মেহেরজান ২ পর্ব ৩

মেহেরজান ২ পর্ব ৩
লেখনীতে- সোহামণি

মেহরান খান শুনতেই রাউশির বুক কেঁপে উঠলো। এই লোক তার নাম্বার পেলো কোথায়? রাউশি কল কেটে দিতে যাবে এমন সময় শুনতে পেলো ওপাশ থেকে মেহরান বলছে,
“খবরদার রাউশি। কল কেটে দিলে আমি তোমার বাড়িতে চলে আসবো।”
রাউশির রাগ লাগলো। মনে মনে বলল,“শালা তুই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? আয় না তোর ঠ্যাং জেটে রেখে দেবো।“
তবে মুখে বলল,

“যে কারণে কল করেছেন সেটা তাড়াতাড়ি বলুন আর কল কেটে দিন।”
মেহরান ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
“আমার সময় খুব কম। ফিরে যেতে হবে।
তাই বাবা মাকে বলে আর আঙ্কেল আন্টিকে বলে বিয়ের ডেট-টা আগিয়েছি। আগামী শুক্রবার বিয়ে। জানো কিনা তার জন্যই কল করলাম।”
রাউশি মাথা কোনো দাহ্য পদার্থ ছাড়াই দাও দাও করে উঠলো। দাতে দাত পিষে বলল,
“আমি তোকে বিয়ে করবো না মানে করবো না। দেখি বিয়েটা হয় কিভাবে?”
খট করে কল কেটে দিলো রাউশি। মাথার চুল ধরে টানতে লাগলো। আর চেঁচিয়ে বলা শুরু করলো,
“ শালা বদ লোক, তোরে এই জন্মেও বিয়ে হবে না। আমারে বিয়ে করার শখ মেটাবো দাঁড়া।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদিকে মেহরান হেসে দিলো রাউশির কথা শুনে। মেয়েটাকে সে প্রথম দেখেছিলো বছর দুয়েক আগে। পারিবারিক বন্ধুত্বের সম্পর্কের কারণ দুই পরিবারের মাঝেই রাউশি মেহরানের বিয়ের কথা গোপনে চলে আসছিলো বেশ অনেক দিন আগে থেকেই। রাউশি এসব বিষয়ে না জানলেও মেহরান জানে। নিজের সেনাবাহিনী পেশার কারণে ঢাকাতে খুব একটা থাকা হয় না। বছরে যে কদিন ছুটি থাকে বা ছুটি নিয়ে আসে তখন বাড়িতে এসে বাবা মায়ের পর সর্বপ্রথম রাউশিকে দেখতেই বেরিয়ে পড়ে। রাউশি মেয়েটা বোকা। ও এসব কিছু বোঝে না। অবশ্য এর একটা কারণও আছে। মেহরান হেসে উঠলো আবারও।

“ কি নিয়ে এতো হাসছিস ভাই?”
উজান কথাগুলো বলতে বলতে মেহরানের রুমের ভেতরে এলো।
“ কিছু না।”
বলে মেহরান নিজের মুখায়ব গম্ভীর করলো।
উজান জোরে হেসে বলল,
“বিয়ের বাতাস লেগেছে তোমার মাঝে।”
মেহরান ভ্রু উঁচিয়ে চাইলো,
“ তোর কাজ নেই?
সারাদিন আমার ঘরে করিসটা কি তুই?”
“ তোমার হাসির আওয়াজ শুনেই আসি।”
“ আমি কি সারাদিনই হাসি নাকি যে সারাদিনই আসিস তুই?”
উজান ব্যাঙ্গ করে বলল,

“মুখে হাসো না। তবে রাউশির ছবি দেখে দেখে মনে যে পরিমাণ লাড্ডু ফাটাও তা আমি একশো মাইল দূর থেকেও শুনতে পায়।”
মেহরান বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকালো,
“তুই এখান থেকে যা।”
উজান এদিক ওদিক উঁকি মারলো,
“ চাবিটা দে না ভাই!”
“কি করবি?”
লজ্জামাখা মুখ নিয়ে উজান বলে,
“জানিসই তো এই সময়ে কোথায় যাই আমি।”
মেহরান প্যান্টের পকেট থেকে চাবিটা উজানের দিকে ছুড়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। উজান ক্যাচ ধরলো চাবিটা। উদ্দেশ্য এখন বিপাশা।

রাউশি মেজাজ খারাপ নিয়ে কাউকে একটা মেসেজ করলো। মেসেজে লিখলো,
“ আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আর তুমি বসে বসে ঘাস কাটছো?”
মেসেজটা সিন হওয়ার অপেক্ষা করলো। কিছুক্ষণ পর রিপ্লায় এলো,
“ পালিয়ে এসো।”
রাউশি কিছুক্ষণ ভাবলো। এ ছাড়া আর উপায়ও নেই। তবুও টাইপ করলো,
“এক বার কল করো।”
“আমি ব্যস্ত আছি রাউশি।”
রিপ্লাইটা দেখেই আবারও মাথা গরম হলো। এই লোককে কল দিতে বললেই সব ব্যস্ততা এসে যায়। রাউশি একটা বিশ্রি গালি দিতে চেয়েও দিলো না। বরং রিপ্লাই করলো,
“ওই ব্যস্ততা নিয়েও থাকো। আমাকে আর কল করতে হবে না কোনোদিন।”

