মেহরিনের সপ্নরঙ শেষ পর্ব 

মেহরিনের সপ্নরঙ শেষ পর্ব 
মির্জা সূচনা

রুপন দাঁত চেপে বলে উঠল—
কি ভেবেছিস? আমি এতটা কাঁচা খেলোয়াড়? ভুলে যাস না, আমি শুধু বাংলাদেশ না, পুরো দুনিয়ার কোণে কোণে ঘুরি। কোথায় কেমন চাল দিতে হয়, তা আমি খুব ভালো করে জানি।
রাজ কেবল বাঁকা হেসে উঠল।
তা দেখে রুপনের ভ্রু কুঁচকে গেল।
সে ভেবেছিল রাজের চোখে ভয় দেখতে পাবে, কিন্তু রাজকে হাসতে দেখে তার ভেতর রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল সাথে ভয় ও পেলো।

রুপন রাজের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল—
তোকে আর তোর পরিবারকে এখানেই পুঁতে দেবো!
রাজ তার মুখটা রুপনের কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল—
আমি চাইলে তোকে এখানেই ১১ হাত মাটি খুঁরে পুতে ফেলতে পারি, বেটা। কিন্তু আমি তা করব না। তোকে শেষ দেখতে তোর আরেক বাপ আসছে। শুধু তোর পতনের জন্যই সে অত দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে। আর আমি মটেই এমন মানুষ নই যে কারও প্রাপ্য তার থেকে কেড়ে নিবো। সবারই তো একটা সখ আল্লাদ আছে নাকি?
রুপন ভীষণ ভালো করে বুঝতে পারছে, কার কথা বলছে রাজ।
তাই সে ধীরে ধীরে রাজের কলার ছেড়ে দিল।
এরপর আঙুল তুলেই হিসহিস করে বলল—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওই মাদার**কে আমি বারো হাত মাটির নিচে পুঁতে দেবো। ওই ব্যাইন**চোদ আমার ৬ টা বারে বোম মেরেছে, ফ্যাক্টরিতে বোম মেরেছে, আগুন দিয়েছে আমার গোডাউনে, আমার শত শত অস্ত্র নিয়ে গেছে, ১৭০ টা মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। ওকে তো…
কথাটা শেষ করার আগেই পিছন থেকে প্রেম বলে উঠল—
এখনও অনেক কিছু বাকি আছে। সবার আগে তোকে দেহ থেকে মাথা আলাদা করব। তারপর তোর সবকিছু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব একদম তোর মতোই বিশ্বাস কর একদম কারপন্য করবো না গড প্রমিস।
সবাই তাকাল দরজার দিকে।
শুধু রাজ, রুপনের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো, ফিসফিস করে বলল—
দেখ, তোর আরাক বাপ।
প্রেমকে দেখে সবার ভ্রু কুঁচকে গেল।
শুধু মেহরিন, মহবুবা আর মেহের অবাক হয়ে একসাথে বলে উঠল—

“প্রেম ভাই!”
প্রেম মেহরিনের দিকে তাকিয়ে হেসে হাত নেড়ে বলল—
হাই, মেহু।
মেহরিন বাঁকা হেসে উঠল।
রুপন রাজকে ঘুষি মারতে চাইছিল, কিন্তু তার আগেই প্রেম এগিয়ে এসে হাত ধরে ফেলল।
মুচকি হেসে মুখ দিয়ে চু চু শব্দ করে বলল—
এত সোজা না, বেবি।
প্রেম ইশারা দিতেই যারা এতক্ষণ মেহরিনদের উপর বন্দুক তাক করে রেখেছিল, তারা সঙ্গে সঙ্গে রুপনকে গান পয়েন্টে নিল।
প্রেম রুপনকে ছেরে এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণের জানালা খুলে দিল। সাথে সাথেয় শীতল হাওয়া ঘরে ঢুকে সবাইকে ছুঁয়ে দিল।
প্রেম হেসে বলল—

কি রে রুপন, তোর কলিজাটা কত কেজি রে?
এমন কথা শুনে মেহরিন খিলখিলিয়ে হেসে বলল—
উহু উহু, প্রেম ভাই, ওটা আমি মেপে দেখব। তারপর আপনাকে বলব।
প্রেম মাথা নাড়ল।রাজের দিকে তাকাল।রাজ বাঁকা হাসলো।
বিনিময়ে প্রেমও বাঁকা হাসলো।
প্রেম এগিয়ে রুপনের সামনে দাঁড়াল।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল—
কি রে সালা, তোর গায়ে হাফপ্যান্ট কেন? শাড়ি-চুড়ি কই?

রাগে ফেটে পড়ল রুপন। প্রেমের দিকে তেরে আসতে চাইলো, কিন্তু প্রেম তাকে ঠেকিয়ে এক থাপ্পড় দিল।
চোখের ইশারাতেই কয়েকজন এগিয়ে এসে রুপনকে বেঁধে ফেলল এক চেয়ারে।
এদিকে মেহরিনের সামনে এগিয়ে এলো মেঘ।
হাতে একটা বাক্স দিল।মেহরিন সেটা খুলতে যাবে— এমন সময় কারও পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।
সবাই বাঁকা হাসলো। আরেক শিকার ও চলে এসেছে।
একটা নারী দরজার সামনে এসে গুনগুন করতে করতে ঘরে ঢুকল।
কিন্তু আলো নিভে থাকায় বিরক্ত হয়ে বলল—
উফ! এই রুপনও না! অন্ধকার করে রেখেছে কেন ঘরটা? আজব তো!
বলেই লাইট জ্বালিয়ে দিল।
লাইট জ্বালানো মাত্রই সবাই একসাথে বলে উঠল—

“সারপ্রাইজ!”
এতোজনের কথা শোনে নারীটা সবার দিকে তাকায়,
ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। বিপদ বুঝে উল্টো ঘুরে পালাতে চায়—
ঠিক সেইসময় লামিয়া গিয়ে ধরে ফেলে।
হেসে বলে—
হেই জেসি বেবি, হাউ আর ইউ?
ইউ নো, আমরা তোমাকে কতটা মিস করছিলাম।
জেসি সবার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বুঝে যায়—আজ সে শেষ।
মেহরিন হাততালি দিয়ে বলে ওঠে—এবার জমবে মজা, হেই জেসি বেবি!জেসি ঘাবড়ে যায় মেহরিনের কথায়।
মেহরিন মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে—

