মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৬

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৬
মির্জা সূচনা

তারা ঢুকতেই হঠাৎ করে শিকদার বাড়ির সব আলো জ্বলে ওঠে।
অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটার কোণা কোণায় আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে।
লোকদুটো চমকে যায়।
তাদের জানামতে, সবাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকার কথা—
তাহলে এই আলো কে জ্বালালো?
তারা একে-অপরের দিকে তাকায়।তার পর সামনের দিকে তাকায়,আর সামনে যা দেখে, তাতে তাদের চোখ দুটো ছানাবরার মতো গোল হয়ে যায়।
একজন অস্পষ্টভাবে বলে ওঠে,
রু… রু… রুপা…?
তারা দেখে,

দুটি চেয়ারে ঠিক রাজরানীর মতো পা তুলে বসে আছে দুই রমনী মেহরিন আর রূপা বেগম।
তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেনো কোনো রাজ্যের রানি। সাধারণত তো রাজারাই বিচার করে,
কিন্তু এদের দেখে মনে হচ্ছে এই রাজ্যে রাজারাই শুধু নয়, বরং শাস্তি দেয় রানিরা।
দুইজনের হাতেই দুটো চাবুক।
তা ঘোরানো শুরু করে দিয়েছে…
পায়ের ভঙ্গি এতটাই আয়েশী,
যেন তারা শাস্তির রায় শোনার অপেক্ষায় বসে আছে।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন ভয় পেয়ে বেরিয়ে যেতে চায়—
কিন্তু পিছন ফিরতেই “ঠাস!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শব্দ করে দরজা গর্জে উঠে বন্ধ হয়ে যায়।
লোক দুটো যেনো ভিতর থেকেই বের হওয়া আত্মার মতো ঘুরে দাঁড়ায়,
আরও একবার তাকায় মেহরিন আর রূপা বেগমের দিকে।
রূপা বেগম কৌতুক কণ্ঠে বলে ওঠেন—
বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান,
এইবার ঘুঘু তোমার বোধিবো পরাণ!
এই সামান্য কথাতেই সামনের দু’জনের কলিজা নড়ে ওঠে।
তারা বুঝে যায়—জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা হয়তো তারা আজ এই বাড়িতে এসে করেছে।
নিজেদের বুদ্ধিহীনতায় দুই লোক এবার একে-অপরের মুখের দিকে তাকিয়েও কিছু বলতে পারে না।
ঠিক তখনই হঠাৎ…

মেহরিন উঠে দাঁড়ায়।
গলায় সুর বলে—
তুনে মারি এন্ট্রিয়া রে..
দিলমে বাজে ঘন্টিয়া রে…
টিং টিং টিং!
রূপা বেগম হেসে ওঠেন।
মেহরিন উঠে দাঁড়াতেই, লোক দুটো পিছিয়ে যায়—আর তাদের পিঠ ঠেকে যায় দরজায়।
মেহরিন জোরে হাসে—
সেই হাসি দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ঘর কাঁপিয়ে তোলে।
চারপাশে এক ধরণের ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়।
লোকদুটো আরও ভয় পেয়ে যায় মেহরিনের হাসিতে।মেহরিন আয়েশ করে আবার চেয়ারে পা তুলে বসে,
ডান হাতে তুড়ি বাজায়।

আর ঠিক তখনই
সেই দুই লোকের উপর ঝরেপড়ে তরল জাতীয় কালচে একরকম পদার্থ—
দেখতে কুচকুচে কালো, সেঁতসেঁতে, অজানা।
মেহরিন মুচকি হাসে।
রূপা বেগম এবার বলে ওঠেন—
আমাদের তরফ থেকে সামান্য অভ্যর্থনা।
এই তো প্রথমবার আমাদের বাড়ি এলি তোরা—
একটু তো আপ্যায়ন করতে হয়, তাই না?
তোদের জন্য special অভ্যর্থনার ব্যবস্থা!
সামনের লোকদুটো অপমান আর ভয়ে জ্বলে ওঠে।
মেহরিন হাসে—
আরেহ মামনি, অবশ্যই পছন্দ হয়েছে!
এমন অভ্যর্থনা… ওরা বাপের জন্মেও পেয়েছে নাকি?
রূপা বেগম মাথা নাড়ে—

