মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৭

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৭
মির্জা সূচনা

রাত ঠিক বারোটা।আকাশে তারা জ্বলছে, চারপাশ নিস্তব্ধ। আত্মীয়-স্বজন সবাই বাড়ি চলে গেছে। ছাদের এক কোণায় বসে আছে তিনজন—মেহরিন, রাজ আর লাবিব।
আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ লাবিব বলে উঠলো,
— ভাবি তুমি কীভাবে সব ম্যানেজ করলে তুমি?
মেহরিন কিছু বলে না শুধু মুচকি হাসে।
লাবিব অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
—তুমি আর ভাই একেবারে এক কপি। ভাই কোনো প্ল্যান করলে সেটা যেমন সাফল্য ছাড়া থামে না, তুমি আর এক কাঠি সরেস! কিন্তু এতকিছু একা ম্যানেজ করলে কীভাবে?
রাজও মাথা নেড়ে বলে,

— সেটাই তো ভাবছি। আচ্ছা তুমি‘boom’টা পেলে কোথায়?
মেহরিন এবারও কিছু না বলে শুধু মুচকি হেসে ওঠে।
তারপর হঠাৎ বলে,
— এইটাই তো শেষ না… আরেকটা সারপ্রাইজ আছে Just wait and see…”
রাজ আর লাবিব একসাথে বলে ওঠে,
— আবার কী সারপ্রাইজ?
মেহরিন হাসে। ফোন বের করে সময় দেখে, তারপর কাউকে কল দেয়। বলে,
— কি রে, মিশন সাকসেসফুল?
ওপাশ থেকে কী বলা হয়, সেটা শোনা যায় না। শুধু মেহরিন হাসি মুখে বলে,
— “Well done.”
তারপর রাজ আর লাবিবের দিকে তাকিয়ে বলে,
— 1… 2… 3… Dhammmaka!!!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাজ আর লাবিব চমকে ওঠে।একে অপরের মুখের দিকে তাকায় তারপর আবার মেহরিনের দিকে তাকায়।
মেহরিন উঠে দাঁড়িয়ে গান ধরে,
মে তেরা দুশমন…!
দুশমন তু মেরা…!
মে নাগিন.. তো সাপেরা …!!
লাবিব কানে কানে রাজকে বলে,
— ব্রো, ভাবি কি পাগল হয়ে গেছে?
রাজ চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে,
— আর একবার আমার বউকে পাগল বললে তোকে পাবনায় রেখে আসবো—টিকিট ছাড়াই।
লাবিব মুখে হাত দিয়ে বলে,
— থাক! আর কিছু বলবো না। কিন্তু এক কাজ করো, ভাবিকে জিজ্ঞেস করো তো এই ‘ধামাকা’টা আসলে কী ছিল?
রাজ বলে,

— বউ, তুমি আবার কি ধামাকা করেছো তাড়াতাড়ি বলো। নয়লে টেনশনে আমার কিডনি লক হয়ে যাবে।
মেহরিন হেসে বলে,
— ফোন চেক করুন।
রাজ আর লাবিব ফোন বের করে দেখে—একটা ভিডিও পাঠানো হয়েছে। ভিডিওটা চালিয়ে দেখে ওদের চোখ ছানাবড়া।
ভিডিওটিতে সায়েম সাহেবকে দেখা যাচ্ছে যে একটা মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় রয়েছে সেই ভিডিও পুরো নেট দুনিয়াতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
দু’জন একসাথে বলে ওঠে,
— “Ohhh nooo!”
মেহরিন উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
তার হাসিতে রাজ আর লাবিবও হেসে ফেলে।
মেহরিন বলে,