জানিস আমার চুল ধরে টেনেছিলো এই জেসি বেবি।
সাথে সাথেই মেহবুবা জেসির চুল টেনে ধরে বলে—
চিন্তা নেই, এই কাজটা আমি করব।
ওদিকে বেচারি জেসি একদিকে তো জমের হাতে ধরা পড়েছে,অন্যদিকে আবার এমন আক্রমণ, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। জেসি নিজেকে বাচাঁতে যখন মেহবুবার চুল ধরে,
তা দেখে লাবিব বেজায় চটে যায়।
সে গিয়েও জেসির চুল টেনে ধরে বলে—
এই মাতারি, ছাড় ছাড়!আমার বউকে… আমার বউয়ের চুল ধরার সাহস কই পাস তুই?আমি এখনও পর্যন্ত আমার বউয়ের সুন্দর চুলগুলোতেও হাত দিইনি।
ডাইনী, পিশাচিনী, রাক্ষসশী!তুই ধরলি কেন? ছাড়, ছাড়!

একদিকে মেহবুবা অন্য দিকে লাবিব জেসি উপায় না পেয়ে ছেড়ে দিলো মেহবুবার চুল।ওদিকে মেহবুবার অগ্নি চোখ লাবিবের দিকে পড়তেই লাবিবের হাত থেমে যায়।
সে ঢোক গিলে বলে—সরি বউ, সরি, সরি!আর কোনোদিনও কোনো মেয়ের চুল ধরব না।
মেহবুবা দাঁতে দাঁত চেপে বলে—
তোর হাতে আমি এসিড ঢালব। তুই কোন সাহসে ওই ডায়নীকে টাচ করলি?
লাবিব মুখটা কাদু কাদু করে বলে—
ওই ডাইনী তো তোমার সুন্দর চুলগুলো ধরেছিল।আমার সহ্য হয়নি, তাই…
মেহবুবার অগ্নি চোখ আবার জেসির দিকে ফিরল।
হঠাৎ বাঁকা হেসে বলল— খুব শক না চুল টানার?
ওর যদি হাতটাই না থাকে তখন?
লাবিব ৩২ পাটি বের করে বলে—

তাহলে তো খুব ভালো!সাথে বেল মাথা করে দিলো, আরো ভালো হবে।ওদিকে বাকিদের হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ—ওদের কাহিনি দেখে!
মেহবুবা আর লাবিব যখন কথায় ব্যস্ত,
আর বাকিরা শুধু দেখছে,তখনই সুযোগ বুঝে জেসি আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়।প্রেমার কাছে গিয়ে মাহিনকে নিয়ে দৌড়ে যায় জানালার কাছে।
কেউ কিছু বোঝার আগেই ঘটে যায় ঘটনাটা।সবাই আঁতকে ওঠে।
মেহরিন চিৎকার করে বলে—
খুব খারাপ হয়ে যাবে জেসি আমার বাচ্চাকে আমার কাছে দাও,তাহলে তোমার শাস্তি একটু কম হতে পারে।
জেসি হেসে বলে—
আমি জানি আমি এমনিও মরব,
ওমনেও মরব।তাহলে ভালো না তোমাদের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে মরি?অন্তত নিজের মনে তো শান্তি পাব।

বলেই কাওকে কিছু বুঝে উঠতে না দিয়ে
মাহিনকে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে।
এতক্ষণে মেহের এসে পৌঁছেছিল জেসির কাছে,
কিন্তু আটকাতে পারেনি জেসিকে। একটুর জন্য পারলো না মেহের মাহিন কে নিতে। সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল। ওদিকে একসাথে দু’জন লাফ দিয়ে জানালা দিয়ে নেমে গেল—রাজ আর প্রেম।
ওরা দু’জনেই বাজ পাখির মতো নজর রাখছিল জেসির প্রতিটা ধাপে।হয়তো আগেই বুঝেছিল এরকম কিছু হবে।
তাই তো জেসি মাহিনকে ছুড়ে মারতেই ওরা দু’জন লাফ দেয়।মেহরিন এক চিৎকারে ফ্লোরে বসে পড়ে।
প্রেমা দৌড়ে এসে ধরে মেহরিনকে।বাকিরা দৌড়ে জানালার কাছে যায়।মেহের কষিয়ে দু’টো থাপ্পড় দিল জেসির গালে।

রাজের বুকে মাহিন—রাজ তাকে আগলে নিয়েছে।প্রেম ওদের দুজনকে দুই হাতে আগলে রেখেছে।
ওপরে থেকে দেখে সবাই তিনজনকেই সুস্থিরভাবে,
নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাস ফেলে সবাই।লাবিব ধপ করে বসে পড়ে।
মেহরিন আহাজারি করতে থাকে।সবাই এতটাই শকড যে—
ওরা ঠিক আছে—এটাও কেউ মেহরিনকে বলতে পারছে না।
মেহের আর মেহবুবা নিজেদের খোয়াশ মিটাচ্ছে জেসির ওপর। মিনিট তিনেকের মধ্যেই এসে হাজির হয় রাজ আর প্রেম।রাজের কোলে মাহিন।
নিজের সন্তানকে সুস্থভাবে দেখে দৌড়ে গিয়ে কোলে নিয়ে
অজস্র চুমু খায় মেহরিন বুকে চেপে ধরে। মাহিন ফেলফেল নয়নে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে।
মেহের প্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে বলে—

এটা তোমার কাজ ছিল, তাই না প্রেম ভাই?
প্রেম মাথা নাড়িয়ে বলে—
হ্যাঁ, মাহিন যেহেতু ওদের হাতেই ছিল,তাই আমি একটুও রিস্ক নিতে চাইনি।তাই আগেই থেকেই সব সেফটি রেখেছিলাম।
রাজ এগিয়ে যায় জেসির কাছে গিয়ে ঠাসস করে এক থাপ্পড় মেরে বলে—