—হ্যাঁ তাই তো… তাই তো…
মেহরিন এবার তাদের দিকে ফিরে বলে—
আপনারা জানেন?
আসলে অভ্যর্থনা তো লাল রঙ দিয়েই জানাতাম,কিন্তু কী বলুন তো?…
ভাবলাম, আপনাদের মন আর চরিত্রের রঙ যেহেতু কালো—
তাই কালো রঙটাই উপযুক্ত আপানাদের জন্য।
ভালো করেছি না বলুন?

ভয় পেয়েছে তারা—তবে তা মেহরিন কিংবা রূপা বেগমকে বুঝতে দিতে নারাজ।
তাদের একজন দাঁত কেটে বলে উঠলো,
কি ভাবছো? এইসব করলেই বা বললে আমরা ভয় পাবো?
রূপা বেগম চুপ।
মেহরিন হঠাৎই চট করে বলে উঠলো,
উপসসস… সরি সরি! একদম বুঝতে পারিনি!
সেই তো, সেই তো… ভয় কিসের! ভয় পাওয়ার মতো কিছু তো করলামি না!
কথার শেষে একখানা ডেভিল হাসি দিয়ে বললো,
ভয় পাওয়ার মতো দেখতে কি আমি, যে ভয় পাবেন?আমি কি কিছু করেছি, বলুন?
একদম ইনোসেন্ট মুখ করে চোখ গোল করে দাঁড়ালো।তারপর ঠোঁট উল্টে মুচকি হাসিতে বললো—
আমি তো শুধু Mr. Talukdar, মানে আমার বোনের শ্বশুর সম্মানিত এক ভদ্রলোক—
তাকে একটা বোমা উপহার দিয়েছি।

আমি কি খারাপ কিছু করেছি, বলেন?
তারপর পাশের জনের দিকে ফিরে চোখ টিপে বললো—
আর আর কী করেছি এমন!
শুধু শাফিন নামের জানোয়ারটার চোখে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছি,
আর ওর… মেয়েদের দেখলেই যেই জায়গায় চুলকায়,সেই জায়গাটা পা দিয়ে পিষে পিষে থেঁতলে দিয়েছি!
এই বলে মেহরিন এক চিলতে বাঁকা হাসি হাসে।
এবার সামনে দাঁড়ানো একজন তেরে আসতে চাই।ঠিক তখনই মেহরিন একটুখানি সরে গিয়ে বলে—
আবহাওয়া গরম… গরম লাগছে…

হেই, পানি!
এই ডাকে সাড়া দিয়ে লাবিব আর লামিয়া পানির পাইপ হাতে চলে আসে একটা হিন্দি গান গেয়ে।
লাবিব গায়,
Aaj blue hai paani…
Paani pani paani paani paani,
Aur din bhi sunny…!
Sunny sunny sunny sunny sunny
Aajaao on the beach yaar
Photo meri kheench,
phooti kismat hogi teri,
Gar tune ye baat na maani…!
লামিয়া গায়,
Aaj blue hai paani..
Paani pani paani paani paani…!
Aur din bhi sunny,
Sunny sunny sunny sunny sunny
Aajaao on the beach yaar
Photo meri kheench,
phooti kismat hogi teri,
Gar tune ye baat na maani..!