— গিফট কেমন লাগলো আপনাদের?
গিফট পেয়ে আপনাদের অনুভূতি কেমন বলুন?
লাবিব বলে,
—ভাবি, তুমি যা দিয়েছো না…
রাজ হাসতে হাসতে বলে,
— Moonbeam! তুমি এত কিছু কবে করলে?
মেহরিন এবার মুখটা গম্ভীর করে বলে,
— এইটা তো শুধু শুরু…ওদের মান সম্মান অহংকার আহমিকা আমি মেহরিন শিকদার—মাটির সাথে মিশিয়ে দেবো। ওদের রাস্তায় নামিয়ে আনবো।
ওদের পাপের শাস্তি, ওদের পেতে হবে।
আপনাদের শৈশব কেড়ে নেওয়ার শাস্তি তাদেরই পেতে হবে।
আপনাদের মা-বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করেছিল যারা—তাদের শাস্তি পেতে হবে। সবকিছু থাকার পরেও আপনারা যাদের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন তাদের শাস্তি পেতে হবে। সব কিছু হিসাব ওদের দিতে হবে।
লাবিব গর্বিত চোখে তাকায় মেহরিনের দিকে। রাজ একেবারে স্তব্ধ।
মেহরিন এবার এগিয়ে এসে রাজের দু’হাত ধরে বলে,

—আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী, আপনার সুখ-দুঃখের সাথী।
আপনার খুশি মানেই আমার খুশি।
আপনার দুঃখ মানেই আমারও ব্যথা।
আপনার প্রতিশোধ, মানে আমারও প্রতিশোধ।
আপনি একা না, কবি সাহেব… আপনার Moonbeam, আপনার বউ, আপনার আরিওনা আপনার পাশে আছে… আর সারা জীবন পাশে থাকবে ইনশাল্লাহ।
রাজ জড়িয়ে ধরে মেহরিনকে।
লাবিব চোখ মুছে হেসে ছাদ থেকে নেমে যায়, মনে মনে বলতে বলতে—

— জীবনসঙ্গী তো এমনই হওয়া উচিত। যে সব অবস্থায় স্বামীর পাশে থাকে… আমার ভাবির মতো।
রাজ মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ধীরে ধীরে বলে উঠল—
আজ আবার তুমি প্রমাণ করে দিলে, আমি ভুল মানুষকে ভালোবাসিনি। আমি এমন একজনকে ভালোবেসেছি, যে শুধু আমার ভালোবাসা নয়, আমার বিশ্বাসের জায়গা, আমার আস্থার ঘর। সে আমার জান-পাখি, আমার Moonbeam, আমার আরিওনা… আমার বউ।অনেক ভালোবাসি তোমায়, বউ।
মেহরিন হেসে বলে উঠল—
আমিও ভালোবাসি আপনাকে, জামাইজান। আপনি আমার কবি-সাহেব, আমার স্বামী, আমার ভালোবাসার মানুষ, আমার জীবন-মরণের সাথী।
এক গভীর আবেগময় মুহূর্তে, দুজনের নিঃশ্বাস এক সুরে মিশে যায়।
একটু পর, মেহরিন আস্তে করে মুখ তুলে রাজের বুক থেকে আর বলে—
জানেন কবি সাহেব, আপনার কোন জিনিসটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?
রাজ কপাল কুঁচকে বলে—

কি?
মেহরিন দুই হাত তুলে দেয়, যেমন বাচ্চারা কোলে উঠার জন্য হাত বাড়ায়।
রাজ হেসে বলে—
— বাচ্চা কোলে নেবার বয়সে যদি এমন বাচ্চার মা কে কোলে নিতে হয়, তাও আবার যেই সেই রকমের না… একেবারে ডেঞ্জারাস! ঠান্ডা মাথায় শত্রুর বারোটা বাজিয়ে দেয় এমন বাচ্চার মা…!
মেহরিন মুখ ফিরিয়ে নেয়, বলে—
— ধুর! আনরোমান্টিক ব্যাটা.. মুডটাই নষ্ট করে দিলো…
রাজ হেসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, দুই হাত রাখে মেহরিনের পেটে। শুধু রাখে না, হাত দিয়ে এলো মেলো ভাবে ছুঁয়ে দেয়। মেহরিন কেঁপে ওঠে।
— কবি সাহেব…
রাজ নেশাগ্রস্ত গলায় বলে—

— হুম?
মেহরিন রাজের হাত ধরে বলে—
— আপনি আমার কথা শুনছেন না কেন?
রাজ এবার মেহরিনকে নিজের দিকে ফিরিয়ে মুখে দু’হাত রেখে বলে—
—শুনছি না বুঝি? তুমি তো বললে আমি আনরোমান্টিক! একটু দেখালাম, আনরোমান্টিক কি করে রোমান্টিক হয়…
মেহরিন রাজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে—
—ইসসসস! চুপ। আমার কথা আগে শুনবেন।
রাজ মুচকি হেসে হালকা কামড়ে দেয় মেহরিনের আঙ্গুলে তার পর বলে—
— শুনছি ম্যাডাম।
মেহরিন মুখ ঢেকে বলে—

