মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৪

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৪
মির্জা সূচনা

মোনাজাত শেষে করেই এসে মেহরিনের কোলের উপর মাথা রাখে রাজ।
মেহরিন কিছু বলে না কেনো জানি কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।মেহরিন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার “কবি সাহেব”র দিকে—
এই মানুষটা তার ভালোবাসা, তার প্রথম প্রেম,তার জীবনের এমন এক পুরুষ যাকে সে চেয়েছিলো তার স্বামী, তার ভাগ্যের লেখা জীবন মরনের সাথী।
ভেবেই বুকটা কেমন ভরে আসে এক অপার্থিব সুখে।
কিছুক্ষণ পরে রাজ হঠাৎ উঠে যায়।
মেহরিন কৌতূহলে তাকিয়ে থাকে।
রাজ কয়েকটা ছোট ছোট বাক্স আর শপিং ব্যাগ নিয়ে আসে।
একটা ব্যাগ মেহরিনের হাতে দিয়ে বলে,

— এটা আমার প্রথম উপার্জনের টাকায় কেনা।
দু’টা শাড়ি কিনেছিলাম— আমার তো মা নেয় তাই ওটা আমার আরেক মা মানে মামনী কে দিয়েছি, আর এইটা তোমার জন্য… আমার সহধর্মিণীর জন্য।
তারপর একটা বাক্স মেহরিনের হাতে দেয়।
— এই নেকলেসটা সেই দিন কিনেছিলাম যেদিন প্রথম ভাবলাম—তোমাকেই বউ করব।তুমি আমার প্রথম প্রেম প্রথম ভালোবাসা আর তোমাকেই বানাবো আমার বউ আমার জীবনের সাথী।
মেহরিন কিছু বলে না শুধু অপলক তাকিয়ে থাকে রাজের দিকে।
আরও একটা ছোট্ট বাক্স এগিয়ে দেয়—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— এটা আমাদের বংশের শিকদার পরিবারের ঐতিহ্য,
সব বউদের দেওয়া হয় এটা। এই নাকফুল টা আমার মায়ের হাতের শেষ চিহ্ন। আজ এটা তোমার। তুমি পরবে এটা আরিওনা। আজ আমার মা থাকলে হয়তো সে নিজে হাতেই পড়িয়ে দিতো তোমাকে।
মেহরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
তার হৃদয়ের প্রতিটি কোণে বাজতে থাকে রাজের কথা।
সে নিঃশব্দে নাকফুল হাতে নেয়।
শেষে রাজ নিজের হাতে একটা আংটির বাক্স খোলে,
একটা আংটি বের করে, মেহরিনের দিকে হাত বাড়ায়।
মেহরিন নিঃশব্দে হাত বাড়ায়।
রাজ নিজের হাতে সেই আংটি পরিয়ে দেয়।
তারপর হালকা একটা চুমু দেয় মেহরিনের হাতে…
কিন্তু মেহরিন মুহূর্তেই নিজেকে সরিয়ে নেয়।
রাজ কিছু বলে না।

মেহরিন চুপ চাপ শপিং ব্যাগ আর বাক্সগুলো নিয়ে উঠে যায়, আলমারিতে গুছিয়ে রাখে।
তারপর কোনো কথা না বলে বিছানার ফুলগুলো সরিয়ে দেয়,
চাদর ঠিক করে শুয়ে পড়ে।
রাজ তাকিয়ে বলে—
— বউ, তুমি শুয়ে পড়লে? আজ তো আমাদের বাসর রাত…
মেহরিন কিছু না বলে অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে হেসে ফেলে।
কিন্তু সেই হাসির মধ্যে যেনো একটা অভিমান লুকিয়ে আছে।
রাজ কাছে আসে, হাত ধরতে চায়—
মেহরিন বলে,
— খবরদার, আমাকে ছুঁতে যাবেন না।
রাজ অবাক হয়ে বলে,

