মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৭
মির্জা সূচনা
ছিঃ! আপনাকে আমি এতদিন বাবা বলে ডেকে এসেছি, এটা ভাবতেই এখন গা গুলিয়ে ওঠছে! ছিঃ! আপনি এতটা নীচ, আমি কোনোদিন ভাবতেই পারিনি… ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আমি আপনাকে আমার আদর্শ ভাবতাম! আর সেই আপনি—আপনি কি না আমার বাবা,মা, মামা, ভাইয়ের হত্যাকারী? ছি মি. তালুকদার… ছিঃ!
কথাগুলো চিৎকারে করে বলে রাহি।
কথা শেষ করে হঠাৎই হু হু করে কেঁদে ওঠে রাহি। মেহরিন রাহিকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে। শিশুদের মতো রাহি মেহরিনের বুকেই আশ্রয় খুঁজে পায়, ঠিক শিশুদের মতোই কেঁদে ওঠে।
সাবিহা তালুকদার হঠাৎই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে রিদ আর রাজকে সরিয়ে দেন। তড়িঘড়ি করে ছুটে যান রেদওয়ান তালুকদারের দিকে। পরপর তিনটি জোরালো থাপ্পড় বসিয়ে দেন তার গালে।
“থু!”
মুখে থুথু ছুড়ে দেওয়াতে গর্জে ওঠেন রেদওয়ান তালুকদার, সাবিহা..!
চুপ! একদম চুপ! তোমার লজ্জা করে না? এতগুলো মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিলে…কাল সাপ ছিঃ!
বলেই কান্নায় ডুকরে ওঠেন সাবিহা। ঘৃণাভরা চোখে তাকিয়ে বলেন,
আমি এতদিন আমার তিন বন্ধুর খুনির সঙ্গে সংসার করেছি! ভাবতেই নিজের প্রতি ঘেন্না লাগছে,মরে যেহতে ইচ্ছে করছে। তোর ইচ্ছে করে না মরে যেতে? এত গুলো মানুষের জীবন ধংস করে ও দিব্যি বেচে আছিস। মরছিস না কেন?মর, মরে যা তুই! মরে যা, মরে যা..
একদম গলা ফাটিয়ে শেষ কথা বলেন সাবিহা তালুকদার। তাই তার কাশি ওঠে যায়,তীব্র কাশিতে কাঁপতে থাকেন তিনি। মেহরিন মেহেরকে চোখের ইশারায় পানি দিতে বলে। মেহের মাথা নেড়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় শাশুড়িকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাবিহা তালুকদার বিনা বাক্যে পানি খান।
পানি খেতে গিয়েই চোখ পড়ে যায়—রূপা বেগমের পায়ের পাশে পড়ে থাকা চাবুকের দিকে।
সাবিহা তালুকদার দৌড়ে গিয়ে সেটি তুলে নেন।
সোজা এগিয়ে যান রেদওয়ান তালুকদারের সামনে। সবাই নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তিনি রেদওয়ান তালুকদারকে একটা ধাক্কা মারে। ধাক্কার ফলে বেস খানিক টা পিছিয়ে যান তিনি।রাগে গায়ে হাত তোলার জন্য এগিয়ে আসেন রেদওয়ান, থাপ্পড় খেতে হবে বলে চোখ বন্ধ করে নেয় সাবিহা তালুকদার। কিন্তু ২-৩ সেকেন্ড পর ও যখন অনুভব করে থাপ্পড় তার গায়ে পরেনি তখন চোখ মেলে তাকাই তিনি। আর দেখেন রেদওয়ান তালুকদারের হাত ধরে ফেলেছে রূপা বেগম।
আর তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিদ আর রাজ। তাদের চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে,সেই আগুনেই দুজন রেদওয়ান তালুকদার কে শেষ করে দিবে।
রূপা বেগম বলেন,
খুব শখ না শরীরের জোর দেখানোর? মেয়েদের গায়ে হাত তোলার? মনে আছে তো ফারজানার মাইর গুলোর কথা কিভাবে কুত্তার মত একদিন মেরে ছিল তোকে? খুব তো পুরুষত্ব দেকালি আজ না হয়, নারীশক্তি দেখে যা। তুই কী ভেবেছিস সেদিনের মত আজ ও আমি অসহায়?আবা আমার সামনে আমার বন্ধুকে মারবি? আমি বসে বসে দেখব?