—ইসসস এইভাবে ‘ম্যাডাম’ ডাকবেন না। আমার কেমন কেমন লাগে…
রাজ দুষ্টু হাসে, মুখটা মেহরিনের কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে—
— কেমন কেমন লাগে, বউ জান?
মেহরিনের কান গরম হয়ে ওঠে। সেও রাজের কানে কানে বলে—
— সেটা এখন বলবো না… সাজেকে গিয়ে বলবো কেমন?
রাজ হঠাৎ শিশুদের মতো করে বলে—
— বউউউউ…”
মেহরিন হেসে তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় তারপর কওালে কপাল ঠেকিয়ে বলে—
—আহারে, আমার বউ-পাগল জামাইটা।
রাজ হেসে বলে—

— অবশ্যই আমি বউ-পাগল! এমন বউ পেলে পাগল না হয়ে উপায় আছে?
মেহরিন রাজের নাকে হালকা কামড়ে দেয়।
রাজ বলে—
— সব সময় আমার কাজটা তুমি করো…
মেহরিন বলে তাই বুঝি?
রাজ মাথা নাড়ে—
—হ্যাঁ, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি তোমার বউ, আর তুমি আমার জামাই। এই দেখো যেমন তুমি আমায় খেয়ে দিলে..যেখানে আমার তোমাকে….
মেহরিন হেসে বলে—
— ছি… কী ভাবেন আপনি এসব?
রাজ বলে—

—আচ্ছা বলো তো, আমার কোন জিনিসটা তোমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?”
মেহরিন একটু এগিয়ে এসে বলে—
— আপনার কবিতা… যেটার প্রেমে পড়ে আমি হারিয়ে গেছিলাম…যার মায়ায় পরেছি অনেক ভাবে।
রাজ আরেকটু পিছিয়ে যায়।
মেহরিন আবার বলে—
— “আর…”
রাজ বলে—আর?
মেহরিন আবার বলে—আর…
রাজ আবার— আর…
এই খেলার ছলে মেহরিন এগোচ্ছে রাজ পেছাতে পেছাতে গিয়ে ঠেকে দেয়ালে।
মেহরিন আবার রাজের সামনে এসে দু’হাত বাড়িয়ে দেয়। রাজ তাকে কোলে তুলে নেয়।
মেহরিন রাজের চোখে চোখ রেখে বলে—
— আর আপনার এই… এটা…

সে আঙুল রাখে রাজের কপালে তার পর কপাল থেকে শুরু করে আঙ্গুল নামিয়ে আনে নাকে… তারপর থামে গলার সেই উচু অংশে, যাকে অ্যাডামস অ্যাপলের বলে ঠিক তার ওপরে।
— এই জায়গাটা… খুব পছন্দ আমার…
রাজ ধীরে ধীরে দম নেয়, গলায় যেনো কথা আটকে যায়।
মেহরিন ঠোঁটে হালকা ছোঁয়া দেয় সেখানে।
রাজ মেহরিনের মাথা তুলে ডুবে যায় মেহরিনের ঠোঁটে।মেহরিনের সারা পেয়ে রাজ আরও বেসামাল হয়ে উঠে।
মুহূর্তেই তারা হারিয়ে যায় এক গভীর অনুভবে, যেখানে কথা কম, স্পর্শের ভাষা বেশি। রাজ দিশেহারা, আর মেহরিন… তার সম্মতিতে রাজ একেবারে তাল মাতাল।
রাজ যখন একরকম দিশেহারা হয়ে পড়েছে, তখনই মেহরিন তাকে আস্তে করে ঠেলে দেয়।