— তুমি আমার বিয়ে করা বউ, তোমাকে ছুঁব না তো কাকে ছুঁব পাশের বাড়ির ভাবিকে?
মেহরিন টিটকেরে মেরে বলে, ওহ তার মানে পাশের বাড়ির ভাবির সাথে আপনার…
এটুকু বলতেই রাজ মেহরিনের হাত ধরে বলে,
ছিঃ ছিঃ ছিঃ বউ তুমি আমাকে ওমন ভাবো ছিঃ… বিশ্বাস করো বউ আমার কোনো ভাবির সাথে কিছু নাই। আমি মন, প্রান, যৌবন, জীবন সব দিয়ে তোমাকেই শুধু ভালোবাসি।
মেহরিন প্রথমে হাসলেও এখন কেমন যেনো হয়ে গেলো।
মেহরিন উঠে বসে, হাতটা ঝাঁকিয়ে ছুঁড়ে দেয়,
তার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে।
একদম ভালোবাসা দেখানোর চেষ্টা করবেন না।
আপনি যা করেছেন, আপনি হয়তো ভুলে যেতে পারেন,
কিন্তু আমি পারি না…!
এই বলে সে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
রাজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুই বলে না।
কেবল বিছানায় নেমে আসে এক নীরব রাতের দীর্ঘশ্বাস।
রাজ ক্ষীন গলায় বলে ওঠে,

—বউ, তুমি আমার সাথে এমন অন্যায় করতে পারো না…
বাসর করার অধিকার তো আমারও আছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক আমি।তুমি আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারো না বাসর করা আমার স্বামী গত অধিকার আর আমার অধিকার তোমার দিতেই হবে। তোমার এই অবিচার অন্যায় কিন্তু জাতি মেনে নিবে না।
মেহরিন চোখ পাকিয়ে বালিশটা ছুঁড়ে মারে তার দিকে,
— না মানলে না মানুক! তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ুন!
রাজ হতবাক। মুখ ভার করে বিছানায় বসে পড়ে।
নিরবে বকবক করতে থাকে,
আর মেহরিন চুপচাপ শুনতে থাকে, হাসি চেপে।
হঠাৎ রাজ গান ধরে—

ও বউ… কেনো আমার কাছে আসো না…
ও বউ… তুমি আমায় কী ভালোবাসো না…
ও বউ… কেন আমার কাছে আসো না….
চলো ঝগড়া মারামারি..
ভুলে যাই তাড়াতাড়ি…
ইতনা গুসকা কিউ…
তুমি কেনো এত বোকা সাজো…
আমায় একটু বুঝো…
শোনো না… আই লাভ ইউ…
ও বউ….
তুমি আমায় কি ভালোবাসো না….
ও বউ….
গানটা শেষ হতেই মেহরিন উঠে পড়ে।আস্তে আস্তে রাতে দিকে এগিয়ে যায়। রাজ ভাবে হয়তো তার বউয়ের রাগ ভেঙে গেছে তাই সে চুমু দিতে আগায়..
অমনি ধপাস***

রাজ পড়ে গিয়ে আহাম্মকের মত তাকিয়ে আছে মেহরিন এর দিকে, তারপর বলে তুমি আমায় বাসর রাতে ফেলে দিয়ে মাজা ভেঙ্গে দিলে বউ … ও বউ.. এটাতো আমার করার কথা ছিল.. মারামারি করো ভালো কথা। তাই বলে তুমি বাসর রাতেও মারামারি করবে এটা কিন্তু জাতি কোন কালই মেনে নিবে না ।
মেহরিন উঠে গিয়ে,
রাজের হাত ধরে টেনে ঘরের বাইরে বের করে দেয়।
তারপর দরজাটা ঠাসস** করে বন্ধ করে দেয়!
রাজ অবাক! দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে অবুঝ বাচ্চার মতো।
তারপর দরজা ধাক্কা দিয়ে বলে—
—বউ! দরজা খোলো!
আমি আর কিছু বলবো না। প্লিজ ঘরে ঢুকতে দাও!
ও বউ… ওই Moonbeam ..!
মেহরিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে।
মনেই মনে বলে—
আমাকে কষ্ট দেওয়া?

