মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫
মির্জা সূচনা

রিদ তখনো রাস্তার কোণায় স্থির—চোখে বিস্ময়, মনে ধাঁধা।
এই মেয়েটা কে? দেখতে এতটা একিরকম রাগ,জেদ, মুখ, গলা,হাসি.. হুবহু মেহরিন… তবু সে নয়। কেনো এত মিল?
তার ভেতরটা ছটফট করছে—এই রহস্যের জবাব খুঁজতেই হবে।
অন্যদিকে…
মেহের গাড়ি থামায় এক ১১ তলা বিল্ডিংয়ের সামনে। মুখে নিজের মতো এক আত্মবিশ্বাসী হাসি।
গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত উঠে যায় ৩ তলায়।
ওইখানেই তার আজকের গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস মিটিং।
রুমে ঢুকেই বলে—

I am extremely sorry! Traffic jam-এর কারণে আমি দেরি করে ফেলেছি। আমার জন্য আপনাদের এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো—sincere apologies to everyone.
সবাই হেসে বলে—
It’s okay..
মিটিং শুরু হয়, মেহের প্রেজেন্টেশন দেয় নিখুঁতভাবে। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে—
আমি আশাবাদী—আমাদের প্রজেক্ট সফল হবেই!
হাততালিতে ভরে ওঠে রুমটা।
সবাই ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়।
পেছন থেকে একজন আসে।
আমার মেয়ে সবকিছুতেই সেরা—পড়া-শুনা, অফিস, দুষ্টুমি সব কিছুতে।
মেহের হেসে বলে—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সবই তোমার জন্য, পাপা।
সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
তারপর একটু নিচু গলায় বলে—
আমি খুব শিগগির বাংলাদেশ যাচ্ছি।
বাবা চিন্তিত হয়ে বলেন—
ঠিক আছে। কিন্তু ফিরার সময় মেহরিন, মেহবুবা আর মাহিরকে নিয়ে ফিরবে। আর মেহরিন আম্মুকে বোঝাতে ভুলো না—আমাকে যেনো ভুল না বুঝে। আমার কেমন ব্যস্ত সময় যায়, সেটা ওকে বুঝিয়ে বলো। আমি খুব দ্রুত ওদের সঙ্গে দেখা করব।
মেহের মাথা নাড়ে—

চিন্তা করো না, পাপা। আমি সব বুঝিয়ে বলব।
১ দিন কেটে গেছে।
তবুও মেহরিন এখনো রাজের সাথে ঠিক করে কথা বলছে না।
রাজ অনেকবার চেষ্টা করেছে, গলায় আদর এনে বলেছে,
Moonbeam, প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দাও।
কিন্তু মেহরিম যেনো পাথর হয়ে গেছে। চোখে চোখ পড়ে না, কথা তো অনেক দূরের।
রাজ যতবার বুঝতে চেয়েছে ততবার মেহরিন ফিরিয়ে দিয়েছে।
সন্ধ্যাবেলা
রুপা বেগম,মেহরিন, লামিয়া, আর কুলসুম বসে গল্প করছিল।
হঠাৎ রাজ আসে। চোখ সরাসরি মেহরিন-এর দিকে।
উপরে আসো..

মেহরিন সাড়া দেয় না আর না উপরে যায়।
রুপা বেগম সেটা লক্ষ্য করেন।
তিনি মেহরিন-এর হাতটা ধরে কোমল গলায় বলেন,
তুমি কি কোনো কারণে রাজ বাবার ওপর রেগে আছো, বউমা?
মেহরিন তাকায় তার দিকে, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর নিচু গলায় বলে,
রাগ না মামনি, অভিমান। খুব অভিমান। ও আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। আর আমি… ওকে সব ফিরিয়ে দেব।
রুপা বেগম একটু আঁতকে ওঠেন।
রাজ বাবাকে কষ্ট দিও না বউমা… ওর জীবনে তো কষ্টের কমতি নেই । তুমিও কষ্ট দিলে ছেলেটা মরে যাবে।
মেহরিন আতঁকে উঠে চোখ ভিজে ওঠে।
মামনি, আসলে আমি…