— উঁহু… এখন না, মেহরিন চোখে চোখ রেখে বলে ছিলাম, আমি আপনার কাছে ধরা দেবো কিন্তু এখানটায় না…
রাজ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। ঠোঁটে তৃষ্ণার দীর্ঘশ্বাস।
—আমি কালই সাজেক যাচ্ছি।
মেহরিন হেসে ওঠে। রাজের বাহুতে হালকা এক চড় দেয়।
রাজ বলে,
— আপনার খুব হাসি পাচ্ছে তাই না কিন্তু আপনি যে আমাকে তৃষ্ণার্ত রেখে যাচ্ছেন আপনি আমাকে শুধু তৃষ্ণায় জ্বালাচ্ছেন আর বলছেন ভালোবাসেন..
মেহরিন হাসে।
রাজ অস্থির হয়ে বলে—

— তুমি আমার তৃষ্ণা মেটাচ্ছো না, অথচ আমি পিপাসায় মরছি, বউ…”
মেহরিন হেসে ফিসফিসিয়ে বলে—
—আরও কিছুদিন তৃষ্ণায় থাকুন… সময় হলে আমিই আপনার সব পিপাসা মেটাবো—মোহে, ভালোবাসায়, পুরোপুরি…”
রাজ হেরে গিয়ে বলে—
— আচ্ছা তবে আজ অন্তত জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে দিও। প্রথম দিনের মতো মাঝরাতে বের করে দিও না প্লিজ…
মেহরিন মাথা নাড়ে। রাজ তখন তাকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
মেহরিন রাজের বুকের মাথা রেখে ধীরে ঘুমের দেশে পারি দেয়। রাজও চোখ বন্ধ করে, বুকের মধ্যে তার প্রিয় মানুষটিকে জড়িয়ে রাখে প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে।
সকাল ৯টা। মেহরিন রান্নাঘরে সবার জন্য নাস্তা তৈরি করছে।লামিয়া রেডি হয়ে নেমে আসে।
— Tata ভাবিমণি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মেহরিনকে একটা চুমু দিয়ে বিদায় নেয় সে।

— সাবধানে যেও, বলে মেহরিন।
লাবিব নাস্তা করছে, রূপা বেগম নিজের রুমে, আর কুলসুম মেহরিনকে সাহায্য করছে। হঠাৎ রাজ ডাক দেয়—
— Moonbeam…?
সব গুছিয়ে মেহরিন বলে—
— কুলসুম আপা, তুমি বাকিটা দেখে নিও, আমি আসছি।
কুলসুৃ বলে আচ্ছা ভাবি।
মেহরিন রুমে ঢুকে দেখে রাজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। মেহরিন জিজ্ঞেস করে
— কি হয়েছে? ডাকছেন কেন? সব তো আপনার সামনেই আছে।
রাজ হেসে বলে—

— আসল জিনিসটা তো সামনে ছিল না।
মেহরিন চারপাশে তাকিয়ে বলে—
— কি জিনিস?
রাজ এগিয়ে এসে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে
— এই যে আমার বউ।
মেহরিন হেসে ফেলে। রাজের টাই টা পরিয়ে দেয় মেহরিন।
রাজ বলে— রেডি হয়ে থাকো। মিটিং শেষ করে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবো।
মেহরিন টেনে বলে—
— “ঠিক আছে…”
রাজ মেহরিনের কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে
— আসি।
মেহরিন মুখ গম্ভীর করে বলে—

— আমি এত কষ্ট করে রান্না করলাম, আর আপনি খেয়ে চলে যাবেন?
রাজ ভ্রু কুঁচকে বলে—
— বউ কষ্ট করে রান্না করেছে, না খেয়ে গেলে উপায় আছে? না খেলে তো দেখা যাবে তুমি রাগে আমার অফিসেই বম মেরে দেবে।
মেহরিন হেসে , রাজের বুকে মুখ গুঁজে দেয়।
রাজও হাসে। তাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে বলে—
— চলো।
তারপর তারা একসঙ্গে নাস্তা করে। রাজ আর লাবিব চলে যায় অফিসের পথে,

দুপুর ১টা।
মেহরিন রেডি হচ্ছে। সাথে লামিয়া। লামিয়াও যাবে মেহরিনদের সাথে।
লামিয়া:
ভাবিমণি, তুমি আমার ব্রো কে অনেক ভালোবাসো, তাই না?
মেহরিন হেসে বলে:
তোমার ভাইকে আমি বিয়ের আগেই ভালোবাসতাম। আর এখন তো উনি আমার স্বামী। আমার আত্মার সাথে ওনার সম্পর্ক। তাঁর বাঁকা হাড় আমি।
লামিয়া বলে,ব্রোও তোমাকে অনেক ভালোবাসে, ভাবিমণি।
মেহরিন মাথা নাড়ে।
ঠিক তখনই রাজের কল আসে।
লামীয়া দেখে ফোনে নাম লেখা—“কবি সাহেব”
লামিয়া হেসে বলে
বাব্বাহ, কবি সাহেব!
মেহরিন ফোন রিসিভ করে।
রাজ বলে,