কথাগুলো যেনো বিদ্রোহের ঘোষণা।
এই সময় সায়েম এগিয়ে এসে রূপা বেগমকে থাপ্পড় মারতে যায়।
কিন্তু সে পড়ে যায় মাটিতে।
সবার চোখ সেদিকে! সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাজ আর রিদ।
এই দুই শক্তিমান পুরুষের লাথির আঘাতে সায়েম মাটিতে উল্টে যায়। সায়েম রহমান যখন এগওয়ে আসে তা দেখেই, রাজ আর রিদ সজাগ হয় যখনি তেরে আসে সাথে সাথে রিদ আর রাজ এক সাতে লাথি মারে। সেটা দেখে মেহরিনের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। রূপা বেগমের মুখেও তেমনই সাফল্যের হাসি।
এইবার রূপা বেগম ঘর কাঁপিয়ে একটা থাপ্পড় মারেন রেদওয়ানের ডান গালে। থাপ্পড়টা এত জোরে ছিল যে, রেদুয়ান তালুকদারের দুনিয়াই ঘুরে গেল।
নিজেকে সামলানোর আগেই আরেকটা–থাপ্পড় পরে বাম গালে।
রেদওয়ান দাঁত কিড়মিড় করে তেরে যাচ্ছিল রুপা বেগমের দিকে, এমন সময় লাবিব ছুটে এসে একেবারে বুক বরাবর লাথি মেরে ফেলে দেয় রেদওয়ান তালুকদারকে।
খবরদার! আমার মায়ের গায়ে হাত দেওয়ার কথা ভুলেও ভাবিস না, আমার মায়ের গায়ে হাত দিতে আসলে তোকে আমি লাবিব চৌধুরী, এক্ষুনি দোযখে পাঠিয়ে দেব!— গর্জে বলে ওঠে লাবিব।
রূপা বেগম হেসে ওঠেন, আর আস্তে আস্তপ বসেন। তাঁর মুখে দৃপ্ত হাসি।
রুপা বেগম বলেন,
কি অবস্থা সব ভালো তো? কী রে তোরা দেখি এখনও আমাকে দুর্বল আর অসহায় ভাবিস।তোরা তো দেখি কিছুই জানিস না বাপু! আমি এখন দুই বাঘের মা। তা বাঘ চিনিস তো? আমিও কি যে বলি না-শুধু ছেলেরা না রে, আমার বউমারাও আছে। তাদের সাথেই তোদের মতো দু-চারটা রেদু আর সামু পেরে উঠবি না রে।
রেদওয়ান চিৎকার করে বলে উঠল,
তোরে আমি…..
কিন্তু সেই কথা শেষ করার আগেই রাজ আর লাবিব একসাথে চিৎকার করে উঠে, উহ! উহ! অঙ্গুলি নির্দেশ করে এদিক ওদিক নেরে বলে ওঠে।
এতে আরও জলে উঠে রেদওয়ান তালুকদার কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন, এমন সময়—
আহ বাচ্চারা! চুপ করো।
রূপা বেগম উঠে দাঁড়ান।
তোমাদের মামনি এখন কিছু হিসাব নিকাশ নেবে তার পুরনো বন্ধুদের থেকে।
ওহ হ্যাঁ, শুধু আমি না, সাবিহাও নেবে!”
সাবিহা তালুকদারের দিকে ফিরেই বলেন কথা টা। কিরে সাবু নিবি না?
সাবিহা চোখের পানি মুছে বলেন,
অবশ্যই!
তাঁর হাতে ধরা চাবুকটা আরও শক্ত করে ধরে। রূপা বেগম তাকিয়ে হেসে ফেলেন।
রুপা বেগম হটাৎ লামিয়া কে ডেকে উঠেন।
লামিয়া বুঝে এখন তার কী করতে হবে,
লামিয়া নিচু হয়ে আরেকটা চাবুক তুলে। সেটা তুলে এগিয়ে দেয় রূপা বেগমের দিকে।
রূপা সেটা হাতে নিয়ে বলেন,
চল সাবু!
বলেি এগিয়ে যায় তারা। হাতে থাকা চাবুক টা ঝাকিয়ে..!
সাবিহা বলেন,
এইটা আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলার শাস্তি!
আর এক ঝটকায় দেন চাবুকের ঘা।
রেদুয়ান আর্তনাদ করে ওঠে।
এইটা আমার ভালোবাসার সঙ্গে প্রতারণার শাস্তি!আরও জোরে মারে।
এইটা আমার বন্ধুদেরকে খুন করার জন্য!