মেহরিন কে কথা শেষ করতে না দিয়ে রুপা বেগম তার হাত চেপে ধরেন,
এসো আমার সাথে।
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ঢোকে।
রুপা বেগম দরজা বন্ধ করে দেন।
তারপর আদুরে গলায় বলেন,
এখানে বসো, আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো আজ।
মেহরিন একটু হকচকিয়ে যায়।
চোখে কৌতূহল। মনে মনে ভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর মামনী কী করে দিবে?
বসে পড়ে ধীরে ধীরে।
রূপা বেগম ধীরে ধীরে বললেন,

— তুমি কেন অভিমান করেছো আছো? এই কারণেই তো যে রাজ বাবা তোমার সামনে লামিয়াকে কেনো এমনভাবে উপস্থাপন করলো, যেনো তাদের মধ্যে সত্যিই কিছু ছিল। এটাই তো তাই না?
মেহরিন মাথা নাড়ল।
রূপা বেগম আবার বললেন,
— আচ্ছা.. তোমার মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগেনি, কেনো রিদ তালুকদার তোমাকে বিয়ে করতে আসেনি?
মেহরিন এবারও মাথা নাড়ল।
রূপা বেগম এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
—লামিয়াকে ওমন ভাবে তোমার সামনে আনার পেছনে একটা কারণ ছিল, বউমা। আর রিদ তালুকদার তোমাকে বিয়ে করতে আসেনি, কারণ রাজ বাবা সেটা চায়নি।
মেহরিন বিস্ময়ে বলল,
—রিদ ভাইয়াকে কি ওনি মানে রাজ চিনতেন?
রূপা বেগম মাথা নাড়লেন,
— হ্যাঁ।

মেহরিনের ভিতরে তখন যেনো ঝড় বইছে। সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। অনেক কথা বলতে চাইছে, কিন্তু মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মুখ দেখে রূপা বেগম বললেন,
— জানি, তোমার অনেক প্রশ্ন। আজ সব বলব তোমায়। সব শুনে তুমি নিজেই বলবে, রাজ বাবা কিছু অন্যায় করেছে কি না। আর তুমি রাজ বাবার উপর রাগ বা অভিযোগ অভিমান পুশে রাখবা কি না।
মেহরিন উঠে বসল, মুখে অস্থিরতা, চোখে কৌতূহল।
—আপনি সব খুলে বলুন, মামনি। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।
রূপা বেগম একটু থেমে বললেন,
— আমাদের সবার… মানে রাজ বাবা, লাবিব, লামিয়া আর আমার… আমাদের সবার একটা অতীত আছে।
মেহরিন কিছুটা কাঁপা গলায় বলল,
— মা… মামনি, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
রূপা বেগম একটু হেসে বললেন,

— রিদ এর বাবা, রেদওয়ান তালুকদারের কথা বলতে চাইছো, তাই না? তাঁকে আমি চিনি, কী না?
মেহরিন মাথা নাড়ে।
রুপা বেগম বলে, চিনি খুব ভালো করে চিনি।
তাঁকে কি ভোলা যায়?
মেহরিন চুপ থাকে। রূপা বেগম যেনো একটু সময় নিচ্ছেন, হয়তো নিজেকে প্রস্তুত করছেন অতীতের কালো ছায়ার সঙ্গে লড়ার জন্য। অবশেষে তিনি বললেন—
তোমার শাশুড়ি আর আমি ছিলাম বেস্ট ফ্রেন্ড। আমাদের আরেকটা বন্ধু ছিল, সাবিহা—যাকে তুমি হয়তো চেনো, রিদের মা।
মেহরিন বলল, হ্যাঁ, আমি চিনি।
রূপা বেগম ডুবে গেলেন অতীতে—

অতীত
আমি ছিলাম ময়মনসিংহ জেলার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আর ফারজানা ছিল জমিদার বাড়ির মেয়ে ওর বাবা আর দাদা দুজনেই জমিদার। ফারজানা থাকত ওর দাদুবাড়িতে, ওর দাদা-দাদির কাছে। ওর বাবা-মা আর দুই ভাই থাকত শান্তিপুরে, ওর বাবার নিজের জমিদারি দেখাশোনা করত।
আমি আর ফারজানা ছিলাম প্রতিবেশী, আর ছোটবেলা থেকেই বেস্ট ফ্রেন্ড। বরং বলাই যায়, বন্ধুর চেয়ে বোন ছিলাম বেশি আমরা। ফারজানা ছোট থেকেই খুব দুষ্টু আর চটপটে ছিল, আর আমি ছিলাম ওর সব সময়ের সঙ্গী। আমরা ছিলাম আমাদের গ্রামের প্রাণ। সবাই আমাদের খুব ভালোবাসত, বিশেষ করে ফারজানাকে।

