মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৫৩+৫৪
ইশরাত জাহান
হাসপাতালে আজ একমাস হয়ে গেলো ভর্তি আছে মায়া।চিকিৎসা চলছে সেই সাথে ব্রেনে আঘাত লাগায় মায়ার ছটফটানি বাড়ছে।তার মন্ত্রীর প্রাণকে উদ্ধার করতে না পারার কষ্ট মায়ার মাঝে কম নেই বরং সবার থেকেও বেশি।কারণ শেষ মুহূর্তে বাচ্ছাসুলভ তাজকে মায়াই হাত বাড়িয়ে দেয় বাঁচানোর জন্য।ফলাফল শূন্য হওয়ার কারণে মায়ার ব্রেনে দ্বিতীয়বার চাপ সৃষ্টি হয়।সেই সাথে মাথায় বাঁশের আঘাত।সেগুলোই বারবার মস্তিষ্কে চলাচল করছে।চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হওয়া সত্ত্বেও মায়ার উপর প্রভাব ফেলছে না।স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছে।রাজ আসেনি প্রথম এক সপ্তাহ।তাজকে খুঁজে চলেছে।মাহমুদ সরদার চুপচাপ এক কোণায় বসে থাকেন।মালিনী তেমন একটা পাত্তা দেয়না।
সিয়া আসে মায়াকে সেবা করে আবার রাজকে দেখে কান্না করে।জারা এখন সুস্থ।বীর জারাকে নিয়ে নিজের বাংলোতে থাকে।সেই সাথে খোঁজ চালাচ্ছে আরশাদের। সেদিন তাজকে কিডন্যাপ করে আরশাদ বুঝেছিল তার জীবন ঝুঁকিতে।কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেওয়া জরুরি।এত কাঁচা খেলোয়াড় আরশাদ না।একদিকে পুরো সরদার পরিবার বিপদের মুখে আরেক দিকে আরশাদ গা ঢাকা দিলো।তারেককে গোপনে সেবা করে মিলি।মৌ এখন রিস্ক সময় কাটাচ্ছে।পেট হালকা ভারী হয়ে উঠেছে।পিয়াশ যথেষ্ঠ সময় ব্যয় করে মৌয়ের পিছনে।রাজ কিছুই বলেনা বরং সুযোগ করে দেয়।মায়ার প্রাণ ভোমড়া মৌ।তাই পিয়াশের এদিক থেকে কপাল খুলে গেলো।রুদ্র দিনরাত এক করে খোঁজ করছে তার হিয়াপাখির।খান বাড়ি মানে বীরের দাদু বাড়ি আর রাজের নানা বাড়িতে গিয়ে হিয়াকে পায়নি রুদ্র।মালিনীর কাছে হিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে একটাই কথা বলে,”হিয়াকে আমি খান বাড়িতে রেখেছিলাম।ও এখন কোথায় আমি সত্যিই জানি না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রুদ্র এখন উপর মহল থেকে হিয়ার নিখোঁজের জন্য একটা এপ্লাই করে।তারপর সেদিকে তদন্ত চালানো হচ্ছে।কেউই হাত পা গুটিয়ে বসে নেই।আদ্র আছে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট এর সুযোগে।এই পুরো মুহূর্ত দেখে মজা নিচ্ছে সোনালী।সে তো চায় সরদার মহলের প্রত্যেকে এভাবে অচল হয়ে পড়ুক।এটার সুযোগ খুঁজেছিল সোনালী এতদিন।মিহিরের ঘরে এসে বসেছে মাত্র।মিহির এখনও মায়াকে নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে।মায়ার কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।এদিকে রুবি এখনও মোহনা সেজে সরদার বাড়িতে পড়ে আছে।মিহিরের সামনে গেলেই রুবি তিক্ত বানী ছুঁড়ছে।বিশেষ করে কিছুদিন আগেই রুবির একটা মিসকারেস হয়।বিয়ে ছাড়া বাচ্চা!বিশ্রী লাগে এসব শুনতে।রুবি পাপ করেছে।
মিহিরের প্রেমে পড়ে তার প্রেমে অতি মাত্রায় প্রভাবিত হয়ে পাপ করেছে।এক হাতে তালি বাজে না।রুবির এই কাজটাও রুবির ইচ্ছাকৃত ছিল।যতই সে মিহিরকে অন্ধ বিশ্বাস করুক মিহিরকে হারানোর ভয় হোক না কেন,মিহিরের সাথে বিয়ের আগে এই সম্পর্ক তার করা উচিত হয়নি।নিজের শরীরকে মূল্যহীন করে দিলে তার প্রতিদান তো দিতেই হবে।রুবিকেও দিতে হয়েছে।সেদিনের পর থেকেই মিহিরের প্রতি ঘৃণা রুবির।ভাগ্য ভালো এই সময়টা রুবি শিবচরে থাকেনা।থাকলে বাবা মায়ের সম্মুখে এই পরিস্থিতি ঘটলে মুখ লুকানোর জায়গা পেতো না রুবি।বাচ্চা নষ্ট হবার ব্যাপারটা শুধু তিনজন জানে।সোনালী মিহির আর রুবি।ঘরের এক কোণায় হাত ভাজ করে অন্য মুখে রুবি দাড়িয়ে আছে।সোনালী কিছুক্ষণ দুজনকে দেখে বলে ওঠে,”শোনো মোহনা ওটা তোমার অজানা কারণে ভুল হয়েছিল।আর আমার তো এতে আপত্তি নেই।তুমি আর মিহির তো বায়োলজিক্যাল না।মিহির ভুল করেছে তোমাকে হার্ট করে।আমি ওকে পানিশমেন্ট দিবো।”
রুবি ফিচেল হেসে বলে,”আমাকে কি ছোট বাচ্চা মনে হয় আপনার?একটা চকলেট দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজের করে নেওয়ার মত সস্তা মেয়ে মনে হয়?অবশ্য আপনার ছেলে তো আমাকে একই ট্রিক দিয়ে নিজের ফাঁদে ফেলেছিল।তার জন্য পস্তাতে হলো আমাকে। আর কত এই চাল চালবেন বলবেন?আমি এবার নিজের কাজে ফিরতে চাই।আপনাদের এই নোংরা খেলা আমার আর ভালো লাগেনা।”