তারা দুই ভাই বোন গান গায়তে গায়তে পাইপ দুটো ধরে রাখে ঠিক সেই দুইজনের মুখের দিকে।
মুহূর্তেই তারা কাকের মতো ভিজে যায়।
শুধু ভিজে যাচ্ছে এমন না,
পানির স্রোত আর মুখোশের কারনে নিঃশ্বাসই নিতে পারছে না তারা।
বাঁচার জন্য ছটফট করে,
এদিক ওদিক পালাতে চায়,
কিন্তু যেদিকে যায়, সেদিকেই লাবিব আর লামিয়া পাইপ ধরে—
পানি ঠিকমতো মুখে পড়ছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
অবশেষে দুইজনেই মুখোশ খুলে ফেলে।
মেহরিন তখন বলে—
— “স্টপ।”
সাথে সাথে লাবিব আর লামিয়া থেমে যায়।

সায়েম রহমান মেহরিনের দিকে ফিরে চিৎকার করে উঠলো,
হারামজাদি! তুই আমার ছেলেকে মেরেছিস! এইটার বদলা আমি তোর সন্তানদের মেরে নেব!
এক মুহূর্তেই মেহরিন ভাগিনী হয়ে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে সায়েমের গলা চেপে ধরলো। এমন হঠাৎ দৃশ্য দেখে সবাই গুলিয়ে গেল।
মেহরিন গর্জে উঠলো,
হারামির বাচ্চা! এখানেই মেরে পুঁতে দিব তোকে! তোর এই নোংরা মুখে যদি আমার সন্তানের কথা উচ্চারণ করিস, তোর ছেলেকে যেমন মেরেছি, তোকে তার থেকেও বেশি কষ্ট দিয়ে মারবো! তোদের সঙ্গে আমার এখনও অনেক হিসাব বাকি, কুকুরের দল!
মেহরিনের শরীরে যেনো অশরীরী ভর করেছে। রূপা বেগম, লামিয়া আর লাবিব—তিনজনে মিলে মেহরিনকে ঠেকাতে পারছে না। এদিকে সায়েমের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, কারণ মেহরিন তার গলা এমনভাবে চেপে ধরেছে যে নিঃশ্বাস নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

ঠিক তখনই রেদওয়ান তালুকদার হঠাৎ দৌড়ে ওপরে উঠে গেল। উদ্দেশ্য—বাচ্চাদের হত্যা করা। তার পায়ের শব্দে সবার দৃষ্টি সেদিকে। তা দেখে সবাই বাঁকা হাসে।
মেহরিন সায়েমকে ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেওয়া মাত্র সায়েম কাশতে থাকে। লামিয়া এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে ঘৃণাভরা কণ্ঠে বলে,
এই নিন, পানি খান। আপনার ভাগ্য দেখেন, যে আমার বাবা, ভাই, ফুপ্পি আর ফুপাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, সেই খুনিকে পানি খাওয়াচ্ছি!

সায়েম কোনো কথা না বলে পানি নিয়ে খেয়ে ফেলে। পানির কষ্টে সে কাঁপছে, কোনোমতে গিলছে, তারপর গলা ধরে বসে থাকে। বয়স হয়েছে, শরীর এত ধকল সহ্য করতে পারছে না, তবুও এসেছে ছেলের হত্যার বদলা নিতে।
এদিকে রেদওয়ান তালুকদার মেহরিন আর রাজের রুমে পৌঁছে দেখে ঘর ফাঁকা। শুধু দুটো বাচ্চার বিছানা সাজানো। সেখানে দুইটা বাচ্চা শুয়ে আছে। রেদওয়ান তালুকদার হেসে ওঠে, আহারে! এত কষ্ট করে বাঁচলেও শেষরক্ষা হল না!তোমাদের মরতেই হবে তাও আমার হাতে।
এই বলেই পিস্তল বের করে গুলি ছোড়ে বাচ্চাদের দিকে। কিন্তু বোকা সে জানে না, এই দুটি মানুষ নয়—মানুষের মত দেখতে পুতুল। গুলি করেও যখন রক্ত বা কান্নার শব্দ পায় না, তখন সে এগিয়ে যায়। বাচ্চাদের সামনে গিয়ে দেখে—দুটো নিছক পুতুল। তখনই তার মাথা ঘুরে যায়।
পেছন থেকে মেহর বলে ওঠে,