এখন কেমন লাগে,আমাকে কষ্ট দেওয়ার হিসাব আমি পাইপাই নিবো..
Mr. Shikdar, হারে হারে বুঝতে পারবে আমি কি জিনিস!
এ কথা ভেবে বিছানায় গিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ে।
ওদিকে রাজ বারবার ডাকাডাকি করে, কিন্তু কোনো উত্তর পায় না।
শেষমেশ হতাশ হয়ে চলে যায় লাবিবের রুমে।
লাবিব দরজা খুলেই অবাক—

— আরে ব্রো! এত রাতে নিজের রুম ছেড়ে এখানে কেন?
রাজ কিছু বলে না, সরাসরি গিয়ে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ে।
লাবিব হতভম্ব। কয়েক সেকেন্ড পরে হেসে বল
— ভাবি বের করে দিয়েছে বুঝি?
রাজ একটা বালিশ ছুঁড়ে মারে লাবিবের দিকে
— আর একটা কথা বললে, তোকে আমি ঘর থেকে বের করে দেব।
লাবিব হেসে বলে—
—বাহ্! ভাবী তোমাকে বের করেছে, আর তুমি আমাকেও বের করবে?
দারুণ ভারসাম্য!
রাজ গম্ভীর মুখে চেয়ে থাকে।
লাবিব হাত তুলে বলে—
— ওকে, ওকে! আর কিছু বলব না।
এই বলে পাশেই শুয়ে পড়ে।
আর রাজ?
চোখে ঘুম নেই। মনে শুধু সেই দরজা… আর দরজার ওপারে তার “বউ”।

ভোর বেলাই মেহরিনের ঘুম ভেঙে যায়।
চোখ মেলে উঠে বসে।
দূরে কোথাও আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে।
পাশ ফিরে দেখে, বিছানাটা খালি।
একটা শান্ত হাসি খেলে যায় তার মুখে।
নিঃশব্দে উঠে ওজু করে নামাজ পড়ে নেয়।
তারপর কিছুখন শুয়ে থাকে।আর তারপর কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বের হয়ে আসে রুম থেকে।
নতুন বউ হয়ে শুধু শাড়ি পরে বসে থাকলে চলবে না।
এই ভাবনাই যেনো তাকে টেনে নেয় রান্নাঘরের দিকে।
রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখে, একটা মেয়ে বাসন মাজছে।
সম্ভবত হেল্পিং হ্যান্ড।
মেয়েটি মেহরিনকে দেখে চমকে উঠে বলে,

— আরে ম্যাডাম! আপনে এত সকালে… কিছু লাগবো? আমিই কইরা দিতাসি!
মেহরিন হেসে বলে,
— কিছু লাগবে না। নাম কী তোমার?
মেয়েটি হেসে উত্তর দেয়,
— আমার নাম কুলসুম, ম্যাডাম।
মেহরিন মায়া মাখা হাসি দিয়ে বলে,
— সুন্দর নাম, ঠিক তোমার মতোই।
আর হ্যাঁ, আমাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে ‘আপু’ বা ‘ভাবি’ বলবে।
কুলসুম যেন খুশিতে ডানাও মেলে!
— আচ্ছা ভাবি।
মেহরিন জিজ্ঞেস করে,
— একটা সাহায্য করবে? এই বাড়ির সবাই সকালে কী খেতে পছন্দ করে, একটু বলো তো।
কুলসুম ভাবে, তারপর বলে,

— আম্মা মানে লাবিব ভাইজানের আম্মা, উনি দুধ-চা খান, চিনিটা একটু কম দিয়ে।
সাথে পরোটা আর ডিম ভাজি।
লামিয়া আপা স্যান্ডউইচ আর জুস খান।
আর লাবিব ভাই, উনি যেটা দেন সেটাই খান।
বড় ভাইজান, মানে আপনার স্বামী… উনি তো তেমন কিছু খান না,
তবে শুনেছি আলু পরোটা আর মুরগির ঝোল নাকি তার খুব প্রিয়।
মেহরিন মুচকি হেসে বলে,
— বুঝেছি। আর তুমি?
কুলসুম একটু থমকে যায়,
— আমার? আমাকে তো কেউ কখনও জিজ্ঞেস করে না ভাবি…
মেহরিন আন্তরিক গলায় বলে,
— তবে আজ আমি করলাম, এবার বলো তো।
কুলসুম মাথা নিচু করে বলে,

— আমার না, নুডুলস খুব ভালো লাগে ভাবি।
মেহরিন হেসে বলে,
— তাহলে আজ নুডুলস হবেই।
কুলসুম বলে,
আমি ঝটপট তাইলে সব রান্না করে ফেলতেছে ভাবি।
মেহরিন শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে গায়ে হাত লাগিয়ে বলে,
— তোমার করতে হবে না, আমি করছি।
তুমি শুধু আমাকে সাহায্য করো।
কুলসুম আতঙ্কে বলে ওঠে,
— আরে ভাবি! আপনি নতুন বউ! আপনার কাজ করলে চলবে?
আম্মা জানলে আমার রক্ষা নাই।
মেহরিন শান্ত গলায় বলে,

