মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪১
মির্জা সূচনা
সকাল ১১টা।
মেহরিন বিছানায় শুয়ে আছে। জ্বর এসেছে, সঙ্গে ঠান্ডা আর শরীর ব্যথা তো আছেই। মেহরিন নাক টানছে, আর রাজকে গালি দিচ্ছে।
রাজ এক কোণে দাঁড়িয়ে সব গালি হজম করে হেসে যাচ্ছে।
মেহরিন বিরক্ত হয়ে বলে,
কি পরিমান নির্লজ্জ মানুষ হলে গালি শুনে ও হেসে যাচ্ছে।
— এই আপনি আমার চোখের সামনে থেকে জান তো,বিরক্ত লাগছে আমার!একদম সহ্য হচ্ছে না আপনাকে।
রাজ হাসে বলে,
— বউ ও বউ!
মেহরিন এক ধমক দিয়ে বলে,
— কী হইছে হে! এত প্রেম আমার ভালো লাগে না। যান এখনই সামনে থেকে।
রাজ তখন একটু থেমে বলে,
— আচ্ছা আচ্ছা, যাচ্ছি। কিন্তু আগে এই স্যুপটা খাও, ওষুধ খেতে হবে তো, ওষুধ না খেলে তো ব্যথা আর জ্বর ও কমবে না।
মেহরিন আরেক ধাপ রেগে উঠে।
হাতের কাছে থাকা বালিশ, পায়ের কাছে থাকা চুড়ি—সব রাজকে ছুঁড়ে মারে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— একদম আমার মেজাজ খারাপ করবেন না! অসভ্য লোক। নিজেই ব্যথা দিয়ে,আবার ওষুধ খাওয়াতে আসছেন? যান! আপনি আর আমার সামনে আসবেন না।
রাজ চোখ ছোট করে বলে,
— বউ তোমার কাছে না গেলে বাচ্চার বাপ হবো কেমনে?
মেহরিন বলে,
— নিকুচি করছে আপনার বাপ হওয়া। আপনার এত অত্যাচার সহ্য করবো না আমি। প্রয়োজনে সুপার মার্কেট থাইকা বাচ্চা কিনে এনে বাচ্চার বাপ হন। আমারে রেহাই দিন।
রাজ হেসে বলে,
— সুপার শপে আজ কাল বাচ্চাও বিক্রি করে জানতাম না তো! কবে থেকে তারা বাচ্চা সাপ্লাই দেওয়া শুরু করল, বলো তো?
আর আমি কোন দুঃখে বাচ্চা সুপার শপ থেকে আনবো।যেখানে আমি নিজেই, ডর্জন ডর্জন বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। তুমি চাইলে আমি প্রতি বছর বছর বাচ্চা দিতে পারবো। তুমি না জেনে আমার পুরুষত্বে আঙ্গুল তুলতে পারো না বউ। আমি হলাম সেই বীর পুরুষ যে ১ দিনে ২ বার বাসর করার ক্ষমতা রাখি।
এই কথায় মেহরিন থতমত খেয়ে যায়।
রাগে-দুঃখে হুস নেয়—কী বলতে যে কী বলে ফেলেছে!