আরও আঘাত।
এইদিকে রূপা বেগম ঘুরে যান সায়েমের দিকে।
এইটা আমার দিকে কুনজর দেওয়ার জন্য!এভাবে একটা একটা করে ওদের কুকর্মের কথা বলছে আর মারছে।
একের পর এক চাবুকের ঘা করে মারতে থাকেন।
দুজনের চিৎকারে পুরো শিকদার বাড়ি কেঁপে যায়। প্রতিধ্বনিতে মুখর হয় চিৎকার, আহাজারি, বিচার—
আর সবার মুখে তখন তৃপ্তির হাসি।
শুধু রাজ আর রিদ দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে।
তারা নিশ্চুপ, কিন্তু চোখে ঝরে পড়ছে কথা।
পুরনো ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায় কী শেষ হচ্ছে হয়তো হে অথবা না।
রিদের যে একদম’ই কষ্ট হচ্ছে না তা কিন্তু না,যখনই সে বাবার জন্য কষ্ট পেতে চায়।তখনই তার ভিতর থেকে কেউ বলে ওঠে,
এই মানুষ টা তোমার বাবা হলে ও অন্য কারো বাবা- মায়ের হত্যাকারি,বন্ধুর মুখোশ পরা শত্রু।
এখন তোমার বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু রাজের ছোট বেলার কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে না? কষ্ট হচ্ছে না সেই মামানির কথা যে তোমাকে মায়ের চাইতে বেশি ভালোবাসতো তার নৃশংস মৃত্যুর কথা ভেবে? কষ্ট হচ্ছে না বাবা রুপী রুদ্র শিকদারের কথা ভেবে? তোমার কী কষ্ট হচ্ছে না আসলাম চৌধুরীর জন্য। যে তোমাকে নিজের চাচার থেকে ও বেশি ভালোবাসতো? কষ্ট হচ্ছে না হাবিবের কথা ভেবে যে তোমার মায়ের পেটের ভাই না হয়েও তোমায় আগলে রাখতো?
রিদ মাঝে মধ্যে ভাবতো ও নিজেই শেষ করে দেবে এই মানুষ রুপী পশুটাকে। রিদের জীবনের ভালোবাসার মানুষদের কেড়ে নিয়েছে এই পশু টা।
অনেকক্ষণ পর ঘামঝরা মুখে হাপাতে হাপাতে দাঁড়িয়ে থাকে দুই বন্ধু—সাবিহা তালুকদার আর রূপা বেগম।
এক সময় তারা চাবুক ফেলে দেয়।
সাবিহা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তার প্রিয় রূপাকে। রূপা বেগম ও আদরে আঁকড়ে ধরেন।
বিশ্বাসত্ব ও ভরসা যোগ্য আশ্রয় পেয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠে সাবিহা তালুকদার। অপরাধীর নেয় খুব করুন ভাবে বলে,
আমাকে মাফ করে দে রুপু। আমি না জেনে, না বুঝে, আমার বন্ধু ও তার সন্তানের খুনি, ওই জানোয়ারটার সঙ্গে এতদিন সংসার করে এসেছি। আমায় মাপ করে দে রুপা, মাপ করে দে আমায়।
রূপা বেগম দুহাতে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
আহা সাবু, কী শুরু করলি বাচ্চাদের সামনে, তুই এভাবে কাঁদছিস কেন বাচ্চাদের সামনে! আর তুই কেন কাঁদছিস? কাদবে তো ওরা তুই আমি কেনো কাদবো বল তো?
বেদনায় কুঁকড়ে থাকা রেদওয়ান তালুকদার আর সায়েম রহমানের দিকে ফিরে তাকিয়ে রূপা বেগম এক গাঢ় হাসি দিলেন।
হাসি, যা দিয়ে মানুষ সাধারণত নিজের খুশি প্রকাশ করে।
হাসি, যা এক অনন্য আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু কিছু হাসি থাকে, যা খুবই বিপজ্জনক। যেমন—রূপা বেগমের এই হাসি।
বাঘ যেমন শিকার পাওয়ার আনন্দে হাঁসে, সেই রকম এক শিকারি হাসি তাঁর মুখে। শিকার ঠিক ধরা পড়েছে, পালাতে পারবে না আর।
রেদওয়ান তালুকদার আর সায়েম রহমানের আত্মা শুকিয়ে যেতে লাগলো।
রূপা বেগম হাসিমুখে বললেন,
বউমা, তোমার স্পেশাল ওষুধটা একটুখানি ওদেরও দাও।
মেহরিন হাসলো।
রাহিকে ছেড়ে সামনে এগিয়ে এসে বললো,
Just one minute, শাশুড়ি মা!