মিহির এবার উচ্চস্বরে বলে ওঠে,”এক্সাক্টলি মম।এই মেয়েটার না মনে আছে তার অতীত আর না এই মেয়েটা আমাদের কোনো কাজের।পুরোই বাবার মত ওয়েস্ট।ওকে বের করে দেও বাড়ি থেকে।ও কোনো কাজেরই না।”
রুবি এবার একটু ভয় পেলো।এই বাড়ি থেকে বের করে দিলে মায়ার কাছে কি জবাব দিবে রুবি?মায়ার অনুমতি ব্যতীত রুবি এক পা সরাতে পারবে না।এদের মা ছেলের মাঝে থেকে যে সমস্ত ইনফরমেশন রুবি পায় সব তো মায়াকে জানায়।এখন তো আরও জানাতে চায় রুবি।এই মিহিরের জঘন্য অবস্থা নিজ চোখে দেখতে চায়।তাই বুদ্ধি খতিয়ে বলে,”যাবো তো আমি বটেই।তবে আমার পরিচয় যখন পেয়েই গেছি তখন আমার ভাগের অংশ নিয়েই যাবো।এই সরদার মহলের অর্ধেক প্রপার্টি মহসিন সরদার তার মায়াবতীর নামে লিখেছে।কিছু মনে না থাকলেও বাবার থেকে এগুলো খুব ভালো করে জানি আমি।দাদুর একটা ইচ্ছা পূরণ না হলেও আরেকটা ইচ্ছা পূরণ হবে।আমার মন্ত্রীকে দরকার নেই সম্পত্তি পেলেই হবে।শুধু সম্পত্তি না আমি তো আমার বাবার ব্যবসার হাত ধরবো ভাবছি।কারণ আমিই তো তার একমাত্র মেয়ে।এই মিহির তো বায়োলজিক্যাল না।”
সোনালী শুকনো ঢোক গিলে বলে,”তুমি কিভাবে জানলে?”
“আপনি কি মনে করেন নিজেকে?ইঙ্গিতে শুধু বায়োলজিক্যাল বলতে মায়ের ডিএনএ ম্যাচ করেনা এটাই বুঝিয়ে দেন আর আমি বুঝে গেলাম?আমি খুব ভালো করেই জানি মিহিরের শরীরে শুধু শাহানা পারভীন না মোহন সরদারের রক্তও নেই।মিহির আপনার অবৈধ সন্তান ঠিকই কিন্তু সরদার বংশের না।”
“প্রমাণ কি তোমার কাছে?”
মিহিরের কথা শুনে রুবি স্মিত হেসে বলে,”তোমাদের ডিএনএ টেস্ট করালেই তো প্রমাণ আসবে।যদিও আমি জেনেছি তোমাদের গোপণ কথা শুনেই।”
সোনালী হালকা হাসি দেখিয়ে রুবির কাধে হাত রেখে বলে,”তুমি তো তোমার বাবার সম্পত্তি চাও তাই না?”
রুবি মাথা উপর নিচ করে।সোনালী মিহিরকে ইঙ্গিতে চুপ করতে বলে রুবির উদ্দ্যেশে বলে,”তোমার বাবা তো তার সম্পত্তি রাজকে দিয়ে দিয়েছে।রাজের কাছে বিক্রি করেছে।ওই যে ব্যবসা ওটার জন্যই।এখন এই মহলে আমরা আছি শুধু সরদার পদবী আছে বলেই।সবকিছু দেখতে গেলে সম্পত্তির মালিক এখন একজন।শাহমীর রাজ সরদার।যার সম্পত্তির অধিকার এখন তার বউয়ের ও ভবিষ্যৎ বাচ্চার।বাচ্চা না আসলেও শাহমীর রাজের বউ কিন্তু এসেছে।দুর্ভাগ্যবশত মোহনা নামক মায়াবতী না মায়া নামক মায়াবতী।ওই রাজের মায়াবতী তো তুমি নও এখন মায়াবতী তো ওই মায়া।তাহলে তোমার সম্পত্তি পেতে হলে কি করা উচিত বলো তো?”
“কি করা উচিৎ আমার?”
“মায়াকে তোমার রাস্তা থেকে সরানো।তবেই না সম্পত্তি পাবে।”
ভ্রুকুটি করে রুবি বলে,”কিভাবে?”
“মায়ার জায়গা মোহনা নিবে।রাজকে মোহনা বিয়ে করলে সম্পত্তি সব মোহনা পাবে।তখন তুমি তোমার অধিকার পেলে আর কি।”
“এর মানে আমাকে মায়া ম্যা….. মায়ার এগেইন্সে যেতে হবে?”
“হ্যাঁ।”
রুবি উল্টো দিক ফিরে শুকনো ঢোক গিলছে। এ কম ফেঁচাদে পড়ল সে!মায়ার হয়ে কাজ করতে এসে মায়ার বিরুদ্ধে যেতে হবে!মায়ার অগ্নিরূপের কথা ভাবলেই এখানে গা কাপছে।তাও বর্তমান সামাল দিতে বলে,”ওকে ফাইন।তবে তাই হোক।”
সোনালী একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।মিহির পাত্তা না দিয়ে নিজের মত মায়ার কথা ভাবছে।রুবি যদি রাজকে বিয়ে করে তবে মিহিরের রাস্তা ফাঁকা।মায়ার মত মেয়েকে ভাগ্যে পাওয়া অনেক ব্যাপার।সোনালী এখন তাকে সুবর্ণ সুযোগ করে দিচ্ছে।এটাই কাজে লাগাবে মিহির। মায়ারাজ আলাদা হলে সবারই ভালো।মুখে মৃদু হাসি ফুটলো মিহিরের।
প্রতিদিনের মত এদিক ওদিক বাইক নিয়ে ঘুরছে রুদ্র।হিয়াকে নিয়ে মালিনীর কাছে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো উত্তর জানা গেলো না।হিয়ার কলেজের সমস্ত বন্ধু বান্ধবীদের বাসায় গিয়ে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে।মন্ত্রীর বোনের পরিচয়ের জন্য রুদ্রের সুবিধা মিলছে জিজ্ঞাসাবাদে কিন্তু রুদ্র হিয়ার খোঁজ পেলো না। মাঝ রাস্তায় ফোন বেজে উঠলো রুদ্রের।বাইক থামিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে রাজের কল।রিসিভ করতেই রাজের কর্কশ কন্ঠে শুনতে পায়,”আমার বোনের খবর পেলি?”