তাও হার মানে না।
— আপনি জান তো, এখন থেকে আমার মাথা না খাইয়া বের হন।
রাজ ধীরে ধীরে এসে মেহরিনকে কোলে তুলে নেয়।
মেহরিন রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
—দেখেন, আমার সত্যিই ব্যথা কমে নাই। এখন যদি কিছু করেন, আমি কিন্ত সত্যি হাত চালাবো বলে দিলাম।
রাজ হেসে বলে,
— কিছু করব না প্রমিস। তুমি শুধু খেয়ে নাও।
রাজ নিজের হাতে যত্ন করে খাওয়ায় মেহরিনকে।
ওষুধ খাইয়ে দেয়।
তারপর শুইয়ে দেয়।
নিজেও এসে পাশে শুয়ে পড়ে।
মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে।
সিঙ্গাপুর, দুপুর ১টা।
মেহের রেডি হচ্ছে।উদ্দেশ্য—রিদ এর সাথে দেখা করা।
গতকাল সন্ধ্যায় দেখা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু অফিসের কাজ শেষ হতে হতে গভীর রাত হয়ে গিয়েছিল।তাই আর দেখা করা হয়ে উঠেনি।
আজ রাত ৮টায় মেহেরের বাংলাদেশে ফ্লাইট, তাই আজ মেহের দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সময়টা কাটাবে রিদের সঙ্গে।
মনটা ভালো, তাই গান গাইতে গাইতে রেডি হচ্ছে মেহের।
ঠিক তখনই হঠাৎ যেনো ছায়ার মতো পেছনে এসে দাঁড়ায় রিদ।
মেহের হেসে ফেলে। সে জানে, এই যে মনে মনে রিদকে ভাবছে—এই কল্পনা, এই অনুভূতি ওর জীবনের বাস্তব হয়ে গেছে।
সে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
— এই যে, গম্ভীর মুখো, আপনি আমাকে অনেক জ্বালাচ্ছেন জানেন তো? আমার মন-মাথা সবখানে শুধু আপনিই ঘুরছেন। আমি চোখ খুলি—আপনি, চোখ বন্ধ করি—আপনি! বলুন তো, কী করি এখন?
রিদ একটু হেসে ফেলে।
মেহের তখন বলে,
—মন আর মস্তিষ্কে যখন আপনি গেঁথে গেছেন, তখন জীবনেও খুঁটি গেড়ে বসুন না, মশাই!
হালকা, হাস্যরসে ভরা মূহূর্তটাও যেনো আজ একটু ভারি।
কারণ, আজ রাতে মেহের চলে যাবে।
মেহের তার বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়।
লেকের পারে একটা ব্রাঞ্চে বসে আছে রাজ।মেহের চলে যাবে বলে কেমন যেনো
মনটা খালি খালি লাগছে। জানে না কেন, এই কদিনেই কেন এমন টান তৈরি হয়ে গেল?
মেহরিনকে ছেড়ে আসার সময় ও তো এমনটা অনুভব হয়নি, কিন্তু এবার যেনো একটু বেশিই লাগছে।
ঠিক তখনই মেহের আসে। হাসিমুখে এসে পাশে বসে,
কিন্তু রিদের মনটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে।
মেহের একটা ধাক্কা দিয়ে বলে,
— এই যে মিস্টার! এমন কেবলা কান্তের মতো বসে আছেন কেন?
রিদ চমকে উঠে তাকায়।
আর তখনই সমস্ত বিষণ্নতা যেনো উবে যায়। এতখনের অস্থিরতা খারাপ লাগে যেনো মুহূর্তেই পালিয়ে যাই।
রিদ ঘড়ি দেখে বলে,
— ম্যাম, আপনি তো আমাকে অপেক্ষার সাগরে বসিয়ে দিয়েছিলেন।
মেহের একটু হেসে বলে,
—আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ইচ্ছে করে লেট করিনি। একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছি, বুঝি।
রিদ দু দিকে মাথা নাড়ে,
— কিছু অপেক্ষা দীর্ঘ হলেও তার ভেতরে অন্যরকম অনুভূতি মিশে থাকে। অনুভূতি মেশানো সেই অপেক্ষা তখন বিরক্তিকর নয়, মধুময় হয়ে ওঠে।
মেহের আবার হেসে ফেলে।
—বাহ! আপনি তো একেবারে প্রেমিক পুরুষদের মতো কথা বলছেন!
রিদ চুপ করে থাকে, কিন্তু চোখ দুটো ততক্ষণে অনেক কিছু বলে ফেলে।
কিছুক্ষণ ওরা আড্ডা দেয় হাসা হাসি করে। রিদের মুখে তখনো হালকা হাসি খেলা করছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই হাসিমাখা মুখটা মলিন হয়ে গেল। সে মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলে উঠল,
— কখন যাচ্ছো?