“Moonbeam, তুমি লামিয়াকে নিয়ে আমার অফিসে চলে আসো। এখান থেকেই আমরা চলে যাবো তোমাদের বাড়িতে।
মেহরিন বলে,
“আচ্ছা,”
মেহরিনরা বেরিয়ে পড়ে, রূপা বেগমকে বলে,রাজের অফিসের সামনে গিয়ে নামে। ভিতরে ঢোকার আগে হঠাৎ একজন লোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।
মেহরিন বলে,
“সরি।”
লোকটা কিছু একটা লুকায়, বলে—
“No problem.”
মেহরিন ভালোভাবে তাকায় লোকটার দিকে। তারপর ভিতরে ঢুকে পড়ে।
ওরা রাজের কেবিনে গিয়ে বসে। হঠাৎ মেহরিন দেখে, ওই লোকটাও ভিতরে ঢুকছে—হাতে কিছু একটাযা উনি লুকিয়ে রাখছে।
মেহরিন লামিয়াকে বলে,

তুমি একটু বসো, আমি আসছি।
সে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে দেখেই বুঝে নেয়, লোকটা কোথায় ঢুকছে—সেই জায়গাতেই মূলত মিটিং হচ্ছে রাজদের।
লোকটা রাজের পাশে গিয়ে বসে। রাজ তখন প্রজেক্টরে কিছু বোঝাচ্ছে সবাইকে।
ঠিক তখনই লোকটা তার হাত থেকে বন্দুক বের করে খুব নিচে থেকে তাক করে রাজের মাথায়। যেনো কেউ দেখতে না পায়।
ঠিক সেই মুহূর্তে, মেহরিন নিজের ব্যাগ থেকে ধারালো ছুরি বের করে ছুঁড়ে মারে লোকটার হাতে। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকটা পড়ে যায়। সবাই চমকে ওঠে।
লাবিব ছুটে এসে লোকটাকে ধরে ফেলে।
মেহরিন বলে,
ছাড়ো ওকে।
লাবিব
কিন্তু ভাবি…
মেহরিন রাজের দিকে তাকায়
রাজ মাথা নাড়ে।
রাজ বলে,
ছাড়।
লাবিব রেগে বলে

ইচ্ছে তো করছে হতোকে এখানেই পুঁতে দিই।
মেহরিন ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায়। পুরো রুম স্তব্ধ।
তার গায়ে কালো রঙের শাড়ি, চুল খোঁপা, মুখে হালকা সাজ। কিন্তু চোখে যেনো আগুন।
অনেকে চিনে ফেলছে মেহরিনকে, অনেকেই পারছে না।
মেহরিন লোকটার পাশে ঘুরতে ঘুরতে বলে—
কে পাঠিয়েছে আপনাকে, ভাই?
লোকটা ভয় আর হাতের ব্যাথায় কাঁপছে। সে রাজকে চেনে। কিন্তু অনেক টাকার লোভে এসেছে। ভাবেনি ধরা পড়ে যাবে।
মেহরিন কৌতুকের সাথে বলে,
আরে আরে ভাইজান! ভয় পাবেন না! বলেন তো, কে পাঠিয়েছে আপনাকে?
রাজ দুই হাত বাজ করে তাকিয়ে আছে মেহরিনের দিকে। ঠোঁটে হালকা হাসি।
লাবিব মনে মনে বলে,

