মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫০
মির্জা সূচনা
আইসিইউতে লাবিব।
তার পাশের কেবিনে মেহবুবা। শারীরিক দুর্বলতায় নেতিয়ে গেছে তাকে সেলাইন দেওয়া হয়েছে।
যে গার্ড মেহবুবাকে নিয়ে এসেছে, তার নাম সাব্বির রহমান—গার্ডদের লিডার।
খুবই চতুর, এবং বুদ্ধি সম্পন্ন সে একা হাতে সব সামলে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা রাখে।
সাব্বির রাজকে কল করেছিল, কিন্তু ফোন বন্ধ।
একজন গার্ড বলে উঠল,
—স্যার, মামনিকে কি জানাবেন?
সাব্বির এক ধমকে বলল,
—তুই কি পাগল? মামনি এই খবর জানলে কী হবে বুঝতে পারিস?
এমনিই তিনি অসুস্থ। এইসব কিছু বস সামলে নেবেন।
আই থিংক বস এখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আছেন, তাই ফোন অফ।
আপাতত এদিকটা আমি সামলে নেব। স্যারের কিছু হবে না, ইন শা আল্লাহ।
এদিকে মেহরিন আর মেহের দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছে।
মেহরিন বলল,
—স্যার, আমি মনে করি, ওরাই সেই গ্যাং—যারা শুধু অস্ত্র না,
ড্রাগসও সাপ্লাই দেয় বিভিন্ন কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভীর ভদ্রলোকটি বললেন,
—হুঁ। তবে এখানে পদে পদে বিপদ। ওরা খুব চতুর।এখনো পর্যন্ত অনেক ধরতে চেয়েছে তাদের কিন্তু পারেনি। কোন না কোন ভাবে তারা পালিয়ে যায়।
মেহের হেসে বলল,
— স্যার, তারা যতই চতুর হোক না কেন, আজ ওদের যমের দুয়ারে পাঠাব।
ভদ্রলোক হেসে বললেন,
—তা তো যাবেই। কিন্তু সাবধান শত্রুকে দুর্বলতা উচিত নয়।
মেহরিন তার চিবুকে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
—আমি আগে যাই, স্যার।
মেহের, তুই ব্যাকআপে থাকবি।
মেহের মাথা নাড়ে।
এদিকে রাজ আর রিদ একটা উঁচু টিলায় গাছের পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছে।
রিদ বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—ওরা আসলে কী চায়? ওদের ধরবে, না মেরে দেবে?
রাজ বলল,
— আই থিংক, ইনকাউন্টার করবে।
ওদের গ্যাংকে ধরা যায় না। কোনো না কোনোভাবে পালিয়ে যায়।
তাই উপর থেকে অর্ডার—দেখলেই উড়িয়ে দিতে।
রিদ বলল,
— এখানে তো লাইফ রিস্ক আছে।
রাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
— হুঁ, তা আছে।
মেহরিন নিজের গেটআপ চেঞ্জ করে ফেলে।
গায়ে পড়ে এক সস্তা চুরিদার, চুল এলোমেলো, পায়ে নেই কোনো জুতা।
মেহরিন বলল,
—আমি যাচ্ছি। আপনারা রেডি থাকবেন।
এই বলে দৌড়াতে শুরু করে, আর চিৎকার করতে থাকে,
— বাঁচাও! বাঁচাও!
দৌড়াতে দৌড়াতে পৌঁছে এক তাবুর সামনে।
সেখান থেকে দুজন লোক বের হয়।
হাতে বন্দুক।
— এই! কে তুই?
বন্দুক তাক করে মেহরিনের দিকে।
মেহরিন কাঁপতে কাঁপতে বলে,
— আমাকে কিছু লোক তাড়া করছে…
বলতে বলতেই পড়ে যায়।
দুটো লোক তাকে ধরে ফেলে।
— এই মেয়ে, কী হলো?