এতোক্ষণ ধরে হাসতে থাকা মেহেরের মুখ থেকেও যেনো হাসিটা মুছে যায় মুহূর্তেই। রিদের কথায় যেনো ভালোবাসার এক সূক্ষ্ম ছোঁয়া পায় মেহের। মনের ভেতরে বলে ওঠে—
আমি যদি আপনার চোখের আড়াল হই, আপনি কি আমার বিরহে পুরবেন? আপনার বুকের বা পাশে কি আমার জন্য চিনচিনে ব্যথা করবে? আপনি কি আমার শূন্যতা অনুভব করবেন?
তাহলে একবার মুখ ফুটে বলুন না—
মেহের, তুমি যেও।
বিশ্বাস করুন, আমি রয়ে যাবো, শুধু তোমার পাশে।
কিন্তু মুখে বলে,
— ৮ টায়।
রিদ শুধু ছোট্ট করে বলে,
— ওহ।
তবে মনের ভেতর কাঁপন চলে,
তোমার বিরহ যে আমাকে খুব পোড়াবে, নীলয়োনা… তোমার ওই নীল চোখে যে আমি আমার মরন দেখেছি। সেই চোখে চোখ পড়ার পর থেকে আর ভুলতে পারছি না সেই নীল রাঙা চোখ, হারিয়ে গেছি একেবারে ওই নীল চোখে।
এই অল্প কিছু দিনের পরিচয়ে একজন মানুষ আবার আমার হৃদয়ে কীভাবে বাসা বাঁধলো—তা কেমন করে বোঝাবো!
মেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর জোর করে মুখে হাসি এনে বলে,
— চলুন না, একটু হাঁটি।
রিদ তাকায় মেহেরের দিকে। দুজনের দৃষ্টি মিলে যায়।
মেহের পারে না ওই চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে—রিদের চোখে তাকালেই মনে হয়, সেই চোখ যেনো অনেক কিছু বলে দেয়—যা রিদ মুখে বলতে পারে না।আবার অনেক কিছু পড়ে ফেলতে জানে যা মেহের বলতে চায় না।
মেহের ধীরে বলে,
— এভাবে তাকাবেন না।
রিদ হেসে জিজ্ঞেস করে,
— কেন?
মেহেরের উত্তর,
— সব কেনো’র উত্তর হয় না।
রিদ আবার হাসে।
আর মনে মনে বলে,
তার মানে, তুমিও আটকে গেছো আমার চোখে…
মেহের উঠে দাঁড়ায়। রিদ-ও উঠে দাঁড়ায়। দুজন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
তাদের আশে পাশে অনেক কাপেল—কেউ কারো হাত ধরে হাঁটছে, কেউ বা কারো কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। সবাই যার যার ভালোবাসায় ব্যস্ত।
মেহের আশে পাশে তাকিয়ে দেখছে, আর হাঁটছে। হঠাৎ রিদ বলে ওঠে—
—আপনার হাতটা ধরার অনুমতি কি আমাকে দেওয়া যায়, ম্যাডাম?
মেহেরের পা দুটো থেমে যায়। বুক ধুকপুক করছে।
এই সামান্য কথাতেই যে হৃদস্পন্দন এতো বেড়ে যেতে পারে—তা জানা ছিল না মেহেরের।
এই সামান্য কথাতেই যেনো শরীরে এক ধরণের কাঁপুনি সৃষ্টি হচ্ছে।
মেহের রিদের দিকে ঘুরে বলে—
—দেওয়া যায়… যদি এই হাত কখনও না ছাড়েন।
রিদ হাসে, মাথা নেড়ে বলে—
—যথা আজ্ঞা, মহারানী।
মেহের হেসে ফেলে।
রিদ এগিয়ে হাত বাড়ায়।
মেহের নিজের হাত দেয়।
রিদ খুব শক্ত করে ধরে সেই হাত।
মেহের হেসে বলে—
—আমি সারাজীবনের জন্য হাত ধরতে বলেছি, আমার দেহ থেকে হাত আলাদা করতে বলিনি।
রিদ হাসে—
—প্রথম হাত ধরা যেনো সারাজীবন মনে থাকে, তাই একটু গভীর ভাবেই ছুঁয়ে দিলাম, যেনো সে ছোঁয়া কখনও মুছে না যায়।
মেহের হেসে ফেলে।
পুরো দুপুর আর বিকেল দুজনে একসাথে কাটায়।
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ বাজে। মেহের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে এয়ারপোর্টে।
সাথে আছে জেরি—প্রিয় বান্ধবী, যাকে বিদায় জানাতে এসেছে।
মেহেরের চোখ আশেপাশে ঘুরছে, চোখ দুটো কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
জেরি হয়তো বুঝতে পারে মেহেরের মনের অবস্থা।
সে বলে—
— বেবি, আসবে না হয়তো… আসলে এতক্ষণে চলে আসতো।
মেহের মাথা নাড়ে।
ঠিক তখনই মাইকে ঘোষণা হয় ভিতরে ঢোকার জন্য।
মেহের জেরিকে জড়িয়ে ধরে বলে—
—আসছি বেবি। খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে।
জেরি বলে—
— Yes, baby..