তোকেই এখানেই পুতে দেবো কুত্তার বাচ্চা, তোর সাহস কী করে হলো? আমার সন্তানের ক্ষতি করতে চাওয়ার—তোকে তো অনেক আগেই পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতাম। শুধু তোর বাপ আমার মামনীর ধরে তের জীবন বিখা চেয়ে ছিল, দেখেই বেঁচে গিয়েছিল নইলে যেদিন আমার বউয়ের চুলে হাত দিয়েছিলি, ওই দিনই মেরে ফেলতাম। এই হাতগুলো অ্যাসিড দিয়ে পোড়িয়ে ফেলতাম— যা হয়েছে তা আর বলব না তোকে। তোর শেষটা আমার বউ আমার সন্তানের মায়ের হাতেই হবে।

জেসি এতক্ষণ সবার সমস্ত কথা শুনছিল—মনে মনে একটা ছকও কষে নিলো হটাৎই সে করে বসল এক দুঃসাহসী কাজ, রাজকে এক ধাক্কা দিয়ে কেউ কোনো কিছু বুঝবার আগেই জালানায় লাফ দিলো—নিচে ফোম থাকায় কোনো ক্ষতি হয়নি। সোজা উঠেই গাড়িতে চেপে বসলো এবং চলে গেল। তা দেখে বাকিরা হেসে ফেলল।
মেহরিন প্রেমার দিকে তাকালো প্রেমা হেসে মাহিনকে কোলে নিলো। মেহরিন, মেহবুবা ও মেহের তিনজন একসাথে একে একে ঝাপ নিয়ে নেমে গেলো—জানালা দিয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে তারা হাসলো। প্রেম ডেকে বলল—মেহু, তিনজনেই ওপরে তাকালো প্রেম ৩ টা গাড়ির চাবি ছুরে দিল ৩ বোন চাবি নিয়ে ইশারায় সেলুট দিলো তা দেখে প্রেম অ হেসে ইশারায় সেলুট দিলো।

পিছনে দাঁড়িয়ে লাবিব বলল—ভাবিমনী, তুমি মুরগি নিয়ে এসো, আমরা ততক্ষণে মশলা রেডি করি।
মেহরিন সামনের দিকে তাকিয়ে বলল—“ওকে।” তিন বোন উঠে পড়ল; তিনটা কালো গাড়িতে। ওদিকে কনফারেন্স কল চলছে—জীবন ফোনে বলে দিচ্ছে জেসি কোন দিকে যাচ্ছে বেচারা জেসি জানে না তার কপালে কী আছে। গাড়ি জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে রাত্রের আধারে অল্প আলো নিয়ে ছুটতে লাগল বারবার পিছনে তাকিয়ে দেখছে কেউ আসছে কিনা। যখন বুঝলো পিছনে কেউ নেয় সুস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলে।

জঙ্গলের পথ পার হয়ে মেইন রাস্তায় উঠতেই হঠাৎ একটি গাড়ি এসে ধাক্কা দিলো জেসির গাড়িকে। জেসি তাকিয়ে দেখে, বাম পাশে মেহের। ডান দিকে গাড়ি ঘুরেয় জেসি তখনই অন্য পাশ থেকে ধাক্কা লাগে — ওদিকে মেহবুবাকে দেখে সামনে এগোতে চাইলেই, দেখা যায় মেহরিন সামনে থেকে অনেক স্পিডে আসছে দু’দিকে থেকে ধাক্কা খেয়ে জেসি একটু পিছিয়ে যায়; অন্য রাস্তা ধরে জেসির ভয়ে হাত-পা কাঁপতে থাকে। একটু সামনে গিয়েই জেসির গাড়ি বন্ধ হয়ে যায় — অনেক বার চেষ্টা করেও গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। ভয়ে জেসি পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে। তখন তিনটি গাড়ি একসাথে এসে পরে।

জেসি কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনটি গাড়ি চারপাশে গোল গোল ঘুরতে থাকে। জেসি বুঝে যায় তার আর সময় নেয় সে বসে পড়ে, রাস্তায়। মেহরিন, মেহের ও মেহবুবা একসাথে ঘুড়তে ঘুড়তে সাইড হয়। প্রথম মেহরিন জেসির ওপর গাড়ি চালিয়ে দেয় — গাড়ি নীচে চাপা পরে, জেসির সুন্দর দেহটা রাস্তায় পিষে যায়। মেহরিনের গাড়ি ছুটে চলে যায় মেহের-ও জেসির ওপর নিজের গাড়ি চালিয়ে দেয়। জেসির ওপর গাড়ি চালিয়ে তারা সোজা নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে চলে যায়। মেহবুবা ৪-৫ বার গাড়ি চালায় জেসির ওপর। এত বার গাড়ির চাপা পরার ফলে জেসির শরীর সড়কেই সাথে মিশে যায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা, শরীরের মাংসগুলো রাস্তায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পরে আছে। যা দেখে বুজার উপায় নেয় এটা কোন মানুষ নাকি পশু।

মেহবুবা কাচ নামিয়ে একদলা থুথু ফেলে, আক্রোশভরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
আমার পরিবার আর সন্তানের দিকে যে চোখ দিবে, তাদের পরিণতি হবে তোর মতো—তোর কাফনের জন্য যেমন একটুকরো মাংস খুঁজে পাবি না। তেমনি বাকিদেরটাও পাবে না।
কথা শেষ করে মেহবুবা কাচ তুলে নিজের গন্তব্য উদ্দেশ্যে চলে গেল — সেই বাংলো-র দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিন অগ্নিকন্যা আবার প্রবেশ করল সেই বাংলোর ভেতরে। একেবারে সোজা চলে এল বিশাল ঘরে। মেহরিনরা ঢুকতেই সবাই হাসল। প্রেম অপলক তাকিয়ে আছে মেহরিনের মায়াবী মুখশ্রীতে। রাজ এগিয়ে গিয়ে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরল। তিনজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উচ্চস্বরে বলে উঠল—
বাঘিনীরা হাসিমুখে ফিরেছে, মানে শিকার খাচাই।