একজন বলে,
— মনে হয় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
যা, পানি নিয়ে আয়।
সাথে থাকা লোকটা পানি এনে ছিটিয়ে দেয় মেহরিনের চোখ-মুখে।
মেহরিন চোখ খুলে কাতর কণ্ঠে বলে,
—ভাইজান… আপনাগো দুইটা পায়ে ধরি…
আমারে বাঁচান… ওই জানোয়ার গুলা আমায় মাইরা ফেলবো ভাইজান…
আমি আপনাগো দাসী হইয়া থাকমু…
এই দুনিয়ায় আমার কাও নেই ভাইজান…
আমারে একটু আশ্রয় দেন…
এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
লোকগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসে।
একজন বলে,
—তা মেয়ে, আমরা যা বলব তা করতে পারবি তো?
মেহরিন মাথা নেড়ে বলে,
—হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইজান, পারমু। আমি সব কাম পারি।
আমারে শুধু একটু মাথা গোঁজার জায়গা দেন…
লোকগুলো মেহরিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয়।
তারপর বলে,
— আমাদের বস এসেছে লন্ডন থেকে।
তার আবার বাঙালি মেয়ে খুব পছন্দ।
তারে খুশি করতে পারবি?
মেহরিন মুঠো শক্ত করে।
মনে মনে বলে,
কসম খোদার, তোদের বাঁচে ফিরতে দিবো না!
রাগ গিলে বলে,
—হ্যাঁ ভাইজান, সব পারমু।
লোকগুলো হেসে উঠে।
— আজ তো আমাদের প্রমোশন হবে রে!
বস খুব খুশি হবেন।
আমাদের ওপর বসকে খুশি করা মানেই আমাদের ভাগ্য খুলে যাওয়া!
— এই যা, এই মেয়েটারে পাশের তাবুতে নিয়ে গিয়ে রেডি করে আন।
পাশের লোকটা মাথা নেড়ে মেহরিনকে জিজ্ঞাসা করল,
— তোর নাম কী?
মেহরিন কাঁপা গলায় বলল,
— ফুলি।
লোকটা হেসে বলল,
— সুন্দর নাম! তোর মতোই…
এই আয় আমার সাথে।
মেহরিন তার পেছনে পেছনে চলতে থাকে।
তার চারপাশে ঘোরে সাপের মতো কুটিল চোখ… মেহরিন—এক চরম ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই নরকের ভেতর!
মেহরিনকে নিয়ে লোকটি এক তাবুতে ঢোকে।
তাবুর ভেতর ঢুকেই সে দেখে—২৫-২৬টা মেয়ে হাত-পা বাধা অবস্থায় পড়ে আছে।
চোখগুলোতে ভয়, মুখে কান্নার দাগ শুকিয়ে আছে।
এই দৃশ্য দেখে মেহরিন বুঝে যায়—এরা শুধু অস্ত্র বা ড্রাগস না, নারী পাচার-এর সাথেও জড়িত।
মনে মনে বলে ওঠে,
তোদের খুব তাড়াতাড়ি জমের দুয়ারে পাঠাব, জানোয়ার দল!
মেহরিন মুখে বলে,
— ভাইজান, আমি এখন কী করমু?
লোকটা বলে,
— দাঁড়া… এই!
এই বলেই সে হাক দেয়,
— ওইরে! তোরা কই?
ডাক শুনেই বেরিয়ে আসে তিনজন মেয়ে।
চোখে মুখে সাজ, পোশাকে অশ্লীলতা—
চোখে কি সব লাগিয়েছে টকটকে লাল লিপস্টিক, কপালে বড় টিপ,পোশাক পরে ওরা নগ্ন সাজের নামে লজ্জাহীনতা।
একজন হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে,
আরেকজন মেহরিনের দিকে এসে বলে,
— কী রে! এই মালটা কই পাইলি?
পুরাই তো আগুন।
দেখলেই পাগল হইয়া যাইবো!
মেহরিনের শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে,
তবু মুখ বুঝে সব সহ্য করে।
অপাশে মেহের সব শুনতে পাচ্ছে,
রাগে তার শরীর জ্বলছে।
রাজ আর রিদ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।
রিদ বলে,
— কী রে, কিছু তো দেখা যাচ্ছে না! কী করবি?
রাজ ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
— ওই দুইটা কুত্তার বাচ্চারে আমি নিজ হাতে ওপরে পাঠাব।
আমার আরিওনার দিকে নোংরা নজর দিয়েছে আর নোংরা কথা বলেছে।
রিদ চুপ।
তার নিজের রাগে শরীর কাঁপছে।
ওই লোকটা তখন বলে,
— চল, ফুলিকে রেডি কর। বসের কাছে পাঠাব।
মেয়েরা হেসে বলে,
— আহা মেয়ে, তোর কী ভাগ্য!