রুদ্র নীরবে নিশ্বাস নেয়।উত্তর দিতে পারছে না।বারবার একই ভঙ্গিতে উত্তর পেতে পেতে রাজ নিজেও অভ্যস্ত।কান থেকে ফোন সরিয়ে কেটে দিলো কল।পিছন থেকে মাহমুদ সরদার সোফায় বসা অবস্থায় বলেন,”এবারও কি চুপ?”
রাজ মাথা উপর নিচ করে।মালিনী চোখের পানি মুছে বলে,”আমি তো ওকে খান বাড়িতেই রেখে এসেছিলাম।এরপর কোথায় গেলো মেয়েটা কিছুই তো বুঝলাম না।”
সোনালী সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এদেরকে দেখে মালিনীর কাছে এসে মালিনীকে শান্তনা দেয়।রাজ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বাইরে বের হলো।মায়ার কাছে যাবে এখন সে।বাইরে বের হতেই আকাশে বিকট শব্দ করে বিন্দু বিন্দু পানির দেখা দিলো।রাজ গাড়িতে উঠে বসে।সেই সাথেই চারপাশ বৃষ্টিতে ঘিরে ধরলো।রাজ বৃষ্টির পানি দেখছে।গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার।রাজের এখন বক্ষ ফাঁকা লাগছে।শূন্য বক্ষে হাত বুলিয়ে বলে,”আমার বক্ষে তোমাকে প্রয়োজন মায়াবতী।এবার তোমার শান্তির জন্য না এবার তোমার মন্ত্রীর শান্তির জন্যে।”
বলেই সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দিলো এক টান।সমস্ত ধোঁয়া জানালার বাইরে যাচ্ছে।গাড়ির জানালার ভিতর দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ঢুকছে।রাজের চোখমুখ ভিজে এসেছে।ভালো লাগছে বেশ।বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোটার সাথে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানো মুহূর্ত।মায়াবতী জানলে তার খবর করে দিতো।মায়া একদম সহ্য করতে পারেনা রাজের ধূমপানকে।বিশ্রী গন্ধ লাগে মায়ার কাছে।রাজ কখনও মায়ার সামনে ধূমপান করেনি।এখন মায়া কাছে নেই বলেই এই দুঃসাহস দেখাচ্ছে।ভাবতেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখা দেয় রাজের।
বাইকের পিছনের দিকে মাথা এলিয়ে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে রুদ্র।হাঁপিয়ে উঠেছে হিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে।একমাস ধরে নিখোঁজ মেয়েটা।বুকটা ফাঁকা হয়ে আছে।হিয়াকে হারাবার কষ্ট যদি মাহমুদ সরদারের পর কারো বেশি থাকে তবে সেটা রুদ্রের।খেয়ে না খেয়ে হিসাব মিলিয়ে যখন যার কথা মনে পড়ে তার কাছে চলে যায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে।অনেক অনেক ক্রাইম এরিয়াতেও তদন্ত করেছে।বৃষ্টি ভেজা আকাশের দিকে চোখ রেখে বিন্দু বিন্দু পানির কারণে চোখ পিটপিট করে রুদ্র।তবুও চোখটা মেলানোর চেষ্টা করে বলে,”হিয়াপাখি কোথায় তুই?তোকে যে খুব করে চায় তোর নষ্ট পুরুষ।এই নষ্ট পুরুষকে একটাবার শুদ্ধতায় ঘিরে দিতে পারলি না রে!শুধু পারলি অপমানে জর্জরিত করতে।”
হিয়ার মিষ্টি হাসির মুখশ্রী সেই সাথে রাগের মুখশ্রী কল্পনা করে রুদ্র চোখ বন্ধ করে।তখনই মেঘ ডেকে ওঠে।বজ্রপাত হয় খুব জোড়ে।রুদ্র ঠোঁট কামড়ে হেসে গাইতে শুরু করে,”দেখলে তোকে….বদলায়ে দিন, বদলায়ে রাত, বদলায়ে ঘুম,সঙ্গে সময়।
সন্ধ্যে হলে…বন্ধ ঘরে…মনে পড়ে তোরই কথা,
এমনই হয়….
কেনো যে তোকে পাহারা পাহারা দিলো মন?
কেনো যে এত সাহারা সাহারা সারাদিন?
কেনো যে তোকে পাইনা পাইনা মনে হয় সারাটাদিন?”
গান শেষ করতেই রুদ্রের চোখ ভিজে আসে।এই ভেজা চোখ কেউ দেখতে পায়না।আজ আকাশটাও রুদ্রের সাথে কান্না করছে।এতে রুদ্রের সুবিধা।চোখ থেকে গড়িয়ে যাওয়া সমস্ত পানি আকাশ্রের পানি ধুয়ে দিচ্ছে।এখন তার হিয়াপাখির প্রয়োজন নেই।থাকলে হয়তো হিয়াপাখি বলতো,”নষ্ট পুরুষের চোখে পানি মানায় না রুদ্র ভাই।তাদের চোখে তো শর্ট ড্রেস পড়া সুন্দরী মেয়েদেরকেই মানায়।”
রুদ্র সেই কথাতে গা দোলানো হাসি দিতো।জিতিয়ে দিতো হিয়াকে তিক্ত কথাগুলো শুনে। তাতেও শান্তি পেতো রুদ্র যদি হিয়া তার চোখের সামনে সুরক্ষিত অবস্থায় থাকতো।এখন কেমন আছে হিয়া?ভালো আছে তো?তার নষ্ট পুরুষের কথা কি মনে পড়ে?নাকি সব ভুলে গেছে শুধু বিপদের মধ্যে বাবা আর ভাইকে মনে করছে?রুদ্র চাতক পাখির মত খুঁজছে শুধু তাকে।এই রুদ্রের ভালবাসা বুঝবে তো হিয়া নাকি এবারও গোপনে ভালোবেসে যাবে?