— চিন্তা কোরো না।তোমাকে কেউ কিছু বলবেনা আমি আছি তো।
আর তুমি তো আমাকে সাহায্য করবেই।
কুলসুম বারবার না করলেও শেষমেশ রাজি হয়।
দুজনে একসাথে রান্না শুরু করে।
মাঝে মাঝে হাসাহাসি, মাঝে মাঝে ঝোলের স্বাদ দেখে ঠিক করে।
রান্নার ফাঁকে মেহরিন ঘড়ির দিকে তাকায়।
তারপর কুলসুমকে বলে—

— তোমাদের ভাইজানরা কখন উঠে?
কুলসুম বলে—
— আটটার মধ্যে উঠে যায়, ভাবি।
মেহরিন মাথা নাড়ে,
—আচ্ছা… তাহলে তাড়াতাড়ি শেষ করি।
তার চোখে-মুখে এক নতুন আলোর ছায়া—
নতুন সংসার, নতুন দায়িত্ব,
আর রাজের জন্য একফালি নরম মমতা।
সাড়ে সাতটা বাজে।
মেহরিন আর কুলসুম মিলে সব রান্না শেষ করেছে।
নাস্তার আইটেমগুলো টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছে।
এমন সময় ঘরের দিক থেকে বের হয়ে এলেন রূপা বেগম।
রান্নাঘরে মেহরিনকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।

—আরে বউমা, তুমি রান্নাঘরে? কেন ?
মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
মেহরিন ঘুরে দাঁড়িয়ে হেসে বলল,
— কেন মামনি? রান্নাঘরে আসা কি আমার মানা?
রূপা বেগম একটু গম্ভীর গলায় বললেন,
— না তা নয়… কিন্তু তুমি তো নতুন বউ। এখনই রান্না করার দরকার নেই।
আমি আর কুলসুম মিলে সব সামলে নিতে পারি।
তুমি তো এ বাড়ির বউ, কাজের মেয়ে না যে সব কিছু করতে হবে!
হালকা হেসে আবার বললেন,
— হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে শখ করে রান্না করলে আলাদা কথা।
মেহরিন হেসে উত্তর দিল,
— মামনি, আমি তো আমার বাড়িতেও রান্না করতাম।
চিন্তা করবেন না, কষ্ট হলে অবশ্যই জানাবো আপনাকে।
রূপা বেগম কিছু না বলে চলে গেলেন সোফায় বসে পড়লেন।
তারপর কুলসুমকে বললেন,

— কুলসুম, চা দে তো।
মেহরিন নিজেই ট্রেতে করে তিন কাপ চা নিয়ে এলো।
একটা কাপ দিল রূপা বেগমকে, একটা নিজে নিল, আর একটা কুলসুমকে দিয়ে বলল—
— এই নাও, কুলসুম আপা, তোমার চা।”
রূপা বেগম মেহরিনের ভদ্রতা ও আচরণ দেখে খুশি হলেন।
চায়ের এক চুমুক নিয়ে বললেন,
— বাহ! বউমা তো দেখি দারুণ চা বানাও।
তবে চায়ের স্বাদটা একটু আলাদা লাগছে… কেন গো?
মেহরিন হেসে বলল,
— কারণ এতে আমি গোলমরিচ আর লবঙ্গ দিয়ে ফুটিয়ে এনেছি, মামনি।
রূপা বেগম খুশি হয়ে বললেন,

— খুব ভালো হয়েছে!
তোমায় তো ১০-এ ১১ দিতে হয়!
মেহরিন হেসে ফেলে।
পাশ থেকে কুলসুম বলে উঠে,
—আরে বাশ! ভাবি তো আজ পুরাই ফাটায় দিলেন! চা আসলেই মজা হইছে!
ঠিক তখনই নিচে নেমে আসে লামিয়া।
মেহরিনকে দেখে বলে,
— আরে ভাবিমণি! তুমি এত সকাল সকাল উঠে গেছো?
মেহরিন হাসে।
লামিয়া বলে,