সোজা বসের কাছে!
বসরে খুশি করতে পারলেই আর পেছনে ফিরতে হবে না।
লোকটা হুকুম দেয়,
— বেশি কথা না! রেডি কর!
এই বলে লোকটা চলে যায়।
লোকটা যেতেই মেহরিন একটা বাঁকা হাসি দেয়।
একজন মেয়ে তার কাছে এসে বাজে ভাবে ছুঁয়ে বলে,
— তোর ফিগার তো পুরাই…
কথা শেষ হওয়ার আগেই মেহরিন তার ঘাড়ে এমন একটা মারে—মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যায়!
বাকি দুজন কিছু বলার আগেই
মেহরিন ছোট সুই-এর মতো কিছু ছুড়ে মারে—
দুজনই মাটিতে পড়ে যায় সাথে সাথে!
তাবুর ভেতরের অন্য মেয়েরা ভয় পেয়ে যায়।
মেহরিন তখন সেই তিনজনকে পাশে ফেলে দিয়ে বলে,
—ভয় পেয়ো না। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না।
তোমাদের এখান থেকে নিয়ে যাব, চুপচাপ আমি যা বলি তাই শোনো।
মেয়েরা যেনো সপ্ম দেখছে, একজন বলেই ফেলে,
— আপা, সত্যি? আপনি এখান থেকে নিয়ে যাবেন?
মেহরিন হাসে,
—হ্যাঁ, নিয়ে যাব।
আমাদের পুরো টিম এসেছে। চিন্তা কোরো না।
এই বলে মেহরিন তাদের মধ্য থেকে একজনের বাঁধন খুলে দেয়।
— তুমি বাকিদের খুলে দাও, আর আমাকে বলো—চেঞ্জ কোথায় হবে?
মেয়েটা দেখিয়ে দেয়,
মেহরিন সেখানেই গিয়ে কিছুটা ওদের মতোই সেজে নেয়।
মেয়েরা বলে,
— আপা, আপনি ওই জানোয়ারটার কাছে যাবেন?
মেহরিন হেসে বলে,
— না গেলে জমের বাড়ি পাঠাব কেমন করে!
মেয়েরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
এক পাশে গিয়ে রেডি হয়ে আসে মেহরিন অনেকটা ওদের মত করেই সাজে।
মেহরিন বলে,
— শোনো, ওই পাশে যাও।
এই একটা ছুরি দিয়ে তাবু কেটে বের হয়ে যাবে।
সবাই ঠিক আছে?
মেয়েরা মাথা নাড়ে।
— আর এই তিনটাকে সরিয়ে ফেলো,
ওদের উপর জামাকাপড় রেখে দাও যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে।
মেহরিন বের হতেই সেই আগের লোকটা এসে পড়ে।
— এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?
ওরা কই?
মেহরিন ঠান্ডা গলায় বলে,
— ভাইজান, ওরা তো আমারে আসতে বলল।
ওরা নাকি সাজবে।
লোকটা বিরক্তিতে কিছু অশ্রাব্য গালি দেয়।
তারপর বলে,
— চল। আর শোন, সাবধান!
বসকে রাগাবি না, বুঝছিস?
মেহরিন মাথা নাড়ে।
ভেতরে ভিতরে একটাই অঙ্গীকার—
এই জানোয়ারগুলোর শেষ আজই হবে।
ওই লোকটা মেহরিনকে নিয়ে যায়।
একটা বড় তাবুর ভেতর, একটা লোককে ঘিরে বসে আছে আরও বেশ কয়েকটা লোক।
তারা একটা টেবিলের উপর কিছু অস্ত্র, কিছু ড্রাগস আর একটা ম্যাপ রেখে দিয়েছে।
মেহরিন সবকিছু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে।
মেহরিনকে নিয়ে আসা লোকটা হাসে,
— বস, আপনার জন্য একটা দেশি মা*ল আনছি, পুরাই করা মা*ল।
লোকটা উল্টা দিকেই আছে, তাই মুখ দেখা যাচ্ছে না।
বাকি লোকগুলো মেহরিনকে চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে।
ওদিকে রাজ আর রিদ বসে আছে।
রিদ বলে,
— ভাই, এখন টেনশন হচ্ছে ওরা তো মেহেরিনকে কোথাও একটা নিয়ে গেল, আর কতক্ষণ এইভাবে বসে থাকব?