দেয়াল টপকে মাত্র বাড়ির ভিতরে আসলো জারা।ভিতরে এসে গাউনের মধ্যে হাত রাখতেই কর্কশ কন্ঠ ভেসে ওঠে,”কোথায় গিয়েছিলে জানেমান?”
জারা কেঁপে উঠলো কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”তুমি কখন আসলে?”
বীর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সোফা থেকে উঠে জারার কাছে এগিয়ে এসে জারার দুই বাহু চেপে নিজের অতি নিকটে আনে।রক্তিম চোখজোড়া জারাকে ভয় পাইয়ে দেয়।ভালোবাসে বলেই হারানোর ভয়।এছাড়া বীরের হিংস্র ভালোবাসার ভয় জারা পায়না।জারার মাঝে ভয়ের ছাপ নেই বলে বীর জারার থুতনি চেপে ধরে বলে,”আবারও কিছু গোপন করতে চাইছো বুঝি?একবার আমাকে নিয়ে ডেয়ার দেখানো,তারপর আমাকে ধোঁকা দেওয়া,নিজের আসল মাফিয়া দেখানো।এতকিছু কি কম নাকি যে আবারও নতুন প্ল্যান আটছো!মগজে একটা কথা ভালো করে ঢুকিয়ে রাখো যত বড় চাল চালো না কেন তুমি আমারই থাকবে।আমার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ হবার আগ পর্যন্ত তোমার নিস্তার নেই জানেমান।”
জারার চোখ দিয়ে গলগল করে পানি পড়ছে।জারা আবেগে বলেই দেয়,”যেদিন তোমার থেকে তোমার মূল্যবান সম্পদ আমি তছনছ করে দিবো সেদিনও কি পারবে আমাকে নিজের করে রাখতে?”
বীরের হাত আলগা হয়ে আসতে নেয় জারার এহেন কথাতে।জারা বুঝতে পেরে সরে যেতে নিলেই বীর আবারও জারাকে শক্ত করে ধরে নিজের মাঝে লেপ্টে নেয়।মুখে কিছু বলেনা।জারার মুখটা বীরের বুকে এসে আটকে গেলো।জারার কানের লতিতে ছোট্ট করে কামড় দিলো বীর।জারা একটু কেঁপে উঠলেও মৃদু হাসলো।বীর ফিসফিস করে বলে,”আমার মূল্যবান সম্পদ তো তুমি নিজেই।”
জারা নিশ্চুপ হয়ে নরম চাহনি দিলো।বীরের মুখে নিজের কথা রোমাঞ্চকর বানী দিয়ে ফেরত পেলো।এখন কিছুই বলার নেই জারার।
হাসপাতালে এসে মায়ার কেবিনে মাত্রই পৌঁছালো রাজ।মায়ার জ্ঞান ফিরেছে ঘণ্টা দুই হবে।রাজ আসতে দেরি করেছে।হাসপাতালে পৌঁছে মায়ার কেবিনে ছুটে এলো।মায়া বেডে শুয়ে আছে।কপালে ব্যান্ডেজ করা।হাতে ক্ষতগুলোর দাগ আছে কিন্তু ব্যাথা নেই।উন্নতমানের চিকিৎসা পেলে কি আর এই কাটা ছেড়া থাকে?রাজ ছুটে এসে মায়াকে জড়িয়ে ধরে।রাজের নিশ্বাসের সাথে সিগারেটের গন্ধ মায়ার নাকেমুখে বাড়ি খাচ্ছে।মায়া ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো রাজকে।রাজ দূরে সরে গেলে একটু অবাক চাহনি দেয়।মায়া নাক সিটকে বলে,”কে আপনি?”
রাজ অবাকের সাথে বলে,”মায়াবতী?”
রাজ একটু এগিয়ে আসতে নিলেই মায়া বলে ওঠে,”এভাবে অন্যের হবু বউকে জড়িয়ে ধরাটা কি আপনার শোভা পায়?তাও আবার আমার হবু বরের সামনে।”
রাজ যেনো ঘোরে গেলো।কি বলছে মায়া কিছুই বুঝতে পারল না।রাজ অবাক চাহনি দিয়েই আছে।মায়া আবারও বলে তবে এবার রাজের পিছনের দিকে মাথা বেকিয়ে বলে,”দেখো না মিহির উনি তোমার সামনেই অসভ্যতা করছে।তুমি কিছু বলবে না?তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?”
রাজ পিছনে ঘুরে মিহিরকে দেখে আরো বেশি অবাক হলো।সোফায় হাঁটুর উপর পা দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বসে আছে মিহির।এক ভ্রু উচু করে রাজের দিকে ভিলেনি হাসি দিলো।রাজ হাত মুঠ করে মিহিরের দিকে এগিয়ে সোজা মিহিরের গলা টিপে ধরে বলে,”শুয়োরের বাচ্চা তোর সাহস কত বড় তুই আমার বউয়ের দিকে নজর দিশ!তোর এই রুহু আমি তোর শরীর থেকে আলাদা করে দিবো।”
মিহির খুঁকখুঁক করে কেশে ওঠে।মায়া হাইপার হয়ে ওঠে। বেড থেকে উঠে কোনরকমে রাজের হাত ধরে খামচে বলে,”ছাড়ুন ওনাকে।আপনি ওনাকে মারছেন কেন?”
রাজ অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে মায়ার দিকে ফিরে বলে,”তুই এই কাপুরুষের জন্য আমার সাথে ঝগড়া করছো মায়াবতী? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া হু ইজ হি?”
“হি ইজ মাই ফিয়ন্সি।”
“বিবাহিত মেয়ের কোনো হবু বর থাকেনা।এই ছোট্ট বিষয়টা কি তোমার মাথায় আঘাতের সাথে নিঃশেষ হয়ে গেছে?”
