মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৪

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৪
মির্জা সূচনা

আমি কি মজা করতে গিয়ে তোকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম, মেহু? — মেহের অপরাধী গলায় বলে।
মেহরিন হেসে বলে, আরে না তেমন কিছু না। ওই ভদ্রলোকের অফিস থেকে ফিরেই বউকে দরকার পড়ে, সেখানে বউকে না পেয়ে সালিকার প্র্যাঙ্কের শিকার হয়েছে। তাই চটে গেছে।
সেই মুহূর্তেই মেহবুবা, চুমকি, রাহি আর লামিয়া এসে মেহরিনকে জাপটে ধরে বলে,
“You are the most lucky girl!”
মেহরিন হেসে ওদের জড়িয়ে ধরে বলে,
তোমাদের পাকামোর ফল এখন আমাকেই ভুগতে হবে!
মেহের হাসতে হাসতে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে,
বউ ভক্ত জামাই পেয়েছো, আর একটু ভোগবা না? সোনা, তা তো হবে না! কী বলো বাচ্চারা?
তখনই রাহি, লামিয়া, চুমকি আর মেহবুবা একসাথে চেঁচিয়ে বলে,
ঠিক!

মেহরিন হেসে মেহেরের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
তুমি যাকে মন দিয়েছো, সে ভালো মানুষ—আশা করছি বিয়ের পর বউ ভক্ত হবে।
মেহের লজ্জা পেয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বলে,
যা কিছু বলিস না! বলে দুলনায় গিয়ে বসে পড়ে।
বাকিরা সবাই মেহেরের কাছে যায়, আর মেহরিন চলে যায় নিজের রুমের দিকে।
দু’আ দুরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয় মেহরিন।
কারণ, এটাই প্রথম—যে তার ‘কবি সাহেব’-এর রাগের মুখোমুখি হবে।
পরিচয়ের পর থেকে কখনও রাগ দেখায়নি।
রুমে ঢুকে দেখে, কবি সাহেব ল্যাপটপে কাজ করছে।
মেহরিন পরিস্থিতি বোঝার জন্য কাশি দেয়, কিন্তু না…
কবি সাহেব ফিরেও চায় না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেহরিন পা টিপে টিপে গিয়ে পাশে বসে।
রাজ তাকাচ্ছেই না।
মেহরিন বলে, শুনছেন।
রাজ বলে, আমি এখন কাজ করছি। কেউ যেনো আমাকে ডিস্টার্ব না করে।
মেহরিন রাজের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করি?
রাজ ঠাসসস করে ল্যাপটপ বন্ধ করে,
মেহরিন চমকে ওঠে।
ল্যাপটপটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে মারে, টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা ‘ঠাসস’ করে লাগিয়ে দেয়।
মেহরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
নিজেকেই নিজে বকে,
কেন যে ওদের সঙ্গে তাল দিলাম! একদম উচিত হয়নি!
এমন করা আমার।

আমার ভোলা ভালা জামাইটা কী ভয়ানক রেগে গেছে!
এখন এই রাগ কীভাবে ভাঙাই?
কিছুক্ষণ পায়চারি করে মেহরিন।
তারপর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে, আর সে সোজা বেরিয়ে যায়—লাবিবের রুমের দিকে।
লাবিব ল্যাপটপে কাজ করছিল।
মেহরিন গিয়ে বলে,
লাবিব, আসবো?
লাবিব হাসিমুখে বলে,
আরে ভাবি আসো তুমি, আসতে আবার অনুমতি লাগবে নাকি!
মেহরিন ভিতরে ঢুকে বলে,
আমার একটা কাজ করে দিতে পারবা?
লাবিব বলে,