রাজ বলে,
— ওয়েট। বেশি না আর,
জাস্ট ৫–৬ মিনিট, আর পরেই হয়তো তাণ্ডব শুরু হবে।
রিদ বলে,
— মানে?
রাজ রিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
—এগুলোর পেছনে কার হাত আছে জানিস?
যে এগুলো পরিচালনা করে।
রিদ বলে,
— কে?
রাজ বলে,
— তুই তাকে বা তাদের চিনিস।
খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পারবি।
কিন্তু কসম করসি, আমার অরিওনার গায়ে যদি ওই কুত্তার বাচ্চা টাচ করে,
ওকে কুচি কুচি করে কাটব।
তার পর কুকুরকে খেতে দিব।
রিদ বলে,
— কিন্তু সে কে?
রাজ আর কিছু বলে না।
ফোনটা বের করে অন করে, তারপর ওর লোকদের বলে,
— আসপাশ ক্লিয়ার চাই।
৫ মিনিট পর সব কচু কাটা করে ফেলবে।
অপাশ থেকে কী বলল শোনা গেল না।
এইদিকে ওই লোকটা বলল,
— তাই নাকি? আচ্ছা, তবে তোরা সবাই যা, ওটাকে পাঠা।
মেহরিন চমকে ওঠে।
এই গলাটা তো চেনা…
এটা তো…!
মেহরিন আর কিছু ভাবতে পারে না।
ভালো মানুষের পেছনে এত বড় শয়তান—এই লোক!
মেহরিন ভয় পায়,
লোকটা না আবার তাকে চিনে ফেলে।
মেহরিন চোখে চুলকানোর ভঙ্গিতে চোখের কাজল লেপে দেয়,
তিলটা দেখে যদি চিনে ফেলে, সেই ভাবেই লিপস্টিকও লেপে দেয়।
পাশে থাকা লোকটা আস্তে করে বলে,
—এই, কী করসিস?
সব লেপে দিছিস ক্যান?
মেহরিন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
—ভাইজান, আমার তো এইসব দিয়া অভ্যাস নাই… কেমন জানি চুলকায়।
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলে,
— আচ্ছা আচ্ছা, আর চুলকাস না।
মেহরিন বলে,
— আইচ্ছা ভাইজান।
সব লোকগুলো একে একে বেরিয়ে যায়।
যাওয়ার সময় নোংরা নজর দিতে ভুলে না।
এই লোকদের বস এখনো উল্টে ঘুরেই বসে আছে।
মেহরিনের পাশে থাকা লোকটা বলে,
— যা বললাম মনে রাখিস।
তারপর বলে,
— বস, আমি আসছি।
এই বলে তাবু থেকে বেরিয়ে যায়।
লোকটা বলে,
— এইদিকে আসো, বেবি…
মেহরিন বাঁকা হাসে, ফিসফিস করে বলে,
—আজ তোর জীবনের শেষ দিন।
মেহরিন এগিয়ে যায়।
লোকটা ফিরে তাকায়।
মেহরিন যা সন্দেহ করেছিল, ঠিক তাই—
এই লোক!
লোকটা এগিয়ে আসে মেহরিনের দিকে।
আর মেহরিনের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলে,
—তোমাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে…
কই দেখেছি, বলো তো?
মেহরিন কিছু বলে না।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
ওই লোকটা বলে,
— সে যাই হোক…
তুমি কিন্তু একদম করা মা*ল, বেবি।
মেহরিনের কাছে আসে, শ্বাস নিয়ে বলে,
—আহহ… কী ফি*গার!
দেখতেই নেশা ধরে যাচ্ছে!
আজ তোমাকে আমি সুখ দিবো, আর তুমি আমাকে বলো পারবে না?
মেহরিন হাত মুঠো করে রাগে,
ঘৃণায় মন চাচ্ছে সামনের এই জানোয়ারের শরীরের চামড়া খুলে নেই!