মায়া চোখ ছোট ছোট করে বলে,”কে বিবাহিত?আমি বলেছি আমার হবু বর মিহির।তাহলে আমি বিবাহিত হই কিভাবে?”
রাজ মায়ার দিকে চোখ স্থির রেখেছে।মাথায় আঘাত পেয়ে কি তাহলে মায়ার স্মৃতি গেলো!ভাবছে রাজ।এই দুই ঘণ্টার মাঝে কি তবে মিহির মায়ার মাথায় সুযোগ বুঝে অন্যকিছু ঢুকিয়ে দিলো?আসলেই তো তাই।নাহলে কি মায়ার মত মেয়ে মিহিরকে হবু বর বলতে পারে?রাজকে না চিনে অন্য কাউকে নিজের হবু বর বলা মানে তো এটাই যে মায়ার কিছুই মনে নেই।মিহিরকে ছেড়ে দিয়ে রাজ কল করে আদ্রকে।আদ্র রিসিভ করেনা।সে এখন অন্য জায়গায় ব্যাস্ত।সিডিউল অনুসারে অন্য জায়গায় সার্জারি চলছে আদ্রর।কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য একজন ডাক্তার এলো।রাজ তাকে দেখে চোখে কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে বলে,”কি হয়েছে আমার বউয়ের?”
ডাক্তার শুকনো ঢোক গিলে বলে,”ওনার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে। সরি টু সে উনি কিছুই মনে রাখেননি।”
রাজ আঙুল উঁচিয়ে মিহিরকে দেখিয়ে বলে,”ও এখানে কি করে এলো?”
“দেখুন আপনারা তো বাইরের মানুষ এলাউ করতে দিবেননা কিন্তু সরদার পরিবারের মানুষ তো এলাউ।আমি সরদার পরিবারের মানুষকে না বলি কিভাবে?তাই রোগীকে দেখতে আমি সবার প্রথমে যাকে পেয়েছি তাকেই ঢুকতে দিয়েছি।”
রাজ জোরে জোরে দুটো নিশ্বাস নিয়ে মিহিরের দিকে ফিরে তাকালো।মিহিরের পাশে মায়া দাড়িয়ে আছে।মিহির মায়ার দিকে একবার তাকিয়ে রাজের দিকে চোখ রেখে দাঁত কিড়মিড় করে হেসে বলে,”বাড়িতে যাবে না বেবী ডল?”
মিহিরের মুখে বেবী ডল শুনে রাজ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে মিহিরের বামপাশের বুক বরাবর দিলো এক লাথি।মিহির মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মেঝেতে।মায়া বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।ডাক্তার নিজেও ভয় পেলেন।রাজকে তো চেনে সবাই।মায়া জ্ঞান হারালে কি হবে!বাকিরা খুব ভালো করেই জানে শাহমীর রাজ কি?মায়া এগিয়ে এসে যেই মিহিরকে ধরতে নেয় ওমনি রাজ শক্ত করে মায়ার হাত ধরে।মায়া ব্যাথা পেয়ে বলে,”হাত ছাড়ুন আমার ব্যাথা লাগছে।”
“তার থেকেও বেশি আমার ব্যথা লাগছে।তোমার তো হাতে আমার সোজা এই জায়গাটায়।”
রাজের বুকের বামপাশটায় ইঙ্গিত করে বলে।মায়া হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বলে,”অন্যের হবু বউয়ের দিকে নজর দিবেননা।আমি কিন্তু এসব নোংরামি সহ্য করতে পারিনা।”
“ওহ রিয়েলী!তোমার এসব নোংরামি সহ্য হয়না বুঝি?তাহলে দেখা যাক কেমন অসহ্যকর লাগে তোমার এই নোংরামিতে।”
বলেই মায়ার হাত ধরে নিজের কাছে এনে মায়াকে কোলে নিয়ে বাইরে যেতে নেয়।মায়া পা লাফাচ্ছে।রাজকে দুই হাত দিয়ে কাধের দিকে মেরেই চলেছে।রাজ ব্যাথা পেলেও সহ্য করে নিচ্ছে।মায়ার মুখে একটাই কথা,”ছাড়ুন আমাকে ছাড়ুন বলছি।আমি আপনাকে খুন করে দেবো বলে দিলাম।”
“তুমি আমাকে খুন করতে পারবে না মায়াবতী বরং আমার জন্য অন্য কাউকে খুন করতে পারো।”
“আপনি কে যে আমি আপনার জন্য অন্য কাউকে খুন করবো?”
“আমি তোমার স্বামী তোমার মন্ত্রী মশাই শাহমীর রাজ।”
“আমি অবিবাহিত আমার স্বামী নেই।হ্যাঁ আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।মিহির আমার হবু বর।আপনি কেন আমাদের মাঝে আসছেন?”
রাজের পা আটকে গেলো।মায়ার মুখে এসব শুনে রাজের কপালের শীরা ফুলে উঠেছে।এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও এখন মায়াকে পাশের আরেকটা কেবিনে নিয়ে ছুঁড়ে মারে ফাঁকা বেডে।পকেট থেকে ফোন বের করে ওদের বিয়ের ছবি দেখিয়ে বলে,”লুকস আমাদের বিয়ের ছবি।আমি তোমার স্বামী হই অন্য কেউ না।ওই মিহির মিথ্যা কথা বলেছে তোমাকে।ও তোমার স্বামী না বরং ও তোমার বা…..