রাউশি ফোনটা ছুড়ে মারলো বিছানার ওপর। মানুষটার নাম আনাফ। সবে তিনমাস হলো রিলেশনে গিয়েছে। মানুষটার সাথে সামনাসামনি একবারও দেখা না হলেও ভয়েস কলে কথা হয়েছে কয়েকবার। দুজনেই দুজনকে ভালোবাসে অনেক। আর এমন কিছু নিয়ে রাউশি মেহরানকে বিয়ে করবে কিভাবে? অসম্ভব। রাউশি হাসফাস করতে লাগল। কি দিন এলো তার?

সবে বের হলো বাসা থেকে। এমন সময় একটা বাইক খুব স্পিডে এসে থামলো তার সামনে। ইউসুফ ইশারা করলো বাইকে ওঠার। রাউশিও উঠে বসলো। ইউসুফ বাইক স্টার্ট দিলো। রাউশি খুব চিন্তিত স্বরে বলল,
“গতকাল মেহরান মেসেজ দিয়েছে।”
ইউসুফ অবাক হলো,
“কি বললো?”
“কল কেটে দিয়েছি।”
ইউসুফ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর বলল,
“তোর বিয়ে করে নেওয়া উচিত রাউশি।”
“তুই চুপ থাক।”

ভার্সিটি গেইটের সামনে পৌঁছাতেই কেউ একজন থামিয়ে দিলো রাউশিদের। ইউসুফও সতর্কতায় ব্রেক কষে। কালো চশমা পরিহিত হাসিব, চশমাটা খুলে এক চোখ টিপ মেরে প্রস্ফুটিত আওয়াজে বলে,
“বাইক জার্নি নিশ্চয় শুভকর হয়েছে মৌরিন রাউশি এবং আবরাম ইউসুফ?”
রাউশি বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো। চোখ গেলো রাস্তার অপরপাশে যেদিক হতে মিলি হাত নাড়াচ্ছে, তার জন্য ওয়েট করার। হাসিবের কথায় রাউশি মিলির দিকে তাকিয়েই ব্যাঙ্গ করে উত্তর করলো,
“আরও শুভকর হতো যদি না তুই এই মুহুর্তে বাঁধা দিতি।”
খুব জোরে জোরে হাসলো হাসিব। রাস্তায় হেঁটে চলা পথচারীরাসহ ভার্সিটির ফটক পেরিয়ে ঢুকতে যাওয়া সিনিয়র জুনিয়র অনেকেই তাকালো রাউশিদের দিকে। লজ্জায় আর অস্বস্তিতে রাউশি হাসিবের পায়ে নিজের পা দ্বারা বড়সড় একটা আঘাত করলো।

ইউসুফও ততক্ষণে নেমে গিয়েছিলো। হাসিবের অবস্থা বুঝে হাসিবের মুখ চেপে ধরে যাতে চিৎকার করতে না পারে। কিছু পথচারী আর শিক্ষার্থী আর তেমন গুরুত্ব না দিলেও কিছুজন এমন এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে যেন রাউশিরা কোনো জেল পলাতক আসামী। মিলি এগিয়ে এলো তাদের দিকে। রাউশির কাঁধে হাত রেখে বারকয়েক হাপালো। ইউসুফকে এভাবে হাসিবের মুখ চেপে রাখতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
“আরে আরে করছিস–টা কি? মরে যাবে তো।”
“মরুক। ও মরলে চল্লিশা খেতে পারবো।”
ইউসুফ ওভাবেই হাসিবের মুখ চেপে ধরে উত্তর করলো।
চটজলদি হাসিব ইউসুফের পেটে নিজের কনুই দ্বারা আঘাত করলো। ইউসুফ ‘উফফ’ বলে ছেড়ে বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিলো হাসিবকে। হাসিব বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলল,
“এখনই তো মেরে ফেলতি।”