লোকটা হঠাৎ মেহরিনের অতিনিকটে এসে দাঁড়ায়।
যখনই মেহরিনকে ধরতে যাবে—
ঠিক তখনই মেহরিন বসে পড়ে,
আর পায়ে বেধে রাখা অস্ত্র তুলে চালিয়ে দেয় হাতে।
ওই লোকটা কিছু বলবে,
মেহরিন গলায় অস্ত্র ধরে বলে—
— কুত্তার বাচ্চা!
তোর এত বড় সাহস!
আমাকে নোংরা নজরে দেখিস, আবার হাত লাগাতে চাস!
তুই যে এসবের পেছনে থাকবি কোনোদিন ভাবিই নাই, সালা!
লোকটা আটকে উঠে বলে,
— মে..মেহরিন…
মেহরিন বাঁকা হেসে বলে,
— হ্যাঁ মিস্টার শাফিন রহমান… আমি।
শাফিন কিছু বলতে যাবে,
মেহরিন বলে,
—উহু, উহু!
একটা আওয়াজ বের হলেই জানে… মেরে দিব।
তারপর মেহরিন বলে,
—সব কিছু এখন আমাদের হাতে। আটক! এটা বলার সাথেসাথেই…
গোলির আওয়াজ শোনা যায়!
মেহরিন কপাল কুঁচকে বলে,
— গুলি কে চালায়? গুলি চালানোর তো কথা নয়!
ওদিকে শাফিন হাতের ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
মেহের আর ওদের টিম চলে আসে,
দূর থেকে দেখতে পায় কিছু কালো পোশাক পরা লোক মেশিন গান চালাচ্ছে,
আর একে একে সব দেশদ্রোহী লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে।
লোকগুলোর দিকে ভালো করে তাকায় মেহের,
দেখে—সবাই কালো পোশাক পরলেও বুকের কাছে একটা লোগো আছে।
যেটা সবার একরকম।
ওটা দেখে মেহের কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করে।
মনে পড়তেই বাঁকা হেসে বলে,
— It’s not fair, ভাইয়া…
তারপর বলে,
—স্যার, আশা করছি আমাদের মিশন সফল হবে।
স্যার বলেন,
— এই লোকগুলো কারা?
মেহের হেসে বলে,
— আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী।
স্যার গম্ভীর হয়ে বলেন,
— ওটা একটা ক্রাইম।
মেহের বলে,
— ধরতে পারলে ধরে নিন ওদের।
স্যার বিরক্ত হন।
মেহেরের কথায় মনে মনে বলেন,
এই মেয়েটা সবসময় অ্যাটিটিউড দেখায়।
ওদিকে রাজ বলে,
— চল, আমাদের আর কাজ নেই।
রিদ বলে,
এসবের পেছনে কে আছে, তাকে দেখব না?
রাজ হাসে,
—দেখলে সহ্য করতে পারবি?
রিদ স্লান হাসে,
—নিজের বাবারটা পারলে… বাকিদেরটাও পারব।
রাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
— মিলির হাজব্যান্ড… শাফিন।
রিদ বলে,
— What?
রাজ মাথা নাড়ে।
একজনকে কল করে বলে,
—ওদের বসকে আমার চাই, যেভাবেই হোক ওকে উঠিয়ে নাও। আমি ওকে চাই…
ওরা বের হয়ে পড়ে।
রিদকে নিয়ে যখন বাইকের কাছে আসে,
ঠিক তখনই কল আসে সাব্বিরের।
রাজ কল রিসিভ করে বলে,
— হ্যাঁ বলো সাব্বির, কী হয়েছে?
সাব্বির বলে,
— Boss, স্যার-এর উপর হামলা হয়েছে!
স্যার এখন ICU-তে।
সাথে ম্যামও আছেন,
ওনার শরীর দুর্বল, স্যালাইন চলছে।
ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে।
রাজ বলে,
— What?!
কে করেছে হামলা?
গর্জে ওঠে রাজ।
সাব্বির বলে,
— স্যার, ওরা… Mr. Talukder-এর লোক!
রাজ ফোন কেটে দ্রুত বাইকে উঠে পড়ে।
রিদও উঠে, বলে,
—কার উপর হামলা হয়েছে?