—ও কুলসুম আপা, আমায় জুস দাও তো!
মেহরিন তাড়াতাড়ি বলে,
— তুমি বসো, আমি দিচ্ছি।
লামিয়া মুচকি হেসে বলে,
— আজ তো আমার সকালটাই জমে যাবে।
সকালে উঠেই সুন্দরী ভাবির হাতের নাস্তা।
সবাই হেসে ওঠে।
মেহরিন তাকে জুস আর স্যান্ডউইচ দিয়ে দেয়।
লামিয়া কৌতূহলী হয়ে বলে,
— ভাবিমণি, তুমি কিভাবে জানলে আমি এগুলো খাই?
মেহরিন চোখ টিপে বলে,
— কুলসুম আপা বলেছে।
লামিয়া হেসে বলে,
—ওহ, ঠিক।
রূপা বেগম তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন,

— আটটা বাজে। এখন রাজ নিশ্চয়ই কফি চাইবে। কুলসুম, কফি বানাও।
কুলসুম হেসে বলে,
— ভাবি তো কইরা রাখছে সব আম্মা।
রূপা বেগম এবার সত্যিই খুশি হয়ে হেসে ফেলেন।
— বাহ! বউমা তো দেখি সব খোঁজখবর রাখে।
ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে চায়ের গন্ধ আর এক নববধূর কোমল যত্নের স্পর্শ।
সকালে সবাই টুকটাক গল্পে মেতে উঠেছে।
ঠিক তখনই ঘুম চোখে দুলতে দুলতে নিচে নামে রাজ।
গম্ভীর গলায় বলে—
— কুলসুম, কফি দে।
পেছন থেকে লাবিব বলে ওঠে,

— আমাকেও দিও।
মেহরিন গিয়ে দুই মগ কফি নিয়ে আসে।
একটা লাবিবকে দেয়।
লাবিব মজা করে বলে—
— আরে আজ তো সকালটাই জমে গেল।
নতুন ভাবির হাতে বানানো কফি, আর সকালে সকালে মানে—মুড ফ্রেশ একদম।
মেহরিন গম্ভীর মুখে আরেকটা মগ নিয়ে রাজের সামনে গিয়ে বলে—
— আপনার কফি।
রাজ কিছু না বলে কফি নিয়ে চুপচাপ উপরের দিকে হাঁটা দেয়।
রুমে দিকে।
রূপা বেগম মেহরিনকে ডাকেন,

— বউমা, দেখে এসো রাজ বাবার কিছুর দরকার আছে কিনা।
মেহরিন সম্মতি জানিয়ে উপরে ওঠে।
রুমে ঢুকে দেখে রাজ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কফি খাচ্ছে।
মেহরিন বিছানাটা গুছিয়ে দিতে শুরু করে।আরচোখে কয়েকবার দেখেন আজ কি করছে,
হঠাৎ রাজ এসে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে।
মেহরিন হতভম্ব হয়ে বলে—
— কি সমস্যা আপনার? এইরকম আচরণ করছেন কেন?একদম এমন ডলা ডলি করবেন না।
রাজ গম্ভীর গলায় বলে—
আমার বউ আমি যা ইচ্ছা তাই করবো।
— তুমি অন্যায় করেছো আমার সাথে বউ।
আমার বউ হয়েও বাসর রাতে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো।
এটা কি ঠিক করেছো?
মেহরিন ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
তার চোখ জ্বলজ্বল করছে।

—আপনি কী করেছেন সেটা আপনি ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু আমি না।
আপনার সেই আচরণ আমি আজীবন মনে রাখবো।
সে দরজার দিকে এগোতেই রাজ তার হাত ধরে টেনে নেয়।
মেহরিনকে নিজের কাছে এনে তার ঠোঁটে চেপে ধরে ঠোঁট।
রাজের এই আচরণে মেহরিন অবশ হয়ে যায়।শরীরের জন্য একটুও বল পাচ্ছে না কেমন যেন নিজেকে লাগছে পাগল পাগল,
তবুও সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
শেষমেশ আর না পেরে সে রাজের ঠোঁটে কামড় দেয়।
রাজ তবুও ছাড়ে না।
তখন মেহরিন কনুই দিয়ে তার পেটে এক ধাক্কা দেয়।
রাজ কষ্ট পেয়ে মেহরিনকে ছেড়ে দেয়।
রাজ গম্ভীর গলায় বলে—