এ কথা বলেই সে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে,আর রান্নাঘর থেকে নুনের কৌটো নিয়ে ফিরে এলো সে।
মেহরিনের হাতে নুনের কৌটো দেখে রেদওয়ান আর সায়েম একে-অপরের দিকে তাকায়।
তারা বুঝতে পারছে না, মেহরিন কী করতে চলেছে!এমন সময় ও নুন দিয়ে কী করবে?
তারা এটুকু জানে—মেহরিন কোনো সাধারণ মেয়ে নয়।
গত দুই বছরে এই মেয়ের সম্পর্কে তাদের ধারণা বারবার ভেঙেছে।
তবে ভয় একটাই—এই মুহূর্তে সে নুন এনেছে কেন? নুন যে মেহরিন কারনবিহীন আনবে না কি করতে চায় মেহরিন?
তারা চিন্তায় ডুবে।
ঠিক তখন মেহরিন বাঁকা হাসি দিয়ে বলে উঠল,
ভাবছি মাছ ভাজি করব! মাছটা ভালো করে ধুয়ে তাতে মরিচ দিলাম, সাথে আবার অল্প একটু হলুদ ও দিলাম… আর কী দেব জানো?
মেহরিনের কথায় লাবিব, লামিয়া, মেহের, মেহবুবা হেসে ফেলে।
রাজ কিংবা রিদের মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না।
শান্ত মাঝখান থেকে বলে ওঠে,
নুন! যা তোমার হাতে আছে। নাহলে তো স্বাদ আসবে না।
মেহরিন হাসে।
তুমি জানলে কী করে?
শান্ত দাঁত বের করে হেসে বলে,
তোমার বান্ধবী মাঝেমাঝে আমার সাথে ঝগড়া হলে আমাকে দিয়ে রান্না করায়, আর নিজে বসে বসে খায়। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জানো? শুধু রান্না নয়—আমাকে দিয়ে ঘর মোছানো, বাসন ধোয়া, কাপড় ধোয়া পর্যন্ত করাই আবার মাঝে মধ্যে তো? এটুকু বলেই থামে শান্ত! মেহরিন ব্রু কুচকে বলে মাঝে মধ্যে তো কী?
শান্ত এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
মাঝে মধ্যে তো আমাকে দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করাই..! কথাটা’র শেষের দিকে যেনো দুঃখ ও হতাশা কাজ করলো।
শান্ত’র কথা ও মুখের ভাব দেখে সবাই হেসে ওঠে।
মেহরিন হাসতে হাসতে বলে,
গুড, ভেরি গুড। এই না হলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড! মেয়েরা, শিখে রাখো—এই প্ল্যান কাজে দেবে!
রাহি কান্নার মাঝে বলে,
হে হে, আমি এটা অ্যাপ্লাই করব রাকিব ভাইয়ার উপর। শান্ত ভাইয়া একা কেন অত্যাচারিত হবে!
সবাই ফিক করে হাসে দেয় রাহির কথায়।
রাজ আর রিদের মুখেও এবার হাসির দেখে মিলে।হয়তো বোন হেসেছে তাই,
আসলে মাঝে মধ্যে এমন হয় যে,খুব কষ্টে বা খারাপ সময়ে অথবা সিরিয়াস মুহূর্তে এমন কিছু কথা শুনে মানুষ হাসতে বাদ্য হয়। সেই হাসি পরিস্থিতি বুঝে না।
সবাই যখন হাসতে বেস্ত ঠিক তখনই মেহরিন হাসতে হাসতে মুখ টা হঠাৎ শক্ত করে ফেলে।
তাহলে এবার আমি মাছটা লবণ দিয়ে মেখে নেই, কী বলো সবাই?
মেহের, মেহবুবা আর লামিয়া একসাথে বলে উঠে,
অবশ্যই!
