মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ৪৬
ইশরাত জাহান
সবাই এদিক ওদিক তাকাতে থাকে।তখনই মেয়েটি বলে,”আপনাদের বাড়ির ছোট ছেলে রৌদ্রদ্বীপ রুদ্রের সন্তানের মা হতে চলেছি আমি।”
বুকের ভিতর মোচড় দিলো হিয়ার। হ্যাঁ সে চেয়েছিলো রুদ্রের আসল রূপ সবার সামনে প্রকাশ করতে কিন্তু ভালোবাসার মানুষ আজ অন্য কারো।ঘৃণা এক জিনিস আর ভালোবাসার মানুষকে অন্যের পাশে দেখা আরেক জিনিস।হিয়া পিছিয়ে যেতে নেয়।মায়া তাকালো হিয়ার দিকে।সাথে সাথে এসে হিয়াকে আকড়ে নেয় মায়া।রাজ হাত মুঠ করে নিলো।বোনের দুঃখ সহ্য হচ্ছে তার নিজেরও।কিছু করার আগে মাহমুদ সরদারের দিকে তাকালো।বাবার চোখের ইশারা পেয়ে চুপ থাকলো রাজ।
সোনালী এগিয়ে এলো মেয়েটির দিকে।বলে,”এই মেয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলবে না।কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”
মেয়েটি এবার সোনালীর দিকে ঘুরে বলে,”প্রথমত আমার নাম জেসি। আর দ্বিতীয়ত আমি প্রমাণ ছাড়া চলি না।আমাদের প্রত্যেকটা মোমেন্টের ছবি আছে আমার কাছে।চাইলে দিতে পারি।”
মোহন সরদার তাকালো রুদ্রের দিকে।রুদ্র নিশ্চুপ।কোনো কথা বলছে না সে।মোহন সরদার সেদিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি না হিয়াকে ভালোবাসো?বলেছিলে তো ওকে বিয়ে করবে।তোমার মাও এই কথাটি বলেছিলো।তাহলে আজ এই মেয়ে কোথা থেকে উদয় হলো?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রুদ্র কোনো উত্তর দিলো না।জেসি একটি কাগজ এগিয়ে দিলো সোনালীর দিকে।বলে,”এখানে আমার প্রেগনেন্সি রিপোর্ট আর আমার সাথে রুদ্রর কিছু পিক আছে। আশা করি এগুলো দেখে স্বীকার করতে অসুবিধা হবে না।”
ছবি আর রিপোর্টগুলো দেখতে থাকে বাড়ির সবাই।মালিনী ঘুরে তাকালো সোনালীর দিকে।সোনালী হতবম্ব হয়ে আছে।মাহমুদ সরদার এবার রুদ্রের কাছে এসে বলেন,”এগুলো করার আগে আমাদের কথা ভাবলে না?তোমার বাবা তো আমাদের মুখে চুনকালি দিয়েই রেখেছে এবার তুমি।এই বংশের সম্মানটা ধুলোয় মিশিয়ে দিলে বাবা।”
রুদ্র তাকালো মাহমুদ সরদারের দিকে।মাহমুদ সরদারের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারবে না রুদ্র।হাজার হোক মাহমুদ সরদারকে অনেক ভালোবাসে রুদ্র।তিনি ছোট থেকেই রুদ্রকে আদর যত্ন করেছে।রুদ্র মাথা নিচু করে আছে।মায়া এবার জেসির কাছে এসে বলে,”কি চাও তুমি?”
“আমার সন্তানের পরিচয়।যেটা আমাকে আপনারা দিতে পারবেন।”
“যার সন্তান সে কি পরিচয় দিবে?”
জেসি মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওটা আপনাদের বাড়ির ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন।”
মায়া তাকালো রুদ্রের দিকে।রুদ্রকে জিজ্ঞাসা করে,”স্বীকৃতি দিবে তো তোমার বাচ্চাকে?”
রুদ্র বলে ওঠে,”কখনই না।”
মায়া এবার রুদ্রের কাছে এগিয়ে এসে বলে,”তাহলে ওর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে কেনো?”