মেহের বাঁকা হাসল, মেহরিন কিছু বলতে যাবে—তার আগেই মেহবুবা বলে উঠল,
ছিঃ ভাইয়া, আমাদের শিকার এত নিকৃষ্ট কিছু কি করে হতে পারে? ওটা তো নেংটি ইঁদুর, তাই রাস্তায় পিষে চলে এসেছি। ইউ নো ওই রাস্তায় সরকার মসলা পাতি কম দিয়েছিলো তাই ওই জেসি বাবি কে রাস্তার মসলা নানিয়ে সরকারকে বকা সোনার হাত থেকে বাচিয়ে আসছি।দেখলে আমি কত ভালো নাগরিক।
রাজ বাঁকা হাসল। ওদিকে মেহবুবার এহন কথা শুনে লাবিবের অবস্থা খারাপ। সে নিজে মানুষ মেরে কেটে শুকাতে দিয়ে দিবে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু তার হবু বউ কাউকে মেরেছে শুনলেই বুকের ভেতর ব্যথা ওঠে। তার বউটা যে দরজাল, ওর হাতে কেউ পড়লে আর প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারবে না—সেই ধারণা তার আছে। আর এটাই তার ভয়ের আসল কারণ। কোনো কারণে ভীষণ খেপে গেলে যদি তার বউ তার “পটল তোলার টিকিট” কনফার্ম করে দেয়—এই আতঙ্কেই সবসময় অস্থির থাকে বেচারা লাবিব।
লাবিব তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করল—

কি… কি… কি কো-করেছো?
মেহবুবা যেন ভারী খুশি হলো লাবিবের প্রশ্নে। বাকিরা লাবিবের অবস্থা দেখে হেসে উঠল। রিদ এগিয়ে গিয়ে স্নেহ ও ভালোবাসার সাথে মেহেরের ঘাম ঝরা মুখটা মুছে দিল।
ওদিকে মেহবুবা লাফাতে লাফাতে লাবিবের কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে বলল—কি হয়েছে জানো?
লাবিব ভয়ে ভয়ে দুই দিকেই মাথা নাড়ল। মেহবুবা খানিক বিরক্ত হলেও তেমন পাত্তা দিল না। মনেটর আনন্দে বলতে শুরু করল সে কিভাবে জেসিকে গাড়ির নিচে পিষেছে।
তা শুনে সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মেহবুবার দিকে। হঠাৎ লাবিব বুকে হাত দিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল—
পা… পা… পানি খাবো!

লাবিবের এমন কান্ড দেখে আবারো হাসাহাসি শুরু হলো। মেঘ এগিয়ে গিয়ে পানি এনে দিল। পানি খেয়ে থম মেরে বসে থাকল লাবিব। বারবার তাকাচ্ছে মেহবুবার দিকে—যে এখন ভীষণ উৎফুল্লতার সাথে লামিয়ার সাথে কীভাবে রুপমকে মারা করা যায় সেই প্ল্যান করছে। দু’জনের কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন মজাদার কিছু রান্না হবে। রুপন মাছ মাংস আর রাতা রাধুনি।
ওদিকে লামিয়ার মুখে ঔসব শুনে আরশ এসে লাবিবের পাশে বসে বলল—ভাই, আমি বাড়ি যাব।
লাবিব অসহায় চোখে তাকাল। পর মুহূর্তেই বাঁকা হাসল। মনে হলো আরশের কপালেও শনি নাচছে। সে একা নয়—আরশের বউয়ের মাইর খাবে।

ওদিকে রাজ মেহরিনের এলো মেলো চুলগুলো সুন্দর করে গুঁজে দিল কানের পিছনে। মেহরিন মিষ্টি করে হাসল। এই দৃশ্য দেখে প্রেমের হাসি আরও তীব্র হলো। প্রেমা একপলক নিজের ভাইকে দেখে নিল। ভাইয়ের কষ্ট সে উপলব্ধি করতে পারল।প্রেমা এগিয়ে গিয়ে প্রেমের কাছ থেকে মাহিনকে নিজের কোলে নিল। মেহরিনরা বেরিয়ে যাবার পর রুপনের ক্লাস নিয়ে এতক্ষণ যাবত প্রেম মাহিনকে নিয়ে বসেছিল। কতো আদর করেছে তাকে!
মেহরিন এসে মাহিনকে কোলে নিল। মেঘকে ডাক দিল অন্য ঘরে নিয়ে গেলো মাহিনকে খাওয়াতে । দশ মিনিট পর ফিরে এসে দিলো মেঘের হাতে মাহিনকে।

সবাই এবার রুপমকে মাঝখানে রেখে গোল হয়ে বসল।
মেহরিন বকা হাসে, এক হাত বাড়িয়ে বললো—
আমার বক্সটারে সাথে সাথেই লামিয়া বক্সটা দিল। মেহরিন হাতে বক্সটা নিয়ে ফ্লোরে রেখে খুললো বের হয়ে এলো, নানা অস্ত্র—এটাই সেই বক্স যা রাজ উপহার দিয়েছিল।
মেহরিন একটু ভাবুক হয়ে বললো—
সবার আগে তোর চোখ উপরাবো? না কলিজা বের করব? উম্ম না না না, প্রথমে তোর জিহবা কাটবো, যার সাহায্যে তুই আমার ভাই আমার সন্তানের কে তুলে আনার কথা বলেছিলি।

সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। বেচারা রুপন—র জীবনের যাই যাই অবস্থা, ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। এমনিতেই প্রেম, রাজ, লাবিব, রিদের মাইর খেয়ে আদমরা হয়ে গেছে। মেহরিনরা বেরিয়ে যাওয়ার পর পর এই ওর ওপর চলে এল অমানবিক নির্যাতন। মেহরিন একটা কেচি তুলে নিলো, হাতে নিয়ে কেচ কেচ শব্দ করলো। সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। প্রেমের হাতে ফোন—সে ভিডিও করছে তীব্রকে দেখাতে হবে তো। মেহরিন সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কেচিটা একটু ঘুরিয়ে প্রথমেই রুপন-এর দুই হাতের রগ কেটে দিলো।সাথেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। রুপন ছটফট করে উঠলো। সবার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক—যেন বেশ আকর্ষণীয় কিছু হচ্ছে। এরপরে কি কি হবে দেখার জন্য সবাই উদগ্রীব। রুপন খুব ছটফট করছে, যাদিও চেয়ারে বাধা, তবু অনেক নরাচড়া করা করছে। মেহরিন বিরক্ত হলো—বোনের মনের ভাব বুঝে মেহবুবা এসে রুপন-এর চুল টেনে ধরলো যেন নড়তে না পারে। মেহরিন হাসলো। লামিয়া এসে রুপন-এর দুই ঠোঁট একসাথে করে একটু টেনে ধরলো। মেহরিন ‘কেচত’ করে কেটে নিলো রুপন-এর দুই ঠোঁট এর পর ছেড়ে দিলো। মেহবুবা আর লামিয়া হায়ফায় করলো। রগ কাটায় এমনেই নিস্তেজ হয়ে আসছিলো শরীরটা। তার ওপরে ঠোঁট জুড়ে কাটা, গলা কাটা—মরগির মত কাতরাচ্ছে রুপন মুখ দিয়ে হু হু শব্দ করছে।
তা দেখে রাজ খুব বিরক্ত হচ্ছিল। রাজ কিছু বলবার আগেই লামিয়া বললো—ব্রো ফিল পাচ্ছি না। রাজও তাল দিলো

ঠিক বলেছিস কিভাবে করা যাবে বল তো?
ঠিক তখনই নজর গেল প্রেমের ফোনের দিকে। রাজ চট করে বললো—চল টিকটক করি। লামিয়া হে হে করে শুরু করলো।
রাজের কথায় লাবিব নিজের টাস্কি খাওয়ার মুড থাকে বের হয়ে বলে—ওয়েইট, গান আমি বাজাচ্ছি বলেই দৌরে গিয়ে টিভি অন করে ফুল সাউন্ডে গান ছেড়ে দিল—বেজে উঠলো হিন্দি গান।
“ইউ লুক লাইক ওহ
ইউ ডান্স লাইক আহ্‍”

গান বাজার সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাড়ালো। মেহরিনও উঠে দাড়ালো। সবার একতলে নাচ শুরু হলো গানের তালে তালে সবাই নাচে। নাচ শেষ হতেই মেহরিন আবার এগিয়ে গেল রুপন-এর কাছে।
রুপনের অবস্থা ভীষণই শোচনীয়।তা দেখে মেহরিন বাঁকা হাসে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে—
কষ্ট হচ্ছে খুব, তাই না? আমারও হয়েছিল। কুকুরের বাচ্চা, তুই আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে তার আরেক মায়ের কাছ থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলি? জানের মায়া নেই? বুঝিসনি কার কলিজায় হাত দিচ্ছিস? সবই তো জানিস আমি কেমন, আমার পরিবার কেমন, আমার স্বামী কেমন! একবারও মনে হল না নিজের পরিণতির কথা?
রুপন শুধু চেয়ে থাকে, কিছু বলে না। বলবেই বা কেমন করে? সে পথ তো এখন বন্ধ।

হঠাৎ মেহরিন একটা পেলাশ তুলে নিলো। তার সাহায্যে রুপনের জিহ্বা কিছুটা বের করে ধারালো একটা ছুরি দিয়ে সেটা কেটে ফেলল এক টানে। জিহ্বাটা হাতে নিয়ে বাঁকা হাসে বলে উঠল—
“তুই আমার সন্তানদের নিয়ে খেলতে চেয়েছিলি! দেখ এখন আমি তোর জীবন নিয়ে খেলব।”
ওদিকে গান চলছেই, একটার পর একটা।
এদিকে মেহরিন তার কাজে ব্যস্ত।

হঠাৎ মেহরিন উঠে দাঁড়ালো, পেছনে ফিরে সবার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলো তারপর, আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা ছুরি একের পর এক ঢুকাতে লাগলো রুপনের দু চোখে। বেশ কয়েকবার এমন করার পরও যখন মন ভরলো না, তখন আঙুল ঢুকিয়ে দিল দুই চোখে। টেনে বের করে আনলো গলা গলা দুটো চোখ।
মেহের এগিয়ে এসে মরিচের ঢাকনা খুলে খানিকটা গুঁড়ো নিয়ে দিল রুপনের ফাঁকা চোখের গর্তে। গরু জবাই করার পর যেমন কাতটাই রুপন ও ঠিক তেমন ভাবেই কাতটাচ্ছে। চেয়ার উল্টে পরে ছটফট করছে।
মেহরিন তাকালো সবার দিকে। সাথে সাথেই রাকিব চেয়ার শুদ্ধ রূপনকে উঠিয়ে বসালো। কৃতজ্ঞতার হাসি দিলো মেহরিন। বিনিময়ে রাকিব নিজের বুকে হাত রেখে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো।
কোনো কথা ছাড়াই মেহরিন মাঝারি সাইজের দা তুলে নিলো।এক এক করে দু’কুপে রূপনের শরীর থেকে দুই হাত আলাদা করে ফেললো মূহুর্তেই। হাত দুটো ফ্লোরে পড়তেই লামিয়া আর মেহবুবা দৌড়ে এসে সেগুলো তুলে নিলো।
৩২ পাটি বের করে বললো,