আরও একবার পাশে পাশে চোখ ঘুরিয়ে, মেহের ভিতরে ঢুকে যায়।
মেহের নিজের সিটের পাশে এগিয়ে যায়। দেখে পাশে একটা ছেলে বসে আছে। ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছে না—মুখটা ঢেকে রেখেছে বই দিয়ে। বই পড়ছে হয়তো।
মেহের কিছু বলে না। চুপচাপ বসে পড়ে।
মনটা খারাপ।
রিদ আসেনি।
আজ, এতটা সময় একসাথে কাটানোর পরও বিদায় জানাতে এল না।
মেহের বুঝে ফেলেছে—রিদের মনেও কিছু আছে মেহেরের জন্য।
তাই তো মনে মনে ভীষণ আশা করছিল, আজকের এই বিদায়ের মুহূর্তে রিদ আসবেই…
কিন্তু সে এলো না।
মনটা চুপচাপ হাহাকার করছে। কেনো এলো না সে।
তখনই পাশের ছেলেটা বলে ওঠে—
— হ্যালো ম্যাডাম! কাউকে খুঁজছেন বুঝি?
মেহের তড়াক করে পাশ ফিরেই…
রিদকে দেখে অবাক হয়ে যায়!
খুশি হয়ে কিছু বলতে যাবে..
তারপর আবার ভাবতে থাকে—
না না, এ নিশ্চয়ই কল্পনা!
নিজেকেই আস্তে করে বলে ওঠে—
— জান তো, এখান থেকে সবসময় শুধু আমাকেই জালাতন করা… আমি খুব রাগে আছি আপনার উপর… বেয়াদব, শয়তান লোক… একটু দেখা করতে এলে কি হতো, হ্যাঁ?
তখন পাশে থাকা রিদ বলে—
—দেখা করে কী হবে? আপনার পথ চলার সাথীই তো হয়ে এসেছি ম্যাডাম!
মেহের রেগে যায়—
— চুপ! কল্পনাই এসে, আবার বাড়াবাড়ি করছেন।
রিদ হেসে বলে—
— সারাক্ষণ আমায় কল্পনায় ভাবেন, বুঝি ম্যাডাম?
মেহের বলে—
—আমার মাথা খাওয়া বন্ধ করুন তো! আর যান এখান থেকে!
রিদ বলে—
— কোথায় যাবো আপনাকে ছেড়ে? আপনাকে ছাড়া যে থাকতে পারবো না। তাই তো চলে এলাম!
মেহের বলে—
— এখন কিন্তু বেশি হচ্ছে!
রিদ বলে—
— হলে ক্ষতি কী?
মেহের মুখ বাঁকিয়ে বলে—
— দেখা দিলেন না বিদায় বেলায়, এখন কল্পনায় আমার মাথায় জেকে বসেছেন! উফ্ আল্লাহ! এই পুরুষটাকে আমার মাথা থেকে নামিয়ে দাও!