বি ভাবছেন শ্বশুর মশাই, ওগুলো কান্না কেন করছে না আহা কান্না করবে কী করে?ওরা তো পুতুল। মানুষ না।
রেদওয়ান তালুকদার পিছনে ফিরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
একদম আমাকে শ্বশুর মশাই বলবি না! তোরা দুই বোন আমার জীবনের অভিশাপ! তোর বোনের জন্যই আমার ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার একমাত্র ছেলে! তোর মতো মেয়েকে আমি আমার বাড়ির কাজের মেয়ে হিসেবেও রাখব না! আর তুই নিজেকে আমার ছেলের বউ ভাবিস?
মেহর কানে আঙুল দিয়ে বলে,

ধুর মিয়া! শুধু এক পেঁচাল পারেন! নতুন কিছু বলেন। আর কী বললেন,
আমি আপনার বাড়ির কাজের মেয়েও হতে পারতাম না? বাহ! আমার সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি?
সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ১০ ব্যবসায়ীর তালিকায় আমি একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী নারী! তার চেয়েও বড় কথা—আপনি নিজেই আমার বোন মেহুকে আপনার ছেলের বউ বানাতে চেয়েছিলেন!আর আমি তার কপি।
রেদওয়ান তালুকদার কৌতুকভরে হেসে বলে, সেটা তো দুইটা কারণে। নিজ থেকে থরি চেয়েছি?
মেহর অবাক হয়ে বলে, মানে? এটাতেও আপনার স্বার্থ?
রেদওয়ান তালুকদার হেসে বলে,
প্রথমত, রিদ ওকে চেয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, আমি জানতাম রাজ মেহরিনকে ভালোবাসে, দূর থেকে আগলে রাখে। যদিও তখন জানতাম না রাজ শিকদারই রুদ্র আর ফারজানার ছেলে! জানলে অনেক আগেই মেরে ফেলতাম। যাকগে, যেটা আগে পারিনি, সেটা আজ করব। ওর বাবার মতো ওর সাথেও তাই ঘটবে!
মেহর হেসে উঠে বলে,

উফফ, শ্বশুর মশাই! আপনি এত বোকা কেন? এতদিনে যার কিছু ছিরতে পারলেন না, তা আজ পারবেন? আপনার জন্য খারাপ লাগছে জানেন! ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল শ্বশুরকে রান্না করে খাওয়াব, যত্ন করব। কিন্তু কপাল খারাপ! আপনার মতো একটা জানোয়ার, বিশ্বাসঘাতক, বিকৃত মানুষ আমার শ্বশুর! যাকে দেখলেই থুথু দিতে ইচ্ছে করে!
এই কথা শুনেই রেদওয়ান তালুকদার চড় মারতে তেড়ে আসে। মেহের তার হাত ধরে ফেলে আর বলে,
আপনি যদি একজন ভালো মানুষ হতেন আর আমি আপনাকে অসম্মান করতাম, তাহলে আপনি শ্বশুর হিসেবে আমাকে মারতে পারতেন। আমি কিছু বলতাম না। কিন্তু আপনি তো সম্মান পাওয়ার যোগ্যই না!আর না আমার গায়ে হাত তোলার যোগ্যতা রাখেন।
উপস! আপনি আগ্গে কেন করছি? আপনার সাথে তো যায় না।
আর কী যেন বলেছিলেন? আপনি আমাকে বউমা হিসেবে মানেন না?