ফারজানা মানুষের দুঃখ সহ্য করতে পারত না।জমিদার বাড়ির মেয়ে হয়েও কোন অহংকার ছিল না ফারজানার ভিতরে গরীব দুঃখীর সাথে খুব অনায়াসে মিশে যেতো। কতবার যে নিজে না খেয়ে বাড়ির খাবার চুরি করে খাওয়াত খুদার্ত মানুষদের, তার হিসাব নেই। কারো বাসায় বাজার না থাকলে নিজের ঘর থেকে দিয়ে আসত। কেউ অসুস্থ হলে ছুটে যেত দেখতে,যারা অসহায় থাকত তাদের ওষুধ কিনে দিত ওষুধ কেনার টাকা দিতো সবার পাশে থাকত। কোন বৃদ্ধ কাজ করতে থাকলে সেই কাজ নিজে করে দিয়ে আসতো যে কাজ ও করতে পারতো না সেই কাজে ডেকে নিতে এলাকার ছেলেদের। ওদের বাড়ি কেউ ভিক্ষা নিতে আসলে তার পনেরো দিনের খরচসহ দিয়ে দিতো ফারজানা। প্রতিটি দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে ফারজানা তাই সবাই ওকে খুব ভালোবাসত।

এমন হতো মাঝেমধ্যে ওর দাদুর কাছ থেকে মানুষ টাকা ধার নিতো সেই ধারে টাকা ওকে চাইতে পাঠালে,ও গিয়ে যদি দেখতো ওই বাড়িতে রান্না হয়নি খাবার নেই ধারে টাকা আনতে গিয়ে ও উল্টো বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে ওদের দিয়ে আসতো। তাই সবাই ওকে খুব ভালোবাসতো আর ওর সঙ্গেই থাকার কারণে আমাকেও সবাই ভালোবাসত।

আমরা আমাদের গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই, আর দুই জনেই ভালো রেজাল্ট করে পাশ করি। এতে আমাদের পরিবার খুব খুশি হয়, আর আমাদের ভর্তি করিয়ে দেয় কলেজে।শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়।
আমি আর ফারজানা ভর্তি হই ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে। প্রথম দিনেই আমরা বন্ধুত্ব করি আরেকজনের সঙ্গে—ওর নাম ছিল সাবিহা। মেয়েটা ছিল ভীষণ ভদ্র আর লাজুক। প্রথম দেখাতেই ওকে আমাদের ভালো লেগে যায়। আমরাও ওর সঙ্গে সহজে মিশে যাই। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমরা কত দুষ্টামি, ফাজলামি করতাম তার হিসাব নেই। তবু আমাদের পড়াশোনায় কখনও ফাঁকি থাকত না।তাই হাজার দুষ্টুমি ফাইজলামি করলাম স্যার ম্যাম আমাদের কিছু বলতো না।
হঠাৎ একদিন আমাদের ক্লাসে আগমন হয় তিনজন নতুন ছেলের—রুদ্র, রেদওয়ান আর সায়েম।
আমাদের দিনগুলো বেশ ভালোই চলছিল। ক্লাস, আড্ডা, ফাজলামো—সব মিলিয়ে কলেজজীবন যেনো রঙিন এক গল্প।