হেয়ালি করে রুদ্র বলে,”এমন তো না যে আমি একা ইন্টারেস্টেড ছিলাম।ও নিজেও তো আমার কাছে এসেছিলো।ইনফ্যাক্ট আমাকে প্রেম প্রস্তাব ওই আগে দেয়।”
জেসি এবার রুদ্রর কাছে এগিয়ে এসে বলে,”লুক রুদ্র ওটা পাস্ট।তোমার আমার সম্মতিতে আজ আমাদের এই অবস্থা।আমি চাই তুমি আমাদের বেবীকে একসেপ্ট করো।”
“নট পসিবল। কার না কার বাচ্চা কে জানে!তোমার সাথে আমি একা সম্পর্ক করেছি নাকি?তোমার ইন্টেনশন তো বড়লোক বাড়ির ছেলেরা।দেখো ওখান থেকেই কারো তরফ থেকে বাচ্চা যুটিয়েছো।বাবা কে শিওর না তাই আমাকে ফাঁসাতে চাও।”
রাজ এবার তেড়ে আসে রুদ্রের দিকে।বলে,”এতটা চিপ মেন্টালিটি কিভাবে হয় রুদ্র?একটা মেয়েকে সম্মান করতে হয়।অন্তত তোর বাচ্চার মা সে।”
“সরি টু সে আমি মানতে পারছি না।”
কান্না করে দেয় জেসি।রুদ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”তাহলে বিয়ে করেছিলে কেনো আমাকে?বিয়ে করে আমার সাথে এতদিন ভালোবাসার অভিনয় কেনো করেছিলে?”
সোনালী এবার অবাক হলো।বলে ওঠে,”বিয়ে করেছে মানে?তুমি তো বললে তোমার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছে শুধু?”
“প্রেমের অভিনয় করেই তো রেজিস্ট্রি করে আমাকে।তারপর আমাকে নিয়ে কিছুদিন ঘুরে এখন আমাকে ভুলেই গেছে। কাল যখন বললাম যে আমি মা হতে চলেছি ও অস্বীকার চলে আসে।আমি কি করবো বলুন তো?বাসা থেকে বকাঝকা করছে আমাকে।”
হিয়া কাপছে থরথর করে।রুদ্র গোপনে বিয়ে করেছে আবার তার সাথেও ফ্লার্ট করতে থাকে।হিয়ার কান্না দেখছে মায়া।মায়া এবার নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না।কোনো ধোঁকাবাজকে মায়া সহ্য করতে পারে না।কখনও কাউকে ধোঁকা দেওয়া মায়ার স্বভাব না।এবার মায়া সোজা ডাইনিং টেবিল থেকে একটা ছুরি নিয়ে আসে।ওটা জেসির হাতে দিয়ে বলে,”যে তোমার বাচ্চার স্বীকৃতি দিবে না কিন্তু মেয়েদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে তাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেও।যাও তোমার অধিকার বুঝে নিতে।”
জেসি অবাক হলো।ভীত হয়ে বলে,”ছুরি দিয়ে কি করবো?”