পরের কাজ আমরাই করবো প্লিজ।
ওদের কাণ্ড দেখে সবাই হেসে ফেললো। শুধু লাবিব আর আরোশ একে অপরের দিকে অসহায় চোখে চাইল। মেহরিন মাথা নেড়ে অনুমতি দিলো।
পছন্দের খেলনা হাতে পেয়ে বাচ্চারা যেমন আনন্দে মেতে ওঠে, তেমনি আনন্দে ভরে উঠলো লামিয়া আর মেহবুবার চোখ-মুখ। তারা মেহরিনের বক্স থেকে দুটো বড়সাইজের ছুরি বের করলো। ফ্লোরে ফেলে কাটা হাতগুলো নিয়ে মনের আনন্দে টুকরো টুকরো করছে আর হাসাহাসি করতে করছে দুজন।
মেহরিন তাকালো রূপনের দিকে—যে এখন শুধু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সময় নষ্ট না করে মেহরিন এক ঝটকায় একটা কুড়াল তুলে টানা তিনটা কুপ বসালো রূপনের বুকে। তারপর ছুরির সাহায্যে বুক চিরে বের করে আনলো কলিজাখানা। গরম তাজা রক্ত ঝরছে কলিজা খানা থেকে।
দৃশ্যটা দেখে প্রেম বলে উঠলো,

এত ছোট কলিজা ছেহ্।
রাজ মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বললো,
এই টুকু কলিজাতে এত সাহস রাখতো! ভাবতেই লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার।
রিদ হতাশার সাথে বলে উঠলো,
আমি ভেবেছিলাম অন্তত পাঁচ কেজি হবে। ধুর মান সম্মানই রাখলো না সালা আমার সো কল্ড স্টেপ ব্রাদার—এই মুখ আমি কাকে দেখাবো!
এমন সময় জীবন এসে বললো,

ভাবি, কলিজাখানাটা দাও। মামুনির আমানতটা ফ্রেশ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া লাগবে।
মেহরিন হেসে কলিজাটা দিলো। জীবন সেটাকে যত্নসহকারে একটা বক্সে রেখে দিলো।
রাজ মেহরিনকে তারা দিলো—চুমকি হাসপাতালে মহিম অনেকক্ষণ মাকে ছেড়ে আছে, কাল আবার বিয়ে আছে। এই ঝামেলা শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। মেহরিন মাথা নেড়ে সায় জানালো।
কোনো প্রকার সময় নষ্ট না করে তার শেষ কাজটা সেরে ফেললো—এক কুপে রূপনের দেহ থেকে মাথাখানা আলাদা করে ফেলো।

রূপনের মাথাখানা চিটকে গিয়ে পড়লো ফ্লোরে। দৃশ্যটা দেখে মেহরিন হেসে উঠলো। বক্স থেকে একটা হাতুড়ি বের করে এগিয়ে গেলো মাথার কাছে। ফ্লোরে বসেই হাতুড়ি চালাতে শুরু করলো রূপনের মাথায়।
হাতুড়ির আঘাত চলতে থাকলো ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মগজ বের হয়ে এলো, পুরো মুখ থেঁতলে গেলো।
কাজ শেষ হতেই মেহরিন তৃপ্তির হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রাজ এগিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। এক হাতে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বললো—খুশি?
মেহরিন হাসলো।

রাজ তখন মেঘাকে বলে উঠলো,
মেঘ, এটাকে কোনো কুমিরের ফিশারিতে ফেলে আসবা। অভুক্ত কুমিরগুলোকে এক বেলা খাওয়াতে চাই। আমার ভাই আর বোনদের বিয়ের উপলক্ষে।
মেঘা হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো।
এরপর সবাই গোসল করে জামা পাল্টে নিলো। সবার শরীরে তখনো রক্ত লেগে ছিল মোটামুটি। পোশাকের ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল সাব্বির।
রাজ এবার সিহাবকে বলে উঠলো,
মেঘাকে নিয়ে সময়মতো পৌঁছে যাবি। প্রেম আর প্রমাকেও ইনভাইট করলো রাজ ও বাকিরা। এরপর সবাই বেরিয়ে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।

সময় আর স্রোত কারো জন্য কখনো থেমে থাকে না, তেমনি থেমে থাকেনি মেহরিনদের সময়ও। সেদিনের পর দেখতে দেখতে কেটে গেছে বারো বছর। আর সেই সাথে বদলে গেছে সবার জীবন। সবাই এগিয়ে গেছে, বদলেছে সময়।
কিন্তু এতটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও বদলায়নি কারো প্রতি কারো ভালোবাসা, বদলায়নি বন্ধুত্ব। বারো বছর পরও সবাই সেই আগের মতোই আছে। না—আগের মতো নয়, এখন তাদের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে।
এখন তারা সবাই একসাথে থাকে এক বিশাল রাজমহলে। যার নাম রাখা হয়েছে “মেহরিনের স্বপ্নরঙ”। আর সেই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মেহরিনের স্বপ্নের ছোঁয়া।

কিছু বছর আগে মেহরিন একদিন স্বপ্নে দেখেছিল—তারা সবাই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সেই স্বপ্নের কথা রাজকে বলতে গিয়ে খুব কেঁদেছিল মেহরিন। আর ঠির তার কিছুদিন পর আবার মেহরিন আরেকটি স্বপ্ন দেখে—যেখানে তারা সবাই একসাথে, এক বিশাল রাজমহলে থাকছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে রাজকে স্বপ্নটার ব্যাখ্যা করেছিল মেহরিন।
তার ঠিক পাঁচ মাস পরই তারা সবাই চলে আসে সেই মহলে। বিশাল জায়গাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে এই রাজমহল। চারপাশে নানা গাছ, গাছালি, বাগান, পুকুর—সব মিলে যেন মেহরিনের স্বপ্নকে বাস্তবে আরও সুন্দর, আরও নিখুঁত রূপ দিয়েছে রাজ শিকদার নিজ হাতে।
এখন সবাই পুরো পরিবার নিয়ে একসাথে থাকে। যদিও বড়রা সবসময় থাকে না, মাঝেমধ্যে তাড়া চলে যায় তাদের আগের নীরে। তবে,