হঠাৎ একদিন আমাদের এলাকায় এলো ফারজানার ছোট ভাই, আসলাম। প্রায়ই সে আসত। আর আমি? আমি তো ছোটবেলা থেকেই ওকে দেখতে পেলেই ছুটে যেতাম। কেন জানি না, ছেলেটাকে আমার খুব ভালো লাগত। ফারজানা ব্যাপারটা জানত। মজার ছলে মাঝেমাঝেই ও আমাকে “ভাবি” বলে ডাকত, আর আমি লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম।
আসলাম আর ফারজানা ছিল পিঠাপিঠি ভাইবোন। ও শান্তিপুরে পড়ত। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যার কারণে আসলামের পড়া চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে যায়। ফলে ও চলে আসে ময়মনসিংহে—আর ভর্তি হয় আমাদের কলেজেই। প্রথম দিনেই ওর সঙ্গে রুদ্রর দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তারপর থেকে ওদের দুজনের বন্ধুত্ব যেমন গাঢ় হতে থাকে, তেমনি আমরাও আরও ভালো বন্ধু হয়ে যাই ওদের সকলের।
দিন দিন আমি আর সাবিহা বুঝতে পারি, রুদ্র আসলে ফারজানাকে পছন্দ করে—না না, পছন্দ না, ভালোবাসে। সেই চোখের চাহনি, সেই নিরব ভালোবাসার স্পর্শ আমাদের চোখ এড়ায় না। আমি একদিন ফারজানাকে সরাসরি বলেই ফেলি, তুই বুঝিস না রুদ্র তোকে কতটা ভালোবাসে? কিন্তু ফারজানা সবসময় এড়িয়ে যেতো আমাদের এই কথা। মুখে কিছু না বললেও আমি জানতাম, ওর মনেও রুদ্রের জন্য ভালোবাসা আছে—ভালোবাসা, যা ও কখনো বলতে পারেনি।

আর অন্যদিকে, সাবিহা একসময় স্বীকার করে—সে রেদওয়ানকে ভালোবাসে। আর এদিকে সায়েম আমাকে বলে সে আমাকে ভালোবাসে, আমি ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলি যে আমি ছোএ থেকে আসলাম কে ভালোবাসি। আর সায়েম ও সেটা মেনে নেয় আর আমার কাছে মাফ চায় না যেনে এইসব বলার জন্য। সব মিলিয়ে, অজস্র না বলা ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর মিষ্টি দুষ্টামির মাঝে আমাদের সময়গুলো এক একটা সোনালী স্মৃতি হয়ে ধরা দিত।
কলেজ জীবনটা যেনো এক রঙিন ছবির মতো—যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত জড়িয়ে আছে না বলা কথার ছায়ায়, অব্যক্ত ভালোবাসার গভীরে।

একদিন আমাদের ক্লাসে ঘটে গেল একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
সেদিন ক্লাসের ঠিক ঢুকতেই একটা ছেলে ফারজানার কাছে এগিয়ে এসে চুপিচুপি একটা চিঠি দেয়। ফারজানা চিঠিটা নেয়নি, ছেলেটাকে রীতিমতো ধমকেই সরিয়ে দেয়। কিন্তু এমন ঘটনা তো আর চাপা থাকে না! খবরটা ঠিকই পৌঁছে যায় রুদ্রর কানে।
রুদ্র বরাবরই চুপচাপ, ভদ্র ছেলে হলেও, ফারজানাকে নিয়ে সে ছিল অদ্ভুতরকম সংবেদনশীল। আর যেই না সে শুনল অন্য একটা ছেলে তার ভালোবাসার মানুষকে চিঠি দিয়েছে—ব্যস! যেনো তার মাথায় আগুন ধরে গেল। সেই বিকেলে, কলেজ ক্যাম্পাসের মাঠে রুদ্র চিঠি দেওয়া ছেলেটাকে ধরে এমন মার মারে, যেনো জীবন বের করে ফেলবে!

সে কী মাইর! বাবাগো…
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কেউ রুদ্রকে কিছু বলেনি। বলার সাহসও পায়নি কেউ। কারণ রুদ্রর বাবা ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। আর রুদ্র নিজে তার মেধা দিয়ে স্যার-ম্যাডামদের মন জিতে নিয়েছিল খুব অল্প সময়েই। সবাই জানত, রুদ্র ভালো ছেলে—কিন্তু সেই ভালো ছেলের ভিতরেও যে আগুন জ্বলছে, সেটা কেউ আগে টের পায়নি।রুদ্রকে ছেলেটাকে মারতে দেখে সবাই ভেবেছিল রুদ্র হয় অন্যায় করেছে যার জন্য রুদ্র তাকে মারছে।
সেদিন সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে রুদ্রর সঙ্গে ফারজানার।
রুদ্র যখন মাথা গরম করে ক্যাম্পাস থেকে বেরোতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ফারজানা গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসে। কারও কিছু বলার আগেই, সবার সামনে—ফারজানা রুদ্রর৷ গালে কষিয়ে একটা চড় মারে।
ঠাসসসস****