রাজ আরও কিছু বলতে নিবে মিহির বলে ওঠে,”ওগুলো এআই দিয়ে এডিটের ছবি।রাজের সবসময় তোমার দিকে কুনজর লেগেই থাকে বেবী ডল।ও এসব ছবি বানিয়ে তোমাকে ব্ল্যাকমেল করে আমার থেকে আলাদা করতে চেয়েছিল।আমি ছবিগুলো বিশ্বাস করিনি বলেই তোমার উপর হামলা করে।এরপর তোমার আর কিছুই মনে পড়ছে না।”
রাজ চোয়াল শক্ত করে।মায়ার নজর রাজের চোয়ালের দিকে।মায়া রাজকে দেখে বলে,”মিথ্যা বলে আমাকে আপনি বিভ্রান্ত করতে পারবেন না।মিহির আমাকে ভালবাসে।আমাকে টেক কেয়ার করে।ও আমাকে এতটাই বিশ্বাস করে যে আমার এসব নকল ছবি দেখেও ও আমাকে ছেড়ে দেয়নি।আমি তাহলে কি করে ওল অবিশ্বাস করি?আপনি চলে যান।সরে যান আমাদের জীবন থেকে।”
রাজ এবার হুংকার দিয়ে প্রথমবারের মত মায়ার সামনে রক্তিম চাহনি দিয়ে বলে,”আব্বে এই মায়াবতী।”
বলেই মায়ার চোয়ালে হাত রেখে বলে,”যা কিছু বলছো সব কিন্তু তোমার মনের কথা না।এই সবকিছু তোমার নিউরনে চাপিয়ে দেওয়া কথা।তাই মাফ করে দিলাম আমাদের বিচ্ছেদের কথা তোমার জবানে আনার জন্য।এই শাহমীর রাজ তার মায়াবতীর ইচ্ছা পূরণ করবে মানে এই না যে শাহমীর রাজের জীবন থেকে তার মায়াবতীর অস্তিত্ব মুছে ফেলবে।এটা কোনোদিন সম্ভব না।”
মায়া এবার উত্তেজিত হয়ে গেলো।রাজের মুখ থেকে আসা সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ সাথে রাজের তেজ দেখানো কথা সহ্য হলো না।এক প্রকার ছোটাছুটি করতে করতে অজ্ঞান হয় মায়া।ডাক্তার এগিয়ে এসে মায়াকে দেখে। নার্স এসে মায়াকে আগের কেবিনেই নিয়ে গেলো।ঠিকভাবে শুইয়ে দিলো বেডে।কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বাইরে এসে দাড়াতেই রাজ বলে,”কি হয়েছে ওর?”
“ওনার জ্ঞান ফেরার পর মেমোরিতে প্রথমেই ঢোকানো হয় উনি মিহির সরদারের হবু বউ।তাই এটা অসম্ভব হলেও মানতে হবে যে উনি যেটা বিশ্বাস করেছেন ওটা অতি দ্রুত মিথ্যা প্রমাণ করা যাবেনা। এতে ওনার ব্রেনে চাপ পড়বে।পরপর দুইবার আঘাত লাগায় ওনার মানসিক সমস্যা আছে।উনি বলতে গেলে একজন সাইকো।যার মধ্যে একবার যেটা সত্যি বলতে দাবি করানো হয় তা শত চেষ্টায়ও মিথ্যা করা সম্ভব হয়না।”
“এখন আমার করণীয়?”
“ওনাকে আপাতত একটু ফোর্স কম করা।উনি যেটাতে বিশ্বাসী সেটাতেই সায় দিতে হবে।ধীরে ধীরে তাকে বোঝাতে হবে সে যেটা জানে সব মিথ্যা।এখন কিছু বললেই হাইপার হয়ে উঠবেন উনি।নিজের ক্ষতিও করে দিতে পারেন।তখন হয়তো আপনি মিসেস মায়াকে চিরদিনের জন্য হারাবেন।”
রাজ এবার দুর্বল হতে শুরু করে।পিছিয়ে গেলো ধীরে ধীরে।রাগে দুঃখে দেয়ালে কয়েকটা ঘুষি দেয়।যার প্রত্যেকটা ব্যাথা রাজের হাতে লাগছে।ডাক্তার এগিয়ে এসে নার্সকে ডেকে বলে,”ওনার হাতে ব্যান্ডেজ করে দেও।”
নার্স এগিয়ে আসতে নিলে রাজ হাত উঁচিয়ে হুংকার দিয়ে বলে,”আমার বউকে চিনিস তো তোরা?আস্ত এক বাঘিনী সে।আমার আশেপাশে কাউকে দেখতে পারেনা।আমার হাত ধরলেই সেই নারীকে কোমায় পাঠিয়ে দেয় আমার মায়াবতী।তাই সাবধানে থাক।আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখ তোরা।”
ডাক্তার কাপা কাপা গলায় বলে,”কিন্তু আপনার হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে।”
“এটা সামান্য ক্ষত যার রক্ত দেখতে পাচ্ছিস সচক্ষে আর করুণা করছিস।যে ক্ষত আমি ছোট্ট থেকে বয়ে বেড়াচ্ছি তার তো রক্ত দেখা যায়না।এই জন্য করুণা করতে পারছিস না।এক মায়াবতীকে আগলে নিয়ে সারাজীবন পারি দিবো ভেবে এসেছি।এখন সেও আমাকে ভুলে গেলো।আমার আর থাকলো টা কি?”
রাজের রক্তিম চোখ দিয়ে হালকা পানির দেখা দিলো।ডাক্তারের করুণা হলো।ছুটে এলো আদ্র।রাজকে দেখে ডাক্তারের দিকে ফিরে বলে,”কি হয়েছে?”