“মেরে বালি চাপা করে দিবে ওকে।কাপুরুষ হয়েছে একটা।এদের কাজ মেয়েদের ফাঁসিয়ে তাদের জীবন নিয়ে খেলা করা।একবারও ভেবে দেখে না যে মেয়েটি তাকে ভালোবেসে আত্মত্যাগ করছে।”
জেসি ছুরি ফেলে দিয়ে বলে,”আমি এগুলো করতে পারবো না।আমি শুধু আমার বাচ্চার প্রাপ্য সম্মান চাই।রুদ্রকে বলুন আমাকে মেনে নিতে।বিয়ে তো হতেই গেছে আমাদের।এখন এটা পাবলিকলি স্বীকৃতি দিলেই হবে।”
কেউ কিছু বলার আগে বাইরে থেকে হইহুল্লোড় শব্দ আসে।মিডিয়ার লোক জড়ো হয়েছে আশেপাশে।রাজ সহ বাড়ির সবাই যায় সেদিকে।মিডিয়ার লোকদের সাথে জেসির বাবা আছে।তিনি চিৎকার করে বলেন,”আমার মেয়েকে ব্যাবহার করেছে এই রুদ্র।মোহন সরদারের একমাত্র ছেলে।চাকরির নাম করে আমার মেয়েকে এতদিন পাবলিক না করে শুধু ফুর্তি করেছে।এখন আমার মেয়ে তার সন্তানের মা হবে সে তার সন্তানকে অস্বীকার করছে।এটার বিচার চাই আমরা।”
মিডিয়ার লোক একেক করে প্রশ্ন করছে।বিশেষ করে প্রশ্নগুলো সব রাজকে করা হচ্ছে।এই বাড়ির প্রধান এখন রাজ।সে একজন মন্ত্রী।আর তার পরিবারের এক সদস্যের এমন বাজে কাজ ধরা পড়েছে।মিডিয়ার লোকেরা বলে,”কিছুদিন আগে আপনার কাকার রিলেশন ধরা পড়ে।খোঁজ নিয়ে জানা যায় আজ থেকে বহুবছর আগে আপনার কাকা তার বউ বাচ্চা থুয়ে পিএ মানে আপনার বর্তমান কাকীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।সেখানকার অবৈধ সন্তান এই রুদ্র।আজ আবার তারও একটা লুকায়িত সম্পর্ক প্রকাশ পেলো।আপনাদের ফ্যামিলিতে পরপর মেয়েদের এভাবে ঠকানো হয়।এটা কি কোনমতে আপনাদের বাবা ছেলের পাওয়ারে চলে?”
শেষের কথাতে মাথা গরম হয়ে যায় রাজের।মিডিয়ার সামনে কিছু বলতে যাবে তার আগে মায়া এসে রাজের হাত ধরে আটকে দেয়।সাংবাদিক এবার মায়াকে প্রশ্ন করে,”আপনি আপনার শশুর বাড়ি নিয়ে কি মতামত দিতে চান ম্যাম?”
মায়া মাইকের সামনে এসে বলে,”আসলে আমার কাকা শশুর আর আমার শশুর এদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।আমার শ্বশুর একজন মাটির মানুষ।তার ভিতরে এসব নোংরামি নেই।উল্টো আমরাই ঠকছি।তার প্রমাণ আছে আমার কাছে।”
বলেই মায়া পেনড্রাইভ তার ল্যাপটপে চালু করে।দেখিয়ে দিলো রাতের করা ভিডিও।স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রুদ্র হিয়াকে ঠকাচ্ছে।কিছু জায়গা মায়া কেটে দিয়েছে।যেখানে তাকে শো করা হয়েছে।ভিডিও দেখে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রুদ্রের দিকে এগিয়ে আসলো রাজ।রুদ্রের কলার চেপে ধরে বলে,”এই পরিবারে কোনো অপদার্থ থাকবে না।যার জন্য আমরা ঠকছি আবার আমরাই অপদস্থ হচ্ছি সে থাকবে না এই বাড়িতে।তার স্থান এই বাড়ির বাইরে।”
বলেই ঘাড় ধাক্কা দেয় রুদ্রের।হিয়া আতকে ওঠে।কিন্তু নিজেকে শক্ত রাখতে দেওয়ালের সাথে নিজেকে চেপে রেখেছে।ভালোবাসার মানুষকে এভাবে এক্সপোজ হতে দেখতে হিয়ার সহ্য হচ্ছে না।সে তো চেয়েছিলো রুদ্রকে শুধু তার বাড়ির লোকেদের সামনে এক্সপোজ করবে।তারপর এদের বিচার বাড়ির লোক করবে আর সে তার মতো বাইরে পড়াশোনা করবে।কিন্তু রুদ্র তো তার চাওয়ার থেকেও বেশি শাস্তি পাচ্ছে।
রাজ এসে দাড়ালো জেসির সামনে।বলে,”তোমার বাচ্চার বাবা এখন এই বাড়ির বাইরে।তাই তোমার দাবিদার ওদিকটায় যেয়ে মিটিয়ে নেও।আমাদের এই বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করবে না।”
রাজের রক্তিম চোখ দেখে জেসি চুপ করে থাকে।কোনো কথা না বলে বেড়িয়ে আসে।রুদ্র তাকালো হিয়ার দিকে।হিয়ার চশমা সহ চোখ জোড়া ভিজে আছে।টুপটুপ করে পড়ছে পানি।হিয়ার চাহনি সোজা রুদ্রের দিকে।রাজ এসে হিয়ার কাধে হাত রাখে।হিয়া তাকালো রাজের দিকে।রাজ বলে,”আমার বোন দুর্বল মন মানসিকতার নয়।সে নিজেকে সামলে চলতে পারে রাইট?”
