিল, কিন্তু মেহমিদ তখন জানাতে নিষেধ করেছে, তোমাকে সেখান থেকে বের করার জন্য এতো প্ল্যান ছিল মেহমিদের। তখনি মেহমিদ বলে উঠলো আমি তোমাকে সব বলছি মেঘা, তুমি মন দিয়ে শুনো _ তুমি কি একবারো ভেবে দেখেছো, তোমার বাবার বংশ অনুযায়ী সেই বংশের রিতী অনুযায়ী যার আগে পুত্র সন্তান হবে তাকে বেশি সম্পদ দেওয়া হবে। সেই হিসেবে মোশারফ হোসেনের বেশি সম্পত্তি পাওয়ার কথা, যেখানে আমি ছিলাম মোশারফ হোসেনের প্রথম ছেলে সন্তান। কিন্তু সেই নিয়ম কেন ভঙ্গ করে তোমার বাবাকে কেন বেশি সম্পত্তি দেওয়া হলো জানো ?
মেঘা মাথা নাড়িয়ে বললো_ শুনছি আমার দুই চাচা দাদামশায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাই আমার বাবাকে বেশি সম্পত্তির উত্তরাধিকার বানিয়েছে।
মেহমিদ বলে উঠলো _ কি সেই বিশ্বাসঘাতকতা শুনবে না, মোশারফ হোসেনের পালিত সন্তান আমি, যখন সেটা তোমার দাদামশাই জানতে যে সম্পদের লোভে ছেলে সন্তান দত্তক এনেছে তখন তিনি রাগে ক্ষোভে তোমার বাবা কে বেশি সম্পত্তির উত্তরাধিকার বানায়।
আর আমার আসল বাবা হচ্ছেন _এই আনসার রহমান। কীভাবে কি আমি তোমাকে খুলে বলছি।
ফ্ল্যাশব্যাক………………………
আব্রাহাম হোসেন ছিল মেঘার দাদা। আব্রাহাম হোসেন বাবা ছিলেন জমিদার,সেই বংশের রিতী অনুসারে যার আগে প্রথম পুত্র সন্তান হবে সেই হবে বেশি সম্পত্তির উত্তরাধিকার। আব্রাহাম হোসেনের তিন ছেলে, মোশারফ, আনোয়ার,আর শাহিন তিন ছেলেই ছিল প্রতিষ্ঠিত, শাহিন বাকিদের থেকে পড়াশোনা ভালো ছিল এবং অনেক পড়াশোনা করে শহরে নিজের চেষ্টায় বড় বিজনেস দাড় করায়,সেই বিজনেসের অংশীদার ছিলেন মোশারফ হোসেন ও। তখন মোশারফ হোসেন ও আনোয়ার হোসেন ছিল বিবাহিত, শায়লা বেগম তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন,এর তিন মাস পর রাহিমা বেগম অন্তঃসত্ত্বা হলো, মোশারফ হোসেনের তখন মনে ভয় জন্মে গিয়েছিল,যদি তার মেয়ে সন্তান হয়,আর আনোয়ার হোসেনের ছেলে সন্তান,
এই ভয় নিয়ে ছয় মাস পর আট্রা করার পর তিনি দেখতে পেলেন তার ছেলে সন্তান হবে এবং আনোয়ার হোসেনের মেয়ে, সেদিন আনোয়ার হোসেন মন মরা ছিলেন,আর মোশারফ হোসেন বাসায় ঘোষণা করে দেন তার ছেলে হবে, সেই খুশিতে শায়লা বেগমের জেনো যত্নে , চিকিৎসায় যেনো কোন ত্রুটি না হয় সেজন্য শহরে চলে যান। আর ঠিক তখনি শাহিন তার ভালোবেসে বিয়ের কথা জানালে আব্রাহাম হোসেন আপত্তি জানান, কেননা মেঘার মায়ের বাবা মা কেউ বেঁচে ছিলো না, ভাইয়ের আদরের, ভাইয়ের সংসারেই বেড়ে ওঠা তার। পরিবার মেনে না নেওয়ায় শাহিন পালিয়ে বিয়ে করে বাসায় মেঘার মাকে নিয়ে আসেন।