রিদ ভ্রু কুঁচকে বলে—
—তাহলে কি এখন অন্য কাউকে চাইছো নাকি?
মেহের বলে—
— উফ্, তা কখন বললাম?! আপনি এখন যান তো!
রিদ হেসে বলে—
— এখন তো কখনও যাব না। একবার ধরেছি মানে সারাজীবন থাকবো।
মেহের পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে নিজেকেই গালাগাল করে—
— মেহের… আর বকবক করিস না। কেউ যদি জানতে পারে তুই কল্পনায় এক ছেলের সঙ্গে এমন বকবক করিস, সবাই তোকে পাগল ভাববে!
রিদের এ কথা শুনে হেসে বলে—
— এতটাই ভাবো আমায় নিয়ে যে সারাক্ষণ মন-মস্তিষ্কে আমি-ই থাকি!
মেহের এবার রাগে রিদকে গলা চেপে ধরে বলে—
— আর কল্পনায় এসে জালালে কিন্ত একদম মেরে দেবো বলে দিলাম।
রিদ মেহেরের কপালে একটা টোকা দিয়ে বলে—
— আমি কল্পনা না, ম্যাডাম। বাস্তবে আপনার সামনে।
মেহের বোকার মতো তাকিয়ে থাকে…
কিছুক্ষণ বোঝার পর যখন বুঝতে পারে এটা কল্পনা নয়, সত্যি, তখন চোখ বড় বড় করে বলে—
— আ..আ..আপনি সরি! সরি! আমি ভাবছিলাম কল্পনা…
রিদ বলে—
— এখন গলা টা ছাড়ো, তা না হলে আর জীবনে সরা-সরি দেখতে পাবে না! কল্পনাতেই আসতে হবে।
মেহের বলে—
—ও হে হে… এটা বলে হাত সরিয়ে নেয়… আর বোকা বোকা হেসে রিদের দিকে তাকাই…”
তারপর অন্য পাশে ফিরে চোখ বন্ধ করে বলে—
— মেহের রে, তুই এটা কী করলি রে?উফফ….আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাবো… একদম পাগল হয়ে যাবো!… অবশ্য হবো কী? আমি তো পাগল হয়েই গেছি!
ওদিকে রিদ হেসে হেসে শেষ… মেহেরের কান্ড দেখে…
মেহের লজ্জা পাচ্ছে নিজের কাণ্ডে।
রিদ বলে—
— থাক… আর নিজেকে গালাগাল করো না। আমি বুঝতে পারছি তো…
মেহের বলে—
— আপনি খুব খারাপ জানেন তো? আগে কেন বললেন না যে আপনি যাবেন?
রিদ হেসে বলে—
—সারপ্রাইজ দিবো বলে বলিনি, ম্যাডাম!
মেহের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসে থাকে।
রিদ বুঝতে পারে, মেহের অভিমান করেছে।
তাই বলে—
—আমি দুঃখিত, ম্যাডাম। আমার বলা উচিত ছিল। কিন্তু…এখন মনে হচ্ছে না বলেই ভালো করেছি। অন্তত এটা তো জানলাম… আমি যে আপনার কল্পনাতেও বিচরণ করি!
মেহের রিদকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে—
—আপনি কথা বলবেন না আমার সাথে!
রিদ গালে হাত দিয়ে বসে থাকে…
সারাদিন ঘুমিয়েই কেটে গেছে মেহরিন আর রাজের। সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙে মেহরিনের। জ্বর আর গা-ব্যথা অনেকটাই এখন নেয়। সে এখন ব্যালকনিতে বসে আছে, হাতে কফির মগ। রাজ তখন রুমে নেই। মেহরিন চুমুক দিচ্ছে কফিতে, আর প্রকৃতির নীরবতা উপভোগ করছে।
রাজ এসে দেখে, মেহরিন একা বসে আছে। কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
মেহরিন রাজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, মাথা তার বুকে রেখে বলে,
— পরিবেশটা সুন্দর তাই না?
