মেহেরজান পর্ব ৪০
লেখনীতে- সোহা
মেহরান একটা চেয়ার টেনে আরিয়ার সামনে বসলো। আরিয়া ভয় পেলেও মেহরানের এমন পুরো কালো গেট-আপে একদম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলো। কালো শার্টে মেহরানকে এতো সুন্দর মানায়! আরিয়া জানতো না। একমুহুর্তের জন্য ভুলে গেলো তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ গেলো নুজাইশের দিকেও। এই মেহরান সুদর্শন বলে কি ওর সব বন্ধুরাও সুদর্শন নাকি ভাবতে লাগলো আরিয়া।
নুজাইশ নিজের আকাশী রঙা শার্টের হাটা গুটিয়ে মেহরানের পাশে একটা চেয়ারে বসলো নিজেও। আরিয়া ভাবলো মেহরান তো বিবাহিত সে নুজাইশকে পটানোর চেষ্টা চালাবে। এদিকে তুষার দেয়াল ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে। এবার মেহরান গমগমে আওয়াজে বলল,
“তা মিস. আরিয়া, এবার বলুন রাউশিকে কেন মারতে চেয়েছিলেন?”
আরিয়ার ধ্যান ফিরলো। মনে পড়লো তাকে এরা তুলে নিয়ে এসে বেঁধে রেখেছে। আরিয়া মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
“মেহরান তোমার সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। কোন সাহসে তুমি আমাকে এখানে বেঁধে রেখেছো৷ আমার বাবা জানতে পারলে তোমাকে এখানেই জ্যান্ত পুতে দেবে৷”
“ওহ আচ্ছা।কিন্তু তোমার বাবা জানবেই বা কি করে?”
নুজাইশ রেগে ছিলো সেই অনেক্ষণ যাবৎ। কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে। যখন থেকে জেনেছে এই আরিয়াই সেদিন রাউশিকে এক্সিডেন্ট করিয়েছে তখন থেকে খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রাখছে, দমিয়ে রাখছে। নুজাইশ দাতে দাত চেপে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আগে এটা বলো রাউশিকে এক্সিডেন্ট কেন করালে?”
আরিয়া কপাল কুঁচকালো। সাথে কিছুটা ভয়ের আভাস দেখা দিলো তার মাঝে। চোখ লুকাতে লাগলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“কি বকছো তোমরা?আমি কিন্তু চেঁচাবো।”
তুষার হেসে বলল,
“চেঁচালেও লাভ নেই মিস.। এখানে কেউই আপনাকে বাঁচাতে আসবে না। তবে হ্যা মারতে আসবে। ভয়ানক সব হিংস্র প্রাণীরা।”
পিলে চমকে উঠলো আরিয়ার৷ মেহরানের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করে বলল,
“দেখো মেহরান। আমায় ছেড়ে দাও। এতে তোমারই ভালো হবে।”
মেহরান উঠে দাঁড়ালো। ধীরপায়ে হেঁটে আরিয়ার পেছনে গেলো। আর বলতে লাগলো,
“আজ তোমার এক পা কেঁটে ফেলা হবে। কেমন হবে বলোতো আরিয়া?”
আরিয়া যেন আরও বেশি ভয় পেলো। এবার কান্না করার উপক্রম হয়ে গেলো তার। এখানে তিন তিনটে যুবক আছে। এদের সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না। আরিয়া একপ্রকার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“দেখো মেহরান তুমি এমনটা কিছুতেই করবে না। আমি তো, আমি তো ওই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারি না বলেই মারতে চেয়েছি। ওই মেয়েটা নাকি তোমার স্ত্রী।আমার থেকে সুন্দর নয়। তুমি কিভাবে ওই মেয়েকে বিয়ে করতে পারো? এইজন্য রেগেই ভুলবশত_”
“ভুলবশত মেরে দিতে চেয়েছিলে তাই তো?”
“হ্যা।”
আরিয়ার এসব কথাবার্তা শুনে নুজাইশ ভীষণ রকমের রেগে গেলো। আরিয়াকে চড় মারতে যাবে তার আগেই মেহরান থামিয়ে দিলো। তুষারকে বলল,
“নুজাইশকে নিয়ে যা।”
তুষার নুজাইশকে ধরলো। নুজাইশ যাওয়ার আগে আরিয়াকে বলল,
“মেহরান জ্যান্ত ছেড়ে দিলেও আমার হতে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত আরিয়া।”
আরিয়া এদের এসব ভয়ানক সব কথাবার্তায় তার প্রান যায় যায় অবস্থা। কলিজা হাতে নিয়ে বসে আছে আপাতত। না জানি এরা তাকে কিভাবে কি করবে? খারাপ কিছু করবে না তো আবার? এসব ভাবতেই তার নারী সত্ত্বা কিছুটা থমকালো। নুজাইশ আর তুষার বেরিয়ে গেলো। মেহরান আবারও আরিয়ার সামনে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“দেখো আরিয়া, তুমি কি করেছো তো জানো! এখন বলো তোমার শাস্তি কি দেওয়া যায়?”