শেষ! ভাইজান বলে বলে মেরেই দেবে! কী মানবতা, বাহ!
অবশ্য মানবতা তো থাকবেই—ভাবি টা কার, দেখতে হবে না। আমার এত মানবতা আমার ভাবির যদি না থাকে তাহলে কি জাতি মেনে নিতো।
লাবিব নিজেই নিজেকে বাহবা দিতে লাগল মুখ চেপে।
হঠাৎ মেহরিন চিৎকার করে বলে:
কি হলো? কথা বলছেন না কেন? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো, ভাইজান।
তার পর মুহূর্তেই সুর বদলে আদুরে গলায় বলে
“আহা ভাইজান, বলুন না..”
মিটিং রুমে উপস্থিত সকলে হতবাক।
রাজ আর লাবিব হাসছে।
মেহরিন লোকটার চোখে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বলে,
না না, এভাবে হবে না! লাবিব?
লাবিব বলে,

জি ভাবি?
মেহরিন বলে
তোমার বন্দুকটা দাও তো, দুই মিনিটের জন্য ধারে দাও।
লাবিব হেসে বলে,
দুই মিনিট কেন, দুই-তিন দিনের জন্যই নিয়ে নাও!
মেহরিন হাসে।
লাবিব বন্দুকটা দিয়ে দেয়।
মেহরিন লোকটার হাত টেবিলের উপর রেখে বন্দুক ঠেকিয়ে ঠাস করে একটা গুলি করে দেয়।
সবাই আঁৎকে ওঠে।
অনেকে বলে থাকে—
যেমন জামাই, তেমন বউ! একজন পেন দিয়ে মেরে দেয় আরেকজন ভাই ডেকেও গুলি করে দেয়।
রাজ আর লাবিবও অবাক।
ওরা ভেবেছিল মেহরিন শুধু ভয় দেখাবে, কিন্তু সে তো সত্যি সত্যিই গুলি করে দিলো।
লোকটা চিৎকার করে কাঁদছে:

আমাকে ছেড়ে দিন! আমাকে তালুকদার সাহেব অনেক টাকা দিয়েছে রাজ শিকদারকে মারতে।আমি লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে ছেরে দেন।
মেহরিন চোখে আগুন নিয়ে তাকায় লোকটার দিকে, আর চিৎকার করে বলে,
তোর ওই বাপকে গিয়ে বলে দিস, রাজ শিকদারের কাছে পৌঁছানোর আগেই,
এই মেহরিন শিকদারকে পার করতে হবে!
আর মেহরিন শিকদারকে পার করার মতো সাধ্য ওর নেই।
খবরদার! আমার হাসবেন্ডের দিকে যদি আর একবার চোখ তুলে তাকাস—
সেই চোখ আমি মেহরিন উঠিয়ে নেবো। তবে আমি তোকে জানে মারবো না।তবে
যে হাতে আমার স্বামীকে মারতে বন্দুক তুলেছিলি,
সেই হাতটা তুই নিজের শরীরেও রাখতে পারবি না।
তারপর ডাক দেয়—

লাবিব!
লাবিব বলে,
হ্যাঁ ভাবি?
মেহরিন বলে,
ওর এই হাতটা আলাদা করে দাও। আর সেই হাতটা একটা গিফট বক্সে ভরে পাঠিয়ে দিও—
রেদওয়ান তালুকদারের কাছে।
লাবিব মৃদু হেসে বলে,
আচ্ছা!
মেহরিন বন্দুকটা লাবিবের হাতে দিয়ে, রাজের কাছে যায়।
রাজের মুখটা নিজের আঁচলে মুছে দিয়ে বলে,
এসির মধ্যে ঘেমে যাচ্ছেন কেন?
রাজ হেসে ফেলে।
সবাই মেহরিনের দিকে তাকিয়ে অবাক।
এই মেয়েটাই একটু আগেই একজনকে গুলি করলো, আর এখন জামাইয়ের মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে।
রাজ:

“I’m sorry, everyone.
এখন আমার বউকে সময় দিতে হবে।
আপনারা যেতে পারেন।
সবাই মাথা নাড়ে আর একজন একজন করে বেরিয়ে যায়।
রাজ মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে:
ইশ, আমার বউটা এত ভায়োলেন্ট কেন!
মেহরিন হেসে বলে,
মাঝে মধ্যে হতে হয়!
চলুন এখন।
তারপর রাজ, লাবিব, মেহরিন ও লামিয়া মিলে মেহরিনদের বাড়ির পথে রওনা হয়।