—তুমি বউ না, জল্লাদ।
মারামারি করো সে ঠিক আছে। তাই বলে কি সব সময় আমার মারামারি করা ঠিক বউ?
নিজে তো আদর করোই না। আমি আদর করছি আর তখনও তুমি মারামারি করছ।
বিরক্ত গলায় বলে—
— সকাল সকাল একটু আদর চাইলাম, আর তুমি মারলে!
মেহরিন বলে—
— আপনি অসভ্য, অশালীন!
আমার থেকে শত হাত দূরে থাকবেন।
রাজ হেসে বলে—
— মামার বাড়ির আবদার তাই না?
তুমি আমার বউ, আর আমি থাকবো শত হাত দূরে?
Nooo. never… impossible..
মেহরিন কিছু না বলে, রাজকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, অসভ্য অভদ্র বলতে বলতে নিচে চলে যায়।
পেছন থেকে রাজ বলে—
— বউ… আমার সাথে এমন অবিচার করো না…”

সিঙ্গাপুর সকাল ১০টা।
রিদ এসেছে তার মামার বাড়ি, কিছুদিন এখানে থাকবে। হালকা ঠান্ডা পড়েছে, তাই মুডও শান্ত।
সকাল ৯টায় বেরিয়েছিল সে, সঙ্গে মামাতো ভাই তুষার। তারা যাচ্ছে একটা পার্কে, রিদ নিজেই ড্রাইভ করছে।
তুষার পাশের সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে।
রাস্তার বাঁকে আসতেই হঠাৎ সামনের দিক থেকে দ্রুতগতির একটা গাড়ি এসে পড়ে।
রিদ দক্ষ হাতে গাড়ি সামলে নেয়, মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে যায় একেবারে শেষ মুহূর্তে।
ব্রেক চেপে গাড়ি থামিয়ে দেয় রিদ। আরেকটা গাড়ি একেবারে সামনের দিক থেকে ঠিকঠাক থেমে যায়।
ওই অপর গাড়ি থেকে নেমে আসে এক মেয়ে—
পরনে ফর্মাল ড্রেস, সুন্দর করে বাঁধা চুল পেছনে ঝুঁটি করে রাখা। মুখে মাস্ক, শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে—চোখের রং টা হালকা নীল।
মেয়েটা এগিয়ে এসে রিদের গাড়ির জানালায় টোকা দেয়।
রিদ জানালা নামিয়ে ‘সরি’ বলতেই যাবে,
মেয়েটা তখনই রেগে গলায় বলে ওঠে—

—এই! বেয়াদব! চোখে দেখে গাড়ি চালাস না?
— আর একটু হলে তো উপরে উঠেই যেতাম আমি তখন কী হতো, জানিস?
—বাপের টাকায় ফূর্তি ছাড়া আর কিছু জানিস না বুঝি! এই তোর বাবার নাম কী, বল!
রিদ স্তব্ধ হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই গলা, এই কণ্ঠস্বর..
ঠিক যেনো মেহরিনের মতো!
চোখ দুটো নীল হলেও—সেই চাহনি, সেই তেজ, যেনো একদম ওরই প্রতিচ্ছবি।
রিদ কথা না বলায় মেয়েটা আবার বলে—
— এই, তুই এভাবে আমার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছিস কেন?
হ্যারেজমেন্ট +নারী নির্যাতন+ এটেম্পট টু মার্ডার কেস ঠুকে দেব, তখন মজা টের পাবি।
তুষার এবার বলার চেষ্টা করে—

— “I’m really sorry, but we didn’t mean to—
মেয়েটা তুষারকে এক ধমক দিয়ে বলে—
— চুপ! তুই চালাচ্ছিলি?
তাহলে কথা বলিস না! আহাম্মক।
রিদ এখনও বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটার চাহনি, আচরণ—সবই খুঁজে নিচ্ছে কোনো পুরনো পরিচয়ের ছায়া।
মেয়েটি আবার বলে,এই মালটা কি… বুবা?
তুষার দুদিকে মাথা নাড়ে।
মেয়েটা কড়া গলায় বলে ওঠে,
— না হলে কথা বলছে না কেন?
তারপর রিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এই, কথা বল।
রিদ কিছুটা সংযত গলায় বলে,