আরে কুলাঙ্গারের পুত,জানোয়ারের ছাওয়াল,দাদি শাশুড়ীর বাল বেচে তাল কিনা পুত,ওরে দাদা শশুর গুলামের বড় পুত রেেে তুই আমাকে কী মানবি না? আরে ভালো শাশুড়ীর জানোয়ার বর।তোকে তো আমিই শ্বশুর হিসেবে মানি না! তুই আমার বালের শ্বশুর! বুইড়া খাটাইশ বুড়া বয়সেও এক চুল শয়তানি কমে না তাই না? এক পা কবরে চলে গেছে তাও শয়তানি সারা শরিরে কিল বিল করে। তুই বাবা হবার যোগ্য না, স্বামী হবার তো দূরের কথা, শ্বশুর হবারও না! তুই তো মানুষ হবার যোগ্যই না! তোর মতো জানোয়ারের সাথে আমার এত ভালো শাশুড়ির সংসার হল কীভাবে জানি না। অবশ্য সেই বোকার মহিলা জানেই না তুই কতোটা জঘন্য মানুষ! জানলে হয়তো তোর মন মানুষের মুখে জোতা মারতো।

কথা শেষে মেহের এক ঝটকায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় রেদওয়ান তালুকদারকে। সে উঠে আবার তেড়ে আসে মেহেরের দিকে। এমন সময় রিদ এসে দাঁড়ায় দু’জনের মাঝে। রিদকে দেখে নিশ্চুপ হয়ে যায় রেদওয়ান তালুকদার। হয়তো সে এখানে রিদকে আশা করেনি। কতোদিন পর ছেলেকে দেখল সে—বিয়ের দিন বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলো রিদ, এরপর আর ফেরেনি, না কোনো খোঁজ দিয়েছে। তবে দূর থেকে ঠিকই নজর রেখেছে ছেলের ওপর।
রেদওয়ান তালুকদার রিদের দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছিস বাবা?
রিদ আঙুল তুলে বলে,

ইসস… আপনার ও মুখ থেকে আমি আমার নাম শুনতে চাই না, একদমই না।
রেদওয়ান তালুকদারের ভেতরটা যেনো ভেঙে চুরে গেল, রিদের এই একটি কথায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কষ্ট তখনই হয়, যখন সন্তানের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখা যায়। তার পরাজয় সেখানেই, তার নিজের রক্ত তাকে ঘৃণা করে, তার মুখ দেখতে চায় না।
রিদ মেহেরের হাত ধরে নিচে নেমে যায়, যেখানে সায়েম আর বাকিরা আছে। রেদওয়ান তালুকদার যেন জড় কোনো বস্তু হয়ে নিচে নামতে থাকে। সে চাইলে চলে যেতে পারতো, কিন্তু যায়নি। ভেতরটা গুঁড়িয়ে গেছে রিদের একটি বাক্যে।

রেদওয়ান তালুকদারকে নামতে দেখে রূপা বেগম হেসে বলে,
আরে আয় আয় রিদু, তোর জন‍্যই অপেক্ষা করছিলাম। জানিস, আজ তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
রেদু তোর মনে আছে কি করেছিলি সে রাতে?
রূপা বেগমের গলা কাঁপছিলো শেষের কথা টুকু বলতে গিয়ে।
রেদওয়ান তালুকদার কুৎসিতভাবে হেসে উঠে সে কথায়। রূপার সামনে এগিয়ে যায়, বলে,
কী রে রূপা? তোর মনে নেই? চল তবে মনে করিয়ে দিই।
তার মুখে হাসি থাকলেও অন্যদের চোখে ঘৃণা ঝরে পড়ে। কেবল মেহেরিন আর রূপা বেগমের মুখে ফুটে ওঠে তীব্র ব্যঙ্গ।