রাজ মৃদু হেসে বলে,
— তুমি আমার পাশে থাকলে আমার কাছে সব পরিবেশই সুন্দর।
মেহরিন হেসে ফেলে। রাজ ওর হাত থেকে কফির মগ নিয়ে নিজেই খায়।
মেহরিন বলে,
— ঘুরতে যাবো, চলুন।
রাজ নরম স্বরে বলে,
— না, তোমার শরীর এখনো ভালো না। কাল যাবো, আজ না।
মেহরিন মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে,
— না! আজই যাবো!আর এখনি।
রাজ বলে,
— আচ্ছা, রেডি হয়ে নাও তবে।
আর কথা নয়, মেহরিন ঝটপট উঠে পড়ে।
রাজ তাকিয়ে অবাক,
— রেডি হতে বলেছি বলেই কি আমাকে ফেলে চলে যাবে? পাঁচ মিনিট পর রেডি হলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত নাকি? নাকি ট্রেন ছুটে যাবে।
মেহরিন হেসে বলে,
— মুড চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে তো।
রাজও হেসে বলে,
— তা ঠিক! তোমার মুড তো আবার মিনিটে মিনিটে চেঞ্জ হয়।
মেহরিন রেগে এসে বলে,
— কি বললেন আপনি?
রাজ দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে,
— কিছু না, কিছু না।
মেহরিন চোখ পাকিয়ে চলে যায়।
দুজনেই ম্যাচিং ড্রেস পড়েছে। মেহরিন পড়েছে কালো টিশার্ট তার উপর ব্লেজার, কালো প্যান্ট। রাজও একদম একই।
দুজনেই অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর, ক্ষুধায় কাবু হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। সারাদিন কিছু না খাওয়ায় দুজনেই খুব ক্ষুধার্ত।
মেহরিন খেতে খেতে একটানা বকবক করে যাচ্ছে, আর রাজ মন দিয়ে সেই বকবক শুনছে। এর মাঝে রাজের প্রায় একশোটা ফোন এসেছে। কিন্তু তার কাছে এখন “তার বউয়ের আজাইরা বকবক”-টাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তাই ফোন অফ করেই দিয়েছে।
খাওয়া শেষে রিসোর্টের দিকে রওনা।
মেহরিন কিছুটা হেঁটে বলে,
— আমি আর পারছি না, আমাকে কোলে নিন।
রাজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
— তুমি কোথায় কোথায় কোলে উঠতে চাও বলো তো? তুমি কি বাচ্চা?
মেহরিন বলে,
— কোলে নেবেন, নাকি আমি গিয়ে অন্য কোনো ভদ্রলোকের কোলে উঠবো?
রাজ মেহরিনকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
— আমার বউকে আমি কোলে নেবো, অন্য কেউ কোলে নিবে তো দূরের কথা চোখ তুলে তাকালেও আমি রাজ শিকদার সেই চোখ উপড়ে ফেলবো—মনে রেখো।
মেহরিন হেসে বলে,
— সিংসোটে।
রাজ মেহরিনের নাকে নাক ঘশে বলে,
— হ্যাঁ, আমি সিংসোটে। শরম সিংসুটে, উচ্চ লেভেলের সিংসুটে!