ডাক্তার সব খুলে বলে।সব শুনে আদ্র এক পলক মিহিরের দিকে বিরক্তিকর চাহনি দেয়।রাজকে দেখে আদ্রর খারাপ লাগছে।এই ছেলেটা অল্প বয়সে মাকে হারালো।বাবার দ্বিতীয় বিয়ে দেখলো।এরপর বাবার থেকে ভালোবাসা পেলো না।দাদা একমাত্র ভালোবাসতো সেও অসুস্থ হতে শুরু করে।শাহানা পারভীন যে কিনা মায়ের আদর স্নেহ দিতো সেও প্রেগনেন্ট হয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।এরপর মায়াকে দেখে রাজের দুনিয়া পাল্টে গেলো।মহসিন সরদার রাজকে সবসময় বলে এসেছেন,”আমার মায়াবতী আমাদের বংশের প্রথম কন্যা সন্তান।আমার নয়নের মণি মোহনা সরদার।যাকে আমি মায়াবতী বলে ডাকবো।”
দাদুর থেকে শুনে রাজও মায়াকে মায়াবতী বলে ডাক দেয়।যত বড় হয় একসাথে মাটির পুতুল নিয়ে বর বউ খেলে।এমনকি মায়া রাজ দুজনেই ছোট বেলায় ছোট ছোট লাল বেনারসি ও সাদা পাঞ্জাবি দিয়ে বর বউ সেজে কতবার যে তিন কবুল বলে খেলেছে তা গুণে শেষ হবেনা।রাজ ধীরে ধীরে প্রাপ্ত বয়স্ক হতে থাকে।তখনই মায়ার জন্য আলাদা অনুভুতি দেখা দিলো।মায়াকে বউ রূপে মানতে রাজি হয় রাজ।সবাই সাক্ষী হয় ওদের বাল্যবিবাহে।এটা মহসিন সরদারের একটা আলাদা বুদ্ধি বলা চলে।তিনি বুঝতে পারেন রাজ লন্ডনে গেলে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটবে।তাই রাজ যাওয়ার আগে গ্রামের দিকে এসে গোপনে বিয়ে দিয়ে রাখেন।
সেই মায়াকে আড়ালে আবডালে নিজের কাছে রেখেছে রাজ। মায়াকেও বুঝতে দেয়নি।মায়ার জীবনের সফলতা দেখার অপেক্ষায় ছিল শুধু।যেই মায়া ঢাকায় নিজের শোরুম উদ্বোধন করেছে রাজ আর অপেক্ষা করতে চাইলো না।নিজের বউকে সবার সামনে নিজের করতে চাইলো। বীর জারাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাজ নিজের মত করে মায়াকে বুদ্ধি করে বিয়ে করে।যেই মায়ার জন্য জীবনের এতগুলো বছর একাকিত্বে পার করে দিলো আজ সেই মায়া তাকে ভুলে গেছে।রাজের জন্য এটা কতটা যন্ত্রণার এটা শুধু রাজের স্থানে নিজেকে কল্পনা করলেই বুঝতে পারবে।আদ্র এসে রাজের কাঁধে হাত রেখে বলে,”ধৈর্য ধরো ব্রো।সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমার মায়াবতী আমাকে ভুলে গেলো।এটাও দেখার বাকি ছিল!”
“পরিস্থিতি এগুলো দেখাতে বাধ্য করেছে।”
“আমার যদি বুকের ক্ষতটা গভীর না থাকত তাহলে সেদিন আমিও মারামারি করতে পারতাম।সেদিন তো আমার এই গুলি লাগা ক্ষততেও ওরা লাথি মারে।….
রাজ আরও বলতে নিলে আদ্র অবাক হয়ে।রাজকে প্রশ্ন করে,”আমাদের তো বলোনি।”
“একদিকে আমার ভাই আরেকদিকে আমার বউ।দুজনের বিপদে আমার ক্ষত কিছুই না।তাও আমি পারলাম না কাউকে রক্ষা করতে।আমি আজ হেরে গেলাম।”
আদ্র রাজের পাঞ্জাবির প্রথম দুইটি বোতাম খুলে দেখে গুলি লাগা স্থান কালো হয়ে আছে।তাজকে আক্রমণ করার একদিন কি দুইদিন আগেই তো রাজ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে।রাজ নিজেও তো পরিপূর্ণ সুস্থ ছিল না।তার মধ্যেই সব ঘটে গেলো।সবাই ভুলে যায় রাজের শরীরের কথা।ভুলবে নাই বা কেন?তাজকে হারানোর বেদনা হিয়ার নিখোঁজ সংবাদ মায়ার হাসপাতালের চিকিৎসা।এসবে কার এত সময় রাজের দিকে চোখ রাখার?মায়া সজ্ঞানে থাকলে রাজের যত্ন নিতো।এখন তো সেও রাজকে চিনতে পারছে না।
মাহমুদ সরদার বাইরে গেছেন।তার এখন তাজ ও হিয়াকে নিয়ে এদিক ওদিক দৌড়াতে হচ্ছে।তাজের বডি পাওয়া যায়নি।ফোর্স নিয়ে যাওয়া হয় খাদের শেষ প্রান্তে।পেলো না কোনো অস্তিত্ব।অনেকের ধারণা তাজকে জলহস্তিরা খেয়ে ফেলেছে।সিয়ার ধারণা সোনালী কিছু করেছে হয়তো।তাই তো এখন সোনালীকে সহ্য করতে পারছে না।মালিনী ও সোনালী একত্রে আলাপ করতে করতে মাহমুদ সরদারের ঘরে যাচ্ছে।সিয়া ওদের পিছু নিলো।এই সোনালীকে দুচক্ষে সহ্য করতে পারছে না সিয়া।রুদ্রকে জানিয়েছে কিন্তু এটুকু জেনেই বা কি হবে?সিয়ার নজর এখন সোনালীর উপর থাকে।ওরা ঘরে এসে বসতেই সোনালী বলে ওঠে,”তোমার বউমার স্মৃতি হারিয়েছে।এই সুযোগ আছে।মোহনার সাথে রাজকে বিয়ে দেওয়ার।তাহলেই তো দলিলগুলো একসাথে হবে।দুই দিকের দলিল এক হলে আমরাই ওদের বিপদে ফেলে সম্পত্তি পাবো।ফর্মুলা তো আমাদের কাছে কিন্তু ওই কাগজপত্র,ওগুলো না থাকার কারণে তো বৈধ নাম করে আমি ফর্মুলা সাপ্লাই করতেও পারবো না।একটু চেষ্টা করো তুমি।”
মালিনী বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলে,”আমি কি হাত গুটিয়ে বসে আছি?নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করে রেখেছি।এমন জায়গায় রেখেছি যে কেউই ওকে খুঁজে পাবে না।একবার শুধু ফর্মুলার দলিলগুলো আর বাড়ির কাগজপত্র আমদের দখলে পাই তারপর হিয়াকে নিয়ে আসব।তখন তো তোমাদের আর সমস্যা নেই।”
“হিয়াকে আটকে রেখে তুমি ভালোই করেছো।নাহলে তোমার মেয়ের অবস্থা আমি খারাপ করে দিতাম।”
“খবরদার আমার মেয়ের গায়ে একটা দাগও যেনো না লাগে।ওকে আমি সরিয়ে রেখেছি যেনো তুমি তোমার কাজ সহজভাবে করতে পারো।আমার মেয়ে এর মধ্যে ফাঁসবে না।তাই তুমিও ওর কিছু করার কথা ভাববে না।”
“আরেহ জানি জানি।তোমার ভাই তো…
খট করে শব্দ আসে। সিয়ার হাত দরজার সাথে।সিয়া অবাক হয়ে দেখছে ওর মাকে।মালিনী একটু ঘাবড়ে গেলো।সিয়া ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে বলে,”ছিঃ!”