রাজ, মেহরিন, রিদ, মেহের, রাকিব, রাহি, জিবন, আরফা, লামিয়া, আরশ, সিহাব, মেঘা, মাহির আর তার বউ মীম—সবাই তাদের সন্তানদের নিয়ে মহল ভরে রেখেছে হাসি-আনন্দে। হে মাহির বিয়ে করেছে সেই মেয়েকেই যার বকা শুনে প্রেমে পরেছিল সেই মেয়েই এখন মাহিরের বউ অনামিকা ইবরাত মিম। ওদের বিয়ে টাও হয়েছে শুধু রাজ আর রিদের জন্য। এখন সবাই সুখী এত গুলো ভালোবাসার মানুষ এখন এক সাথেই থাকে।
সাথে আছে আরও দশ-বারো জন কাজের লোক। মজার ব্যাপার হলো, এখন সব নারীগন শাড়ি পরে। সবার শাড়ীর আচলে থাকে এক গুচ্ছ চাবি। সারাদিন বাচ্চাদের পেছনে ছোটাছুটি করে, মাতৃত্বের আনন্দে ডুবে থাকে।
সময়ের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে তাদের জীবন, এখন তারা সবাই নিজের মতো সুখী। পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেব মেলাতে আর কারো ইচ্ছে নেই। কেউ পূর্ণতা পেয়েছে, কেউ পায়নি—তবুও সবাই মোটামুটি সুখেই আছে।
সেদিনের পর থেকে আর কখনো…কোন শত্রুর দেখা মিলেনি। সব চারদিক থেকে মাকড়শার জালের মতো সবাইকে সুরক্ষা দেয় রাজ। অবশ্য আরাল থেকে আরেকজন ও করে।
গোধুলি বিকেলে মহলের বাগানে শুয়ে আছে প্রেম।আর মাহিম প্রেমের বুকে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,

তুমি আম্মু কে এখনও ভালোবাসো পাপাই?
প্রেম হেসে মাহিমের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তর দেয়,
ভালোবাসি কি না বলতে পারলাম না। তবে তার জন্য আমার মনে এক আকাশসম মায়া আছে। যা আমি চাইলেও এ জীবন থাকতে কোনদিন কাটাতে পারবো না।
মায়া হলো কলঙ্কের মতো-একবার লেগে গেলে তা আর মুছা যায়না। যতদিন বেঁচে থাকবো এই মায়া নামক কলঙ্কের ভাগীদার হয়েই বাঁচতে হবে। বুঝলেন আব্বাজান।
পাশ থেকে মাহিন বলে উঠে,
আম্মু জানেনা তুমি যে তাকে ভালোবাসতা?
প্রেম হেসে মাথা নেড়ে না করে। তা দেখে দুই ভাই একে উপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে যা তারা দুজন বাদে কেউ জানেনা।ওদের দুইজনকে এমন ভাবে চেয়ে থাকতে দেখে প্রেম হেসে ফেলে। মাহিন আর মাহিম এক সাথে বলে উঠে,

আমরা তোমার মতো বোকামি করবো না পাপাই আমরা আগেই বলে দিবো। যদি সোজা কথায় কাজ না হয় কিডন্যাপ করে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবো যা হবে তুমি আর পাপা বুঝে নিও। ওদের কথায় প্রেম এবার আরও জোরে হেসে ফেলে।
প্রেম উঠে বসে দুই হাতে মাহিন আর মাহিম কে জড়িয়ে ধরে বলে,
আসল কথা হচ্ছে আল্লাহ আপনাদের আম্মুকে আপনাদের পাপার জন্যই বানিয়েছে। তাই আমি তাকে পায়নি। তার থেকেও বড় কথা মেহু রাজকে অনেক ভালোবাসে। রাজ হয়তো আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে মেহুকে।আমি তো তাও বেচে আছি রাজ মেহুকে না পেলে মরে যেতো। ভালোবাসলে যে পেতেই হবে এমন তো কোন কথা নেয়,ভালোবাসার মানুষকে সুখী দেখলে অনাএশে একটা জীবন তার সুখ দেখে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
মাহিম বলে উঠলো,

তুমি আম্মু কে অতীত ভেবে..
এতোটুকু বলতেই প্রেম হেসে বলে,
মানুষ কখনো অতীত হয় রে অতীত হয় সময়..!
“শখের বয়সে যারা মনে ধরল,তাকে কপালে ধরল না” রে বাপ সে নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেয় তুই আছিস তো এতেই হবে। কী তোরা থাকবি না?
মাহিম মাহিন একসাথে বলে উঠে,
ইনশাআল্লাহ সব সময় থাকবো।
ওরা আরও নানান গল্পে মেতে উঠে। মাহিন আর মাহিম রাজের সাথে যেমন ফ্রি তেমনই প্রেমের সাথেও। রাজই ওদের বলেছিল প্রেমের সাথে এমন ভাবে মিশতে যেনো কখনো নিজেকে একা না মনে করে।প্রেম যে জীবনে আর কাউকে আসতে দিবেনা তা রাজ জানে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ প্রয়োজন। একা একা থাকলে মানুষ বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই তো রাজ কৌশলে প্রেমকে বেঁচে থাকার সম্বল হিসাবে মাহিন আর মাহিম কে দিয়ে দিলো। প্রেম ও চলে এসেছে এদিক টাই তবে সে মহলে থাকে না সবাই অনেক করে বলার পর ও রাজি হয়নি।তবে রোজ বিকেলে আসে মাহিন আর মাহিমের সাথে সময় কাটাতে। কোন অকেশন হলেও আসে। শুধু মাহিন মাহিম নয় সব বাচ্চার সাথেই প্রেমের খুব ভাব। মেহিন মাহিম প্রেম এভাবেই আড্ডা দিতে থাকে ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত। প্রেমের জীবন ওদের নিয়েই চলে যাচ্ছে।

রাত দশটা।
মেহরিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তার আকাশপানে। সম্ভবত আজ পূর্ণিমা। আকাশ জুড়ে তারার মেলা, তার মাঝখানে থালার মতো এক টুকরো রূপালি চাঁদ।
রাজ ঘরে ঢুকতেই মেহরিনকে জানালার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে হাসে। অফিসের ব্যাগটা একপাশে রেখে এগিয়ে গিয়ে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে।মেহেরিন চুপচাপ হাসল।
— আজ এত দেরি হলো যে?
উত্তরে রাজ মেহরিনের কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল—
—আজ অনেক জ্যাম ছিল মুনবিম।
রাজের ঘামে ভেজা মুখটা মেহরিন তার আঁচল দিয়ে মুছে দিল। রাজ হাসে বউয়ের এ আদরটা সে প্রতিদিনই পায়।
রাজ মেহরিনকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল—