মেহরিন হাহা করে হেসে ওঠে, রাজও হেসে ফেলে।
রাজ একটা গান ধরে,
মন বোঝে না বোঝে না বোঝে না
মন বোঝে না বোঝে না
পড়ছে কানো বিনা মেঘে বাজ
দ্য লেখা আমার তো নয় কাজ
চাইছি দিনে অল্প দাখা তোর
পালটে দিতে আমার গল্পের মোড়
কিছুতেই উপায় মেলে না
ও ও… মন
বোঝে না বোঝে না বোঝে না
না বোঝে না বোঝে না
না বোঝে না বোঝে না বোঝে না
মন বোঝে না বোঝে না
ইচ্ছে করে একটা ঘরে থাকবো দুজনায়
গড়বো ভিটে খুশির ইটে সঙ্গীহবি আয়
কলের পারে জলের ধারা ঘরের পরে তুই
চারটে হাতে খেলনা পাতে একজোড়া চড়ুই
সে ভাবনারা চোখ খোলে না
ও ও হো… মন
বোঝে না বোঝে না বোঝে না
মন বোঝে না বোঝে না
মন বোঝে না বোঝে না বোঝে না
মন বোঝে না বোঝে না
রোজ বিকেলে আতর ঢেলে তোকে সাজাবই
মেলায় যাবো রিক্সায় চড়ে বসবি পাশে তুই
বন্দি আছে হাজার আশা বুকের মাঝে দেখ
একটু চিনে নিলেই হব দুজন মিলে এক
তবু স্বপ্নেরা মুখ তোলে না
ও ও হো… মন
বোঝে না বোঝে না বোঝে না
মন বোঝে না বোঝে না
পড়ছে কানো বিনা মেঘে বাজ
পদ্য লেখা আমার তো নয় কাজ
চাইছি দিনে অল্প দেখা তোর
পালটে দিতে আমার গল্পের মোড়
কিছুতেই উপায় মেলে না
ও ও ও… মন
বোঝে না বোঝে না বোঝেনা
মন বোঝে না বোঝে না
এ মন বোঝে না বোঝে না বোঝে না
মন বোঝে না
গাইতে গাইতে ওরা রিসোর্টের কাছাকাছি চলে আসে।
রিসোর্টের সামনে এসে মেহরিন বলে,
— আমাকে নামিয়ে দিন।
রাজ বলে,
— না, থাক।
মেহরিন হেসে, হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে কয়েকজনকে একসাথে আসতে দেখে। মেহরিনের মস্তিষ্ক কিছু একটা ইঙ্গিত দেয়।
সে রাজের গলায় ঝুলে পড়ে, একটু নেকামি করে বলে,
— হাব্বি….!
রাজ হেসে বলে,
— হুমম, হাবিবি?
মেহরিন চোখ গোল করে বলে,
— আমাদের প্রেমটা যেনো কারো সহ্যই হয় না! ঢাকায় ফিরে তার মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করতেই হবে—তার এত চুলকানি কেন? আর কোন ব্র্যান্ডের মলম লাগালে চুলকানি কমবে!
রাজ তখনই বুঝে ফেলে, মেহরিন কার ইঙ্গিত করছে।
সে হাসতে হাসতে বলে,
— Are you ready, হাবিবি?
মেহরিন হাসে,
— Yes, হাব্বি!
রাজ সঙ্গে সঙ্গে মেহরিনকে নামিয়ে দেয়। এদিকে লোকগুলো একেবারেই কাছাকাছি চলে এসেছে।
তাদের মধ্যে একজন একটু কটাক্ষের স্বরে বলে ওঠে,
— রাত দুপরে রঙ করে বেরাচ্ছো কপোত-কপোতী!
রাজ হেসে বলে,
— না ভাই, হানিমুনে এসেছি তো! প্রসেসিং এ আছি—একসাথে দুটো বাচ্চার বাপ হতে পারি কি না দেখি!
লোকগুলো রাজের খোলা মেলা কথায় হকচকিয়ে যায়,একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
মেহরিন রাজের বাহুতে থাপ্পড় মেরে বলে,
— ছিঃ, অসভ্য!
রাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে,
— আচ্ছা ভাই, আপনারাই বলেন, বউয়ের সামনে যদি ভদ্র সভ্য আর শুদ্ধ পুরুষ থাকি, তাহলে জীবনে বাবা হতে পারব?
ওই লোকগুলোর মধ্যে একটা ছেলে বলে,
— হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তো!
রাজ তখন বলে,
— দেখলে তো বউ ওরাও এটা মানে। শুধু তুমি বুঝতে চাও না।মেহরিন মুখ বাঁকাই।
রাজ আবার ওদের দিকে ফিরে বলে,
এখন আপনারা বলেন, আপনাদের আগমনের কারণটা শুনে একটু ধন্য হয়।
একজন বলে,
— তোমাদের দু’জনকে মেরে বালিচাপা দিতে এসেছি।
এই কথা শুনে মেহরিন এক ঝটকায় সেই ছেলের গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
— নতুন জামা পরেছি আজ, আর তুই বলিস বালিচাপা দিবি? ময়লা লাগবে না জামা-কাপড়ে? জানিস জামাকাপড় কাচতে কত হ্যাপা?