হ্যাঁ, অবশ্যই। কী করতে হবে বলো না।
মেহরিন বলে,
তুমি যেকোনোভাবে তোমার ভাইকে নিয়ে বাড়ির বাইরে যাবে।
কোনভাবেই রাত ১০টার আগে আসা যাবে না। পারবা?
লাবিব একটু ভাবতে ভাবতে বলে,
পারব। কিন্তু কেন? কিছু হয়েছে?
মেহরিন সব খুলে বলে লাবিবকে।
লাবিব প্রথমে অবাক হলেও পরে হেসে ফেলে,
ভাইয়ের ভালোবাসার বর্ণনা শুনে।
মেহরিন বলে,
মনে রেখো—১০টার আগে ফেরা যাবে না!
লাবিব বলে,
আচ্ছা। কিন্তু এতে আমার লাভ কী?
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
কী চাই বলো?
লাবিব দাঁত বের করে বলে,
তোমার বোনকে বলবা আমার জন্য কফি করে দিতে।
মেহরিন হেসে বলে,

“Okay, deal!”
লাবিব বলে,
Okay! তাহলে ‘মিশন রাগ ভাঙানো’ শুরু!
দুজন হাইফাই করে।
লাবিব বলে,
তুমি ভাইয়ের কাছে যাও, আমি ২০ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে যাবো ভাইকে নিয়ে।
মেহরিন হেসে চলে আসে।
রুমে আসে, রাজের জন্য কফি নিয়ে।
দেখে, রাজ আবার ল্যাপটপে বসে গেছে।
চুলগুলো ভালোমতো মোছে নি, পানি পড়ছে।
মেহরিন রাজের সামনে কফিটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
আপনার কফি।
রাজ বলে,
খাবো না।
মেহরিন কফির মগটা টেবিলে রাখে,
তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছতে থাকে।
রাজ কিছুক্ষণ চুপ থাকে,
তারপর মেহরিনের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
কোনো দরকার নেই।
মেহরিনের খারাপ লাগে।
কান্না আসতে চায়।

কিন্তু নিজেকে শক্ত করে রাখে।
দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে।
আসলে, যাদের কাছ থেকে আমরা শুধু ভালোবাসা পেয়েছি,
যদি তারাই হঠাৎ করে উপেক্ষা করে বা রুক্ষ ব্যবহার করে—
ওই আঘাতটা সরাসরি মনের মধ্যে লাগে।
এখন মেহরিনের ঠিক তেমনই লাগছে।
কিন্তু তবুও কিছু করার নেই।
কারণ, এখানে ১০০% দোষ তার নিজের।
রাজ চলে যায় ব্যালকনিতে।
মেহরিন দাঁড়িয়ে থাকে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে।
রাজ ব্যালকনি থেকে উঁকি দিয়ে দেখে মেহরিন কী করছে।
তখনও দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, মাথা নিচু করে।
রাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,

Sorry Moonbeam, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু আজ তুমি যা করেছো, একদম ঠিক করোনি। আমি জানি এটা মজা ছিল, কিন্তু আমি যদি ওই মেয়েটাকে অন্য ছুঁয়ে ফেলতাম—না বুঝে, না জেনে—তখন তুমি কি সেটা মানতে পারতে? কখনোই না! আমি জানি তুমি পারতে না। তোমার কষ্ট হতো, সেটা যতই প্র্যাঙ্ক হোক।
রাজ থামে।
আমি আজ অবধি তোমাকে ছাড়া কোনো নারীকে ওইভাবে ছুঁইনি। যদি তুমি ভেবে আমি ও মেয়েটাকে ছুঁয়ে ফেলতাম, আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতাম না।
রাজ নিজের হাতের দিকে তাকায়—যে হাতে সে মেহেরকে ধরেছিল।
সেই হাত দিয়েই দেয়ালে ঘুষি মারতে থাকে অনবরত। রক্ত পড়ে।
মেহেরিন শব্দ পেয়ে ছুটে আসে, যখন দেখে রাজ কি করছে তখন,মেহরিন দৌড়ে কাছে আসে, ওর হাত ধরে বলে,
কি করছেন আপনি? পাগল হয়ে গেছেন? রক্ত পড়ছে, দেখতে পাচ্ছেন না?
রাজ ওকে ঝাঁকিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়।
মেহরিন হতভম্ব। এতটা রাগ রাজ করতে পারে, কল্পনাও করেনি।
চোখে জল নিয়ে তাকায়।