সিঙ্গাপুর, সন্ধ্যা ৭টা।
মেহের বের হয়েছে বাইক নিয়ে।
বাইকটা তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলোর একটি।
সাথে আছে জেরি।
তারা মূলত একটা বাইক রেস করতেই বের হয়েছে।
দুজনে পরেছে কালো জিন্স, টি-শার্ট আর তার উপর ব্লেজার। মাথায় হেলমেট।
দু’জনে হাই-ফাই করে রেস শুরু করে।
রেসের শুরুতেই মেহের জেরিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়।
মেহের হাসে।
কিন্তু ঠিক তখনই দেখতে পায়, আরেকটা বাইক তার পাশেই ছুটছে।
একটা তীব্র, নিঃশব্দ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।
মেহের মনে মনে বলে,

আচ্ছা! তাহলে রেস করতেই চাও? চলো, হোক যাক।
মেহের গতি বাড়ায়।
দু’টো বাইক হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে চলে।
কখনও কেউ এগিয়ে যায়, কখনও পিছিয়ে পড়ে।
শেষমেশ বিজয়ী হয় মেহের।
মেহেরের বাইকের সামনে এসে থামে সেই অপরিচিত বাইক।
দু’টো বাইকই অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে—নির্জন রাস্তায়।
সেই বাইক থেকে একজন লোক নেমে আসে।
সে মেহেরের সামনে এসে দাঁড়ায়, হাত বাড়িয়ে বলে,
Hey, I am Rid.
মেহের হাত মেলায়

“Meher.”
রিদ তাকায়। তার মুখে একরকম গম্ভীর বিস্ময়।
মেহের হেলমেট খুলে ফেলে।
তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে কাঁধে।
তারপর সে হেলমেটটা ছুঁড়ে মারে রিদের দিকে।
রিদ সেটা ধরে ফেলে।
মেহের এক হাতে চুলগুলো গোছাতে থাকে।
রিদ অপলক তাকিয়ে থাকে।
তার চোখ মেহেরকে পর্যবেক্ষণ করে একেবারে নিখুঁতভাবে—
নীল চোখ, গোলাপি ঠোঁট, সোজা নাক আর থুটনির সেই ছোট্ট তিল।
আর যেভাবে চুলগুলো মেহের নিজ হাতে গুছাচ্ছে—
তাতে রিদ যেনো কিছু একটা অনুভব করতে থাকে।
রিদ মনে মনে বলে,

এইটুকু সামান্য চুল গুছানো অবস্থায়… কেউকে এতটা সুন্দর লাগে?
না… হয়ত আমি খুঁজছি মেহরিনকে ওর মাঝে…তাই এমন লাগছে।
কিন্তু… ওরা তো আলাদা…দুটো মানুষ।
ঠিক তখনই মেহের বলে,
ও হ্যালো? কোথায় হারিয়ে গেলেন?
রিদ চমকে উঠে বলে,
না না, কিছু না। আপনি এই সময়… মানে আমি ভাবছিলাম…
মেহের হেসে বলে,
ছেলে ভাবছিলেন তাই তো?
রিদ মাথা নাড়ে, হেসে ফেলে।
মেহের মুচকি হেসে বলে,
অনেকেই ভাবে।
রেস করতে গিয়ে কিছুটা নির্জন রাস্তা ধরে এসেছে দুজনে।
হালকা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। জ্যোৎস্না আর স্ট্রিটলাইট মিশে তৈরি করছে এক রহস্যময় পরিবেশ।
রিদ মুখ তুলে বলে,

যদি কিছু মনে না করো, একটা অনুরোধ করবো?
মেহের বলে,
অনুরোধ তাও আমাকে?
হালকা হেসে বলে,
আচ্ছা, বলুন।
রিদ একটু দ্বিধা নিয়ে বলে,
ওইখানেই বসি চলুন।
দুজনে রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে।
রিদ এবার গম্ভীর হয়ে বলে,
আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।
মেহের বলে,
আপনি কি আমার টিচার, যে প্রশ্ন করবেন আর আমি বাধ্য ছাত্রী হয়ে উত্তর দেবো?
রিদ হেসে বলে,