রেদওয়ান তালুকদার বলতে শুরু করে,
সেদিন আমি প্রথম কী করলাম জানিস? প্রথমে গেলাম রুদ্রদের বাড়ি। সাথে নিলাম সায়েমকে। সেখানে গিয়ে দেখি, ফারজানা, তার মেয়ে, আর তোর বড় ছেলে হাবিব ঘরে— আর আমাদের পিছু পিছুই এলো কাজের মেয়েটা। জানিস, মেয়েটা খুব বেয়াদব ছিলো। নিজেকে একদম ফারজানার রক্ষাকারী ভাবতো। আর তোর ছেলে হাবিবও কম না, ছোট হলেও ভীষণ সাহসী ছিলো। আমার কাজে বাধা হচ্ছিলো, তাই মাথা ফাটিয়ে অজ্ঞান করে দিলাম। আর সেই কাজের মেয়েটাকে মেরে বেধে রান্নাঘরে আটকে রাখলাম। বাচ্চাটাকে তুলে দিলাম ড্রাইভারের হাতে।
আর ফারজানাকে?

এটুকু বলে একটু থামে সে, যেন সে খুব মজা পাচ্ছে এসব বলে,
রেদওয়ান হাসতে হাসতে আবার বলে,
তাকেও টেনে নিয়ে গেলাম চিলে কোঠাঘরে।
ঠিক সেই সময় দৌরে এসে এক ঘুষি মারে—লাবিব! সে চিৎকার করে বলে,
কুকুরের বাচ্চা! তোকে আজ জানে মেরে ফেলবো।
রূপা বেগম বললেন, লাবিব! মায়ের ডাকে শান্ত হয়।
লামিয়া এসে হাত চেপে ধরে লাবিবকে বলে, ভাইয়া, তুমি রাগে গিয়ে কিছু করে ফেললে ভাবিমণির প্ল্যান মাটি হয়ে যাবে।

রিদ চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার জন্মদাতা বাবার দিকে। এই মানুষটা তার বাবা? এটা ভাবেই মনে হচ্ছে, এখানেই মরে যেতে পারত সে। ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে রিদের। মেহের তা বুঝে শক্ত করে ধরে রিদের হাত, চোখের ইশারায় ভরসা দেয়, আমি আছি।
রিদও মেহেরের হাত চেপে ধরে। রেদওয়ান তালুকদার তখন হেসে বলে,
বাহ, তুই তো দেখি তোর বড় ভাইয়ের মতই হয়েছিস। তোর বড় ভাইও এমনই তেড়ে এসেছিলো। কিন্তু পরিণতি কি হয়েছিলো মনে আছে?

লাবিব আবার তেড়ে যেতে চায়, কিন্তু মেহেরিন ডাক দেয়, লাবিব!
লাবিব থেমে যায়, ফ্লোরে বসে পড়ে। তার পাশে বসে পড়ে লামিয়া, ভাইকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
রেদওয়ান তালুকদার আবার বলতে শুরু করে, একে একে বর্ণনা করে কিভাবে সে হত্যা করেছে ফারজানা শিকদারকে, কিভাবে ১৫ বছরের সাহসী হাবিবকে মেরেছে, কিভাবে রুদ্রকে বিশ্বাস ঘাতকতা করে পিছন থকে মেরেছে, কিভাবে আসলামের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। সব বলার পরে সে হেসে উঠে বলে,
ইসস, সেদিন যদি রূপা তোকে পুড়িয়ে মারার কথা না ভেবে, একদম মেরেই ফেলতাম। তাহলে এত ঝামেলাই হতো না।