রাজ মেহরিনের চোখে পানি দেখে আরও এক ঘুষি মারে দেয়ালে।
মেহরিন এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।
রাজ চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলায়। তারপর মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
কাঁদছো কেন? আমি তোমাকে বকেছি? মেরেছি?
মেহরিন রাজকে জড়িয়ে ধরে বলে,
মারুন, বকুন, তবু কথা বলুন আমার সাথে। আপনার অবহেলা আমার সহ্য হয় না, কবি সাহেব!
রাজ কিছু বলে না। চুপ করে থাকে।
মেহরিন আরও বলে,
বিশ্বাস করুন, আমি বুঝতে পারিনি আপনি এতটা রেগে যাবেন। তাহলে আমি কখনোই রাজি হতাম না। আমাকে মাফ করে দিন, কবি সাহেব। আমি আর কখনো এমন করবো না। দয়া করে আমার জন্য নিজেকে কষ্ট দেবেন না।
রাজ বলে,

কান্না করো না প্লিজ কানা থামাও।
তাহলে বলুন, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন?
রাজ মেহরিনকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বলে,
ওরা তোমাকে বললো, আর তুমি রাজি হয়ে গেলে? তাই না? তোমার কি একটুও সেন্স নেই যে আমি কী করতে পারি বা কি করি? যদি আমি সত্যিই ওর সাথে কিছু করে ফেলতাম—না চিনে না জেনে—তখন? আমি তোমাকে বুদ্ধিমতী ভাবতাম, মেহরিন!
মেহরিন করুণ চোখে তাকায় রাজের দিকে।
এই প্রথম রাজ তাকে মেহরিন বলে ডাকে।
মেহরিন বুঝে যায়—রাজ সত্যিই ভীষণ রেগে আছে।
সে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় লাবিব আসে।
Bro, একটু বাইরে আসো। এমার্জেন্সি!”
রাজ কিছু না বলে চলে যায়।
লাবিব কানে কানে কিছু বলে রাজকে নিয়ে বেরিয়ে যায়…

মেহরিন কিছুক্ষণ বেলকনিতে বসে থাকে। তারপর উঠে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে।
এরপর সবাইকে এসএমএস করে ডাকে—তার রুমে আসতে।
সবার মধ্যে মেহের, মেহবুবা, চুমকি আর লামিয়া আসে। রাহি চলে গেছে ইতোমধ্যে। বাড়ি থেকে অনেক কল করছিল তাই চলে যেতে হয়েছে।
মেহরিন মনমরা হয়ে বসে।
মেহের কাঁধে হাত রেখে বলে—
— সরি মেহু। বুঝতে পারিনি ভাইয়া এতটা রেগে যাবে।
মেহবুবা বলে—

— ঠিক বলছিস। এতটা বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়নি।”
লামিয়া বলে—
—ব্রো এমনিতে সহজে রেগে না, কিন্তু একবার রেগে গেলে সহজে তা কমে না।
মেহরিন বলে,
রাগ রাগ ভাঙাতে হবে।ঝামেলাটা আমরা সবাই মিলে পাকিয়েছি, তাই ঠিক ও করতে আমাদের কেই করতে হবে। কিন্ত সবার সাহায্য লাগবে।
সবাই এক সাথে বলে—
— কি সাহায্য?
মেহরিন ফিসফিসিয়ে কিছু বলে।
মেহের হেসে বলে—
—বাহ! তার মানে আজ খাট—ভা…
চুমকি মেহের মুখ চেপে ধরে।
মেহবুবা বালিশ ছুঁড়ে মারে।
মেহরিন বিরক্ত হয়ে বলে—