বলেই দৌড়ে চলে যায়।সোনালী ব্ল্যাকমেইল করে বলে,”সুযোগ আছে এই মেয়েকেও সরাও।নাহলে এর কিছু হলে আমি দায়ী না।”
“সরাতে হবেনা। একে আমি আমার মুঠে আনতে জানি।তুমি চিন্তা করোনা।আমি দেখছি ওর ব্যাপারটা।”
মালিনী চলে গেলো সিয়ার পিছনে।সিয়া নিজের ঘরে এসে ফোন হাতে নিয়ে কল দেও আদ্রকে।ওদিকে রিং হতেই মালিনী এসে সিয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,”যা যা নিজের কানে শুনেছিস সব ভুলে যাবি।”
সিয়া কান্না করতে করতে রাগ দেখিয়ে বলে,”মানলাম তাজ ভাই তোমার সন্তান না তাই তার হারিয়ে যাওয়াকে তুমি স্বাভাবিক নিচ্ছো না কিন্তু মা হিয়া তো তোমার নিজের মেয়ে।তুমি ওকে কিডন্যাপ করে রাখলে কিভাবে?নিজের স্বার্থে নিজের মেয়েকেও কিডন্যাপ করে রাখলে!”
“নিজের স্বার্থের থেকেও বড় কথা হিয়ার সুরক্ষার জন্য।আমি হিয়াকে কিডন্যাপ না করলে ওরা মেরে ফেলতো।আমিও সন্তান হারিয়েছি একটা।আর কত সন্তান হারাবো?তুই একদম চুপ থাকবি।কোনো টু শব্দ করবি না।নাহলে তোকেও কিন্তু কিডন্যাপ করে রাখবো।”
“কেন মা কেন?ওদের সঙ্গ কেন দিচ্ছো তুমি?ভাই ভাবী আছে তো।ওরা দুজনে মিলে এই বাজে লোকগুলোর খারাপ পরিণতি করে দিবে।”
“কিচ্ছু করতে পারবে না।বরং এই যাবতকাল সবাই সবকিছু হারিয়ে এসেছে আরো হারাবে। আর আমি কেন সঙ্গ দিবো না ওদের?আমি কি পেয়েছি জীবনে?তোর বাবার ভালোবাসা পাইনি আমি।আমি শুধু একটা চেহারার জন্য তোর বাবার সাথে সংসার করার সুযোগ পাচ্ছি।রোহিনীকে কল্পনা করে আমার সাথে সংসার করে তোর বাবা আমার সাথে।মালিনী খান ভেবে কোনোদিন আমাকে ভালোবাসতে পারেনি।”
“তুমি আমার বাবাকে চিনতেই পারোনি।আমার বাবা তার প্রথম বউকে ভুলতে না পারলেও দ্বিতীয় বউকেও ভালোবাসে।তোমাকে আমাদের জন্য বাবা এখনও কোনো শাস্তি দিতেই পারেনি।তুমি ওদের সাথে যুক্ত হয়ে বড় মায়ের ফর্মুলা আদায় করতে চাও।ছিঃ মা ছিঃ।তুমি তোমার বোনের ক্ষতিটাও করে দিলে।তোমরাও যমজ বোন ছিলে মা আল্লাহ তোমাকেও যমজ সন্তান দিয়েছে।একবার ভেবে দেখোতো তোমাদের দুই বোনের মত যদি আমাদের ভাগ্য একই হয় তোমার সহ্য হবে তো মানতে?”
“সিয়া!বড় বড় কথা বলে ফেলেছিস তুই।জীবনের মূল্য বুঝতে পারিসনি এখনও।বাবা আর ভাইয়ের থেকে শুধু মানবতার ফেরিওয়ালা হতে শিখেছিস।”
“ভাগ্যিস মানবতার ফেরিওয়ালা হয়েছি তোমাদের মত জালিম না।”
সিয়ার গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় মালিনী।সিয়া গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকায় মালিনীর দিকে।মালিনী কাপতে কাপতে বলে,”আমি শুধুমাত্র একজন প্রয়োজন হয়ে এসেছি তোর বাবার জীবনে।প্রিয়জন হবার সুযোগ পাইনি।সেই সাথে হারিয়েছি প্রথম সন্তানকে।আমার দুঃখ তুই কি বুঝবি?”
মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৫১+৫২
“মা!”
“মা যেদিন হবি সেদিন বুঝবি এই মা সন্তান হারিয়ে ঠিক কতটা পুড়েছিল সেদিন।”
সিয়া কান্না করতে করতে বাইরে দৌড়ে গেলো।মালিনী খুব ভালো করেই জানে সিয়া মালিনীর ব্যাপারে কাউকে জানাবে না।মাকে সিয়া এখন ঘৃণা করলেও মাকে তো লোক সমাজে বদনাম করা যায়না।কিন্তু মালিনী এটা জানেনা মালিনীর এই সমস্ত কথা আদ্র ও রাজ শুনেছে।আদ্র ম্যাসেজ করে দিলো রুদ্রকে।রুদ্র একটু শান্তি পেলো।নিজের সন্তানকে কিডন্যাপ করে রেখেছে মানে হিয়া সুরক্ষিত আছে।এখন তাহলে ওদেরকে অন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