রাজ ভাঙ্গা গলায় বলে,
— লাবিব…
আর কিছু বলার দরকার পড়ে না।
রিদ বুঝে যায় কার কাজ এটা।
রিদও ছুটে চলে,
রাজের পিছু পিছু…
রাজ পাগলের মতো বাইক চালিয়ে পৌঁছে যায় হাসপাতাল।
পৌঁছেই বাইক ফেলে সোজা ICU-এর সামনে দৌড়ে যায়।
রাজকে দেখেই সাব্বির দৌড়ে আসে—
—Boss! Cool down… Sir এখন সুস্থ আছেন, কিন্তু খুবই দুর্বল। পরপর একই জায়গায় দুইবার আঘাত লাগাই, আর ব্লাডিং বেশি হওয়ায় অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন।
রাজ একটু শান্ত হয়।
রিদ নিজের বাইক আর রাজের বাইক সাইড করে রাখে। সেও আসে।
রিদ বলে,
— হামলা কে করেছে?
সাব্বির গম্ভীর গলায় বলে,
— “Mr. Talukder…”
রিদ মাথা নিচু করে ফেলে।
ঘৃণা, রাগ… লজ্জা সবকিছু আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে তার চোখে-মুখে।
নিজেকেই প্রশ্ন করছে,
একটা মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে!
সে এগিয়ে যায় লাবিব-এর কেবিনের সামনে।
লাবিবকে দেখে ভাবে—
এই ছেলেটা তো আমার থেকেও ছোট।
সন্তানতুল্য একটা ছেলেকে মারার জন্য লোক পাঠায়!
উনি কী মানুষ?
এই জঘন্য লোকটাই আমার জন্মদাতা পিতা?
এটা ভাবতেই গা গুলিয়ে ওঠে রিদের।
হঠাৎ রিদ সাব্বিরের সামনে এসে বলে,
— মেহবুবা?
সাব্বির বলে,
—ম্যাম পাশের কেবিনে।
রিদ যায়, দেখে স্যালাইন চলছে, মেহবুবা ঘুমাচ্ছে।
অদিকে কাছেপিঠে যত লোক ছিল শাফিনের,
সবগুলো মাটিতে পড়ে আছে।
আর ভিতরে…
মেহরিন, শাফিনের গলায় অস্ত্র ধরে আছে।
মেহের আর ওদের টিম সেই তাবুর বাইরে দাঁড়িয়ে।
মেহু কোথায় তুই?”
মেহরিন বলে,
— এখানে,
সবাই ঢুকে।
শাফিন কে দেখে হেসে বলে,
—তো বাবা জীবন চল, তোমাকে শ্বশুরবাড়ি ঘুরতে নিয়ে যায়।
এতদিন অনেক খাটিয়েছো বাছা… এবার তোমার পালা।
শাফিন গর্জে ওঠে,
— তোরা কেউ বাঁচবি না!
সবগুলো মারা পড়বি! মনে রাখিস!
মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বলে—
সালি! তোকে তো আমি নিজেই পুঁতে দেব!মেহরিন হাসে।
এ কথায় মেহের গিয়ে এক লাথি মারে বুক বরাবর।
শাফিন ছিটকে পড়ে যায়।
মেহরিন বলে,
— আহা এভাবে না। ওর শাস্তি খুব ভয়ানক হবে।
— এই জানোয়ার, দেশদ্রোহী, অস্ত্র-পাচার, ড্রাগস, নারী-পাচার—সব কিছুর পেছনে এই হারামজাদার হাত আছে!
I think… শুধু ও না, আরও কেউ আছে।
স্যার বলেন,
—ঠিক বলেছো মেহু। আমারও তাই মনে হয়।
মেহের বলে,
— এটার হাত কেউ বেঁধে দাও। নাহলে মরে যাবে।
মেহরিন বাধা দিয়ে বলে,
— না মরুক! বাঁধার দরকার নেই।
মেহরিন কাটা হাতটায় পা দিয়ে চেপে ধরে, বলে
— বল! তোর সঙ্গে আর কারা আছে?
শাফিন চিৎকার করে ওঠে।
বাম হাতে থাপ্পড় মারতে যায়,
মেহরিন সেই হাত ধরে মচকে দেয়,চুল টেনে ধরে
বলে,
— এত সোজা! কী ভেবেছিস? মেয়েরা শুধু ভোগের বস্তু?