— উফ, থামবি তোরা? এমন কিছু না করলে উনার রাগ কমবে না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, আর তোরা মজা নিচ্ছিস! এখন যা বললাম, কাজে লেগে পড়।
সবাই একমত হয়, হাতে হাতে রুম সাজাতে শুরু করে।
লাল আর সাদা লাভ বেলুন, রঙিন মোমবাতি, স্যরি লেখা সার্কিট বেলুন, লাইটিং—সব মিলিয়ে এক রঙিন রূপ।
ঠিক তখনই মালিহা মির্জা রুমে ঢোকেন।
সবাই তড়িঘড়ি করে সব লুকিয়ে ফেলে।
মেহরিন বলে—
—কিছু বলবে মা?
মালিহা মির্জা সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে বলেন—
— তোমরা কি করছ এখানে সবাই? আমাকে দেখে চোরের মতো করছ কেন তোমরা?
মেহের সিরিয়াস মুখ করে বলে—

— আপনি এখন যান। আমরা গোপন বৈঠকে বসেছি। এখানে কোনো মহিলা মানুষ এলাউড না, আর এটা অবশ্যই আপনার মেয়ে জামাই সম্পর্কিত।এখন তাও যদি আপনার জানার আগ্রহ থাকে তাহলে বলুন, আমরা সব বিস্তারিত ভেঙে ভেঙে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিব আপনাকে।
মালিহা মির্জা একটু লজ্জা পায় এমন কথায়।কিছু না বলে একপ্রকার দৌড়ে পালন ওখান থেকে।
সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে।
লামিয়া বলে—
—মেহের আপু, তুমি তো একেবারে জোস! কী কথা বললে আন্টি তো একদম পালিয়েই গেল!
মেহের হেসে বলে—
— কোন রোগে কোন ওষুধ লাগবে, আমি জানি রে বোনু।
সবাই হাসতে হাসতে রুম সাজানো শেষ করে।

রুমের মাঝখানে মেঝেতে ‘SORRY, KOBI SHAHEB’ লেখা।আর পুরো ঘর লাল সাদা বেলুনে সাজানো।তার সাথে ঘরের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে রংবেরঙের মোমবাতি। অপূর্ব সুন্দর লাগছে রুমটা।
সাজানো শেষ হতেই মেহরিন বলে এবার তোরা যা।মেহের বলে হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো বের করে দিবিই কাজ শেষ না। আফটারনাল তুইও তো একজন বাঙালি। ওই যে একটা প্রবাদ বাক্য আছে না গাং পার হইলে মাঝি কোন শালা! আমাদের ব্যাপারটাও সেম।
মেহরিন তেড়ে যায়, তা দেখে মেহের হাসতে হাসতে দৌড় দেয়। একে একে সবাই মেহরিনকে অল দ্যা বেস্ট বলে চলে যায়।

ঘরের সবাই চলে যেতেই মেহরিন টেবিলের কাছে এগিয়ে যাই একখানা চিঠি লেখে।
টেবিলের ওপর চিঠি, একটা গোলাপ, আর একটা মোমবাতি রাখে মেহরিন।
তারপর চলে যায় কভার্টের সামনে খুঁজে খুঁজে একটা কালো শাড়ি বের করে।আর তা নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। শাড়ি পড়ে এসে আয়নার সামনে বসে মেহরিন, চোখে একটু কাজল দেয়, ঠোঁটে দেয় লাল লিপস্টিক, কপালে ছোট টিপ, আর চুলে গুলো এক সাইড করে বেলি ফুলের গজরা লাগাই।
সাজ শেষ করে লাবিবকে টেক্সট পাঠায়—

—চলে আসো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা চলে আসে।
রাজ রুমে ঢুকে অবাক।
— এই সব কে করলো?
সে তাকায় আশেপাশে—মেহরিন নেই।
ফ্লোরে চোখ যায়—SORRY, KOBI SHAHEB,
রাজ হাসে—মনে মনে বলে,
— রাগ করে ভালোই হলো, বউটা কত্ত কিছু করেছে। শুধু ফাইটার নয় রোমান্টিকও আছে বটে!
রাজ নিজের ঘড়ি খুলতে খুলতে এগিয়ে যাই টেবিল এর সামনে ওয়ালেট আর ঘড়ি রাখতে গিয়ে টেবিলের ওপর গোলাপ আর চিঠি দেখে।
সে হাসে।
চিঠি খুলে পড়তে শুরু করে।
প্রিয় স্বামী,