“আমায় ক্ষমা করো মেহরান৷ আমি আর এমনটা কখনোই করবো না। তোমাদের দিকে নিজের ছায়াও মারাবো না। তোমাদের, তোমাদের কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি মেহরান।”
মেহরান হাসলো,
“ছায়া যতদিন থাকবে তোমার ততদিন ঠিকই আমাদের পিছু মারাবে। সেই ছায়া কিভাবে স্থির রাখতে হয় সেটা আমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে আরিয়া।”
মেহরান ‘ভেতরে আসুন’ বলতেই দুজন নার্স ভেতরে আসলো। একদম আরিয়ার সামনে এসে আরিয়াকে কিছু একটা ইনজেকশন পুশ করা হলো। আরিয়া শুধু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছটফট করলো। সাথে কান্নাও জুড়ে দিলো। মেহরান উঠে দাঁড়ালো। এবার খুবই সিরিয়াস আর গম্ভীর ভাবে বলল,
“অবশ্যই তুমি আমার দৃষ্টিকোণে সবচেয়ে বড় অপরাধী, কারণ তুমি আমার জানে আঘাত করেছো। এর জন্য তোমার শাস্তি প্রাপ্য ছিলো। না আমি তোমাকে মৃত্যু দেবো না তবে তোমার মস্তিষ্কসহ তোমাকে অচল করে দেবো। এই তুমি আর কাউকে ক্ষতি করার কথা ভাবতে পারবে না।”
আরিয়ার শরীরে স্লো পয়েজনিং এর ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। মেহরান বলে রেখেছে আরিয়াকে এখানে পুরো একমাস যাবৎ বন্দি রেখে প্রতিটা সময় স্লো পয়েজনিং এর ইনজেকশন যাতে দেওয়া হয়। কারণ এই মেয়েকে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় তবে এতে করে এ আবারও ভবিষ্যতে কারও না কারও ক্ষতি করবে। যেভাবে সেদিন লোক লাগিয়ে রাউশিকে ট্রাকের নিচে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। অবশ্য খানিক সফল হয়েছেও। রাউশির পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে সারাজীবনের জন্য। রাউশি এখনও খুড়িয়ে খুড়িয়েই হাঁটে। মেহরান নিজ হাতে মারতে পারতো। তবে তার বাবা মায়ের বুক খালি করে দিতে চায় না মেহরান। থাকুক আরিয়া বেঁচে তবে বেঁচে থেকেও যাতে মনে হয় সে বেঁচে নেই।
মেহরান বাইরে বের হতেই নুজাইশকে দেয়ালে ঠেসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তুষার এগিয়ে এসে বলল,
“এই মেয়ের বাপ তো সারা শহরে লোক লাগিয়ে দেবে মেয়েকে খোঁজার জন্য। তখন কি করবো?”
“ওর বাড়িতে বলা হয়েছে একমাসের জন্য বিজনেস ট্রিপে দেশের বাইরে গিয়েছে। সমস্যা হবে না।”
নুজাইশ খুব শান্ত আওয়াজে কথাটা বললো। তুষার হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো।
মিলির ব্যাপারে সকালে নুজাইশকে বলেছিলেন নুজাইশের মা তবে নুজাইশ সরাসরি না করে দিয়েছে। মাকে আর বাবাকে শুধু একটা কথাই বলেছে নুজাইশ,
“আমি এমন কিছুতে আটকে গেছি যেখান থেকে বের হতে পারছি না। আর না বের হতে চায়। এমন একজন নিষিদ্ধ নারীর মায়ায় আটকেছি যে আমার কাছে দূরদর্শিনী নামেই পরিচিত। তাকে দেখা যাবে শুধু তবে ভালোবাসা পাপ। তাকে ছোয়া যাবে না। এই আক্ষেপ আর সুখ নিয়েই আমি আমার এই জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। তোমরা আর আমায় জোর করবে না মা বাবা।”