হিয়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দিলো।সিয়া এসে জড়িয়ে ধরে হিয়াকে।মিলি কি করবে বুঝতে পারছে না।ভাইয়ের দুর্দিন দেখে যেমন কষ্ট হচ্ছে তেমন ভাইয়ের প্রতি রাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।হিয়াকে নিয়ে ভিতরে যেতে থাকে সিয়া।হঠাৎ রুদ্র ডেকে ওঠে,”হিয়াপাখি।”
হিয়ার পা সেখানেই থেমে গেলো।সিয়া হাত ধরে টানতে থাকে কিন্তু হিয়ার পা চলছে না।পিছনে ঘুরে তাকালো হিয়া।রুদ্র বলে,”আমি আবার ফিরে আসবো।আর সেদিন তুইও আমাকে চাইবি।যেখানে খুশি যা কিন্তু এই রুদ্রের কথাগুলো মাথায় রাখবি।তোর জীবনে যেনো অন্য পুরুষের আগমন না দেখি।”
বলেই হালকা হেসে চলে যায় রুদ্র।হিয়া হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সেখানে।হাউমাউ করে কেঁদে দেয় এবার।এতক্ষণ রুদ্রের সামনে নিজেকে আড়াল রাখলেও এবার আর পারলো না।মাহমুদ সরদার মালিনী রাজ ও মায়া তাকিয়ে আছে।ভালোবাসা না পাওয়ার দুঃখটা সবাই বুঝে।হিয়ার কান্না দেখে মায়া এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে হিয়াকে।হিয়া এবার ফোফাতে ফোফাতে বলে,”ভালোবাসা এমন অবাধ্য কেনো?আমরা না চাইতেও ভুল মানুষকে ভালোবাসি।কেনো আমাদের মন ভুল মানুষের দিকে চলে যায়।হাজার চাইতেও এই ব্যার্থ ভালোবাসায় নিজেকে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে হয়।ভালোবাসা কেনো বুঝেশুনে মনের ভিতর বিরাজ করে না?”
এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই।আসলেই তো ভালোবাসা কেনো ভুল মানুষের প্রতি আসে।আমরা জেনে শুনে তো ভালোবাসি না।এই যে বীর সেও ভালোবাসলো।যাকে ভালোবাসলো তাকে পেলো না।পাবে না বলেই নিজেকে হার মানিয়ে বিদায় নিলো।যেখানে সে লড়াই করতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে।এক নিষিদ্ধ প্রেমের কারণে নিজের জীবনটা শেষ করে দিলো।জারা যে কি না অন্যের সংসার ভাঙতে এত চেষ্টা করে।দিন শেষে সেও একজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হসপিটালে ভর্তি।আর আজ হিয়া।এক নষ্ট পুরুষের প্রতি আসক্ত হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে।এদের কাছে ভালোবাসা নিজে থেকে এসেছে।এরা তো ডেকে ডেকে আনেনি ভালোবাসা।
মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ৪৫
আজ মিডিয়াতে মোহন সরদার ও সোনালীকে নিয়েও কথা উঠেছে।মোহন সরদার পুরো ভেঙ্গে পড়েছে।পুরনো পাপ আবারও ফুটে উঠেছে।আজ তার ছেলের জন্য তার পাপের বোঝা বেড়ে গেলো।এই ছেলের জন্যই তো সে তার বউ আর মেয়েকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।সবাই মিলে ভিতরে চলে যায়।জেসি তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।গাড়ির কাছে এসে পিছনে ঘুরে দাড়ালে দেখতে পেলো আয়রাকে।আয়রা জেসিকে দেখে তার চোখ টিপ দিলো।জেসি নিজেও আলতো হেসে গাড়িতে উঠে পড়ে।