ফ্লোরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা, ব্যথায় কুঁকড়ে থাকা রেদওয়ান তালুকদার ও সায়েম রহমান তখন সব বুঝে যায়।
এই মাছ তারা।
এই নুন তাদের গায়েই মাখানো হবে।
দুজন একসাথে আকুতি মিনতি করে সায়েম কাতর গলায় বলে ওঠে,
নুন দিও না মা! আমরা তো তোমার বাবার মতই… দয়া করো… এমন কোরো না…
এ কথায় যেনো মেহরিনের মাথায় আগুন ধরে যায়।
একটা জোরালো লাথি মারে সায়েম রহমানের মুখে।
চুপ! তোরা তো মানুষ’ই না। আবার বাবা দাবী করিস? না তোরা বন্ধুত্বের যোগ্য, না তোরা স্বামী হবার যোগ্য। আর না তোরা বাবা হবার যোগ্য। বাবা নামটা উচ্চারণ করবি না! তোরা বাবা হবার যোগ্যই না। তোর তো একটা ছেলে—উপস্! স্যরি, তিনটা ছেলে! কিন্তু মজার বিষয় হলো—দুটোই আমার হাতে মরেছে! আর একটা কোন গর্তে আছে, জানি না। তবে তাকেও বের করে ওপরে পাঠিয়ে দেব!
সবাই অবাক হয় মেহরিনের এমন কথায়।অবাকের রেশ কাটাতে না পেরে সবাই মেহরিনের দিকে তাকাই।
শুধু মেহের, রাজ আর লাবিব ছাড়া।সবাই অবাক হয়েছে। সায়েম রহমানও স্তব্ধ।
রেদওয়ান তালুকদার হতবাক।
মেহরিন হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে বলে,
উপস্! স্যরি! তোর যে তিনটা ছেলে, সেটা তো কেউ জানেই না! ওয়েইট!
সবার দিকে তাকিয়ে মেহরিনবলে,
তোমরা নিশ্চয় ভাবছো, এই জানোয়ারের ৩ টা ছেলে কেনো বলছি? এর তো একটাই সন্তান—তার নাম শাফিন। তাই তো?
সাবিহা তালুকদার আর রূপা বেগম মাথা নাড়ান।
রিদ রাজের দিকে ফিরে ইশারায় জানতে চায়—মেহরিন যা বলছে, তা কি সত্যি?
রাজ ইশারায় বুঝিয়ে দেয়—হ্যাঁ, ঠিকই বলছে।
রিদ অবাক!
মেহরিন ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকায় সায়েম রহমানের দিকে।
এই জানোয়ার তিনটা বিয়ে করেছে। শুধু তিনটা ছেলে না,দুইটা মেয়ে ও আছে!
সাবিহা তালুকদার আর রূপা বেগম থমকে যান। তারা বেশ অবাক হন কারন,
তারা তো জানতেন, সায়েমের শুধু একজন স্ত্রী, একজন সন্তান।
মেহরিন বলেন,
শুধু তাই না। এই জানোয়ার মেয়ের নেশায় আসক্ত। প্রায়ই নানা দেশে গিয়ে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে। শুধু তাই নয়—এরা শুধু তোমাদের শত্রু নয় এরা দেশের শত্রু।এরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রাগস দেয় ছাত্রছাত্রীদের। শুধু এটুকুতেই থেমে থাকেনি এই মানুষ রুপী পশু গুলো। এরা অস্ত্র ব্যবসা, নারী পাচার—সব কিছুতেই জড়িত!
সাবিহা তালুকদার বিস্ময়ে কেঁপে উঠেন। কাপা কাপা গলায় বলে,
এগুলো কী বলছো তুমি মেহু?