কিছুদিন আব্রাহাম হোসেন ছেলের সেই কর্মকান্ডে অসন্তুষ্ট থাকলে ও পরে মেনে নেন। তারপর শাহিন মেঘার মাকে নিয়ে শহরের নিয়ে একসাথে সুখে সংসার করতে থাকেন। এরকিছুদিন পর মোশারফ হোসেনের স্ত্রী শায়লা বেগমের ডেলিভারি পেইন উঠলে তাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়, কিন্তু র্দুভাগ্য বশত সেদিন মোশারফ হোসেনের ছেলে জম্মের পর পরই মারা যায়। তাতে মোশারফ হোসেনের ছেলের মৃত্যুর চাইতে সম্পদ থেকে বঞ্চিত হোওয়ার ভয় কাজ করতে থাকে, সে সম্পত্তি ধরে রাখার জন্য নবজাতক শিশু খুজার জন্য তার অফিসের গাড়োয়ান কে খুঁজ নিতে বলে, ইমার্জেন্সি তার একটা ছেলে সন্তান লাগবে,
যত টাকা লাগে মোশারফ হোসেন তাই দিবে। তখন আনসার রহমানের ও ছেলে সন্তান হয়, কিন্তু সন্তান প্রসবের পর পর আনসার রহমানের স্ত্রী মারা যায়। প্রিয় স্ত্রী কে হাড়িয়ে, আনসার রহমান অতি দুঃখে পাথর হয়ে যান, তখন আবার আনসার রহমানকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য পিরাপিরি করতে থাকে, মেঘার মা এসে আনসার রহমান কে তার ছেলের ভবিষ্যতের জন্য বিয়ে করতে বলেন। কিন্তু আনসার রহমান বিয়ে করতে নারাজ, এই কষ্ট ভুলার জন্য আনসার রহমান একসময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন এবং এর ফলে সমস্ত কিছু বিক্রি করে প্রায় নিঃস্ব হোওয়ার অবস্থা, তখন নেশা করার জন্য টাকা না পেয়ে একটা অফার পান তার ছেলেকে বিক্রি করে দিলে সে অনেক টাকা পাবে। যেহেতু তিনি ছেলেকে ঠিকঠাক মতো দেখবাল করতে পারছেন না, তাই তিনি ছেলেকে বিক্রি করে দেন, কিন্তু কার কাছে বিক্রি করছে তা জানতো না।
এসব শায়লা রহমান কিছুই জানতো না, তাকে এতো দিন জানানো হয়েছিল,তার ছেলে ICU যে ভর্তি আছে। সেদিন সেই শিশুটি কে আদর যত্ন করে লালন পালন করেন। এর পরেই মাহিদ আসে শায়লা বেগমের কোল আলো করে। এর পাচ বছরের পর শাহিনের,দুটি মেয়ে হয় মেঘা,আর মাটি, মেঘা যখন তিন বছরের মাটি তখন কোলে। এর মধ্যেই কোনভাবে আব্রাহাম হোসেন জানতে পারেন আর বড় ছেলে সম্পত্তির জন্য বাচ্চা দত্তক নিয়েছে, আর মেজো ছেলে এই সম্পত্তির প্রতি বছরের ফল মূল বিক্রি করার টাকা নিজের কূটনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে টাকা সেখান থেকে নিজের জন্য খরচা করে ফেলেছে। এর ফলে রেগে আব্রাহাম হোসেন সেই রীতি ভঙ্গ করে শাহিন কে অধিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার বানায়। যে হিংসার বশভর্তী হয়ে মোশারফ হোসেন এক্সিডেন্ট করিয়ে, মেঘার বাবা মাকে হত্যার পরিকল্পনা করে, মেঘার মা এক্সিডেন্টে ঘটনাস্থলেই মারা যান,আর শাহিন কে হসপিটালে ভর্তি করায়, আনসার সেই খবর শুনে দৌড়ে ছুটে যান দেখতে, বোনের মৃতদেহ দেখে কন্নায় ভেঙে পড়েন। তারপর শাহিনের কাছে জানতে চাইলে শাহিন আনসার রহমান কে সবকিছু খুলে বলেন। এবং পাঁচদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকে তিনি মারা যান।
বর্তমান……………
সব শুনে মেঘার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। মেঘা কান্নাভেজায় গলায় বলে উঠলো _ তারপর আপনি কীভাবে এতো কিছু জানতে পারলেন আর মামাকে কীভাবে খুঁজে পেলেন।