কিছু বলতেই ইচ্ছে করছে না, তবুও এই চিঠিখানা লিখছি…
কারণ অভিমান জমে থাকলে ভালোবাসার শব্দগুলোও কষ্ট পায়।
হ্যাঁ, ভুল হয়েছে… একটা ভুল করে ফেলেছি, যা আমার করা মোটেও উচিত হয়নি,স্বীকার করি। তবে তার মানে এই না যে সব দোষ আমার! সব দোষ তো আপনার বাঁকা হাড়ের আর সেই পাকা হাতের…
যে হাতে আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছে ভালবাসায়, গেঁথে দিয়েছে আবেগে—
তাই কোনভাবেই সম্পূর্ণ দোষ আমার নয় এখানে ৫০% ভাগীদার আপনিও।
ভুল করে ফেলেছি, তবুও বউ তো আপনারি—
তাই সব কিছু বিবেচনা করে মাফ করে দিন। আর নয় তো আপনার বাঁকা আর কে বলুন নিজের সীমার মধ্যে থাকতে। আমাকে দিয়ে যেনো কোন উল্টাপাল্টা কাজ না করাই।

–ইতি আপনার
স্ত্রী মেহরিন শিকদার
ধীরে ধীরে তার হাসি বারতে থাকে।
মনে মনে বলে, নিজে দোষ করে সেখানে আবার আমাকেও ৫০% ভাগীদার বানাচ্ছে বাহ কি বুদ্ধি। সব দোষ নাকি আমার বাঁকা হারের।
—এসবের দরকার ছিল না, বউ… আমি এমনিতেই সব ঠিক করে নিতাম। আমি কি আমার আরিওনার ওপর রাগ করে থাকতে পারি?

রাজ হাত বারিয়ে গোলাপ টা নেয়।
হাতে ব্যান্ডেজ বাধা, লাবিব জোর করে করিয়ে দিয়েছে।
সে গোলাপটা হাতে নিয়ে চিঠির ওপর রাখে।
তারপর মেহরিনকে খুঁজে না পেয়ে বেলকনিতে যায়।
ওখানে দাঁড়িয়ে এক কালো শাড়ি পরা রমণী।
পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে।
গজরা থেকে বেলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে।
রাজ ধীরে ধীরে বলে—

— Moonbem?
মেহরিন ধীরে ফিরে তাকায়…
মেহরিন ঘুরে তাকাতেই থমকে যায় রাজ।
রাজের মনে হচ্ছে তার Moonbem যেনো রাতের আঁধারে লেখা কোনো কবিতা।
কালো শাড়িতে ঢেকে রাখা তার শরীর যেনো চাঁদের গায়ে মেঘের পরত,
আর ওই চোখ—যেখানে কাজলের রেখায় আঁকা আছে না বলা হাজার গল্প।
ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক—তেমন জ্বলজ্বলে কিছু না,
তবু এতটা নরম, এতটা হৃদয়ছোঁয়া,
যেনো কোনো পুরনো ভালোবাসার কথা চেপে রাখা রঙ।
কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ—তার সরলতা আর নারীসুলভ অহংকারের ছাপ।
আর সেই চুল… খোলা চুলে গাঁথা বেলি ফুলের গাঁজরা।
বাতাসে হালকা করে দুলে ওঠে তার চুল,
আর প্রতিটা ফুল যেনো সুবাস ছড়ায়, শুধু ঘ্রাণ নয়—মনের গভীরে।
মনে হয়—সময় থেমে গেছে কিছুক্ষণ,
সব শব্দ থেমে গেছে, শুধু তার চুড়ির শব্দ বেঁচে আছে বাতাসে।
রাজের হাত যেনো নিজেই চলে যায় বুকের বাম পাশে, আর সেখানে চেপে ধরে সে বসে পড়ে।