মেহরিন বলে, হ্যাঁ আন্টি আমি ঠিক বলছি। শুধু সায়েম রহমান নয় এসবের সাথে সমান তালে মি.তালুকদার ও জড়িত। তবে শুধু ওরা দুজন নয় আরও দুজন আছে।একজন তো সায়েম রহমানের ওই ছেলে,আরেকজন কে তা এখনও জানা জায়নি। এরা শুধু আমাদের শত্রু নয় এরা দশের শত্রু, দেশের শত্রু। এদের দেখা পেলেই ইনকাউন্টার করার কথা বলা হয়েছে।
সাবিহা তালুকদারের পায়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সরে যাচ্ছে। নিজেকে আর সামলাতে পারেন না তিনি।
এই একদিনেই আরও কী কী শুনতে হবে তাঁকে? এতটা খারাপ একজন মানুষ ও হয়?ভালো মানুষের রূপ নিয়ে থাকা মানুষ—তিনি আগে কখনো দেখেননি।
তাঁর বন্ধুদের খু’নি, তাঁর সন্তানের খু’নি—এখন আবার দেশের শত্রু।হাজার হাজার বাচ্চার জীবন ধংস করে দিচ্ছে এই মানুষ টা।
সাবিহা তালুকদার ধপ করে পড়ে যান।
তাঁকে আগলে ধরে রাজ আর রিদ।
আর মেহরিন এগিয়ে গিয়ে হাতে থাকা নুন ছিটিয়ে দেয় দুই জানোয়ারের গায়ে।
চাবুকের মার খেয়ে শরীরের অনেক জায়গায় ক্ষত- বিক্ষত হয়ে আছে। সেখানে নুন পরাই,
গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করে ওঠে রেদওয়ান তালুকদার ও সায়েম রহমান।
মিনিট পাঁচ পর।
যখন আর ব্যথা ও যন্ত্রণা সইবার মতো থাকে না, তখন রেদওয়ান তালুকদার আর সায়েম রহমান গড়াগড়ি খেতে খেতে মাটিতে শুয়ে পড়ে। তাঁদের শরীর জখমে জর্জরিত। সাদা টাইলসের মেঝে ততক্ষণে রক্তে রঞ্জিত।
এই সময়, রাহি এক বালতি ঠান্ডা পানি এনে তাদের গায়ে ঢেলে দেয়।
পানির ছোঁয়ায় যেনো একটু প্রাণ ফিরে পায় তারা। রেদওয়ান তালুকদার চোখ তুলে করুণভাবে তাকায় রাহির দিকে।
রাহির চোখেও তখন জল।
তিনি কাঁপা গলায় বলেন,
আমাকে মাফ করে দাও মা…
রাহি কেঁদে ফেলে। কান্না থামানোর চেষ্টা না করে বসে পড়ে তাঁর সামনেই।
মেহবুবা সামনে এগিয়ে আসতে চায়,
কিন্তু মেহরিন মাথা নেড়ে না করে।
মেহরিনের চোখ যায় মেহেরের দিকে।
মেহের বাঁকা হাসে। মাথা নাড়ে।
মেহরিন-ও হেসে ওঠে।
সবার দৃষ্টি তখন রাহির দিকে।
রাহি ধীরে ধীরে রেদওয়ান তালুকদারকে ধরে ওঠায়। তারপর ফের কান্নায় ভেঙে পড়ে—
এমন কেন করলে বাবা? আমি তো তোমাকে খুব ভালোবাসি। জানো, আমি মায়ের থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসি।
আমার দাদা ভাইয়ের থেকেও বেশি।
জানো আমি সবসময় গর্ব করে বলতাম,
আমার বাবা পৃথিবীর সব চেয়ে ভালো ভালো বাবা সবচেয়ে ভালো মানুষ।
আমার আদর্শ।
যিনি অসহায়দের পাশে থাকেন, দরিদ্রদের সাহায্য করেন।
যিনি কখনো একটা পিঁপড়েও মারেন না।
আর আমাকে পৃথিবীর সব চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।
রাহির কথার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। গাল বেয়ে জল গরিয়ে পরে বুকের কাছে জামা কিছুটা ভিজে যায় অশ্রুতে।
রেদওয়ান তালুকদারের চোখেও কী তখন অশ্রু? হয়তো হ্যাঁ, আচ্ছা এই জগন্ন মানুষটারও কী কষ্ট হচ্ছে রাহির চোখে পানি দেখে? হয়তো হচ্ছে। যে মানুষ নিজের নবজাত সন্তান কে মেরে ফেলতে পারে, তার কী পালিতো মেয়ের জন্য কষ্ট হওয়ার কথা? কিন্তু তাও রেদওয়ান তালুকদারের হচ্ছে। হয়তো সার্থের জন্যই রাহিকে সে নিজের কাছে রেখেছে কিন্তু? বাবার অভিনয় করতে করতে সত্যিই মেয়ে বানিয়ে নিয়ে ছিলো রাহি কে।
হঠাৎ করেই রাহি তাঁকে জড়িয়ে ধরে।
সবাই হতবাক।
এতসব জানার পরও রাহি তাঁকে জড়িয়ে ধরল?