কথাটা বলেই নুজাইশ বেরিয়ে গিয়েছিলো। রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে এসব ভাবলো। রাস্তার ওপরপাশে মিলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো নুজাইশ। মেহরান পাশের সিটে বসে মোবাইল টিপছে। পেছনে তুষার মিলি,রাউশিদেরই ফ্রেন্ড রুনার সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। ছেলেটা একটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে। এ নিয়ে বন্ধুমহলে কতশত হাসি ঠাট্টা হলো।
নুজাইশ আবারও মিলির দিকে তাকালো। তার থেকে কিছুটা দূরে বৃষ্টির ওপর চোখ গেলো।নুজাইশের মনে পড়লো এই বৃষ্টির কথা। এই মেয়ে আগের তুলনায় বেশ মোটাসোটা হয়েছে। আগে তো রুগ্ন ছিলো। এখন আগের তুলনায় ভালোই হয়েছে। অনেকদিন পর মিলি, বৃষ্টি দুজনের দেখা পেলো তাও একই জায়গায়। তারা দুজন দুজনকে না চিনলেও নুজাইশ তাদের দুজনকেই চেনে। দুজনই তার জীবনের কিছুদিনের আগন্তুক। নুজাইশ নিজের ভাবনাতে নিজেই ভড়কালো। এসব কি ভাবছে সে৷ গাড়ি চালানোতে মন দিলো নুজাইশ। এখন সোজা খান বাড়িতে যাবে তিনজন।
খান বাড়িতে পৌঁছালো তিনজনে। বাইরে জবা ফুলের গাছটার নিচে পাতানো বেতের সোফার ওপরে বসে রাউশি, নাহিন, মাইশা, তানিয়া মিলে লুডু খেলছিলো। গাড়ি থেকে সবাই নেমে পড়লো।মেহরান হেঁটে সামনে রাউশিদের দিকে এগিয়ে গেলো।
এদিকে রাউশিরা গাড়ির আওয়াজ শুনলেও খুব একটা মন দেয় নি। কারণ খেলায় এখন টান টান উত্তেজনা চলছিলো। মেহরান গিয়ে রাউশির পেছনে দাঁড়ালো। রাউশি খেয়াল করে নি। তবে বাকিরা খেয়াল করলো। তবে খুব একটা পাত্তা দিলো না। কারণ খেলায় মত্ত তারা। শেষে রাউশি নাহিনের সাথে পারলো না। তবে দ্বিতীয় হয়েছে।
নুজাইশও আসলো তখন। নাহিন চেঁচাচ্ছে। ‘আমি জিতেছি, আমি জিতেছি’ বলে। রাউশি ধমকালো নাহিনকে,
“ভেড়ার মতো ভ্যা ভ্যা করিস না।”
“দেখো মেহরান ভাই। তোমার বউ আমায় হিংসে করছে।”
রাউশির খেয়ালে আসলো মেহরানকে। পেছনে ঘুরে মেহরানকে দেখলো। এদিকে নুজাইশ এগিয়ে আসতেই মাইশা নুজাইশকে দেখে একদম শকড। সে তো নুজাইশের ওপরে ক্রাশড।
রাউশিও নুজাইশের দিকে তাকালো। সালাম জানিয়ে বলল,
“কেমন আছেন নুজাইশ?”
নুজাইশকে নাম ধরে ডাকতে দেখে মাইশা বলল,
“কি বলছো রাউশি আপু? উনি তোমার স্যার? নাম ধরে ডাকছো যে?”
রাউশি হাসলো। নুজাইশই উত্তর করলো,
“আমিই বলেছি তাকে।”
তুষার নুজাইশের দিকে তাকালো। মাথা নিচে নামিয়ে একটা হাসি দিলো তুষার। নুজাইশের এই ভালোবাসার বিষয়ে মেহরান বাদে তুষারও জানে। নুজাইশ যে তার বন্ধু এ নিয়ে মাঝে মাঝে তুষার গর্ববোধ করে। এই ছেলে কিভাবে চোখের সামনে বন্ধু আর প্রিয়তমাকে একসাথে দেখতে পারে। এটাই ভাবে তুষার। কতটা সাহস আর কঠিন হলে এটা পারা যায়!
মেহরান রাউশির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“চল রাউশি।”
রাউশি পেছনে তাকিয়ে মেহরানকে বলল,
“কোথায়?”
তুষার উত্তর করলো,
“আরেহ রাউশি গিয়ে তো দেখো। চলো সবাই চলো।”
মেহেরজান পর্ব ৩৯
রাউশি বুঝতে পারলো না কোথায় নিয়ে যেতে চাই এরা তাকে। মেহরান রাউশির হাত ধরে রাউশির সে অবস্থাতেই গাড়ির কাছে নিয়ে গেলো। রাউশি শাড়ি বদলে লাল টকটকে একটি জামা পরিহিত ছিলো। গাড়ির কাছে এসে মেহরান নুজাইশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোরা আয়। বাকিদেরও নিয়ে আসিস।”