এমন সময় হঠাৎ একটা শব্দ করে খুলে যায় শিকদার বাড়ির দরজা।
সেই শব্দে সবাই সেদিকে ঘুরে তাকায়। দরজা খোলার শব্দেই মেহরিন আর রূপা বেগমের মুখে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি। সেদিকে তাকাতেই রেদওয়ান তালুকদারের মুখের হাসি গায়েব হয়ে যায়—হাসির জায়গায় নেমে আসে কালো অন্ধকার। কারণ তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে—সবিহা তালুকদার এবং রাহি। দু’জনের চোখেই পানি।
আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকে পড়ে তারা। সবিহা তালুকদারকে ধরে আছে রাজ আর শান্ত রাহিকে ধরে রেখেছে মেহবুবা আর আরফা। সবিহা তালুকদার ভিতরে ঢুকেই তাকায় রূপা বেগমের দিকে। অস্পষ্টভাবে আওড়ায়—রূপু…
রূপা বেগমও প্রিয় বান্ধবীকে এত বছর পর দেখে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। সেও ডেকে ওঠে, সাবু! হঠাৎ চোখ ঘুরিয়ে সে নিয়ে রাখে রেদওয়ান তালুকদারের মুখে। ইতিমধ্যে রেদওয়ান তালুকদারের কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। কারণ সে জানে, সবিহা তালুকদার যেমন নম্র, ভদ্র, শান্ত—তেমনই হিংস্র।
সবিহা তালুকদার এগিয়ে যায় স্বামীর দিকে। গর্জে ওঠে,

তুমি আমার ফারজানাকে মেরেছো! আর ওই নিষ্পাপ বাচ্চা হাবিবকে, আসলামকে, রুদ্রকে… এদের সবাইকে মেরেছো?
রেদওয়ান তালুকদার কিছু বলতে যায়, কিন্তু তার আগেই সবিহা তালুকদার ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর।জোরে একটা থাপ্পড় মেরে কলার ধরে টেনে ওঠে, তুই মেরে ফেলেছিস ওদের… জানোয়ার! কীভাবে পারলি এই কাজগুলো করতে? যার বাড়িতে খেয়ে পড়ে থেকেছিস তার পিঠে ছুরি চালাতে বিবেকে বাধলো না? এই এই, তুই আমার বাচ্চা কাওকে মেরেছিস তাই না? তাই না? তুই মেরে ফেলেছিলি আমার মেয়েকে!

এই কথায় সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সবিহা তালুকদারের দিকে। তিনি গর্জে ওঠেন, সেদিন আমি নিজের কানে আমার মেয়ের কান্না শুনেছিলাম। কিন্তু তুই বলেছিলি—আমার বাচ্চা মারা গেছে! মরা বাচ্চা হয়েছে আমার, আর রাহি, মানে ফারজানা আর রুদ্রর মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলি—’ওকে নিজের মেয়ে মনে করো!’ তারা সবাই মরে গেলেও ও বেঁচে গেছে—ওটা আমার সমস্যা না। আমার প্রিয় দুই বান্ধুর মেয়ে, আমার নিজের মেয়ের চেয়েও কম নয়। কিন্তু… আমার আসল মেয়েকে তুই কী করেছিস, জানোয়ার? বল!
সবাই চূড়ান্ত স্তব্ধতায় ডুবে যায়। কারণ এই কথাটা কেউই জানত না। সবাই জানত সবিহা তালুকদার মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছে। আর অনেকেই তো এটা পর্যন্ত জানত না যে রাহি আসলে রিদের নয়, রাজের বোন। এটা শুধু জানত মেহরিন, রূপা বেগম, রাজ, লাবিব, লামিয়া আর রিদ। তবে তারাও জানত না যে সবিহা তালুকদার জীবিত সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন।

রেদওয়ান তালুকদার মুখে বলেই ফেলে, ও নেই… মেরে ফেলেছি।
এই কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে। সবাই অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়। সবিহা তালুকদার পেছিয়ে যেতে যেতে মাটিতে পড়ে যান। রাজ আর রিদ দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে। রাহি এগিয়ে এসে অসহায় কণ্ঠে বলে, তুমি… আমার নিজের বাবা না?

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৫

রেদওয়ান তালুকদারের ভিতরটা যেন কেমন করে ওঠে। নিজের সন্তান না হলেও রাহিকে নিজের মেয়ের মতোই বড় করেছেন তিনি। হয়তো প্রথমে স্বার্থের জন্য—কিন্তু ধীরে ধীরে একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল রাহির প্রতি।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৭