শাফিন বলে,
—নিজের বিপদ ডেকে এনেছিস তোরা। জানে, মেরে দেব সব কটা কে।
মেহের তেরে এসে দু’টা ঘুষি মারে।
তারপর চুল টেনে ধরে বলে,
—ব্লাডি বিচ….
তোর মতো কাপুরুষ কী করতে পারে দেখে নেব!
জানোয়ারের বা*চ্চা!
এই চোখে নোংরা নজর দিস না!
মেয়েদের তাই না‘তোর’…
এই বলে দু’চোখে পর পর কটা ঘুষি মারে!
শাফিন ব্যথায় কুঁকড়ে যায়, চিৎকার করে বলে,
— তোমাদের আমি ছাড়ব না! দেখে নিবো
মেহরিন টিম মেম্বারদের একজনকে বলে—
— সুমু দাও!
সুমু নামে মেয়েটি দৌড়ে আসে।
একটা লবণ দেয়।
মেহরিন সেটা দেখে হেসে ফেলে।
তারপর নিজের অস্ত্র দিয়ে আরও দুইটা পুস দেয় শাফিনের হাতে।
তারপর ডেভিল হাসি দিয়ে কাটা জায়গায় লবণ লাগিয়ে দেয়!
শাফিন গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে।
বাকিরা স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
কারণ এসব তারা এসব দেখে অভ্যস্ত।
মেহরিন যাকে ধরে,
তার মুখ থেকে কথা না বের না হওয়া পর্যন্ত ছাড়েনা।
বলে,
— বল, তোর সঙ্গে কারা আছে?
শাফিন চিৎকার করছে, কিন্তু বলছে না কিছু।
মেহরিন আরও একটা পুস দেয়,
আর লবণ দিয়ে চাপ দিয়ে ধরে রাখে!
শাফিন বলে,
— মেরে ফেল আমাকে! আমি আর পারছি না!
মেহের বলে,
— সরতো, এই কুত্তার বা*চ্চার নাটক আর ভালো লাগছে না!
এই বলে মেহরিনের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে
৪–৫টা পুস দেয়,
আর লবণ মাখিয়ে চেপে ধরে রাখে।
শাফিন চিৎকার করে বলে,
— আমার বাবা…আর
রেদওয়ান আঙ্কেল!
সবকিছু দেখে আর কাউকে কিছু বলতে হয় না।
সবাই বুঝে যায়।
সবাই নীরব…
তবে সবার মুখে একটাই প্রকাশ—
ঘৃণা আর বিজয়ের হাসি।
মেহরিন একটা ইশারা দেয়,
ঠিক তখনই কেউ একজন এক বালতি ঠান্ডা পানি ছুঁড়ে মারে শাফিনের গায়ে…
শাফিন-কে নিয়ে বের হয় সবাই।
চারপাশে থমথমে অবস্থা।
মাটি, বাতাস—সব যেন নিস্তব্ধ, অপেক্ষা করছে আরেক বিস্ফোরণের।
ঠিক তখনই…
হঠাৎ প্রবল এক ঝড়ো বাতাস,
আর বিকট শব্দ—
“ঠঠঠঠঠ…”
সবাই উপরে তাকিয়ে দেখে—
একটা হেলিকপ্টার!
সবার মুখে বিস্ময়!
কারো চোখে অবিশ্বাস… কেউ কেউ স্থির দাঁড়িয়ে, কেউ আবার পেছনে সরে যায়।
হঠাৎ…
হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে একজন লোক নেমে আসে!
আর সোজা শাফিন-কে টেনে ধরেই
হেলিকপ্টার আবার ঘূর্ণায়মান ভঙ্গিতে উপরে উঠতে থাকে!
উপরে বসে থাকা কেউ একজন দড়ি টানছে।
ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যায় যে
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ।
সবার চোখ এখন আকাশে…
আর নিচে দাঁড়িয়ে মেহের-এর মুখে শুধু একটা চাপা হাসি।
কারণ সে আন্দাজ করতে পেরেছে—
এটা কার কাজ।
মেহরিন চিৎকার দিয়ে বলে,
— “Oh shit!”