— “কনি সাহেব”
রাজ ফিসফিস করে বলে, আরিওনা…
মেহরিন ছুটে আসে। চোখ-মুখ কাদুনে হয়ে আছে তার।
— তুমি আমাকে খুন করতে চাও, Moonbem?
— কি বলছেন এসব!পাগল হয়ে গেছেন নাকি?
— আমাকে মারার জন্য এত আয়োজন বুঝি?
মেহরিন এতক্ষণে বুঝে যায় রাজের কথার মানে। রাগে তার মাথা গরম হয়ে যায়। রাজের বুকের মাঝখানে এক কিল মেরে বলে—
— অসভ্য, শয়তান! বেয়াদব লোক! সব সময় সবকিছু নিয়ে মজা করেন! আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানেন?
রাজ বলে,

—আমার বুকে ব্যথা করছে আর তুমি সেই বুকেই মারছো? ইটস্‌ নট ফেয়ার বউ!
মেহরিন তড়িত্ উঠে আসে, কাছে বসে যায়—
—কি হয়েছে? বেশি ব্যথা করছে?
রাজ মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে—
— এভাবে আমার সামনে আসো না বউ… আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলব… তখন এই সুন্দর শরীরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে আমার গভীর ভালোবাসায়!
মেহরিন চোখ বড় করে বলে—
—আল্লাহ! তুমি কার পাল্লায় ফেললা আমায়? কি পাগল লোক! আমায় অযথা টেনশন দেয়।একদিন মেরেই ফেলবে টেনশন দিতে দিতে! আপনি আমাকে মার….

আর কিছু বলার আগেই রাজ তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে… কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে বলে—
— এসব বা*ল মার্কা কথা মুখে আনবা না। আমি বেঁচে থাকতে তোমার কিছু হবে না। সবাই আমায় ছেড়ে চলে গেছে, তুমিও কি আমায় ছেড়ে চলে যেতে চাও?
মেহরিন কিছু বলতে চাইলে রাজ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দেয়—
— না। আর একটাও বাজে কথা না। আমার সামনে আর কখনও এসব বলবে না। মনে থাকবে তো?
মেহরিন মাথা নাড়ে। রাজ তাকে কোলে বসিয়ে কপালে গভীর চুমু খায়।

প্রিয়তমা, তুমি আমার নিঃশ্বাসে জড়ানো ভালোবাসা…
তোমার অনুপস্থিতির কল্পনাই আমার বুকটা ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
আমি জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি—
হারিয়েছি আমার বাবা, হারিয়েছি আমার মা।
তাদের হারিয়েও টিকে ছিলাম, কোনোভাবে…
কিন্তু তোমায় হারালে?
না বউ, আমি আর টিকতে পারবো না।
তুমি আমার শেষ আশ্রয়, শেষ চাওয়া।
যদি কখনো মৃত্যু আসে—
তবে আমার আগে আসুক।
তোমার মৃত্যুর আগে যেনো আমার সমস্ত অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যায়।
আমার চিহ্ন পর্যন্ত যেনো না থাকে এই পৃথিবীতে।
আমাকে এমনভাবে নিও, যেনো আমি কোনোদিন ছিলাম না—
তবু সে যেনো বেঁচে থাকে, সে যেনো ভালো থাকে।আমার মাওলা।
কিন্তু যদি নেওয়ারই হয়,

তবে আমাদের একসাথে নিও।
কারণ আমি জানি, আমরা কেউই কাউকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
আমার জীবন চলে তোমার হাসির ছায়ায়,
তোমার চোখের জল আমার মৃত্যুর চেয়েও কঠিন শাস্তি।
তুমি আমার সমস্ত ভালোবাসার শেষ ঠিকানা।
তুমি না থাকলে আমার পৃথিবীটাই অচেনা।
তাই, যদি মৃত্যু আসে—তবে আমার আগে নিয়ে যেও আল্লাহ।
তুমি কি জানো,
তুমি আছো বলেই আমি এখনো আছি…
তুমি আছো বলেই শ্বাসটা টিকে আছে।
তুমি হারালে, আমি শেষ।
তুমি আমার পৃথিবী, তুমি আমার শান্তি, তুমি আমার শেষ জীবন।
মেহরিন রাজের মুখে হাত রেখে মাথা নাড়ে, চোখ বুজে বলে—