ভালোবাসি, বউজান… আমার বাচ্চাদের মাকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি।
মেহরিন জড়িয়ে ধরে উত্তর দিল—
আমিও ভালোবাসি, আমার বাচ্চাদের বাবাকে।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর মেহরিন হঠাৎ বলল—
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ কবি সাহেব… আমার জীবনে আসার জন্য। ধন্যবাদ, আমার বাচ্চাদের বাবা হওয়ার জন্য। ধন্যবাদ, আমাকে এত ভালোবাসার জন্য। ধন্যবাদ, আমার সাধাসিধে রঙহীন স্বপ্নগুলোকে রঙিন করে তোলার জন্য।
রাজ হেসে বলল—

আমি না এলে হয়তো অন্য কেউ আসত, যে তোমাকে হয়তো আরও বেশি ভালোবাসত… আমার থেকেও বেশি।
রাজের কথায় মেহরিন রাজের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
আপনি ব্যতীত অন্য কারো ভালোবাসার আমার প্রয়োজন নেই, কবি সাহেব। আপনি যদি আমাকে এক চিমটি ভালোবাসেন, আর অপর দিকে অন্য কেউ এক সাগর ভালোবাসা নিয়ে আমার সামনে আসে, আমি আপনার সেই এক চিমটি ভালোবাসাই বেছে নেব। আপনার চেয়ে বেশি আমায় কেউ ভালোবাসে না, কবি সাহেব—আর কখনো পারবেও না। দুনিয়াতে বাবা-মায়ের পর আপনি-ই আমাকে এক পৃথিবী সম ভালোবাসেন। তাই আল্লাহ আমার কপালে আপনার নাম লিখে দিয়েছেন। আপনি আপনার ভালোবাসার চাদরে আমায় জড়িয়ে রেখেছেন খুব যত্নে। আপনার এই ভালোবাসার নিয়ে আমার মৃত্যু হোক।

মেহরিনের চোখ ভিজে এল, কিন্তু গলায় দৃঢ়তা।
কবি সাহেব, এক জীবনে আপনি আমায় এত ভালোবাসা দিয়েছেন, যা হয়তো কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে দিতে পারে না। আর কখনো এমন কথা বলবেন না। মেহরিন শিকদারকে ভালোবাসার অধিকার শুধু তার স্বামী রাজ শিকদারের। তার ব্যতীত অন্য কারো ভালোবাসার আমার প্রয়োজন নেই। আমার শুধু কবি সাহেবের ভালোবাসা হলেই চলবে।
রাজ তৃপ্তির হাসি হেসে মেহরিনকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
মোহনীয় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল—

জীবনের অনেক পথ পেরিয়ে বুঝতে পারেছি,
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ তুমি।
তুমি শুধু আমার স্ত্রী নও তুমি আমার স্বপ্নের পূর্ণতা,
আমার বেঁচে থাকার সবথেকে দৃঢ় কারণ।
আমার শত শত না পাওয়ার ভিতর অমৃত চিরস্থায়ী পাওয়া তুমি।
ধন্যবাদ, আমাকে ভালোবেসে পাশে থাকার জন্য,
ধন্যবাদ, আমার ঘরকে আলোয় ভরিয়ে তোলার জন্য।
আমাদের সন্তানদের মা হয়ে তুমি যে মমতার সমুদ্র ঢেলে দিয়েছ,সে ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না।
তুমি আমার জীবনসঙ্গী,আমার প্রতিটি স্বপ্নের রঙ—

তোমার চোখে আমি খুঁজে পাই স্বপ্নের মায়াবী ছায়া,
যেখানে আমাদের ভালোবাসা নতুন ভোরের মতো ফুটে ওঠে প্রতিদিন। আমি কৃতজ্ঞ,কারণ আমার সমস্ত গল্পে তুমি আছো,আমার প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে তোমার নাম লেখা থাকবে আমার মুনবিম,আমার আরিওনা,আমার প্রিয়তমা, আমার স্ত্রী,আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ অধ্যায় তুমি।
তুমি যদি না থাকতে-আমার জীবন হতো এক অসম্পূর্ণ অধ্যায়,একটা খালি কাগজ, যেখানে কোনো গল্প লেখা নেই।
তুমি আছো বলেই আমি স্বপ্ন দেখতে শিখেছি,তুমি আছো বলেই ঘর মানে আশ্রয়, ঘর মানে শান্তি।
তুমি আমার সন্তানের মা,তুমি আমার বুকের ভিতর লুকোনো হাজারো প্রার্থনার উপহার।তুমি আমার চোখের অশ্রু মুছে দেওয়া নরম হাত,তুমি আমার ক্লান্ত দিনের নিঃশব্দ আশ্বাস।
আমি গর্বিত তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেয়ে,

তুমি শুধু আমার পাশে নও তুমি আমার প্রতিটি শ্বাসের সাথে জড়িয়ে আছো। আজ যদি জীবন থেমেও যায়,
আমি নিশ্চিত—আমার ভালোবাসার গল্পে তোমার নামই লেখা থাকবে সবচেয়ে উজ্জ্বল অক্ষরে।
কথা শেষ হতেই রাজ মেহরিনের দিকে তাকাল। মেহরিনের চোখে চিক চিক করছে। রাজ প্যান্টের পকেট থেকে একটা রজনী গন্ধের মালা বের করল, আর তা খুব যত্ন করে মেহরিনের খোপায় পরিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলো।
মেহরিন মিষ্টি করে হেসে উঠল।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৮

ঠিক তখন রাজ একটি গান ধরল…!
পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনী গন্ধায়
রূপ সাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়
পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনী গন্ধায়
রূপ সাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের
রঙিন স্বপ্ন মাখা
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের
রঙিন স্বপন মাখা
তোমার চাঁদের আলোয়
মিলায় আমার দুঃখ সুখের সকল অবসান
তোমার চাঁদের আলোয়
মিলায় আমার দুঃখ সুখের সকল অবসান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here