স্যার বলেন,
—এগুলো কার কাজ?
মেহের শান্ত গলায় বলে,
—স্যার… এগুলো সম্ভবত ওই হারামজাদার লোকেদের কাজ।
মেহরিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল,
তখনই মেহের চোখ দিয়ে ইশারা করে—
মেহরিন থেমে যায়।
চারদিকে যেন হঠাৎ গা ছমছমে নিস্তব্ধতা।
উপরে হেলিকপ্টারটা ছোট হতে হতে আকাশে মিলিয়ে যায়…
নিচে রয়ে যায় শুধু একটাই প্রশ্ন—
এই অদৃশ্য শক্তি কার?
মেহরিন বলে,
— স্যার, আমরা ফিরে যাচ্ছি। আপনি বরং ওই মেয়েগুলোকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
স্যার মাথা নাড়েন।
তারপর জিজ্ঞেস করেন,
— এখনো কি নাম গোপন থাকবে?
মেহরিন আর মেহের হেসে ফেলে।
স্যারও হেসে বলেন,
—ঠিক আছে, আমার বাঘিনীরা—বুঝে গেছি। যাও, তোমরা। বাকি কাজ আমরা সামলে নেব।
দুই বোন বিদায় নিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরে বাইকে চড়ে রওনা হয়।
মেহের সামনে, পেছনে মেহরিন।
মেহরিন চেঞ্জ করে বের হয়েছে।
হঠাৎ…
মেহের-এর ফোনে একটা SMS আসে।
রিদ-এর নাম দেখে মেহের বাইক সাইডে করে দাঁড় করিয়ে ফেলে।
মেহরিন বলে,
— কি হয়েছে?
মেহের বলে,
— রিদ-এর টেক্সট।
মেহরিন হেসে ফেলে।
মেহের ফোনের স্ক্রিনটা তাক করে দেখায়।
SMS:
> Rid:
হসপিটালে চলে আসো তোমরা। লাবিব আর মেহবুবা এখানেই আছে।
সাথে লোকেশন।
মেহের উত্তেজিত হয়ে বলে,
— মেহু, ধরে বস।
মেহরিন বলে,
— কেন? কী হয়েছে?
মেহের বলে,
—লাবিব আর মেহবুবা হসপিটালে!
মেহরিন কিছু বলে না।
মেহেরকে শক্ত করে ধরে বসে।
৩০ মিনিটের রাস্তা—
মেহের সেটা ১০ মিনিটেই শেষ করে ফেলে।
দুই বোন হাসপাতালে ঢোকে দৌড়ে—
তাদের চোখে শুধুই একটাই কথা:
যা-ই হোক, ওরা যেন ঠিক থাকে।
রাত তখন ৯টা।
রিদ ফিরোজ মির্জাকে কল করে জানিয়েছে ওদের ফিরতে দেরি হবে।
লাবিব তখনও শুয়ে আছে,জ্ঞান ফিরে নি এখনও।
তার পাশে রাজ আর রিদ।
চুপচাপ বসে—অভিমানের আগুনে আর দায়িত্বের ভারে ভেঙে পড়া চোখে তাকিয়ে আছে লাবিবের দিকে।
ঠিক তখনই…
দৌড়ে রুমে ঢোকে মেহের আর মেহরিন।
দুজনেই দমবন্ধ অবস্থায়।
দেখে ওরা চমকে ওঠে।
রিদ বসে আছে লাবিবের মাথার পাশে,
আর রাজ লাবিবের হাত ধরে বসে আছে নিঃশব্দে।
মেহরিন রাজের কাঁধে হাত রাখে।
জিজ্ঞেস করে,
— কে করলো এইসব?
রিদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
—আমার বাবা ছাড়া এত নিচ কাজ আর কে করতে পারে, বলো তো?
মেহু কিছু বলতে চেয়েছিল,
কিন্তু মেহরিন ইশারাই“না” করে দেয়।
মেহু চুপ করে যায়।
তারপর…
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৯
মেহরিন এগিয়ে যায়, উল্টোপাশে লাবিবের মাথার পাশে বসে পড়ে।
ধীরে ধীরে লাবিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
তার চোখে তখন কষ্ট, অসহায়ত্ব, আর…
একটা অব্যক্ত প্রতিজ্ঞা।