—এমন কথা বলবেন না। এখনও অনেক কিছু বাকি কবি সাহেব। আপনার সন্তানের মা হওয়া বাকি। আপনার সাথে জীবন উপভোগ করা বাকি। আপনার হাত ধরে বৃদ্ধ হওয়া বাকি।
রাজ মুচকি হেসে বলে—
— হ্যাঁ! নাতি-নাতনির মুখটাও তো দেখতে হবে!
মেহরিন থেমে যায়। রাজ হাসে—
— তুমি তো বললে বৃদ্ধা হবে আমার সাথে, তাহলে নাতি-নাতনি দেখব না? চলো চলো, তাদের আনার ব্যবস্থা করি!
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে বলে—
—আপনি নাতি-নাতনি আনবেন কীভাবে?
রাজ বাঁকা হেসে বলে—
—আমি নাতি-নাতনির বাবা, অথবা মা’কে আনব। আর তারা আনবে আমাদের নাতি-নাতনি।
মেহরিন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
— এই লোক কি বলছে এসব?

রাজ হঠাৎই মেহরিনের দিকে তাকিয়ে রাগে গর্জে ওঠে—
— সব দোষ তোমার!
মেহরিন অবাক হয়ে তাকায়—
— মানে? আমি কি করলাম আবার?
রাজ ঝাঁঝিয়ে ওঠে—
— চুপ! তোমার জন্য আমার বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না! ওরা পড়াশোনায় পিছিয়ে যাচ্ছে! একমাত্র তোমার জন্য! দায়িত্বহীন মা কোথাকার!
মেহরিন মাথায় হাত দিয়ে কপাল চাপড়ে বলে—
— আল্লাহ! কি পাগল লোক আমার কপালে লিখলা? বাচ্চা তো হলোই না, আর উনি বলতেছে আমার জন্য নাকি ওদের স্কুলে যেতে দেরি হচ্ছে!
রাজ থামেই না—

— চলো চলো, প্রসেসিং শুরু করি! আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আর কতোদিন একা একা থাকবে? ওনাদের খেলার সাথি দরকার! আর আমি একজন দায়িত্ববান জামাই। ওনাদের ইচ্ছা আমি নিজের জীবন, যৌবন দিয়ে হলেও পূরণ করব ইন-শা-আল্লাহ!
মেহরিন হতভম্ব। মুখে ভাষা নেই।
— এই পাগল লোক রাগ করেই ভালো ছিল…!
রাজ মেহরিনকে উদ্দেশ করে বলে—
— চলুন, মিস ওসচেতন গার্ডিয়ান?
মেহরিন হেসে ফেলে। আর রাজ তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরে।
রাতটা গভীর। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে সাদা পর্দায়। ঘরের ভেতরে হালকা গন্ধ — বেলি আর টিউলিপের। ফুলে ভরা বালিশ, চারপাশে রঙিন মোমবাতির আলোর ঝিলিক।
রাজ ধীরে ধীরে মেহরিনের গায়ে শাড়ী ঠিক করে দেয়। মেহরিন চুপচাপ। চোখে-মুখে মিশে আছে লাজ, ভয়, আর এক অদ্ভুত প্রত্যাশা।
রাজ মৃদু গলায় বলে—

— তোমাকে পেয়ে আমি পূর্ণ হয়েছি, বউ। আজ রাত শুধু আমাদের। রাগ, অভিমান, হাসি, কান্না… সব পেরিয়ে এসেছি আমরা। এবার একসাথে থাকার সময়।
মেহরিন নিচু গলায় বলে—
—কবি সাহেব।
রাজ তার হাত ধরে বলে—

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৩

— তুমি শুধু আমার। আমার মেহরিন। আমার স্বপ্নরঙ।
চোখে চোখ রেখে রাজ মেহরিনের কপালে একটি চুমু খায়। আর বাইরে চাঁদের আলো আরও মৃদু হয়ে ঘরটাকে আবেশে ভরিয়ে দেয়।
আর ওরা দুজন হারিয়ে যায় ভালোবাসার উত্তাল সাগরে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৫