— আপনি এমন ব্যবহার করছেন কেন? আপনি একজন মেয়ে, আপনাদের আচরণে সৌজন্য থাকা উচিত।
মেয়েটা একেবারে তেড়ে আসে,
— আচ্ছা, তাই নাকি।আচ্ছা মাননীয় তোমরা মুখো ,এই গম্ভীর মুখ, যেনো সারাদিন উপোসে থেকেছে, একদম গুমরে থাকা এক প্রটিবন্ধী।ড্রাইভ করার সময় চোখ খোলা রাখা যায় না… আরেকটু হলেই তো আপনার জন্য আমি উপরে তোকে যেতাম।
পরের বার চোখ খোলা রাখিস ড্রাইভ করার সময়।
সবাই আমার মতো ‘ভালো মানুষ’ না যে মাফ করে দেবে।
তুষার নিচু গলায় ফিসফিস করে বলে,
— ভালো মানুষ না চাইলেও, গালাগালি তো চাই না…
রিদ রেগে ফিসফিসিয়ে বলে, “Stupid.”
এ কথা শুনেই মেয়েটা থেমে যায়।
তারপর ধীরে ধীরে মুখের মাস্ক খুলে বলে,
— এই… কাকে আপনি স্টুপিড বললেন হে?
আমাকে?

— তুই stupid! তোদের পুরো চৌদ্দ গুষ্টি stupid!
তার চোখে আগুন জ্বলছে।
— আজ সময় কম আছে, না হলে তোকে দেখিয়ে দিতাম কী জিনিস আমি!সময় থাকলে আজ তোদেরকে বুঝিয়ে দিতাম আমি—মেহের কী জিনিস।
যত্তসব বেয়াদব!
এই বলে মেয়েটি ঘুরে চলে যায়।
রিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মেহের?
এক মুহূর্তে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেহরিনের মুখ—
একই নাক, মুখ, রাগ…

শুধু একটা পার্থক্য—মেহরিনের চোখ ছিল কালো, আর এই মেয়ের চোখ হালকা নীল।
আর মেহরিনের ঠোঁটের নিচে ছিল একটা ছোট তিল, যেটা এই মেয়ের থুতনিতে। নামটা যেন কি বলে গেল ঐ মেয়েটা মেহের।
নামের কত মিল মেহরিন মেহের।আচ্ছা ওরা কি একে অপরের পরিচিত।
তুষার ধীরে বলে, “What happened, bro?
রিদ কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ সামনে তাকায়,
আর দেখে, মেহের গাড়িটা দূরে চলে যাচ্ছে।
সে আর কিছু না ভেবে চুপচাপ পিছু নেয়…
মেহের মনে সুখের গান গাইছিলো আর ড্রাইভ করছিল। কিন্তু হঠাৎ সে টের পায়—ওই ছেলেটা, মানে রিদ,তাকে ফলো করছে।
তার ঠোঁটে টেনে আসে একপাশে বাঁকা, শয়তানি হাসি।

— চলো, একটু খেলা হোক।
মেহের সঙ্গে সঙ্গে একপাশের সরু গলিতে ঢুকে পড়ে।
রিদ দূর থেকে দেখে, কিন্তু থামে না।
সে বুঝতে পারে না কেন এত পরিচিত মনে হয় এই মেয়েটাকে।
তার চেহারায় এমন কিছু আছে, যেটা তাকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়।
তবুও সে পিছু নেয়।
ঠিক যখন রিদ একটা মোড় ঘুরবে, হঠাৎ পেছন দিক থেকে কেউ এসে ধাক্কা দেয় গাড়িতে।
রিদ হতচকিত হয়ে ঘুরে তাকায়।
মেহের মাথা বের করে,হেসে বলে,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৩

— এই যে গুমরা মুখো,
আর পিছু নিলে একদম উপরে পাঠিয়ে দিবো।
তারপর গলার স্বরে একরকম আগুন ছড়িয়ে বলে,
— আমি মোটেও ভালো মানুষ নই।
আমার সাথে লাগতে এলে এমন জালে জড়াবে,
যেখান থেকে বের হবার রাস্তা খুঁজে পাবা না।
তার চোখে ঝলকে ওঠে আত্মবিশ্বাস আর রহস্য।
রিদ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পায় না।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