… প্লিজ?
মেহের হেসে বলে,
আচ্ছা বলুন।
রিদ ধীরে বলে,
তোমার কি কোনো জমজ বোন আছে?
অথবা এমন কোনো কাজিন, যে একদম তোমার মতো দেখতে?
মেহের হেসে বলে,
হ্যাঁ, আমার জমজ বোন আছে। নাম মেহরিন।
তবে আমাদের চোখের রঙ আলাদা, আর একটা ছোট পার্থক্য আছে—
রিদ বলে,
তার ঠোঁটের নিচে তিল, আর তোমার চিবুকে।
মেহের মাথা নাড়ে
ঠিক তাই তো…

কিন্ত আপনি কীভাবে জানেন আপনি কী মেহু কে চিনেন?
রিদ শান্ত গলায় বলে,
তুমি মেহরিনের বিয়েতে যাওনি?
মেহের বলে, না ওই দিন আমার একটা এক্সাম ছিলো। কিন্তু বললেন না তো আপনি কিভাবে চিনেন মেহু কে?
রিদ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
ওর বিয়ে আমার সাথেই ঠিক হয়েছিল।
মেহের আচমকা চমকে বলে,
ওহ্! আপনি… রিদ তালুকদার?
রিদ মাথা নাড়ে।
মেহের হাসেবলে,
তাহলে এখানে কেন?
রিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
মজা করছো? তুমি জানোই তো, মেহরিন রাজকে ভালোবাসে।
মেহের মাথা নাড়ে
হুম… তাও ঠিক। যাই হোক, যা হয় ভালো’র জন্যই হয়।
তবে… আপনি পালিয়ে এসেছিলেন কেন?
রিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,

রাজ আমার ছোটবেলার বন্ধু।
আমি কীভাবে তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করি?
যেখানে মেহরিন নিজেও রাজকে চায়।
মেহের চুপচাপ রিদ-এর দিকে তাকিয়ে থাকে।
কেনো যেনো রিদেীর এই কথা টা খুব ভালো লাগলো মেহেরের।এই মানুষটা তাকে অবাক করছে।
একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আছে রিদ-এর কথায়।
মেহের বলে,
আমি যতদূর জানি, আপনি নিজেও মেহরিনকে ভালোবাসতেন।
রিদ চোখে চোখ রেখে বলে,
ভালোবাসতাম কিনা জানি না…
তবে হ্যাঁ, মেহরিনকে আমার ভালো লাগত।
কিন্তু সেই ভালো লাগা বা ভালোবাসা ২-৩ মাসের।
আর রাজ তাকে তিন বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবাসে।
মেহের মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
রিদ-এর এই স্বীকারোক্তি তাকে কেমন এক অনির্বচনীয় আবেগে ভাসিয়ে নেয়।
মেহের বলে,

আপনি সত্যিই খুব ভালো একজন মানুষ।
রিদ হাসতে হাসতে বলে,
তুমি বলছো এই কথা ? সেই দিন তো আমার গোটা বংশ উদ্ধার করে দিচ্ছিলে।
মেহের বলে,
দোষ তো আপনারই ছিল।
রিদ এবার জোরে হেসে ফেলে।
এই হাসিটাই যেনো অন্যরকম—মেহের থমকে যায়।
রিদ-এর হাসিতে সে হারিয়ে যায়।
তার হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে…
মেহের নিজের মধ্যেই অনুভব করে—এটা কেমন এক অচেনা অনুভব।এই প্রথম এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে মেহেরের।কেমন একটা ঘোর লেগে যাচ্ছে।
রিদ-এর দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইছে খুব।
রিদ হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলে,
কি হলো? চুপ করে গেলে কেন?
মেহের হেসে বলে

কিছু না… কিছু না…
রিদ উঠে দাঁড়ায়।
হাত বাড়িয়ে দেয়।
চলো, বাড়ি ফেরা যাক।
মেহের একবার তাকায় রিদ-এর মুখের দিকে, তারপর হাতের দিকে।
অবশেষে… রিদ-এর হাতটা ধরে উঠে পড়ে।
তবে ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু একটা ঘটে যায়।
রিদ-এর হাত ছুঁতেই মেহের শরীর কেঁপে ওঠে।
সে দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৬

একটাও কথা না বলে রিদের কাছ থেকে হেলমেট নিয়ে বাইক স্টার্ট করে চলে যায়।
রিদ পেছন থেকে ডাকে
মেহের শুনো..
কিন্তু মেহের আর থামে না।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৮