তারপর আনসার রহমান বলতে লাগলেন _ নিজের আদরের কলিজার টুকরা বোন মারা যাওয়ার পর নেশা ছেড়ে দিয়েছি, এবং নিজের করা ভুল বুঝতে পারি, সেদিন থেকে নিজের ছেলের খোঁজ লাগায়, সেই দাড়োয়ান কে ধরে জিগ্গেস করি আমার ছেলে কে কোথায় বিক্রি করেছে, সেদিন জানতে পারি আরো কোথাও না আমার বোনের হত্যাকারী মোশারফ হোসেন ই আমার ছেলেকে দত্তক নিয়েছে। আইননত অধিকার না থাকায় আমি আমার ছেলের অধিকার ধরতে পারতাম না, কিন্তু দূর থেকে আমি ঠিকই মেহমিদ কে দেখতাম এবং ফলো করতাম।
তখন মেহমিদ আনসার রহমান কে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো _ আমি ছোটবেলা থেকেই রহস্য উদঘাটন করতে ভালোবাসি এবং পুলিশ হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু একদিন আমার ভাই মাহিদের অতিরিক্ত পেট ব্যাথা শুরু হয়,তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়, ডাক্তার বললো মাহিদের অ্যাপেন্ডিসাইটিস পেট ব্যাথা তাই তাকে সেদিন অপারেশন করা হয়। অপারেশন করার ফলে রক্তের প্রয়োজন হয়, তাই আমাদের ব্লাড টেস্ট করা হয়, সেদিন জানতে পারি আমার বাবা মা ভাই সবার রক্তের গ্রুপ A+, কিন্তু আমার, ও পজেটিভ। সেদিন থেকে আমার মনে সন্দেহের দানা বাঁধে,আর আমার পিছন একটা লোককে ফলো করতে দেখি প্রায় সেটা আর কেউ না,ওনি আমার বাবা আনসার রহমান। ওনার কাছ থেকে সব শুনি এবং ওনার সাথে আমার ডি এন,এ ম্যাচ করায় আমি শিউর হই। এরপর থেকে আমি প্রায় ওনার কাছে আসি ওনার খোঁজ খবর নেই।
সব শুনে মেঘা রেগে গেলো, আর বলতে লাগলো আপনি আমাকে আগে বলেননি কেন। বলেই মেঘা মেহমিদের সাথে ঝগড়া শুরু করলো, আনসার রহমান সেই ফাঁকে হাসতে হাসতে চলে গেল, আনসার রহমান চলে যেতেই মেহমিদ দরজা লাগিয়ে দিল, তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে,_ আগে জানালে কি হতো?
মেঘা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল, এখন মেঘার লজ্জা লাগছে ভিশন। তারপর মেঘা বলে উঠলো _ জানেন আমার লাইফের বেস্ট মূহুর্ত এই সময়টা, আমি যে কি পরিমান সারপ্রাইজ হয়ে গেছি, ।
মেহমিদ বলে উঠলো _ সারপ্রাইজ দিতেই তো ইচ্ছে করে যোগাযোগ করিনি, আর জোর করে বিয়ে করার মজাটাই আলাদা। আর মাটি কে নিয়ে ভাববে না, ওও সেইফ জায়গায় আছে,মাহিদের কাছে।
মেঘা জেনো এবার কিছুটা শান্তি অনুভব করলো। কিন্তু তারপরেই জিগ্গেস করলো কিন্তু মাটি কীভাবে মাহিদের কাছে গেল,আর অনু আমাকে মেসেজে এসব কি বললো। তারপর মেহমিদ মেঘা কে সব খুলে বললো _ সব শুনে মেঘা রেগে বলে উঠলো, চলুন এখুনি ওদের পুলিশে ধরিয়ে দিব, সাথে সাথে মেহমিদ আটকে বলে উঠলো _ এখুনি না, ওদের উচিত শাস্তি দিব তারপর।
মায়াবতী পর্ব ১৫
এখন যাও খেয়ে নাও, এরপর পড়তে বসো ইকরার পাঠকরা তো কেউ কেউ আমায় কেরেক্টার লেস বানিয়ে দিয়েছে। বলেই মেহমিদ শার্ট পরে বাইরে চলে গেল।
মেঘার এখন কিছুটা হালকা লাগছে, সাথে শান্তি ও লাগছে, ড্রয়ার থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল লম্বা একটা শাওয়ার নিতে।