মাঠ জুড়ে নিঃশব্দতা। কেউ কিছু বলতে পারছে না।
রুদ্র হতবাক, ফারজানা কাঁপছে—রাগে।
ক্যাম্পাসের মাঠে ঘটনার সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত যেনো কারও নিশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। সবার চোখ ফারজানার দিকে—আর ফারজানার চোখ রুদ্রর দিকে ঠিকরে পড়ছে আগুনের ঝলক।
ফারজানা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— কেন মারলি ওকে? কোন অধিকারে?
রুদ্র, যার মুখ তখনো রাগে- লাল, সেদিন মাঠবর্তী লোকদের সামনেই বুক ফুলিয়ে চিৎকার করে বলে উঠেছিল,
—ভালোবাসার অধিকারে! তোকে আমি ভালোবাসি! শুনেছিস? তোকে ভালোবাসি আমি! তুই শুধু আমার—যে তোর দিকে হাত বাড়াবে, সেই হাত আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব!
তার চোখে তখন ছিল অগ্নিশিখা। প্রেমে পাগল একটা ছেলের চোখ।
কিন্তু এইবার ফারজানা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে আবারও তার গালে চড় মারে।
চোখ দুটো জ্বলছিল।

— তো আমাকে কখনও বললি না কেনো যে তুই আমাকে ভালোবাসিস.. গাঁদা!কখনো চেয়েছিস আমি ভালোবাসি কি না?
রুদ্র থমকে যায়। চোখ স্থির।
ফারজানা এক পা এগিয়ে আর একটা থাপ্পড় মেরে বলে,
— আমি-ও তোকে ভালোবাসি…বুঝেছিস গাধা।
এক মুহূর্ত… এক চুপচাপ নিঃশব্দতা… তারপর যেনো সব ভেঙে পড়ল।
রুদ্র কিছু না বলে, ছুটে চলে যায় ফারজানা। ফারজানা আর পেছনে তাকায় না।
আর ঠিক তখনই আসলাম এসে জড়িয়ে ধরে রুদ্রকে।
— তাহলে কবে হচ্ছিস আমার দুলাভাই।
রুদ্র মুচকি হেসে বলে,

— আজই গিয়ে জানাব বাবাকে…
ওদের হাসি, আনন্দে ভরে ওঠে কলেজ ক্যাম্পাসে জুড়ে ।
আর একটু পরে রেদওয়ান আর সায়েমও এসে জড়িয়ে ধরে রুদ্রকে।
বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর স্বীকৃতির সে এক অনন্য মুহূর্ত।
এ যেনো একটুকরো কৈশোরের স্বপ্ন বাস্তবতার রূপ পেল।
রুদ্র তার বাবা কে নিয়ে এসেছে ফারজানাদের বাড়িতে, দুই পরিবার একসাথে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের কথা পাকা করে। সব যেনো স্বপ্নের মতো এগোচ্ছিল। আর কেউ জানত না, এই স্বপ্নের পেছনে জমছে এক কালো ছায়া।
ফারজানার বিয়ের দুইদিন আগে হঠাৎ রেদওয়ান আসে ফারাজানাদের বাড়িতে।
সেদিন দুপুরে, আমি, ফারজানা আর রেদওয়ান বের হলাম গ্রামের পথ ধরে। গাঁয়ের মানুষ আমাদের দেখে হাসে, আর ফারজানাকে আশীর্বাদ করে—একটা সাধারণ প্রেমকাহিনির অসাধারণ রূপ যেনো ওদের চোখে।
অনেকটা হেঁটে এক নির্জন জায়গায় পৌঁছাতেই রেদওয়ান বলে,

— গাছ থেকে পেয়ারা আনতে?
আমি জানতাম ওর চোখে অন্য কিছু, তাই মুচকি হেসে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়লাম ভেবে ছিলাম রুদ্র কিছু বলতে পাঠিয়েছে। ওদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম—আর সেই কথাগুলো আমার বুকের ভেতর কাঁটার মতো বিঁধে যাচ্ছিল।
রেদওয়ান হঠাৎ বলে উঠে,
—ফারজানা, আমি তোকে ভালোবাসি। তোকে বিয়ে করতে চাই।
ফারজানা চমকে উঠে,
— কি বলছিস তুই? তুই জানিস আমি রুদ্রকে ভালোবাসি আর রুদ্র আমাকে। তুই তো রুদ্রের বেস্ট ফ্রেন্ড, তুই এটা কীভাবে বলতে পারিস?লজ্জা করছে না তোর বন্ধু হয়ে, বন্ধুর হবু বউকে এগুলো বলতে…
রেদওয়ানের মুখ মুহূর্তেই কালো হয়ে যায়।
সে গর্জে ওঠে—