মেহরিন আর মেহেরের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। রেদওয়ান তালুকদার ধীরে হাত রাখেন রাহির পিঠে।
রাহি হঠাৎ ডেকে ওঠে—
— বাবা…
—হুম…
—তুমি আমার বাবা-মাকে কেন মেরেছো?কেন মেরেছো আমার মামাকে? আমার ভাইকে?
রেদওয়ান তালুকদার চুপ করে থাকেন। রাহি আবার ও জিজ্ঞেস করে,
—তুমি কি সত্যি তোমার মেয়েকেও মেরে ফেলেছো?
রেদওয়ান তালুকদার ধীরে, কাঁপা গলায় বলে, হ্যাঁ…
আচ্ছা তুমি তো তাঁদের খুব বিশ্বাসভাজন ছিলে, তাই না?
— হ্যাঁ…
— তারা কখনো ভাবেনি তুমি এটা করতে পারো তাই না?
— হ্যাঁ…
রাহি হাসে।
তারা কতটা বোকা ছিল তাই না! তোমাদের মতো বিশ্বাসঘাতক সাপকে তারা দুধ কলা দিয়ে পুষেছে। আচ্ছা বাবা, তুমি আমার মায়ের সঙ্গে যেভাবে নির্যাতন করেছো… এবং তাকে মেরে ফেললে সেটা কি ঠিক ছিল?
— আমার বাবার খেয়ে, তার পরে, তার জন্যই ভালো একটা জীবন পাওয়ার পর ও আমার বাবাকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছো, তাই না?
রেদওয়ান তালুকদার চুপ করে থাকেন।
—তুমি কি সত্যি আমার মামাতো ভাই আর মামাকেও মেরেছো?
রেদওয়ান তালুকদার হালকা মাথা ঝাকায়।
— ভালোই করেছো। তাদের সাথে এমন টাই হওয়া উচিৎ ছিলো। তারা মানুষ চিনতে পারেনি। তারা অন্ধ ছিল, তোমার মতো কালসাপ কে বন্ধু ভেবেছিল।
আচ্ছা বাবা সত্যিই কী তাদের এমন টা প্রাপ্য ছিল? তারা তো তোমাকে বন্ধু ভাবতো,তুমি কীভাবে পারলে এমন টা করতে? আচ্ছা বাবা ওদের খুব কষ্ট হয়েছিল তাই না? অবশ্য হওয়ারই কথা। একে তো মৃত্যু তাও আবার কাছের মানুষের হাতে,ইসসস ভেবেই আমার বুক টা ছিড়ে যাচ্ছে জানো? খুব কাছের কারো হাতে মরলে খুব কষ্ট হয় তাই না?
রেদওয়ান তালুকদার চুপ করে থাকেন।অবশ্য কি বা বলবেন।
রাহির হাসি আর তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
—তোমার পেছন থেকে ছুরি মারার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল বাবা?
রেদওয়ান তালুকদার কাঁপা কণ্ঠে বলেন—
— জানি না…
রাহি হাসতে হাসতে দাঁড়ায়।
রাজ আর রিদ দু’জনেই ভয়ে উঠে দৌড়ে যেতে চায় বোনের কাছে।
কিন্তু মেহরিন আর মেহের মাথা নেড়ে থামিয়ে দেয়।
রাহি বলে,
— তুমি জানো না? তাহলে চল… আমি তোমাকে জানাই।
সে দৌড়ে যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে।
রাহি এগিয়ে গিয়ে আবার জড়িয়ে ধরে রেদওয়ান তালুকদারকে।
—বাবা… আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি জানো এই পৃথিবীতে আল্লাহ নবীর পর আমি তোমাকেই ভালোবাসি। কথা শেষে রেদওয়ান তালুকদারের কপালে চুমু খায়।
— তোমার শরীরের বাবা-বাবা গন্ধটা আমি মিস করবো।
রেদওয়ান তালুকদার রাহির মাথায় হাত রেখে কিছু বলতে যায়, ঠিক তখনই জামার নিচে লুকিয়ে রাখা হাত টা বের করে একরা ধারালো ছুরি বসিয়ে দেয় রেদওয়ান তালুকদারের বুকের ঠিক বাম পাশে।
রেদওয়ান তালুকদার চমকে তাকায়।
রাহি হেসে বলে,
—এইটা আমার বাবা-মা-ভাই থেকে আমাকে আলাদা করার জন্য।
আরেকটা আঘাত।