রাউশি হাসিবের কথা শুনে হাসিবের মাথায় গাট্টা মেরে মিলিকে নিয়ে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“সমস্যা কোথায়? ইউসুফের বাপ আস্ত একজন ডাক্তার।”
রাউশিদের পিছু পিছু হাসিব, ইউসুফ দুজনেই হাঁটা ধরলো। ভার্সিটির বিশাল ফটক পেরিয়ে তাদের দৈনন্দিন আড্ডার স্থল কৃষ্ণচূড়া গাছটির ধারে চলে গেলো। কৃষ্ণচূড়া গাছটিকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে একটি ইটে বাঁধানো বেঞ্চ। ওখানে বসেই অপেক্ষা করছিলো তাদের অন্যজন বন্ধু শ্রুতি। বন্ধুদের আসতে দেখে সড়ে বসে জায়গা দিলো। একে একে সবাই বসে পড়লো সেখানে। মেদুর রোদ্দুরের নিচে কৃষ্ণচূড়া গাছটা তার শীতল ছায়া দেয়। এজন্যই হয়তো এই বন্ধুমহল, এই স্থানটিকে সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দেয়।
“আমাদের রাজশাহী ট্যুরের সমস্ত এরেঞ্জমেন্ট হয়ে গেলেও, ওখানে গিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরবো তার পরিকল্পনাগুলো এখন সাজানো হোক গোছালোভাবে।”
ইউসুফ খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাটা বলে উঠলো।
বাকিরাও একে একে সায় জানালো। রাউশি কিছু বলতে যাবে তখনই সেখানে রুনা আর নাঈমের উপস্থিতি ঘটে। রুনা এসে ইউসুফকে বলে,

“অবশ্যই আমরা অনেক জায়গায় ঘুরবো।”
“ঘুরবো তো ঘুরবোই তবে জায়গার নাম না জেনে যাবো–টা কোথায়?”
শ্রুতির কথায় বিরক্ত হলো রুনা। মুখায়বে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে বলল,
“আমরা কি কচি খোকা–খুকি? যে জায়গার নাম জানবো না। আগে রাজশাহী তো যেয়ে নিই। নাঈম ছেলে হয়েও ওর ডেঞ্জারাস বাপ মেনে নিচ্ছেন না।”
শ্রুতি ব্যঙ্গ করে বলল,
“ও কি রাজশাহী বিয়ে করতে যাচ্ছে নাকি? যে মেনে নিচ্ছেন না আঙ্কেল?”
ছোটখাটো হাসির রোল পড়ে গেলো মুহুর্তের মাঝেই। সেদিক দিয়েই ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ভয়ানক অধ্যাপক নাজমুল হাসান যাচ্ছিলেন। এভাবে এদের হাসতে দেখে ভাবলেন উনাকে নিয়ে হাসছে। এগিয়ে এসে ধমকে বললেন,
“নির্লজ্জ কোথাকার! স্যারদের দেখলে দাঁড়িয়ে সালাম দিতে হয়। সম্মান করতে হয় আর তোমরা…”
বাকি কথা বলার আগেই সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে একযোগে বিনয়ী স্বরে সালাম দিলো রাউশিরা। এতে যেন নাজমুল স্যার আরও ক্ষেপে গেলেন। আবারও ধমকে বললেন,

“চুপ করো। নাটকীয় ভক্তি দেখাতে আসবে না। শিক্ষকদের দেখলেই হাসি পায় আজকাল তোমাদের। এই স্বভাব পরিবর্তন করো নয়তো আমি ডিপার্টমেন্ট হেড এর কাছে কমপ্লেইন করবো।”
সবাই চমকে গেলো। তারা আবার উনাকে দেখে কখন হেসেছে? হাসিব হুট করেই বলে ফেলল,
“স্যার আমরা তো আপনাকে দেখে হাসি নি। দেখেন নি আমাদের হাসি সাবলীল ছিলো। আর আমরা তো আপনাকে দেখলে এর থেকেও বেশি জোরে জোরে হাসি।”
হাসিবের কথায় সবাই আবারও হেসে ফেললো মুখ টিপে। রাউশি স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে জানে এই স্যার তাদের অপছন্দ করে। সবসময়ই বড়লোকের রাজকুমার, রাজকুমারী বলে নানা রকম কটু কথা শোনান ক্লাসে। কটাক্ষ করে নানা কথা বলেন।
এদিকে আরও বেশি রেগে গেলেন নাজমুল হাসান। হাসিবকে ধমকে বললেন,

“চুপ করো বেয়াদব। সবার মধ্যে তুমিই বেশি ফাজিল ছেলে। শিক্ষার অভাব হলে যা হয়।”
এটা বলেই চলে গেলেন নাজমুল হাসান। নাজমুল হাসানের কথা গায়েও মাখলো না কেউ এমনকি হাসিব নিজেও। কারণ এই খাটাশ ব্যাটা তাদের প্রতিটি কাজে খুঁত ধরতেই থাকেন। ভালো কাজেও খুঁত ধরবেন, খারাপ কাজে তো কথাই নেই।
নাজমুল হাসানকে নিয়ে আবারও ছোটখাটো একটা সমালোচনা শুরু হলো। রাউশি তাদের থামিয়ে বলল,

মেহেরজান ২ পর্ব ২

“বাদ দে। চল ক্লাসে যাওয়া যাক।”
হাসিব বাঁধা দিয়ে বলল,
“যাস না রাউশি। এখন ওই খাটাশটারই ক্লাস।”
রাউশি শুনলো না। চলে গেলো।

মেহেরজান ২ পর্ব ৪