—কিসের বেস্ট ফ্রেন্ড? রুদ্র সব সময় আমাকে তার চাকর মনে করে! আমি গরিব বলে? তার বাবার টাকা আছে বলে স্যার-ম্যাডামরাও ওকে ভালোবাসে,আর আমাকে অপমান করে! সবাই ওকে চায়, আমাকে কেউ চায় না! জানিস, আমি তোকে আগে থেকেই ভালোবাসতাম! আর ও কী করলো তোকেও নিজের করে নিলো..আমি সব সময় ওর কাছে হেরে যাবো কেনো বল কেনো এলাকার সবাই ওর গুনো গান করে আর আমাকে ওর মতো হতে বলে আমি কেনো ওর মতো হবো বল??ওকে সবাই ভালোবাসে কেনো বল কেনো?
এই বলে সে ফারজানার হাত চেপে ধরে আর বলে,

— চল পালিয়ে যাই! আমি তোকে সুখে রাখব, সত্যি!
ফারজানা হতবাক হয়ে যায়। রেগে, কষ্টে কেঁপে ওঠে সে।
তারপর এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে, সজোরে একটা থাপ্পড় মারে রেদওয়ানকে।
— তোকে আমি ভাইয়ের মতো ভেবেছি! তোকে বিশ্বাস করেছি! আর তুই! তুই বন্ধু না—শত্রু! রুদ্রকে সবাই ভালোবাসে কারন ওর মন ভালো। ও গরীব দুঃখীর পাশে দারাই। অসহায়দের সাহায্য করে ওর মধ্যে অহংকার নেয়।ও নিজের ভালো গুন দিয়ে সবার ভালোবাসা অর্জন করে নিয়েছে। তোকে রুদ্র কত বিশ্বাস করে আর তুই ছিঃ! এমন গাদ্দারি করলি! তুই বন্ধু হওয়ার যোগ্যই না। তোর মতো বন্ধু আমার শত্রুরও না হোক।
এই বলে সে পিছন ফিরে ছুটে চলে আসে। আর আমি তখন গাছের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসে পেছন পেছন দৌড়ে ফারজানার কাছে যাই।
ওর চোখে তখন শুধু জল,আর বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র যন্ত্রণা।
আমি ওর পাশে দাঁড়াই, নিঃশব্দে ওর হাত ধরি সব সময়ের মতো।

ফারজানা আর রুদ্রর বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। আমি বারবার বলেছিলাম, ফারজানা যেনো রুদ্রকে রেদওয়ানের সেই দিনের ঘটনাটা জানিয়ে দেয়। আমি সেদিন রেদওয়ানের চোখে রুদ্রর জন্য আকরুশ ঘৃনা দেখেছিলাম। তাই বার বার বলছিলাম রুদ্রকে যানাতে কিন্তু ও মাথা নাড়ল।
— এখন না। সময় হলে বলব।
আর সেই “সময় হলে” বলাটা, বুঝি কাল হয়ে দাঁড়ায়।
গায়ে হলুদ আর তত্ত্ব নিয়ে যখন সায়েম আর রেদওয়ান এল ওদের বাড়ি, তখনো কারো কল্পনাতেও ছিল না, কী হতে চলেছে।
সবার সামনে হঠাৎই রেদওয়ান ফারজানার পায়ের কাছে বসে পড়ে,