— এইটা আমার মাকে নির্যাতন করে মারার জন্য।
আরেকটা…
— এইটা আমার বাবাকে পিছন থেকে ছুরি মারার জন্য।
আরও…
— এইটা আমার ভাই আর মামনিকে রাজপ্রাসাদ থেকে ছুড়ে ফেলে রাস্তায় নামানোর জন্য।
একটা দুটো নয়, পর পর আঘাতে দেহ নিস্তেজ হয়ে আসে।
সবার সামনে লুটিয়ে পড়ে রেদওয়ান তালুকদার।
রাহির মুখ রক্তে ভেজা।
সে যেন রক্তপিপাসু জন্তু, বহুদিন পর শিকার পেয়ে গেছে।
সে তাঁর বুকে মাথা রেখে বলে—
—আমি অনেক আগেই জেনেছিলাম, তুমি আমার আসল বাবা না। কিন্তু তুমি যে আমার বাবা-মা মামা-ভাইয়ের খু’নি তা ভাবতেই পারি নি।
এই বাক্যটা যেনো বজ্রাঘাত হয়ে পড়ে চারপাশে।
সবাই একে অপরের দিকে তাকায়।
মেহরিন ছুটে আসে, রাহিকে বুকে টেনে নেয়।
রাহির সমস্ত শরীর কাঁপছে।
মেহরিন বলে—
—চুপ… সোনা, চুপ করো…কিছু হয়নি।
রাজ আর রিদ আশ-ফাশ করতে থাকে। দৌড়ে আসে রাহির পাশে।রাহি এগুলো সয্য করতে পারবে না বলেই তো তারা কিছু জানায়নি। এখন যদি এসব সয্য করতে না পেরে যদি ওর কিছু হয়ে যায়? এইসব ভেবেই রাজ আর রিদের কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। রাহির কিছু হলে যে ওরা শেষ। বাকিরা এখনও বিষয়্যই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রাহি এমন কিছু করবে এটা জেনো কারো মাথায় ধরছে না।
সায়েম রহমান চুপচাপ ফ্লোরে পরে আছে। আপাতত তার শরীরে ব্যাথা ভুলে সে তার সাথে কী হবে ভেবে আতঙ্কিত।
রেদওয়ান তালুকদার কষ্টেসৃষ্টে বলেন—
—আমাকে মাফ করে দিও… রাহি মা…
এর পর সে মেহরিনের দিকে ফিরে হেসে বলে—
—আমি মরে গেলেই সব শেষ না… তোমাদের ধ্বংস করবে আমার ছেলে… রু… রু… রুপন।
এই বাক্যটা যেন আবার বজ্রপাত হানে।
রিদ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে।
সাবিহা তালুকদার কাপা গলায় বলে—
— রুপন কে?
রেদওয়ান তালুকদার হাসে।
— রু রুপন আমার বড় ছেলে… রি রিদের বড় ভাই।
সাবিহা তালুকদার বসে পড়ে।
রিদ ভাঙা গলায় বলে—
— তাহলে আপনিও… দুইটা বিয়ে করেছেন?নাকি তার ও অধিক?
রেদওয়ান তালুকদার হাসেন।
— হ্যাঁ আমি দুটো বিয়ে করেছি। রুপন তোমার বড় ভাই।
সাবিহা, ওকে তো আমি কখনও বিয়ে করতাম না, যদি না সবাইকে দেখানোর প্রয়োজন পড়ত।
ফারজানার কাছে নিজেকে ভালো করার জন্য সাবিহাকে বিয়ে করেছিলাম… শুধু মুখ রক্ষা করার জন্য।
ফারজানার রিযেক্ট করার পরেই গ্রামে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম বলে কেউ জানতো না।
যখন হাতে বেশি টাকা আসলো, তখন ওদের পাঠিয়ে দিলাম মালয়েশিয়া।
সবাই স্তব্ধ।
রেদওয়ান তালুকদার আবার বলেন—
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৬
—আমি যদিও তোমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম, কিন্ত তাও আমি সত্যিকারের ভালোবেসেছি রাহি… এখনও বাসি…
আমাকে মাফ করে দিও মা…
এই কথা বলেই তাঁর দেহ হঠাৎ স্থির হয়ে যায়।হয়তো দেহ থেকে প্রান পাখি উরাল দিয়েছে।
নিঃসাড়, নিঃস্পন্দ,
পাপের প্রলাপের অবসান।