ছেলেটা গালে হাত দিয়ে বলে,
— স্যরি আপা,তবে আমি জানি কাপড় ধোয়া কত কষ্টের! আমি তো বাড়িতে আমার বউয়ের কাপড়ও ধুই।
মেহরিন অবাক হয়ে বলে,
— কি বললি!
রাজ হেসে বলে,
— ভাই, তুইও তোর বউকে ভয় পাস। আয় ভাই বুকে আয়।
ছেলেটা রাজকে জড়িয়ে ধরে।
মেহরিন নাক মুখ কুঁচকে বলে,
— যতসব আদিখ্যেতা।
ততক্ষণে তাদের দলের ‘বস’ সামনে এগিয়ে এসে বলে,
— এই, তুই কী করছিস বলদ! মারতে এসেছি, আর তুই ওদের সাথে খাতির করছিস?
বলে মেহরিনের দিকে হাত বাড়িয়ে মেরতে আসে। মেহরিন সাথে সাথেই তার হাত মুচড়ে ধরে কড়া স্বরে বলে,
— হারামজাদা, এত বড় সাহস!
চতুর্দিকে থাকা সাথের লোকেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ওদেট বস গর্জে উঠে বলে,
—তোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? মার ওদের।
একসাথে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজের। রাজ সবার সঙ্গে লড়ছে, আর মেহরিন তখন সেই লোকটার হাত মুচড়ে এমনভাবে ঘারে মারে যে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। মেহরিন তাড়াতাড়ি পাশের একটা লাঠি নিয়ে রাজের পাশে দাঁড়ায়।
দুজনে মিলে এমন মারধোর শুরু করে যে প্রতিপক্ষের অবস্থা কাহিল।
যে ছেলেটাকে রাজি জড়িয়ে ধরেছিল সেই ছেলেটাকে রাজ ধরে ঘুষি মারতে নেয় সে বলে ওঠে,
— ভাই! মুখে মাইরেন না, বউ দেখলে খুব মারবে!
রাজ হেসে বলে,
—তুই তো আমার মুডটাই নষ্ট করে দিলি ব্যাটা। যা চলে যা।
ছেলেটা গুটিগুটি হেঁটে চলে যাবার আগে বলে,
— ভাই, আপারে কী দেইখা বিয়ে করছেন, না মানে? এতগুলো বেড়া মানুষকে কেমনে মারল বাবা গো।
তারপর একটু থেমে আস্তে বলে,
— আপনাকেও মারে, তাই না?
রাজ মাথা নেড়ে বলে,
— না, মারে না। শুধু বেশি রাগ উঠলে ঘর থেকে বের করে দেয়।
ছেলেটা হা করে তাকিয়ে থাকে।
মেহরিন তখন বলে,
— এই তোর বউয়ের নাম্বার দে তো! কল দিয়ে বিচার দিবো।
ছেলেটা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
— না আপা এমন কইরেন না, তাহলে আমাকে আজ আর বাড়িতে ঢুকতে দেবে না! ও অনেক মারে! এই হতভাগাকে গৃহচ্যুত করবেন না আপা!
বলে সে দৌড়ে পালায়।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪০
রাজ আর মেহরিন হেসে হেসে রিসোর্টের ভেতরে চলে যায়। রাতের আকাশে হালকা চাঁদের আলো, আর সেই আলোয় একজোড়া মুখ হাসতে হাসতে হারিয়ে যায়।
“নীল” – চোখের রঙ, আকাশের মতো বিশাল মায়া।
“অয়না (অয়ন/অয়না)– মানে ঘর, আশ্রয়, হৃদয়ের গোপন কোণ।
একসাথে “নীলোয়না” মানে:
“যার চোখে আমার ঘর, যার নীল দু’চোখেই আমি আশ্রয় খুঁজি।”