— ভুল করেছি, খুব বড় ভুল। আমি ভালো হতে চাই, সত্যিই চাই। আমায় মাফ করে দে। তোর কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই আমার।
ফারজানা হতভম্ব। একসময় চোখে জল নিয়ে রেদওয়ানকে ক্ষমা করে দেয়।
— ভুল মানুষ করে, তবে অনুশোচনাটাই মানুষকে আবার মানুষ করে তোলে।
এর পর খুব ধুম ধাম করে ওর বিয়ে হয়।
ফারজানা আর রুদ্র—ওদের সংসার রঙিন স্বপ্নে ভরে ওঠে। ওদের ভালোবাসা যেনো আর কোনো ঝড় ঠেকাতে পারবে না।
আর আমি?
বিয়ের কিছুদিন পর একদিন বিকেলে, কলেজ ক্যাম্পাসে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে গলা ভেসে এলো,

— তুই জানিস তো, ছোটবেলা থেকে তোকে খুব পছন্দ করতাম। আমি তোকে ভালোবাসি, রুপা।
চমকে পেছন ফিরে দেখি, আসলাম।
সেই আসলাম—যাকে আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি, শুনেছি, অনুভব করেছি, আর নিঃশব্দে ভালোবেসে গেছি।
সেদিন ওর কথায় আমার হৃদয় যেনো আনন্দে উড়ছিল। মেঘের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি এমন লাগছিল।
ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, সে ফেরে।
আর যাকে ভালোবেসে জীবনে চেয়ে প্রার্থনা করো, সে যদি একদিন এসে বলে “আমি তোকে ভালোবাসি”—তবে তারচেয়ে বড় খুশি এই জীবনে বদয় আর কিছু নেই।
আসলাম আমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, আমার বাবা ও রাজি হয়ে যায।
আমার জীবন তখন পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছে।

আসলামকে বিয়ে করার পর ওর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর যত্নে আমি যেনো নতুন করে নিজেকে চিনতে শিখলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার কোল আলো করে আসে এক টুকরো চাঁদ—আমাদের ছেলে হাবিব।
হাবিবের প্রথম হাঁটা, প্রথম কথা, প্রথম স্কুল—সব কিছুর মাঝে কাটছিল আমার জীবন।
আর সেই সময়টাতেই ফারজানা আর রুদ্রর সংসারে এক অভাব যেনো নিঃশব্দে জমতে শুরু করেছিল।
প্রথমদিকে কেউ কিছু না বললেও, বছর কয়েক পেরোনোর পর আশেপাশের চাহনি আর চাপগুলো বেড়ে যায়।
কিন্তু রুদ্র?
সে কখনও একবারও ফারজানার চোখে দুঃখ আসতে দেয়নি। বলত—

—সন্তান না থাকলেও, তুমি আমার পৃথিবী। সন্তান আল্লাহর দান আল্লাহ চাইলে হবে না চাইলে হবে না তাই এগুলো নিয়ে মন খারাপ করো না।
এমন ভালোবাসা খুব কম মানুষ পায়। রুদ্র ফারজানাকে ভালো ডক্টর দেখাতে থাকে।
এদিকে রেদওয়ান সাবিহাকে বিয়ে করে নেয়। সায়েম ও বিয়ে করে বিদেশে সেটেল হয়ে যায়। সব মিলিয়ে আমাদের সবার জীবন খুব ভালোই কাটতে লাগলো।
একদিন সকালবেলা আসলাম আমায় ডাকে,
—শোন, দারুণ খবর আছে।
আমি হতবাক হয়ে শুনি, ফারজানা আর সাবিহা—দুজনেই গর্ভবতী। সুখ যেনো আমাদের সাথী চার দিকে শুধু সুখ আর পূর্ণতা।

আরও বিস্ময়ের কথা, ওরা দুজনেই একই দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়।
একই সময়, একই দিনে—একই হাসপাতালে দুই ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।
আলোয় ভরে যায় দুটো পরিবার।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৪

সেই দিন রুদ্রের খুশি যেনো আকাশ ছুঁয়েছিলো। ছোট রাজ ও রিদ দুজনকে কলে নিয়ে আজান দেয়।
আর আমি, ফারজানা আর সাবিহা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম—সুখের কান্না।
জীবন যদি নাটক হয়, তবে এই পর্ব যেনো আল্লাহর লেখা এক সুন্দর দৃশ্যপট।
যেখানে ভালোবাসা, ভরসা আর বন্ধন একসাথে বাঁধা পড়ে যায়—নতুন এক ভবিষ্যতের দিকে।
কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন টিকলো না.. আমাদের কারো জীবনে.. চলে এলো সেই কালো রাত।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫ (২)